“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ২ জুলাই, ২০১৮

চক্রব্যূহ

।। সুপ্রদীপ দত্তরায়।।

(C)Image:ছবি













হ্যালো, মা আমি সুমিত বলছি
সুমিত, তোমার বাবুসোনা
 
শুনতে পাচ্ছো তুমি
 
এখন --, এখন -- যাচ্ছে শোনা ।
এই কে আছিস প্লীজ ---
একটু ফোনটা ঠিক করে দে'না।
আমাকে দেখতে পাচ্ছো তো ?
হ্যাঁ, ঠিক
  ঠিক ধরতে পেরেছো , 
আমি এখন বাড়িতে, ক্যালিফ্রোনিয়ায়
আগামী কালও থাকবো , মিটিং আছে
 
একটা ভীষণ বড় ডিল, অনিশ্চয়তার মাঝে
  
যদি হয় , জয় নিশ্চয়।
 
প্রমোশন আটকায় কোন বেটা ।
কী বললে মা ?
  কোনটা --, বাড়ি ? 
হ্যাঁ , এখন তো মা ওটাই সরকারি।
তোমার ওখানে তো আসা হয় না আর ।
এখন আমি নাগরিক আমেরিকার ।
এই দেখো না , আজ কত মাস
 
তোমাকে দেখতে যাওয়ার আশ,
কিন্তু হচ্ছে কোথায়, সম্ভব না ।
 
কী বললে মা ? দেশ বাড়িতে যাবো
  ?
না না, ওই রিকোয়েস্টটা করো না প্লিজ
 
আগামী সপ্তাহে যেতে হবে জাকার্তা ,
 
ওখান থেকে সরাসরি আফ্রিকা ।
এক মাস ওখানেই থাকতে হবে
 
কালো মানুষদের সাথে ।
এখন কি আর সেই সময়টা আছে ? বলো ?
 
আমার এখন ভীষণ ব্যস্ততা।
তাছাড়া তোমার নাতি দুটো
 
বড্ড দুষ্ট, কিছুতেই যেতে চায় না দেশে ।
ওখানে তো এসি নেই, কমোড নেই
ইচ্ছে মতন
  কারেন্ট নেই ---
পলিউশন , জ্যাম, নোংরা
 
এত অস্বাভাবিক
  ভ্যাঁপসা গরম 
ওদের ঠিক স্যুট
  করে না।
তাছাড়া যখন তখন যেতে চাইলেই হয় না ।
ওদের তো স্কুল আছে মা । ছুটি কোথায়?
 
তুমিতো চাও না ওরা স্কুল কামাই করুক ।
তবে আমি একবার আসবো নিশ্চয়ই ।
ওরা আসুক কিংবা না আসুক,
 
আমি কিন্তু আসবো অবশ্যই ।
ওটা যে আমার জন্ম ভিটা মা ।
আরে হ্যাঁ, তোমার হাঁটুর ব্যথাটা --
ভুলেই গিয়েছিলাম, সেই কবে বলেছিলে
 
এখনো কি টেনে টেনে হাঁটতে হয় পা'টা
সরি মা, বলেছিলাম বটে এবার এলে বাড়ি ,
 
কমোড একটা করিয়ে নেওয়া ভীষণ দরকারি ।
তুমিও মা পারো সত্যি; করিয়ে নিলেই হয়।
সব কাজ এখন যদি আমায় দেখতে হয়
 
আমি তো পারবো না মা ।
যখন তখন তুমি ডাকবে, আমি আসবো
 
এতো চলতে পারে না, সম্ভব নয়।
 
আমার একটা ফ্যামিলি আছে,
 
আফিস আছে, স্ট্যাটাস আছে
 
আমি তো সেই আগের বাবুসোনা নই ।
বোঝার চেষ্টা কর এবার ।
মা, ঘুম পাচ্ছে?  তুমি শুনতে পাচ্ছো স্পষ্ট ?
বুবাই বলছিল তোমার নাকি বুকে ভীষণ কষ্ট
 
আমি বুঝি, আমার জন্য তোমার
  মন কেমন করে, 
আমাকে দেখতে, খুব কাছে পেতে
ইচ্ছে করে তোমার ।
কিন্তু একটা কথা বোঝ মা ,
আমার যে এখানে চলাফেরা
তারও আছে নিয়ম নীতি
 
যখন তখন দেশ বাড়িতে আসতে পারিনা ।
আমি যে ফেঁসে গেছি ভীষণ চক্রব্যূহে
 
ফেরার পথ নেই ।
ছোটবেলা তুমিই বলতে পড়ার শেষ নেই ।
আরো পড়, আরো পড় , অনেক বড় হও
বড় আমি হয়েছি মা, অনেক অনেক বড়
 
যেখান থেকে আকাশ ছোঁয়া যায় ।
 
হাত বাড়ালেই চাঁদের স্পর্শ
 
পৃথিবীটা টেনিস বল, ছোট্ট মনে হয়।
আকাশ চষে এপার ওপার
 
লকার ভরা রত্ন বাহার
 
কিছুই আর আমার কাছে দুষ্প্রাপ্য নয়।
তবুও আমি এখনো মা সোপান ভেঙে চলি ।
পায়ের নিচে সিঁড়িগুলো সব খসে খসে যাচ্ছে
 
আমি ছুটছি আর ছুটছি।
 
যন্ত্রদানব যেন
  আবেগহীন দিগন্তেতে  ধুঁকছি,
আমার ঘর, শহর, দেশ ক্রমেই হয়ে যাচ্ছে লীন,
 
মনের মধ্যে কেউ যেন আর দাগ কাটে না ।
ওখান থেকে তোমার ছবি অনেকটাই স্পষ্ট না ।
না না অমন করে বলো না মা, বলতে নেই
মাঝে মাঝে কাজের চাপে হারিয়ে যাই
 
সত্যি বলি ভুলে যাই, আমারও একজন মা আছেন
 
সাত সমুদ্র পাড়ে , তিনি -
  আমায় নিয়ে ভাবেন ।
আমায় কাছে পাবার আশায় সকাল সন্ধ্যা কাঁদেন ।
আবার জানো অনেক সময়ই অভিমান হয়।
তোমার জন্যই আমার আজ এমন পরিচয়।
বাবা যখন মারা গেলেন, তখন নতুন চাকুরি
 
শেষ সময়টাতে
  দুরে থাক, কাজেও আসিনি।
সবাই মিলে দুয়ো দিলে, কিছুই বলিনি ।
আমার তখন কি আর আয় সামান্য কটা টাকা
 
চিকিৎসাটার বহর টেনেই পকেট হতো ফাঁকা ।
দেশে আসবো , টাকা কোথায় শুধুই বিলাসিতা
 
আজ টাকা আছে, বাবা নেই, বুকের মধ্যে চিতা।
এখনো মা শুনতে পাই, আমি মানুষ হলাম না 
দেশে আমার অসুস্থ মা, আমি দিল্লি মদিনা ।
কেউ বোঝে না দায়িত্বটা, হাজার লোকের জীবন,
 
আমাকেই যে ভাবতে হয় ওদের ভরণপোষণ ।
আমিও মা হতে পারতাম সাধারণ একটা ছেলে
 
গ্রামের স্কুলে মাস্টার কিংবা মেছো পাড়ার জেলে,
দিনের শেষে দাওয়ায় এসে তোমার পাশে বসতাম
 
তোমার শীতল স্পর্শে মাগো পরাণ খুলে হাসতাম ।
কেন এমন হল তুমি বলতে পারো মা?
সুখী হতে চেয়ে আমি, কেন স্বজন হারা।
আমি তো মা চাইনি ওগো, কেন এমন হল,
 
কতদিন মা তোমার হাতের নাড়ু খাইনি বল ।
 
তোমার হাতের পাটিসাপটা, নলেনগুড়ের সন্দেশ ।
কতদিন মা যাওয়া হয়নি
  দুজনেতে দরবেশ ।
জন্মদিনে পায়েস আর আশীর্বাদী ধান
 
আমি খুব মিস করি মা তোমার গলায় গান।
 
তুমি ভাবো ভালো আছি , ভালো আমি নেই মা ।
আমার মত কোন ছেলেই এ জীবনটা চায় না ।
ওখানে জন্মদিনে পায়েস হয়না, যা হয় কেক স্যাম্পেন
 
আনন্দ মানে উইক এন্ড, আকণ্ঠ মদ্যপান ।
জীবন এখানে ইট পাথর, ভালবাসা অভ্যাস
 
সুখ এখানে সমৃদ্ধি মা, ভেতরে দীর্ঘশ্বাস।
ভালো এখানে থাকা যায়না, সত্যি অসম্ভব
 
তবুও এদেশ ছাড়া যাবে না, এটাই আমার সব ।
তুমি আবার রাগ করো না, ক্ষমা করে নিও,
আগামী জন্মে তোমার কোলেই মূর্খ জন্ম দিও।
অভাব হয়তো থাকবে মা, হয়তো কষ্ট হবে,
 
তবুও মা দিনের শেষে তোমার স্পর্শ রবে ।


কোন মন্তব্য নেই: