“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৯

অভিনব অভিযান

  ।। আবু আশফাক্ব চৌধুরী।। 
















জ খুঁজে নেব তোমার মৌনতা
তোমার সুঠাম দেহে সৌন্দর্যের অবকাশ
ধীর লয়ে  হাতড়ে নেব বিশাল প্রাঙ্গণ
যা আবদ্ধ ছিল নিষিদ্ধ ভূগোলে
আজ একা তুমি অন্দর মহলে
নির্জন দুপুর শ্রাবণের বৃষ্টি ধারা
মাঝেমাঝে ডাহুকের ডাক
অন্তঃসত্ত্বা হবার বাসনায় উদগ্রীব দুটো চোখ
একদিকে ভয় একদিকে কামনার পাশা
মাঝখানে প্রেমের হিন্দোল খেলা করে
পাশবিক প্রবণতা অন্তরে বাহিরে
এসো কাছে আসো আরও কাছে
প্রথম পরশ দাও ভালবাসা হোক প্রেম
তুমি আমি ভেসে যাই অগাধ সমুদ্রে ।

কবিতা হায়! হায়!

।। আবু আশফাক্ব চৌধুরী ।।

(C)Image











ধুস  শালা!  কতবার তোর সাথে কেটেছি আড়ি
কতদিন করেছিস কত বাড়াবাড়ি
তারপরও কেন ফিরে আসতে চাস সেই পুরনো বাড়ি?
আমি এক দুই নয় শতবার দিয়েছি তালাক।
বুড়বক বুঝে-না কিছু রাতবিরেতে এসে ছুড়ে হাঁক।
বুঝিনা তোর নাম কে রেখেছে কবিতা ?
ভোলা ডিমে সারাদিন দিলে তা।
তোর প্রেমে নস্যাৎ বাকি সব প্রেমিকা
না চেয়েও হয়ে গেছি আমি তোর সেবিকা।

বুধবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৯

উদ্বেগ

(C)Image























।। রফিক উদ্দিন লস্কর ।।

কিছু কলমে চিতার গতি
স্থান কাল বুঝে,
কিছু কলমে শুকায় মসি
রয় মাথা গুঁজে।
জানিনা কেন কলমগুলো
এমন মৌলবাদী!
দিন দুপুরেও ঘুমিয়ে পড়ে
হয়ে সুবিধাবাদী।
যতই দামী হোকনা কলম
রক্ত কিন্ত কালো,
শ্বেতবসনে দাগ দিয়ে যায়
তবুও সে ভালো।

মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৯

ইমোজি ভালোবাসা

 
।। বিদ্যুৎ চক্রবর্তী ।।
                                                                                






কটি ইমোজি তোর থেকে পেতে
পোড়াই যে কত কাঠখড়
সে তো শুধু আমিই জানি
হৃদয়ে লাগাতার ঝড়।

তুই কি জানিস - তোর থেকে আসা
একটি ইমোজির দাম
সে তো শুধু আমিই জানি
সুখে মোড়া নীল খাম।

একটি ইমোজি তোলপাড় করে
আমার পিয়াসী মন,
একটি ইমোজি খুশিতে ভরে
আমার উদাসী ক্ষণ।

ছলকে উঠে আকুল হৃদয়
সুখ টইটম্বুর,
শোণিত ধারায় ছুটে চলে যত
ভালোবাসা ঘনঘোর।

তুই তো থাকিস গণ্ডি ভেতরে
লোক জানাজানি ভয়ে,
আমি তো প্রতিটি ক্ষণেই তোকে
ভাবি মশগুল হয়ে।

একটি ইমোজির পথ চেয়ে থাকি
অগুনতি হা-পিত্যেশে
মরেছি মরমে, জ্বলেছি শরমে
আমি তোকে ভালোবেসে।

কত যে কথার পাহাড় রচি
তোর সাথে দিনে রাতে
লোকলাজ ভয়ে চাপা পড়ে রয়
ভাবী ঘাত প্রতিঘাতে।

বিধিনিষেধের যাঁতাকলে আমি
পথ খুঁজে না পাই
ঘুরপথে তাই তোর সকাশে
ইথারে পৌঁছে যাই।

আমার যত না বলা কথা সব
তোর যে হৃদয় দোলায়
সেই বার্তাটি আসে ফিরে তোর
একটি ইমোজি ছোঁয়ায়।

এমনি করেই ভাসবো দুটিতে
পুষবো মিলন আশা
বলবে কথা এমনি ইমোজি
ভালোবাসা ভালোবাসা।

সোমবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৯

ভার্চুয়াল


।।   অভিজিৎ চক্রবর্তী ।।

(C)Imageঃছবি

        কী কারণে সে বেঁচে আছে। হ্যাঁ ঠিক এই কথাটিই ইদানীং মনে হচ্ছে বিমলের। কলেজ-জীবনে নকশাল করত। হুরুয়া থেকে তরণি এসে গোপনে লিখনগুলি দিয়ে যেত। রাতারাতি আলতায় চুবিয়ে দেওয়ালে দেওয়ালে লিখে ফেলাই ছিল তার কাজ। সেটা ষাট-সত্তরের দশক নয়। আশি। পুলিশি দাপটে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে সব। তবুও গোপনে কোথাও কোথাও চলছে বিক্ষিপ্ত কর্মসূচী। প্রশাসনও পাত্তা দিচ্ছে না। কারণ সেই আগের তেজ আর নেই। যদিও সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন তখনো ফিকে হয়নি। ফের যেন বিপ্লবের উত্থান হবে। আসলে কলেজ লাইফটাই এমন। বিমল ভাবে, সমাজের জন্য কিছু করা, মানুষের জন্য কিছু করা, নতুন কিছু করার স্বপ্ন এই সময় অনেকটা নেশার মত।  চোখের সামনে সোভিয়েত ইউনিয়ন। আহা। হবে না কেন! হতেই হবে। হাতে হাতে চের ডায়েরি, মায়কোভস্কির কবিতা। কিউবার আন্দোলনের ঘটনা উত্তেজিত করে তুলছে। সোভিয়েত থেকে আসছে নানা পত্রিকা। বাংলা ম্যাগাজিন। রাদুগা প্রকাশন। সস্তায় ঢাউস ঢাউস বই। তলস্তয়, গোর্কি। মাঝেমাঝে প্রজেক্টারে সোভিয়েত সিনেমা। নানা কর্মকাণ্ড। গোপনে লিফলেট বিলি। এখন হাসি ওঠে। কী না করেছে। সে এক উত্তেজনার সময় ছিল। এসব নিয়ে এখন আর কোনো আকর্ষণ নেই তার। সেই বন্ধুবান্ধবও নেই। বেশিরভাগই বিভিন্ন কোর্পোরেট কোম্পানিতে আছে। মোটা মাইনে। বিশাল বাড়ি, দামি গাড়ি। বাড়ির সামনে সবুজ ঘাসের লন। চাকর- বাকর সব আছে। সে এক অন্য দুনিয়া। কে যে কোন পক্ষে চলে গেছে বুঝতে পারেনা বিমল। নিজেই বা কোনদিকে। হা হা হা। যে আমেরিকার বিরুদ্ধে কলেজ জীবনে এতো উষ্মা ছিল, এখন ফেসবুক না খুললে ঘুম আসে না। এখন তার মনে হয়, মানুষ আসলে স্বভাবতই ধনতন্ত্রবিশ্বাসী, অর্থলোভী। সেজন্য সমাজতন্ত্র তাকে লড়াই করে আনতে হয়। অর্থাৎ প্রবৃত্তিগতভাবে মানুষ সুবিধাভোগী।

 

          কিন্তু মৃত্যুর ইচ্ছাটা শুধু স্বপ্নের মোহভঙ্গের জন্য নয়। ইদানীং খালি মনে হচ্ছে সব অর্থহীন। নিজেই হতবাক হয়। নিজেকে যেন আর চেনে না। এ কীরকম ভাবনা তার। মারা যেতে পারে এমন কারণ অজস্র । যেমন বাড়িতে এখন আর কেউ নেই। বাবা চলে গেছে শৈশবেই। মা ছিল। মা-ও গেল গত বছর। যাকে ভালোবাসতো, সেই মেয়েটি এখন এক এন আর আই বিয়ে করে কানাডাবাসী। মাঝে মাঝে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে। নায়গ্রা ফলস আইফেল টাওয়ার, উপত্যকা, সমুদ্র, বিভিন্ন রিসর্টের ছবি দেয়। একেবারে ঝাঁ চকচকে জীবন। ভালোই। তার সেই একঘেয়ে সেন্টিমেন্ট থেকে দূরে সে এক অন্যরকম দুনিয়া। বিমল কল্পনাও করতে পারে না। 

         তবু এখনো কেন সে বেঁচে আছে! নাকি সে মরে গেছে অনেক আগেই। এখন আসলে সে আর নেই। কবে কোন শীতের রাতে একাকী ঘুরতে ঘুরতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোনো সৈনিকের মত ঠাণ্ডায় খাদ্য আশ্রয়হীনভাবে সে মরে গেছে। অথবা কোনো মরুভূমিতে যেতে যেতে যেতে জলের তৃষ্ণায় মরীচিকায় বিভ্রান্ত সে মারা গেছে। অথবা কোনো কানা গলির ভেতর গুম করা হয়েছে তাকে। কেউ তাকে জীবিত পায়নি। মাছি ভন ভন করা তার লাশ পচে ভেসে উঠেছে সংসারে। 

       বিমল যেন এই সময়ের কেউ নয়। দশ  বছরে চারপাশের মানুষগুলোর এতো অভূতপূর্ব পরিবর্তন! তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। নিজেকে মনে হয় গেল শতাব্দীর ভূত। তার আমলের যেন কেউ কোথাও নেই। রাস্তায় বেরোলে চারপাশে আকাশছোঁয়া বাড়ি, বহুতল ফ্ল্যাট, দোকান, মল। ছেলেমেয়েরাও পাল্টে গেছে। চলা ফেরা থেকে শুরু করে ড্রেস, চুলের কাটিং। ভাষাও যেন বুঝে না আজকাল। হাঁটতে হাঁটতে একটি ঝলমলে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। ভেতরে অজস্র লোক। তীব্র আলোর ফোয়ারার ভেতর পুরুষ রমণীরা মন্ত্রমুগ্ধ যেন ঘুরে বেড়ায়। বিমলের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। বাইরে থেকে বিমল তাদের কোনো কথা শোনে না।  তাকাতে তাকাতে এক সময় বিমলের মনে হয় গা ঝলসানো এই আলোর ভেতর এই লোকগুলো যেন অ্যাকুরিয়ামের কোনো প্রাণী। আটকা পড়ে গেছে। অথবা বেরোনোর কোনো ইচ্ছা নেই। হয়তো কোনোদিন ছিল। এখন নিঃস্পৃহ ভেসে বেড়াচ্ছে। এক সময় মনে হয় এ যেন দুই সময়। দুই যুগ। অ্যাকুরিয়ামের ভেতরে চলে গেছে একটা জগৎ। আর একটা ভেতরে ঢুকতে না পেরে হারতে হারতে হারিয়ে গেছে। বিমলের মাথা ঝিমঝিম করে। ভেতরেও কী ওদের মাথা ঝিমঝিম করছে না। বিমলের খালি মনে হয়, এই কাচের ঘরের ভেতরে গ্যাস চেম্বারে দমবন্ধ হয়ে ওরা মারা গেছে কবে। অথবা ওদের মেরে ফেলা হয়েছে। ওরা আসলে সবাই মৃত। 

 

          রোজ সে নিয়ম করে একবার সমস্ত শহর তন্ন তন্ন করে  খোঁজে।হারতে হারতে তার তো হারাবার কিছু নেই। মনে মনে ভাবে, সে কি মনের অতলে সুদীপার অপেক্ষা করে নাকি ? খুব গভীরে! কোথাও তার প্রতি বিশ্বাস এখনো আছে ? নাকি সব মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্ট! সুদীপাও হয়তো এই গ্রহের কোনো অ্যাকুরিয়ামে আটকে আছে। বেরোতে চাইছে। পারছে না। ইদানীং তার সবকিছু গুলিয়ে যায়। প্রতিষ্ঠান নিয়ে যাদের মাথাব্যথা ছিল, তারাই প্রতিষ্ঠিত। সুদীপাও কী এই চেয়েছিল! হয়তো তাই। হয়তো নয়। এ তার কীসের লড়াই! যখন সবাই ভুলে গেছে তাকে, তখন নিজের অস্তিত্ব নিয়ে এ তার কেমন ওঠাপড়া! অস্বস্তি লাগে।

 

          বিমলের মনে হয়, রাজনৈতিক আদর্শের বাইরে আরো কিছু একটা থাকে। সেটা মন। এবং তার মতিগতি স্থির সুতোয় ধরা যায় না। নইলে যতবার সুইসাইডের এটেম্প্ট নিয়েছিল সে, ততবারই সে পারেনি। না, ভয় নয়। মনে হয়েছে, বেঁচে থাকবে সে। সে মরতে পারে না। স্মৃতির মত থেকে যাবে সে। কোনো আদর্শের জন্য নয়। কোনো উত্থান বা ষড়যন্ত্রের জন্যও নয়। এমনকি সুদীপার জন্যও নয়। সেল ফোনের এই সংখ্যাহীনতার যুগে কারো কারো বাড়িতে যেমন রয়ে যায় সংযোগহীন মৃত সেলফোন। ঠিক সেই রকম। অতি সাধারণ। সে ভাবে, এই কাচের ঘরের লোকগুলোর সঙ্গে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। একেক সময় সে চিৎকার করে।আমার দিকে তাকাও, এই যে আমি এখানে। আমাকে দেখো। আমি কিছু বলতে চাই। ভয় হতে থাকে। চারদিকে উপরে মাঝে লক্ষ লক্ষ সি সি টি ভি ক্যামেরা। তার মনে হয় প্রতিনিয়ত কেউ তাকে লক্ষ করে চলছে। সে কী করে, কোথায় যায়, কী বলে। যেকোনো সময় চালান হয়ে যেতে পারে অন্ধ কুঠুরিতে। ধীর পায়ে সে সরে পড়ে। তার মনে হয় চারদিকে কোটি কোটি সেলফোন কিন্তু সংযোগহীন। কেউ কখনো কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। একেক জন থেকে একেক জন কত কত দূর। বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। সবাই যেমন আলাদা আলাদা। একা। একলা। এক একটা সংখ্যা। সেলফোনের নম্বরের মত। ফেসবুক খুললে কত কত বন্ধু। বিপ্লব তবু দীর্ঘজীবী নয়। বিমল জানে। সবাই বলছে। কেউ কিছু শুনছে না। বুঝছে না। তার গুলিয়ে যায়। সব যেমন নেটওয়ার্ক ক্ষেত্র থেকে বাইরে চলে গেছে।  সেও কবে হারিয়ে গেছে কোথায়। এই শহরের ভিড়ে সে যেন ভাসতে ভাসতে হাবুডুবু খাচ্ছে। যখনই সে ফোন করে, যখনই কথা বলতে চায়, শুনতে পায় ইস রুট কি সভি লাইন ব্যস্ত হে। কৃপয়া থোরি দের বাদ ডায়াল করে।

 

শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৯

হেইতি থাকতো হারবনি অডা

।। অভীককুমার দে।।



(C)Imageঃছবি












বনবাসীর গন্ধ শুঁকে লঙ্কায় ফিরে এলেই বিভীষণ।

পূর্বোত্তরের পাহাড় বলে
বাংলা থেকে আটক শিবিরের দূরত্ব বেশি নয়।

যে জাতের রক্তে স্বাধীনতা
সে জাত আটক শিবিরে, জীবিত !

কে তিনি বলেছিলেন, 'যেইতি বিয়াইছে... '

যে আকাশের নিচে প্রথম আলো
ঠিক তার নিচে মানুষ খোয়ারে, ঘাস খাবে এই জাত
গরুগুলো পাহারা দেবে
চামড়ার ব্যবসা করবে অমানুষের দল।

ঠিক তারপর বন্ধ ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখো জাতের ছবি।
যদি প্রতিটি জীবিত ছবির ভেতর জাতের লাশ
তবে অনিবার্য মৃত্যু মিছিল...

কে তিনি বলেছিলেন, 'হেইতি থাকতো হারবনি অডা'
কেউ শুনেও শোনেনি, বেশ...
জাতের অজাত চুপ করে থাক
এ দেশ গোলামের জন্য নয়।


শিলাছড়ির শিলাগুহা

।। অভীককুমার দে।।


(C)Imageঃছবি


হঠাৎ, জয়ের ফোন আসলো দিন পাঁচেক আগে। বিজনদার সাথেও কথা হয়েছিল।সৌমেন হরিণা আসবে, শিলাগুহা যেতে চায়। আমাকেও যেতে বলেছেন। শিলাগুহার কথা এর আগে অনেকবার শুনেছি। গবেষক অশোকানন্দ রায়বর্ধনও এই গুহার কথা বলেছিলেন আমাকে। সঙ্গী ও সুযোগের জন্য যাওয়া হয়নি এর আগে, তাই আমিও না করিনি।

আজ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেছি। ন'টার আগে যেতে বলেছিল জয়। আসলে যখন খুব তাড়াতাড়ি, দরজাও আঁচল টেনে ধরে; তা নাহলে চরকবাই থেকে হরিণা যেতে তিনবার গাড়ি বদলাতে হলো ! তবুও সময় মত গিয়ে পৌঁছেছি। বিজনদার দোকানে অন্যদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। জয় বাজারেই, কাছাকাছি কোথাও। সৌমেন আর সঞ্জীবদা এসে পৌঁছেছে। এগারোটা নাগাদ মোটরসাইকেলে রওনা হলাম শিলাছড়ির উদ্দেশ্যে। হরিণা ও রূপাইছড়ির ঠিক মাঝামাঝি জয়ের বাড়ি। আনুমানিক চার পাঁচ কিলোমিটার গেলে সোনাই বাজার। বাজার থেকে বনকুল অভিমুখে সামান্য এগিয়ে গেলেই সঞ্জীবদার বাড়ি। এ পথে এখনও শহরের দূষণ লাগেনি। পাহাড়, বন, গ্রাম একসাথে মিলেমিশে আছে। পরপর গ্রামগুলোকে যুক্ত করে একটি পাথুরে রাস্তা জীবনের ছন্দ মেখে এগিয়ে গেছে।

আঁকাবাঁকা পথ উঁচুনিচু পাহাড়ের ঢালে ঝুলছে।পাহাড়ের কাছে প্রকৃতির মায়ামেয়ে। পুরুষের মতো প্রহরী শরীর, নারীর মতো সবুজ মন। পায়ে লতানো গাছের নূপুর। নূপুরে ঢেঁকিশাকের কারুকাজ। মাঝে মাঝে বনফুলের মুক্তো।
বাঁদরঝোলা রাস্তা কোথাও পাহাড়ের কোমর জড়িয়ে, কোথাও চুমু খায় পায়ে। এসব দেখে সূর্যটা হেসে উঠলে কুয়াশা চাদরে জড়িয়ে নেয় শরীর এবং নীরবতার বাদ্যযন্ত্রে প্রকৃতির সুর নিজস্ব ধারায়। শুনতে শুনতে এগিয়ে চলেছি আমরা পাঁচজন। পাহাড়ের বাড়ি এলে মনের খোকাবাবুর আবদারও বেড়ে যায়। তা নাহলে একটু পরপরই ছবি তোলার নামে দাঁড়িয়ে পড়বে কেন ? কেনইবা জয়ের মতো ধীরস্থির ছেলে পাহাড়ের ঢালে একটি ফুল দেখে অস্থির হয়ে উঠবে ? শৃঙ্খলা বাহিনীর মানুষ হয়েও সৌমেনইবা অন্য কেউ কেন ! যার গলা ছেড়ে বেড়িয়ে আসছিল গানের কলি। আনন্দে আত্মহারা সঞ্জীবদার মুখেও পুনমের হাসি প্রজাপতির মতো ভাসতে দেখেছি। অনবরত কথা ফুটতে শুনেছি বিজনদার মুখে। আসলে পাহাড়ের কাছে এলে মানুষের ভেতর আর কোনও জড়তা থাকে না।

তোমাদের মতোই আমার প্রিয় বন্ধু পাহাড়, বন, নদী। মনের সাথে তর্ক করে যখন আমি হেরে যেতে যেতে চুপ হয়ে যাই, তুমি ঠিক বুঝতে পারো। কাছে আসো, সঙ্গ দাও। ভুলগুলো বেছে বেছে সরিয়ে দিতে পারো মন থেকে। ঠিক তেমনই, পাহাড়ের কাছে গেলে ঘন সবুজ বন আমার সব জড়তা সরিয়ে দেয়। খুশির ঝর্ণা ছলাৎ করে ওঠে। মনের ভেতর একটি চঞ্চল নদী ঢেউ ছড়িয়ে বয়ে যায়। তৃপ্তির অভিমুখে অদ্ভুত স্বচ্ছতায় সাঁতার কাটি। পাহাড়ি বন আমার অবয়বের দু'পিঠ দেখে হাসে।

হরিণা থেকে শিলাছড়ির দূরত্ব পঁয়তাল্লিশ পঞ্চাশ কিলোমিটারের বেশি হবে না। অথচ যখন শিলাছড়ি পৌঁছলাম তখন প্রায় পৌনে একটা। মাথার উপর দুপুর ভাঙছে। খোঁজখবর নিয়ে আমরা শিলাগুহার পথে রওনা হয়েছি। মোটরসাইকেলে আরও কিছুদূর যাওয়ার পর হাঁটা পথ। জলাশয়ের পাশে পাশে গুহাটা সরু খাঁজে পা গলিয়ে পাহাড়ের দিকে হাঁটছি। গভীর জঙ্গলের ভেতর মুখ লুকিয়ে একটি ছড়ি অজগরের মতো শুয়ে আছে। তিনবার ছড়িটির ছায়াশরীর আড়াআড়িভাবে অতিক্রম করার পর আকাশ ছোটো হয়ে দূরে সরে যাচ্ছে। জলের শব্দ বাড়ছে। এখান থেকে ছড়ির গা বেয়ে যেতে হবে সামনের দিকে। এই জলপথ ছাড়া শিলা-গুহায় পৌঁছানো সম্ভব নয়। যতই এগিয়ে যাচ্ছি ছড়িটি ঝর্ণা হয়ে উঠছে। ঘুঙুর পায়ে তাল ঠুকছে পাথরে। পিচ্ছিল পাথরে গড়িয়ে নেচে ওঠা ঝর্ণার মুখ থেকে চোখ ফেরানো যায় না। যতই এগিয়ে যাচ্ছি, ছোটো হয়ে আসছে আকাশ। ছড়ির উপর মুগলীলতা, পাশে কাঁটাঝোপ, উঁচু পাহাড়িঢাল। অদ্ভুতুড়ে আলো আঁধারে পাহাড়কে ভয়াল করে তুলেছে।

আনুমানিক দুই কিলোমিটার হাঁটার পর সামান্য একটু খোলা জায়গা। সামনেই পাহাড়ের গায়ে হা করে আছে একটি গুহা। ছড়িটি সামান্য বেঁকে বাঁদিকে সরে গেছে। আমরা যখন গুহামুখে এসে পৌঁছেছি তখন ঘড়িতে দুটো। অথচ মনে হচ্ছে, গুহামুখ দিয়ে ভেতর থেকে কেউ অন্ধকার ঢেলে দিচ্ছে সামনে। পাহাড়ের শরীর ভেদ করে সেই অন্ধকার মুছে দেবার ক্ষমতা আকাশের আলোতে নেই।

একে একে সবাই মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে ঢুকে পড়লাম গুহার ভেতর। ঢোকার সময় গুহামুখে মোমবাতি জ্বালিয়ে পাহাড়ি প্রাণীগুলোকে আমাদের অস্তিত্বের কথা জানিয়ে গেলাম। বিজনদার খানিকটা ভয় হচ্ছিল কিনা বুঝতে পারিনি। সৌমেনকে পথ দেখানোর জন্য সামনে যেতে বললেন। গুহামুখ থেকে তিন চার হাত যেতেই পৃথিবীর সমস্ত অন্ধকার জমে এখানে চিররাত্রি। মোবাইলের আলোকে চেপে ধরছে অন্ধকার। সীমাবদ্ধ গণ্ডির ভেতর বাঁধা পড়ে ছটফট করছে আলো।ভেতর দেয়ালে গুহামুখের দরজাটি কবে কারা হেলান দিয়ে রেখেছে। দরজাটি ছুঁয়ে অনুভব করলাম, এমনই সব গুহায় ডাকাতরা রেখে যেতো লুটের সম্পদ। এমনই কোনও গুহার সামনে এসে দরজা খোলার জন্য নাকি বলতে হতো 'খুল যা সিমসিম'। যদিও এই গুহা সেই গুহা নয়। এটি সমশের গাজীর গুহা। এখন ভেতরে চামচিকা আর বাদুড়ের নিরাপদ বসবাস।

গুহার ভেতরের পথ অত্যন্ত সুকৌশলে তৈরি হয়েছে। খুব তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, ধৈর্যশীল ও প্রচুর শ্রমশক্তি না থাকলে এমন একটি অসাধারণ সৃষ্টি অসম্ভব। কেননা, গুহার ভেতর চলতে চলতেই টের পাওয়া যায় বাহ্যিক চাপ, গতি ও প্রভাব বিস্তারের কোনও সম্ভাবনা নেই। এখানে অবস্থানরত কাউকে আক্রমণ করা বা গুহাতে বন্দী আছে এমন কাউকে উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব। কোথাও কোথাও রাস্তা অত্যন্ত সরু। হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়। হামাগুড়ি দিয়ে কিছুটা ঢোকার পর মাথা সোজা করার জায়গা আছে। আবার বেঁকে গেছে পথ। একদম ভিতরে ঢুকলে ইগলুর মতোই প্রায় গোলাকার জায়গা। পাশ দিয়ে পাহাড় ঘামানো জল নিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা আছে। অনন্ত তৃষ্ণায় বুক ফেটে মৃত্যু হবে না।

সমশের গাজীকে ছুঁয়ে দেখার এর থেকে ভালো কোনও জায়গা হতে পারে কিনা আমার জানা নেই। এখানে না এলে ত্রিপুরার ইতিহাসের একটি বৃহৎ অধ্যায় অদেখাই থেকে যাবে।