“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ১৬ জুন, ২০২১

সীতা সাবিত্রী চন্দ্রাবতী অরবিন্দ

 ।। অর্পিতা আচার্য ।।

সৌজন্য www.rokomari.com

পৃথিবীর বেশিরভাগ এপিক লিখেছেন পুরুষেরা, পুরুষদের ঘিরে । সেসব এপিকে সাহসী মানুষটি পুরুষ, ভাগ্যতাড়িত মানুষটি পুরুষ, শোকগ্রস্ত, বিজয়ী বা পরাজিত মানুষটিও পুরুষ । সামান্য কয়েকটি এপিকই রয়েছে নারীকে ঘিরে। নবনীতা দেবসেন যখন চন্দ্রাবতীর রামায়ণ অনুবাদ করতে গেলেন ইংরেজিতে তিনি লিখলেন,“Out of the thirty-eight basic things upon which most epic narratives of the world are based only nine are associated with women."

মেয়েদের জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনাবলীতে এপিক হওয়ার মত উপাদান কি তবে নেই? মেয়েদের চোখ দিয়ে জগতকে দেখার মত পুরুষই হয়তো কম। প্রায় সব এপিকেই নারীর সম্মানের চাইতে সৌন্দর্য বড়। নারী শুধু বিজয়ের সামগ্রী, তাকে রক্ষা করতে পুরুষ যখন স্বর্গমর্ত্য রসাতল করেছেন, করেছেন যতটা তার জন্য, তার চাইতে নিজের মেল ইগো রক্ষার জন্য বেশি। যতই আমরা মেয়েদের লেখাকে মেয়েলি লেখা’’ বলে ছোট করি না কেন, পুরুষদের রচনাও হয়তো আসলে পুরুষালি। অর্ধেক পৃথিবীর খবর সেখানে অনুক্ত, অবহেলিত। 

শ্রী অরবিন্দের লেখা সাবিত্রীতে আমরা দেখেছি কিভাবে একজন পুরুষও পারেন নারীর মহিমান্বিত রূপটি নিয়ে এপিক লিখতে। সাবিত্রী সেখানে শুধুমাত্র সতীই নন, জ্ঞান অন্বেষণে সমুজ্জ্বল এক নারী, যে শুধু তার মেধা ও মননের শক্তিতে যমের মত জ্ঞানীকে প্রভাবিত করে স্বামীর জীবন ফিরিয়ে আনতে পারেন। ঘোচাতে পারেন শ্বশুরের অন্ধত্ব। এখানে এক নারীর জ্ঞানের আলো যেন প্রতীকী আয়ুধ হয়ে ওঠে, অন্য পুরুষদের মৃত্যু ও অন্ধত্বের বিপরীতে। সাধারণভাবে সাবিত্রীকে আমরা সতী বলেই জানি। চিরদিনই তার সতী রূপটিকে সবচেয়ে বেশি হাইলাইট করা হয়েছে। কিন্তু অরবিন্দের লেখা সাবিত্রী যেখানে সাবিত্রীকে সূর্যের কন্যা বলে সম্বোধন করা হয়েছে, সেখানে সাবিত্রীর উত্তরণ কিন্তু শুধু সতীত্বের নয়, ভালোবাসা ও জীবন যা পরমতম সত্য অভিলাষী, সেদিকেই তার যাত্রা।

 (C)www.amazon.in

চন্দ্রাবতী, বাংলার প্রথম মহিলা কবি বলে যাকে মনে করেন অনেকে, তার এপিক রামায়ণ আবর্তিত হয়েছে সীতাকে ঘিরে। ষোড়শ শতাব্দীর কবি চন্দ্রাবতী ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার পাতুয়ারী গ্রামে জন্ম নেন।

 

ধারাস্রোতে ধলেশ্বরী নদী বহি যায় 

বসতি যাদবানন্দ করেন তথায়

 ভট্টাচার্য্য বংশে জন্ম অঞ্জনা ঘরনী

 বাঁশের পাল্লায়  তালপাতার ছাউনি

 

(C)COVER IMAGE

এভাবেই নিজের জন্ম পরিচয় দিয়েছিলেন চন্দ্রাবতী। চন্দ্রাবতীর রামায়ণে আর এক সীতাকে আমরা দেখি, সতী তৈরির প্রচলিত রীতিকে বাদ দিয়ে যেখানে তাকে গড়া হয় রক্তমাংসের এক মেয়ে করে, যে আত্মসম্মান বোধের প্রবল ধীতে সমৃদ্ধ। চন্দ্রাবতীর রামায়ণ আজও বাংলার মেয়েদের নিজস্ব মনের কথায় গাঁথা রামায়ণ, যেখানে সীতা তার দুঃখ, বঞ্চনা, অবহেলা ও নীরব প্রতিবাদ নিয়ে একাত্ম হয়ে যান মেয়েদের সঙ্গে। কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত তাঁর সীতায়ণেযেন চন্দ্রাবতীরই উত্তরসূরি। 

সতীত্ব ও দৈহিক সৌন্দর্য ছাড়াও যে নারীর মেধা, ধী ও মননের, তার মানসিক সৌন্দর্যের গুরুত্ব রয়েছে , রয়েছে তার চিন্তা ইচ্ছা আর অনুসন্ধিৎসা, তা এই দুটি এপিকে আমরা দেখতে পেয়েছি। অরবিন্দ ও চন্দ্রাবতী এমন  নারীত্বের কথা বলেছেন যা নম্র, কমনীয়তা ও মানবী সৌন্দর্যে ভরপুর, সূক্ষ্ম ও মার্জিত... অথচ দৃঢ় ও সচেতন আত্মগরিমায় ভরপুর। যে নারী নারী হওয়ার জন্য গর্বিত, পুরুষের প্রশংসা লালায়িত নয় ।

এই সীতা সাবিত্রীর দেশে যেখানে পতিভক্তি প্রেমের চাইতে মুখ্য হয়ে ওঠে, সেখানে অরবিন্দ বা চন্দ্রাবতীর এপিক অবশ্যই ব্যতিক্রম।

 

কোন মন্তব্য নেই: