“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২২

ফুলমতি


 ।। শৈলেন দাস ।।

(C)Image:ছবি

 

লকডাউন শেষ হয়েছে সবেমাত্র। স্কুল খুলে ক্লাসও শুরু হয়েছে যথারীতি কিন্তু ছাত্র ছাত্রীর উপস্থিতি এখনও কম। এমনই এক শনিবারে কমন রুমে বসে কৃষ্ণ রায় স্যার প্রস্তাব করলেন, স্কুল ছুটির পর সবাই মিলে কোথাও ঘুরতে গেলে কেমন হয়? সিনিয়র টিচারদের কেউই আগ্রহ দেখালেন না। তবে সদ্য চাকরি পাওয়া টেট শিক্ষক তিনজন সৌরিন সেন, দিব্যজ্যোতি শর্মা এবং শিবাজী দেব স্যারের প্রস্তাবে সোৎসাহে রাজি হয়ে গেল। শিবাজী শিলচরেরই ছেলে। সৌরিনের বাড়ি লক্ষীপুর এবং দিব্যজ্যোতি বর্হিবরাক থেকে এসেছে।  দুজনেই শিলচরে ভাড়া বাড়িতে থাকে। আলোচনা করে ঠিক হল চাতলা হাওর দেখতে যাবে তারা। সেই অনুযায়ী কৃষ্ণ রায় স্যার তার পরিচিত  ড্রাইভার হরিকে ফোন করল দুইটার মধ্যে এসে তাদেরকে নিয়ে যেতে। এর আগে স্কুল ছুটি হলে তারা হোটেলে লাঞ্চ সেরে নেবে।

        আসাম ইউনিভার্সিটির পশ্চিমাঞ্চল জুড়ে থাকা বিস্তৃত জলাভূমি হল চাতলা হাওর। শিলচর থেকে রওনা হয়ে শিলকুড়ি ক্যাম্পের বাজার এলাকা থেকে পশ্চিম দিকে যাওয়া রাস্তাটি দিয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতেই তারা ঢুকে পড়ল হাওর এলাকায়। কৃষ্ণ রায় স্যার জানালেন এই হাওর এলাকা তার অত্যন্ত প্রিয়। এখানকার জল, বায়ু, মাটির একটা আলাদা আমেজ আছে। হাওরের গ্রামগুলিতে কৈবর্ত সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের বাস। এরই মধ্যে গাড়ি লালমাটি পেরিয়ে এসে বৈরাগীটিলার কাছে ঢাউস উঁচু এক ব্রিজের সামনে থামল। ব্রিজ বানানো সম্পূর্ণ কিন্তু তৈরি হয়নি অ্যাপ্রোচ তাই স্থানীয় জনগণের কোন কাজেই লাগছে না এটি বরং অভিশাপ হয়ে যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে বহু কাল। ড্রাইভার বলল – স্যার গাড়ি আর এগোবে না, আপনারা পায়ে হেঁটে হাওর ঘুরে আসুন আমি অপেক্ষা করি এখানে।' দিব্যজ্যোতি কিছুটা সংকোচের সাথে বলল – ‘অপরিচিত মানুষ দেখে স্থানীয়রা আমাদেরকে ডিস্টার্ব করবে না তো?’ হেসে ফেলল হরি। বলল- ‘স্যার, এখানকার মানুষজন এরকম নয়। আপনারা নিশ্চিন্তে ঘুরে আসুন, অসুবিধা হলে আমাকে ফোন করবেন।' সৌরিন নিশ্চিত হতে বলল – ‘তুমি কি এখানকার মানুষজনকে চেনো?' হরি জানাল, সে এখানকার মাটি এবং মানুষেরই অংশ। 

          ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে তারা। বৈরাগী টিলার পশ্চিমাংশে ঢালু জমিতে সারিসারি হিজল গাছ। কৃষ্ণ রায় স্যার উনার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে সবকিছু বর্ণনা করে যাচ্ছেন এবং আগ্রহভরে শুনছে দিব্যজ্যোতি ও সৌরিন কিন্তু শিবাজী কিছুটা আনমনা হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কৃষ্ণ রায় স্যার লক্ষ্য করেছেন ব্যাপারটি। শিবাজীর  নজর যেন কিচ্ছু একটা খুঁজছে যা এই হাওরের প্রকৃতির অংশ নয় অথচ তা এখানেই রয়েছে। যাই হোক, কথা বলতে বলতে ধান ক্ষেতের আল ধরে এগিয়ে চলেছেন সবাই এবং কিছুক্ষণের মধ্যে হরিণটিলা পেরিয়ে হাওরের মাঝ বরাবর এসে গেছেন তারা। কৃষ্ণ রায় স্যার লক্ষ্য করলেন হাওরে এখন বুরো ধানের চাষ অনেকটা কমে এসেছে। চাষীরা নিজেদের ক্ষেতের মাটি খুঁড়ে চারপাশে বাঁধ দিয়ে ছোট ছোট ফিশারি তৈরি করে ফেলেছে এবং বাঁধের উপর লম্বা লম্বা বাঁশ পুঁতে রেখেছে। একটি ফিশারির এক কোণে খুব উঁচু মাচাতে ছোট্ট একটি ঘর দেখে সৌরিন জানতে চাইল, এটা আবার কী? কৃষ্ণ রায় স্যার বললেন – ‘সম্ভবত হাওরে জল বাড়লে বাঁশগুলিতে জাল বেঁধে ঘিরে রেখে মাছ চাষ করা হয় এবং রাতে ওই ঘরে থেকে ফিশারী পাহারা দেয় জেলেরা।' এবার মুখ খুলল শিবাজী। জানতে চাইল, ‘এত জলে নেমে ওরা কিভাবে মাছ চাষ করে? ভয় হয় না ওদের?’ কৃষ্ণ রায় স্যার বললেন – ‘জলের সাথে কৈবর্তদের আত্মার যোগ রয়েছে। ওরা জলে নামলে ঐশ্বরীয় গুণের অধিকারী হয়ে ওঠে যেন!'

           শহুরে জীবন থেকে দূরে হাওরের প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়ার কিছু মুহূর্ত মোবাইলে ক্যামেরাবন্দি করল দিব্যজ্যোতি। ততক্ষণে সূর্য পশ্চিম দিকে হেলতে শুরু করেছে। তাই আর দেরি করা যাবেনা। কৃষ্ণ রায় স্যার বললেন – ‘চল তাড়াতাড়ি এগুই। নয়ত ক্ষেতের আল ধরে হাঁটতে অসুবিধা হবে।' তারা গাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। দূর কোথাও থেকে মাইকে পদ্মপুরাণ পাঠের আওয়াজ ভেসে আসছে। গাড়ি যত শিলকুড়ির দিকে এগোচ্ছে ততই পদ্মপুরাণ পাঠের আওয়াজ ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। মেয়েলি কন্ঠে এমন করুণ সুরে পাঠ করছে, শুনে মনে হচ্ছে দেব সভায় লক্ষ্মীন্দরের প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বেহুলার করুণ ক্রন্দন যেন স্বর্গ থেকে ভেসে আসছে। কিছু স্বর মানুষের হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দেয় যেমন ঠিক তেমনি সেই করুণ সুর সবার মনকেই ছুঁয়েছে এবং শিবাজীকে কেমন যেন অনেকটা অস্থির করে তুলেছে, এই স্বর তার অতি পরিচিত। সে অনেকটা কাতর স্বরে বলল – ‘স্যার, চলুন না পুজো বাড়িতে একবার যাই।' হাওরে আসার সময় তারা খেয়াল করেনি, সন্ধ্যা হতেই এখন বোঝা যাচ্ছে যে লালমাটি গ্রামের পুজো বাড়িটি বেশ সুন্দর লাইটিং করে সাজানো হয়েছে। ড্রাইভার হরি বলল – ‘স্যার, এই গ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তি বিশু দাস তার মানত পূরণের জন্য এ বছর বিশেষভাবে মনসা পূজার আয়োজন করেছেন। পুরো হাওর এলাকার সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছেন। আপনারা গেলেও খুব খুশি হবেন।' কৃষ্ণ রায় স্যার বললেন – ‘তোমার পরিচিতি আছে তো?' স্যারের কথা শেষ হতে না হতেই শিবাজী বলে উঠল, পরিচিতি না থাকলেও চলুন না একবার যাই।

হরির সাথে অপরিচিত তিনজন ব্যক্তিকে পুজো বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখে গৃহকর্তা বিশু দাস হাতজোড় করে এগিয়ে আসলেন তাদের অভ্যর্থনা জানাতে। হরি বলল – ‘দাদা, ওনারা শিলচর থেকে এসেছেন হাওর দেখার জন্য। আপনার বাড়িতে পূজা হচ্ছে দেখে আসতে চেয়েছিলেন তাই আমি নিয়ে এলাম।' বিশু দাস বেশ খুশি হয়ে বললেন – ‘এ তো আমার পরম সৌভাগ্য। এমন শুভ দিনে আমার বাড়িতে স্যারেরা এসেছেন এ এক পরম পাওনা।' এরই মধ্যে একটি মেয়ে একটি থালাতে চারটি নতুন লাল গামছা নিয়ে এসেছে। বিশুবাবু প্রথমে কৃষ্ণ রায় স্যারকে তারপর এক এক করে সবাইকে গামছা দিয়ে বরণ করে বাড়ির ভিতর নিয়ে গেলেন।

বাড়ির সমস্ত উঠান জুড়ে প্যান্ডেল বানানো হয়েছে। পূর্ব দিকে মুখ করে মায়ের মূর্তি বসানো, তার ডানপাশে সারি সারি চেয়ারে বসে আছেন গ্রাম্য মুরুব্বিরা এবং বাঁদিকে মাটিতে পাতানো মাদুরে বসে মহিলারা পাঠ করছেন পদ্মপুরাণ। আসরের মধ্যমণি যে মেয়েটি সুললিত কন্ঠে পদ্মপুরাণ পাঠ করে সবাইকে বিমোহিত করে চলেছে তাকে দেখেই শিবাজীর বুকের ভিতর তোলপাড় শুরু হয়েছে। কৃষ্ণ রায় স্যার গ্রামের মানুষজনের সাথে বেশ খুশ মেজাজে গল্প শুরু করেছেন, সৌরিন এবং দিব্যজ্যোতিও চেয়ারে বসে বেশ উপভোগ করছে পুজো বাড়ির পরিবেশ কিন্তু শিবাজী যেন কিছুটা বিমর্ষ। নিবিষ্ট মনে যে পদ্মপুরাণ পাঠ করছে সে কি একবারও তাকাবে না তার দিকে?

          পাঁচ বছর আগের ঘটনা। শিলচর বিটি কলেজের প্রবেশপথের সামনে বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়ে সিগারেটে সুখ টান দিচ্ছিল শিবাজী। এমন সময় একটি মেয়ে এসে  জিজ্ঞেস করল – ‘বলতে পারবেন ফার্স্ট সেমিস্টারের ক্লাসটা কোন দিকে?' শিবাজী লক্ষ্য করল মেয়েটি দেখতে একদমই সাদামাটা। পরনে সিম্পল একটি চুড়িদার, গায়ের রং শ্যামলা তবে চোখেমুখ বেশ সুশ্রী এবং মোটামুটি স্বাস্থ্যবতী। সে একদমই গুরুত্ব না দেওয়ার মত করে বলল- ‘সোজা ভেতরে চলে যাও, নতুন বিল্ডিংয়ের শেষ রুমে।' মেয়েটি চলে যেতেই বন্ধুরা বলল- ‘এ কী রে? ফ্রেসার্সদের এভাবে ছেড়ে দিলে চলে? একটু আধটু জ্বালিয়ে নিলে হত না?' শিবাজী বলল – ‘বাদ দে তো, এই মেয়েকে আবার কী জ্বালাব?'

             দুদিন পর শিবাজী তার ক্লাসের দরজার সামনে  দাঁড়িয়ে আছে এমন সময় মেয়েটি এসে বলল – ‘আমি ফুল, মানে ফুলমতি দাস। আমার লেট এডমিশন হয়েছে তাই অনেকগুলো ক্লাস মিস হয়ে গেছে। নতুন ক্লাসের কারও সাথে সেভাবে চেনাজানা হয়নি। তাই নোটস পাচ্ছিনা। আপনার নিশ্চয়ই ফার্স্ট সেমিস্টারের নোটসের খাতাগুলি রয়ে গেছে। যদি আমাকে দিয়ে সাহায্য করেন তবে আমার খুব উপকার হয়।' মেয়েটির আত্মবিশ্বাস এবং কথা বলার ধরন দেখে শিবাজীর খুব ভাল লাগল। সে বলল – ‘পুরনো খাতাপত্র এই মুহূর্তে কোথায় আছে আমাকে খুঁজে দেখতে হবে। বাই দা ওয়ে, তোমার সাথে আমার চেনা নেই জানা নেই তাহলে আমি তোমাকে নোটস দেব কেন?' ‘মানুষের উপকার করতে হলে চেনাশোনা হতে হয় বুঝি? তাছাড়া আমি তো বললাম আমার নাম ফুলমতি এবং আমি যে ফার্স্ট সেমিস্টারের ছাত্রী সে কথা তো প্রথম দিনই বলেছি। পুরনো কিছু নোটস দেওয়ার জন্য এই পরিচয়টুকু কি যথেষ্ট নয়?' বলেই ভুরু নাচালো সে। হেসে দিল শিবাজী। বলল, ‘ঠিক আছে আমাকে দুই দিন সময় দাও।’

ক্লাস থেকে শিবাজীর সহপাঠীরা বিষয়টি বেশ উপভোগ করছিল। ফুলমতি চলে যেতেই একজন এসে বলল – ‘কী ব্যাপার শিবাজী? ফুলের সুবাসে তুমি যেন বিমোহিত মনে হচ্ছে।' শিবাজী বলল – ‘তোরা পারিসও বটে। তিলকে তাল বানানো বাদ দে তো।' বলেই সরে পড়ল সেখান থেকে। দুদিন পরে শিবাজী নোটস এনে দিল ফুলমতিকে এবং তারপর থেকে দেখা হলেই ওদের মধ্যে সামান্য কথাবার্তা হত। এই দেখে শিবাজীর বন্ধুরা বলাবলি করতে লাগল-- ‘এই ফুল মনে হয় শিবের জন্যই ফুটেছে।' ওরা শিবাজীকে উৎসাহ দিতে থাকল যে ফুলমতি নিশ্চয়ই তাকে ভালবাসে। সে যেন আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি প্রপোজ করে ফুলকে। প্রস্তাবটা শিবাজীরও মনে ধরেছে। এই কয়দিনের মেলামেশায় মেয়েটি তার মনে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। দুয়েকদিন চিন্তাভাবনা করে সে ঠিক করল, ফুলমতিকে প্রস্তাবটা দেবে সে। কিন্তু সমস্যা হল ফুলমতি কয়েকদিন থেকে কলেজেই আসছে না।

         প্রায় এক সপ্তাহ পর ফুলমতি কলেজে এসেছে। শিবাজী কলেজের গেটের সামনেই দাঁড়ানো ছিল। সে ফুলমতির কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল- ‘ফুল তোমার সাথে একটি কথা ছিল, খুবই পার্সোনাল।' ফুলমতি ক্লাসের দিকে যেতে যেতে বলল – ‘বলতে হলে এখনই বলুন? কলেজ ছুটির পর আমি কিন্তু দাঁড়াতে পারব না।' শিবাজী পিছন থেকে অনেকটা তোতলানোর মত করে বলল – ‘আ-মি তোমাকে ভাল-বাসি ফুল।' পিছনে ফিরে তাকায়নি ফুলমতি, প্রত্যুত্তরে শুধু বলল- ‘আমি সিগারেট খাওয়া পছন্দ করি না।' কী কথার কী উত্তর! কিছুটা রেগে গেল শিবাজী। কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে ফুলমতির পথ আগলে দাঁড়াল সে। বলল – ‘যা বলার স্পষ্ট করে বল, আমার সাথে হেঁয়ালি করছ কেন?' ফুলমতি বলল – ‘হেঁয়ালি করব কেন? আপনার মনের অনুভূতি আপনি প্রকাশ করেছেন। আমিও আমার পছন্দের কথা জানিয়েছি।' ‘এর মানে আমাকে তোমার পছন্দ নয়, তাই তো?’ রাগত স্বরে বলল শিবাজী। ফুলমতি ম্লান হেসে উত্তর দিল – ‘আমি তো তা বলিনি।' তারপর আর দাঁড়ায়নি শিবাজী, সোজা বেরিয়ে গেল কলেজ থেকে। ফুলমতি একটি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে রওনা দিল ক্লাসের দিকে।

            সেদিনের পর থেকে ফুলমতি আর কলেজে আসেনি। অভিমানী শিবাজীও তার ভালোলাগা ফুলের কোনও খোঁজ করেনি। কয়েকবার ভেবেছিল আইরংমারায় গিয়ে স্থানীয় পুরনো বন্ধুদের নিয়ে খোঁজ করবে ফুলমতির। কিন্তু নানা অসুবিধার কারণে তা আর করা হয়ে ওঠেনি। কথা প্রসঙ্গে  একদিন ফুলমতি বলেছিল তার বাড়ি আইরংমারার আশেপাশেই চাতলা হাওরের কোন এক গ্রামে। তাই আজ কৃষ্ণ রায় স্যার যখন চাতলা হাওরে ঘুরতে আসার কথা বললেন শিবাজী তেমন আগ্রহ না দেখালেও মনে মনে কিন্ত একটা আশা পোষণ করেছিল এবং তা যে সত্যি সত্যি ফলে যাবে এ কথা সে কল্পনাও করেনি।

পূজো বাড়িতে মেয়েদের পদ্মপুরাণ পাঠে সাময়িক বিরতি, এখন পুরুষেরা পাঠ করতে বসবে। এরই মাঝে শিবাজীদের প্রসাদ খাওয়া হয়ে গেছে। কৃষ্ণ রায় স্যার বললেন – ‘তোমরা একটু বসো, আমি ওদের সাথে একটা প্যারা অন্তত পড়ে যাই। অনেকদিন হয়েছে এরকম আসরে পদ্মপুরাণ পাঠ করার সুযোগ হয়নি।' সৌরিন বলল – ‘আপনি পাঠ করুন স্যার আমরা শুনতে আগ্রহী।' দিব্যজ্যোতিও মাথা নেড়ে সায় দিল। এমন সময় ছোট্ট একটি মেয়ে এসে শিবাজীকে বলল, ‘আপনি আমার সাথে আসুন, ফুল দিদি আপনাকে ডাকছে।’  শিবাজী যেন আগের থেকেই প্রস্তুত ছিল। একটুকুও সময় নষ্ট না করে সে মেয়েটির পিছে পিছে বেরিয়ে আসল প্যান্ডেলের বাইরে। দিব্যজ্যোতিদের জানানোর কথাও খেয়াল  হয়নি তার।

           বিশুবাবুর পাশের একটি বাড়িতে গিয়ে ঢুকল শিবাজী। একজন বয়স্ক মহিলা একটি বিছানার এককোণে বসে আছেন, তার পাশেই ভিতর ঘরের দরজাতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফুলমতি। শিবাজীকে চেয়ারে বসতে বলে বয়স্ক মহিলা জিজ্ঞেস করলেন – ‘দাদা ভাই, তুমি নাকি আমার ফুলের সহপাঠী ছিলে? বুঝতেই তো পারছ, গ্রামাঞ্চলে মেয়েরা বাইরের মানুষের সাথে কথা বলতে সংকোচ করে তাই তোমাকে এখানে ডেকে আনলাম। তুমি খারাপ পাওনি তো?' শিবাজী বলল – ‘না না, খারাপ পাব কেন? বরং আমিও তো সুযোগ খুঁজছিলাম ফুলের সাথে কথা বলতে।' ফুলমতি সজল নয়নে থাকিয়ে ছিল শিবাজীর দিকে। বলল – ‘আপনি আমাকে খুব খারাপ পেয়েছিলেন, না?' শিবাজী তার কোন উত্তর না দিয়ে জানতে চাইল ফুলমতি কলেজ ছেড়েছিল কেন। এর জন্য কি সে-ই দায়ী?

            ফুলমতির বাবা ধূমপান করতেন খুব বেশি। তাই টিবি রোগে ভুগছিলেন তিনি। যেদিন শিবাজী ফুলমতিকে প্রপোজ করেছিল তার আগের এক সপ্তাহ মূমুর্ষূ বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে কাটিয়ে এসেছিল সে। তখনই ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন উনি আর বাঁচবেন না। তাই বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছিল উনাকে। সেদিন কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে এসে দেখে তার বাবা চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তারপর নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ফুলমতিকে বিএড পড়া বাদ দিতে হয়েছিল। তবে সে এনআইওএস থেকে ডিএলএড করে নিয়েছে এবং বর্তমানে ইউপি লেভেলের টেট দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি শিলকুড়িতে একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করছে। তাদের গ্রাম থেকে স্কুলটি অনেক দূর তাই এখানে মামার বাড়িতে থাকে সে।

          বেশিক্ষণ কথা বলতে পারেনি ওরা। এরই মধ্যে দিব্যজ্যোতি ফোন করেছে, তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে তাদের। ফুলমতির মোবাইল নম্বরটি নিজের মোবাইলে সেভ করে ঘর থেকে বের হতে যাবে শিবাজী এমন সময় বয়স্ক মহিলা পেছন থেকে ডাকল – ‘দাদা ভাই, একটু দাঁড়াও। এই উপহারটি আমার ফুল দিদি তোমার জন্য অনেক আগেই তৈরি করেছিল। এটা তুমি নিয়ে যাও।' ছোট্ট একটি কাপড়ের টুকরো, হাতে নিতেই বুঝা গেল এতে সুতার কাজ করা। সম্ভবত রুমালই হবে। শিবাজী আর সেটা খুলে দেখে নি, বেরিয়ে পড়ল তাড়াতাড়ি।

            গাড়িতে উঠে রুমালটি খুলে দেখল শিবাজী। তাতে ছোট্ট একটি টিয়া পাখির নক্সা আঁকা, নীচে লেখা ‘যাও পাখি বল তারে; সে যেন ভুলে না মোরে'। শিবাজীর মনটা মোচড় দিয়ে উঠল। সে উপলব্ধি করল, সামাজিক রক্ষণশীলতার কারণে প্রান্তিক সমাজের মেয়েরা নিজের বিরহ বেদনা প্রকাশ করতে পারেনা, তাই পদ্মপুরাণের বেহুলার বিলাপই হয়ে ওঠে তাদের নিজস্ব ক্রন্দন। ফুলমতির প্রতি তার ভালবাসা কয়েক গুণ বেড়ে গেল। ঝাপসা হয়ে আসল তার চোখ। এমন সময় কৃষ্ণ রায় স্যার বলে উঠলেন- ‘কী বল শিবাজী, হাওরের মাটি, মানুষ এবং তাদের ব্যবহার কি তোমার ভাল লেগেছে? আবার কি কখনও আসবে এখানে?' এখানকার মাটি, প্রকৃতি তাকে কতটুকু ছুঁয়েছে তাতে সে নিজেই সন্দিহান। তবে মনে মনে বলল ‘এখানে যে ফুল প্রস্ফুটিত হয়ে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে  তাকে নিয়ে যেতে তো আসতে হবেই।' মুখে বলল – ‘নিশ্চয়ই আসব স্যার, আসতে আমাকে হবেই।' বলেই পকেটে থাকা সিগারেটের বাক্সটি গাড়ির জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলল সে।

            মাইকে ভেসে আসছে পদ্মপূরাণের সুর। একজন পুরুষের কন্ঠে পদ্মাবতী কর্তৃক লক্ষিন্দরের প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার কথা শুনতে শুনতে হাওর এলাকা পেরিয়ে এসেছে তারা।

 


রবিবার, ৬ নভেম্বর, ২০২২

হারানো পথ

(C)Image:ছবি








 || মিঠুন ভট্টাচার্য ||


রোজ গলির সামনে
আমার খুব চেনা একটি ছেলেকে দেখি
অচেনা মুখে
দাঁড়িয়ে আছে।
চোখাচোখি হয়
আটকে পড়া কথায়।
তার চোখে জ্বালামুখ ব্যথার গভীর শুনি।
ভবিষ্যৎ শঙ্কায়
আশার সেতুতে পা রেখে ঠায় দাঁড়িয়ে,
অপেক্ষায়।
কোভিড যন্ত্রণা সইতে পারেনি
আমার স্বদেশী স্বজন ক'ত!
আধমরা যত পড়ে আছে
চেনা অচেনার বৃত্তে।
ভরা সংসার নিয়ে পথে নামে
হাসির আড়ালে ছলছল চোখ আলগোছে রেখে।
ইচ্ছে করে
সমবেদনার হাসি জানাই।
পরক্ষণেই মনে হয়
ছেলেটির সহমর্মী প্রয়োজন মেটানোর ক্ষমতা আমার নেই।
আছে একটু সময়ের
মনখারাপি পোশাকি কথা।
আমি নেহাত
যাত্রাপথের সৌভাগ্য আশ্রয়ে বাড়িতে আছি
রাতের নির্ভরতায়।


বৃহস্পতিবার, ২০ অক্টোবর, ২০২২

ক্রমাগত রক্তপাত

।। মিঠুন ভট্টাচার্য ।।
(C)Image:ছবি













রক্তধারা শুরু
আমার কৈশোর উদযাপনে।
যৌবনের আগমনী বার্তায় যেন
ব্যথা বেদনা সহ্যের প্রস্তুতি ।
তাই বলে কি
খুবলে নেবে আমায় তোমরা?
আমায় দেবে না মুক্ত বাতাস?
মুক্ত আকাশের অধিকার
কি নূপুর নিক্কণে,
মুক্ত পুঁজির বিশ্বায়নে বেঁচে
বিজ্ঞাপনে সেঁটে দেবে?
আমার পছন্দের পৃথিবী জুড়ে কি
ঘৃণা উদগিরণের গিরিখাদে
লালিত হব ললনা হয়ে?
রক্তাক্ত অভিশাপ ছড়া
শরীর মন বয়ে চলবে চিরকাল জুড়ে?
এ কেমন বিচার বিধাতার?
আমিই যদি মা দুর্গার প্রতিনিধি
তবে কেন অসুরের উল্লাস দাপাদাপি ?
আমার মুক্তির দশহাত
আমারই অন্তরের
শক্তিপুঞ্জে জাগিয়ে রেখে
অর্ধেক আকাশের চাওয়া প্রতিষ্ঠায়।
আগুন হোমে  মন্ত্র
জপে যেতে হবে আমারই।
এছাড়া শুরু কোথায়?

শনিবার, ৮ অক্টোবর, ২০২২

অথ মালিনীবিল কথা



 ।।শৈলেন দাস।।

     মালিনী বিল শিলচর শহর সংলগ্ন এক সুপরিচিত স্লাম। শ্রমজীবী প্রান্তিক মানুষের বাসভূমি এই এলাকা আশির দশক পর্যন্ত ছিল এক পরিত্যক্ত জলাভূমি। তখন শহুরে বাবুদের কাছে এখানকার জমির কোন মূল্য ছিলনা বরং জঙ্গলময় খালি জায়গা হওয়ায় পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষ তটস্থ থাকত এই ভয়ে যে কখন জঙ্গল পেরিয়ে চোর ডাকাত এসে পড়ে তাদের ঘরে ।

     বিশ্বায়নের ছোঁয়া লেগে শহর শিলচরের শরীর যখন ক্রমশ: বেড়ে উঠছিল তখন ক্রমবর্ধমান শ্রমিকের চাহিদা পূরণ করতে গ্রাম বরাকের শ্রমজীবী মানুষ ধীরে ধীরে শহরমুখী হতে শুরু করে। এরই অঙ্গ হিসাবে কিছু সংখ্যক মানুষ বসতি স্থাপন করতে শুরু করে মালিনীবিলে। এছাড়াও শহরের আশপাশের অন্যান্য স্লাম এলাকা থেকে অনেক মানুষ আসে যারা মূলত ছিল ওই সব এলাকার ভাড়াটিয়া।

     মালিনী বিলের অধিকাংশ মানুষই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কৈবর্ত এবং বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত। এখানে বসতি স্থাপন করতে এসে এই মানুষগুলো প্রথমে লড়াই শুরু করে প্রকৃতির সাথে। জলাভূমির উপর বাঁশের চালা বানিয়ে তার উপর ঘর বেঁধে বসবাস। নেই কোন পথ ঘাট, পানীয় জল। তার উপর বর্ষায় প্রায়ই বাঁশ বেতের তৈরি ঘরগুলি ভেঙ্গে পড়ত  বান তুফানে। তাদের দ্বিতীয় লড়াই ছিল পার্শ্ববর্তী একাংশ পুরনো মানুষের সাথে। মিথ্যা অপবাদ দেওয়া এবং সুযোগ পেলেই নানা অজুহাতে তাদের হেনস্থা করতে দ্বিধাবোধ করত না তারা। 

     জীবন ও জীবীকার তাগিদে পরিত্যক্ত জলাভূমিতে বিবিধ প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে কোনোমতে টিকে থাকতে থাকতে মালীনিবিলের বাসিন্দারা ধীরে ধীরে নিজস্ব পরিচিতি লাভ করতে শুরু করে। মজবুত হতে থাকে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান। সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও কেউ কেউ সুনাম অর্জন করতে থাকে নিজেদের অধ্যবসায় এবং কর্মের মাধ্যমে। কিন্তু শহর সংলগ্ন এলাকায় থেকে শহুরে পরিবেশে বসবাস করেও সামগ্রিকভাবে মালীনিবিলবাসীরা আশানুরূপ উন্নতি করতে পারেনি। বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে হাতে গুনা কয়েকজনই সামান্য সফল হয়েছে।

     মালিনী বিলের বাসিন্দাদের সম্পর্কে শুরুর দিকে কিছু মানুষ যে ভ্রান্ত ধারণা এবং বিরূপ মনোভাব পোষণ করত তা বর্তমানে কিছুটা কমেছে এবং তা সম্ভব হয়েছে এখানকার মানুষের সারল্য এবং সততার কারণে। নিজেদের কর্ম গুণ দিনে দিনে বিকশিত করে বৃহত্তর সমাজকে উন্নত পরিষেবা দিয়ে চলেছে তারা সততার সাথে। ফলে ধীরে ধীরে অনেকের আস্থাভাজন প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছে তারা। তবুও একাংশ মানুষ এখনও এমন রয়েছে যাদের কাছে মালিনীবিলের মানুষ মানেই সব দোষের দোষী।

     যে জলাভূমির জলকাদা পায়ে লাগলে এক সময় ভদ্রলোকেরা নিজেদের অশুচি মনে করত, ঘৃণা করত এখানকার মাছ, ফসল এবং মাটিকে। ব্রাত্যজনের যত্নআত্তি এবং প্রাণের স্পর্শে তা আজ হয়ে উঠেছে যেন সোনা তুল্য। যে কেউ মনে এই অভিলাষ পোষণ করে, যদি একটুকরো জমির দখল পাওয়া যেত! কিন্তু পাবে কি করে? এখানে তো শ্রমজীবীদের বাস। তাই সময়ে সময়ে ব্লুপ্রিন্ট তৈরি হয়েছে উচ্ছেদের। চোর ডাকাত অপবাদ দিয়ে মারা হয়েছে এখানকার নিরীহদের। মালিনী বিলের বাসিন্দাদের জমির পাট্টা দেওয়ার জন্য সরকারি প্রক্রিয়া অনেকদূর এগিয়েও বাতিল হয়ে গিয়েছে কোন অদৃশ্য হাতের কারসাজিতে।

     যেখানে শিক্ষার হার কম এবং নাগরিক সুবিধা অপ্রতুল সেখানে সামান্য উচ্ছৃঙ্খলতা এবং অসামাজিকতা খুব একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। তবুও মালিনী বিলের মানুষ  বৃহত্তর সমাজের সাথে মেলামেশা করা এবং মত বিনিময়ের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সংযমী। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় এই এলাকা এবং এখানকার মানুষের খারাপ দিকগুলো তুলে ধরার জন্য গণমাধ্যমগুলোর ঔৎসক্য এবং তৎপরতা অতিমাত্রিক, একাংশ বুদ্ধিজীবী সুযোগ পেলেই তাদের উপর অপবাদের দায় চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতা পোষণ করে। তাদের ঘরে বিনা নোটিশে রাতের আঁধারে পুলিশ ঢুকে যেতে পারে। এত সবের পরও এখানকার সহজ সরল মানুষ এই স্বপ্নে বিভোর যে একদিন ঠিকই যাবতীয়  অপবাদ ঘুচে সত্য এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবেই।

 


বৃহস্পতিবার, ৬ অক্টোবর, ২০২২

আজব

 ।। প্রতিভা মণ্ডল দে ।।













আজব গজব পৃথিবীতে
আজব গজব ভাব।
মিলেমিশে থাকার কথায়
ভাবের যখন অভাব।
শক্তিশালী মানুষ গুলোতে
অণুজীবের প্রভাব।
করছে মানুষে মানুষে দূরত্বের ভাব।
একা একা দূরে দূরে 
থাক নাকমুখটা মুরে।
চেন নিজেকে জান নিজেকে
কে তুমি কেন এসেছ
এই  ভবেতে,
ভালো থাকার ভালো রাখ
একে অন্যকে,
থেকেও দূরে ভালোবাস
সবাই পৃথিবীতে 
এই কারণে আস।
 


শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২

প্রজন্মের অন্তর

।। মিঠুন ভট্টাচার্য ।।

(C)Image:ছবি










কিশোরী মন কেঁদে উঠে
ভয়ে ব্যথায়,
অপরিচিতের মাঝে
অচেনা নতুন পরিবারে।
আমি বলে চলি-
তোর কিছু হয়নি,
তুই ভান করছিস,
কাঁদিস তুই আবেগ জাগিয়ে
আমার সহানুভূতির পালকি চড়বি বলে।
আমি বেঁচে আছি
আমার মন্দবাসার দিনগুলো আঁকড়ে।
 
স্নেহের স্মৃতি বড় ঝাপসা মেদুর,
রাতগুলো কুপীর আলো আঁধারি।
আমি ভাসতে পারিনি
এলইডি বাল্বের উজ্জ্বলতায়।
ভেবেছি -
আলোর বন্যা
আমার পুরষ্কার।
ভালোবাসার স্পর্শ পড়েনি
শরীর বাসায়,
মনের কোঠায়
মাকড়সা জালের ছাদ।
দেখো না আরেকবার
আমি কিশোরী সেজে!
 

বুধবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আদম সুমারী

।। আ, ফ, ম, ইকবাল॥ 













অগণিত মানুষ 
আসে যায় ধরণীতে 
ধরণী থেকে । 

আপন কর্ম দিয়ে 
কেউ হয়ে উঠে কালজয়ী 
কেউ বেঁচে বেঁচে মরে যায় 
কেবল কর্মের নিরিখে 
পরিচয় এ ধরায়। 

আফসোস- 
দেবস্থানেও আজ 
অমানুষ ঠাঁই পেয়ে যায় 
করুণা প্রেমের ঝর্ণা 
অকালে শুকিয়ে যায় 
পাল্টে গেছে মানুষের সংজ্ঞা 
পাল্টে গেছে প্রেমের পরিভাষা ! 

মজলুম আজ 
ফুলের পাপড়ি 
মজলুম নিষ্পাপ শিশুকন্যা 
মজলুম দলিত সংখ্যালঘু 
আইনের দাড়িপাল্লা ধরে থাকা 
সেই মেয়েটির খুলে গেছে আজ 
একটি চোখের বাঁধন !

ক্ষমতার দাপটে 
ক্রেন এক্সকেভেটর 
ধরেছে কানুনের রূপ 
বুলডোজার হয়েছে  
নবযুগের হিটলারি কালচার !

জ্বলছে দেশ দেশান্তর 
নিরোরা আত্মমগ্ন হয়ে তুলছে 
বীণার তারে অভিনব সুর  
ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা  
বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে !

ধর্মের নামে রচিছে বিধান যারা 
জানেনা ধর্মের বাণী  
আছে যদি ধর্ম-প্রীতি 
মেনে দেখো ধর্মের নীতি 
মুছে যাবে সকল বাধা ব্যবধান 
কায়েম হবে মানুষের রাজত্ব
হবে জাগ্রত 
উজ্জিবিত মানুষের প্রাণ !  
             
            হাফলং। ডিমা হাসাও।
                   ২১-০৯-২০২২। 

রবিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আলোর ছন্দ


।। মিঠুন ভট্টাচার্য।। 



























সূর্যের দেশে
রোদ স্মিতার আলোয়
তোমায় নিয়ে
তমসাবিহীন রাত্রি জাগি
রাত বারোটায়।
শীত স্বপ্ন হাতে
উদীচী ঊষায়
তোমায় নিয়ে বিভোর
প্রাণস্মিতা ছন্দে
তুমুল আলোর ফোয়ারা তলে।







বৃহস্পতিবার, ১৮ আগস্ট, ২০২২

প্রশ্ন

 
 

 ।। , , ,  ইকবাল॥ 

        

(C)Image:ছবি

     








কে বলেছে প্রকৃতি বিমুখ 

যার ফলে যত দুর্যোগ ?  

তাহলে কে দিয়েছে বিছিয়ে  

আকাশলীনা বিস্তৃত ছায়া 

যার তল্লাটে জেগে উঠছে 

প্রজন্ম, উত্তর প্রজন্ম  

নিভৃত নিরবচ্ছিন্ন! 

 

বিঘ্নিত করেছি আমরা 

ঘরে ঘরে ভাতের সম্ভার 

গভীর সবুজ পাহাড়গুলো 

ব্যস্ত ছিল গুহায় গুহায়    

সাজাতে আমাদের তরে  

বর্ণিল ধ্যানকেন্দ্র 

আমাদের স্বপ্ন 

আমাদের সাধনা ছিল পরিব্যাপ্ত 

মানবের তরে- 

মানুষের মতো করে ! 

আমরা করেছি সেথায় 

কংক্রিটের কলোনি পত্তন !  

 

কথা ছিল 

জগতের সকল ডায়াগনস্টিক সেন্টারে  

নির্ণীত হবে সকল প্রেমের অসুখ  

কথা ছিল  

সকল ল্যাবে হবে মানবিক উৎকর্ষের প্রয়োগ  

আজ কারা বানিয়েছে তা সাধনা নিধনের কারখানা ? 

তারপরও প্রকৃতি বিমুখ ?  

 

তোমার অরির তরে 

রেখেছ তল্লাটে ভরে 

সারিসারি কামান 

সর্বাধুনিক মেশিনগান 

গোলাবারুদের ঠেক 

প্রকৃতি তার সচল অনিলে 

জং থেকে রাখছে তা সামলে 

তাই দিয়ে করেছ যুদ্ধ ঘোষণা 

প্রকৃতির বিরুদ্ধে 

কে ডেকেছে তবে কন্যা নিধনের বন্যা ? 

 

তারপরও 

আলোকিত সূর্যের বাঁশির বিভাসে 

বটবৃক্ষের অমৃত মেঠো ছায়ায় 

বাড়বাড়ন্ত মাটির কায়া 

শোষণের হাতিয়ার শিয়রে জমা রেখে

পোহাচ্ছ নির্ঘুম রাত 

স্বপ্নে দেখছ নির্মল নিষ্কলুষ প্রভাত  

সকল দায় শুধু প্রকৃতির ! 

                 ১৮-০৮-২০২২। 

 

স্বদেশ আমার

।। জাহিদ রুদ্র ।।








এখন আর কিছু ঠিক রইল না 

যতবার চললাম মানুষ হয়ে ওঠার রাস্তায়

অমানুষ হয়ে গেলাম টের পাওনি

তুমি টের পাওনি বলে, 

অর্ধমানবের মতো শিম্পাঞ্জির খেলা দেখে হাততালি দাও

তারও দুঃখ আছে, মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি 

যে সাদা ফানুস উড়িয়েছিলে, সুতোয় বাঁধা 

দু একটা গেরুয়া ও সবুজ রং এর ও ছিল 

ওরা যে এক একটা মরা লাশ -- তা কি জানতে ?

 

প্রিয়তমা, তুমি টের পাওনি বলে

উদাসীনতা আমাকে অমানুষ করে তুলেছে

তোমার সম্মানে মৌনতা নিয়ে লালকেল্লা

তার প্রতিটা কিলায় লাইভ টেলি-কাস্ট চালায় 

বিলকিসরার স্বাধীনতা

গোধরা কনসাইন্টমেন্টে!

 

প্রিয়তমা, জানি তোমার গলা শুকিয়েছে 

মহোৎসবের অমৃত পানে

আজাদী, জল জীবন কেড়ে নেয় বিনা দ্বিধায় ---

মন্বন্তর থেকে ছিয়াত্তরতম স্বাধীনতা

ফুল এপিসোডে ফারাক অবশ্যই

ক্ষুধা মানুষ খেয়েছিল আর আজ রাজনীতি জীবন।

 

হোক না খোলা সব পতাকা

একবার তোমার মুখে হাসি দেখে যাই প্রিয়তমা ,

লিখা হোক যত মহাসভা সংবিধান 

উড়ুক যত ধর্ম পতাকা 

শিকল ভাঙ্গবে স্বদেশ আমার ।