“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ২১ মে, ২০২১

করোনা ও শান্তিপথের শিশুরা

   

                          ।। মাসকুরা বেগম ।।

          

(C)Imageঃছবি

     শান্তি পথের বাড়িগুলোতে বসবাস করে বেশ কয়েকটি শিশু । আট থেকে দশ বছর বয়সের - দানিশ, মামু, সাফিন, ফারহান । পাঁচ থেকে ছয় বছর বয়সের - আমানী, জিসান, কৃতিকা । দুই বছর বয়সের আদিব । ভিন্ন ভিন্ন পরিবারে বসবাস করলেও তারা সবাই যেন এক প্রাণ,এক মন,এক আত্মা। সবাই সবার ঘরে চটপট করে কখন মায়েরা অনুমতি দেবে আর তারা বেরুবে গলির রাস্তায়। গলিতে তারা সাইকেল চালায় আর খেলাধুলা করে।সাইকেল চালানো,ফুটবল খেলা ইত্যাদি থেকে ও তাদের আগ্রহ বেশি সবাই মিলে চিৎকার চেঁচামেচি করা আর দৌড়ানো । আদিব ভালোবাসে দানিশ আর ফারহানকে । দানিশ আর ফারহানকে দাদা' ‘দাদা' বলে তাদের পিছনে ছুটে । মামু, আমানী এক সাথে খেলতে ভালোবাসে।সাফিন ও তাদের সাথি। জিসান,মামুর অনুসারী-অনুরাগী।কৃতিকা মেয়েটি যেন হিমা দাসের প্রতিচ্ছবি।ছেলেরা যখন সাইকেল চালায় তখন ও তাদের সাথে প্রতিযোগিতা করে দৌড়ায় কৃতিকাসবাইকে অবাক করে সাইকেল আরোহীদের পিছনে ফেলে  আগে চলে যায় ও !

 সেদিন সকালে খবর বেরুলো জিসানের মায়ের করোনা পজিটিভ ! ওর মা প্রাইভেট স্কুলের শিক্ষিকা । স্কুল যাওয়া - আসা করছিলেন । কোথা থেকে কীভাবে সংক্রামিত হয়েছেন কোভিড-১৯ ভাইরাসে। সংক্রামণের ভয়ে গলির সবাই গৃহ বন্দি । ফোনের মাধ্যমে জিসানের ঘরের খবরাখবর রাখা হচ্ছে। শিশুদের সাইকেলে এখন জং ধরছে। ফুটবলগুলো পড়ে আছে ঘরের কোনো এক কোণে নয়তো খাটের নিচে।ক্রিকেট এর ব্যাট গুলো বলের বিরহে মলিন হলে পড়ে আছে ঘরের নয়তো বারান্দার কোনো এক কোণে ।

      শান্তি পথের দুধারে ঘাস - লতাপাতায় ঘন সবুজ হয়ে উঠেছে। অজানা অচেনা যত সব আগাছায় সুন্দর মনমুগ্ধকর ফুল ফোটে করে তুলেছে এই পথকে অনন্য। সাদিকার নানার বাগানের আম গাছে কাঁচা কচি আম হাতের নাগালে । কিন্তু নেই কোনো দুষ্টু - মিষ্টি ছেলে যে দুটো আম পেড়ে পালাবে । 

     হাউস নাম্বার-দুইয়ের প্রথম তলার সাফিন, আদিব ও দ্বিতীয় তলার ফারহান আর হাউস নাম্বার-চারের দ্বিতীয় তলার দানিশ, আমানী, নিচের তলার মামু।মাঝখানে হাউস নম্বর তিনে এখনও শুধু গ্রাউন্ড ফ্লোর অব্দি কাজ হয়েছে। তাই উপরটা খোলামেলা। দক্ষিণ দিকের ডনবসকো ইউনিভার্সিটির স্টাফ কোয়ার্টারের ফ্ল্যাটে আছে কিছু শিশু।এই কয়েকজনের মধ্যে জানলা কিংবা ব্যালকনি দিয়ে চলতে থাকে আলাপ। জানালার কিংবা ব্যালকনির গ্রিলে লটকে লটকে চিৎকার করে করে চলে বার্তালাপ । আকাশে - বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে শিশুদের মিষ্টি মধুর সুর । গ্রিল ভেঙে যেন বেরুতে মন চায় তাদের । আকাশে ভেসে চলা মেঘের মতো হাওয়ায় ভেসে ভেসে খেলা করতে মন চায় । পাখির মতো স্বাধীনভাবে বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে শূন্যে উড়ে চলতে মন চায় । 

নিচের তলার মামু এসে সঙ্গী হয় দানিশ- আমানীর । তাদের জন্য বেডরুমটা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে । যা খুশি করে এখানে । বিছানার উপর জানালার গ্রিলের সাথে রশি টাঙ্গিয়ে তার উপর বিছানা চাদর দিয়ে তৈরি করে তাবু । জানলার পরদা সরিয়ে দেখায় ফারহান, সাফিন -দের । সাফিন আর আদিব উঠে চলে আসে ফারহানের ঘরে । এখানেও জানালার গ্রিল আর টেবিলের পায়ের সাথে বিছানা চাদর কিংবা মায়ের ওড়না বেঁধে তৈরি হয় ওদের তাবু । 

       আমানী ডাকে ফারহান ! ফারহান!' । ফারহান জানলা দিয়ে উঁকি দিয়ে সাড়া দেয় । আমানী বলে, ‘ফারহান ! একটু গ্রিলে লটকে ব্যায়াম করো তো।' মেদহীন ফারহান গ্রিলে লটকে কিছু কারিশমা দেখাতে উস্তাদ ।

দানিশ বলে, ‘ফারহান ! আজ অনলাইন ক্লাস নেই নাকি ?'

ফারহান বলে, ‘আছে । কিন্তু এখন নয়, পরে হবে । এই দেখ আমার কাছে কী কী খেলনা আছে । আমি কী তৈরি করেছি। দেখ, দেখ।' 

 দানিশ বলে, ‘হাই পাঙ্কু ! তুই মাইন্ড ক্রাফট ভিডিও গেম খেলিস ?' 

হ্যাঁ!........দানিশ তুমি খেলো না '

মা মোবাইলে ডাউনলোড করতে দেয় না যে। আমাদের ঘরে এসেছিল আদনান ও ফাহিম ওদের মোবাইলে খেলেছি । আরও কিছু ইউটিউব থেকে দেখে দেখে শিখে ফেলেছি।'

পাঙ্কু জিজ্ঞেস করে, ‘দানিশ ! আজ তোমার ঘরে ইফতারে কী বানিয়েছে ?' কিংবা তোমাদের , না ? কী কী খাবার তৈরি করে দে ।'

 আদিব জানলা দিয়ে ডাকে, ‘দানিশ ! দানিশ !'

       চশমা চোখে ক্ষীণকায় নয়/দশ বছরের মেয়ে লিপি কোয়াটারের এক ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখছে আর শুনছে সবাইকে । 

সাফিন বলে, ‘হাই ! তোমার নাম কী?'

আমার নাম লিপি । তোমার নাম কী?' এভাবে সবার সাথে পরিচয় হয় ওর ।

মামু জিজ্ঞেস করে, ‘লিপি তোমার চোখে চশমা কেন? এটা বুঝি তোমার স্টাইল?'

না না ! স্টাইল বলছ ! আমার একদম ভালো লাগে চশমা চোখে দিতে।'

দানিশ জিজ্ঞেস করে, ' এটা কি পাওয়ার থাকা চশমা ?'

হ্যাঁ !'

হ্যাঁ!!! কী বলছ !' এক সঙ্গে সবাই আঁতকে উঠে ।

পাঙ্কু বলে,‘ও যে সব সময় মোবাইল নাইলে ল্যাপটপের সামনে বসে থাকে তাই ওর চোখ খারাপ হয়ে গেছে।'

তাই নাকি লিপি ?' বাকিরা জিজ্ঞেস করে।

হ্যাঁ ! আমি তো এমনিতেই ইউটিউব আর ভিডিও গেম ভালোবাসি।তারপর এই মহামারিতে স্কুলের অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি বাড়তি অনলাইন মাধ্যমে অ্যাবাকাসের ক্লাস,মিউজিকের ক্লাস,আর্ট ক্লাস,কোডিং শিখার ক্লাস, যোগ-ব্যায়ামের ক্লাস ইত্যাদি করতে গিয়ে সারাদিন মোবাইল আর ল্যাপটপের সামনে বসে বসে আমার চোখ শেষ !' ছোট্ট লিপি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘আমি এই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি থেকে খুঁজে নেবো আমার ছবি আঁকার বিষয়।তোমাদের চিৎকার চেঁচামেচির ধ্বনি- প্রতিধ্বনি থেকে খুঁজে নেবো মিউজিক। মায়ের কাছ থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখব। অ্যাবাকাস আমায় যেন একটি মেশিনে তৈরি করছে।তাই আমি ছেড়ে দিয়েছি এসব কিছু।শুধু স্কুলের ক্লাস করব।নিচের মাঠে ইচ্ছে মত ভলিবল খেলব। তোমরা আমার বন্ধু হবে ?'

নিশ্চয়ই ! নিশ্চয়ই ! আমরা সবাই খুব ভালো বন্ধু ।' সবাই একসাথে বলে উঠল মিষ্টি মধুর সুরে। 

       ঘরে বসে বসে ঘরোয়া পুষ্টিকর খাবার খেয়ে খেয়ে শিশুদের খুব শারীরিক বৃদ্ধি হচ্ছে। গায়ে রোদ লাগছে না তাই গায়ের রঙ অনেক ফর্সা হয়ে গেছে। আগের থেকে যেন একটু বেশিই সুস্থ-সবল-সুন্দর হয়ে উঠেছে শিশুরা। বয়সের থেকে যেন একটু বেশিই বড় হয়েছে।একদিন আমানীর বাবা মেয়েকে আদর করে বললেন, ‘মা ! তুমি বড় হয়ে যেও না। ছুট্টটি থেকো।বেশি বেশি করে কোলে নিতে পারব ।' 

আমানী উত্তর দিল, ‘তুমি কি যে বল আব্বা । বড় কি আমি নিজে নিজে করছি আব্বা ! আমি তো আপনা আপনিই বড় হচ্ছি !'

      ফারহান মা-বাবার কাছে বায়না করে, ‘আমার একটি বোন লাগে।সবার ছোট ভাই কিংবা বোন আছে। শুধু আমার নেই।' 

         মামু তো অনেক ঘরোয়া খুঁটিনাটি কাজ কর্ম শিখে ফেলেছে ! যখন স্কুল খোলা ছিল যে মামু নিজে নিজে খাওয়া দাওয়া করার সময় পেতো না সেই মামু এখন ছোটভাই ছয়মাসের যিবানের এর কাপড় চোপড় গুছিয়ে রাখতে জানে,ঘর দোর পরিপাটি করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে জানে,ডাইনিং টেবিলে অতিথি আপ্যায়ন করতে জানে!স্কুল বন্ধ থাকায় মেয়েরা মায়েদের ঘরোয়া কাজে টুকটাক সহায়তা করছে।পড়াশোনার চাপ নেই আগের মতো।মা-মেয়েদের দিন খুব ভালোই যাচ্ছে,কিছুটা মা-ঠাকুমার দিনের মতো । 

         সাফিন ও সারাদিন ছোট ভাই আদিবের পিছে পিছে ঘুরে । স্কুল খোলা থাকলে কি পারত সাফিন আদিবকে এতো সময় দিতে ? ঘুম থেকে উঠে স্কুলের জন্য রেডি হওয়া, সকাল সাড়ে সাতটায় স্কুলের জন্য বেরিয়ে পড়া । বিকেল দুটো তিরিশ মিনিটে এক গাদা গৃহকর্ম নিয়ে ঘরে ফেরা। হাত-মুখ ধুয়ে, খেয়ে-দেয়ে বিশ্রাম নেওয়া। তারপর বিশ্রাম করে উঠে স্কুলের গৃহকর্ম নিয়ে বসে পড়া। এই ছিল প্রাত্যহিক রুটিন। ভাইয়ের মুখটাই ভালো করে দেখার সময় পেতো না।করোনা মহামারির বন্ধ বোধহয় শিশুদের উপর থেকে কিছুটা অযথা চাপ কমিয়ে দিয়েছে।পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে ঠিকই কিন্তু পড়াশোনার নামে শিশুদের উপর প্রাইভেট স্কুলের যে জুলুম হচ্ছিল তা একটু কমেছে ।

          সাহিল ছেলেটা বড্ড ভালো । ওরা কয়েকটি পরিবার শান্তি পথের একটি আসাম টাইপ বাড়িতে বসবাস করে । গতবছর ঐ বাড়িতে থাকা মুন্নার মা হাসপাতালে জন্ম দেয় একটি কন্যা সন্তান । সঙ্গে সঙ্গে খবর আসে মুন্নার মা করোনা পজিটিভ । তখন করোনা পজিটিভ হলে তো হয়রানির শেষ ছিল না । মুন্নার মায়ের চৌদ্দগুষ্টি কোয়ারান্টাইনে' । ঐ বাড়িতে যত ছিল সবাই চৌদ্দ দিনের নিভৃতবাসে। অনেক কষ্টে দিন কাটিয়ে ছিল লোকগুলো । ভাগ্যিস আর কারও পজিটিভ হয়নি । সাহিল সরকারি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে । চটপটে হালকা পাতলা ছোট ছেলে । কেউ যদি কোনো দরকারে ডাকে, ঝটপট হাজির সে । মা-বাবা বা যেকোনো লোকের সাহায্য সহায়তায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ছোট্ট সাহিল। কিন্তু তার নিজের পড়াশোনা লাটে উঠেছে করোনা মহামারির জন্য । 

         বেচারা জিসান! বাইরে বেরুনো তো বন্ধ, ঘরের ভিতরে ঢুকাও বন্ধ। মায়ের পাশে যেতে পারে না। ঘরের সম্মুখের বারান্দায় খেলতে থাকে সারাদিন । একা একা কী আর খেলা যায় ! বিরক্ত হয়ে উঠে । অকারণে রাগ হয় । ছুঁড়ে ফেলে দেয় খেলনাগুলো।  মায়ের উপর অভিমান করে । মাঝে মাঝে বিনা কারণে কাঁদে দু'দিন পর ওর নানিরও করোনা পজিটিভ ! জিসানরা থাকে ওর নানির ঘরে। নানা মারা গেছেন সেই কবে। মামা তো নেই।‌ শুধু মা আর মাসি।বড় মাসি নিজের শ্বশুর বাড়িতে থাকে।জিসানের বাবার কর্মস্থল এখান থেকে কাছাকাছি স্থানে। তাই ওর মা-বাবা ওকে নিয়ে নানির সাথে থাকেন।নানির একাকীত্ব ও ভালোই কেটে যায়। জিসান নানির অন্তঃ প্রাণ।এখন জিসানের খুব কষ্ট - নানি কাছে ডাকে না,আদর করে না ভাত খাইয়ে দেয় না ! আগে তো মা-বাবার চেয়েও বেশি সময় কাটাত নানি সাথে।মা কাছে ডাকে না, আদর করে না, পড়াতে বসে না, বকাবকি ও করে না ! বাবা কী সব রান্না করে মুখে তুলা যায় না ! বাবার হাতে একটুও স্বাদ নেই । এক গ্রাস ভাত যদি নানি খাইয়ে দিত । কী স্বাদই না লাগত ! এখন মামু-রা ও খেলতে ডাকে না ! কেউই রাস্তায় বেরই হয় না খেলতে !

        করোনা মহামারির জন্য কচি -কাঁচা শিশুরা আজ তাদের শৈশব উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত । পারছে না স্বাধীনভাবে এখানে- সেখানে বিচরণ করতে । স্কুল ও স্কুলের বন্ধুদের খুব মিস করছে । ঘরে বসে আর কত আঁকবে প্রিয় কার্টুন চরিত্র ? কত গাইবে ছড়াগান ? কত খেলবে রান্না-বাটি ? কত কাটাবে সময় জড় পুতুলের সাথে ? ভীষণ বিরক্ত লাগছে ! অসহ্য হয়ে উঠছে এই বন্দি জীবন ! কখন যে কাটবে মহামারির এ আতঙ্ক ! আজ করোনা স্বাধীন, তারা বন্দি ! এমন দিন কখন আসবে - যেদিন করোনা হবে বন্দি আর তারা হবে মুক্ত ? ভাবনার পাহাড় আজ শিশুদের মনে । মাঝে মাঝে মন চায় রেস্টুরেন্টের খাবার খেতে । মন চায় একটু বেড়াতে যেতে পার্কে নয়তো কোনো আত্মীয় - স্বজনের ঘরে । কিন্তু তারা তো ঘর থেকে বেরুতেই পারছেনা । বিল্ডিং এর নিচে গিয়ে একটু দৌড়াতে ও পারছেনা । পারছেনা সবাই মিলে হৈচৈ করতে। শুঁকতে পারছেনা কাঁচা মাটির গন্ধ । তাইতো তারা বিল্ডিং গুলোর ছাদে উঠে একসাথে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে  স্লোগান দেয় গো, করোনা গো!'

       

 

 

শনিবার, ১৫ মে, ২০২১

আধ পেয়ালা চায়ের কবিতা


আধ পেয়ালা চায়ের সঙ্গী আমার,
নিত্যদিনের অফিস কাজের ফাঁকে
ভাগের চায়ে ছুটতো না তো তুফান
ছুটতো শুধু, গান গল্প কবিতার কথা
মাঝে মাঝে জীবন জীবিকা গরিবি কথা। 
কী করে যে মিলেই যেত সময় -
আমার দেরি হলে - সেদিনই তাঁর দেরি,
তাঁর যেদিন সকাল সকাল ছোটা
আমার সেদিন চায়ের কাপের তাড়া।
আধ কাপ চায়ের ফাঁকেই হাল হকিকৎ,
নিত্যদিনের ভালো মন্দ কথা
শিল্পী মানুষ অগাধ যে তাঁর দায়ভার
আধপেট খেয়ে বেড়ান ঘুরে ঘুরে
সাহিত্যের এক দুয়ার থেকে
হাজার দুয়ারে। দৃষ্টি থেকে উজান
ইতিহাস সব নখদর্পণে বাস।
এ নিরস পৃথিবী, ব্যস্ত চরাচর
দেয়নি কিছুই তাঁকে।
মহান বলেই অনেক কিছু
দিয়েছেন পৃথিবীকে।
নীরবেই তাই অভিমান নিয়ে বুকে
গেছেন চলে মানস চরাচরে।
আজ চোখের জলে জানাই বিদায়
হে বন্ধু, হে অগ্রজ সম আত্মীয়
আমার শিল্পী মনের যাপন বেলার সঙ্গী
থাকবে বেঁচে চিরটিকাল তুমি
মনমাঝে অবিরত।

শনিবার, ১ মে, ২০২১

রেংটি পাহাড় : কতটুকু কার ??

 
।। পার্থঙ্কর চৌধুরী।।

(C)বার্তালিপি

রেংটি পাহাড়! শহর শিলচর থেকে ৩০৬ নং জাতীয় সড়ক হয়ে দক্ষিণ-দিক ধরে ৫০ কিলোমিটার যেতে না যেতেই ভাইরেংটি। ভাইশব্দটা মিজোরা কি অর্থে ব্যবহার করে, সেটা না জানলেও, আপাতত:, প্রচলিত অর্থে যদি সহোদর ধরে নেই, তবে যে প্রশ্নটা অবধারিত উঠে আসছে, তা হলো, এই গত কিছুদিন থেকে পত্র-পত্রিকায় এত ভাতৃঘাতী খবর বেরুচ্ছে কেন ??
            এই তো সেদিন। মানে কুড়ি ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭। অর্থাৎ রাজ্যটার বয়স সবেমাত্র ৩৪ বছর। অবশ্যি তার আগে আরো ষোল বছর (১৯৭২-১৯৮৭র ১৯ ফেব্রুয়ারি) সে কেন্দ্র শাসিত ছিল। এরও আগে? স্বাধীনতার পর থেকে ৭১ সাল অব্দি তো এই লুসাই পাহাড় ছিল তো আসাম রাজ্যেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যদিও যাতায়াতের জন্য সমতলের বাসিন্দাদের বিশেষ পাস দরকার হত। সে আরেক কথা। বেঙ্গল রেগুলেশন। সেটা না হয় পরে বলছি। কিন্তু এক্ষুনি যেটা বলতে চাইছিলাম, তা হলো, প্রাণী এবং উদ্ভিদদের বংশবিস্তার সাধারণত: দুভাবে হয়। অযৌন এবং যৌন প্রক্রিয়া। (ইংরেজিতে Asexual এবং Sexual)অ্যামিবা জাতীয় নিচুবর্গের প্রাণীদের দেহ Asexual বা অযৌন প্রক্রিয়াতে (Binary fission) দ্বিখণ্ডিত হয়ে এক থেকে দুই, দুই থেকে চারটি অ্যামিবা সৃষ্টি হয়। তাহলে, মোদ্দা কথা এটাই যে, ওই চারটি দেহে যে জিন-ক্রমোজম রয়েছে, সবই একই দেহ থেকে সৃষ্ট। মেঘালয় বলুন, কিম্বা নাগাল্যাণ্ড, মনিপুর বলুন কিম্বা অরুণাচল প্রদেশ - একই দেহ থেকে সৃষ্ট ভায়েরা নিজেদের মধ্যে এত লাঠা-লাঠিতে ব্যস্ত কেন? ইতর প্রাণীদের মধ্যেও যে এমন ঘটনা বিরল!
        বলতে চাইছিলাম, যে পাহাড়টাকে স্থানীয়রা রেংটি-পাহাড়বলে চেনেন, তার পোশাকি নাম, ‘ইনার লাইন রিসার্ভ ফরেস্ট’ ( Inner Line Reserve Forest, বা সংক্ষেপে ILRF)১৯৮৩ সালের বেঙ্গল ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রেগুলেশন আইনমতে ১৮৭৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন আসামের কাছাড় জেলার দক্ষিণপ্রান্তের ভূখণ্ডকে এই ইনার লাইনঘোষণা করা হয়। যদিও এরও প্রায় দুবছর পর, অর্থাৎ ১৮৭৬-৭৭ সালে গেজেট নোটিফিকেশনের মধ্য দিয়ে ওই পাহাড়ের কেন্দ্রস্থ স্থানের ৩৩৯ বর্গ মাইল এলাকাকে রিসার্ভ ফরেস্টের আওতায় আনা হয়, এবং পরিধি অঞ্চলের আরও ৪৮৯ বর্গ মাইল এলাকা আন-রিসার্ভডরাখা হয়েছিল। (In 1876 a total area of 825 square miles was set apart as Unreserved Forest, of which 336 square miles are within, and 489 without, 'the Inner Line'. – হান্টার, ১৮৭৯ )। এ তো গেলো তখনকার কথা। সেদিনের তুলনায় আজকের দিনের এই ইনার লাইন রিসার্ভ ফরেস্ট প্রায় ৬.১৬ মাইল (বা প্রায় ১০ বর্গ কিলোমিটার) কমেছে, এবং ৮১৮.৮৪ বর্গ মাইল (অর্থাৎ ১৩১৭.৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বর্তমানের রেংটি পাহাড়।
    


         পাশের দেওয়া ছবি থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এই বিশাল এলাকা জুড়ে যে রিসার্ভ ফরেস্টটি বিস্তৃত, বর্তমান ভৌগোলিক মানচিত্র অনুযায়ী তার পরিধি এলাকার সীমানা আনুমানিক ৪০ শতাংশ আসামের (কাছাড় এবং হাইলাকান্দি জেলার) সঙ্গে জুড়ে রয়েছে, বাকি আরও আনুমানিক ৪০ শতাংশ মিজোরামের সাথে এবং পরিধি অঞ্চলের বাকি ২০ শতাংশ রয়েছে পাশের রাজ্য মনিপুরের সাথে।

          ফরেস্ট বিভাগের অনুমতি ক্রমে এবং গবেষণার স্বার্থে গত দেড় কিম্বা দুই দশক ধরে আমাদের ছেলেরা প্রায়ই এই ইনার লাইন অঞ্চলে যেতে হচ্ছে। তুলনামূলক ভাবে সহজ গন্তব্য স্থল গুলো হচ্ছে, বালিচুরি, একারথল, নাগাথল, নক্সাটিল্লা, লোহারবন্দ। আরও দক্ষিণে এগিয়ে গেলে শেওড়াথল, হাডাম্মাবস্তি, পানছড়া ইত্যাদি গ্রাম। অঞ্চলগুলোতে প্রবেশ করলেঅরণ্যের রোদনপ্রায়ই চোখে পড়ে। যত্ন-আত্তির সেরকম ভাবে করা হচ্ছে না ঠিকই, তবুও এই রিসার্ভ ফরেস্টের বিভিন্ন জায়গা বেশ কিছু মূল্যবান গাছ এবং দুর্লভ প্রজাতির প্রাণীর এখনও আবাসস্থল। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের সদর্থক ভূমিকার ফলে ইনার লাইনের আসামের (অর্থাৎ কাছাড় ও হাইলাকান্দি জেলার) আওতায় থাকা স্থান গুলোতে জীববৈচিত্র্য নিয়ে কম বেশি গবেষণা তথা সংরক্ষণের কাজ চলছে যদিও, কিন্তু পার্শ্ববর্তী মিজোরাম রাজ্যে একই ধরনের প্রতিষ্ঠান থাকা সত্বেও, রেংটি পাহাড় নিয়ে সেরকম কোনও কাজ প্রকাশিত গবেষণাপত্রে চোখে পড়ে নি! মিজোরাম অধ্যুষিত ইনার লাইনের ৪০ শতাংশ অঞ্চলে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে প্রাধান্য পেয়েছে, এরকম কোন গবেষণার খবর নিশ্চয়ই সংরক্ষণবাদীদের কাছে সুখকর হবে। আসলে রেংটি-পাহাড়বলুন কিম্বাইনার লাইন রিসার্ভ ফরেস্ট’, এই বিশাল পাহাড়ি এলাকা এবং এর মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিচিত্র সব মূল্যবান উদ্ভিদ এবং প্রাণীকুলের সঠিক সংরক্ষণের জন্য তিন তিনটি রাজ্যও সরকারের ( আসাম, মিজোরাম এবং মনিপুর) সদর্থক ভূমিকা পালনের জন্য যৌথ আলোচনা টেবিলে বসা প্রয়োজন। বিপুল জীববৈচিত্রে ভরপুর এই পাহাড় নির্দ্বিধায় একটি জাতীয় উদ্যান, নিদেনপক্ষে একটা অভয়ারণ্যের দাবী রাখতেই পারে। এ তো গেল ইতিবাচক দিক। সম্ভাবনার কথা। এ যাবত ঘটে যাওয়া যাবতীয় সমস্যার 'পেনাসিয়া'। (বলাবাহুল্য, কেন্দ্রের উদ্যোগেই জাতীয় উদ্যান কোথাও স্থাপন করা যেতে পারে।)
  


    

  এর উল্টোদিকে, অর্থাৎ, নেতিবাচক দিকগুলো হচ্ছে, সাম্প্রতিক অতীতেই অর্থাৎ এই করোনা-কালীন সময়েই আমরা পত্র-পত্রিকায় দেখতে পেয়েছি, শিলচর- আইজল সড়কের আসাম প্রান্তের প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাতে মিজোরা চেক-গেট বসিয়ে দিয়েছিল। কলাশিব জেলার লোকেদের সঙ্গে আসামের কাছাড় জেলার প্রান্তীয় গ্রামের বাসিন্দাদের সংঘর্ষ এখন প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা! এ ছাড়াও দক্ষিণ করিমগঞ্জ জেলার লোকেদের সাথে মিজোরামের লোকেদের সংঘর্ষ প্রায়ই খবরে বেরোয়। একদিকে আসামের জমি মিজো অধিগ্রহণের অভিযোগ তো রয়েছেই। মিজোদের পাল্টা অভিযোগ, আসাম প্রান্তে থাকা অবৈধ বাংলাদেশিরা এ সমস্ত ঝামেলা পাকাচ্ছে। আসলে এই সমস্ত অভিযোগ- পাল্টা অভিযোগের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করতে গেলে ব্রিটিশ জমানায় ফিরে যেতে হবেযখন সাহেবরা তাদের প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ইনার লাইননামক বিভাজন রেখা টেনে দিয়েছিল। কিন্তু বিসমিল্লায় গলদ-টা সেই থেকেই থেকে গেছে। স্বাধীন ভারতে রাজ্যগুলো পৃথকীকরণের সময় আন্তঃরাজ্য সীমানার এই বিভাজন রেখাগুলো সুস্পষ্টভাবে টেনে দেওয়া হয়নি বলেই আজকের দিনে অশান্তির এই বাতাবরণ। সীমানা নির্ধারণ প্রসঙ্গে উত্তর পূর্বের প্রায় প্রত্যেক রাজ্যেরই এক একটা স্বতন্ত্র ধারনা, এবং এই বদ্ধমূল ধারনাই আন্তঃরাজ্য সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু।
    


      

  আপাতত: যদিও আসাম এবং মিজোরাম, এই দুই রাজ্য সরকারের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা অনুযায়ী সীমান্ত ঘেঁষা এলাকাতে স্থিতাবস্থা অর্থাৎ স্টেটাস-কুওবজায় রাখার কথা, কিন্তু বাস্তবে যদি দুপক্ষই তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করত, তবে তো আর উটকো খবরগুলো পত্র-পত্রিকায় ইদানীং বেরুত না!
         


         হ্যাঁ, শুরুতেই বলেছি, বেঙ্গল রেগুলেশনপ্রসঙ্গটা নিয়ে পরে বলব। বলতে চাইছিলাম, আসাম মিজোরাম সীমানা বিবাদের পেছনে রয়েছে দুটো নোটিফিকেশন। প্রথমটা ১৮৭৫ সালের - যা দিয়ে লুসাই পাহাড়কে কাছাড়ের সমতল থেকে আলাদা করা হয়েছিল, এবং দ্বিতীয়টা ১৯৩৩ সালের, যা দিয়ে এই একই পাহাড়কে মনিপুর থেকে আলাদা করা হয়েছিল। মিজোরাম বিশ্বাস করে যে আসাম মিজোরাম সীমানা ১৮৭৩ সালের বেঙ্গল ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রেগুলেশন’ (BEFR Act) (যার নোটিফিকেশন ১৮৭৫ সালে বেরিয়েছিল) মোতাবেক হওয়া উচিত। মিজোদের দ্বিতীয় অভিযোগ, ১৯৩৩ সালের মনিপুর থেকে ওই লুসাই পাহাড়-কে আলাদা করার সময় মিজো সমাজের লোকদের মতামত নেওয়া হয় নি!
        এবার তাহলে দেখা যাক এ ব্যাপারে বেঙ্গল ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রেগুলেশন’-এর বক্তব্য কি? ১৮৭৩ সালের এই BEFR Regulation (Regulation 5 of 1873)- উল্লেখ রয়েছে যে,সেটা প্রযোজ্য হবে তৎকালীন কামরূপ, দরং, নগাঁও, শিবসাগর, গারো পাহাড় অধ্যুষিত গোয়ালপাড়া জেলা, খাসি ও জয়ন্তিয়া পাহাড়, নাগা পাহাড় এবং সেই সময়ের কাছাড় জেলাতে। এই আইনের ব্যাপ্তি প্রসঙ্গে পরের পাতায় আরও বলা আছে যে শিডিউল্ড ডিসট্রিক্ট এক্ট, ১৮৭৪’ ( XIV of 1874, Section- 5) প্রযোজ্য হবে গোয়ালপাড়া জেলার পূর্বপ্রান্ত (ইস্টার্ন ডুয়ার্স), নাগা পাহাড়ের মোককচাং, সদিয়া, বালিপাড়া এবং লখিমপুর ফ্রন্টলাইন এলাকা এবং কাছাড় জেলার লুসাই পাহাড় এলাকা গুলোতে। ওখানে আরও বলা রয়েছে, It shall be Lawful for the state Government to prescribe, and from time to time alter by notification in the official Gazette, a line to be called ‘The Inner Line’ in each of the above named district… অর্থাৎ সরকার ( মানে, অবিভক্ত রাজ্য সরকার) সময় সময়ে এই ইনার লাইন সীমানার সংশোধন অথবা সংবর্ধন করতে পারতেন। ইনার লাইন এলাকাতে সমতলের বাসিন্দাদের অনধিকার প্রবেশ সম্পর্কে বলা আছে, ‘Any one…. if goes beyond such line without a pass, shall be liable, on conviction before a magistrate to imprisonment…. Which may extend to one year, to a fine not exceeding one thousand rupees or both…. অর্থাৎ সে ব্রিটিশ হোক বা ভারতীয়, অবৈধ প্রবেশকারীদের এক বছরের জেল এবং/ অথবা ১০০০ টাকা (১৮৭৩ সালের মূল্যমানে) জরিমানা হতে পারত। নিঃসন্দেহে উপজাতি এলাকার লোকেদের স্বতন্ত্র যে জীবন প্রণালী, তা বাইরের লোকেদের সংমিশ্রণে যাতে শঙ্করায়িত না হয়, তাই তেমন এক খানা আইন। এতটুকু তো ঠিকই আছে।
          কিন্তু, সমস্যা হল ওই রেগুলেশনে বর্ণিত ‘State’ অর্থাৎ রাজ্যের সংজ্ঞায় ! ১৮৭৩ সালের আসাম রাজ্য,(মাদার-অ্যামিবা) যা থেকে গত দেড়শ বছরে অনেক গুলো রাজ্য ছিটকে বেরিয়ে গেছে…, সেটাকে জোড়া দেওয়ার মতো কোনোরাজনৈতিক রসায়ন’, অথবা কুইক-ফিক্সপাওয়া কি সম্ভব?