দৈনিক যুগশঙ্খ শিলচর ও গুয়াহাটি সংস্করণ, ২৩ জুলাই,১৮ |
তিনসুকিয়া ডিব্রুগড়ের কিছু লেখক শিল্পী সমাজকর্মী গত
১৫ জুলাই তারিখে তিনসুকিয়া বড়পাথারে এক সভাতে সমবেত হয়ে বিদেশী বাছাই প্রক্রিয়াতে
দীর্ঘদিন ধরে যেভাবে ডি-ভোটার করে, ডিটেনশন ক্যাম্পে বাঙালিদের পুরে দেওয়া হচ্ছে তাতে উদ্বেগ
প্রকাশ করেন। সেই সঙ্গে নাগরিকত্ব আইন সংশোধনী বিধেয়ক, ২০১৬-র মধ্যদিয়ে যেভাবে দেশে
ধর্মীয় মেরুকরণকে এবং আসামে ভাষিক মেরুকরণকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে তাতেও নিজেদের
চিন্তা ব্যক্ত করেন। বাঙালি হিন্দু মুসলমানের এবং অভিবাসী মুসলমানদের নাগরিকত্বের
প্রশ্ন নিয়ে যেভাবে অসমের রাজনৈতিক সামাজিক জীবন আলোড়িত হচ্ছে তাতে অগ্রণী
বাঙালিদের সরব হওয়া এবং মতামত গড়ে তুলা দরকার ভেবে এই সভার আহ্বান করেছিলেন শুভ্রজ্যোতি বর্ধন, গোপাল বসু, অসিত রায়,প্রশান্ত ভট্টাচার্য,সুজয় রায়, ভানু ভূষণ দাস,সুশান্ত কর, সুভাষ সেন, ত্রিদিব দত্ত এই ন’জন লেখক শিল্পী সমাজকর্মী।
বিশিষ্ট নাট্যকর্মী এবং
সাংস্কৃতিক সংগঠক উজান সাহিত্য গোষ্ঠীর সভাপতি সুজয় রায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই
সভাতে তিনসুকিয়া ডিব্রুগড় ডিগবয় , গুইজান, সোনারি থেকে বেশ কিছু অগ্রণী
ব্যক্তিত্বের সমাবেশ ঘটে। সভার শুরুতেই উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সুশান্ত কর
বলেন, এই সভা নয় কোনো প্রতিবাদী
সভা। কিন্তু যেহেতু বাঙালিদের মত বিনিময়ের কোনো মঞ্চ নেই, নেই সংবাদ মাধ্যম—তাই বিষয়গুলো নিয়ে নিজেদের
মধ্যে বিভিন্ন মত এবং পথ নিয়ে আলোচনা তর্ক বিতর্ক করে একটি সার্বিক অভিমত গড়ে
তুলবার দায়িত্ব বৌদ্ধিক অগ্রণী শ্রেণিটির উপরে বর্তায়। তিনি বলেন, আয়োজকদের তরফে একটি অবস্থান
স্পষ্ট করেই সভাটি ডাকা হয়েছে। কিন্তু জরুরি নয় যে সবাইকে সেই অবস্থানে সম্মতি
জানিয়ে কথা বলতে হবে।
এর পরে
বক্তাদের অধিকাংশই প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব আইন সংশোধনী বিধেয়ক, ২০১৬-কে সাম্প্রদায়িক আখ্যা
দিয়ে সেটি বাতিলের পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। একদিকে যখন আসাম চুক্তি মেনে নিয়ে এক
বিদেশী মুক্ত এবং সেই সঙ্গে বিদেশীর নামে হেনস্তা মুক্ত আসাম গড়ে উঠবে বলে অসমিয়া
বাঙালি হিন্দু মুসলমান সবাই আশা করছিলেন, তখন এই বিল অসমিয়া মনে অহেতুক এক অস্তিত্বের আশংকাকে চাগিয়ে
দিয়েছে, অন্যদিকে মুসলমান সমাজ
নিজেদের ব্রাত্য ভাবতে শুরু করেছেন। এই পরিবেশে বাঙালি হিন্দুর অস্তিত্বও সুরক্ষিত
হতে পারে না। অথচ, বাংলাদেশ থেকে আদৌ সেরকম
প্রব্রজন ঘটছে না, আর যদি কেউ এসেও থাকেন এই বিলে তাদের নাগরিকত্বের কোনো নিশ্চয়তাও দেয় নি। একটি
অর্থহীন বিল দিয়ে বাঙালি হিন্দুদের বড় অংশকে নিতান্ত প্রলোভিত করবার চেষ্টা হচ্ছে।
একদিকে যেমন বিলের সমর্থনে হিন্দুত্ববাদী আবেগ উস্কে দেওয়া হচ্ছে, সেরকম বিলের বিরোধিতা করতে
গিয়ে স্বঘোষিত একাংশ বামপন্থীদের মধ্যে উগ্রজাতীয়তাবাদী প্রবণতার সমালোচনা করা হয়
সভাতে। এবং সেই সমালোচনা সভাতে উপস্থিত বাম ব্যক্তিত্বরাই করেন। যদিও সভাতে নাগরিক
বিলের সমর্থনেও কেউ কেউ মত প্রকাশ করেছিলেন---কিন্তু সভা শেষে উপস্থিত সবাই সর্বসম্মতি ক্রমে এটি বাতিলের পক্ষেই অভিমত
দেন। এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
যেভাবে যথেচ্ছ ডি-ভোটার বলে
বাঙালিদের চিহ্নিত করা হচ্ছে, যখন তখন ডিটেনশন ক্যাম্পে পুরা হচ্ছে এবং এন আর সি প্রক্রিয়াতে নিত্যনতুন
ফরমান জারি হচ্ছে তাতে বক্তারা আশঙ্কা ব্যক্ত করেন যে লাখো বাঙালি হিন্দু মুসলমান
এবং অভিবাসী মুসলমান নাগরিকদের অহেতুক হেনস্তা করা হচ্ছে, এবং এন আর সি থেকেও যে বহু
যোগ্য নাগরিকের নাম বাদ পড়বে—সেরকম একটি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ডি-ভোটার বলে চিহ্নিতদের সিংহভাগ পরে ভারতীয়
বলে প্রমাণিত হচ্ছেন। এবং অনেকেই একপক্ষীয় মামলাতে বাংলাদেশী বলে গ্রেপ্তার করবার পরেও তারা ভারতীয়
বলে ছাড়া পাচ্ছেন। কিন্তু ততদিনে দৈহিক,মানসিক, এবং আর্থিক ভাবে একেবারেই
বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন। বক্তারা বলেন এই
লড়াই বাঙালি হিন্দুর বা মুসলমানের একার
হতে পারে না। হিন্দুত্ববাদ বাঙালি হিন্দুকে বাকি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে। অসমিয়া
উগ্রজাতীয়তবাদের মতো বাঙালি জাতীয়তবাদী অবস্থানও বাঙালির সংগ্রামের পরিসর তৈরি করে
না। সাম্প্রদায়িক পথ আত্মঘাতী পথ। নাগরিক হিসেবে সম্মানের এবং সমানাধিকারের
সংগ্রাম বাঙালি হিন্দু মুসলমানকে গণতান্ত্রিক এবং নিপীড়িত অসমিয়া সমাজকে পাশে
নিয়েই লড়তে হবে। বিলের বিরুদ্ধে যেমন বাঙালি সমাজকে সরব হওয়া দরকার, তেমনি বাঙালির নাগরিকত্বের
সমস্যা নিয়ে অসমিয়া সমাজেরও গণতান্ত্রিক অংশের সরবতা দরকার। বক্তারা অনেকেই বলেন, মূলত শ্রমজীবীদের নাগরিকত্ব
নিয়েই প্রশ্ন উঠছে, তাদের মধ্যেও নারী এবং শিশুরাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিপন্ন হচ্ছেন। ফলে এই
সংগ্রাম শ্রমজীবীদের লড়াই, নারীর অধিকারেরও লড়াই। শ্রমজীবীদের বিভাজিত করবার জন্যেও এই সব হচ্ছে। সস্তা
শ্রমের চালান নিশ্চিত করতে সাংবিধানিক অধিকার বিহীন শ্রমবাহিনী গড়ে তুলবার চেষ্টা
হচ্ছে। সভা এই মতও ব্যক্ত করে যে যেহেতু আজঅব্দি ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো
ব্যক্তিদের প্রায় সবাই ডি-ভোটার। ভোটার তালিকাতে নাম নেই, অথচ বাংলাদেশী বলে আটক রাখা
হয়েছে সেই সংখ্যা অতি নগণ্য। অন্যদিকে আসাম চুক্তি পরবর্তী কালে চুক্তি মেনে তালিকা
সংশোধন করতে করতে সর্বশেষ যে ভোটার তালিকা রয়েছে সেটি ২০১৪তে সংশোধিত। একে জাতীয়
সংগঠনগুলো থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ আদালতও শুদ্ধ তালিকা বলে মেনে নিয়েছেন। তাঁর
ভিত্তিতেই সেবারে লোক সভা নির্বাচনও হয়। যেহেতু বিশাল সংখ্যক দরিদ্র জনতার কাছে
পুরোনো প্রয়োজনীয় দলিলাদি নাও থাকতে পারে তাই তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এটিকে এন আর সি
প্রস্তুত প্রক্রিয়াতে গ্রহণযোগ্য দলিল হিসেবে গ্রহণ করবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এবং
এখনো যখন প্রচুর মানুষের এন আর সি থেকে নাম বাদপড়বার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে, তিনি সেই প্রস্তাবের
পুনরাবৃত্তি করছেন। বিশিষ্ট তাত্ত্বিক হীরেন গোঁহাইও বলেছেন, দলিল নেই বলেই এন আর সি
ছুটদের বিদেশী ট্রাইব্যুনালে পাঠানো চলবে না। সেরকম ক্ষেত্রে ২০১৪র ভোটার তালিকা
সংক্রান্ত এই প্রস্তাব বিবেচনা করা যেতে পারে। কেবল ডি-ভোটার বলে চিহ্নিতদের নিয়ে
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আদালত যেমন নিচ্ছেন নিন। তাতে অসম চুক্তির মর্যাদাও সুরক্ষিত হয়, চরিত্রে দিক থেকে এটি
ধর্মনিরপেক্ষও এবং বহু ৭১ পূর্ব ভারতীয় নাগরিক বিপন্নতার থেকে রক্ষা পান।
সভায় বক্তব্য রাখেন প্রবীণ শিক্ষাবিদ জ্ঞান রঞ্জন
দেব, সোনারি থেকে তরুণ সমাজ কর্মী
অনুপ ভৌমিক, সিপি আই এম এল নেতা
শুভ্রজ্যোতি বর্ধন এবং সুভাষ সেন, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা বিশ্বজিত বর্মণ, দৈনিক যুগশঙ্খের বার্তা সম্পাদক সঞ্জীব নন্দী, চিত্র এবং বাচিক শিল্পী
ত্রিদিব দত্ত এবং সবার শেষে সভাপতি সুজয়
রায় প্রমুখ। সাংস্কৃতিক কর্মী দীপক চক্রবর্তী, সুশান্ত চক্রবর্তী, এবং সারা আসাম বাংলাভাষী যুবছাত্রপরিষদের তরুণ নেতা জয়ন্ত
পাল বক্তব্য না রাখলেও প্রশ্নোত্তরে অংশ নেন।
সুশান্ত কর সভার একটি সারাৎসার তুলে ধরে পর্যালোচনা
করে নিজের বক্তব্য রাখেন, এবং আয়োজকদের হয়ে কিছু প্রস্তাব সভাতে তুলে ধরলে সেগুলো সর্বসম্মতিতে গৃহীত
হয়। সভা অভিমত ব্যক্ত করে সাম্প্রদায়িক
নাগরিকত্ব আইন (সংশোধনী) বিধেয়ক, ২০১৬ বাতিল হোক তথা ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার উপর কুঠারাঘাতের
প্রয়াসকে ব্যর্থ হোক। ডি-ভোটারের নামে বাঙালিদের বিদেশী সাজানো বন্ধ হোক। ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক মানুষের মানবাধিকার
নিশ্চিত করা হোক। এবং চূড়ান্ত রায় দেবার আগে আগে ভোটাধিকার স্থগিত করে হলেও, সাধারণ কয়েদীদের সঙ্গে জেলবন্দি করে রাখা বন্ধ করা
হোক। বিদেশী বাছাইর ভিত্তি বর্ষের মতো
সমস্ত বিদেশী বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন তথা নিষ্পত্তি করবার জন্যেও দুই বা তিন
বছরের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হোক। দরিদ্র
দলিত হিন্দু মুসলমান নাগরিকদের প্রয়োজনীয় দলিলাদির অভাবের কথা বিবেচনাতে রেখে
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাব অনুযায়ী, অসম চুক্তি মেনে তৈরি ২০১৪র সর্বশেষ ভোটার তালিকাকে এন আর
সি ছুট অথচ ভারতীয় নাগরিকদের প্রামাণ্য নথি হিসেবে বিবেচনা করা হোক।
সভাতে সিদ্ধান্ত হয়, এন আর সি-র দ্বিতীয় খসড়া
প্রকাশ পরবর্তী পরিস্থিতি বিবেচনাতে রেখে দেড় দুই মাসের মধ্যে তিনসুকিয়া
দুর্গাবাড়িতে ‘নাগরিকত্ব এবং গণতন্ত্র’ শীর্ষক একটি আলোচনা চক্রের আয়োজন করবেন, আজকের সভার আয়োজকেরা। যেখানে ন্যূনতম একজন বাঙালি এবং একজন অসমিয়া বক্তাকে আমন্ত্রণ জানানো হবে।
সেই সভাতে অসমিয়া সমাজেরও বিদ্বজ্জনকে আমন্ত্রণ জানানো হবে।
ওদিকে প্রায় একই বিষয়ে আগামী ২৮ জুলাই, শনিবার গুয়াহাটির লতাশীলের
বিষ্ণুনির্মলা ভবনে ফোরাম ফর স্যোসিয়েল হারমনি,দেশপ্রেম এবং
বসুন্ধরা—দ্য ন্যু ডেজ ‘নাগরিকত্ব এবং গণতন্ত্র’ শীর্ষক আলোচনা সভা ডেকে অসমিয়া বাঙালি, হিন্দু মুসলমান, বরাক ব্রহ্মপুত্রে
একটি ঐক্যমত্যের পরিবেশ গড়ে তুলবার যে প্রয়াস শুরু করেছে সভা সেই প্রয়াসকে
অভিনন্দন জানায় , এবং তার সাফল্য কামনা করে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন