“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ২৪ জুন, ২০২১

প্রতিস্থাপন

 
।। সাদিক মোহাম্মদ লস্কর ।।
 
 
 
 
 
 
জানি তুমি বটবৃক্ষের মতো
দুর্বল অথচ দৃঢ় পায়ে
আশ্রয় নিতে চাও এ গাঁয়ে।
ক্ষতি নেই লাগে আপাতত।
তার পর তুমি ধীরে ধীরে
নিজেই় হয়ে ওঠো আশ্রয়,
সুজন কুজনের আলয়
মুখরিত কূজনের ভিড়ে।
আর ততক্ষণে আমি শেষ
আমি নিঃশেষ হয়েই যাই,
তোমার ফুলে ফলে চারায়
থাকে না আমার অবশেষ।
23/6/21
6:30 am

শনিবার, ১৯ জুন, ২০২১

প্রাক্তন...

 

                                                      ।। শৈলেন দাস ।।

(C)Imageঃছবি

একে তো করোনা সংক্রমণের ভয় অন্যদিকে ভাদ্র মাসের প্রখর রৌদ্র শরীর নিংড়ে ঘাম বের করে নিচ্ছে। সরকারী দায়িত্ব পালনের হ্যাপা, ভয় ও বিরক্তি সত্ত্বেও বহুতল বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছি। সবাইকে বলতে হবে র‍্যাপিড এন্টিজেন টেস্ট করিয়ে নিতে, সাথে সর্দি কাশি জ্বর ইত্যাদির তথ্য সংগ্রহ করা। আমার সঙ্গে রয়েছে দুজন সহযোগী, আশাকর্মী নীলম'দি এবং  অঙ্গনওয়াড়ি ওয়ার্কার পূর্ণিমা।

দোতলায় একটি ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল টিপতেই সাড়া মিলল। দরজা খুলে মুখ বাড়াল একজন অল্প বয়সী মহিলা। অসহ্য গরমের জন্য অন্তর্বাসহীন ঘরোয়া পোশাক পড়ে রয়েছে সম্ভবত তাই সসংকোচে ডান হাতে তার বুক আড়াল করা। আমার সহযোগী নীলম'দি বলল, “আমরা হেলথ থেকে এসেছি। আপনাদের পরিবারের বিষয়ে তথ্য জানতে চাই।মুখে মাস্ক লাগানো থাকায় আমার ম্লান হাসি সে দেখতে পায়নি তবে চোখের ভাষা যে অন্যরকম ছিল সেটা ওর চোখ এড়ায়নি। সম্ভবত সে কারণেই আমি কিছু বলতে যাব, এমনি থামিয়ে দিয়ে বলল- এটা আমার বাবার বাড়ি, আমি মাকে ডাকছি বলেই সে ভিতরে চলে গেল। অচেনা পুরুষের সামনে এমন পোশাকে দাঁড়িয়ে কথা বলা সমীচীন নয়। তাই বোধ হয় চলে গেছে।

আমার মনে অস্থিরতা, এত দিন পর দেখা হল অথচ সে আমাকে চিনলই না! বিজ্ঞানের মতে, কিছু নির্দিষ্ট স্বর আমাদের হৃৎস্পন্দনকে বাড়িয়ে তোলে। তাই আমি মুখ থেকে মাস্ক সরিয়ে তার মায়ের সাথে কথা বলতে শুরু করলাম এমনভাবে যাতে সে ভেতর থেকে শুনতে পায়। কাজ হয়েছে, দরজার আড়াল থেকে মায়ের কাছে এসে দাঁড়াল সে। সব রকমের সংকোচ এখন গৌণ। সে কথা বলতে শুরু করল আমার সাথে। করোনা উপসর্গের তথ্য দেওয়ার ছলে জানিয়ে দিল তার স্বামী একজন ফ্রন্টলাইন করোনা ওয়ারিয়র। এই শহরেরই প্রাণকেন্দ্রে একটি ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকে ওরা। দুই সন্তানের সুরক্ষার কথা ভেবেই এখন বাবার বাড়িতে চলে আসা। দায়িত্ব পালনে আমাদের টিমের অসুবিধা হচ্ছে কিনা জানতে চেয়ে সে কৌশলে জেনে নিল আমার ডিপার্টমেন্ট। নিজের সুখী জীবনের গল্পের সাথে মিলিয়ে নিল আমার জীবনের ব্যর্থতা! অথচ  একবারও মনে হয়নি সে আমরা প্রাক্তন প্রেমিকা।

যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ শেষ হলে পূর্ণিমা বলল- স্যার, চলুন যাই। ঘরে থাকবেন, সুস্থ থাকবেন এইটুকু বলেই অন্যমনস্কের মত আমি সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে শুরু করলাম। ওরা বলল- স্যার, বাকি ঘরগুলোতে যাবেন না?” আমার কেমন যেন ক্লান্তি লাগছে, বললাম- আজ আর কোন ঘরে যাওয়া হবেনা।”

কোনরকম ভূমিকা ছাড়াই নিজের বিষয়ে এত কিছু বলে ফেলা, পরোক্ষে আমার বিষয়ে জেনে নেওয়া সর্বোপরি অস্বস্তিকর পোশাকে নির্লিপ্তভাবে আমার সামনে দাঁড়িয়ে তার কথা বলে যাওয়া কিন্তু খেয়াল করেছে আমার সহযোগীরা। কয়েকটা সিঁড়ি নীচে নামতেই ওরা  উৎসুক হয়ে জানতে চাইল ব্যাপারটা কী? আমি কিছু বলিনি শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্রুত নীচে নামতে লাগলাম।

            ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছি আমরা। সূর্যের প্রখরতা এখন কিছুটা ম্লান। কোথা থেকে যেন এক খণ্ড মেঘ এসে ঢেকে দিয়েছে তাকে। ব্যালকনি থেকে কাঁপা গলায় ডেকে বলল সে- সাবধানে থেকো সতীশ, খেয়াল রেখো নিজের।চোখের কোণে জলও জমে ছিল হয়ত। আমি আর পিছন ফিরে তাকালাম না।

 

শুক্রবার, ১৮ জুন, ২০২১

অন্তর্বাস

                                                   ।। শৈলেন দাস ।।

(C)IMAGEঃছবি

তা
কে অবিনাশ
'দা বলেই ডাকে চৈতালি আর  অবিনাশ নাম ধরে ডাকে  চৈতালিকে। শহরের মাঝামাঝি এলাকায় থাকা সত্ত্বেও অবিনাশের একতলা এই বাড়িটা কেমন যেন অগোছালো ছিল এতদিন। ভাড়াটে হিসাবে চৈতালিরা আসার পর থেকে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। চৈতালির নূপুরের রিনিঝিনি যেন মাতিয়ে রেখেছে পুরো বাড়িটাকে।

 চৈতালির চোখ দুটো অপূর্ব, নেশায় ভরা একদম! ছিম-ছাম শরীরের চঞ্চলতা চোখে পড়ার মত। গায়ের রং দুধে আলতা বললে মোটেও ভুল হবেনা। যেদিন প্রথম ধ্রুব চিতলিকে বাড়িটি দেখাতে এনেছিল, তাকে দেখে পুরনো স্মৃতিতে হারিয়ে গিয়েছিল অবিনাশ। বেশ কিছু বছর পর নতুন করে নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হয়েছিল তার। নিজের ব্যক্তিগত অতীতের তিক্ত দিনগুলির কথা কোনোদিনও সেভাবে মাথায় আনেনি অবিনাশ কিন্তু ইদানীং রাতে বিছানায়, সে ভীষণ গুমরে মরছে যেন নিজের মধ্যে।

 একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে তার স্কুল জীবনের সহপাঠী ধ্রুব। সাত সকালে বেরিয়ে সন্ধ্যের বেশ কিছুটা পর বাড়িতে ঢোকে, কখনও কখনও রাত হয়ে যায় ফিরতে। চৈতালি একা থাকবে ঘরে তাই বন্ধুর বাড়িতে ভাড়াটে হয়ে আসা। অবিনাশের কর্মস্থল বাড়ির অদূরেই একটি প্রাথমিক স্কুল। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রায়ই ছুটির কিছুটা আগেই বেরিয়ে পড়ে সে এবং সোজা চলে আসে বাড়িতে। তারপর আর কোথাও বের হয়না।

 কোন একদিন বিকেলে, কিছুতেই নিজের মনটাকে শান্ত করতে পারছিলনা অবিনাশ। অতীত স্মৃতি রোমন্থন করে খড়-কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছিল তার শূন্য মন। ঠিক বেঠিকের ঊর্ধ্বে উঠে নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলনা। তাই একটু হালকা বোধ করার জন্য ছাদে উঠে গেল সে। সেখানে দড়িতে মেলে দেওয়া চৈতালির শাড়ি বেসামাল হয়ে লুটিয়ে উড়ছে অনেকটা জায়গা নিয়ে। পাশেই ব্লাউজ এবং গোলাপি রঙের অন্তর্বাস ক্লিপ দিয়ে আটকানো। সসংকোচে ক্লিপ সরিয়ে অন্তর্বাসটি হাতে নিল অবিনাশ, বুক ভরে যেন ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করল কোন কিছুর। হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজে ছন্দপতন, অন্তর্বাসটি ছেড়ে ধড়ফড়িয়ে তাড়াতাড়ি  নীচে নেমে এল সে। অসাবধানতা বশত: ভুলেই গেল  ক্লিপ দিয়ে সেটি আটকানোর কথা।

 সন্ধ্যের দিকে, বারান্দায় আরাম কেদারায় বসে মোবাইল ঘাটাঘাটি করছে অবিনাশ, মনে চাপা উত্তেজনা। অন্তর্বাসে ক্লিপ না থাকার ব্যাপারটা চৈতালি সন্দেহ করেনি তো? নয়ত আজ এত দেরী  কেন? এতক্ষণ তো ওর চা নিয়ে আসার কথা।

 রিনিঝিনি নূপুরের শব্দ এগিয়ে আসছে!  উত্তেজনায় টান-টান হল অবিনাশের শরীর। অব্যক্ত অপরাধ বোধে নত তার চোখ। চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে সাবলীল মিষ্টি হাসল চৈতালি। কাঁপা হাতে সেটি কোনমতে নিল অবিনাশ। কিছুটা স্বস্তি বোধ করল সে।

 ফিরে যাচ্ছে চৈতালি। কিন্তু হঠাৎ হাঁটার গতি কিছুটা কমিয়ে নিল সে। ঘাড় ঘুরিয়ে চোখে চোখ রাখল অবিনাশের। এগিয়ে এসে কাঁপা গলায় বলল - আমাদের যে দিন গেছে, তা সত্যিই গেছে অবিনাশদা! অতীত কেন প্রতিবন্ধক হবে আগামীর পথে? মাথা নিচু করে রইল অবিনাশ। ব্যর্থতার গ্লানি দুচোখ বেয়ে নেমে আসছে ধীরে। নূপুরের রিনিঝিনি শব্দটা ক্রমশ মৃদু হতে হতে মিলিয়ে গেল খোলা বারান্দায়...।

 

বুধবার, ১৬ জুন, ২০২১

সীতা সাবিত্রী চন্দ্রাবতী অরবিন্দ

 ।। অর্পিতা আচার্য ।।

সৌজন্য www.rokomari.com

পৃথিবীর বেশিরভাগ এপিক লিখেছেন পুরুষেরা, পুরুষদের ঘিরে । সেসব এপিকে সাহসী মানুষটি পুরুষ, ভাগ্যতাড়িত মানুষটি পুরুষ, শোকগ্রস্ত, বিজয়ী বা পরাজিত মানুষটিও পুরুষ । সামান্য কয়েকটি এপিকই রয়েছে নারীকে ঘিরে। নবনীতা দেবসেন যখন চন্দ্রাবতীর রামায়ণ অনুবাদ করতে গেলেন ইংরেজিতে তিনি লিখলেন,“Out of the thirty-eight basic things upon which most epic narratives of the world are based only nine are associated with women."

মেয়েদের জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনাবলীতে এপিক হওয়ার মত উপাদান কি তবে নেই? মেয়েদের চোখ দিয়ে জগতকে দেখার মত পুরুষই হয়তো কম। প্রায় সব এপিকেই নারীর সম্মানের চাইতে সৌন্দর্য বড়। নারী শুধু বিজয়ের সামগ্রী, তাকে রক্ষা করতে পুরুষ যখন স্বর্গমর্ত্য রসাতল করেছেন, করেছেন যতটা তার জন্য, তার চাইতে নিজের মেল ইগো রক্ষার জন্য বেশি। যতই আমরা মেয়েদের লেখাকে মেয়েলি লেখা’’ বলে ছোট করি না কেন, পুরুষদের রচনাও হয়তো আসলে পুরুষালি। অর্ধেক পৃথিবীর খবর সেখানে অনুক্ত, অবহেলিত। 

শ্রী অরবিন্দের লেখা সাবিত্রীতে আমরা দেখেছি কিভাবে একজন পুরুষও পারেন নারীর মহিমান্বিত রূপটি নিয়ে এপিক লিখতে। সাবিত্রী সেখানে শুধুমাত্র সতীই নন, জ্ঞান অন্বেষণে সমুজ্জ্বল এক নারী, যে শুধু তার মেধা ও মননের শক্তিতে যমের মত জ্ঞানীকে প্রভাবিত করে স্বামীর জীবন ফিরিয়ে আনতে পারেন। ঘোচাতে পারেন শ্বশুরের অন্ধত্ব। এখানে এক নারীর জ্ঞানের আলো যেন প্রতীকী আয়ুধ হয়ে ওঠে, অন্য পুরুষদের মৃত্যু ও অন্ধত্বের বিপরীতে। সাধারণভাবে সাবিত্রীকে আমরা সতী বলেই জানি। চিরদিনই তার সতী রূপটিকে সবচেয়ে বেশি হাইলাইট করা হয়েছে। কিন্তু অরবিন্দের লেখা সাবিত্রী যেখানে সাবিত্রীকে সূর্যের কন্যা বলে সম্বোধন করা হয়েছে, সেখানে সাবিত্রীর উত্তরণ কিন্তু শুধু সতীত্বের নয়, ভালোবাসা ও জীবন যা পরমতম সত্য অভিলাষী, সেদিকেই তার যাত্রা।

 (C)www.amazon.in

চন্দ্রাবতী, বাংলার প্রথম মহিলা কবি বলে যাকে মনে করেন অনেকে, তার এপিক রামায়ণ আবর্তিত হয়েছে সীতাকে ঘিরে। ষোড়শ শতাব্দীর কবি চন্দ্রাবতী ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার পাতুয়ারী গ্রামে জন্ম নেন।

 

ধারাস্রোতে ধলেশ্বরী নদী বহি যায় 

বসতি যাদবানন্দ করেন তথায়

 ভট্টাচার্য্য বংশে জন্ম অঞ্জনা ঘরনী

 বাঁশের পাল্লায়  তালপাতার ছাউনি

 

(C)COVER IMAGE

এভাবেই নিজের জন্ম পরিচয় দিয়েছিলেন চন্দ্রাবতী। চন্দ্রাবতীর রামায়ণে আর এক সীতাকে আমরা দেখি, সতী তৈরির প্রচলিত রীতিকে বাদ দিয়ে যেখানে তাকে গড়া হয় রক্তমাংসের এক মেয়ে করে, যে আত্মসম্মান বোধের প্রবল ধীতে সমৃদ্ধ। চন্দ্রাবতীর রামায়ণ আজও বাংলার মেয়েদের নিজস্ব মনের কথায় গাঁথা রামায়ণ, যেখানে সীতা তার দুঃখ, বঞ্চনা, অবহেলা ও নীরব প্রতিবাদ নিয়ে একাত্ম হয়ে যান মেয়েদের সঙ্গে। কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত তাঁর সীতায়ণেযেন চন্দ্রাবতীরই উত্তরসূরি। 

সতীত্ব ও দৈহিক সৌন্দর্য ছাড়াও যে নারীর মেধা, ধী ও মননের, তার মানসিক সৌন্দর্যের গুরুত্ব রয়েছে , রয়েছে তার চিন্তা ইচ্ছা আর অনুসন্ধিৎসা, তা এই দুটি এপিকে আমরা দেখতে পেয়েছি। অরবিন্দ ও চন্দ্রাবতী এমন  নারীত্বের কথা বলেছেন যা নম্র, কমনীয়তা ও মানবী সৌন্দর্যে ভরপুর, সূক্ষ্ম ও মার্জিত... অথচ দৃঢ় ও সচেতন আত্মগরিমায় ভরপুর। যে নারী নারী হওয়ার জন্য গর্বিত, পুরুষের প্রশংসা লালায়িত নয় ।

এই সীতা সাবিত্রীর দেশে যেখানে পতিভক্তি প্রেমের চাইতে মুখ্য হয়ে ওঠে, সেখানে অরবিন্দ বা চন্দ্রাবতীর এপিক অবশ্যই ব্যতিক্রম।