“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ২৯ জুলাই, ২০১৮

ভালবাসা

।। সুপ্রদীপ দত্তরায়।। 

(C)Image:ছবি








সেদিন পথের মোড়ে হঠাৎই দেখা
ভালবেসে দিয়েছিনু নাম সূর্যতপা
 
মৌন হিমালয় কোলে তপস্যা রত --
শান্ত স্নিগ্ধ যেন অদ্রিরাজ দুহিতা ।
 
চলনে চমকে তার হরিণীর গতি
বন্ধু ছিল মোর,
  ষোড়শী যুবতী 
কথা তার বনানীতে পাখির কুজন
 
পরিচয় বহুকালে, সেই কলেজ জীবন
 
এখনো তেমনি সে, অতি সাধারণ ।
বিকেলের আড্ডাতে
  ভুষণ্ডির মাঠ 
কাঠালতলিতে বা বরাকের ঘাট
 
বহুবার বসেছি সেথায় শুধু দুজনায়
মিথ্যে অজুহাতে, কেবল মনের খেলায়।
হাতেতে রেখে হাত পরম আশ্বাসে
মুক্ত কণ্ঠে গেয়েছিনু জর্জ বিশ্বাসে।
আপন বিভোরে । একগুচ্ছ চাঁপাকলি
 
সযত্নে তুলে এনে বাগিচা থেকে
 
মরমে ভরেছি তার কোমল অঞ্জলি
 
যেন পৃথিবীর বুকে থাকা শ্রেষ্ঠ উপহার ।
কখনো নিজ হাতে কখনো অনুরোধে
 
খোঁপাতে গুঁজেছি তার, নিত্য বহুবার,
 
আপন খেয়ালে । সাক্ষী তার শেষ সূর্য ,
নীড়ে ফেরা পাখি সব শ্রান্ত বিকেলে ।
 
সেও বহুকাল । বাকীসব দগ্ধ ইতিহাস
 
অপেক্ষা, স্বপ্নভঙ্গ আর শুধু
  দীর্ঘশ্বাস ।
জীবনের সব শর্ত ধর্ম, বর্ণ জাত
 
পারিবারিক চাপ, সমঝোতা, অপবাদ
 
ভালবাসা শিখিয়েছে কঠিন সে পাঠ,
শিখিয়েছে ভালবাসা স্বতঃস্ফূর্ত নয়
 
অঙ্ক কষে জীবনসঙ্গী
  বেছে নিতে হয়।
শিখিয়েছে জীবনে প্রতিষ্ঠারই দাম
ভালবাসা বিলাসের অন্তর্নিহিত নাম ।
 
ভালবাসা বিশ্বাসের অন্তিম বিন্দু
আবেগ ভাসিয়ে আনে বিষাদ সিন্ধু ।
প্রতিপদে রজ্জু পথে সতর্কে চলা
 
শিকারি দৃষ্টিতে সদা বার্তালাপ বলা
অনুযোগ, অভিমান প্রহরারত
ভালবাসা বিরহের শ্রেষ্ঠ চারুকলা ।
বহুদিন পর আজ আবার  দুজনাতে দেখা 
চুলে তার ফাঁকে ফাঁকে সুবর্ণরেখা
 
শির'পরে নীল আকাশ, শান্ত স্নিগ্ধ ঘন
দাঁড়িয়ে সম্মুখে একা হিমকমল যেন
 
শিলা ফাঁকে বরফের ঘোমটাতে ঢাকা
 
নীল গোলাকার আহা, অপূর্ব স্নিগ্ধতা।
ধীর পায়ে হেঁটে এসে সমুখে দাঁড়ালে, যেন
 
অনাদিকাল হতে আমারই প্রতীক্ষাতে ।
রোমে রোমে পুলকেতে জাগে শিহরণ
 
আমাকে শুধালে সে, "আছেন কেমন । "
মাত্র দুটো ছোট্ট শব্দ , সহস্র ঝর্ণা
 
অলক্ষ্যেতে বাজে শুনি লক্ষ
  মোহনবীণা
আমাকে শুধালে সে "আপনি "সম্বোধনে
তবু ভালো দেখা হলো হঠাৎই দুজনে ।
অবাক বিস্ময়ে দেখি এখনো তেমনি
সেই চোখ, সেই দৃষ্টি, সেই
  দীপ্ত চাহনি 
আমাকে বললে সে, পরিচিতি হোক।
ঐ যে পার্কে বসা,
  কোনার ভদ্রলোক  
সরিফুজ্জমান হক। আমার স্বীকৃত বর
অতি সজ্জন । ভালবাসেন যেন জন্নতে হুর।
 
ভালবাসার কিতাব আমি আবার শিখেছি ।
 
যেখানে ছিল
  ত্রুটি শুধরে নিয়েছি । 
আর ঐ মেয়েটি, সরিফের আফিয়া
 
যার জন্ম নিয়ে ছিল অসংখ্য সংশয় ,
ভয় ছিল কি হবে তার পিতৃপরিচয়;
উনি দিয়েছেন তাকে কন্যা স্বীকৃতি ।
ভালো করে দেখুন
  ওর মুখের গড়ন, 
কোথাও কি লুকিয়ে আছে পরিচিত
  ছাপ,
ও মৃন্ময় কন্যা মরিয়ম, ভালবাসার অভিশাপ ।
চমকে উঠি, কি শোনালে ফেরদৌস এবার
 
মরিয়ম আমার আত্মজ, আমার সন্তান ।
তবে কি ফেরদৌস ---? হে ঈশ্বর ক্ষমিও আমায়।


মানুষের মন জয় করুন নিজের ব্যবহার দিয়ে


।।জাকারিয়া ইছলাম।।


        প্রত্যেকেই তার কাঙ্ক্ষিত বস্তু লাভের জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করে থাকে। সম্পদের জন্য যে লালায়িত সে তা অর্জনের নিমিত্তে ও সমৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন রকমের কলাকৌশল ব্যবহার করে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের বিভিন্ন পদ্ধতি আবিষ্কার করতে সর্বদা সচেষ্ট থাকে।



(ফটো গুগল ডটকম তেকে)


স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো দর্শকদের মন জয় করার জন্য আধুনিক বিভিন্ন প্রোগ্রাম ও নতুন নতুন অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে থাকে। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ও সঞ্চালকদেরকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় যাতে তারা দর্শকদেরকে আকৃষ্ট করে তাদেরকে অনুষ্ঠান দেখতে আগ্রহী করতে পারেন। একই কথা প্রিন্টমিডিয়া ও বেতারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
অনুরূপভাবে পণ্য বা সেবার উৎপাদকের (প্রোডাক্ট প্রমোটারদের মাধ্যমে) ক্রেতাদের মন জয় করার জন্য কতরকমের পদ্ধতি অবলম্বন করে। যেসব কলাকৌশলের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি করা যায় সেসব কলাকৌশল জানতে এবং সেগুলোকে কাজে লাগাতে সবার মধ্যেই কমবেশি আগ্রহ দেখা যায়।
মানুষের মন বা হুদয় জয় করার অনেক পদ্ধতি ও কলাকৌশল রয়েছে। মনে করেন আপনি একটি সভায় উপস্থিত হলেন। সেখানে প্রায় চল্লিশজন মানুষ রয়েছেন। আপনি তাদের সঙ্গে হাত মেলাতে লাগলেন। প্রথমে একজনকে গুড মর্নিং বলে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। সে কোনরকম হাতের অংশবিশেষ এগিয়ে দিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল 'ধন্যবাদ'। আপনি দ্বিতীয়জনের কাছে গেলেন। সে পাশের একজনের সঙ্গে কথা বলছিল। আপনার গুড মর্নিং শুনে সে হতচকিত কণ্ঠে জবাব দিল এবং আপনার দিকে না তাকিয়েই হাত বাড়িয়ে দিল। তৃতীয়জন তার মোবাইল ফোনে কথা বলছিল। আপনি গুড মর্নিং বলায় সে হাত বাড়িয়ে দিল। কোন রকম হাত মিলিয়ে তবে সৌজন্যস্বরূপ কিছু বলল না, এমন কি আপনার প্রতি কোন আগ্রহ দেখালও না। আর চতুর্থজন আপনাকে আসতে দেখেই গুড মর্নিং বলে দাঁড়িয়ে গেল। চোখে চোখ পড়তেই হাসিমুখে আপনার সঙ্গে কথা বলল। তার হুদয়ের গভীর থেকে আপনার আবেগ প্রকাশ করে আপনার সাথে হাত মেলাল। আপনার সঙ্গে সাক্ষাত করতে পেরে সে বেশ আনন্দিত হয়েছে অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে এটা প্রকাশ করলো। অথচ আপনিও তাকে চেনেন না, আর সেও আপনাকে চেনে না।
এভাবেই আপনি সকলের সাথে গুড মর্নিং বলে হাত মিলিয়ে পরিচয়ের পর্ব শেষ করলেন। এখন বলেন তো, এই চারজন লোকের মধ্যে কার প্রতি আপনার আকর্ষণ সৃষ্টি হবে?
         নিশ্চিত চতুর্থ লোকটির প্রতি আপনি অন্য রকম আকর্ষণবোধ করবেন। অথচ আপনি তাকে চেনেন না। তার নামও জানেন না, সে কোথায় কাজ করে, কী তার পেশা কিছুই জানেন না। তা সত্ত্বেও সে আপনার হুদয়রাজ্য জয় করে ফেলেছে। আর এটা সে কোন টাকা পয়সা কিংবা বড় কোন পদের ক্ষমতার দাপটে করে নি। করে নি বংশমর্যাদার বলে। সে আপনার হুদয়রাজ্য জয় করেছে কেবল কৌশলী আচরণের মাধ্যমে।
এতে প্রতীয়মান হলো, শক্তি, সম্পদ, সৌন্দর্য ও পেশার বড়ত্ব দিয়ে মানুষের হুদয়ে জয় করা যায় না। বস্তুতঃ মানুষের হুদয় এর চেয়েও অনেক সহজে জয় করা যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও খুব কম মানুষ অন্যের হুদয় জয় করতে পারে। আমার মনে আছে, আমি যখন কলেজে পড়তাম তখন আমার সাথে একটা ছেলে পড়ত(সে আমার বন্ধু ছিলো) সে একবার মারাত্মক মানসিক রোগাক্রান্ত ছিল। তার পিতা আমার কলেজের  একজন প্রফেসার ছিলেন। তার বাবার সাথে আমার খুব ভালো রিলেশন ছিলো। আমি অনেক সময় আমার বন্ধুকে সাহায্য করেছি। আমি মাঝে মাঝে তাদের বাড়িতে বেড়াতে যেতাম। তাদের বাড়িটি দেখতে ছিল রাজপ্রসাদের মতো। তার পিতার বৈঠকখানায় সবসময় অতিথিদের এতো ভিড় তাকত যে, সামান্য ফাঁকা জায়গাও থাকত না। তার প্রতি মানুষের এতো ভালবাসা ও আগ্রহ দেখে আমি খুব অবাক হতাম।
অনেক বছর পর। একদিন আমি তাদের বাড়িতে গেলাম। তখন তিনি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন।
আমি তার সে বৈঠকখানায় প্রবেশ করলাম। কামরাটির দিকে তাকালাম। কামরাটির বর্তমান অবস্থা দেখে আমি আশ্চর্য হলাম। সেখানে পঞ্চাশটির অধিক চেয়ার পড়ে আছে। কিন্তু কামরায় কেউ নেই। একজন বুয়া তাকে চা-কফি দিয়ে যাচ্ছে। আমি সেখানে তার সঙ্গে কিছুক্ষণ বসলাম। বের হওয়ার পর ভাবতে লাগলাম, তিনি যখন চাকুরিতে ছিলেন তখন তার কেমন অবস্থা ছিল আর বর্তমানে তার অবস্থা কী? আগে কেন মানুষ তার কাছে আসত? কেন তারা তাকে ভালবাসত? এখন তাকে কেন সেরূপ ভালবাসে না? কেন তার বৈঠকখানায় আগের মতো ভিড় নেই?
আমি বুঝতে পারলাম,  তাই তিনি সদাচরণ এবং অমায়িক ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের হুদয়-রাজ্যকে জয় করতে পারেন নি। মানুষ তারকাছে আসতো তার পদমর্যাদার কারণে, তার চাকরির ক্ষমতা ও প্রভাবের কারণে। ব্যক্তিত্ব ও চারিত্রিক গুণের কারণে নয়। আজ যেহেতু তার চাকরি নেই তাই তার সে ক্ষমতাও নেই। তাই আগের মতো উপচে পড়া সে ভিড়ও নেই।
আপনি মানুষের সাথে এমন ভাবে কথা বলেন, যেন তারা ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে ভালবাসে। তারা যেন আপনার কথা, আপনার হাসি, আপনার বিনম্র আচরণে মুগ্ধ হয়ে আপনাকে ভালবাসে। তারা যেন আপনাকে ভালবাসে। অন্যের দোষ দেখেও তা পাশকেটে যাওয়ার মহৎ গুণের কারণে এবং অন্যের বিপদে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেয়ার মানসিকতার জন্য। তাদের আন্তরিকতা ও ভালবাসা যেন আপনার পদমর্যাদা ও অর্থের কারণে না হয়; বরং তা যেন হয় আপনার প্রতি তাদের হুদয়ের ভালবাসার কারণে। যে ব্যক্তি তার স্ত্রী-সন্তানকে অর্থ-সম্পদ, খাবার-দাবারসহ সব চাহিদা পূরণ করে, সে হয়তো তাদের উদর-তুষ্টি লাভ করতে পারে কিন্তু তাদের হুদয়ের ভালবাসা লাভ করতে পারে না।যে তা সন্তানকে পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ দেয়, কিন্তু তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে, সে তাদেরকে আর্থিকভাবে খুশি করতে পারলেও তাদের মনের রাজ্যে প্রবেশ করতে পারে না।
যদি আপনি দেখেন, বিপদে পড়ে কোন যুবক তার বন্ধু বা তার পরিচিত কোন ব্যক্তির শরণাপন্ন হয়েছে কিন্তু নিজের বাবাকে জানায় নি তাহলে এতে আশ্চর্য হবেন না। কারণ, তার বাবা তার হৃদয়কে জয় করতে পারে নি, ভাঙতে পারেনি তার ও সন্তানের মাঝে বিদ্যমান অদৃশ্য দেয়াল। অথচ তার বন্ধু কিংবা পরিচিত কেও তার হুদয়রাজ্য অবলীলায় জয় করে ফেলেছে। অনেক সময় মারাত্মক দুশমনও হুদয় জয় করে ফেলতে পারে। তবে এর জন্য দরকার হৃদয়কাড়া আচরণগত দক্ষতা আর মানুষ কে আপন করে নেয়ার সুন্দর কৌশল।
আরেকটি বিষয় ভেবে দেখুন। কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে আপনি হয়তো লক্ষ্য করেছেন, তারা যখন কোন সভায়/মিটিঙে উপস্থিত হয়ে বসার জন্য জায়গা খুঁজতে থাকে তখন উপস্থিত লোকদের মাঝে একধরণের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। সবাই তাকে ডাকতে তাকে, সবাই তাকে নিজের পাশে বসতে অনুরোধ করে। বলেন তো এমনটি কেন হয়? কেন তার প্রতি সকলের এতো আগ্রহ! কেন সবাই তার পাশে বসতে চায়? কেউ একজন আপনাকে হয়তো রাত্রের খাবার জন্য ডিনারের ইনভাইট করল কোন এক রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টের নিয়ম হল, প্রত্যেকে নিজ চাহিদা মতো ডিশ থেকে নিজ নিজ প্লেটে খাবার নিয়ে নেবে। তার পর কোন একটা গোল টেবিলে বসে খাবে। সেখানে আপনি হয়তো দেখে থাকবেন যে, কেউ নিজের প্লেট পূর্ণ করার আগেই অনেকে তাকে ইশারা করে বলতে থাকে, ‘এই যে এখানে ফাঁকা জায়গা আছে, এখানে বসুন। প্রত্যেকেই চায় সে তার সঙ্গে বসুক।
কিন্তু ঠিক সেখানে অন্য একজন তার প্লেট পূর্ণ করে এদিকে সেদিকে তাকাচ্ছে অথচ কেউ তাকে ডাকছে না। কেউ তার প্রতি কোন ভ্রূক্ষেপ করছে না। সে একাকী কোন একটি টেবিলে গিয়ে বসে খেয়ে নিচ্ছে।
প্রথমজনের প্রতি মানুষের এতো আগ্রহ, অথচ দ্বিতীয়জনের প্রতি কোন আগ্রহ নেই। এর কারণ কী? কিছু মানুষ এমনও আছেন যে, তারা যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের প্রতি অন্যদের মনের টান অনুভূতি হতে থাকে। যেন তাদের হাতে বিশেষ চুম্বক আছে, যেটি দিয়ে দূর থেকেও তারা অন্যদের হৃদয়-মন আকর্ষণ করে থাকে। এরা কিভাবে অন্যদের হুদয় জয় করলেন? বস্তুত এটা হল বুদ্ধিবৃত্তিক এমন কিছু কলাকৌশল যার মাধ্যমে একজন মানুষ অন্য মানুষের হৃদয়কে জয় করতে পারে। করতে পারে মানুষের ভালবাসা অর্জন।

শেষ কথা
অন্যের হৃদয় জয় করার এবং তাদের ভালবাসা অর্জনের ক্ষমতা আমাদের জীবনকে করতে পারে আরো সুখময়, প্রাণবন্ত ও উপভোগ্য।  



শনিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৮

আমার ছেলেবেলা



   ।।   এম রিয়াজুল আজহার লস্কর ।।

(C)Image:ছবি









ভোরটা হলেই পাখির গানা আসত পাখি গাছে।
গবাদি সব জমত পশু ধলেশ্বরীর কাছে।।
সকাল হলেই পড়া লেখা বিকেল হলেই খেলা।
স্বপ্নের মতই ভাসছে এখন আমার ছেলেবেলা।।

ভোরটা হলেই হুক্কা খেয়ে নামত মাঠে চাষি।
বনের ধারে দুলত হাওয়ায় পুষ্প রাশি রাশি।।
রোজ বিকেলে বনের ধারে জমত শিশু মেলা।
স্বপ্নের মতই ভাসছে এখন আমার ছেলেবেলা।।

রাত্তি হলেই হুক্কা হুয়া ডাকত শেয়াল মাঠে।
বনের বাঘে করত খেলা কাটা গাঙ্গের ঘাটে।।
রাত্তি হলেই অশ্রু ঝরা আসত পড়ার ঠেলা।
স্বপ্নের মতই ভাসছে এখন আমার ছেলেবেলা।।

ঝগড়া ফ্যাসাদ মারামারি অল্প ছিলো গাঁয়।
স্কুল পালালে বিপদ হত করত শাসন মায়।।
সোনার গাঁয়ে মিষ্টি হাওয়া সবুজ রঙ্গের মেলা।
স্বপ্নের মতই ভাসছে এখন আমার ছেলেবেলা।।
                           ------
(শব্দ তরঙ্গ, পৃষ্ঠা নং ৩৫)
© সংরক্ষিত


সুরমা গাঙর পানিঃ সিলেটি জীবনের মহাকাব্য

(লেখাটি শতক্রতু পত্রিকাতে প্রকাশিত। পুরো উপন্যাস ঈশানের পুঞ্জমেঘেও পড়তে পারেন। 



দেবাশিস ভট্টাচার্য 


নতিপ্রজ আখ্যানকার রণবীর পুরকায়স্থ হালের এক শক্তিমান কলমচি। গদ্যের জটিল কারিগরিতে তিনি বিন্যস্ত করেন আখ্যান। ভাষার মুদ্রিত ও দৃশ্যমান সজ্জার অন্তর্বয়নে কিংবা ইনার সারফেসে গড়ে তোলেন কথার আরেক স্তর। এই দুই স্তরেও গদ্যের নির্মিতি সার্থক হয় না, যদি না ইশারায় বা ব্যঞ্জনায় থাকা দৃশ্যগন্ধ উপলব্ধির তৃতীয় স্তরটি উন্মোচিত হয়। বলা ও না বলার নানা স্তরের যোগফলে রণবীরের নাগরিক গল্পবীক্ষা এবং জটিল কথকতা অর্থের উপকূলে পৌঁছায়। প্রকাশিত আধ ডজন গল্পের বইতে গল্পত্ব কম, কাহিনির মায়াসৃজনের চাইতে সুমেধার ভেদ-উপযোগী আখ্যান নির্মাণেই আনন্দ পান এই লেখক। স্বভাবতই তাঁর পাঠক সংখ্যা অপ্রতুল। বচনের কারিগর রণবীর পুরকায়স্থর এই যে ভাবমূর্তি, তা ভেঙে দেয় তাঁর একমাত্র উপন্যাস সুরমা গাঙর পানি। গল্পত্বকে এই উপন্যাস পরিহার করেনি, গল্পের আকর্ষণে সাড়ে তিনশো পৃষ্ঠার বিশাল উপন্যাসটিও ক্লান্তিকর ঠেকে না। তবে আঞ্চলিক ভাষার ব্যাপক প্রয়োগ, শ্রীহট্টীয় সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ-প্রবাদ-জনশ্রুতি-ভূগোল ইত্যাদির অপরিচয়ের দরুন প্রাথমিক পাঠ খানিকটা অস্বস্তি দিতে পারে পাঠককে। এমন সমস্যার কথা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেওছেন এক পশ্চিমবঙ্গীয়পাঠক। আঞ্চলিক উপাদানে ভরা উপন্যাস পাঠকের এতটুকু শ্রম দাবি করতেই পারে। চট্টগ্রাম কিংবা সিলেট এর পাঠক যদি হাঁসুলিবাঁকের উপকথার প্রথম পাঠে সমস্যার কথা বলেন, রাজধানীর মানুষের কাছে সেটা পাঠকের অপরাধ বলেই গণ্য হবে। কেন্দ্র-পরিধির মনস্তাত্ত্বিক বাধা পেরিয়ে যে-পাঠক সুরমা গাঙর পানিপাঠ করবেন, তিনি ইতিহাস ও সংস্কৃতির বিচিত্র তথ্যের সঙ্গে যেমন পরিচিত হবেন, তেমনি চেতনাপ্রবাহরীতি আধারিত আখ্যানের সাংগীতিক গঠনও তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে না। নানাদিক থেকে এই উপন্যাসটি আলোচনা সম্ভব। গোটা সুরমা-বরাক উপত্যকার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা অনুপুঙ্খ উপন্যাসটিকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। উপন্যাসের প্রধান ঐতিহাসিক ঘটনা দেশভাগ। তবে বাংলা কথাসাহিত্যের প্রবণতা অনুসারে, এখানেও ভাগের কথা সামান্যই। ফলের কথাটাই বেশি। দেশভাগ ও রেফারেন্ডামের পর কেন্দ্রীয় চরিত্র বৈতলের দেশত্যাগ ঘটে ২১তম পরিচ্ছেদে, এর পরও রয়েছে উজান পর্বের আরও ৪২ টি পরিচ্ছেদ, যেখানে বৈতলের ঠিকানাসন্ধান যুক্ত হয় স্বাধীনতা-উত্তর কাছাড়ের উদ্বাস্তু পুনর্বাসন এবং এক দশকের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে। প্রাথমিকভাবে ইতিহাসের এইসব বিষয়ই উপন্যাসের আধেয় বলে মনে হয়। উপন্যাসটিকে দেশভাগকেন্দ্রিক বাংলা আখ্যানে এক অভিনব সংযোজন হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে উপন্যাসের ব্লার্বএও। তবে নিবিষ্ট পাঠে উপন্যাসটির আরো কয়েকটি দিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। শ্রীহট্ট-কাছাড়ের আঞ্চলিক জীবন ও সংস্কৃতির এমন কমপ্লিট প্যাকেজঅন্তত অন্য কোনো সাহিত্যিক প্রতিবেদনে এই আলোচকের চোখে পড়েনি। উপন্যাসের ভাষারীতিও এই প্রসঙ্গে স্বতন্ত্র অভিনিবেশ দাবি করে। আর সর্বোপরি আখ্যানের বয়নকৌশল: মধ্যযুগীয় কথকতার একটা উত্তরাধিকার লক্ষ করা যায় সুরমা গাঙর পানিতে। উপন্যাসের ন্যারেটর যে প্রথম পুরুষ, তার স্বর কখনও মিশে যায় উপন্যাসের কোনও চরিত্রের স্বরের সঙ্গে। কথক আর চরিত্র একাকার হয়ে যায়। অন্যদিকে আদি অন্ত মধ্য সমন্বিত প্লট নয়, বরং মুক্ত চলনের সম্মুখমুখী রৈখিক গঠন, স্মৃতির সূত্রে বারবার কয়েকটি নির্দিষ্ট ঘটনা ও দৃশ্যে ফিরে আসা- এ যেন গানের সমে ফেরার মতো ব্যাপার। মার্গসঙ্গীতে স্থায়ীর পাশে ছোট ছোট তান বিস্তার লক্ষ করা যায় অন্তরা-সঞ্চারীতেও। এরকম ছোট ছোট তানবিস্তারের মাধ্যমে আখ্যান বারবার সমে ফিরছে, আবার নতুন বিস্তারকে আত্মস্থ করে চলেছে। কথকতার এই সাংগঠনিক কাঠামোটি কেন্দ্রীয় চেতনাপ্রবাহ আশ্রয় করে এগিয়ে যাওয়ার পক্ষে অনুকূল হয়ে উঠেছে। বৈতলের স্মৃতির প্রবাহেই গড়ে উঠেছে একাধিক উজ্জ্বল ঔপন্যাসিক চরিত্র। চরিত্র নির্মাণে রণবীরের দক্ষতাও মুগ্ধকর। প্রাথমিক ভাবে পাঠকের পর্যবেক্ষণে উঠে-আসা বিষয়গুলির প্রথম দুটি সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছুটা আলোচনাই এই নিবন্ধের উপজীব্য। বলাবাহুল্য, বাখতানীয় অর্থেই অনেকার্থদ্যোতক, বহুস্বরিক এই আখ্যানের আরো অনেক অর্থ, আরো অনেক পাঠ সম্ভব।

।।২।।

সুরমা গাঙর পানিউপন্যাস ঘটনাপ্রবাহ মোটামুটি তিরিশ বছর ব্যাপ্ত। প্রোটাগনিস্ট বৈতলের জন্ম ১৩৩৫ বাংলার গুলাসময়, অর্থাৎ ১৯২৯ সালের বর্ষায়। আখ্যানের সমাপ্তি সমাপ্তি ১৯৬০ সালের আরেক বন্যায়। দেশভাগ ও গণভোটের পর, আবার ১৯৫০-এর পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে নরহত্যা ও শত্রু সম্পত্তিদখলের এক অতিচারী পর্ব শুরু হবার আগেই, বৈতল চলে আসে বইয়াখাউরি থেকে কাছাড়ের শিলচরে, আনুমানিক ১৯-২০ বছর বয়সে। এর মাঝেই, কৈশোরে মুসলমান ছেলে লুলার সঙ্গে অভিন্নহৃদয় বন্ধুতা, দুই বাউণ্ডুলের সিলেট ভ্রমণ এবং গুরু সৃষ্টিধর ওঝার কাছে মনসামঙ্গল গান ও নৃত্যশিক্ষা, দেশভাগের হাওয়ায় লুলার রুহুল আমিন হয়ে ওঠা, ‘কয়েদ আজমএর নামে হিন্দুনারীর ওপর আক্রমণ, আর বৈতলের জীবনের সঙ্গে দুর্গাবতী জড়িয়ে যাওয়া। প্রথম খণ্ডের ২১টি পরিচ্ছেদে রাজনৈতিক ইতিহাসের উত্তাপ সঞ্চারিত হয়েছে ধীর লয়ে। বৈতল আর লুলা এই দুই কিশোর জানে, ‘মাইনষর গাত লেখা থাকে না ইন্দু বাঙাল। ইতা মাইনষে বানায়’ (পৃঃ২৭)। দুই বোহেমিয়ান কিশোর ঘুরে বেড়ায় পশ্চিমের সুনামগঞ্জ থেকে পুবের আদরখানা পাথারকান্দি অব্দি। মসজিদে বাজারে বৈতল দাস হয় বৈতল মিয়া, পড়ে নামাজ। রুহুল আমিন লুলা দাস হয়ে প্রসাদ গ্রহণ করে মন্দির-আখড়ায়। মাতৃহীন লুলার জন্য প্রতীক্ষায় থাকে বইয়াখাউরির দুখিনী মা। আলাদা করে মুরগি রান্না করে খাওয়ায় নিজের মুসলমান ছেলেকে। মায়ের স্বপ্নপূরণ করতে বৈতল যায় গুরুগৃহে, পুথি পড়া শিখতে। এদিকে পিতৃগৃহ মিরতিঙ্গায় গিয়ে সর্পাঘাতে মারা যায় বৈতলের মা। পরম যত্নে মায়ের শব ভেলায় রেখে নদীতে ভাসায় রুহুল আমিন। এই যাপনে ধীর লয়ে আসে দেশভাগ প্রসঙ্গ। মুসলমান প্রধান সিলেটে হিন্দুদের মধ্যে আতঙ্ক শুরু হয়। গুরুর দোকানে ঠাকুরের কুর্সি বানানো কমে যায়। সিলেট বিভাগ যা দীর্ঘদিন ধরে আসাম প্রভিন্সের অঙ্গ, তাকে আসামে রাখতে অনাগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন অসমীয়া নেতৃত্ব। বাঙালি হিন্দুদের একটা বড় অংশ চাইছিলেন দেশভাগ হোক, নতুবা হিন্দুর কর্তৃত্ব থাকবে না। আসামে সাদুল্লা আর বাংলায় সোহরাওর্দি-ফজলুল হক পর্বের শাসন এর প্রেক্ষাপটে ক্ষমতায় অংশিদারিত্বের অভীপ্সা থেকে হিন্দু মধ্যশ্রেণির দেশভাগ এর পক্ষাবলম্বন, আর মুসলমানদের মধ্যে ভারতে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীতে পরিণতি হবার চেয়ে স্বতন্ত্র মুসলমান রাষ্ট্রের পোষকতা-সিলেটের প্রেক্ষিতে এই রাজনৈতিক বাস্তব চমৎকারভাবে উঠে এসেছে বৈতলের গুরু সৃষ্টিধরের সহজিয়া সংলাপেঃ সিলেট অখন বউত পক্ষর এক কমরর তেনা। এইন টানলে হেইন লেংটা। আসামি হকলে ডরাইন বাঙালি রাজা অই যাইব। বাংলা ভাগ না অইলে হিন্দুয়ে ভাবইন প্রধানমন্ত্রী পাইতা নায়। মুসলমানে ভাবইন ইণ্ডিয়াত থাকলে পাওর তলর বেঙ অইয়া থাকা লাগব” (পৃঃ৪০)

এই পরিস্থিতিতে যেমন সৃষ্টিধর ছেড়ে যেতে চান না নিজের জন্মভূমি বিয়ানিবাজার রইদপুয়ানি, তেমনি পাগলা বইয়াখাউরির পানির পুকবৈতলও ভাটির জল হাওর ছেড়ে যেতে চায় না কোনো নতুন ঠিকানায়। নতুন দেশে তো আর লুলার মতো বন্ধু পাওয়া যাবে না। ধর্মের বিভাজন মানে না লুলা-বৈতল। বৈতলের বাড়িতে লুলা-বৈতল একসঙ্গে থাকবার সিদ্ধান্ত নেয়। লুলার কাছে ধর্ম পরিচয়ের কোনো তাৎপর্যই ছিল না, সে বৈতলের সঙ্গে ঢাকা দক্ষিণের বাবুদের বাড়িতে মহাপ্রভু প্রিয় কচুশাকের প্রসাদ নিয়েছে, তার চোখের সামনে দ্রুত কেমন বদলে যায় সব কিছু। গণভোটে ঘরের চিহ্ন হেরে যাবার পর মুসলমানেরা কেমন অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে শারদোৎসবের ঢাকের বাদ্যি সম্পর্কে, বাজনা আস্তেবাজানোর নির্দেশ দেয়। বিরক্ত লুলা মন্তব্যে করে, “কেনে, আস্তে কেনে আকতা। বাঙাল হকল জিনি গেছইন, নানি!” (পৃঃ ৭৪)

হন্তারক সময় এই লুলাকেও বদলে দেয়। লুলা একদিন বন্ধু বৈতলকে বলেছিল, লিগের স্থানীয় নেতারা বৈতলকে ফুসলে তার বাড়িটা হাতিয়ে নেবার পরামর্শ দিয়েছিল। দেশভাগ আর রায়ট লুলাকেও ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সৈনিক হিসাবে গড়ে তোলে। বন্ধু বৈতল বলে, “তুই তো ইলাখান আছলে নায়” (পৃঃ ৭৬) কয়েদ এ আজমের নাম করে, হিন্দু মেয়েদের সর্বনাশের খেলায় পেয়ে বসল লুলাকে। এই লুলাই দুমাস আগের বন্যায় পীড়িত মুসলমানদের নিয়ে মালিটিলার কালীমন্দিরের আশ্রয় নেয়, দুর্গত হিন্দু-মুসলমান মানুষগুলির অন্নসংস্থানের জন্য ভরা পিয়াইনের জলে ঝাঁপিয়ে বৈতলের সঙ্গে মিলে ডাকাতি করে, চাল-ডাল। যখন সে কয়েদ এ আজমের নাম করে, হিন্দু মহিলাদের উপর রাতের আঁধারে ঝাঁপানো শুরু করে দিয়েছে, তখনো বন্ধু বৈতলকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। দুর্গাবতীর সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে বৈতল হত্যা করে লুলাকে। দেশভাগ, ‘পানির পুকবৈতলকে সুনামগঞ্জের হাওর ছেড়ে উজানে যেতে বাধ্য করে, এবার তার ঠাঁই হয় মেহেরপুরের উদ্বাস্তু শিবিরে।

উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ডের ঘটনা প্রবাহের অন্যতম প্রধান বিষয় দেশভাগের বলি মানুষের পুনর্বাসন প্রসঙ্গ। পঞ্চাশের দাঙ্গার আগে পরে শিলচর শহর ও তার আশেপাশে অনেকগুলি উদ্বাস্তু ক্যাম্প গড়ে উঠেছিল। বরাক উপত্যকার বেশ কিছু স্থাননামেও ক্যাম্পশব্দটি রয়েছে। সুরমা গাঙর পানিতে ক্যাম্প জীবনের টুকরো টুকরো ছবি রয়েছে। রয়েছে ক্যাম্প-এর ডোলএর লোভে স্থানীয় মানুষজনেরও উদ্বাস্তু শিবিরে নাম লেখানো, রিলিফ নিয়ে বখরা, দুর্নীতি- এসবের টুকরো-দৃশ্য। উপন্যাস জানাচ্ছে, শিবিরবাসীদের সম্পর্কে শহরের মানুষের তেমন কোনো সহানুভূতি নেই। শহরের সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়া, চুরি ডাকাতির ঘটনা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি ক্ষুব্ধ করে শহরবাসীকে। আবার সুযোগসন্ধানী জমিদার ও ক্ষমতাবান মানুষেরা ক্যাম্পে ক্যাম্পে বেগার শ্রমিক খোঁজে। ক্যাম্প এর জীবনকে লেখক বলেছেন, ‘প্রতিবেশী দেশের নাগরিক খোঁয়াড়’- পশুবৎ জীবনের গভীর যন্ত্রণা এই একটিমাত্র বিশেষণে উন্মোচিত হয়। ঘোলাজলে মাছ ধরার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেরও বিবরণ রয়েছে উপন্যাসে। ক্যাম্পবাসী বৈতল রিলিফ অফিসারের কাছে জানতে যায়, ‘আমরার কিতা অইব, কই যাইমু না অউ ছাপটা ঘরো থাকিয়া মরমু?’ রিফুজির আত্মপরিচয়ের সংকট স্পষ্ট হয় তার উচ্চারণে ঃ গান্ধিয়ে জিন্নায় ইতা কিতা করলা আমরার! ... আমরা কিতা কইন চাইন, হিনর বাঙাল হকলে কয় বাপর দেশো যা, আইলাম। ইনর ইন্দুয়ে বাঙালে কয় রিফ্যুজি কিতা হিন্দু না মুসলমান না খেদাখাওয়া হকলর নতুন ধর্ম।’ (পৃঃ২১০) এরই মাঝে ওড়া খবর আসে নেতাজী সুভাষ ফিরে আসবেন, দুই বাংলা এক করবেন, উদ্বাস্তুরা ফিরে যাবে দেশে। জন্মভিটেয়। স্মৃতিতাড়িত উদ্বাস্তুদের কেউ কেউ দেশে ফিরে যাবার জন্য ভিক্ষা করে অর্থসঞ্চয়।

রয়েছে পুনর্বাসনের ছবিও। পুনর্বাসন আন্দোলনকে জীবনব্রত করে নিয়েছিলেন তারাপদ ভট্টাচার্য, যিনি নিজেও উদ্বাস্তু, শিক্ষকতা করেন শহর শিলচরে। তারাপদ উপন্যাসে এসেছেন হরিমাধব ভট্টাচার্য হয়ে। কালাইন-কাটিগড়া-বড়খলার মতো জনপদগুলিতে উদ্বাস্তুর পুনর্বাসনের আইনি লড়াই, হুরমত আলি বড়লস্কর এর মতো ঐতিহাসিক ব্যাক্তিদের প্রয়াস উপন্যাসে ডকুমেন্টেড হয়। বরাক উপত্যকার উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের এই টুকরো ছবিগুলি উপন্যাসের ইতিহাস অংশের আধেয়। এখানেও রয়েছে লিগ সমর্থক মুসলমানেরা, যারা শ্লোগান তুলেছে সিলেট নিছি গণভোটে/ কাছাড় নিমু লাটির চোটে। ক্রমশ এই স্বর ফিকে হয়ে আসে, লিগের বড় নেতা ময়নুল হক চৌধুরী কংগ্রেসের অবিসম্বাদী নেতা হয়ে যান। হিন্দু মহাসভাপন্থী যমুনা প্রসাদ সিং প্রথম দিকে মুসলমানদের পাকিস্তানে পাঠানোর হম্বিতম্বি করলেও পরে, ক্ষমতার লোভে হয়ে ওঠেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষকংগ্রেসের চা-জনগোষ্ঠীর অন্যতম নেতা। দুই বছর আগে চা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি বেড়েছিল, দু বছরের তলবের দিনে এরিয়ার দিতে গিয়ে দেখা গেল, ইউনিয়নের লেভির পরিমাণ শ্রমিকের বকেয়া মজুরির পরিমাণ থেকে বেশি। শ্রেণি শোষকদের ঐক্যমঞ্চ হয়ে ওঠা কংগ্রেসের ভূমিকা উপন্যাস দেখায় ইতিহাস সম্মতভাবেই। জমিদার যমুনা প্রসাদ আশ্রিত উদ্বাস্তু সামান্য রিক্সাচালক বৈতলকে হত্যা করিয়ে দাঙ্গা বাঁধিয়ে ভোটে জয় সুনিশ্চিত করতে চায়। বৈতলের ভাবনায় উঠে আসে ইতিহাসের প্রতিকার হীন জিজ্ঞাসা। “...দেশ তো ভাগ হয়ে গেছে, হিন্দুস্তান টুকরো হয়েছে, পাকিস্তান হয়েছে। দুই ধর্মের লড়াই কেন থামে না তবে” (পৃঃ২৭৩)। যে-দেশভাগ জন্মসূত্রে পাটনি বৈতলকে সৃষ্টিধর শর্মার নতুন পরিচয় দেয়, উৎখাত করে প্রাণপ্রিয় সিলেট আর সুনামগঞ্জ এর ধাত্রীভূমি থেকে, তারই ধারাবাহিকতায়, আখ্যানের সমাপ্তিতে বৈতলকে বেরোতে হয় আরেক নিরুদ্দেশ যাত্রায়। এক যুগ আগে পরে দুই বন্যায় বৈতলের প্রব্রজনের দৃশ্যটি পুনর্বার অঙ্কিত হয়। বৈতল কিংবা সৃষ্টিধর মূলোৎপাটিত বৃক্ষের মতো থিতু হতে পারে না। জলপুত্র বৈতলের দেশ হারানোর আখ্যান সুরমা গাঙর পানি

।।৩।।

এই হল উপন্যাসের ইতিহাস অংশ। আখ্যানের বিস্তৃত পরিসরে উল্লিখিত হয়েছে প্রচুর ঐতিহাসিক চরিত্র। দেশভাগের আগে যে কমিউনিস্টরা ছিলেন কংগ্রেসেরই অংশ, দেশ ভাগের পর অনন্ত সাধুর মতো কেউ কেউ চলে এসেছেন শিলচরে। ছিলেন বীরেশ মিশ্র অচিন্ত্য ভট্টাচার্যর মতো নেতারাও। তাদের একবারমাত্র নামোল্লেখ ছাড়া তাদের কাজকর্ম সম্পর্কে উপন্যাস নীরব। সতীন্দ্রমোহন দেব, মইনুল হক চৌধুরী, হুরমত আলি বড়লস্কর, বড়খলার দেব লস্কর পরিবার এর নামই এসেছে শুধু। জমিদার যমুনা প্রসাদের মধ্যে একাধিক ঐতিহাসিক ব্যাক্তির ছায়াপাত ঘটেছে। শিলচর শহরের পত্তন প্রসঙ্গে, ব্রিটিশ চা-বাগিচা মালিক এবং ঔপনিবেশিক প্রশাসনের ভূমিকা ইত্যাদি আখ্যানকে প্রসঙ্গক্রমে ছুঁয়ে গেছে মাত্র। এসেছে নতুন বাঙালি বাগান মালিকদের কথাও। উদ্বাস্তু বলতে এক বৈতল ছাড়া আর কারো সঙ্গে তেমন করে পরিচয় ঘটল না আমাদের। এই পর্যবেক্ষণগুলি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে ইতিহাসের প্রেক্ষিতে উদ্বাস্তু-জীবনের যন্ত্রণার আখ্যান রচনাই লেখকের উদ্দেশ্য ছিল না। ঘর এবং দেশ হারানোর যন্ত্রণা বৈতলকে কেন্দ্র করে উচ্চকিত হতে পারে না। সে-অর্থে বৈতলের ঘর ছিল না, সে আজন্ম বোহেমিয়ান, পায়ের তলায় তার সরষেদানা, আর তাই সব ঠাঁই তার দেশের ঠিকানা। দেশের বাড়ির জন্য পিছুটান তার অল্পই। তার বিরহ জলের জন্য ও জলাভূমির জন্য। ভারতবর্ষ তাকে পুনর্বাসন না দিক, পুনর্বাসন দিয়েছে বরাক। দেশের স্মৃতি তার দুটি মানুষকে ঘিরেঃ লুলা আর সৃষ্টিধর। এখানেও বরাকপারে লুলার বিকল্প হিসাবে পেয়েছে দুখুকে, আর কখনো মামুজী কখনো কাকাবাবু, কখনো হেডমাষ্টারের মধ্যে সে পেয়েছে সৃষ্টিধরকে। বৈতলের যে-উদ্বাস্তুপরিচয়, তা যতটা রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক তার চেয়ে বেশি দার্শনিক। দেশভাগ ও তৎপরবর্তী রাজনৈতিক ইতিহাস উপন্যাসের বহির্বৃত উপাদান হিসাবেই বিবেচ্য।

নিবিষ্ট পাঠে মনে হয়, ‘দেশভাগউপন্যাসটির একমাত্র মর্মবিদারক সত্য’ (ভূমিকা) নয়। উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে সিলেটি সংস্কৃতির মহাকাব্য। উপন্যাসের প্রথমখণ্ডে দুই বিধর্মী কিশোরের ভ্রমণ সূত্রে সিলেটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় হয়। পাগলা-বইয়াখাউরি থেকে অনেকটা উত্তরে মিরতিঙ্গার টিলাভূমিতে বৈতলের মাতুলালয়। বইয়াখাউরিতে শুধু জল আর জল, একের পর এক হাওর। মিরতিঙ্গার টিলাভূমিতে নেমে এসেছে উত্তরের চেরাপুঞ্জি পাহাড় থেকে। আখ্যান ছুঁয়ে যায় লক্ষণশ্রী, দেওয়ান হাসন রাজার বাড়ি। সেখানে যেতে চায় লুলা, তার বাড়ি সিলেটের দক্ষিণ পূর্বের খিত্তা গ্রামে, একেবারে হাকালুকি হাওরের পারে। উত্তরে খানিকটা উজিয়ে বড়লেখা ছাড়িয়ে আরো দক্ষিণ পূবে পাথারকান্দি-আদমটিলা হয়ে ভ্রমণ শেষে উত্তর পশ্চিমে উজিয়ে লুলা বৈতলকে পৌঁছে দেয় বিয়ানিবাজারের পাশে রইদপুয়ানি গ্রামে সৃষ্টিধর ওঝার ভদ্রাসনে। চেরাপুঞ্জি পাহাড়ের দক্ষিণে সুনামগঞ্জ-ছাতক হয়ে সিলেট শহরের উত্তর দিকে পূবমুখে সোজা সরলরেখায় বিয়ানিবাজার স্পর্শ করে রেখাটিকে দক্ষিণে হাকালুকি ছুঁইয়ে আদমটিলা অব্দি নিয়ে পুনরায় উত্তর-পশ্চিমে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত যুক্ত করতে দেখব। দুই কিশোর হবিগঞ্জ বাদ দিলে সিলেটের সমস্ত অঞ্চল ছুঁয়ে গেছে। দুই কিশোর সিলেট শহরে সুরমার চান্নিঘাটে বসে দেখেছে মানুষের মেলা। হজরত শাহজালালের দরগাহ। সিলেট-হাকালুকি-বিয়ানিবাজারের ত্রিভূজের মাঝখানে পড়ে গোলাপগঞ্জ ঢাকাদক্ষিণ, মহাপ্রভু চৈতন্যের পিতৃভূমি। সেখানেও রাত কাটিয়েছে দুই বাউণ্ডুলে কিশোর। দ্বিতীয় খণ্ডের কাহিনি বিস্তৃত হয় করিমগঞ্জ-কুলাউড়া রেল লাইন ধরে বদরপুর থেকে শিলচর শহর পর্যন্ত-দক্ষিণ পূবে মাটিজুরি-জালেঙ্গা অব্দি। শ্রীহট্ট- কাছাড়ের গোটা ভৌগোলিক অঞ্চলটাই উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহের ধারক। বানিয়াচঙ এর কাকিমার প্রসঙ্গ হবিগঞ্জ অঞ্চলকে যুক্ত করে উপন্যাসে।

শুধু ভূগোলই নয়, এই অঞ্চলের বিচিত্র সাংস্কৃতিক জীবন, ‘সুরমা গাঙর পানির বড়ো মূল্যবান উপাদান। ওঝানাচ ও গানের কথা রয়েছে উপন্যাসের অনেকটা অংশ জুড়ে। সারা পূর্ববঙ্গেই মনসাকালট এর চারণভূমি, কিন্তু ওঝা নাচ একান্তভাবেই সিলেটের সম্পদ। আরো বিশেষভাবে বললে সিলেটের পূর্বাঞ্চলের সম্পদ। পশ্চিমের বৈতল ওঝা গান ও নাচ শিখতে এসেছে বিয়ানিবাজারে। করিমগঞ্জ মহকুমার চৈতন্যবরণ পাল শ্রীহট্টের এক বিখ্যাত মনসামঙ্গল গায়ক। পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন পদ্মপুরাণ কাব্যের গায়নোপযোগী পয়ার-লাচাড়ি গুলিকে একত্রে সংকলিত করে তিনি যে পদ্মপুরাণ সংগ্রহতৈরি করেছিলেন, তার মধ্যে রয়েছে তাঁর নিজস্ব গায়নরীতি সম্বলিত বিচিত্র ধূয়া ও দিশা। উপন্যাসে বেশ কয়েকটিরই উল্লেখ রয়েছে। বরাক এবং সুরমা উপত্যকায় নারীবেশী পুরোহিতদের মনসাপূজার প্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে। এ বিষয়ে কৌতূহলী পাঠক সুজিৎ চৌধুরীর প্রাচীন ভারতে মাতৃপ্রাধান্যঃ কিংবদন্তীর পুনর্বিচারশীর্ষক গ্রন্থটির প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধটি দেখতে পারেন। মনসাকাল্ট সম্পৃক্ত তৃতীয় লিঙ্গের এই উপাসকদের বলা হয় গুরামি। এখন আর গুরামিদের দেখা যায় না, একটি তথ্যমতে গোটা বরাক উপত্যকায় এক বৃদ্ধা গুরামিই জীবিত আছেন। এরা মনসামঙ্গলপালাকে প্রচুর খেউড় সমেত, বিশেষ ভঙ্গিতে উপস্থাপন করে থাকেন। সিলেটের ওঝা গান ও নাচ এবং গুরামি নাচ এর বিস্তারিত পরিচয় রয়েছে উপন্যাসে। লিকলিকে চেহারার যুবক বৈতল এর দাড়ি গোঁফ কম, সে আড়াই পেচ এর লম্বা ঘাঘরা ও সাদাজামা পরে, কানে দুল চোখে কাজল ঠোঁটে লালিমা আনে। এই হল গুরামির সাজ। ওঝারা বেনি করেন না, মাথায় ফেজটুপি পরেন, কানে দুল পরেন না। বৈতল গুরামি সেজেছে, তার এই নারীসাজ পত্নী দুর্গাবতীর পীড়ার কারণ হয়ে উঠেছে। ওঝা নাচ হল গান-নাচ-অভিনয়-কথকতার একটা কম্পোজিট উপস্থাপনা। পয়ারে বা ন্যারেশন অংশে সুরের দোলা থাকে, মাঝে মাঝেই বায়েন এর সঙ্গে সংলাপে জড়িয়ে পড়ে ওঝা যেমন তৈরি করেন নাট্যমুহূর্ত, তেমনি গল্প বলার মতো সুরটানা গদ্যে কাহিনিকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যান। উপন্যাস ওঝা গানের এই বৈশিষ্ট্যকে জানাচ্ছে জানাচ্ছে এভাবে, “গুরু বলেন বাদি ওঝা তার ওস্তাদ। ওস্তাদির মার হল লাচাড়ি, মানে শ্রোতাকে ধরে রাখা, নাটক করে দর্শকের মন কাড়া। মিল ছন্দের টানে শ্রোতাকে বিবশ করে দেওয়া, কোথাও কিছু শ্রুতিমধুর অথচ ধরা যাচ্ছে না। কোথাও গানের কথাকে থামিয়ে রেখে, অভিনয় দিয়ে দর্শককে মোহিত করে দেওয়া। কখনও বিষাদ কখনও উচ্চকিত আনন্দ কখনও ঢেউ আসবে দুলে দুলে, আসবে উচ্ছ্বাসে।” (পৃঃ ২৪০) দীর্ঘ পালা অভিনয় করে গান করে পরিবেশনের মাঝে মাঝে পরিবেশটি হাল্কা করে নিতে হয়, বিশ্রামের অবকাশ নিতে হাল্কাচালের অপ্রাসঙ্গিক বিষয় উপস্থাপন করেন গায়েন, যা মনসা পালায় নেই। এই রকম সময়ে বায়েনরাই ধূয়া-দিশার পুনরাবৃত্তি করে বিশ্রামের অবকাশ দেয় গায়েনকে বা ওঝাকে। বৈতল এরকম দিশা গায়ঃ বুড়া গেল না তোর খাইত/ অকারণে হইলে বুড়া দুইফরী ডাকাইত।স্মৃতিসূত্রে আসে ওঝা গানের এই বৈশিষ্ট্যর সৃষ্টিধারী ব্যাখ্যাঃ ইতা হক্কলতা পুথিত নাই রেবা। ইতা চালাকি। একলা বকবক করে কে কওচাইন আউয়ায়। আসরর বউঝি হক্কলরে দি যদি পড়াইতাম না পারলায় তে আর কিওর গাওরা তুমি। সময় দেওন লাগব। নাইলে শ্বাসকষ্ট হইব, শাসিরগ ফুলি গেলে গাইতায়ও পারতায় নায় পড়তায় নায়। এর লাগি তারারে মাতাও মাঝে মাঝে।” (পৃঃ ২৪১) ওঝা নাচের পোশাক, কিন্মপুরুষ বিকল্প গুরামি নাচএর পাশাপাশি মনসা পূজারও অনুপুঙ্খ বিবরণ আছে করণ্ডি-পঞ্চগুড়ি-নাগপেচ ইত্যাদি উল্লেখে।

সিলেটের হিন্দু-মুসলমান উভয়ের কাছেই মনসাকাব্যের জনপ্রিয়তা রয়েছে। জন্ম বাউণ্ডুলে মুসলমান ছেলে লুলা চৈতন্যচরণ পালের নাম জানে, ওঝা সৃষ্টিধরের রইদপুয়ানির বাড়িও চেনে। সিলেট তথা বরাক উপত্যকার মধ্যবিত্ত হিন্ধু পরিসরে শ্রাবণীর পূজার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল পুথি পড়া। দৈনন্দিন জীবনে, উপমা দিতে উঠে আসে পদ্মপুরাণের নানান প্রসঙ্গ। বন্ধুদের সঙ্গে খাবারদাবার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বৈতল যেরকম পদ্মপুরাণ, আবৃত্তি শুরু করে দেয়, তেমন অভিজ্ঞতা গ্রামাঞ্চলে দুর্লভ নয় আজও। ওঝার আসরে আজও মুসলমান দর্শকের যে-ছবি উপন্যাসে রয়েছে, তাও বরাক উপত্যকায় সাধারণ দৃশ্য। মামুপীর যে বৈতলের কণ্ঠে বেহুলার দুঃখগাথা শুনে চোখের জল ফেলেন, তাও লেখকের ইচ্ছাপূরণের নির্মিতি নয়।

শুধু মনসামঙ্গলের পালাগান নয়, বরাক- সুরমা লোকসংগীতের বিচিত্র ধারার পরিচয় রয়েছে উপন্যাসে। সূফী ধারার মরমী কবি হাসন রাজার প্রসঙ্গ এসেছে আখ্যানে বারবার। পরমসত্তার জন্য বিরহের বোধ হাসনের গানের একটা উল্লেখনীয় দিক প্রাণবন্ধে আমারে দেওয়ানা করিয়াছে’- গানটি জানে কিশোর লুলাও। হাসন রাজা গাইতেন প্রেমের গান, দিওয়ানা হয়ে নাচতেন, মুসলমান ধর্মের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা ছিল না। বৈষ্ণব ভাবের মরমী কবির রাধাবিষয়ক একাধিক পদ উঠে এসেছে উপন্যাসে। দিনে লণ্ঠন নিয়ে চলতেন আলোকসন্ধানী মরমী সাধক, তিনিই আবার গেয়ে ওঠেন, “মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমিন। রবীন্দ্রনন্দিত এই গানটিও সৃষ্টিধর-বৈতল সংলাপে উঠে এসেছে। 

হাসনের গানে যে ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক প্রেমসাধনার বানী, সেই একই বাণী বহন করে শিতলাং শার গান। রাধারমন আর শিতলাং শা- এই দুই শ্রীহট্টিয় গীতিকার এর গান রয়েছে উপন্যাসে- শিতলাং শার বৈষ্ণব ভাবাপন্ন পদঃ শিতলাং ফকিরে কয় শ্যামরে কালিয়া/ প্রকাশিত কর ঘর দরশন দিয়া। সুন্দরীমোহন দাস রচিত বিখ্যাত সিলেটি রামায়ণ এর কয়েকটি কলিও শোনা গেল বৈতলের কণ্ঠে। সিলেট তথা সমগ্র পূর্ববঙ্গে একদা জনপ্রিয় মাতমের গান শুনেছি উপন্যাসের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে আদমটিলার ফকিরের কণ্ঠেঃ

ও হোসেন কাইন্দা বলে, মা জননী বলি তোরে,

একটু পানি দিলা না মোরে...

নাম না জানা কবির, সিলেট প্রশস্তিমূলক কবিগানে রুহুল আমিনের কণ্ঠে আমরা শুনলাম হজরত শাহজালাল-এর সিলেটে থিতু হবার জনশ্রুতিঃ ইয়েমেন থেকে পূবের পথে দীর্ঘযাত্রা শেষে আরদেশের মাটির সঙ্গে সিলেটের মাটির মিল খুঁজে পান সুফি সাধক শাহজালালঃ

আরব দেশের মাটির লগে মিল ছিলটর

এর লাগি বাগ অইল বাবা শাহজালালর

জালালি কবুতর উড়ে কাজল পাংখা দিয়া।

আল্লা আল্লা জিকির পড়ে তারা সব বইয়া।।

আবার সিলেটের স্থান বন্দনায় দিলবাহার বাঙাল ওরফে লালু গায় স্বরচিত পদঃ

        জলঢুপের আনারস জগতের সেরা

        শ্রীমঙ্গল ফলায় বুঝি দেখতে যাব মোরা।।

        শ্রীমঙ্গল চায়ের বাগান সবার আছে জানা।

        কেমন করে বানায় চা দেখব তার নমুনা।।

        রয়েছে ময়মনসিং গীতিকার একাধিক পালার (মহুয়া, ভেলুয়া, সুন্দরী) উল্লেখ। ঝড়ের রাতে বৈতলের হাতে লুলার মৃত্যুর পর দুর্গাবতী যখন বৈতলের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে তখন মহুয়ার মতো চান্দ সুরুজসাক্ষী করে মনে মনে বৈতলকে স্বামীরূপে বরণ করে নেয়। শ্রীহট্ট কাছাড়ের সাংস্কৃতিক জীবনে মনমনসিংহের পালাগানগুলি যে গভীভাবে আত্তীকৃত হয়েছে, তার আরেকটি প্রমাণ মাটিজুরির ঠিকাদার সাজিদ মিয়ার গায়ক পুত্রের কণ্ঠে রূপবান পালার পাশেই শুনি ভেলুয়াসুন্দরী পালার গান। গোটা উপন্যাস জুড়ে প্রচুর লোকসঙ্গীত যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে মালসী শ্যামাসঙ্গীতও। সিলেট বৈষ্ণব ভাবাপন্ন মরমি সাধনার যে দীর্ঘ পরম্পরা ছিল, তা জানিয়েছেন যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যও।

        শাহজালালের ৩৬০ অনুচর আউলিয়াদের সাধনা এই ধারাকেই পুষ্ট করেছে। একদিকে শাহজালালের ও তাঁর অনুচরদের প্রেমসাধনা, অন্যদিকে মহাপ্রভু চৈতন্যের পিতৃভূমিতে বিচিত্র কীর্তনোল্লাস দুই স্রোতের এই সমন্বয় সিলেটের সংস্কৃতিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। দৈ খোরা পাগলমনিরুদ্দিনের মতো স্বল্পপরিচিত কবির গানে কখনো কৃষ্ণের মথুরাগমনে বৃন্দাবনের হাহাকার, আবার তার পরেই-

দৈ খোরা পাগলে বলে আল্লার নাম আর

মিছা ভবের বাজার হায় হায় হায়...

এসব মিলিয়েই শ্রীহট্টের সংস্কৃতি। বৈতলের কণ্ঠে ঢালানি জিয়ানির গান, শ্যামাসঙ্গীত যেমন শুনি, তেমনি শুনি মারিফতি জিকিরঃ

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদূর

পয়লা বন্দনা করি মালিক ছত্তার।

দুসরা বন্দনা করি নবি মছতকার।।

        এই বন্দনা গীতিটি আমরা পেয়ে যাই পূর্ববঙ্গ ও সিলেটে একদা জনপ্রিয় গাজির গানের মুখবন্ধে। ঘাটু গান ও নাচের প্রসঙ্গ আছে উপন্যাসে। লুলা কিছুদিন ঘাটুর পুয়াহয়েছিল।

        পীর ফকির, তেলপড়া-জলপড়া, হেকিমি দাওয়াই, হেমাঙ্গ বিশ্বাস আর আব্দুল গফফার দত্তচৌধুরীর গান- সারি গানের চটুল আনন্দ থেকে জারির গভীর বিষাদ। সব সমন্বিত হয়ে গড়ে তোলে সিলেটি পরিচয়। ধর্মাধর্ম গৌণ, মানুষে মানুষে ‘.........’ সিলেটের প্রাণভোমরা। এর মাঝে যখন দেশভাগ এসে পড়ে তখন বৈতলের মতো বিভ্রান্ত যুবক দানিশ পিরের অলৌকিক স্মৃতির উদ্দেশে নিবেদন করে প্রার্থনা। তুমি তো অমৃতবড়ি বানাইতায় পারো। তে কেনে সারে অলাখান একখানো থাকার বড়ি খাওয়ায়ই দেও না। সবরে তারার ধর্মউর্ম ভুলাই দেও। কও তারা সব সিলেটি অউকা। তারা মানুষ অউকা

।।৪।।

        সিলেটি জীবন ও সংস্কৃতির অজস্র অনুপুঙ্খ ছড়িয়ে আছে গোটা উপন্যাস জুড়ে। একটি ছড়ার নমুনা-


(ক)  ছিকাই লড়ে ছিকাই লড়ে

ঝনঝনাইয়া টাকা পড়ে...

(খ)   একখান কথা

কী কথা

বেঙর মাথা

কী বেঙ

ঘাড়ু বেঙ।... 


প্রথমটি একান্তভাবেই বৃহত্তর সুরমা-বরাক উপত্যকার উৎস থেকে জাত, তার কোনো বিকল্প পাঠ অন্য অঞ্চলের উপভাষায় পাওয়া যায় না। দ্বিতীয়টির আঞ্চলিক রূপবৈচিত্র্য আছে। উপন্যাসে এমন কিছু প্রবাদ/ ডিঠান/ বাগধারা/ ধাঁধা পাওয়া যায় যা আঞ্চলিক লোকপ্রজ্ঞার সরল প্রকাশ। যেমনঃ  

(গ)   হাওরর মাঝে হাকালুকি, বাকি সব কুয়া

বাবুর মাঝে মুরারীচান্দ বাকি সব পুয়া।

(ঘ)    পিঞ্জামেঘর আঞ্জাআঞ্জি চেরাপুঞ্জির পাড়ো,

ধলাভেড়া ফালদি পড়ে কালা ভেড়ার ঘাড়ো।।

        হাকালুকি দক্ষিণ সিলেটের বিশাল হাওর, যেখানে লঙ্গাই সহ একাধিক নদী এসে মিলেছে। মুরারীচান্দ সেই ইতিহাসবিখ্যাত ব্যক্তি, যাঁর নামে সিলেটের বিখ্যাত এম সি কলেজ। আর ধলাভেড়া-ফালদি পড়ে কালা ভেড়ার ঘাড়ো’- দৃশ্যটি ছাতক থেকে উত্তরে পাহাড়ের উপরে মেঘের খেলা না দেখলে বোঝা কঠিন।

        একটা চমৎকার পদঃ

        (ঙ)    মার রান্দা যেমন তেমন বইনর রান্দা পানি

               আমার বাড়ির এইন রান্দইন খাইতে যেমন চিনি।

পশু পাখি পালনের অর্থনিতিঃ

(চ)  হাসে উনা কইতরে দুনা

ছাগলে পিন্দায় কানো সোনা।

ধাঁধাঃ

(ছ) পুয়া নায় পুড়ি নায়, মুখো দেয় চুমা

উন্দাল নায় চুলা নায়, তেও বারয় ধুমা।

(জ) রাজার বাড়িত মেনা গাই মেনমেনাইয়া চায়

হাজার টেকার মরিচ খাইয়া আরো খাইত চায়।

        বৃহত্তর সিলেটি লোকবিশ্বাসে সিকন্দর গাজি এক অতিলৌকিক চরিত্র। সিলেট জেলার সব নদী হাওরর মালিক এই গাজি। বৈতল বাপের কাছ থেকে গাজিকে তুষ্ট করবার মন্ত্র পেয়েছেঃ

(ঝ)  শাহ সিকন্দর গাজি

মাছ পাইলে আধাআধি

তুই খাইবি মাছ খান

মোরে দিবে গচা খান।

        সুরমা গাঙর পানিতে সিলেটের কথ্যভাষার নিজস্ব বাক্‌রীতির প্রচুর দৃষ্টান্ত রয়েছে। কয়েকটি শুধু এখানে উল্লেখ করছিঃ

(ঞ)  পুন্দো নাই চাম, রাধাকৃষ্ণ নাম।

(ট)  ডরালুকর পাদ্রাপুক।

(ঠ)  কেরাইয়ার ইত পিত কালা পাত কালা।

(ড)  পাওর তলর বেঙ।

(ঢ)  মায় বানায় ভূত, বাপে বানায় পুত।

(ণ)  অ কইতে মার্গো ফাটে।

(ত)  হুলার গুমগুমি নালিয়া খেতো।

(থ)  তামাকাসা মাজলে চিকন, লোহা চিকন তায় আর ছাওয়াল চিকন মায়।

        এই সাংস্কৃতিক পরিবেশটি জীবন্ত হয়ে উঠেছে যেন এইসব প্রবাদ-ধাঁধা-বাক্‌রীতির এইসব উপাদানে। উপন্যাসে সিলেটের জনপ্রিয় খাদ্য শিদল বা হিদলসুটকির প্রসঙ্গ আছে বারবার। পুটি মাছ কয়েক মাস মাটির তলায় রেখে দিয়ে বানানোর কৌশলটিও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে আখ্যানে। এই পরিবেশের উপযুক্ত সংলাপ রয়েছে গোটা উপন্যাস জুড়ে। অন্তত শতাধিক শব্দ আছে যেগুলি সিলেট-বরাকের নিজস্ব শব্দভাণ্ডারের সম্পদ। সিলেটি ভাষার ব্যবহার নিয়ে আছে খানিকটা অহংকারও। সৃষ্টিধর তার শিষ্যকে বলেছেন- সারা বাংলা ঘুরেও সিলেটির লাখান মিঠা মাত পাইতায় নায়। আর সিলেটি মাইনষর বুদ্ধির ধারো কাছো কেউ নাই। সিলেটি পই ডিটান ইতা কুনু ভাষাত পাইতায় নায়। তুমার মুখর আগাত হক্কল সময় পাইবায় হাজাইল মাত।

        শুধু সংলাপের হাজাইল মাতনয়, গোটা উপন্যাসের ভাষা বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে উপভাষার অসামান্য প্রয়োগ দক্ষতায়। আঞ্চলিক উপভাষার শব্দ ও বাচনভঙ্গি মিশে গেছে ঔপন্যাসিকের ন্যারেশনের মান্য-চলিত ভাষায়। উপন্যাসের প্রথম বাক্যটি লক্ষণীয়ঃ সাপিখুপির ভয় নেই বৈতল ওঝারসাপিখুপিশব্দটি সিলেট অঞ্চলের কথ্য শব্দ। এমন দৃষ্টান্ত প্রচুর রয়েছেঃ মায়ের সঞ্চয় দুচার পয়সা ছিকির ভিতর নারকেল মালায় থাকে বড়ঘরের মাড়াইল এ। বৈতল ঠালি ভেঙে পয়সা নিয়ে বেরিয়ে যায়। মান্য চলিত বাংলায় নিম্নরেখাঙ্কিত শব্দগুলির রূপান্তর রয়েছে। মান্যচলিত ন্যারেশনে আঞ্চলিক উপভাষার এই দ্রবণ লেখকের সচেতন প্রয়াসের ফসল। এই কাজটা রণবীর গল্পেও করে থাকেন। কেন্দ্র-পরিধি, মান্য চলিত এবং উপভাষার দূরত্ব ভেঙে দিয়ে জীবনের নির্যাস, আর কথাবয়বের নিজস্ব মেজাজটি তৈরি করেন লেখক। পোষ্টকলোনিয়ালবাংলা সাহিত্যের এই প্রবণতাটি রণবীরের কথনবিশ্বের এক মৌলিক উপকরণ। সিলেটি উপভাষার কথনরীতির বিশিষ্ট সুরটি উঠে এসেছে একদিকে বৈতল-দুখু-লুলার সংলাপে, বৈতলের স্মৃতি ও স্বগতচিন্তায় আর সর্বোপরি সৃষ্টিধর ওঝার কথকতায়। সিলেটের মরমি কবিদের কথা আর গান সৃষ্টিধর বৈতলকে শুনিয়েছেন অনেকটা কিচ্ছাবলবার ভঙ্গিতে। কথকতার এই ভঙ্গিটি চলচ্ছবির দৃশ্যের মতো জীবন্ত হয়ে উঠেছে লেখকের বর্ণনাগুণে। সিলেট কাছাড়ের, ভূগোল, প্রকৃতি লোকপ্রজ্ঞা, বিচিত্র সঙ্গীত-ছড়া-প্রবাদ-কথ্যভাষা-ঐতিহাসিক চরিত্র ও প্রসঙ্গ- সব মিলিয়ে সুরমা গাঙর পানিহয়ে উঠেছে সিলেটি জীবনের মহাকাব্য। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ আঞ্চলিক উপন্যাসগুলির অন্যতম হিসেবে উপন্যাসটিকে বিবেচনা করা চলে। মহাকাব্যিক বিন্যাসের প্রকল্পে যোগ্য সঙ্গত লক্ষ করি বয়ানের রীতি বা আঙ্গিকের দিক থেকেও। ধীর লয়ে প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গের পুনরাবৃত্ত বিন্যাসে শ্রী-হট্ট কাছাড়ের সামাজিক- সাংস্কৃতিক জীবনের চলমানতা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। বিষয় ও আঙ্গিকের যুগলবন্দিতে জীবনের বহুস্বর হয়ে উঠেছে লক্ষ্যভেদীরূপে শ্রুতিগম্য।



*****





শতক্রতু