সকাল থেকেই মুখে মুখে সেই কথাটা ফিরছিল
শুনতে পেলাম মুনমুনও নাকি গল্প ছলে বলছিল
মেয়ে হওয়াটাই ওই মেয়েটির অনেক বড় ভুল ছিল ।
আমি বললাম ভুল ডাঁহা মিথ্যে কথা সব
তোমাদের সমাজটাতেই ঘুণ ছিল
মিথ্যেই শুধু বদনামগুলো তুলছিল
মেয়ে হওয়াটাই ওর নাকি খুব ভুল ছিল ।
সকাল থেকেই আকাশটাতে মেঘ ছিল
মা বললে থাক তবে আজ কলেজ যাওয়া
ঘরেও নাকি টুকিটাকি সব কাজ ছিল
বাপ বললে, ও কেমন কথা ? মোটেই নয়
পড়তে হলে লড়তে হয়, কষ্টটাকে সইতে হয়
জীবনটাতো সহজ নয় । যে সইতে পারে, তারই জয় ।
মেয়েটি তাই জীবন দিয়ে জীবন যুদ্ধে লড়ছিল
তারপরেও বলছে ওরা মেয়ে হওয়াটাই ভুল ছিল ।
আমি বলি বাজে কথা,ঐ সমাজটাতেই ঘুণ ছিল ।
শহরতলির অনেক দূরে,ওখানে তার ঘর ছিল
গরীব ছিল, তবু মাথাটা তার সাফ ছিল
মাধ্যমিকে বৃত্তি পাওয়া সাইকেলটা
তাই চেপে সে নিত্য কলেজ যাচ্ছিল
পথের বাঁকে নদীর ঘাটে যেথায় যত লোক ছিল
মেয়েটির সাথে সবার যেন অনেকদিনের ভাব ছিল ।
লোকের মুখে বলতে শুনি ভাবটাই ওর কাল ছিল,
আমি বলি ভুল কথা , ঐ সমাজটাতেই ঘুণ ছিল ।
সকাল থেকেই সেদিন যেন আকাশটাতে মেঘ ছিল ।
থেমে থেমে আকাশটা খুব অঝোর ধারায় কাঁদছিল
বৃষ্টি দেখে মাস্টার তার ক্লাসটা শুধুই টানছিল
কেউ বলছে আহারে, বৃষ্টিটাই ওর কাল ছিল
কেউ বলছে ও কিছু নয় মেয়ে হওয়াটাই ভুল ছিল ।
আমি বলি বাজে কথা, ঐ সমাজটাতেই ঘুণ ছিল ।
ক্লাসে বসা সেই মেয়েটি সেথায় তখন ভাবছিল
বাড়লে বৃষ্টি অনাসৃষ্টি। ঠাকুর দেবতা ডাকছিল
পথের কথা ভেবে ভেবে হয়তো ভয়ে কাঁপছিল ।
এদিকটাতে বিকেল কেটে সন্ধ্যা তখন নামছিল ।
একে একে সাথের মেয়েরা যে যার ঘরে ফিরছিল
সেই মেয়েটি এখন একা, সাইকেলেতে চাপছিল।
আকাশটা আজ হঠাৎই যেন ঘন ঘন ডাকছিল
ঝড়ের আগের গুমোট ভাব, উড়না হাওয়ায় উড়ছিল
সন্ধ্যা তখনও নামেনি তবু ভাবখানা তার তাই ছিল ।
কেউ বললে যাসনেরে মেয়ে, ওই যে ঝড় আসছে তেড়ে
কেউ বলছে জোরসে চালা, পথ ফুরাবে পায়ের জোরে ।
পথের পাশের তমাল সারি, রাস্তা ধারে গরুর গাড়ি
বলছে মেয়ে সাবধানে যা, এমন দিনেই বিপদ ভারী ।
ছুটছে মেয়ে প্যাডেল চালায়, আরো জোরে আরো জোরে
অন্ধকারকে হার মানিয়ে পৌঁছতে হবে নিজের ঘরে ।
বৃষ্টি বিপদ, আঁধার বিপদ, পথের বিপদ কত শত
তারও চেয়ে বড় বিপদ বখাটে সব ষণ্ডা যত ।
হঠাত আবার বৃষ্টি নামে, পথ জুড়ে সে ভয় দেখায়
গায়ের জোরে জড়িয়ে ধরে, হাত পা গা চুল ভেজায়
সিথি ভেজে কপোল ভিজে, ভিজে গায়ের অন্তর্বাস
তবুও মেয়ে চালায় প্যাডেল উঠুক যতই নাভিশ্বাস
আরো জোরে আরো জোরে এই বুঝি এই সন্ধ্যে হয়
পথের বাঁকেই বিপদ তবু পথ কেন আজ দীর্ঘ হয় ।
পাথর কাটা শরীরটাতে বৃষ্টি ঝরে ঝরঝরিয়ে
বৃষ্টি তারে আদর করে, চুম্বন বিনা বন্ধনে
খাঁজে খাঁজে কাপড় সাটা, চড়াই খাঁজ লজ্জা পায়
সেই মেয়েটি যাচ্ছে বাড়ি , ওড়নাখানি জড়িয়ে গায় ।
হঠাত বাঁকে রাস্তা রুখে, সেই গায়েরই চার ছেলে
এই মুনিয়া একটু দাঁড়া, ওদেরই মধ্যে কেউ বলে ।
ভয় পেয়ে যেই সেই মেয়েটি প্যাডেলটিতে চাপ দেবে
সাইকেলটা টেনে বলে, তোর সাথে আয় ভাব হবে ।
সন্ধ্যা তখন মিলিয়ে গেছে, চারপাশেতে অন্ধকার
সাহস করে মেয়েটি বলে, চাস ভালো তো রাস্তা ছাড়।
অট্টহাসি হাসে সবাই, আকাশ, বাতাস ছেলেগুলো
এই তোমাকে ছেড়ে দেবো, একটুখানি কাপড় তুলো ।
কখন থেকে বসে আছি খিদে নিয়ে শরীর মনে
একটুখানি সময় নিয়ে, খেলতে হবে নির্জনে।
তাঁকিয়ে তোরা দেখছিস কি ওড়না দিয়ে মুখটা বাঁধ,
কেমন দেখ ঠাসা মাল, অনেক দিনের মনের সাধ।
বৃষ্টি পড়ে ঝমঝমিয়ে, বুকে পিঠে সারা গায়
বৃষ্টি নামে দুচোখ জুড়ে, বন্যা ভয়ে মুখ লুকায় ।
মায়ের কথা মনে পড়ে, বলছিল মা যাস না রে
এমন দিনে অনেক বিপদ , সাপের বিষ খাস না রে।
আমি মাগো ভুল করেছি, কোথায় তুমি বাঁচাও আমায়
হায়নাগুলো হামলে পড়ে চাটছে দেখো আমার গায়।
বুকের উপর কাপড় নেই মা ডলছে ওরা পিন্ডটায়
কামড়ে দিচ্ছে জঙ্ঘাটাতে, আদিম এক হিংস্রতায়।
আমি আর বাঁচবো না মা, আমার জন্য জীবন শেষ
কাল থেকে আমি ধর্ষিতা মেয়ে সৌজন্যে সভ্য দেশ ।
চারচারটে হায়না ঘিরে, উৎসব আজ পিচাশপুরী
নাভির নীচে, গলার খাঁজে লোলুপ জিভের সুড়সুড়ি ।
ধমক দিয়ে বলছে দেখো, অমন করে লাফাস কেনে
আদরই তো করছি তোকে, একটু না হয় নিলি মেনে।
হাত দুটো ওর চেপে ধর, দেখিস না কি তেজ দেখায়
ফুল ফুটেছিস মধু খাবো,দেখ তোকে আজ কে বাঁচায়।
ঘন্টা জুড়ে নৃত্য চলে, মেয়েটির শরীর মঞ্চটা
ক্লান্ত হয়ে শ্রান্ত নায়ক চঞ্চুতে দেয় অর্ঘ্যটা।
রক্তে কাঁদে যোনিমুখ, রক্তে ভাসে মেয়েটির বুক
রক্ত মাখে ঘাসের ডগা, স্বপ্ন ভাসে অন্ধশোক ।
বইয়ের পাতা নালায় ভাসে, উদ্ধারের সন্ধানে
আঁধার এসে সান্ত্বনা দেয়, বৃক্ষ লতার ক্রন্দনে
বৃষ্টি তখন লজ্জা পায়, ব্যস্ত পায়ে মুখ লুকায়
নালার পাশে নগ্ন নারী, সভ্যতার ঐ ধৃষ্টতায়।
লোকে বলে বেচারী সে, ভাগ্যেই তার ওই ছিল
আমি বলি মিথ্যে কথা, সমাজটাতেই ঘুণ ছিল ।
কেউ বলছেন দিনের মন্দ বৃষ্টিটাই ওর কাল ছিল
এমন দিনে বেরোতে হয়? কি তার এমন কাজ ছিল --
মায়ের কথা শুনলে না তাই, এই হালটি আজ হলো ।
সোমত্ত মেয়ের ঘোড়া রোগ পড়াশোনায় জেদ ছিল ।
কেউ বলছে সেয়ানা মেয়ে ভিজে গায়ে যাচ্ছিল
ছেলেদের কি দোষ বল, বুড়োদেরই মাথা খাচ্ছিল
কেউবা বলছে অভাগা মেয়ে, এমনটাই ওর লাক ছিল
সত্যি কথা বলতে দোষ, মেয়ে হওয়াটাই ভুল ছিল ।
অবাক আমি -- নপুংসক সব -- লজ্জা নেইকো তাদের --
আমি বলি এমন কথায় জিভ কাঁপে না তোদের?
এই মেয়েটিই তোর আমার মা বোন হতে পারতো তো।
তখন তোদের উন্নাসিক মন উদাস হতে পারতো তো?
আসলে জানিস আমাদের ওই শিক্ষাটাতেই ভুল ছিল,
বুক ঠুকে সব সত্য বলার সাহসটাই যে বাদ ছিল
বিবেক সেতো বিকলাঙ্গ, জন্মেতেই তার খুঁত ছিল
নইলে কি আর বলতে পারিস মেয়ে হওয়াটাই ভুল ছিল ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন