‘মরণ’! ফাঁসির আগে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে চায় কিনা জানতে চাইলে ‘শাস্তি’ গল্পের চন্দরা ওই রহস্যময় শব্দটি উচ্চারণ করেছিল। বাঙালি পাঠক মাত্রেই জানেন যে ওই একটি মাত্র শব্দের অমোঘ প্রয়োগে রবীন্দ্রনাথ কি সাংঘাতিক অভিঘাত তৈরি করেন। কেবল তাই নয়, ছোটগল্পের সমাপ্তি হিসেবে শব্দশিল্পের কারুকৃতি উৎকর্ষের কোন শিখর স্পর্শ করতে সমর্থ এ গল্প তার বিরল দৃষ্টান্ত বইকি! সাহিত্য বিচারের নান্দনিক তুলাদণ্ডে এ গল্প যে একশ শতাংশ নম্বর পাওয়ার অধিকারী সে বিষয়ে সন্দেহের লেশ মাত্র থাকার কথা নয়। কিন্তু নান্দনিক তৃপ্তিই তো সব নয়, শেষ কথাও নয়। সাহিত্য রচনার একটা বৈষয়িক অভিপ্রায়ও যে থাকে, প্রত্যক্ষ কিংবা অপ্রত্যক্ষ, অন্তত রবীন্দ্রনাথের গল্পে যে থাকেই সে তো অস্বীকারের জো নেই। ‘শাস্তি’ গল্পের সুঠাম শরীরটিকে খানিকটা কাঁটাছেঁড়া করে দেখা যাক সে অভিপ্রায়টি স্পষ্ট হয় কিনা! ‘শাস্তি’ গল্পের পরিসমাপ্তিতে আদালত চন্দরাকে শাস্তি দিল নাকি চন্দরা স্বামীর অবিচারের শোধ নিল (অথবা স্বামীকে শাস্তি দিল) এই ‘অমীমাংসিত’ প্রশ্নের জন্যই গল্পটি নাকি সার্থক এরকম অভিমত ব্যক্ত করেছেন বহু অভিজ্ঞ বিশ্লেষক। কেউ কেউ আবার চন্দরার চরিত্রে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহও খুঁজে পান। আমরা একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি নিরীক্ষণ করার প্রয়াস করব, এবং আমাদের প্রয়াসে গল্প থেকেই প্রয়োজনীয় সাক্ষী-সাবুদ পেশ করব। তবে তার আগে ওই ‘মরণ’ শব্দটি সম্পর্কে দু একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।
প্রথমত, বাংলা ভাষার অন্তর্নিহিত ঐশ্বর্যের পরিচয় ব্যতিরেকে শব্দটির মর্মোদ্ধার যে অসম্ভব এবং ভাষান্তরে তা যে কিছুতেই প্রকাশযোগ্য নয় তা স্বীকার করে নেওয়া দরকার। দ্বিতীয়ত, ‘মরণ’ শব্দটির উচ্চারণে রাগ, অভিমান ও ক্ষোভের অভিব্যক্তি যেমন রয়েছে, তেমনি তার মধ্যে দাম্পত্যের আকর্ষণ-বিকর্ষণ মিশ্রিত অম্লমধুর সম্পর্কের- ইংরেজিতে erotic বলতে যা বোঝায় তার - আভাসও অবর্তমান নয়। আর সে কারণেই শব্দটির অসাধারণ ব্যঞ্জনা গল্পের শেষে এক অনন্য অভিঘাত তৈরি করতে সক্ষম হয়, নির্মাণের দিক থেকে সার্থকতার নিদর্শন হয়ে ওঠে। তবু, গল্পের সময়, সামাজিক প্রেক্ষিত ইত্যাদির নিরিখে অব্যর্থ ‘মরণ’ শব্দটি উৎসারিত হয় যে চরিত্রটির মুখ থেকে, সেই চন্দরা নাম্নী গৃহবধূর চরিত্রটি স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের পটভূমিতে কিভাবে ও কতটা সার্থক বা অসার্থক ভাবে চিত্রিত হয়েছে তা একটু খতিয়ে দেখা যেতেই পারে। ‘মরণ’ শব্দটির অনুষঙ্গে চন্দরার চরিত্রে আদৌ কোনো বিশেষ মাত্রা সংযোজিত হয়েছে কিনা একটু খতিয়ে দেখাই যাক না! গল্পের মধ্যে ঘটনা বলতে যেটুকু তা হচ্ছে, দুখিরামের হাতে ‘আকস্মিক ভাবে’ তার স্ত্রী রাধার খুন হওয়া ও দুখিরামকে বাঁচাতে খুনের দায় চন্দরার ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা। মজার বিষয় হচ্ছে যে, চন্দরার স্বামীই পরিকল্পনাটির উদ্ভাবক এবং সে চন্দরাকে দায়টা মাথা পেতে নিতে অনুরোধ পর্যন্ত করে। এই অস্বাভাবিক অনুরোধের জন্য সামান্য অস্বস্তিও সে বোধ করে বলে চন্দরার শাস্তি মকুব করার আশ্বাসও সে দেয়, যদিও শাস্তি মকুবের ব্যাপারে সে নিজেই নিশ্চিত হতে পারে না। ঘটনার আকস্মিকতায় হতচকিত চন্দরা প্রাথমিক বিমূঢ়তা কাটিয়ে, বলা যায়, বিক্ষুব্ধতা প্রকাশ করে ছিদামের কথা মত আত্মরক্ষার চেষ্টামাত্র না করে।
এই গল্পের খুনের মামলায় পাত্র-পাত্রীরা কে কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ এবং তার বিচার-বিশ্লেষণ থেকে কি তথ্য সংগৃহীত হয় দেখা যাক। ‘শাস্তি’ গল্পটির বিভিন্ন স্তর ও মাত্রা বর্তমান। কেন্দ্রিয় স্তরে রয়েছে চন্দরা-ছিদাম সম্পর্ক। এই দাম্পত্য সম্পর্কের আপাত স্বতন্ত্রতা বিঘ্নিত হয় খুনের ঘটনার ফলে। কেন্দ্রাতিগ স্তরে রয়েছে একটি যৌথ পরিবারের চিত্র, যা আবার এক বিশেষ সময় ও সামাজিক ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে বিন্যস্ত। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, চরিত্রগুলি এতটাই সুবিন্যস্ত যে তার বিশ্বাসযোগ্যতা কিংবা বাস্তবতা নিয়ে আদৌ কোন প্রশ্ন ওঠে না। প্রশ্ন ওঠে না ঠিক, তবে এই বিন্যাস যে সরল ও একরৈখিক নয়, বরং বেশ জটিল সেও স্বীকার্য। একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। দুখিরাম সন্ধেবেলা কাজ থেকে ফিরে ভাত দিতে বললে বড় বউ উত্তরে বলে - 'ভাত কোথায় যে ভাত দিব। তুই কি চাল দিয়া গিয়াছিলি। আমি কি নিজে রোজগার করিয়া আনিব।' আর তাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে - (লেখকের মতে) শেষ কথাটার ‘কুৎসিত শ্লেষ’ অসহ্য বোধ হওয়ায় - দুখিরাম খুনটা করে ফেলে। লক্ষণীয় যে ঘরের বউয়ের রোজগার করে আনার বিষয়টি এক নিতান্ত ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ পরিবারের পুরুষ কর্তাটির কাছেই কেবল আপত্তিকর ও অমর্যাদাকর নয়, গল্পকার রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত তার মধ্যে ‘কুৎসিত শ্লেষ’ দেখতে পান। এক্ষেত্রে ‘আকবর বাদশার সঙ্গে হরিপদ কেরানির কোনো ভেদাভেদ নাই’ – রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দুখিরামেরও আশ্চর্য মিল।
ঊনবিংশ শতাব্দির বহু বিজ্ঞাপিত আলোক যে পুরুষতান্ত্রিকতার দুয়ার ভাঙতে পারেনি এ নিশ্চয় তারও প্রমাণ! খুনের ঘটনার খানিক বাদে রামলোচন এসে হাজির হলে ছিদাম যখন বউয়ের কাঁধে দোষ চাপিয়ে বাঁচবার উপায় জানতে চায় তখন রামলোচন কিন্তু ‘ভাত দেয় নি বলে দুখি খুন করে ফেলেছে’ কথাটাই থানায় গিয়ে বলার পরামর্শ দেয়। অর্থাৎ, রামলোচনের অভিজ্ঞতায় উক্ত কারণটির সামাজিক, এবং এমনকি ‘আইনি’ বিশ্বাসযোগ্যতা যে বর্তমান সেটা স্পষ্ট। ওরকম সংসারে খুনের আর্থ-সামাজিক সম্ভাব্য ও বিশ্বাসযোগ্য কারণটি যা হতে পারে সে বিষয়ে রামলোচন অবশ্যই ওয়াকিবহাল। গল্পের প্রারম্ভে গল্পকার ‘জন খাটতে যাওয়া’ দুখি-ছিদামের চিত্তবিক্ষোভের বাস্তব কারণ ব্যাখ্যাও করেছেন নিপুণতার সঙ্গে। দেখা যাচ্ছে খুনের ঘটনার ‘সত্য’ আর প্রাণ বাঁচানোর উপায় হিসেবে রামলোচনের বাতলানো ‘মিথ্যা’ একাকার হয়ে জায়গা বদল করে নিচ্ছে। গল্পের পরিণতিতেও আমরা দেখি কিভাবে ‘বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপিত মিথ্যা’ সমাজ তথা আইনের চোখেও ‘সত্যে’র মর্যাদা অর্জনে সক্ষম হয়। সে যা হোক, গল্পের উপজীব্য কিন্তু এক মর্মন্তুদ খুনের ট্র্যাজিক বাস্তবতা নয়, বরঞ্চ খুন পরবর্তী একটি মিথ্যার সূত্রে গড়ে ওঠা চন্দরা নাম্নী নারীর ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি। দাম্পত্য নামক একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্রে গড়ে ওঠা চন্দরার জীবনের এই সংকট যে আসলে সমাজ নির্দিষ্ট সেটাই দেখানোর প্রয়াস থাকবে নিবন্ধের পরবর্তী অংশে। চন্দরাই এ গল্পের প্রোটাগোনিস্ট চরিত্র। গল্পের বিন্যাস এমন যে মনে হতে পারে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্বাভাবিক নিয়মতান্ত্রিকতায় পুরুষের আধিপত্য অথবা নারীর অধীনতার বিষয়টি এখানে ‘হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ’ অবস্থায় রয়েছ। চন্দরা বুঝি পুরুষের আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক চপেটাঘাত। বস্তুত এ গল্প সম্পর্কে এরকম অভিমত ব্যক্ত করেছেন বহু বিদগ্ধ সমালোচক। গল্পের পরিণতিতে এ ধারণা গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে এক সচেতন ও সযত্ন নির্মাণ-কৌশল। গল্পপাঠের অভিজ্ঞতায় সাধারণত যেসব তথ্য আপাত গুরুত্বহীন বিবেচিত হয়ে থাকে নিবিড় পাঠে বহুক্ষেত্রে তারাই সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আপাত গুরুত্বহীন এইসব তথ্যের সাক্ষ্য থেকে প্রমাণিত হয় যে ‘শাস্তি’ গল্পে আগাগোড়া পুরুষের নিরঙ্কুশ প্রাধান্যই প্রতিষ্ঠিত। গল্পের আরম্ভেই পাঠক ‘রমণীরা সচরাচর কলহপ্রিয়’ এই প্রচারিত ধারণার অলিন্দে চন্দরাকে আবিষ্কার করেন। সন্দেহের বশে ছিদামের তাকে ঘরে দরজা বন্ধ করে আটকে রাখা, অন্যান্য খুঁটিনাটি বর্ণনা এবং চন্দরার ঘাড়ে খুনের দায় চাপানোর সপক্ষে সে যে যুক্তি দেয় ('ঠাকুর, বউ গেলে বউ পাইব, কিন্তু আমার ভাই ফাঁসি গেলে আর তো ভাই পাইব না1’) তা থেকেও পুরুষ প্রাধান্যের বিষয়টি অবিতর্কিত ভাবেই প্রতিষ্ঠিত।
এমনকি রবীন্দ্রনাথও ‘সারাদিনের শ্রান্তি ও লাঞ্ছনার পর অন্নহীন নিরানন্দ অন্ধকার ঘরে প্রজ্বলিত ক্ষুধানলে গৃহিণীর রুক্ষবচন’ শুনলে পুরুষ কর্তাটির মাথা ঠিক রাখা যে দায় তেমন অভিমতই ব্যক্ত করেছেন। ভাবটা এমন যে দুখিরামের বউ রাধা বুঝি সারাদিন পাটরানী সেজে বসে থাকার সৌভাগ্য নিয়ে ওই পরিবারে এসেছে। ক্ষুধার জ্বালা রাধাদের যেন থাকতে নেই, ‘দেড় বৎসরের ছোটো ছেলেটি কাঁদিতেছিল’ (সম্ভবত পেটের খিদেয়) - সে তথ্য সরবরাহ করা সত্ত্বেও রাধার মত নিরুপায় মায়েদের ক্ষুব্ধ হবার কারণ খুঁজে পান না মরমী রবীন্দ্রনাথ। আরো আশ্চর্যের বিষয় যে, চন্দরার ঘাড়ে দোষ চাপানোর নীচ পরিকল্পনাটিকে পর্যন্ত তিনি নিতান্ত হালকা করে ফেলার চেষ্টা করেন। এমন ভাব করেন যে ছিদাম যেন আগপিছ না ভেবে আচমকা একটা মিথ্যে কথা বলে ফেলে জালে জড়িয়ে গেছে। “... যখন নিজের স্ত্রীর নামে দোষারোপ করিয়াছিল তখন এ সকল কথা ভাবে নাই। তাড়াতাড়িতে একটা কাজ করিয়া ফেলিয়াছে, এখন অলক্ষিতভাবে মন আপনার পক্ষে যুক্তি এবং প্রবোধ সঞ্চয় করিতেছে”।
মনোযোগী পাঠকের পক্ষে এমন ওকালতি মেনে নেওয়া কষ্টকর যেহেতু বউ মরলে যে বউ পাওয়া যাবে সে বিষয়ে ছিদামের বিন্দুমাত্র সংশয় ছিল না। পুরুষের পক্ষে পুরুষের যুক্তি যেমন হওয়া উচিত এও তেমন। উল্লেখযোগ্য যে, ছিদামের পক্ষ অবলম্বন করে এ যুক্তি আসলে দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। কিন্তু তার প্রয়োজন হল কেন? হল এই কারণে যে, ‘কাজটা যে ছিদাম ঠিক করেনি’ সেকথাটা সাধারণ পাঠকের মত লেখক নিজেও জানেন এবং মানেনও। এরকম স্ববিরোধিতার উদাহরণ আরো আছে গল্পটিতে। রবীন্দ্রনাথের বর্ণনায় চন্দরা হল ‘একখানি নূতন-তৈরি নৌকার মতো’, আর ওই নূতন নৌকায় সওয়ার হয়েই দুখি-ছিদাম পাপের পাথার পাড়ি দেয়। নৌ-চালনার দায়িত্বে থাকেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এমন কোন তথ্য গল্পকার আমাদের দেননি যাতে চন্দরার চরিত্রে কোন প্রতিবাদী লক্ষণ স্পষ্ট হয়। গোসা করে মামাবাড়ি চলে গেলেও ফিরে আসতে তার দেরিও হয় না। বড় জোর চন্দরা চটপটে চালাক-চতুর মেয়ে এই পর্যন্ত ধারণায় আসে মাত্র। এই প্রেক্ষাপটে চন্দরার ‘আত্মাহুতি’ যে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ রূপে বিবেচ্য হতে পারে না তা সহজেই অনুমেয়। কাজেই ‘আদালত চন্দরাকে শাস্তি দিল না চন্দরা ছিদামকে শাস্তি দিল’ এরকম দ্ব্যর্থতার অনুসন্ধানকে কষ্টকল্পনা বলে চালানোও দুষ্কর। এ আসলে পুরুষালি জবরদস্তি ছাড়া কিছু নয়। পুরুষের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যদি মুখ্য হত তাহলে চন্দরা সরাসরি খুনের দায় গ্রহণে অসম্মতি জানাতো যা সে করেনি। চন্দরা আত্মরক্ষার প্রয়োজনে মৃত জায়ের ওপর মিথ্যে দোষারোপ করা থেকে বিরত থেকেছে মাত্র। সেটাই স্বাভাবিক, কেননা প্রতিবাদের পরিণামেই দুখির বউকে খুন হতে হয়। অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে যে খুনের দায় স্বীকার করা অব্দি চন্দরা স্বামীর নির্দেশ রাগে-দুঃখে-অভিমানে হলেও পালন করেছে। স্বামীর অনুরোধে প্রাণ বাঁচাতে মিথ্যে কথা বলেনি শুধু অভিমানের বশে। তাছাড়া রাধার সঙ্গে ‘নিত্য কলহ’ সত্ত্বেও বস্তুত সে তার চক্ষুশূল ছিল না। আদালতে ‘আমি তাকে দেখতে পারতাম না’ উক্তির অন্তর্গত তীক্ষ্ণ শ্লেষ সে সাক্ষ্যই দেয়। মৃতের ওপর মিথ্যে দোষারোপ যে আসলে ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ স্বরূপ তা জানে বলেই চন্দরার সে কাজে রুচি হয় না, আত্মরক্ষার প্রয়োজনেও না। এতদিন যে সে সব সহ্য করেও সংসারে মানিয়ে চলেছিল সে তো এজন্যই যে তার ধারণা ছিল ‘স্বামী তাকে ভালবাসে’। কিন্তু ভালবাসার কল্পিত সৌধটি এক লহমায় চৌচির হয়ে যেতে দেখে বেঁচে থাকাটাই চন্দরার কাছে অর্থহীন হয়ে পড়ে। ছিদামরূপী তার একান্ত পুরুষটির ভালবাসার কপটতা উপলব্ধি করে স্বভাবতই চন্দরা ভেতরে ভেতরে অভিমানে ফেটে পড়ে, আত্মরক্ষার চেষ্টা পর্যন্ত করে না। ফাঁসির আগে ছিদামের সঙ্গে দেখা করতেও অস্বীকার করে সেই অভিমানবশতই। তখন সে ‘স্বামী রাক্ষসের’ হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেও চায় না। পিতৃতান্ত্রিকতার নিগড়ে বাঁধা জীবনে পারিবারিক চৌকাঠ ডিঙানোর সামর্থ্যহীন অনন্যোপায় নারীর পক্ষে ওই পরিস্থিতিতে মৃত্যু ছাড়া পরিত্রাণের অন্য পথ দৃষ্টিগোচর হয় না। খুব সচেতনভাবে না হলেও ওই ‘স্বামী রাক্ষস’ শব্দটির ব্যবহার বলে দেয় যে নারীর ওপর স্বামী-পুরুষের নির্যাতন বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ অনবহিত ছিলেন না। রামায়ণের কাল হলে চন্দরার ‘পাতাল প্রবেশ’ ছাড়া গতি ছিল না। শেষবারের মত মা-কে দেখতে চাওয়াও সে হিসেবে অর্থবহ – ‘ধরণী দ্বিধা হও’ বলার পরিস্থিতি নেই বলেই হয়ত গর্ভধারিণীর কোলে মুখ লুকোনোর আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছে সে। গল্পকার রবীন্দ্রনাথ তাঁর অসাধারণ নির্মাণ কুশলতায় চন্দরাকে ‘মহিয়সী’ করে গড়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন পুরুষ-প্রাধান্যের স্বার্থেই, কারণ গল্পের পরিশেষের নাটকীয় মোচড় সত্ত্বেও বস্তুত চন্দরার মৃত্যুবরণের মধ্য দিয়ে পিতৃতন্ত্রের স্বার্থই চরিতার্থতা লাভ করে। গল্পের সমাপ্তির যে আপাত দ্ব্যর্থবোধকতা তার ধরন অবশ্যই রক্ষণাত্মক। সাধারণ পাঠকের এমন মনে হতেই পারে যে চন্দরা বুঝি নিজেই মৃত্যুকে বেছে নিয়েছে। আর তাই যদি হয় তো আদালতের মৃত্যুদণ্ড প্রদান অর্থহীন ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। স্বেচ্ছায় যে মৃত্যুবরণ করে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া কি আদালতের পক্ষেও সম্ভব? এই অনুচ্চারিত যুক্তি-পরম্পরার অবলম্বন ব্যতিরেকে গল্পের পরিসমাপ্তি পাঠকের কাছে গৃহীত হবার যোগ্যই নয়। বলা বাহুল্য, এই প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হলে একথাও মেনে নিতে পাঠক বাধ্য হন যে চন্দরার মধ্যে আসলে এক অসাধারণ ‘আত্মশক্তি’, প্রায় ঐশ্বরিকও বলা চলে, রয়েছে যার জোরে সে মৃত্যুকেও স্বেচ্ছায় আলিঙ্গন করতে পিছপা হয় না। অর্থাৎ, চন্দরা সামান্য নারীমাত্র নয়। কিন্তু চন্দরা সে শক্তি পাবে কোথায়? তার সামাজিক প্রেক্ষিত ও অবস্থান তাকে সে সামর্থ্য অর্জনের সুযোগ দেয় না, দিতে পারে না। আর দিতে পারে না বলেই লেখক রবীন্দ্রনাথ চন্দরাকে সে সুযোগ করে দেন। অর্থাৎ, নিজের ইচ্ছায় নয়, চন্দরাকে মরতে হয় তারই স্রষ্টার অভিপ্রায়ে।ঘোমটা ঈষৎ ফাঁক করে বাইরের যা কিছু এক লহমায় দেখে নেবার তৎপরতার মধ্যে যে জীবনাসক্তি ব্যক্ত তা থেকে এও তো স্পষ্ট যে চন্দরা (তার স্রষ্টার মতই) এমন অনায়াসে ‘মরিতে চাহে না’, যদিও তার ভুবনটি তার স্রষ্টার ভুবনের মত নিপাট সুন্দর নয়। কিন্তু তবু তাকে মরতে হয়? এই অন্যায় শাস্তি চন্দরাকে কেনই বা দিতে চান গল্পকার? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যাবার আগে একটু অন্য কথা বলে নেওয়া যাক।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটিকে রবীন্দ্রনাথ সামাজিক-রাজনৈতিক ও আইনি প্রেক্ষিতে বিন্যস্ত করেছেন। এবং সেই প্রেক্ষিতেও নির্দোষ চন্দরার জীবনের বাস্তবতা ও সত্যের আবেদন সামাজিক অথবা আইনি ন্যায়ের প্রতিষ্ঠানের অসাড় অঙ্গে সামান্য সাড়া জাগাতেও সক্ষম হয় না। পক্ষান্তরে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের সাবেক স্বার্থ ও আধিপত্যই রক্ষিত হয় – যাকে দেখা হয় ‘পারিবারিক মর্যাদা’ রূপে। আর এরই জন্য উৎসর্গিত হয় চন্দরা। (আধুনিক গণমাধ্যমের ভাষায় honour killing ছাড়া আর কী-ই বা বলা যাবে একে!) এমন কি দুখিরামের স্বীকারোক্তি পর্যন্ত গ্রাহ্য হয় না, বরং আইনের অন্ধদৃষ্টি তার মধ্যে ঘরের বউকে রক্ষা করার পুরুষ-সুলভ বদান্যতা কিংবা মহানুভবতা খুঁজে পায়! পাবে নাই বা কেন, পুরুষের ‘রক্ষক’ ইমেজটি বজায় রাখার দায়িত্ব যে আইনের হাতে অর্পিত। আর একারণেই দুই উকিলের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে চন্দরার পক্ষে দাঁড়ানোর বিষয়টি সামান্য গুরুত্ব পর্যন্ত পায় না গল্পে, আদালতে! অথচ এর থেকে প্রমাণ হয় যে (গল্পকারের ঘোষণা অনুযায়ী) গাঁ-সুদ্ধ সকলেই একবাক্যে চন্দরাকে ‘খুনি’ সাব্যস্ত করেনি। সমালোচকরা তো ঘটনাটি লক্ষ্য অবধি করেন না। উকিল নিয়োগের সামর্থ্য না থাকা অভিযুক্তের জন্য দুজন উকিল যোগাড় করে দিয়ে গল্পকার হয়ত সামাজিক ও সরকারি ভদ্রতাটুকু বজায় রাখতে চেয়েছেন। এর থেকে এটাও স্পষ্ট হয় যে গল্পের পেছনের পরিকল্পনাটি ছিল ‘ঠাণ্ডা মাথায় খুন করার মত’ আগাগোড়া নিখুঁত।
এদেশে এক কালে সতীদাহ প্রথা ছিল, সহমরণে যাবার জন্য অনুপ্রেরণা যোগানো হত। তারই এক আধুনিক নয়া সংস্করণ ও সম্প্রসারণ যেন দেখতে পাই চন্দরার আত্মবিসর্জনের মূলে। হিন্দুত্বের ধারাটি যদি সযত্নে লক্ষ করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে এদেশে অনিবার্য বিপর্যয়কালে দেশ-জাতি-সমাজ-পরিবারের মর্যাদা রক্ষার দায় চিরকাল নারীর কাঁধে বর্তেছে, চূড়ান্ত আত্মত্যাগের গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়েছে নারীর ওপর। সতীপ্রথা কিংবা জহর ব্রত ইত্যাদিকে মহিমান্বিত করার প্রচেষ্টা ও প্রবণতা সেই সত্যের ঐতিহাসিক সাক্ষ্য বহন করে। উনিশ শতকের নায়করা নানা সামাজিক সংস্কারের মাধ্যমে নারীর ‘স্বাধীনতার গণ্ডি’ কিছু পরিমাণে বৃদ্ধি করার প্রয়াসী হয়েছিলেন যদিও, কিন্তু তাতে পুরুষের নিয়ন্ত্রণ যাতে অটুট থাকে সে বিষয়েও পূর্ণ সজাগ থেকেছেন। এর ফলে নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বিষয়ক পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা কিছু পরিমাণে জটিল রূপ ধারণ করে। উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক-রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিতে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার যে পুনর্বিন্যাস ঘটে তার ফলে জাতীয়তবাদী ধ্যান-ধারণায় নারীর সামাজিক অবস্থান ও ভূমিকা নির্ধারণের প্রশ্নে দেখা দেয় দ্বিমুখী বৈপরিত্য। সামাজিক-সাংস্কৃতিক পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে লিঙ্গভিত্তিক বিভাজন এবং নারীর স্থান নির্দেশের এলাকা ভিত্তিক যে আদলটি তৈরি হয় তাকে ঘর/বাহির (অথবা বিশ্ব), আধ্যাত্মিক/বস্তুতান্ত্রিক, ব্যক্তিগত/সাধারণ, পূর্ব/পশ্চিম এবং নারী/পুরুষ এই দ্বিধা-বিভক্তি হিসাবে সনাক্ত করেছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মত বিদগ্ধ ঐতিহাসিক ও সমাজতত্ত্ববিদরা। নারীর শারীরিক আবদ্ধতা (পর্দা প্রথা ইত্যাদি) মোচনের পক্ষে ওকালতি করে স্ত্রীশিক্ষার দৌলতে নারীকে ‘সক্ষম স্বাধীন’ করে তোলার উনিশ শতকীয় প্রস্তাবনার মধ্যে খাঁচাটাকে বৃহদায়তন ও তত্ত্বগত ভাবে গ্রহণীয় করে তোলাই যে মুখ্য ছিল তা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন বিভিন্ন আধুনিক গবেষক। এক্ষেত্রে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) শব্দটির এক সংকুচিত ভারতীয় তাৎপর্য নিরূপণ করে পাশ্চাত্যের ধারণা থেকে পৃথকীকরণের প্রয়াসও লক্ষণীয়। পাশ্চাত্যের ‘ফ্রীডম’ এদের বিচারে ‘যথেচ্ছাচার’, আর প্রাচ্যে তার অর্থ ‘অহং’ থেকে মুক্তি – অর্থাৎ, স্বেচ্ছা-অধীনতা। এই অনৈতিহাসিক বিচার-বিবেচনার দরুণ ঘরের বাইরে বহির্বিশ্বে নারীর বিচরণ সে পর্যন্তই অনুমোদিত হয় যে পর্যন্ত নারীর সনাতনী ‘সর্বং সহা’ কল্যানী মূর্তিটি আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে চূর্ণ না হয়। ঔপনিবেশিক শাসনের সঙ্গে সমঝোতা ও আপোষের ফলে পাশ্চাত্যের চিন্তা-চেতনা যে পরিমাণে সাঙ্গীকৃত হয়েছে উনিশ শতকের বাঙালির পিতৃতান্ত্রিক মননে, প্রতিক্রিয়ায় সে অনুপাতেই দেখা দিয়েছে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণের এক অনৈতিহাসিক, অসুস্থ ও রক্ষণশীল প্রবণতা। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরাধীনতার বিপ্রতীপে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে ‘অন্তর্লোকের স্বাধীনতা’ অটুট রাখার ছদ্মতৃপ্তি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে সমাজ সংস্কারকদের। জাতীয় মর্যাদার এই অন্তর্জগতেই (inner domain) হয় নারীর নয়া সংস্থান - স্ত্রী-ধর্ম পালনই যেখানে মুখ্য ও মোক্ষ স্বরূপ। আর এই মর্যাদা রক্ষার কল্পযুদ্ধে বলিপ্রদত্ত চন্দরারা যেন ‘মৃত্যুর নৈবেদ্য গেনু রাখি’ বলে ক্রমাগত অতলে তলিয়ে যেতে থাকে। স্মর্তব্য যে, ‘মুক্তি’ কবিতার নায়িকাও সংসারের অবজ্ঞা অবহেলার হাত থেকে রেহাই পেতে মৃত্যুর মধ্যেই মুক্তি খুঁজেছে। নির্যাতিত নারীর নিরুপায় মৃত্যুবরণকে মহিমান্বিত করার এক নিরুপদ্রব প্রয়াস এবং প্রবণতা রবীন্দ্রসাহিত্যের অন্যত্রও বর্তমান। কেবল তাই নয়, রমাবাইয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো রবীন্দ্রনাথ তার জন্য তাত্ত্বিক ভিতও নির্মাণ করেন সচেতন ভাবে, অসাধারণ সতর্কতায়। পাঠক, এই উদ্ধৃতিটি লক্ষ্য করুন- “পূর্বকালে মেয়েরা পুরুষের অধীনতা গ্রহণকে একটা ধর্ম মনে করত তাতে এই হত যে, চরিত্রের ওপর অধীনতা কুফল ফলাতে পারত না, অর্থাৎ হীনতা জন্মাত না, এমনকি অধীনতাতেই চরিত্রের মহত্ত্ব সম্পাদন করত। প্রভুভক্তিকে যদি ধর্ম মনে করে তাহলে ভৃত্যের মনে মনুষ্যত্বের হানি হয় না ।” (রমাবাইয়ের বক্তৃতা উপলক্ষে পত্র/পরিশিষ্ট,রবীন্দ্ররচনাবলী) চন্দরার চরিত্রে এই মহত্ত্বই রবীন্দ্রনাথ আরোপ করতে চেষ্টা করেছেন। স্বামী প্রভুর প্রতি ভক্তিধর্মে অচল থেকে স্ত্রী-ভৃত্যের মৃত্যুবরণে যে ‘মনুষ্যত্বের হানি হয় না’ বরং উজ্জ্বলতা বাড়ে এই বক্তব্যটি প্রতিষ্ঠার জন্যই নিপুণতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ চন্দরাকে সৃষ্টি করেন। কেননা তাঁর আজন্ম বিশ্বাস - “সাধ্বী স্ত্রীর প্রতি যদি কোনো স্বামী পাশব ব্যবহার করে, তবে সে-ব্যবহারের দ্বারা স্ত্রীর অধোগতি হয় না, বরং মহত্ত্বই বাড়ে। কিন্তু যখন একজন ইংরেজ পাখাটানা কুলিকে লাথি মারে তখন তাতে করে সেই কুলির উজ্জ্বলতা বাড়ে না।” (ঐ) নির্মাণের দিক থেকে অতুলনীয় হওয়া সত্ত্বেও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির দরুণ গল্পটি শেষ পর্যন্ত নারীর নিয়ন্ত্রিত মুক্তির উনিশ শতকীয় প্রয়াসের আড়ালে পিতৃতান্ত্রিক শৃঙ্খলটিকে আধুনিক সাংস্কৃতিক সাজ পরানোর পরিকল্পনার বিশ্বস্ত ঐতিহাসিক নিদর্শন হয়ে থাকে মাত্র। পিতৃতন্ত্রের কাছে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ শব্দশিল্পীর এই আত্মসমর্পণ, সে যে কারণেই হোক না কেন, চন্দরার আত্মাহুতির চাইতে কম বেদনাদায়ক নয় - অন্তত বাঙালি পাঠকের কাছে!
1 টি মন্তব্য:
আপনিতো ভাবিয়ে তুললেন, মৃণ্ময়দা। লেখাটা অবশ্য আগেও পড়েছি। এখন, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে ভাবতে বসলে এর আলোকে নতুন করে রবীন্দ্রনাথ পড়ব।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন