।। নীলদীপ চক্রবর্তী।।
ফুলিয়া নোংরা কাপড় আর
বিস্তর আবর্জনার স্তূপটিকে কোলবালিশের মতো জড়িয়ে ডুবে যায় নিশ্চিন্ত ঘুমের কোলে। সঙ্গে সঙ্গেই মহাকাশের কোন অচিন প্রান্ত
থেকে উল্কাপাতের মতো নেমে আসে পেলব স্বপ্ন। স্বেচ্ছাচারীর
মতো দশ বছরের মেয়েটির বিস্মিত অন্দরমহলের আনাচে কানাচে অবলীলায় ছড়িয়ে পড়ে। ফুলিয়ার মনে আছে মাকে, মনে
আছে ধবধবে সাদা পোশাকের ভারী বুটের ছায়ামূর্তির এক উন্নাসিক গতিতে ওর মায়ের
শরীরটাকে ব্রিজের ঢালু খাদ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া! মায়ের বছর দেড়েকের অন্য
শিশুটির তীক্ষ্ণ ধাতব চিৎকার এখনো ফুলিয়ার স্বপ্ন বিলাসে সুর-সংগত করে! ও দেখেছে এই
কান্নার শব্দে ওর মা নিজের বুকের একাংশ উন্মুক্ত করে শিশুটিকে চেপে ধরতো বুকের
সাথে, আর দুচোখ বুজে শিশুটি টেনে নিতে থাকত বিশ্বাস আর
নির্ভরতা। মাকে এরপর ও
আর দেখেনি। ভাইটিকেও না!
ধপ করে
ডাস্টবিন থেকে আসে শব্দটা। শনি
মন্দিরের বাইরে বিশাল লাইনে গরম খিচুড়ি...এখুনি বহুদিনের পুষে রাখা খিদেটা...আর
তখনি শব্দটা ঘুম ভাঙ্গায় ফুলিয়ার। আধ-তন্দ্রায়
আর দাঁতের ফাকে চাপা আঠার তীব্র-গন্ধ রুমালে জড়িত নির্জীব নেশায় চোখ মেলে কিশোরী!
ব্রিজের নিয়ন আলোয় ঝাঁ চকচকে গাড়িটিতে উঠতে থাকা দুটি অপস্রিয়মাণ মানব মানবী! মুখ
চেহারা কিছুই ঠাহর হয় না। মুখ মুখোশ ও
অন্ধকার, সব কেমন মিলে মিশে একাকার হয়ে যেতে থাকে!
সেই ধাতব চিৎকার! সেই নির্ভরতা খোঁজার আর্তি, ফুলিয়াকে উদ্বেলিত করে
তোলে। টেনেটুনে
টলমলে শরীরটা ডাস্টবিন পর্যন্ত নিয়ে যায়। কাপড়ে জড়ান
ছোট্ট নড়বড়ে পুটলি। ভেতর থেকেই
পৃথিবীর যাবতীয় ক্রূরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নিয়ে বেরুচ্ছে সুতীক্ষ্ণ চিৎকারটা! ততক্ষণে
গাড়িটাও নিকষ অন্ধকারে নিজেকে লুকিয়ে ফেলেছে। কাঁপা হাতে পুটলিটা টেনে নেয় ও, কাপড়
সরিয়ে বের করে আনে সুতীব্র শব্দময় এক উষ্ণ মানুষী। বিহ্বল-কোলে বসে পরে সেই শিশুকে নিয়ে। কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবে ফুলিয়া। সেই ভাবনায় মনে পরে মাকে, ভাইটিকেও!
সম্বিত ফেরে নেশাগ্রস্ত কিশোরীর, অদ্ভুত ক্ষিপ্রটায় নিজের
অনুন্নত বুককে অনাবৃত করে স্তনবৃন্তে করে চেপে ধরে কান্নারত শিশু-মুখটি! ঠিক সঙ্গে
সঙ্গেই মানুষের উত্তর-প্রজন্ম বিশ্বাস, নির্ভরতা আর জীবন
খুঁজে নেবার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে অবিরত!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন