“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

মর্জিনার মা ও নারী দিবস


।। মাসকুরা বেগম ।।
            
   

 

।। মাসকুরা বেগম ।।

 

(C)Image:ছবি

          


    ড় আর মাটি দিয়ে তৈরি বিধ্বস্ত চালা ঘরটার পুরানো পচা-নষ্ট শনের চালের ফাঁক দিয়ে বৃষ্টির জল পড়ে ভিজে সব একাকার ।সকাল বেলার আকাশে সূর্যের মসৃণ আলোর ঝলকানি দেখে মনে হচ্ছে  রাত্রে প্রকৃতি যেন হৃদয় উজাড় করে তার দু:খ-কষ্ট গুলোকে  ঝেড়ে মুছে নিজেকে হালকা করে নিয়েছে।  ভিজে যাওয়া ছেঁড়া নকশিকাঁথা, বালিশ আর জ্বালানির খড়িগুলো রোদে শুকাতে দিয়ে বাঁশের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে আছে চিন্তিত মর্জিনার মা । মর্জিনা একমনে উঠোনটা ঝাড়ু দিচ্ছে । ছোট দুই বোন আপনমনে উঠোনে খেলছে । 

 

       মর্জিনার বাবার যেন কোনো চিন্তা ভাবনাই নেই ! সেই সকালে বের হয়ে গেলে আর পাত্তাই নেই। ভাঙ্গা চালের ফাঁক দিয়ে বৃষ্টির জল পড়ে যে ঘরটা বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছে সে যেন চোখেই পড়েনি তার। তেমাথার কোনো দোকানের বারান্দায় বসে বিড়ি টানছে নইলে ক্যারাম খেলছে । 

 

      মর্জিনার মা বসে বসে রোমন্থন করছে অতীতের দিনগুলোর স্মৃতি। তারও একটা নাম ছিল -ফুলবানু খাতুন । কিন্তু এখন যেন সে নিজেই ভুলে গেছে তার নামটা ! মর্জিনার মা-ই যেন তার নাম ! মর্জিনার বাবা বিয়ের পর কতো আদর সোহাগে ভরিয়ে দিয়েছিল সেই দিনগুলো। একটা সাইকেল ছিল মর্জিনার বাবার পেছনে বসিয়ে  ঘুরতে নিয়ে যেতো যেখানে-সেখানে । বিয়ের প্রথম বছর পাশের গ্রামে মেলায় গিয়েছিল তারা। অনেক ঘুরোঘুরি করে, খেয়ে-দেয়ে, এটা-সেটা কিনে ঘরে ফিরতে রাতের অন্ধকার নেমে এসেছিল। হঠাৎ আঁকাবাঁকা মেটে রাস্তার গর্তে ধাক্কা খেয়ে সাইকেল নিয়ে ছিটকে পড়ে গিয়েছিল ! আঘাতের চাইতেও যেন আনন্দ ছিল অধিক । ভাগ্যিস নরম মাটি আর ঘাসের মধ্যে পড়েছিল বলে কোনো আঘাত পায়নি ! মনে পড়লে এখনও হাসি পায়। 

 

      মর্জিনার মায়ের নাকে ছিল তিনটা সোনার নাকফুল - নাকের ডানদিকে একটা, বাঁদিকে একটা আর মধ্যে একটা । দুটা ওর বিধবা মায়ের দেওয়া আর একটা মর্জিনার বাবার দেওয়া। রূপার তৈরি নেকলেস, কানের দুল, হাতের চুড়ি আর পায়ের পায়েল মর্জিনার বাবা বিয়ের সময় দিয়েছিল। 

 

মর্জিনার বাবা-চাচারা পাঁচ ভাই। ছিল কিছু কৃষি জমি। পাঁচ ভাই মিলে চাষাবাদ করত। মর্জিনার বাবা সাপ্তাহিক হাটে গিয়ে উৎপাদিত ফসল বিক্রি করত। ব্যাগ ভর্তি করে নিয়ে আসত  অনেক কিছু। একান্নবর্তী পরিবার টুকরো টুকরো হয়ে পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। একজোড়া ঘোড়া আর একটা ঘোড়ার গাড়ি ছিল যা এক ভাইয়ের  ভাগে পড়েছে। দুই জোড়া চাষের গরু তার একজোড়া আর এক ভাইয়ের ভাগে পড়েছে। একজোড়া মর্জিনার বাবার ভাগেও পড়েছিল । একটা মাছ চাষের পুকুর তা আরেক ভাইয়ের ভাগে। বাজারে একটা মুদির দোকান তা আর এক ভাইয়ের ভাগে পড়েছে। মর্জিনার বাবার ব্যক্তিগত কোনো কাজ ছিল না কিন্তু কাজকর্ম  সে করত - হালচাষ, হাটে ফসলাদি বিক্রি করা, মুদির দোকানে বসা, ঘোড়ার গাড়িটা চালানো - সব মিলিয়ে অনেকটা  আয় করত । ভাইদের সাথে এটা-সেটা করে ভালোই রোজগার  হয়ে যেত । কোনো সমস্যা ছিল না ।

 

      মর্জিনার বাবার ভাগে পড়েছে এই খড়-কুটোর ঘরটা আর আধ বিঘা চাষের জমি। দুটো টিনের ঘর নিয়ে টানাটানি দেখে মর্জিনার মা-ই বলেছিল, ‘এতো টানাটানির দরকার নেই আমাদের, খড়-কুটোর ঘরটাই থাক, টিনের ঘর একটা বানিয়ে নেব ক'দিন পর।’ কিন্তু ক'বছর চলে গেল টিনের ঘর তো আর হলোই না উল্টো খড়ের ঘরটা বিধ্বস্ত হয়ে বৃষ্টির পানিতে সবশেষ !

ভাইয়েরা যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। মর্জিনার বাবার এতটুকু জমির চাষাবাদে সংসার কুলোয় না । তাই জমিটা বন্ধক দিয়ে, গরু দুটো বিক্রি করে একটা চা-পানের স্টল করেছিল বাজারের তেমাথার মোড়ে । কিন্তু সেটাও টিকিয়ে রাখতে পারল না ! দু'বছর হলো বন্ধ হয়ে গেছে । বন্ধক দেওয়া জমিটাও ফিরে পেল না - দেনা শোধ করতে পারে নি বলে । শুরু হলো মর্জিনাদের সাংঘাতিক কষ্টের দিন !

 

      মর্জিনার জন্মের পর কী আনন্দ ফুর্তিই না ছিল মর্জিনার বাবার ! হাট বাজার থেকে কত কিছু নিয়ে আসত মেয়েটার জন্য। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়ের জন্মের পর মর্জিনার বাবা বলেছিল,

- ‘ আবার মেয়ে !’ 

কথাটা যেন হৃদয়ে গেঁথে আছে মর্জিনার মায়ের। তৃতীয় বার মেয়ে জন্ম দিয়ে মা হয়েও তার নিজের মুখ দিয়েই বেরিয়ে এসেছিল - ‘আবার মেয়ে !’

 

       সর্বস্বান্ত হয়ে মর্জিনার বাবা দিন মজুরি করতে আরম্ভ করে । যখন যেটা পায় সেটা । বোধহয় কোনো কাজেই তার মন বসে না ! দিন দিন সে কর্মবিমুখ হয়ে উঠে ! নিজের সংসারের দায় দায়িত্ব ভুলে গেছে ! মর্জিনার মায়ের বিধবা মাও চলে গেছেন ওপারের ডাকে । তার যে আর আপনার বলতে কেউ নেই এ দুনিয়ায় । কীভাবে চলবে এ সংসারটা, মেয়েগুলোর খাওয়া-পরা, পড়া-শোনা, বিয়ে ইত্যাদি নানান চিন্তায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে মর্জিনার মা । 

 

       একবার মর্জিনার খুব কঠিন অসুখ হলে মর্জিনার মা একটা নাকের ফুল  সদকা করে দেয়। ছোট মেয়েটার একবার নিউমোনিয়া হলে আরেকটা ফুল বিক্রি করে ওষুধের খরচা বার করে। হাজার কষ্ট হোক মায়ের দেওয়া একটা নাকের ফুল সে কোনো দিন বিক্রি করবে না,  স্মৃতি হিসেবে রাখবে। রূপার গয়নাগুলোও বিক্রি করে দিয়েছে প্রয়োজনের তাগিদে !

 

      মর্জিনার মা উঠে গিয়ে ছোট একটা চিরকুট নিয়ে যায় পাশের বাড়ির জা'য়ের কাছে ।

- ‘ ভাবি এই নম্বরে তোমার মোবাইল থেকে একটা ফোন করবে কি ? আমার এক মামাতো বোন থাকে শহরে । ওর সাথে একটু কথা বলব গো ।’

 

নিশ্চয়ই ! নিশ্চয়ই ! কই ? দাও নম্বরটা ।’ বলে জা তার হাত চিরকুটটা নিয়ে নেয় ।

 

     ফোনে  কথা হয় তার মামাতো বোনের সাথে যে শহরে নিজে দিন মজুরি করে আর তার স্বামী সবজি ফেরি করে ।এতে তাদের চার জনের সংসার ভালোই চলছে । তাদের এক ছেলে এক মেয়ে । বাচ্চা দুটোও স্কুলে পড়ছে । কথা বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল যে তারা ও শহরে চলে যাবে । সে নিজে দিন মজুরি করে দৈনিক তিনশো টাকা পাবে আর মর্জিনার বাবাও একটা কাজ জুটিয়ে নেবে ।  দিদি বলেছে শহরে কত কাজ আছে !

 

      রাতে মর্জিনার বাবাকে বলল শহরে যাওয়ার কথা । প্রথমে সে রাজি হলো না। পরে মর্জিনার মা যখন প্রশ্ন করল - ‘সংসারটা কীভাবে চলবে ? মেয়েদের নিয়ে কেমন করে থাকবে এই বিধ্বস্ত ঘরে ? কী খাওয়াবে ? কী পরাবে ? ......???’

 

     কোনো উত্তর নেই তার কাছে ! তাই বলল, ‘ঠিক আছে। গোছগাছ কর। যাব না হয় ।’

 

     প্রথমবার শহরের উঁচু উঁচু বিল্ডিং আর নানান রঙের, নানান ধরনের গাড়ি আর জাঁকজমক পরিবেশ দেখে হা করে তাকিয়ে থাকে মর্জিনার মা। মনে মনে ভাবে এসবের মধ্যে কোথায় তাদের থাকার জায়গা হবে ! তারপর যখন তার দিদি আর জামাইবাবু আগে থেকেই তাদের জন্য ঠিক করে রাখা বাঁশ আর টিনের তৈরি চালা ঘরে নিয়ে যায় তখন সে বুঝতে পারে যে এখানে তাদের মত মানুষের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা ঠিকই  আছে। প্রথম দিনে কী আর বুঝবে মর্জিনার মা যে ওই উঁচু উঁচু বিল্ডিং তাদের জন্য বসবাস উপযোগী নয় । সেখানে যারা থাকেন তাঁরা হলেন অন্য এক আলাদা শ্রেণীর মানুষ। ওই শ্রেণীর মানুষ আর তাদের মধ্যে পার্থক্য হলো দুটো ভিন্ন ভিন্ন গ্রহের মত যারা চলতে থাকে নিজ নিজ কক্ষপথে !  

 

      দিদিরা নিজের ঘরের পাশাপাশিই তাদের জন্য ঘর ভাড়া করে দিয়েছে । ঘরের মেজটা পাকা । বাইরে কমন স্নানঘর, টয়লেট আদি । প্রতি মাসে পাঁচশত টাকা ঘর ভাড়া দিতে হবে। স্নান-টান সেরে দিদির ঘরে শান্তিতে পেট ভরে খাওয়া-দাওয়া করল সবাই। দিদি আগে থেকেই মুরগির মাংস, পোলাও আর মাছ, ভাত রান্না করে রেখেছে । দিদির  বাচ্চা গুলোও খুব তাড়াতাড়ি মিশে গেছে তার মেয়েদের সাথে । তারপর ঘরটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সবকিছু গুছিয়ে রেখে, বিছানা পেতে, তারা বিশ্রাম করতে লাগল। মেয়েরা বালিশে মাথা লাগাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। মর্জিনার বাবা ও ঘুমিয়ে পড়েছে ।

 

      মর্জিনার মায়ের ঘুম আসছে না। সে ভাবছে কতকিছু ! কীভাবে শুরু করবে নতুন পথ চলা ? পারবে কী সে ? হেরে যাবে না তো জীবন যুদ্ধে ? মর্জিনা পারবে কী ছোট্ট বোন দুটোকে দেখে-শুনে রাখতে ? কতই বা বয়স মেয়েটার ? সবে এগারোয় পা দিল ! এই বয়সে যে তার স্কুল যাওয়ার কথা ! এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে মর্জিনার মা ! তাকে যে কাজে যেতে হবে তাই ছোট বোন দুটোকে কে দেখবে ! মর্জিনা খুব শান্ত মেয়ে । ঘরোয়া কাজ-কর্ম ও শিখে ফেলেছে অনেকটা। সে পারবে সামলাতে । ছোট মেয়ে দুটোকে এখানে সরকারি স্কুলে ভর্তি করে দেবে । 

 

      পরদিন সকালে মর্জিনার কাছে মেয়ে দুটোকে রেখে দিদির সাথে নয়টার সময় চলে যায় কর্ম ক্ষেত্রে । রবিবার দিন থাকায় দিদির ছেলে-মেয়ে দুটোও ঘরে আছে। তাই একটু ভরসা আছে । দিদির বাচ্চা দুটো কিন্তু দারুণ চটপটে আর  সমঝদার ! ছেলের নাম শফিকুল আর মেয়ের নাম সফিনা । মর্জিনার বাবাকে শফিকুলের বাবা নিয়ে যায় সবজি বিক্রি করার মহাজনের কাছে একেবারে ভোরের আলো উঠার সঙ্গে সঙ্গে । 

 

      শফিকুলের বাবার অনুরোধে মর্জিনার বাবাকে মহাজন সবজি বিক্রি করার জন্য  নিযুক্তি দেয়। খুব ভোরে বেরিয়ে গিয়ে ঘরে ঘরে সবজি বিক্রি করতে হয়।  মহাজন বললেন, ‘ হ্যাঁ শফিকুলের বাবা, শুনো, আজ ও তোমার সাথে যাক্ । একটু চেনা জানা হউক । কাল থেকে ও একলা ফেরি করতে যাবে । ঠিক আছে ?’

 

শফিকুলের বাবা মর্জিনার বাবার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় ! সে জবাব দেয়, ‘ হবে হবে। ঠিক আছে।’

 

        তারপর তারা সবজির ভার কাঁধে নিয়ে সব্জি মণ্ডি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তার ধার ঘেঁষে গিয়ে একটা গলি পথ ধরল তারা । এভাবেই কয়েকটি গলিতে ঘুরল তারা । পথের দুধারে কী উঁচু উঁচু বিল্ডিং, বাংলো বাড়ি, প্রায় বেশির ভাগ বাড়ির সামনে ফুলের বাগানে ফুটে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের ফুল । যেমন - গোলাপ, শেফালী, কাগজ ফুল, হাছনুহেনা, টগর, গাঁদা ফুল, ইত্যাদি  আরো কত কী নাম না জানা,  আগে  না দেখা বাহারি ফুল ! মর্জিনার বাবা অবাক চোখে শুধু দেখছে আর শফিকুলের বাবার সাথে হাঁটছে ।

 

     শফিকুলের বাবা হাঁক দিয়ে দিয়ে যাচ্ছে বাড়িগুলোর সম্মুখ দিয়ে , সবজি লাগে ? সবজি ? পটল, সজিনা, টমাটো, বেগুন, কাঁচা মরিচ,.........’ 

 

      ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলারা বেরিয়ে আসছে, দর- দাম  করছে, যার যেটা দরকার কিনছে । দাদা - বউদি বলে সম্বোধন করে কী মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে শফিকুলের বাবা আর সবজি বিক্রি করছে ! কেউ সবজির বদনাম করতে গেলে আরো মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে সবজি বিক্রি করে তবেই ছাড়ছে ! লেশ মাত্র বিরক্তি নেই তার চেহারায় ! ঠোঁটের কোণের হাসিটা অম্লান হয়ে আছে ! সঙ্গে সঙ্গে মর্জিনার বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে , ‘ ও আমার আপন জন । এদিকে সবজি নিয়ে আসলে ওর কাছ থেকে কিনবেন । খুবই নিরীহ মানুষ ও .......।’ ইত্যাদি কত কথা !

 

      শফিকুলের বাবার সবজির ঝুড়ি দুটো পুরো খালি করে গিয়ে পৌঁছল মহাজনের কাছে । মহাজন শফিকুলের বাবার সাথে সাথে তার হাতেও কিছু টাকা গুঁজে দিল। তার শরীরটা খুব একটা  ভালো লাগছে না, মাথাটা ধরছে ! সারা দিনে বিড়িতে একটা টানও দিতে পারে নি। শফিকুলের বাবা একটা চায়ের দোকানে নিয়ে গেল । চায়ের সাথে বেকারির বিস্কুট খেয়ে, তারপর মুখে পান পুরে, ঘরে ফিরে যায় তারা। ঘরে গিয়েই আগে বিড়ির প্যাকেটটা বের করে শান্তিতে বেশ কয়েক টান দেয় সে । পৃথিবীর সব সুখ, আমেজ যেন এই বিড়ির টানে !

 

     মর্জিনার মাকে নিয়ে তার দিদি শফিকুলের মা একটা 'কনস্ট্রাকশন সাইটে' যায় যেখানে আরো মহিলারাও সহযোগিতার কাজ করছে । শফিকুলের মা ও এখানেই কাজ করে । সে আগে থেকেই ঠিকাদার বাবুর সাথে কথা বলে রেখেছিল । মর্জিনার মাকে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দেয় । বাবু বললেন,

- আজ ঘুরে ঘুরে দেখে বুঝে নাও । কাল থেকে কাজ শুরু করবে । খুব নিপুণভাবে, একাগ্রতার সাথে কাজ করতে হবে নইলে কাজ থেকে বের করে দিতে সময় লাগবে না । রোজ তিনশো টাকা করে পাবে ।’

 

- ‘ ঠিক আছে বাবু । আমি ঠিক পারব ।’ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জবাব দেয় দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ মর্জিনার মা । সত্যি ! পারবে সে ! কারণ তার মধ্যে আছে অভাব অনটনের চিন্তা, মাথায় তিনটে মেয়ের দায়িত্ব বোধ, চোখে সুন্দর একটা ভবিষ্যতের স্বপ্ন !

 

      শফিকুলের মা তাকে একটু কনস্ট্রাকশন সাইটটা ঘুরিয়ে কয়েক জনের সাথে পরিচয় করিয়ে নিজে কাজে লেগে যায়।  মর্জিনার মা এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে দেখছে আর অবাক হচ্ছে !  বিল্ডিং গুলো মনে হচ্ছে  যেন আসমান ছুঁয়ে ফেলবে ! কী করে মানুষ উঠে এতো উঁচু ঘরগুলোতে ! মানুষ উপরে উঠতে উঠতে তো হাঁপিয়ে উঠবে।  এতো বড় বড় বিল্ডিং ! এক একটায় যেন পাঁচ গাঁয়ের মানুষ থাকতে পারবে ! দিদি বলেছে এগুলোকে বলে ফ্ল্যাট । আর উপরে উঠার জন্যও রয়েছে লিফট ! তাই নাকি কষ্টের কোনো কথাই নেই !   

 

     পরের দিন সকালে তাড়াতাড়ি রান্না-বান্না করে চারটা ডাল-ভাত খেয়ে দিদির সঙ্গে সাইটে চলে যায় সে। সাইটে গিয়ে শাড়িটা কোমরের সাথে ভালো করে পেঁচিয়ে উপরে মর্জিনার বাবার পুরোনো একটা শার্ট পরে, মাথায় একটা গামছা পেঁচিয়ে কাজে যোগদান করে সে । এখানে প্রায় সব মহিলা শ্রমিকরা পরেছে এরকম করে । 

 

     মর্জিনার বাবাও সবজি নিয়ে বেরিয়েছে । যে এলাকাটা শফিকুলের বাবা চিনিয়ে রেখেছে সেদিকটাই দেওয়া হয়েছে তাকে । শফিকুলের বাবা অন্যদিকে গেছে   প্রথম দিনই মর্জিনার বাবার বিরক্তি লাগে যখন একজন ক্রেতা তার পটলগুলোর বদনাম করে ! চেঁচাতে চেঁচাতে, ‘ সবজি লাগে.....’ তার গলাটা বেশ শুকিয়ে গেছে। গলির মোড়ে একটি নির্জন জায়গায় গিয়ে বিড়ি জ্বালিয়ে আমেজের সাথে কয়েক টান নিয়ে হালকা অনুভব করে সে । তারপর আবার চলতে থাকে। 

 

      সব সবজি বিক্রি করতে পারেনি সে । কিছু ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। শফিকুলের বাবা মহাজনকে বলল,

- ‘প্রথম দিন তো তাই বোধহয় বেশি কাবু করতে পারে নি । ধীরে ধীরে ঠিকই ঝুড়ি গুলো খালি করে নিয়ে আসতে পারবে ।’ 

      ঘরে ফেরার সময় শফিকুলের বাবা তাকে কীভাবে সে অনেকটা সবজি বিক্রি করতে পারবে, কীভাবে ক্রেতার মন জয় করতে হয় - এসব পন্থা বলতে বলতে ঘরে পৌঁছে তারা । কিন্তু মর্জিনার বাবার এসব এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে যায় ! 

 

     সবজির ভার রেখে গলির নির্জন মোড়ে মোড়ে বিড়ি টানা চলতে থাকে তার । এখন আরো শিকড় মুখে পুরার ও অভ্যাস হয়েছে । রাস্তার মোড়ের ঐ দোকানটার সামনে কয়েকটা বখাটে ছেলে ক্যারাম বোর্ড খেলে। সেও সামিল হয়ে যায় তাতে !  ক্রেতা যদি সবজির দাম কম করার জন্য একটু বদনাম করে তবে বলে দেয় - ‘ আপনার পছন্দ হলে কিনুন না হলে নাই ।’ ‘এতো দেমাগ রে বাবা !’ - বলে ক্রেতা চলে যায়।

 

      সেদিন কাজ সেরে ঘরে ফেরার সময় রাস্তায় শফিকুলের মা মর্জিনার মাকে বলল, ‘ ফুলবানু ! আজ বাবু তোর কাজের খুব তারিফ করেছেন রে ! তুই খুব সুন্দর কাজ করছিস ! একটুও কামাই করছিস না ! ইত্যাদি । এত বদমেজাজি বাবু যদি তোর কাজের তারিফ করেছেন তাহলে সত্যি তুই খুব ভালো কাজ করেছিস ।’

 

- ‘ আলহামদুলিল্লাহ ! আমারও কাজ করে ভালো লাগছে বু। মেয়েগুলোকে দুবেলা দুমুঠো খাওয়াতে পারছি, পরাতে পারছি । ছোট মেয়ে দুটো স্কুলে যাচ্ছে । এই আমার যথেষ্ট । আর একটু একটু করে মর্জিনার বিয়ের জন্য ও কিছু জমাব ।’

 

- ‘তাই যেন হয়। আল্লাহ যেন তোর সব ইচ্ছা পূরণ করেন।’

 

      মর্জিনার বাবার সবজি বিক্রির কাজটাও চলে গেছে । তারপর দু'বছরের মধ্যে আরো কত কাজে লাগিয়ে দিল শফিকুলের বাবা কিছুতেই টিকে থাকতে পারে না সে তার বিড়ি, শিকড়, ক্যারাম বোর্ড আর তেমাথার দোকানের সামনে বসে আড্ডার নেশা চলতে থাকে সমানে ।  মর্জিনার মায়ের রোজগারেই সংসার চলে । 

 

     একদিন কাজের সাইটে খেতে বসে শফিকুলের মা লক্ষ করে খাবার খেতে পারছে না মর্জিনার মা । পাশে এসে জিজ্ঞেস করে, 

- ‘ কী হয়েছে তোর ফুলবানু ? মুখটা এতো শুকনো শুকনো লাগছে কেন ? খাবারও শুধু নাড়াচাড়াই করে যাচ্ছিস !......’ 

 

- ‘ ও কিছু না বু । আমার তিন মাস চলছে ..... বুঝেছ নিশ্চয়ই।’ ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি হেসে বলল মর্জিনার মা।

 

- ‘কী বলছিস তুই ! আবার !.......’

 

- ‘ বু দোয়া কর আল্লাহ যেন এবার একটা ছেলের মুখ দেখান ।’

 

- ‘ কী পাগলামি বকছিস তুই ! আগে-পিছে কিছু ভেবেছিস কী ! আর কত কষ্টের মুকাবিলা করবে !..... ‘ বলে শফিকুলের মা ভাবল  'মর্জিনার বাবা ও তো ছেলে মানুষ' কিন্তু মুখে কিছু বলল না কারণ সে জানে মর্জিনার বাবা যাই হোক মর্জিনার মা তাকে শ্রদ্ধা করে - ভালোবাসে ! 

 

- ভেবেছি বু ! মেয়েগুলো যেন একটা ভাই পায় এই কামনা করি। আজ আমার যদি একটা ভাই থাকত হয়তো আমাকে কত দেখে শুনে রাখত ! ‘

 

        কথাটা শুনে শফিকুলের মায়ের হৃদয় কেঁদে উঠে । আর কিছু বলতে পারে না সে। হাতটা বুলিয়ে দিল মর্জিনার মায়ের মাথায়-চেহারায় আর আশির্বাদ করল, 

- ‘ আল্লাহ যেন তাই করেন বোন !’ 

      তারা যে কনস্ট্রাকশন সাইটে কাজ করে দু'বছরে সেই হাউসিং কমপ্লেক্সে দুটো ব্লক কমপ্লিট হয়েছে । বসবাসের জন্য মানুষও এসে গেছে । প্রথম প্রথম শহরের মানুষের চলন-বলন ইত্যাদি অবাক চোখে দেখত মর্জিনার মা। তার মনে হতো ওদের জীবন-যাত্রা গ্রামের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা । সাইটে আরো কাজ চলছে, তারা সহযোগিতা করছে বরাবরের মত। 

 

        আজ সকাল থেকে মর্জিনার মায়ের শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না । শফিকুলের মাকে বলেনি । শফিকুলের মা জানলে যে কী বলবে তা তার জানা আছে ! বলবে আজ আর কাজে যাওয়ার দরকার নেই , একটু আরাম কর । আমাদের ঘরে খেয়ে নেবে তোরা। কিন্তু তার যে লজ্জা লাগে কত সাহায্য করবে ওঁরা ! শফিকুলের মা বাবা দু'জনে মিলে রোজগার করে অনেকটা উন্নতি করেছে, কোথায় যেন একটা ভিটেও কিনেছে নিজেদের ঘর বানানোর জন্য। 

 

      আনমনা হয়ে বসে বসে কাজ করছে মর্জিনার মা । শফিকুলের মায়ের অনুরোধে আর মর্জিনার মায়ের  কর্ম নিষ্ঠায় সন্তুষ্ট হয়ে ঠিকাদার বাবু তাকে আগের তুলনায় একটু হালকা কাজ দিয়েছেন, যেগুলো বসে বসে করা যায় তবুও এ অবস্থায় সারাদিন কাজ করা যে কত ঝুঁকি পূর্ণ ! তাই বাবু তাকে ছুটি দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু  সে ছুটি নিতে রাজি হয়নি । 

 

       সকাল দশ/এগারোটায় মর্জিনার মা দেখল ফ্ল্যাটের কয়েকজন বিশিষ্ট ভদ্রমহিলা বেরিয়ে আসছেন । আহ্ কী সুন্দর চেহারা এক এক জনের ! কী সুন্দর স্বাস্থ্য ! দেখলেই মনটা ভরে যায় ! একজন মহিলা তার পাশেই দাঁড়িয়ে কারো সাথে মিষ্টি ধমক দিয়ে ফোনে কথা বলছেন,

- আজকে নারী দিবস, তুই সেলিব্রেশনে না আসলে হয় ? তুই এতো বিখ্যাত নারীবাদী লেখিকা তাই তুই থাকলে আলাদা একটা ইমেজ তৈরি হত অনুষ্ঠানে । আমিও গর্ববোধ করতে পারতাম যে তোর মতো একজন সেলিব্রেটির বোন আমি।’ 

 

      মর্জিনার মা মনে মনে ভাবল এই নারী দিবস'-টা কী ! খায় না মাথায় ভরা দেয় ! কৌতূহলী হয়ে মর্জিনার মা বাকি কথা গুলো ও শুনল । তারপর ওদিক থেকে কী জানি প্রত্যুত্তর আসল, ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বর পাল্টে গেল, 

- ‘ ওয়াও! আই এম সো হ্যাপি টু হিয়ার দ্যা গুড নিউজ ! তা আগে বলবে তো যে আমি মাসি হতে চলেছি ! শুন ! খুব সাবধানে চলাফেরা করবে ! বেশি কাজ কর্ম করবে না, বেশি দৌড় ঝাঁপ করবে না, পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেবে,......।’ তারপর আবার ও প্রান্তের জবাবে তিনি বললেন,

- এবার আমাদের মহিলা সমিতির অনুষ্ঠানে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় মুহূর্ত হচ্ছে  কিছু দুস্থ, অসহায়, রুগ্ন মহিলার মধ্যে বস্ত্র বিতরণ করা, ফলমূল বিতরণ করা ও আর্থিক সহায়তা করা।’ 

 

      মর্জিনার মা এক পলক তাকায় নিজের  কঙ্কালসার শরীরের মধ্যাঞ্চলের দিকে আর বুকের ভিতর থেকে আপনাআপনিই এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ! তার মনে বোধহয় সন্দেহ হয়েছে যে সে যে আট মাসের গর্ভবতী এটা বাইরে থেকে বুঝা যাচ্ছেনা নাকি ! বুঝা গেলে তো নিশ্চয়ই এই সব মহান মহিলারা তার প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিতেন । তাঁরা তো প্রায়ই তার পাশ দিয়ে  কর্মক্ষেত্রে যান, বেড়াতে কিংবা শপিং এ যান কিংবা ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিকেলের মৃদু মন্দ হাওয়া গায়ে মাখেন আর সূর্যাস্তের সৌন্দর্য উপভোগ করেন  !

 

       সেদিন দুপুরে শফিকুলের মা তার পাশে এসে বসে খাবার বের করল । মর্জিনার মাকে শুকনো মুখে বসে আছে দেখে বলল,

- এই খাবে না ?’ বলে নিজে তার ব্যাগ থেকে টিফিনটা বের করে খুলে দিল । মর্জিনার মা মুখে খাবার তুলেও খেতে পারছে না দেখে শফিকুলের মা জিজ্ঞেস করল, 

- ‘ তোর কী হয়েছে রে বোন ? কেমন যেন লাগছে তোকে !’  

- ‘ বু আমি আর পারছি না। ঘরে যাব । বিশ্রাম নেব ।’

- ‘ খাবারটা খেয়ে নে বোন । না খেয়ে থাকলে তোর আর বাচ্চার যে ক্ষতি হবে। আমি নিয়ে যাব ঘরে । তোর বিশ্রামের খুব প্রয়োজন।’ 

 

     কোনোমতে একটু আধটু খায় সে । তারপর শফিকুলের মা একটা রিক্সা করে তাকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে , শুইয়ে রেখে, মর্জিনাকে মায়ের লক্ষ রাখতে আর কোনো অসুবিধা হলে তাকে ডাকতে, এসব বলে নিজে আবার চলে যায় কাজে ।

 

     শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল মর্জিনার মা । ঘণ্টা খানেক পর ঘুম ভাঙ্গলে অনুভব শরীরটা কেমন যেন করছে । ওয়াশরুমে যায় । বমি করে। পেটে ব্যথা অনুভব করে । ধীরে ধীরে ব্যথা বাড়তে থাকে । সন্ধ্যার সময় ব্যথা এতটাই বেড়ে যায় যে তার আর বুঝতে বাকি রইল না যে এটা প্রসব বেদনা । মর্জিনাকে বলে দিদিকে ডাকতে । দিদি সবে মাত্র এসে গা ধুতে ঢুকেছে । তাড়াতাড়ি গা ধুয়ে বেরিয়ে মর্জিনার মায়ের কাছে আসে ।

 

     কিছুক্ষণ পর মর্জিনার মা একটা বাচ্চা জন্ম দিয়েই জিজ্ঞেস করে ,

- ‘ বু , ছেলে হয়েছে কি ?’

- ‘হ্যাঁ রে তোর ছেলে হয়েছে !’

কতবছর পর যেন মর্জিনার মায়ের মুখে খুশির হাসি ফুটে উঠে ।

- ‘ আলহামদুলিল্লাহ ! বু ওকে আমার কোলে দাও ! 

     ছেলে কোলে নিয়ে আদর করে । অস্পষ্টভাবে গুন গুনিয়ে ‘আল্লাহ ! লাইলাহা ইল্লা.......’  বলে হঠাৎ পড়ে যায়। শফিকুলের মা তাড়াতাড়ি বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে শুইয়ে রেখে দৌড়ে এসে তুলতে গিয়ে তাকে আর তুলতে পারে না । মর্জিনাকে ডেকে দু'জনে মিলে ধরে বিছানায় শুইয়ে দেয় । দেহটা কেমন যেন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে । অনেক ডাকাডাকি, হাতে পায়ে তেল মালিশ করেও যখন আর তুলতে পারল না তখন শফিকুলের মায়ের বুঝতে বাকি রইল না  যে সব শেষ ! চিৎকার করে কেঁদে উঠল, 

- ‘ মর্জিনা তোর মা কী আমাদের ছেড়ে চলে গেল রে ! তোর বাবাকে ডাক !’

 

      বাবাকে কোথায় ডেকে পাবে মর্জিনা ! সে যে ভবঘুরে ! রাত দশটার আগে কী ঘরে ফিরে ! যা হারানোর বাচ্চাগুলোই তো হারিয়েছে ! সে তো আরেকটা বিয়ে করলে বউ পেয়ে যাবে !!!