“বৃষ্টি নেমেছে হঠাৎ। রবীন্দ্রচন্দ্রর হাতে ছাতা, কিন্তু টাঙাতে ভুলে গেছেন তিনি। বৃষ্টি বেশ জোরে হচ্ছে। এরই মধ্যে হেঁটে যাচ্ছেন চুপচুপ। ভিজে যাচ্ছে বই দুটো।
ভিজুক ভিজুক।”
—‘ব্যর্থ প্রায়শ্চিত্ত’ এভাবেই শেষ করেছেন অরিজিৎ আদিত্য। তিনি কি দুটি বই-ই ভিজে যাবার কথা লিখছেন? না, আরো অনেক কিছু? এ ভেজা কি কোনো আনন্দের, হতাশার, ক্ষোভের, অথবা প্রতিবাদের? প্রশ্নগুলো পাঠকের মনে জাগুক। নইলে যিনি নিজেই একখানা ‘বই’ করছেন, তিনি আরেকটি বই নির্বিকার ভিজে যাবে,নিজেও ইচ্ছে পোষণ করবেন -- ‘ভিজুক’—সে কেন হবে? ছোট গল্পের মতো। গল্পে এরকমই হয়। এক নিপুণ গল্পকারের মতো লিখে গেছেন অরিজিৎ আদিত্য। কিন্তু ‘গল্প হলেও সত্যি’। আকারে গল্প, প্রকারে প্রবন্ধ। এরকম ১৪টি গল্প-প্রবন্ধ রয়েছে। বাকিগুলো কেবলই প্রবন্ধ। দেশভাগে এদেশে ওদেশে বিপর্যস্ত মানুষের গল্প। বাকিগুলো বিপর্যয়ের বিপ্রতীপে দেশভাগে বিপন্ন মানুষের দুনিয়া জুড়ে সাফল্যের কথা, বাকি গুলো সমস্যার গভীরে গিয়ে তাঁর উত্তরণ ভাবনার প্রবন্ধ। সমস্যা ‘ডি’ নিয়ে। পড়তে পড়তে মনে হলো,দেশভাগটাও তো ডি- ডিভিশন।আমরা ‘পার্টিশন’ বলে অভ্যস্ত।তিনি অবশ্য চারটি ইংরেজি শব্দ বেছে নিয়েছেন ‘ডিটেকশন’,‘ডাউটফুল ভোটার’,‘ডিটেকশন’,‘ডিটেনশন’। শব্দগুলোর শুরুর বর্ণ ‘ডি’ (D) – যার চার পাশে আবর্তিত হচ্ছে স্বাধীনতা উত্তর বিশেষ করে অসম আন্দোলন পরবর্তী অসমের বাঙালি জীবন। “অসমে রাষ্ট্র ও রাজনীতির এক হীন পরম্পরার শেষতম সংযোজন ‘ডি’” (কেন ডি/ পৃ:১৫) বইয়ের নাম ‘ডি/ রাষ্ট্রই যখন নিপীড়ক’। বইটি প্রকাশ করেছেন শিলচরের ‘প্রাসঙ্গিক প্রকাশনী’। অনিন্দ্য সুন্দর প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছেন বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী। কারার লৌহকপাটের ওদিক থেকে সামান্য কিছু আলোর রেখা এসে পৌঁছুচ্ছে এদিককার অন্ধকার কুঠুরিতে। তার উপরে সীমান্তের কাঁটা তার। তবু তাঁর বইখানার শুনেছি প্রথম সংস্করণ আর বাজারে নেই। অসমের যে কোনো বাংলা বইয়ের জন্যে এটি সুখবর। মূল্য মাত্র ২০০ টাকা।
২৫টি প্রবন্ধের সংকলন। তাতে ভূমিকাটিও মূল্যবান সংযোজন। লিখে দিয়েছেন রাজ্যের সংখ্যালঘুর মানবিক অধিকার সংগ্রামের অন্যতম ব্যক্তিত্ব যিনি তিন দশক ধরে এই একটি বিষয়ে লেগে আছেন, হাফিজ রশিদ আহমেদ চৌধুরী। ডি-ভোটার, ডিটেনশন ক্যাম্পে হচ্ছেটা কী, গোটা চিত্রটাই পরিসংখ্যান সহ তুলে দিয়েছেন। প্রথম অগপ সরকারের আমলে ২,৮৭, ৬২৫জনকে আসামে বিদেশী চিহ্নিত করে মামলা শুরু করলেও বিদেশী প্রমাণ করতে পারল মাত্র ৮,৬৯৪ জনকে। ১৯৯৬ থেকে ২০১০ এই দেড় দশকে মামলা সংখ্যা ছিল ৪,০৬,৪৫১। এই সময়ে আই এম ডি টি বাতিলও হয়, যথেচ্ছ ভাবে ডি-ভোটার চিহ্নিত করা আগে শুরু হলেও এই সময় বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিদেশী বাছাই প্রমাণিত হলেন কজন? সংখ্যাটি প্রথম অগপ সরকারের আমল থেকেও বহু কম। মাত্র ৫৫৭৭। অর্থাৎ অভিযুক্তের ৬.৫ শতাংশ। তাহলে লাখে লাখে বিদেশীতে আসাম ভরে যাবার গল্প ভুল, কিন্তু লাখে লাখে বাঙালি ভারতীয়দের বিপন্নতার গল্প সত্য, যার কথা কেউ বলে না। সেই কথাই লিখেছেন অরিজিৎ আদিত্য তাঁর বইতে। ‘কেন ডি’ শিরোনামে রয়েছে লেখকের কৈফিয়ত। পেশায় সাংবাদিক, দৈনিক যুগশঙ্খ কাগজের বহুদিন ধরে সম্পাদক। কাগজটি গেল বছর কয় ধরে যে ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে, সেতো খুব সুখের নয়। বাঙালি কেবল অসমিয়া সংবাদপত্রের ‘বাঙালি বিদ্বেষে’র কথা বলেন, কিন্তু বাংলা কাগজের ‘মুসলমানবিদ্বেষ’ তো কম কিছু নয়—সেই নিয়ে কেউ বিশেষ কথাই বলেন না। খুব স্বাভাবিক বলে ধরেই নেন, সেখানে স্বয়ং সম্পাদকের এই বিপরীত মেরুতে অবস্থান আমরা যারা তাঁকে ভেতর থেকে জানি, তারা বাদ দিলে বেশ চমকেই যাবেন। অরিজিতকে কোনোদিন মার্ক্সবাদ –মাওবাদ নিয়ে তর্ক করেছেন, দেখি নি। তিনি আধুনিকাতাবাদ-উত্তরাধুনিকতাবাদের পাঠ নিয়েছেন কি না জানি না। অন্তত তাঁর লেখাতে কোনোদিন মনে হয় নি। এমন বহু শিলচর করিমগঞ্জিদের যখন দৃষ্টি অন্ধ, কান বধির---অরিজিৎ সম্ভবত শুধু হৃদয়ের জোরেই দেখেন এবং শোনেন অনেক স্পষ্ট। নিতান্ত তিনি 'অধ্যাপক' নন। তাঁর সামনে আমাদের মতো বহু অধ্যাপকও নিতান্তই নোট লেখক। এবং সত্যিই আমরা তাঁর বইখানার একটি ‘নোট’ই লিখছি। সহায়িকা। অসমের বাংলা বই তো। শেষ না হলেও সর্বত্র সুলভ হয় না। সে জন্যেও বটে।
তাঁর সুগভীর আস্থা “কোনো আলখাল্লাধারী মওলানার নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক মঞ্চ নয়, বাঙালির প্রয়োজন একটি নিখাদ বাঙালির রাজনৈতিক মঞ্চ। বাঙালি হিন্দু মুসলমানের সম্মিলিত রাজনৈতিক শক্তি অসমে এমন এক সমীকরণের সৃষ্টি করবে যার সামনে মুখ থুবড়ে পড়বে আগ্রাসনের যাবতীয় নীল নকশা। মেরুকৃত বর্তমান পরিস্থিতিতে এমন আশা কাঁঠালের আমসত্ত্বের মতো মনে হতে পারে, কিন্তু অসমে বাঙালিকে পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পেতে হলে এই পথেই হাঁটতে হবে।” (পূর্বোত্তরের বাঙালি ও একটি প্রত্যাহ্বান/ পৃ:১৭১) ‘কাঁঠালের আমসত্ত্ব’ টি সম্ভব কিনা, আর তার থেকে ‘আলখাল্লাধারী মওলানার নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক মঞ্চ’কে বাদ দেবার দরকার আছে কি না, সেই বিচার আমরা পরে করব। কিন্তু এই সত্য মেনে নিতে কষ্ট নেই যে , তিনি একটি ‘বাঙালির রাজনৈতিক মঞ্চ’ কল্পনা করছেন, এবং মুসলমানকে নিয়েই--- ‘যার সামনে মুখ থুবড়ে পড়বে আগ্রাসনের যাবতীয় নীল নকশা।’ সেই আগ্রাসন ‘অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদে’র। এখন সে আমাদের সমস্যা আমরা হিন্দু বা ইসলামী আগ্রাসনের প্রশ্নটিকে কীভাবে দেখছি, এবং সেই অনুসারে ‘আমসত্ত্ব’ কী কৌশলে তৈরি করছি। তার আগে ডি-গল্প গুলো খানিক পড়ে নেওয়া যাক।
সব ঠাঁই মোর ঘর আছে,আমি সেই ঘর মরি খুঁজিয়া :
সব ডি-ভোটারের গল্প অরিজিৎ লেখেন নি। সম্ভবও নয়। তিনি বরাক উপত্যকার থেকে ১৪টি সেরকম গল্প লিখেছেন। দু’বছর ধরে ঘুরেছেন। খবর নিয়েছেন। সেই চৌদ্দটির মধ্যে বৈচিত্র্য আছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে বাংলাদেশে মেয়েকে দেখতে গিয়ে ‘টাউটে’র বিশ্বাসঘাতকতাতে ‘প্রবাসে দৈবের বশে’ ফেঁসে যাওয়া মা-ছেলে জয়ন্তী আর প্রাণতোষের গল্প। একটি হচ্ছে বাংলাদেশে নিজের বাড়িতে স্বামী-কন্যাকে রেখে এদেশে আত্মীয়বাড়ি বেড়াতে এসে ফেঁসে যাওয়া অর্চনা আর তার দুই শিশুপুত্র ‘গোপাল-গোবিন্দে’র গল্প। একটি গল্প প্রকৃতার্থেই ‘বাংলাদেশী’ মা-ছেলে উনমতিবালা-রাধিকা বিশ্বাসের গল্প। সরকার- শাসকদল তো বলছে ভারতই হিন্দুর ‘শেষ আশ্রয়’। এবং কথাটি গেল চার দশক ধরে এরকম করে বলছে, যে বহু হিন্দু বাঙালির এটি সামাজিক বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। সেই বিশ্বাসের করুণ পরিণতির গল্প লিখেছেন অরিজিৎ।
বাকি যে এগারোটি গল্প রইল—তার প্রায় প্রতিটিতেই দেখা যাবে সরকারি আমলাদের অবহেলাতে ভোটার তালিকাতে নাম ভুল উঠা, সময় মতো বিদেশী নোটিশ না পাওয়া, আদালতের শমন না পাওয়া—একেবারে আদালতের চূড়ান্ত রায় নিয়ে এসে পুলিশের হাজতে তুলে নিয়ে যাওয়া আছে। কিন্তু সেই সঙ্গে অভিযুক্তদের তরফেও আছে নিদারুণ অজ্ঞতা আর উপেক্ষা। এমন উপেক্ষা সম্ভবত আসে এই দেশ, দেশের সরকার-প্রশাসনের উপর একধরণের মজ্জাগত ভরসা থেকে। নইলে কি আর রবীন্দ্র চন্দ্র বিদেশী নোটিশ ঘাড়ে নিয়েও থানার সামনে বসে চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে যান? কিংবা মঙ্গল দাস বাবাকে ধরে নিয়ে গেলে ফরিয়াদ জানাতে পুলিশ অধীক্ষকের সঙ্গে দেখা করতে যান দলে বলে? নোটিশ পেয়ে তরাই বিবির বিপন্ন-বিস্ময়!-- ‘বাংলাদেশী? আমি তো মুসলমান!’ মুসলমান কখনো বাংলাদেশী হয় না—এই বিশ্বাস ব্রহ্মপুত্রে না থাক—বরাক উপত্যকাতে আছে। এবং হিন্দুর স্বাভাবিক ‘শেষ আশ্রয়’ হিন্দুস্তান। সেই সঙ্গে আছে আর্থিক অসহায়তা। যার জন্যে অর্জুন নমঃশূদ্র আত্মহত্যা করেই ‘মুক্তি’ পায়। সেই সঙ্গে স্বজন-প্রতিবেশীর ঈর্ষা তথা স্বার্থের সংঘাত। ঈর্ষার সেরকম গল্প একটিও এরকম নয় যে যে ফাঁসিয়েছে সে ভিন্ন ভাষা-ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ, ‘অসমিয়া’তো নয়ই। অথচ, বিদেশী তাড়াবার তাগিদটি মূলত উগ্র-অসমিয়া শাসকশ্রেণিরই।
প্রথম ‘গল্প’ ‘৭২ ঘণ্টা’। শচীন্দ্র গোস্বামী, ওয়াইফ অফ গৌরাঙ্গ গোস্বামী-র নামে বিদেশী নোটিশ একটি গিয়েছিল জারইলতলাতে স্বামীর গানের স্কুলে ২০১২তে। অদ্ভুত নাম ঠিকানা দেখে স্বামী আমল দেননি বলেই বছর কয় পরে এক মে মাসে ৭২ঘণ্টা শিলচর জেলে কাটিয়ে আসতে হলো সুচন্দ্রা গোস্বামীকে। যত জনের গল্প অরিজিৎ পড়ালেন তাঁদের মধ্যে একমাত্র শহুরে মধ্যবিত্ত বামুন শিক্ষিত মহিলা। তাই সম্ভবত সবচাইতে কম সময়ে তিনি হাজত তথা ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেন। এই বাহাত্তর ঘণ্টাই তাঁকে এতোটা বিধ্বস্ত অবসন্ন করল যে বেরিয়ে তাঁর প্রশ্ন, “ ...৭২ ঘণ্টার দুঃসহ অভিজ্ঞতার বোঝায় আমার পা দুটো যে মাটিতে পা রাখল সেই মাটি কি আমার?” (পৃ:৩৩)
সেই প্রশ্নটাই ঘুরিয়ে করেন রেবতি দাস, “বলেন,বাবা,বলেন কোনটা আমার দেশ, একবার লাথি মেরে এপারে পাঠায়,আবার লাথি মেরে বলে যা ব্যাটা ভাগ,এটা তোর দেশ নয়।’ সমস্যা সেই একই --জেলার ভেতরেই স্থানবদল ঘটেছিল, ভোটার তালিকাতে নাম ভুল উঠেছিল। নইলে জন্ম এদেশেই দুর্লভছড়ার বাজারঘাট সোনাই নদীর পাড়ে থাকতেন, বানের তাড়াতে সিংলার পাড়ে ফেতিপাত গ্রামে চলে আসাই হয়েছে কাল। তায় ভোটার তালিকাতে রেবতি দাস আর তিতলিবালা হয়ে পড়েছিলেন, রেপতি আর কোকিলা বালা। স্বাধীনতার আগে থেকেই ভোট দিচ্ছিলেন রেবতি দাস,এই দেশেই। তবু ‘আইন’ মেনে বিদেশী ট্রাইব্যুনাল ২০১০এর আগস্টে তাদের বিদেশী বলে রায় দেয়। তার আগে নয়, পুলিশ সন্ধান করে বেড়ায় তার পরে। পাঁচ বছর ধরে সন্ধান করে গিয়ে সফল হয়। টেনে এনে শিলচর জেলে পুরে। না, তাদের সীমা পার করবার খবর নেই। তবু মাস কয় হাজত বাস করতে হয়েছে, ধারদেনাতে বাঁধা পড়তে হয়েছে। আর মুসলমান সেপাই, যার ভাতের থাকা এগিয়ে দেবার কথাই নয়, বেচারা দিল বলে, রেবতি দাসের হাহাকার, ‘আমার জাত কই থাকল? আমার ধর্ম কই থাকল?’ (পৃ:৩৯)
সেরকমই করিমগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম বাজারঘাটের গোবিন্দগঞ্জের সম্পন্ন কৃষক স্ত্রী বন্দনা দাসের গল্প ‘সীমান্ত প্রহরীর মা’। বিয়ের আগে ভোটার তালিকাতে নাম ঢুকে গেছিল ‘জয়ারানি দাস’ নামে। সেই নিয়ে ডি-ভোটারের নোটিশ এসেছিল গেল শতকের শেষে। তারা নাম শোধরানোর আপিল করেছিলেন, সে সংশোধিতও হয়েছিল। ভোটার আই ডি কার্ডও এসেছিল। কিন্তু কুকিতলের মূল তালিকার জয়ারানি দাসের কী হলো, খবর নেবার দরকার মনে করেন নি। বারে বারে আদালত শমন পাঠিয়েছে। একবার বাজারঘাটের এক রহস্যময় ব্যক্তি ‘মলয় কান্তি দেব’ নোটিশ নিয়ে পৌঁছে দেবেন বলেও দেন নি। ফলে বাংলাদেশী বলে শিলচর হাজতে গেলেন বন্দনা দাস। স্বামী, মেয়ে , মেয়ের বরের দৌড়ঝাঁপে শেষে মুক্তি পেলেন।
এদের চাইতে জটিল চেহারা নেয় পাঁচগ্রামের ঠাণ্ডাপুরের অতিবৃদ্ধ শয্যাশায়ী প্রাণহরির গল্প। ‘রুদ্ধসঙ্গীত’। খুড়তুতো ভাই জয়হরির উদ্যোগে সেই ১৯৬৪তে আসেন বাংলাদেশ থেকে। মনে হলো বাংলাদেশে আর টেকা যাবে না। ‘গাঁয়ের মুসলিমরা হঠাৎ করেই যেন মোড়ল হয়ে উঠেছে, দাবড়ানি দিয়ে কথা বলে।’ সুতরাং চলো ‘ইণ্ডিয়া’। সেই ইণ্ডিয়ার পুলিশ ২০১১তে সে একদিন ‘বাংলাদেশী’ বলে তাঁকে তুলে নিয়ে গেল প্রথমে শিলচর হাজতে। পরে সেখান থেকে কোন আইনে কে জানে দিন পঁচিশেকের পরে মহিষাসন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পার করে দেওয়া হয়। সেখানে বড়লেখা গ্রামের মুসলমানেরাই তাঁকে আশ্রয় দেন, রক্ষা করেন। হবিগঞ্জে তখনো থাকেন প্রাণহরির খুড়তুতো ভাইয়ের পরিবার। বড়লেখার মুসলমানেরাই চাঁদা তুলে গ্রামের একমাত্র হিন্দু অখিলকে দিয়ে পাঠিয়ে দেন হবিগঞ্জে । সেখানে কিছু দিন থেকে আবার ব্যবস্থা করে চোরা পথেই ফিরে আসেন প্রাণহরি। কিন্তু আবারো ধরে নিয়ে যায় পুলিশ, এবার অভিযোগ ডি-ভোটার হবার। ছাড়াও পান অচিরেই। কিন্তু তাঁকে ছাড়িয়ে আনতে গিয়ে ছেলে বীরেন্দ্র একমাত্র দোকানটি বিক্রি করে দেয়। পুরো পরিবার বিধ্বস্ত হয়ে যায়।
তরাই বিবির কাহিনিও এরকমই জট পাকানো। শেষমেশ হলোটা কি স্পষ্ট না। বিদেশী নোটিশ থেকে তিনি মুক্তি পেলেন, কি হাজতে গেলেন। কিন্তু সৎ ছেলে জহির উন্মাদ প্রায় হয়ে গেলেন, এবং শেষে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলেন। শিরোনাম তাই ‘মুরব্বি বেটির সৎ ছেলে’। ঘটনা সেই করিমগঞ্জ জেলার নিলামবাজারের রতনপুর বড়বন্দ গ্রামের, ‘দেশের ওই সব গ্রামের একটি যেখানে সরকারের উন্নয়নের বিজ্ঞাপন এসে পৌঁছয় নি’( পৃ: ৬৮ ) বাংলাদেশী নোটিশের কথা শুনে তরাই বিবির অবাক করা প্রশ্ন ছিল, ‘বাংলাদেশী? আমি তো মুসলমান।’ তবু একদিন আদালতে যাবেন বলে রওয়ানা দিয়েছিলেন। সৎ কন্যার বর আর জহিরেরাই নিয়ে যাচ্ছিলেন। নিলাম বাজার পেরোতে না পেরোতে বৃদ্ধার মরো মরো দশা। তাই না দেখে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। পরে করিমগঞ্জ আদালতে খবর নিতে গেলে উকিল বুঝি বলেছে, আদালতে হাজিরা না দেওয়াতে জজসাহেব রেগে বলেছেন, ‘...দাও বুড়িরে বাংলাদেশে পাঠিয়ে।’ (পৃ:৭৬) বাংলাদেশীকে আশ্রয় দেবার দায়ে পুলিশ তাকেও ধরে নিয়ে যেতে পারে বলে জহিরের ভয় ছিলই। জজ সাহেবের কথার কথা কানে যেতেই সে গলায় দড়ি দেয়। দেশ, জাতি, সম্প্রদায়, আইন-আদালত শব্দগুলোর সম্পর্কে অজ্ঞ, মানে না বোঝার আতঙ্ক এভাবেই একটি জীবন কেড়ে নেয়।
সেরকমই ভোটকর্মীর অজ্ঞতা আর অবহেলায় করিমগঞ্জের ভগিরথলার হাফজা বেগমের নাম হয়ে যায় ভোটার তালিকাতে ‘ছায়া বেগম’। ভোটের কার্ডও আসে, দু’চারবার ভোটও দেন এই নামেই। শোধরানোর চেষ্টা করেও করা হয় না, শোধরানো আর হয় না। একদিন নোটিশ এলো। আদালতে মামলা গেল। ‘ছায়া বনাম হাফজা’ মামলার রায়ে বিদেশী হলেন হাফজা বেগম। শিলচর জেলে দিন কয় কাটালেন। ছেলে মিনাল ঠিকাদারের কাছে ধারদেনা করে টাকা নিয়ে মামলা লড়ে তবে উনিশ দিন পরে বের করে আনল।
জহির সৎ-মাকে আশ্রয় দিলেও, আত্মহত্যা করেছে মায়ের জন্যে নয়, তাকেও না ‘বাংলাদেশী’ আশ্রয় দেবার দায়ে ধরে নিয়ে যায়, সেই ভয়ে। বেচারা জহির গরীব মানুষ। বিপরীতে হায়দর আলি প্রতিপত্তিশালী মানুষ। সেও করিমগঞ্জ জেলারই দক্ষিণ মানিককোণা গ্রামের গল্প ‘কোনো চরিত্র কাল্পনিক নয়।’ ‘হায়দর আলির চার ছেলে। বড় তিনটি কাজ করে সৌদি আরবে। কলকারখানায় কাজ করে ওদের রোজগার বেশ ভালোই । ছুটিছাটায় বাড়ি এলে খরচও করে দেদার। ছোট ছেলে এখনও বদরপুর মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে’(পৃ:৯৩) এই নিয়ে ঈর্ষার শিকার হলো পরিবারটি। সম্পত্তি নিয়ে একই গোষ্ঠীর আত্মীয় রহিম আলিদের সঙ্গে বিবাদ ছিলই, ছিল মামলা মোকদ্দমা। সেই ফাঁসিয়ে দেয়, যখন বহু বহু বছর পরে নিজের মা এবং সৎ বোনকে নিজের কাছে এনে রাখেন হায়দর আলি। মায়ের জন্ম কাছাড়ের গণিরগ্রামে স্বাধীনতার বহু আগে। বিবাহবিচ্ছিন্না মায়ের দ্বিতীয় স্বামী ছিলেন বাংলাদেশের, এবং সেই সুবাদে তিনি মাঝে কিছু বছর সেদেশে কাটান, এই হয়েছে বিপত্তি। হায়দর আলি অনেক কিছুই স্পষ্ট করেন নি, বলেছেন, “আমি যা বলবার পুলিশকে বলেছি, দয়া করে আমাকে আর প্রশ্ন করবেন না।’ তিনি প্রতিপত্তিশালী মানুষ। প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়েই মা বোনকে মুক্ত করেছেন। বোনটি যে ‘বাংলাদেশী’ সেই নিয়ে কোনো সংশয় নেই। সেদিক থেকে কাজটি তার ‘অনৈতিক’ এবং ‘দেশদ্রোহী’ও । যে কেউ বলতে পারেন, যদি তিনি হায়দর আলির ‘হৃদয়ে’র ভাষা না পড়তে পারেন, এবং জানেন। দ্বিতীয় স্বামী নেই, কিন্তু তাঁর সঙ্গে তো ‘তালাক’ও হয় নি। সে অবস্থাতে প্রথম স্বামীর ঘরে ফেরা ধর্মে সয় না। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে মুমূর্ষু মাকে সঙ্গে নিয়ে আসতে গিয়ে তিনি ‘ধর্ম’কেও তুচ্ছ করেছিলেন।
আতরজান বিবি মুমূর্ষু।শয্যাশায়ী। এখনো বেঁচে আছেন।মা মারা গেলেন যখন রবীন্দ্রচন্দ্র যখন ‘বিদেশী’ হবার অভিযোগে জেলে ছিলেন। সেও আরেক ঈর্ষার গল্প। গল্প প্রতিশোধের। কিছু না, গেল পঞ্চায়েতের নির্বাচনে তিনি কৃপেশ দাসের সঙ্গ না দিয়ে দিয়েছিলেন ভাগ্নে-বৌর। শোধ নিতে ফাঁসিয়ে দিল কৃপেশ। নামটি স্বাভাবিক কারণেই কাল্পনিক। ষাটের দশকের শুরুতে বাবা গজেন্দ্র চন্দ্র ত্রিপুরা দিয়ে ভারতে এসে প্রথমে ত্রিপুরাতেই উদ্বাস্তু শিবিরে দিন কতক থাকেন। বাংলাদেশের জমিজমা বেঁচে এসেছিলেন।হাতে টাকাপয়সা ছিল। চলে এলেন কাছাড়ের ধলছড়া ক্যাম্পে। সরকারের দেওয়া জমি পেয়ে প্রথমে সালিমাবাদে বাড়ি করেন।পরে সংসার বড় হলে চলে আসেন নরপতি হাওরে। ১৯৭০এ ছেলে রবীন্দ্র চন্দ্র বিয়ে করেন করিমগঞ্জ রাকেশনগরের সুভাষীবালাকে। সেই রবীন্দ্রচন্দ্রের কাছে ২০০৭এ আসে বিদেশী নোটিশ, ২০১১তে একতরফা রায়ে বিদেশী হয়ে পড়েন। তিনি কিছুই জানতেন না। দারোগা ফোনে যখন জানান, তখন আপীল করবার জন্যে হাতে পাঁচদিনও নেই। উকিল শক্তহাতে সেবারেও মামলা লড়েন নি। কিন্তু এভাবে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে ভাবেন নি। ভাবলেন থানার সামনেই অন্য কাজে গিয়ে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিতেন না। তখনই দেখেন থানা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন কৃপেশ দাস। দারোগা এগিয়ে এসে তাঁকে গ্রেপ্তার করেন। জেলে বসেই কাগজ পড়ে মায়ের মৃত্যু সংবাদ পান। ঘোষিত ‘বিদেশী’র মা। সুতরাং সংবাদ হয়। অবশ্য তাঁর হয়ে দৌড়ঝাঁপ করছিলেন সি আর পি সি-র নেতা সাধন পুরকায়স্থ। তিনিই কাগজকে সংবাদটি দেন। আড়াই মাস পরে জামিনে বেরিয়ে আসেন তিনি। ততদিনে ছ বিঘা জমির সাড়ে চারবিঘা জমি মামলা লড়তে গিয়ে বিক্রি বাটা করে ফেলেছেন। চার সন্তানের দুই বড় মেয়েকে বিয়ে দিলেও ছোট সাবিনা স্কুলে পড়ত, তাকে স্কুল ছাড়িয়ে শহরে পাঠাতে হলো বাবুর বাড়ির কাজ করতে। সঙ্গে দুই বই দিয়েছিলেন এই আশাতে যে মেয়ে পড়বে, আর অবস্থা ফিরলেই মেয়েকে এনে আবার স্কুলে দেবেন।এরই মধ্যে হাওরের সবাই ধরল, মায়ের মুখাগ্নি করতে পারেন নি, সুতরাং প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। তার মানে আবার ধার, আবার দেনা। আকণ্ঠ দেনাতে ডুবে সেটাও করলেন। এই সংস্কারকেই বিদ্রূপ করলেন, না কি মায়ের গর্ভে ‘বিদেশী’ জন্মের—কি জানি-- লেখক এই অধ্যায়ের নাম রাখেন ‘প্রায়শ্চিত্ত’। মাসকয় পরে গুয়াহাটি হাইকোর্ট মেনে নিল রবীন্দ্র চন্দ্র স্বদেশী,তাঁর বাবা স্বদেশী।কিন্তু দেনাতে ডুবন্ত বাবার তখনো উপায় হলো না মেয়েকে ফিরিয়ে আনার। গেছিলেন অম্বিকাপট্টিতে মেয়েকে দেখতে। মেয়ে বাবার হাতে বইগুলো তুলে দিয়ে বলল,“আমার আর লাগবে না।” সেই বইগুলোই ভিজছিল যার কথা দিয়ে আমরা শুরু করেছিলাম। সে কি বই ভিজছিল? না ভিজছিল আরেকটি প্রজন্ম? ভিজে মাটিতে মিশে যাচ্ছিল আরেকটি শিশুর ভবিষ্যৎ? দারিদ্র্যের সঙ্গে অজ্ঞতার খালে, বিলে হাওরে।
যে ‘বাংলাদেশ’কে নিয়ে এতো বিবাদ সেই বাংলাদেশীরা কেমন উদ্ধার করলেন ‘প্রাণহরি’র গল্পে আমরা জেনেছি। একটি গল্পেও পুলিশের ভালোমানুষির কথা নেই, নেই শিলচর জেলের ভালো কথার বর্ণনা। শুধু অর্চনা আর গোপাল-গোবিন্দের গল্প ছাড়া—যারা ছিলেন প্রকৃতার্থেই বাংলাদেশী। প্রাণহরিকে সীমান্ত প্রহরীরা ধাক্কা দিয়েই কাঁটাতারে ওপারে ঠেলে দিয়ে তালা লাগিয়ে দিয়েছিল। তার বিপরীতে বাংলাদেশের বি ডি আর কিন্তু মানুষের সঙ্গে মানুষের মতো ব্যবহার করে। ভারতীয় জেনে চড়থাপ্পড় চালায় না, লাথি ঝাঁটা মারে না। অসুস্থ মেয়েকে দেখতে বাংলাদেশে গিয়ে ধরা পড়ে যান জয়ন্তী আর ছেলে প্রাণতোষ। অধ্যায় নাম ‘প্রবাসে দৈবের বশে’। বি ডি আর এমন ভাব করছে যেন নিতান্ত ধরা পড়ে গেলেন বলে। নইলে বিপদে পড়া মানুষকে উদ্ধার করতে পারছেন না বলে যেন তাদের পাপবোধে র পারা চড়ছে। “...কিন্তু আমি এখন আপনাদের নিয়ে কী করি? কী ফ্যাসাদেই না পড়লুম।” (পৃ: ১১১) মামলা পেয়ে ‘দেশপ্রেম’ দেখাবার উত্তেজনাতে মোটেও পায়নি বাংলাদেশী সীমান্ত প্রহরীর। বিপদে পড়া মানুষগুলোকে বাঁচাতে পারলেই যেন নিজেও বাঁচে। লেখক লিখছেন, “বিডি আরের অফিসারটি ভাল মানুষ,তিনি বুঝতে পারছেন,খামোখা ঝামেলায় পড়ে গেছেন মা-ছেলে। এরা সাধারণ মানুষ, কোনো অপরাধ চক্রের সঙ্গে যুক্ত নয়। কিন্তু আইনতো আইনই। এরা, যত যাই হোক, অনুপ্রবেশকারী তো, এদের তো এমনি ছেড়ে দেওয়া যায় না। বিএসএফ ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়ে গেলে এদের ল্যাটা চুকে যেত। কিন্তু তাও তো হলো না।” (পৃ: ১১৪)
এই গল্প বিপরীত অনুপ্রবেশেরও। প্রাণতোষের বোন রত্নার বিয়ে হয়েছিল বাংলাদেশের অজয় বিশ্বাসের সঙ্গে প্রেম করে। মাঝে মধ্যে যাতায়াত হতো ‘টাউট’ ধরে।এই টাউটেরা আছে এপারে ওপারে দুই পারেই। বিডি আর –বিএসএফের চোখে ধুলি দিয়ে,না দিয়ে মানুষ পারাপার করা এদের কারবার। শেষবারে যখন মায়ে-ছেলে অসুস্থ রত্নাকে দেখতে বাংলাদেশে যান,মনে হয় এপারের ‘টাউটে’র সঙ্গে দরনিয়ে বনিবনা হয় নি, তাতেই দিল ফাঁসিয়ে।বিডি আর অফিসারের সেরকমই অনুমান। শেষ অব্দি দিন চল্লিশের জন্যে জেল হলো। “জেল সুপার আনোয়ার-উজ-জামান কড়া ধাঁচের মানুষ, সপ্তাহে একদিন সব ক’টা ওয়ার্ড টহল দেন। সে সময়ই স্পষ্টভাষায় জানিয়ে দেন, যারা যার ধর্ম যার যার কাছে। কেউ যেন অন্যের ধর্মে হাত না দেয়। কোনও নালিশ এলে তিনি কড়া ব্যবস্থা নেবেন।” (পৃ:১১৬) রোজার দিনে ঘড়ি ধরে হিন্দু কয়েদিদের খাবার দেওয়া হচ্ছে, দশমীর দিনে খাওয়ানো হচ্ছে মিষ্টি। পুজোর ব্যবস্থা করে নিজেদের জন্যে অপমান জনক হওয়া সত্ত্বেও “ ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলেন তারা।” (পৃ:১১৬) শুধু উপায় করা গেল না জেলে মুসলমানের হাতে রান্না না খাবার, তাতে মা জয়ন্তীর ‘গা গুলোতো।’
কিন্তু চল্লিশদিনের থেকে একবছরেও বেরোনো গেল না। জেল বাংলাদেশের, কিন্তু জাল ভারতের। সেই জালে আটকে ঢাকা-পাথারকান্দি-গুয়াহাটি-দিল্লি দিয়ে বহু ঘাটের জলে নেয়ে পনেরো মাস পরে মুক্তি ঘটে মা-ছেলের। তাঁরা অনুভব করেন, “কাঁটাতারের বেড়াই বাস্তব। যে বাস্তবের কাছে রক্তের সম্পর্ক হার মানে।”(পৃ:১১৮)
রবীন্দ্রচন্দ্রেরই মতো ঈর্ষা, ব্যবসাতে শত্রুতার জেরে ফাঁসানো হলো জারইলতলা ফরেস্ট ভিলেজের মঙ্গল দাস আর তার অতিবৃদ্ধ বাবা রমেশ দাসকে দুমাস শিলচর হাজতে থাকতে হলো বিদেশী মামলাতে। সেই অধ্যায় নাম ‘দুই প্রজন্ম’। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে বাজার যাবার পথেই পুলিশ তুলে নিয়ে যায় রমেশ দাসকে। ডি-ভোটার মামলাতে যে তাদের খুঁজছে পুলিশ সেসব মঙ্গল দাসের জানাই ছিল। এও জানা ছিল যে শিলচর আশ্রম রোডে জমি কিনেছেন ব্যবসা ভালো করছেন বলে অনেকেরই গা জ্বলছিল, সেরকমই একজন তাঁদের ফাঁসিয়েছে। নইলে বাবার নামতো সেই ১৯৬৪ থেকেই ভোটার তালিকাতে রয়েছে। তিনি দিনকতক গা ঢাকা দিয়ে রইলেন। ভাবলেন পুলিশ অধীক্ষককে গিয়ে সত্যটা বললে, বাবা মুক্তি পেয়ে যাবেন। হলো উলটো সেখানেই তাঁকেও গ্রেপ্তার করল পুলিশ। সি আর পি সি-র সাধন পুরকায়স্থ, অনুপ চৌধুরীদের চেষ্টা চরিত্রে মাস তিনেকের মধ্যে বাপে ছেলেতে ছাড়া পান।
উধারবন্দের মানিক দাসের বাবা ১৯৬৪র সেপ্টেম্বরে ভারতে এসে করিমগঞ্জের কলকলিঘাটের উদ্বাস্তু শিবিরে নাম লেখান। সেই নথিপত্রও আছে। পরে ভোটার তালিকাতেও স্বাভাবিকভাবেই নাম এসেছে। কিন্তু সেই তাকে কোন রহস্যে কেউ জানে না,একবার বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে পাচার করেছে। উধারবন্দ বাজারে সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছেন কলা বেচতে। ২০০৮এর অক্টোবরে। তাঁকে পথ থেকেই ধরে তুলে নিয়ে গিয়ে সীমা পার করে দেয়। সীমার অপারের দেশ বাংলাদেশই বুঝি তার স্বদেশ। আমরা জয়ন্তী-প্রাণতোষের গল্পে বিডি আরের মানবিক মুখ দেখেছিলাম। কিন্তু এই গল্পে বিএসএফেরই প্রতিচ্ছায়া। তারাও তাকে পাকড়াও করে মারধর করে আবার এপারে ঠেলে দেয়। তারপরের ঘটনা স্পষ্ট নয়। তবে তাঁকে উদ্ধার করে আশ্রয় দেওয়াতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের এক সদর্থক ভূমিকা রয়েছে। এরপরের বছরের ভোটার তালিকাতেও নাম রয়েছে তার। তিনি ভোটও দিয়েছেন। তাঁর সম্পর্কে মামলাটি এখন ট্রাইব্যুনালে স্থগিত রাখা আছে। কিন্তু সেই ২০০৮এর ‘পুশব্যাকের দুঃস্বপ্ন’ এখনো তাকে তাড়া করে বেড়ায়।
‘গোবিন্দ ও গোপাল’ এবং তাদের মা অর্চনার গল্প ঘুরে ফিরে বারে বারে এসেছে। সেই প্রথম অধ্যায়ের সুচন্দ্রা গোস্বামী থেকে শুরু করে অনেকেই হাজতবাসে গিয়ে তাদের দেখেছেন। জয়ন্তী-প্রাণতোষ যেমন বাংলাদেশে মেয়েকে দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে যান, এরা সেরকম করিমগঞ্জ এসেছিলেন আত্মীয়বাড়ি। ভিসা পাসপোর্ট ছিল না। পুলিশের মতে জমিজমা কিনে এখানেই বসত করবার মতলবেই এসেছেন এরা। অর্চনা যতই বলেন,বাংলাদেশই তাঁর বাড়ি, সেখানে স্বামীও আছে, সোমত্ত মেয়েও আছে। তিনি ফিরে যেতে চান। পুলিশ,এদেশের আইন আদালতেরও ইচ্ছে একই। তবু মামলা মোকদ্দমা তো লড়তেই হবে। সেই লড়াইতে আড়াই বছর লেগে গেল। সেই মামলাতেও সাধন পুরকায়স্থ ছিলেন সদা সক্রিয়। তাঁর চেষ্টাতেই তাদের মুক্তি মেলে।সঙ্গে আরো পাঁচ বাংলাদেশী নাগরিকও ছিলেন। ছেলে দুটি জেলের সবার আদরের হয়ে উঠেছে। লেখাপড়ারও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন জেল কর্তৃপক্ষ। তাদের জন্যে খেলনা কিনেও এনে দিয়েছে রোটারি ক্লাব। তারপরেও শিশু দু’টি বুঝে গেছে, ভারত মানে বন্দীশালা, মুক্তি মানে বাংলাদেশ। স্বদেশ।
“ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়া যাবে, এই টোপ দিয়ে সীমান্ত এলাকায় কীভাবে বাংলাদেশের হিন্দুদের এ দেশে এনে সর্বস্বান্ত করা হয়ে থাকে,উনমতিবালা-রাধিকা বিশ্বাস এপিসোড এর জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ।”( পৃ:১৩৩) আজকাল তো সরকারিভাবেই বিজ্ঞপ্তি –বিল এনে সেই টোপ দেওয়া হচ্ছে। তারপরেও বহু প্রাচীনেরা ডি-ভোটার হচ্ছেন, ডিটেনশন ক্যাম্পে যাচ্ছেন, আত্মহত্যা করছেন। সেই গল্পই এই অব্দি আমরা পড়ে এলাম। গোপাল-গোবিন্দ আর তাদের মায়ের গল্পও। কিন্তু এই দুই মা-ছেলের গল্প অনেক করুণ। সম্প্রতি তারা হাজতমুক্ত হয়েছেন আদালতের রায়ে। এখনো বাংলাদেশে যাবার কিংবা থাকবার বিষয়টির নিষ্পত্তি হয় নি। মুক্তিযুদ্ধের বহু আগেই খুড়ো জ্যাঠারা কাছাড়ে এসে দুধপাতিলে বাড়ি করেন। আসেন নি রাধিকা বিশ্বাসের বাবা রাজেন্দ্র।তিনি আসেন ১৯৭৫এ বাকি পরিবারকে বাংলাদেশেই রেখে। ভোটার লিস্টেও নাম তুলেছিলেন। থাকতেন এখানেই কিন্তু দেশের বাড়ি জগন্নাথপুরের বড় শ্যাওড়া গ্রামে যাতায়াত দুই পরিবারেরই ছিল। বছর বারো আগে সেই দেশের বাড়িতেই রাজেন্দ্র মারা যান। তারপর রাধিকাও সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন তিনি ভারতে চলে আসবেন। জমি বাড়ি সাতলাখ টাকাতে বিক্রি করে বাকি পরিবারকে আত্মীয় বাড়ি রেখে তিনি চলে এসেছিলেন মা-কে নিয়ে। টাউট ধরে আগরতলা সীমান্ত দিয়ে। সেই টাকার মধ্যে পাঁচলক্ষ টাকা খুড়তুতো ভাই রমাকান্তকে দিয়েছিলেন,কিন্তু রমাকান্তের দাবি দিয়েছিলেন এক লক্ষ টাকাই। সেই নিয়ে বিবাদ, মারপিট, পঞ্চায়েতে সালিশি। কিছুতেই কিছু হয় নি। রাধিকার কথাতে কেউ বিশ্বাস করেনি। ভাই তাকে তাড়িয়ে দিলেন। শিলচর মালুগ্রামে এক বাড়িতে ভাড়া থাকতে শুরু করলেন।এন আর সি-তে নাম তুলে দেবেন বলে এখানেও এক ‘টাউট’কে পঁচানব্বুই হাজার টাকা দিয়ে ঠকে যান। বাড়িভাড়া বাকি পড়াতে গরিব মালিকও ভাড়াটে তাড়ান। মায়ে ছেলেতে আশ্রয় নেন সর্বোদয় বিদ্যালয়ের বারান্দাতে। বিদ্যালয়েও সমস্যা। পুরসভাকে জানালে তারা ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখার ব্যবস্থা করছিলেন। পুলিশ জেনেও আসি আসি করে আসছিল না। বলছিল বিদ্যালয় থেকে তাড়িয়ে দিতে, কিন্তু দেন নি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এই অব্দিই গল্পটি পড়িয়েছেন লেখক। “প্রশ্ন হল, জন্মের দেশ থেকে এলেন কেন? মুসলমানের অত্যাচারে? বুড়ি বলেন, মিথ্যে বলব না , কোনো অত্যাচার মুসলমানরা করে নি। মায়ের স্বীকারোক্তিতে অস্বস্তিতে ধাধু, আমতা আমতা করেন; না, এমনিতে অত্যাচার করে নি। তবে মুসলমানের দেশ তো, সব অত্যাচার গায়ে পড়ে না অন্তরে দাগ কাটে।” (পৃ: ১৩৫) এই প্রশ্নে লেখক থেমেছেন, “সব হিন্দুর শেষ আশ্রয় হিন্দুস্তানে ধাধু বিশ্বাসের অবস্থান তা হলে কী হবে? (পৃ: ১৩৫) আমাদের প্রশ্ন করতে ইচ্ছে জাগে মুসলমানের যে অত্যাচার অন্তরে লাগে, তার জ্বালা কি ভারতীয় স্বজনের এই লুণ্ঠন আর প্রবঞ্চনার থেকেও খুব বেশি? একেবারেই অসহ্য? তাদের ভারতনিবাস কি তুলনাতে খুব সুখকর মনে হলো?
‘অর্জুনের আত্মহত্যা’ বড়সড় সংবাদ হয়েছিল। নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী এসে বলেছিলেন, আর কোনো অর্জুন নমঃশূদ্রকে আত্মহত্যা করতে হবে না। ডিটেনশন ক্যাম্প গুড়িয়ে দেবেন। সেই জহিরের মতোই ভয়ে আত্মহত্যা করে ফেললেন কাটিগড়া হরিটিকর হাওরের অর্জুন। ষাটের দশকেই বাবা অনন্ত নমঃশূদ্র এদেশে আসেন,বিয়ে করেন, ভোট দেন। হরিটিকরেই জন্ম দুই ভাই বোন অঞ্জলি অর্জুনের। এখন বুঝি মায়ে সন্তানে সবাই বাংলাদেশী। শত্রুতা করেই হাওরের কেউ ফাঁসায়। প্রথমে আমল দেন নি। গ্রামের লোকে বুঝিয়ে শিলচর আদালতে গেলে সি আর পি সি নেতা তথা আইনজীবী অনুপ চৌধুরী বলেন, ভয় পাবার কিচ্ছু নেই। সব ঠিক আছে। মামলা লড়তে হবে। সেই মামলার খরচাপাতিও নিতেন না। উলটে ফেরার ভাড়াও অর্জুনদের দিয়ে পাঠাতেন। তবু ভয় গেল না। লোকেও ভয় দেখাতো, ভারতীয় বলে প্রমাণ না দিতে পারলে বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে গিয়ে লাথি মেরে ফেলে দেবে। সেই ভয়ে বেচারা গুমরে গেল। রুজিরোজগার ছেড়ে দিল, স্ত্রী বাসনার সংসার সামাল দেয়া কঠিন হলো। স্বাভাবিকভাবেই পরিবারেও অশান্তির পারা চড়তে থাকল। বাইরে ভেতরে অশান্তির আগুনে পুড়ে সব জ্বালা থেকে মুক্তি পেতে একদিন পাশের নির্মীয়মান বাড়িতে গিয়ে গলায় দড়ি দিলেন অর্জুন। সেই ডি-ভোটারে শব নিয়েও টানাটানি কম কিছু হলো না। শিলচর মর্গে নিয়ে গিয়ে ময়নাতদন্তেও গেল দুদিন। শরীর পচতে শুরু করেছে। সেই শরীর নিয়ে বাড়ি ফেরা যাচ্ছিল না বলে শিলচর শ্মশানে পোড়াতে গিয়েও আইনে ধরল। টাকা দিয়ে আইনের প্যাঁচ ছাড়াতে হলো। মৃত্যুর কিছুদিন পরেই মা-বোন অভিযোগ মুক্ত হন, এমন কি এন আর সি-র জন্যে ১৯৫১র লিগ্যাসি ডাটাও পাওয়া গেল। মৃত অর্জুন নির্বাচনী ইস্যু হলেন। মায়ের হৃদয় কাঁদে, বিলাপ করে । নির্বাচনী প্রচারের “মাইকের আওয়াজে যেন ঝড়ের মত এগিয়ে আসছে। বুড়ির বিলাপ ঠিক মাইকের স্লোগানে চাপা পড়ে যাবে এবার।” (পৃ: ১৪৭)
দেশে দেশে মোর দেশ আছে,আমি সেই দেশ লব যুঝিয়া :
যাদের কিনা থানা-পুলিশ করতে হলো, জেল হাজতে যেতে হলো, কাঁটাতারে এপারে অপারে লাথি ঝাঁটা খেতে হলো তাঁদের গল্প এই অব্দি শেষ। পরপর তিনটি গল্প খানিক আলাদা। রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার শুরুটা এরকম—“সব ঠাঁই মোর ঘর আছে,আমি/ সেই ঘর মরি খুঁজিয়া।/দেশে দেশে মোর দেশ আছে,আমি/ সেই দেশ লব যুঝিয়া।” (উৎসর্গ/১৪) সেই যুদ্ধে কেউ অনন্তের মতো প্রাণ দেয়, ‘রিফিউজি’ হয়, কেউ হয় ‘সাম্রাজ্যে’র অধীশ্বর। রবীন্দ্রনাথের মতো তাঁদের গল্পের নটে গাছটি মুড়োয় “ধন্য এ মাটি,ধন্য সুদূর/ তারকা হিরণ-বরনী...” বলে। তার জন্যে শ্রেণি আলাদা হতে হয়। সম্ভবত বর্ণও। না খেতে পেলেও বামুন কায়েতেরা পরের বাড়িতে কাজ করেছেন---এমনটা তো আমরা দেখিনি। কিন্তু উন্মাদ হয়েছেন, মাতাল হয়েছেন এবং আত্মহত্যাও করেছেন। সেরকম সংবাদ সম্ভবত বর্ণহিন্দুর ঘরে ঘরে রয়েছে। সেরকম দু’একটি লিখলে মন্দ ছিল না। তবু যা লিখেছেন, মন্দ না। ‘এই স্বাধীনতা, অনন্তকে’ লেখকের স্মৃতি কথা। একটি অভিজ্ঞতার থেকেই বলছেন। অনন্ত ছিল শিলচরে বাড়ির কাজের লোক। মুক্তি যুদ্ধের সময় চলে এসেছিল তার পরিবার। মা আর চার ভাইবোন। নতুন পট্টিতে উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল। থেকে গেছিল। পরে এখানে ওখানে কাজে কর্মে ঢুকে গেছিল পুরো পরিবার। অনন্তের মা লেখকের বাড়িতে কাজে ঢোকে বাড়িরই একজন হয়ে গেছিলেন। “খুব খাটিয়ে মানুষ ছিল। সবাই বলত, রিফিউজিরা খুব পরিশ্রমী হয়। যেন রিফিউজিরা অন্য কোনো দেশের মানুষ, বাঙালি নয়।” (পৃ: ১৪৯) । সেই অনন্তের কঠিন অসুখে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল গুয়াহাটি। অসম আন্দোলন তখন থিথিয়ে এলেও, বিদেশী ধরার ভয় ছিল। অনন্ত সেখানেই মারা গেলে তাকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু মুখাগ্নি করা যাচ্ছে না। যারা নিয়ে গেছেন, তাদের সবারই বাবা-মা রয়েছেন তাই সংস্কারে বাঁধছে। এদিকে দেরি হলে যদি পুলিশে এসে ধরে সেই ভয়ও কুরে কুরে খাচ্ছে। অগত্যা, কিছু ‘গেঁজেল-মাতাল’কে ধরে ‘বিলেতি’ খাইয়ে অন্ত্যেষ্টি হলো অনন্তের। “চিতাভস্ম মিশে গেল স্বজন-পরিজনহীন ভূমিতে। যে ভূমি স্বদেশ না বিদেশ তা আর জেনে যাওয়া হলো না অনন্তর।” (পৃ: ১৪৮) আরেকটি গল্প তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব-পশ্চিম’ থেকে নিয়েছেন। প্রতাপ মজুমদারের গল্প। পূব বাংলার সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান। ফলে কলকাতা চলে এলেও অনন্তদের মতো বিপত্তি হয় নি তাঁর। কিন্তু সেই তিনিও স্বাধীনতা দিবসের পার্টিতে এক বন্ধুর বাগানবাড়িতে গেছেন। বন্ধু যখন জানাচ্ছে খেতে দেওয়া মাছ তাদেরই দীঘির, প্রতাপের মনে পড়ছে এমন দিঘি তো তাদেরও ছিল। এক বাঙালি স্বাধীন, আরেক বাঙালী উদ্বাস্তু। প্রতাপ বা অনন্তদের গল্প তো পাঠ্যপুস্তকেও ঠাই পেল না। “অনন্তদেরও এই স্বাধীনতার শরিক করতে আজও কি পেরেছে বাঙালিরা?” (পৃ: ১৫০) লেখকের প্রশ্ন।
প্রতাপ মজুমদারের মতো দুই ব্যক্তিত্বের প্রতিষ্ঠার দুই গল্প এর পরে রয়েছে। ‘জাপানি বউয়ের বাঙালি বর’ এবং ‘কেপিসি সাম্রাজ্য’ সেরকম দুই গল্প। শীতল রায় সিলেট থেকে প্রেম এবং বিয়ে করে সরাসরি চলে যান জাপানে । সেখানে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। লোকে ‘শিতরু রায়’ বলে চেনে। কেউ প্রশ্ন করলে তিনি নিজেকে ভারতীয় বা বাংলাদেশী বলে নয়, পরিচয় দেন বাঙালি বলে। জন্ম কোথায় জিজ্ঞেস করলে বলেন, বেঙ্গলে। সারা বিশ্বে তাঁর ব্যবসা ছড়িয়ে আছে, আছে ভারতেও , বাংলাদেশেও। সেরকমই কালীপ্রদীপ চৌধুরী সিলেটের দত্তরাইল গ্রামের জমিদার পরিবারের সন্তান। ষাটের দশকে মুরারিচাঁদ কলেজে ছাত্র রাজনীতিও করেছেন। সেরকমই কোনো সংঘাতের জেরে পালিয়ে আসেন প্রথমে কাটাখালে, পরে শিলচরে। আত্মীয় বাড়িতে। কলকাতা গিয়ে মেডিক্যালে পড়েন, সেখানেও ছাত্ররাজনীতিতে জড়ান। ডাক্তারি শুরু করেন মালয়েশিয়াতে। সেখান থেকে ইউরোপ, কানাডা হয়ে আমেরিকা পৌঁছে থিতু হন। ডাক্তারির সঙ্গে চলে সম্পর্কিত বিচিত্র ব্যবসা। সারা বিশ্বে তাঁর বাণিজ্য ছড়িয়ে। ২০০৮এ কলকাতাতে প্রথম বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ। এখন শিলচরেও সেরকম কিছু করবার ইচ্ছে রাখেন।
প্রবাসীর বেশে কেন ফিরি হায় চির-জনমের ভিটাতে :
এর পরের আটটি নিবন্ধ নিয়ে আমরা খানিক বিস্তৃত কথা বলবো। কারণ এখানেই অরিজিৎ তাঁর মতো করে জেল কিংবা কাঁটাতারের জাল থেকে বেরোবার পথ সন্ধান করেছেন। যুদ্ধটার রণকৌশল বুঝবার চেষ্টা করেছেন। আমরাও আসলে তাই করব।
পঁচাশি বছরের বৃদ্ধ ভিখিরি বুলু শব্দকরের মৃত্যু শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পে হয়েছিল । হাইলাকান্দি জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামের মানুষ। ভিক্ষে করতে হাইলাকান্দি যাবার পথে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে হাজতে পুরে। বিদেশী বলে। সেই জেলেই তাঁর মৃত্যু হয় মাস কয় পরে। তাঁর শ্রাদ্ধের দিনেই হাইলাকান্দি জেলাতেই সেদিন প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী সভা। বছর দুই আগে সেরকমই এক নির্বাচনী সভাতে এসে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, আর কোনো অর্জুন নমঃশূদ্রকে মরতে হবে না। ডিটেনশন ক্যাম্প গুড়িয়ে দেবেন। অরিজিৎ লিখছেন, তিনি সভা সেরে যাবেন তো একবার বুলু শব্দকরের বাড়ি? “তিনি বিশ্ববিজয়ী বিরাট মানুষ, হোয়াইট হাউসে পা রাখলে স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট গুজরাটিতে সম্বোধন করেন---কেম ছ? তিনি ঠিক টের পেয়ে যাবেন খালপাড়ের এই বাড়িটাই সেই শ্রাদ্ধবাড়ি। তিনি নিশ্চয়ই সেখানে ঢুকে সন্তপ্ত–ত্রস্ত মানুষগুলোকে পরম মমতায় জিগ্যেস করবেন—কেম ছ?” (পৃ: ১৫৮) অধ্যায়টির নাম “কেম ছ?” একটি তীব্র শ্লেষ। এই শ্লেষ নিয়েই প্রবন্ধ, নিছক ‘গল্প’ নয়, আগেকারগুলোর মতো। শুধু প্রধানমন্ত্রী বা তার দলকে নিয়েই নয়। পূর্বোত্তরের কোনো সংবাদই তো জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রচার পায় না, জাতীয় নেতারা দৌড়ে আসেন না। বুলু শব্দকরও সংবাদ হন নি, জাতীয় নেতারা দৌড়ে আসেন নি, যেমন গিয়েছিলেন রোহিত ভেমুলার খবর নিতে।খবর নিতে যান নি স্থানীয় শাসকবিরোধী নেতারাও, লেখক বুদ্ধিজীবীরাও। লেখক যেন তাদের সবার কাছে প্রশ্ন রাখছেন, কেম ছ? তিনি অবশ্য আক্ষেপ করেছেন ‘এক মিনিট নীরবতা পালন’ না করবার জন্যে, লড়াইর ময়দানে নেমে না পড়বার আক্ষেপটা তো আমাদেরও মনে হচ্ছে দুঃস্বপ্ন মাত্র। অতএব যা হচ্ছে,“ দেশভাগ-অভিশপ্ত ছিন্নমূল বাঙালির এটা ললাটলিখন।” (পৃ:১৬১)
এই শ্লেষেরই সম্প্রসারণ ঘটেছে প্রদীপ পাল নিয়ে প্রবন্ধে। শিলচরের বিধায়কের ভাই। তাঁর এবং তাঁর স্ত্রীর নামে এসেছে বিদেশী নোটিশ। সুতরাং তিনি বললেন, ‘এর শেষ দেখে ছাড়ব’। তাঁর বিধায়ক ভাই “‘শীতঘুম’-এর যাবতীয় লেপকম্বল ছুঁড়ে ফেলে মুখ্যমন্ত্রীর চেম্বার থেকে রাজভবনে দৌড়ঝাঁপ করছেন।” (পৃ:১৬২) লেখক আশা করলেন, ‘শাপে বর হোক এই বিদেশী নোটিশ’। বুলু শব্দকরদের খবর কেউ না নিতে পারেন, বিধায়কের ভাইয়ের বেলা উলটো হতেই পারে বলে আশা করলেন। এমন কি সুচন্দ্রা গোস্বামীর বেলাও কেন বিধায়ক বললেন না, ‘এর শেষ দেখে ছাড়ব।’ ছুঁড়ে ফেললেন না ‘লেপকম্বল।’ সেই প্রশ্ন তুললেন। বিধায়ক এর মধ্যে রাজনৈতিক ঈর্ষার সন্ধান পেলেন। মনে হলো কংগ্রেস প্রশাসনকে ব্যবহার করে কাজটি করেছে। কিন্তু সেই একই অভিযোগ কেন এরা বুলু শব্দকর, জহির আলিদের বেলা করেন না সেই প্রশ্নতো উঠেই। ডিটেনশন ক্যাম্প গুড়িয়ে দেবার কথা তো স্বদলেরই কেন্দ্রীয় সরকারের দায় ছিল। গুড়িয়ে দিলেন না কেন? এমন কি তাঁর পাশে নিজের দলও দাঁড়ালো না প্রতিবাদে। ২০১৪র ভোটার তালিকাকে যখন এন আর সি নবায়নের নথি হিসেবে স্বীকৃতি দেবার দাবি কংগ্রেস তুলেছিল, তাঁর দল মুখ্যমন্ত্রীর কুশপুতুল পুড়িয়েছিল। প্রদীপ পালের কথা জেনে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, রাজ্যে যত ডি-ভোটার রয়েছেন তাদের ৯০%ই ভারতীয়, অথচ যারা বিদেশী নোটিশ দেয় সেই পুলিশের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয় না রাজ্য সরকার। সাংস্কৃতিক কর্মী, সুশীল সমাজও যথাসময়ে নীরব থাকে বলে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন লেখক। আশা করেছেন বিধায়কের ভাইকে কেন্দ্র করেই না হয় ‘তোলপাড় হোক’,‘উঠুক ঝড়’। আমরা জানি সেরকম কিছুই হয় নি। প্রদীপ বাবুরা ডিটেনশন ক্যাম্পে গেছেন বলেও কোনো খবর নেই, এবং তারা যথারীতি কথা রাখেন নি, ‘শেষ দেখে ছাড়বার’ কথা ছিল। শেষ এখনো কিছুই হয় নি।
কিন্তু সেই ‘শেষ দেখা’ যাবে কী করে? এই অব্দি তাঁর তাবৎ ক্ষেত্র সমীক্ষার, স্মৃতিকথার চরিত্রগুলো ছিল বরাক উপত্যকার। কিন্তু ‘শেষ দেখা’র কথাটি ভেবেছেন গোটা পূর্বোত্তর নিয়ে। ‘পূর্বোত্তরের বাঙালি ও একটি প্রত্যাহ্বান’-এ। গোটা পূর্বোত্তরে সংখ্যার বিচারে বাঙালিরাই। আর “শুধু বাংলাভাষী হওয়ার অভিশাপে, সবচেয়ে বেশি নিষ্পেষণের শিকার, এ কথা বললে কমই বলা হবে।” (পৃ:১৬৭) এই আক্ষেপটি সাধারণ বাঙালি মনে আছে। আক্ষেপটি বেশ জনপ্রিয়ও।কিন্তু আমরা ‘সবচে’ বেশি’ কথাটির সঙ্গে সহমত পোষণ করি না।
এই যে জুন, ২০১৮তে হঠাৎ করে দেখলাম দেড় শতক ধরে শিলং শহর সাফাই করবার কাজে নিয়োজিত দলিত শিখদের উচ্ছেদ করে মল বসাবার আগুন ঝরানো আয়োজন ---সেই সব আমাদের নজরে পড়ে না। আমাদের নজরে পড়ে না, যে বাঙালির এক বড় অংশ এক সময় ব্রিটিশ প্রশাসনের ছোটশরিক হয়ে এসেছিলেন। এবং ব্রিটিশ চলে যাবার সঙ্গে করে চলেও গেছিলেন। রেখে গেছিলেন অনেক করুণ স্মৃতি যা বাকি জনগোষ্ঠীগুলোর সমষ্টিগত স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে। তাদের জাতীয়তাবোধের উপাদান হয়েছে। তারা রেখে গেছেন স্মৃতি-ঐতিহ্য বাঙালি মনেও, যা স্বাধীনতা উত্তর দিনেও বাঙালি মধ্যবিত্ত অনুসরণ করে গেছেন। এমন কি বিশাল বাঙালি শ্রমিক-কৃষক শ্রেণিগুলোর মধ্যেও সেই স্মৃতি-ঐতিহ্যের অনেকটাই প্রবাহিত হয়েছে। অনেকেই এখনো জনজাতিদের ‘জঙ্গলি’ মনে করেন। যা গোপন করলে, সত্যি ‘প্রায়শ্চিত্ত’ না করলে আমরা ক্ষোভের প্রশমন করতে ব্যর্থ হবো।
এখন প্রশাসনে বাঙালির সেই আগেকার প্রতিপত্তি সেরকম নেই বটে, কিন্তু বাজারগুলোতে গেলেই দেখা যাবে মাড়োয়াড়ির ছোট শরিক এখনো বাঙালি। বাজারগুলোতে পাইকার মাড়োয়ারি, খুচরো ব্যবসায়ী বাঙালী। তার উপরে ডাক্তারি, ওকালতি, নার্সিং হোম, হোটেল বাণিজ্যে, চা-বাগানের চাকরিতে এবং মালিকানাতে, কেন্দ্র সরকারের চাকরিতেও বাঙালি জমিয়ে আছে। বাঙালি যে লড়ে না, বাঙালির স্বাধিকার এবং মর্যাদার দাবিতেও তার বড় কারণ এই বানিয়া মধ্যবিত্ত নিজের স্থিতাবস্থা রক্ষাতেই স্বার্থ খুঁজে। মানসিক শ্রমজীবীরা যে মধ্যবিত্ত শ্রেণিটি গড়ে তুলেন, তাদের সংখ্যার ক্রমাবনতি হয়েছে—কিছু আসাম আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে, বাকিটা বিশ্বায়নের ফলে। অবশিষ্ট যারা রয়েছেন তাঁদের বড় অংশই হয় এই বানিয়া পরিবার থেকে আসা নতুবা আত্মীয়তার সম্পর্কে বাঁধা। ফলে তাঁরাও বানিয়া-মধ্যবিত্ত শ্রেণি সংস্কার এবং চিন্তাতে আচ্ছন্ন। এই বানিয়াদের সঙ্গে মূলস্রোতের অসমিয়ার বণিক বা মালিক পক্ষের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও সেই সম্পর্ক মোটেও বৈরিতামূলক নয়। এমন কি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীৰ ভেতর থেকে উঠতি ব্যবসায়ী মধ্যবিত্তের সঙ্গেও নয়। এরা সবাই ভাষা-নৃগোষ্ঠীনির্বিশেষে সংগঠনগুলোকে চাঁদা দিয়ে নিরাপত্তা কিনে রাখেন। এমন কি নানা রঙের সন্ত্রাসবাদীদেরও। প্রকাশ্যে বাংলা গান গাইতে কোথাওবা কখনো বাধা পেতে পারেন বাঙালি। কিন্তু হরিনাম নিয়ে কোটি কোটি টাকা হরণ করে নিতে এই রাজ্যে কেউ কোনো বাঙালিকে সরাসরি বাধা দেয় না। বরং সহযোগিতাই করে। গতিকে খামোখা লড়ে নিজেদের বিপন্ন করবে কেন বাঙালি? নিচে থেকে নমশূদ্র চাষাভুষারাও যদি লড়ে , কিন্তু শিলাপাথারের মতো বিড়ম্বনা হয়-- এই বাঙালি বানিয়া-মধ্যবিত্ত তার শ্রেণি স্বার্থে সব সহজ ভাবে মেনে নেয়। যারা বাঙালি বলতে খুব আবেগিক তাদের দরকার নিজেদের শ্রেণি মিত্রদের এই স্বার্থটি বুঝে নেওয়া। নইলে চিরদিন হতাশার রোগে ভুগতে হবে।
সুতরাং একেবারে কারণ ছাড়া ‘শুধু বাংলাভাষী হওয়ার অভিশাপে’ -- বাঙালি নিষ্পেষণের শিকার হয় না। তার মানে এই নয় যে ক্ষোভের সব কারণ সঙ্গত -- অনেকটাই এখন জনগোষ্ঠীগুলোর নব্য-মধ্যবিত্তের গোষ্ঠী-জাতীয়তাবাদের ‘নির্মিত কারণ’। কিন্তু উলম্বে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এই নব্য-মধ্যবিত্ত সর্বত্র প্রথমে বাঙালিকেই দেখেন। সেই জন্যেই সংঘাতগুলো হয়। এবং অধিকাংশ সময় প্রত্যক্ষ মারগুলো পড়ে আনুভূমিক প্রতিদ্বন্দ্বী বাঙালি নিম্নবিত্ত শ্রেণিগুলোর উপরেই। মাড়োয়াড়ি হিম্মত সিংকা আর বাঙালি বড় আমলা রাকেশ পালের মতো ধনিকের উপরে মার ক্বচিৎ কদাচিৎ পড়ে। বাঙালি কালোকারবারীর মাসতুতো ভাইটি অবশ্যই এক অসমিয়া কালোকারবারী। সুতরাং তাদের নিরাপত্তা কেনা থাকে। মারপড়ে শ্রেণি-গত ভাবে যারা শ্রমিক-কৃষক, ছোট দোকানদার, কারিগর—তাদের উপর। কারণ এই সমাজ একদিকে সস্তা শ্রমিকের যোগান দার, সেই যোগান অব্যাহত থাকা দরকার। দরকষাকষি যাতে না করেন তার ব্যবস্থাও টিকিয়ে রাখা দরকার। অন্যদিকে এরা ভোটবেঙ্ক তথা সমর্থন ভিত্তি। সংখ্যাতে বেড়ে গেলে ধনিক শ্রেণি থেকে বাঙালি আইন-প্রণেতার সংখ্যাও বেড়ে যাবার ভয় থাকে। অসম আন্দোলনের শুরু হয়েছিল কোনো বাংলা মাধ্যমের স্কুল খুলবার জন্যে নয়, উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ভোটার তালিকাতে বাঙালির সংখ্যা বেড়ে যাবার আশঙ্কাকে সামনে রেখে। এখনো সব বিপত্তি এই কারণেই। এমন কি ডি-ভোটার তারাই হচ্ছেন, ডিটেনশন ক্যাম্পেও তারাই যাচ্ছেন। মূলত এরা কৈবর্ত, নমঃশূদ্র, মুসলমান, মুসলমানের মধ্যেও কিরান, মাইমাল, এবং চর অঞ্চলের মুসলমান—যাদের ঘর ভেসে যায় প্রতিবছরের বানে এবং নদীধ্বসে। তারা মার খেলেও বাঙালির উপরের শ্রেণিগুলোর কিছু যায় আসে না,তাদের লুণ্ঠনে বাধা পড়ে না—তারা অসমিয়া শ্রেণিমিত্রকে বাঁচিয়ে শত্রু সন্ধান করে বেড়ায় এবং করতে শেখায় মুসলমানে -- বললে কি কিছু ভুল বলা হবে? গেরুয়া ধ্বজাতে ‘পরিবর্তনে’র ঢেউ তুলা তাই সম্ভব হয়েছিল।
কিন্তু আনুভূমিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাতে বাঙালি ভিন্ন কেবল এই দলিত শিখদের উপরে নয়, মার পড়ে মণিপুরে নাগাদের উপরে, নাগাদের মার পড়ে কুকিদের উপর; মিজোদের মার পড়ে মাড়দের উপর, অরুণাচলে মার পড়ে চাকমাদের উপর। গোটা পূর্বোত্তরে হিন্দি তথা মাড়োয়ারি আধিপত্য বিরোধিতার মার পড়ে বিহারি হিন্দু মুসলমান শ্রমিকদের উপর। এমন আরো বহু মারামারির কাহিনিতে আফ্রিকার চেয়ে কম কিছু বিপন্ন নয় গোটা পূর্বোত্তর। আফ্রিকার রাজনীতিতে যেমন এদ্দিন নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিয়েছিল ইউরোপ,এখন ভারত –চিনও নাক গলাচ্ছে। সেরকম, পূর্বোত্তরের এই রাজনীতিতে জাতীয় শাসকশ্রেণির শাসন এবং শোষণ পদ্ধতি নিয়ে আমাদের ভাবনা ঢাকা পড়ে যায় ‘শুধু বাংলাভাষী হওয়ার অভিশাপে’ এই আখ্যানে।
তার উপরে যখন বাঙালি নিজেকে বেশি বেশি ভারতীয় ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী বলে দাবি করে, তখন নিজের অজ্ঞাতেই এবং অনিচ্ছেতেই হয়ে উঠে ‘ভারত রাষ্ট্র’ এবং ভারতীয় শাসক শ্রেণির প্রতিনিধি। সেনার শাসন যখন নামে তখনো বাঙালিকে তার প্রতিবাদে দেখা যায় না। বাঙালি মননের সেই সমস্যা, সেই জটিলতাকে উন্মোচন করেছিলেন মলয়কান্তি দে তাঁর কিছু গল্পে। এই মুহূর্তে আমাদের ‘আক্রান্ত’ গল্পটির কথা মনে পড়ছে। এই যে নিজেদের ‘ভারতীয় ঐতিহ্যের তথা সংস্কৃতির’ উত্তরাধিকারী বলে মনে করে—সেটিও কিন্তু চরিত্রগত ভাবে তত ‘ভারতীয়’ নয় যতটা মনে করা হয়। সেও আসলে ‘ছিন্নমূল হিন্দু বাঙালি’ পূর্বোত্তরীয় মানসিকতা। প্রতিনিয়ত যাকে বিদেশী, বা বহিরাগত বলে অপমান সইতে হয়--- সে যেন খানিক এগিয়ে গিয়েই নিজের এমন এক ‘দেশপ্রেমে’র ধারণা গড়ে তুলে যার সঙ্গে যে আলো হাওয়া রোদ্দুরে সে বাঁচে বাড়ে---সেখানকার বাকিদের ‘দেশপ্রেমে’র সঙ্গে খাপ খায় না বিশেষ। দেশের এই অংশকে সেই ছিন্নমূল বাঙালি চেনেও না বিশেষ। তাকে খিলঞ্জিয়া বা ভূমিপুত্র না বললে তার রাগ চড়ে। কিন্তু নিজে সে নিজেকে নির্বিকার ‘প্রবাসী’ বা ‘বহির্বঙ্গে’র মানুষ বলে দাবি করে। বস্তুত উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণিটি প্রথম সুযোগেই পশ্চিম বাংলাতে বা অন্যত্র চলে যাবার পথও করে রাখে। বিশেষ করে বৌদ্ধিক শ্রেণিটি। এই মানসিকতার সঙ্গে বাকি ভারতের বাঙালির মনন মেলেনা বলেই সেনাবাহিনী বিশেষ আইনের প্রতিবাদ পশ্চিম বাংলার বাঙালি যত করে, যত সেই নিয়ে গান বাঁধে, নাটক করে, কবিতা লেখে, লেখে উপন্যাস, তৈরি করে তথ্যচিত্র, পথে নেমেও সহমর্মিতা প্রকাশ করে—পূর্বোত্তরের অধিকাংশ বাঙালিকে সেইসবের ধারেকাছেও যেতে দেখা যায় না। এহেন ‘ভারতীয়’ মানসিকতা তথা দেশপ্রেম তাকে বাঙালি মুসলমান থেকেও পৃথক করে। সে যখন বলে বাংলাদেশে মুসলমানের মার খেয়ে তাকে আসতে হয়েছে, এসে ডি-ভোটার হতে হচ্ছে, ডিটেনশন ক্যাম্পে যেতে হচ্ছে -- তখন সে এই প্রশ্ন কিন্তু করে না---বাংলাদেশে কি মণিপুরি, সাঁওতালি, রাজবংশী আদি ছিল না? বা নেই? মুসলমানের মার খেয়ে তারা গেল কই? পুরো নিরুদ্দেশ? ডি-ভোটার তারা হয় না কেন? ডিটেনশন ক্যাম্পে পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে যায় না কেন? অরিজিৎ আদিত্য কিন্তু একজনও অবাঙালির গল্প শোনালেন না। তাঁর উপায় ছিল না শুনাবার। দেশ ছেড়ে আসা অবাঙালি থাকলে তবে তো। তাদের কাছে তো এই দেশও যা , সেই দেশও তাই। সর্বত্র সংখ্যালঘু। ধর্মের বাধনে বাঁধা পড়বেন কেন? এবং এখন যখন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে আসামের রাজনীতি সরগরম---তখনো বিলে যদিও বলা হয়েছে আফগানিস্তান থেকে বাংলাদেশের তাবৎ অমুসলমানদের কথা, একে পুরোপুরি ‘হিন্দু বাঙালির বিষয়’ কেবল অসমিয়ারাই বানান নি, হিন্দু বাঙালি নিজেও বানিয়েছেন। এবং তাতে মার্ক্স থেকে মাও পড়া অসমিয়াতো আছেনই, বাঙালিও আছেন। মুসলমান তো হিসেব থেকে বাদ পড়েছেনই, অবাঙালি হিন্দুরাও বাদ পড়েছেন। খণ্ডিত কেবল দেশ হয় নি, হয়েছে ‘দেশপ্রেম’ও। তা নইলে গোটা পূর্বোত্তরে সংখ্যাগরিষ্ঠ যে বাঙালি সে অন্যের সমানে নিজের জন্যে বিকল্প ব্যবস্থা করতে পারত। কিন্তু করেনি। রাজ্যগুলো যখন বৃহত্তর আসাম থেকে ভেঙ্গে বেরিয়ে যাচ্ছিল, এবং এখনো যাবার সম্ভাবনাতে ধুকছে, সে তার চাপা উল্লাস গোপন রাখতে পারেনি। অথচ, ধরতেও পারছে না, আক্ষরিক অর্থেই ‘আহ্লাদে আটখানা’ হয়ে আছে ‘দেশপ্রেমী’ক পূর্বোত্তরীয় বাঙালি। বুদ্ধিতে এতোটাই বিপর্যস্ত সেই ‘ভারতীয় বাঙালি’ নির্বিকার বলেন, ‘অসমিয়ারা নির্বোধ! টের পাবেন যখন মুসলমানে দেশ নেবে।’ সে জন্যেই ডিমাপুরে যখন করিমগঞ্জের এক মুসলমান যুবককে প্রকাশ্য রাজপথে জেল ভেঙ্গে বের করে এনে ন্যাংটো করে খুন করা হলো অধিকাংশ ‘ভারতীয় বাঙালি’ নীরব রইলেন। অরিজিৎ লিখেছেন,“নিহত যুবক মুসলিম বলে হিন্দু বাঙালি যদি নিজেদের নিরাপদ নিশ্চিত বোধ করেন, তাহলে বলব তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন।”(পৃ:১৬৭) কিন্তু এমন ‘স্বর্গবাসী’ বাঙালিও আছেন। আছেন বলেই লিখেছেন। সেই ঘটনার পরেই প্রকাশিত ‘প্রতিস্রোত’ কাগজের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল সঙ্ঘ দীর্ঘদিন এই পাহাড়ি রাজ্যে এমন পরিবেশ গড়ে তুলেছে, মুসলমান ঘৃণার পরিবেশ। আর তাতে মূল সংগঠক গেছিলেন লামডিং থেকে এক বাঙালি। ‘ভারতীয়তা’র চরম রূপ এটাই। এরা ‘ভারতীয়তা’তে আচ্ছন্ন নব্য নাগা। এর মধ্যে শ্রেণি সম্পর্কের এক জটিল সমীকরণও রয়েছে। কল্পনা করুন, এক নাগা যিনি ‘নাগালিম’ দাবি করেন তিনি---দেশদ্রোহী। আরেক নাগা—বা একই নাগা দুই ভিন্ন সময়ে ‘বাংলাদেশী’ দমাতে চান---তিনি ‘দেশপ্রেমী’। তাকে কেউ সেনা দিয়ে দমাবার কথা বলে না।
তিনি সত্য লিখেছেন ভাষিক সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যগঠন হলেও অসমের ক্ষেত্রে এই ভিত্তি এক ভ্রান্তির উপরে দাঁড়িয়ে আছে। যে ভাষাগোষ্ঠীকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে মনে হয়, বাকিদের একত্রে ধরলে তারা কিন্তু তা নন। এটি প্রদেশের অঞ্চলগুলোর বেলাও সত্য-- কার্বি আংলঙে, বডোল্যাণ্ডে। অথচ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতা কুক্ষিগত হয় এই সংখ্যাগরিষ্ঠেরই হাতে। একে আমরা নাম দিতে পারি ‘সংখ্যালঘু হয়েও সংখ্যাগুরুর ক্ষমতা ভোগ’। “ফলে নিরন্তর এক টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়, যে টানাপোড়েনকে কেন্দ্র করেই অসমের রাজনীতির গতি প্রকৃতি নির্ধারণ হয়।” (পৃ:১৬৮) এখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে কাঠামোগতভাবে সংখ্যালঘু অধিকারের সাংবিধানিক সুরক্ষার প্রশ্ন। এবং তা ধর্মীয় সংখ্যালঘু সহ। যা নিয়ে কিনা বাঙালি হিন্দুও ভাবতে প্রস্তুত নয়। এরাও কিন্তু কোথাও একক সংখ্যাগুরু নন, বরাকউপত্যকাতেও নন। সেখানেও মুসলমানকে নিয়েই বাঙালি একক সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু সেই মুসলমানের সঙ্গেও আছে তার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, শরিক করে নিতে দ্বিধা। সেই সুরক্ষা আসতে পারে নানারকম স্বায়ত্তশাসন, সংরক্ষণ, সমান প্রতিনিধিত্বের ভাবনাকে নিয়ে এগোলে। কিন্তু বাঙালি হিন্দু, বিশেষ করে বর্ণহিন্দু---চিরদিন এই সবকে সাম্প্রদায়িকতা বা বিচ্ছিন্নতা বলে ভেবে এসেছে এবং প্রতিরোধ করে এসেছে। থেকেই এটা করতে সে অভ্যস্ত হয়ে এসেছে অবিভক্ত ভারতের দিনগুলো থেকেই। স্মরণ করুন পুনা চুক্তি, সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ নিয়ে তাবৎ বাঙালি হিন্দু জমিদার শ্রেণিটির প্রতিক্রিয়া। শ্রেণি-বর্ণ স্বার্থ ছাড়া কোনোদিনই এরা ‘সাম্প্রদায়িকতা’র বিরোধী হন নি। যাই হোক, অরিজিৎকেই প্রথম দেখলাম, অসমের মুসলমানের একাংশ যে নিজেদের মাতৃভাষা ‘অহম্যা’ লিখিয়েছেন—তাকে ধর্মীয় মৌলবাদ বা হিন্দু বাঙালির বিরুদ্ধে করা ষড়যন্ত্র হিসেবে নয়---দেখেছেন ‘জনবিন্যাস কেন্দ্রিক কুটিল রাজনীতি’র বাধ্যবাধকতা হিসেবে। এবং এই সত্যও আবিষ্কার করতে সমর্থ হয়েছেন যে “বাঙালি মুসলমানেরা এখন নিজেদের রাজনৈতিক মঞ্চের সন্ধান পেয়েছেন, ফলে এখন তাঁরা আবার নিজেদের মাতৃভাষা বাংলা লেখাতে উৎসুক।” (পৃ:১৬৮) কথাটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ। ধর্মীয় পরিচিতি নিয়ে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার প্রয়াস তাকে ভাষাগতভাবে ঐক্যের পথে নিয়ে আসবার প্রবণতা দেখাচ্ছে, তাকে মূলে ফিরতে সাহস যোগাচ্ছে। যে কোনো সম্প্রদায়ের কাছেই এই দুই পরিচিতিই তো সমান সত্য। একটিকে বাদ দিয়ে আরটি হয় না। আমাদের ‘হোক’ বলে চাওয়াটাই যত বিপত্তির মূলে। সম্প্রতি ৬ ও ৭ জুলাই,১৮ ‘আমার অসমে’ ফণীন্দ্র কুমার দেবচৌধুরী উত্তর সম্পাদকীয়তে লিখেছেন তাঁদের স্বাভাবিক পছন্দের অধিকার থাকা দরকার। এমনি যদি কোনোদিন বলেন, তাদের ভাষা ‘মিঞা ভাষা’ তাতেও আপত্তি থাকা উচিত নয়। ভাষা এক হলেই যে কোনো পক্ষ ধর্মকে ছাড়বেন না, সেতো ব্রহ্মপুত্রের অসমিয়া বাদ দিলেও বরাকের বাঙালি জীবনেই দেখা যাচ্ছে। কোনো পক্ষই ‘ধর্ম’কে ছাড়ে নি--- এমন কি নাস্তিকেরাও না। গোটা অসম তথা পূর্বোত্তরের গেরুয়াকরণ আর কীই বা প্রমাণ করে? ধর্ম-পরিচয় ছাড়াটা অসম্ভব---যখন শাসক শ্রেণি ধর্মকেও ‘অবধারিতভাবে পিষ্ট’ করে। ৯জুন, ২০১৮তে অসমিয়া নিয়মিয়া বার্তাতে দেখা গেল অসম সরকারের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীও বলছেন, ‘বাংলাদেশী’ মুসলমানেরা নিজেদের মাতৃভাষা বাংলা লিখছেন। তাঁর ইঙ্গিত -- এসব বাংলাদেশী ষড়যন্ত্র। স্বাভাবিকভাবেই এক মুসলমানকে মনে রাখতে হয় তাঁর ধর্ম পরিচয়। এবং ভাষা পরিচয় ঘোষণা করতে হলেও হচ্ছে সতর্কতার সঙ্গে এবং চুপি চুপি। অরিজিৎ তথ্য দিয়ে দেখিয়েছেন, আদমসুমারিতে ১৯৯১তে যেখানে রাজ্যে অসমিয়া জনসংখ্যা ছিল ৫৭.৮১ শতাংশ ২০০১এ সেখানে সংখ্যাটি কমে দাঁড়িয়েছে ৪৮.৮০%। তার বিপরীতে বাঙালি জনসংখ্যা ২১.৬৭ % থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭.৫৮। তিনি অনুমান করেছেন এটা হয়েছে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মুসলমানদের এক অংশ বাংলায় ফিরে আসছেন বলেই। এই পরিস্থিতি যে আশঙ্কা বা উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে তাতেই সম্প্রতি ‘খিলঞ্জিয়া’ বা ‘অসমিয়া’র সংজ্ঞা নির্ধারণে অসমীয়া পক্ষ সক্রিয় হয়ে উঠেছেন বলে তাঁর অভিমত। এই বৃদ্ধিকেই এখন ‘নাগরিক বিল’ বিরোধীরা ব্যাখ্যা করছেন বাংলাদেশ থেকে হিন্দু বাঙালি চলে আসবার তত্ত্ব হিসেবে। যে তত্ত্ব এতোদিন হিন্দুত্ববাদীরা প্রচার করতেন, এবং বাঙালি হিন্দু সেই প্রচারে সোৎসাহে যোগ দিতেন। এখন সেই গেরুয়া শিবির একদিকে বাংলাদেশে হিন্দু টিকতে পারছেন না বলে প্রচার দিচ্ছেন, অন্যদিকে অসমে হিন্দু চলে আসবার তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করছেন--- এই বিপরীত অবস্থানকে মেলানো কঠিন। তাদের ‘শাকদিয়ে মাছ ঢাকবার’ অক্ষমতা করুণভাবে সামনে চলে আসছে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি হিন্দুর গেরুয়া অংশটির মধ্যে হঠাৎ করে নিজেদের ‘অসমিয়া বাঙালি’ বলে প্রচার দেবার উৎসাহকেও সম্ভবত এইভাবেই ব্যাখ্যা করা চলে। এমন কি সম্প্রতি সুকুমার বিশ্বাস বলে এক ‘বাঙালি’ নেতা এক টিভি চ্যানেলে ষাটের ভাষা আন্দোলনকেও বরাকের মুসলমানদের কাজ বলে চিহ্নিত করেছিলেন।মুসলমানদের অসমিয়া বলে আদমসুমারিতে লেখাতে হবে---এমন দাবি বদরুদ্দিন আজমল করাতে বহু বাঙালিই তাঁর নিন্দে মন্দ করেছেন। কিন্তু অরিজিৎ দেখেন বিষয়টি অন্যচোখে, একেই সম্ভবত ‘দেখা’ বলে, “ এই প্রেক্ষাপটে সুগন্ধী ব্যারন মৌলানার রাজনৈতিক মঞ্চে সমবেত হলেন বাঙালি মুসলমানরা। বিজেপি-পরবর্তী সময়ে এ ছাড়া হয়তো তাঁদের সামনে আর কোনও বিকল্প পথও ছিল না।” (পৃ:১৬৮) ফলে যে ‘মেরুকরণ’ আরো তীব্র হয়েছে সেই কথাও তিনি লিখছেন। এহেন পারস্পরিক অবিশ্বাসজনিত “মেরুকরণ সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাংলাভাষীদের এক প্রত্যাহ্বানের মুখে ঠেলে দিয়েছে।” (পৃ:১৬৮)
অরিজিৎ ব্রহ্মপুত্রেও কাটিয়েছেন দীর্ঘদিন। এখানকার জনজীবনকে দেখেছেন কাছে থেকে। ফলে বরাকে ব্রহ্মপুত্রেও বাঙালি জীবনের বৈচিত্র্যকে তিনি বোঝেন ভেতর থেকে। আশির দশকের মতো দমবন্ধ পরিস্থিতি না থাকলেও, “বাংলা সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে ব্রহ্মপুত্রে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক বাধা ক্রিয়াশীল থাকে। অপ্রাসঙ্গিকভাবে হলেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিহু নৃত্য বা রাভা সঙ্গীতের সংযোজন ঘটান আয়োজকেরা। এটাই সংখ্যালঘু মনস্তত্ত্ব।” (পৃ:১৭০) বিপরীতে বরাক উপত্যকাতে সাংস্কৃতিক মঞ্চে হিন্দু মুসলমানে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে দেখা গেলেও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে সেরকম দৃশ্য বিরল। রাজনৈতিক ভাবে অনেকে বাঙালি বা বাঙালি মুসলমান হয়ে উঠলেও সাংস্কৃতিক চর্চার ক্ষেত্রে তাঁদের দ্বিধা প্রবল এবং ‘অসমিয়া প্রভু’দের বিরাগভাজন হবার শঙ্কা অনেক গভীরে ছড়িয়ে আছে। আরেকটি দিকও অবশ্য লক্ষণীয়, যেটি হয়তো অরিজিৎ পরিসরের জন্যে এড়িয়ে গেছেন---সে হলো আবশ্যিক ভাবে বাংলা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের একটি বাহ্যিক হিন্দু রূপ দেওয়া। বহু বার্ষিক অনুষ্ঠানাদিতে যেখানে সহজেই সরস্বতী বন্দনার মতো হিন্দু ধর্মীয় রীতিনীতি এড়িয়ে চলা যায় সেখানে সেই সব নির্বিকার অনুসরণ করা হয়। যেন ধরেই নেওয়া হয় সাংস্কৃতিক কর্মীরা অনিবার্যভাবেই বিশ্বাসী হিন্দু। অথচ, দুনিয়া জুড়ে পঁচিশ কোটি বাঙালির সাংস্কৃতিক বৌদ্ধিক কর্মীদের খবর নিলে দেখা যাবে হিন্দুতে-মুসলমানে নাস্তিকদের সংখ্যাটি মোটেও ছোটখাটো নয়। অথচ এমন বহু অসমিয়া অনুষ্ঠানাদি রয়েছে, যেখানে সেসব মোটেও হয় না। এই যেমন তিনসুকিয়াতেই রয়েছে তিনসুকিয়া ম্যুজিক কলেজ, যার সামনে সরস্বতীর বিশাল মূর্তি বসাবার আয়োজন চলছে। অথচ বহু পুরোনো বিষ্ণুজ্যোতি সাংস্কৃতিক সমাজের সামনে রয়েছে জ্যোতিপ্রসাদের মূর্তি, গেটে রয়েছে জ্যোতিপ্রসাদ –বিষ্ণুরাভা দু’জনেরই দেয়ালে খোদাই চিত্র। বাঙালি রবীন্দ্র-নজরুলের কথাও সেরকম ক্ষেত্রে ভাবতে পারে না!
বরাকে যেখানে একাধিক বাংলা কাগজ রয়েছে, ব্রহ্মপুত্রে সেখানে একটিই। অনেকগুলোই বেরিয়েছিল যদিও পাঠক নেন নি নানা কারণে। অসমিয়া কাগজেও বাঙালি জীবনের সংকট সমস্যাদির কথা আসেই না। এসব অরিজিৎ লিখেছেন। কিন্তু আমাদের মনে হয়েছে, বাঙালি মননকে বরাকে যে তর্ক বিতর্কগুলো সমৃদ্ধ করে ব্রহ্মপুত্রে তাও হয়ে না উঠবার এও এক বড় কারণ। নাগরিক বিল, ডি-ভোটার ইত্যাদি প্রশ্নে বাকি বাঙালী কী ভাবছেন—বা সমস্যাটি আদৌ কতটা গভীর সেসব প্রশ্নে তাদের তো ভাববারই সুযোগ নেই বাংলা কাগজ কিংবা সংবাদ পত্রের অভাবে। তাদের সিংহভাগের ভরসা যতটা জানায় অসমিয়া কাগজ আর বাকিটা জনশ্রুতি। এক বিশাল জনসংখ্যা এমন আরো বহু কারণে বৌদ্ধিকভাবেই ক্রমাবনতির শিকার হচ্ছেন।
আপনার যারা আছে চারি ভিতে পারি নি তাদের আপন করিতে :
এর থেকে বেরোবার পথ কী? তিনি দু’টি পথের সন্ধান দিয়েছেন। আমাদের গুরুত্ব দিয়ে---সেই নিয়ে ভাবা দরকার। এক,অসমের বহুভাষিক প্রাদেশিক পরিচিতিকে বাকি সবারও মেনে নেওয়া দরকার। এবং বাংলাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় পরিচিতির ঊর্ধ্বে উঠে ভাষিক স্বতন্ত্রতার নিরিখে বাঙালিকে আত্মপরিচয় নির্মাণ করতে হবে। বাঙালিকে হিন্দু মুসলমান পরিচিতি তথা দুই পৃথক জাতি, এই ধারণা ছেড়ে এক রাজনৈতিক মঞ্চে আসতে হবে। সেখানেই তিনি লিখেছেন, এ যাবত মুসলমানের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক মঞ্চের বাধ্যবাধকতা মেনে নিয়েও, “কোনো আলখাল্লাধারী মওলানার নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক মঞ্চ নয়, বাঙালির প্রয়োজন একটি নিখাদ বাঙালির রাজনৈতিক মঞ্চ।”(পৃ:১৭১) কাঁঠালের আমসত্ত্ব বলে মনে হলেও অসমে বাঙালিকে এই পথেই হাঁটতে হবে। সম্প্রতি বঙ্গাইগাঁওতে এক সমাবেশে দুই এক বক্তা প্রায় একই রকম কথা বলে বিপদে পড়েছেন। কেন বিপদে পড়লেন, সেও এক অন্য প্রশ্ন। বাঙালি হিন্দুর দল কিন্তু ২০১৬তে অসমের নির্বাচনে একটি দেখা গেছিল। ভারতীয় গণপরিষদ নামে। দলটি এখনো আছে।কিন্তু অরিজিতের প্রস্তাবটি তার থেকে ভিন্ন। তিনি মুসলমানকেও সঙ্গে নেবার কথা লিখেছেন। সেরকম হিন্দু-মুসলমান বাঙালি ঐক্যের কথা আজকালে লিখে অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্যও উগ্র-অসমিয়া জাতীয়তাবাদীদের থেকে তো অবশ্যই, বহু ‘বাম-গণতান্ত্রিক’ অসমিয়ারও সমালোচনার পাত্র হয়েছেন। হয়েছেন বলেই স্বপ্ন দেখা যাবে না, এমনটি আমরা বলি না। কিন্তু সমস্যা আছে।
ধরে নেওয়া যাক, আমরা তাঁর সঙ্গে সহমত। আসলে এ কোনো দুই ভিন্ন পথও নয়। স্বপ্ন নিশ্চয় প্রতিজন বাঙালির প্রথমটাই। ধরে নেয়া যাক, এ দূরগামী স্বপ্ন। সে যদি অন্যে করে দেয়, তবে আর বাঙালির কিছুই না করলেও চলে। করবে না বলেই দ্বিতীয় পথের কথা। অর্থাৎ দ্বিতীয় পথ থেকেই প্রথম পথে পৌঁছুতে হবে। কিন্তু সেই পথও তো ধরছে না কেউ। বরং বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ ভাষাপরিচয়কে ধরে রাজনৈতিক –সামাজিক তথা সাংস্কৃতিক মঞ্চের কথা যারা অন্তত বরাক উপত্যকাতেও বলে এসেছেন ,যাদের এক বড় অংশ চিরদিন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিরা অসমিয়া হয়ে গেছেন, বা তাঁবেদারি করছেন বলে নিন্দে মন্দ করে এসেছেন, মুসলমান অংশকে তো ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলেই গবেষণা নিবন্ধই লিখে এসেছেন—তাঁদের কাউকে কাউকে দেখা গেছে দেশভাগ নিয়ে তথাগত রায়ের বই উন্মোচনের সভাতে সরাসরি হিন্দুর হয়ে কথা বললে কেন ‘সাম্প্রদায়িক’তা হবে—এই প্রশ্ন করেই ফেলেছেন! সেই তথাগত, যিনি ব্রহ্মপুত্রে এসে বাঙালি হিন্দুদের পরামর্শই দিয়ে ফেললেন,মাতৃভাষা অসমিয়া বলে লেখাবার জন্যে।আর এখন নাগরিক আইন সংশোধনী বিলের উপরে আস্থা জানিয়ে অনেকেই গেরুয়া শিবিরের দিকে হেলে পড়েছেন। ভাবে মনে হবে তারা অসমের মুসলমান বাঙালির তো বটেই, হিন্দু বাঙালিরও দুর্দশা ভুলেই বসে আছেন। সুকুমার বিশ্বাসের কথা লিখলামই। তিনি তো বলেই ফেললেন, অসমের বাংলা ভাষা আন্দোলন তো করেছেন বরাকের মানুষ, ব্রহ্মপুত্রের মানুষ তো বাংলা কাকে বলে চেনেই না। বরাকেও সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন মইনুল হক চৌধুরী। অর্থাৎ বাংলা নিয়ে ভাবা ব্যাপারের পুরোটাই একটি মুসলমানি ষড়যন্ত্র। বাঙালির বৌদ্ধিক পতনও তাতে স্পষ্ট বোঝা যায়। ইতিমধ্যে আমরা দেখিয়ে এসেছি, এমন ভাবনাতে তিনি আর এখন একক নন। বহু ‘বামে’রও এই বিচ্যুতি স্পষ্ট, ঠিক যেমন অসম আন্দোলনের বিরোধিতা করে অত্যাচারিত বহু অসমিয়া বামও এখন ‘দ্বিতীয় অসম আন্দোলনে’র নেতৃত্ব নিতে উদগ্রীব। যদি একা পড়ে গেছেন দু’দিকেই তবে সে বাঙালি কিংবা বাংলা মূলের মুসলমানই। যাদের যেকোনো স্বতন্ত্র উদ্যোগকে চিরদিন ‘মৌলবাদ’ বলেই নিন্দে করে আসা হয়েছে দুই দিকেই, দুই ভাষাতেই। বাংলাতেও,অসমিয়াতেও। তারা দুই দিকেরই কোনো আন্দোলনেই পথে নামেন নি। বিলের পক্ষেও নন, তো বিরুদ্ধেও না। এই অবস্থাতে তারও আগেকার তৃতীয় আরেকটি পথের কথা ভাবতেই হয়। আমরা নিজেদের কথা লিখব। তার আগে দেখে নিই, অরিজিৎ আর কী লিখছেন?
তিনি স্পষ্ট দেখেন, “উপসংহারটা এই---নরেন্দ্র মোদি সরকারের বহু বিজ্ঞাপিত ও ততোধিক বিতর্কিত রাজপত্র বা নোটিফিকেশনে বাঙালি হিন্দুর আহ্লাদিত হওয়ার কিছু নেই।” (পৃ: ১৭২) পরের অধ্যায়ের নাম ‘অস্পষ্টতার রাজনীতি’। শুরুটা সেই তীক্ষ্ণ শ্লেষে, “শুধু উপসংহারটাই স্পষ্ট।’ এতে বাঙালি হিন্দুর নাগরিকত্বের দাবির ‘দন্ত্য-ন’ টুকুও নেই। “বরং এমন প্রশ্নই অনিবার্যভাবে উঠে আসে যে---তা হলে ভোটের বাজারে বর্ণহিন্দু অসমিয়ার চিত্তজয়ের লক্ষ্যেই কি এই রাজপত্র? বর্ণহিন্দু অসমিয়া বা আরও নির্দিষ্টভাবে বললে অসমিয়া জাতীয়তাবাদী শক্তিকে কি রাজপত্র দুটো এই বার্তাই মূলত পৌঁছে দিচ্ছে না যে, দ্যাখো, ছিন্নমূল বাঙালি হিন্দুকে নাগরিকত্ব দেওয়ার ভাবনাই এই এন ডি এ সরকারের নেই।” (পৃ: ১৭২) যারা পাকিস্তান –বাংলাদেশ থেকে এই দেশে আসবেন,মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে তাদের কী হবে? নথিপত্র না থাকলে কী হবে? ডি-ভোটারদের কী হবে? ডিটেনশন ক্যাম্পে রয়েছেন যারা তাদের কী হবে? সেরকম বহুকথাই সেই ‘রাজপত্রে’ অস্পষ্ট। “...সরকার চাপা চাপা অস্পষ্টতা দিয়ে রাজপত্র দু’টোকে মোড়ে দিয়েছে। যে অস্পষ্টতার ফাঁকফোকর দিয়ে উঠে আসছে নানা প্রশ্ন, এবং যে- প্রশ্ন জারিত সংশয়কে ঘিরে অসমের রাজনীতি ফের আশির ধাঁচে উত্তাল হওয়ার দিকে এগিয়ে চলেছে।” (পৃ: ১৭২) অরিজিৎ ২০১৬র নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে সরাসরি কোনো কথা লেখেন নি। যদি লিখতেন, লিখতেন একই কথা---অনুমান করতে পারি। এক জায়গাতে শুধু পরে লিখেছেন, ৭১এর পরে আসা হিন্দুদের কথা মানবতার মাপদণ্ডে বিচার করা দরকার, আর বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের দরকার এর সমর্থন করে বাঙালি জাতিসত্তা নির্মাণে সদর্থক ভূমিকা নেবার। সেই নিয়ে পরে আবার আমরা ফিরব। কিন্তু আপাতত অরিজিৎ অনুমান করেছিলেন এমন এক রাজপত্রের পরে বাংলাদেশের মৌলবাদী শক্তির হাতে হিন্দু নির্যাতন বাড়বে। দেখা গেল বিল নিয়ে আসবার পর ২০১৬র জুনে বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা রানা দাশগুপ্তও একই কথা বললেন কাগজে বিবৃতি দিয়ে। বিবিসিও সেটি সংবাদ করছে। তিনি স্পষ্টই বলেছেন, “ এমন কোন সিদ্ধান্ত ভারতের নেয়া উচিত নয়, যা এদেশের সংখ্যালঘু নাগরিকদের দেশত্যাগে উৎসাহিত করবে।...“নাগরিকত্ব দেবার যে সিদ্ধান্ত তারা (ভারত) ঘোষণা করেছে – এ সিদ্ধান্তে আমরা ক্ষুব্ধ , আমরা বিচলিত।” ('ভারতের ঘোষণায় সংখ্যালঘু নির্যাতন বাড়বে';https://www.bbc.com/Bengali; ২৮ জুন, ২০১৬) এই রাজপত্রকে কেন্দ্র করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার কিছু বাঙালি হিন্দু সংগঠনের বিজয় মিছিল বের করাটা নিয়েও অরিজিৎ বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। এরা উগ্র-অসমীয়া জাতীয়তাবাদীদের সংগঠিত হবার সুযোগ করে দিয়েছেন মাত্র।
তিনি কিন্তু জাতীয়তাবাদীদের আশংকার জায়গাটিও বুঝতে চেয়েছেন। তাঁর প্রশ্ন, বাঙালি হিন্দু যদি অসমে জনগণনাতে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে আতঙ্কিত বোধ করতে পারে, তবে বাঙালির সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে তাদের আশঙ্কাকে অস্বীকার করবার আমাদের যুক্তি কী? এখানেও তিনি জনসংখ্যা নিয়ে আরো কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। বাঙালির জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেড়ে যাওয়ার জন্যে বাঙালি হিন্দুকেই দায়ী করবার আগে বডো ডিমাছা, কার্বি, সাঁওতাল আদি জনজাতিরা নিজেদের মাতৃভাষা কী লেখাতেন আর লেখাচ্ছেন সেই সব অনুসন্ধান করাও দরকার মনে করেছেন। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মুসলমানেরা কী লেখাচ্ছেন তারও সন্ধান জরুরি। ময়মনসিংহ মূলের মুসলমানেরা অসমিয়া লেখান বলে এযাবৎ আমরা বাংলা লেখালেখিতে ‘মৌলবাদী বিশ্বাসঘাতকতা’ বলেই নিন্দে মন্দ শুনে এসেছি। এই প্রথম দেখা গেল কেউ সহানুভূতির সঙ্গে সমস্যাটি দেখছেন। তিনি জাপানি গবেষক মেকিকো কিমোরা, যিনি নেলিতে ক্ষেত্র অনুসন্ধান করেছিলেন, তাঁর কথার উল্লেখ করে দুটি কারণের কথা উল্লেখ করছেন, ১)‘প্রভুত্ববাদী অসমিয়াদের রোষ’ প্রতিহত করার মতো শক্তি এবং ২) ‘অসমের সমস্ত মুসলমানকে একত্রিত করতে পারবার মতো সামর্থ্য’---মুসলমানেরা ‘এখনো’ জোটাতে পারেন নি বলেই তাঁরা নিজেদের অসমিয়া পরিচয় দিয়ে অসমিয়া সমাজে সামিল করে রেখেছেন। (পৃ: ১৭২) “অর্থাৎ এই সমন্বয় স্বাভাবিক নয়, কৃত্রিম।” (পৃ: ১৭২) সাম্প্রতিক জনগণনাতে মুসলমানের সংখ্যা বেড়েছে ৩.৩ %। সেই যুক্তিতে অসমিয়া সংখ্যা বাড়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটি তো কমেছে। সেখান থেকেই তাঁর প্রশ্ন, অসমীয়াদের আগেকার সংখ্যাগরিষ্ঠতাটা কি তবে কৃত্রিম? এ আই ডি ইউ এফের উত্থানে কি মুসলমানের যে শক্তি এবং সামর্থ্যের কথা মেকিকো লিখেছেন সেসব জুটে গেছে? এবং “ এই মুসলিমরা এখন তাঁদের মাতৃভাষা কী লেখান, এই সমীক্ষা হওয়া কি জরুরি নয়?”
সমীক্ষাটি করতে চাইলেই খুব সহজ নয়, বিশেষজ্ঞ হওয়া চাই। সম্প্রতি আদমশুমারির একটি ভাষা বিষয়ক প্রতিবেদন বেরিয়েছেও। আমরা সেটির প্রসঙ্গে না গেলেও কিছু অসুবিধে নেই। অরিজিৎ স্বয়ং কিছু বিস্তৃত অধ্যয়ন করেছেন এই অধ্যায়ে। এবং তাঁর সিদ্ধান্ত হলো মুক্তি যুদ্ধের পরে বাংলাদেশ থেকে হিন্দুর এই দেশে চলে আসার হার ক্রমাগত কমেছে। “এক কথায় একাত্তরের পর বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তু এ দেশে চলে এসেছেন বলে যে মিথ তৈরি করা হয়েছে, তা ঠিক নয়। কত শরণার্থী এসেছেন এর কোনও সঠিক হিসেব নেই।” (পৃ: ১৭৬) । তিনি সারা ভারতে শরণার্থী আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্ব সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাসের বক্তব্য তুলে ধরেছেন এইভাবে, “ ‘৭১এর পর বাংলাদেশ থেকে হিন্দু যাঁরা এ দেশে এসেছেন, তাঁদের খুব কম সংখ্যকই অসমে আশ্রয় নিয়েছেন, কারণ তাঁরা জানতেন অসমেও বাঙালিরা নিরাপদ নন, এদের একটা বড় অংশ উত্তর বঙ্গে আশ্রয় নিয়েছেন... পশ্চিম বঙ্গ বা স্বাধীন অসমে বাংলাদেশ থেকে মুসলিমদের আসার সংখ্যা নিতান্তই অল্প। ... গত পনেরো বছর ধরে বাঙালি হিন্দুরও পশ্চিম বঙ্গে অনুপ্রবেশের মাত্রা ব্যাপক হারে কমে গেছে।” (পৃ: ১৭৬) তথ্যগুলোকে অবিশ্বাস করবার আসলেই কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে দেড় কোটিরও বেশি বাঙালি হিন্দু আছেন, অসমে অসমিয়া জনসংখ্যার সমানে কিংবা বেশি। ব্যাপক হারে তাদের প্রব্রজন হলে অসমিয়াদের চিন্তার সঙ্গত কারণই আছে। কিন্তু গেল তিন দশকে আদালতে যত বিদেশী মামলা হয়েছে আর তার থেকে বিদেশী বলে যত রায় বেরিয়েছে, তার মোট সংখ্যাটাই এখনো লক্ষ ছড়ায় নি। এবং এদের ৭৫ শতাংশই বাঙালি হিন্দু। সুতরাং লাখে লাখে বাংলাদেশ থেকে লোক চলে আসবার তত্ত্বটি একেবারেই সত্য নয়, মুসলমান আসবার তত্ত্ব তো আরো না। বাংলাদেশ থেকে প্রব্রজনের তত্ত্বটিকে ঠিক এই পদ্ধতিতে খারিজ করবার ভাবনা এর আগে কেউ ভেবেছেন বলে আমরা দেখিনি। পদ্ধতিটি মৌলিক বলেই প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু বাঙালি হিন্দু অনুপ্রবেশের তত্ত্বটি অসমিয়ারা বিশ্বাস করেন, মুসলমান অনুপ্রবেশের তত্ত্ব অসমিয়া বাঙালি হিন্দু---দুই পক্ষই বিশ্বাস করেন। বিশ্বাসে মিলায় হরি, তর্কে বহুদূর—বিষয়টি এই পর্যায়েই গিয়ে পৌঁছেছে।
তার মানে রাজপত্র (বা আমরা এখন নাগরিক বিলও বলতে পারি) বাঙালি হিন্দুদের কিছু দিচ্ছে না, প্রব্রজিত হয়ে বাঙালি হিন্দু সংখ্যা বাড়াচ্ছে না। রাজনীতিতেও প্রত্যাহ্বান জানাচ্ছে না। অখিল গগৈ একটি হিসেব দিয়েছেন, অসমের ৪৭টি বিধান সভা কেন্দ্রে মুসলিমরা, ২৭টি বিধান সভা কেন্দ্রে বাঙালি হিন্দু আর মাত্র ৫২ কেন্দ্রে ভূমিপুত্ররা নির্ণায়ক শক্তি। অরিজিৎ হিসেব দিয়েছেন, একত্রিশ জন বাঙালি হিন্দু বিধায়ক রয়েছেন। কিন্তু মাত্র একজনকেই সিকি-মন্ত্রী হিসেবে রয়েছেন, তিনিও অপরাধী সংশ্রবে জেল খাটা জামিনে মুক্ত। “এটা ঘটনা,অসমে বাঙালি হিন্দুর কোনও রাজনৈতিক প্রত্যাশা নেই, সম্ভাবনা নেই, ভূমিকা নেই, কিস্যু নেই” (পৃ: ১৭৭) --- তাঁর তীব্র হতাশা এইভাবেই ব্যক্ত হয়েছে। অখিল গগৈর দেওয়া হিসেবেও হিন্দু-মুসলমানে মিলে গেলে বাঙালি ৭৪টি আসনে নির্ণায়ক শক্তি হতে পারে। হতে পারে না বলে ‘বর্ণহিন্দু অসমিয়ার কাছে বাঙালি হিন্দু স্রেফ আবর্জনা, ব্রাত্যজন। ভাষার ভিত্তিতে মুসলিম বাঙালির সঙ্গে একমঞ্চে আসার সম্ভাবনা কবেই শেষ হয়ে গেছে। এই বাঙালি হিন্দুকে খামোখা কেন যে ভয় পাচ্ছেন সমুজ্জ্বল-অখিল-প্রফুল্লরা, ভগবানই জানেন।” (পৃ: ১৭৭) এই তীক্ষ্ণ বাক্যবাণের লক্ষ্য তো অন্যদিকে নির্বোধ, অক্ষম বাঙালি হিন্দুই। এখন বিল-বিতর্কের আবহে যা আরো বেশি সত্য হয়ে সামনে আসছে।
কিন্তু একটি প্রশ্ন তো রইলই, অরিজিতের সেই দ্বিতীয় পথের কী হবে? মানে হিন্দু-মুসলমানে বাঙালি হিন্দুর এক মঞ্চে আসবার পথের? ‘ভগবান’ ই কি তৃতীয় পথ? অন্তত যে ‘শ্রেণিমিত্র’ তত্ত্বের কথা আমরা লিখে এলাম, তাদের উপরে ভরসা করলে কথাটি এরকমই। তারাই বাস্তবের ভগবান। আমরা আরো খানিক এগুবো। ‘সেতুর সন্ধানে দুটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে’ তাঁর হতাশোক্তির আরো বিস্তৃতি ঘটেছে। সেখানে তিনি হিন্দু মুসলমান, বরাক ব্রহ্মপুত্রের সম্পর্ক নিয়ে আরো খানিক এগিয়েছেন। মূলত আই এম ডি টি আইন বাতিল নিয়ে অবস্থান বিচার করতে গিয়ে। দুটি গল্প বলেছেন। শিলচরের এক প্রমোটার বন্ধু স্বপ্ন দেখছেন আই এম ডি টি আইন বাতিলের ফলে ব্রহ্মপুত্র থেকে তাড়া খেয়ে বাঙালি বরাকে চলে আসবে আর ফ্লেট ব্যবসার পোয়াবারো হবে। এর পেছনে অবশ্য কোনো যুক্তি নেই। তিনি শুনে থাকতে পারেন। কিন্তু এটি কোনো জনপ্রিয় আখ্যানের অংশ নয়। আরেক বন্ধু খুশ, এবারে ‘বাঙালরা বুঝবে ঠেলা!’ এটাই আসলে সারা আসামে জনপ্রিয় হিন্দু বাঙালি রাজনৈতিক আখ্যান। আর এস এস বিজেপিও এই কথা বলেই আইনটি বাতিল হলে বিজয়োৎসব করেছিল। এবং আশ্বাস দিয়েছিল হিন্দুদের কিছু হবে না। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে বাঙালি ‘জাতীয়’ সংগঠনগুলো আসুর সঙ্গে সেই বিজয়োৎসবে যোগ দিতে আমরা দেখেছি। তিনি বিজেপির কথা লিখেছেন, সেই সব সংগঠনের কথা লেখেন নি। ক্ষমতাতে না এসেই বিজেপি প্রচার দিচ্ছিল, “বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরা যেদিনই আসুক না কেন, তারা অনুপ্রবেশকারী নয়। তারা শরণার্থী। তাদের ভারতীয় হিসেবেই গণ্য করা হবে।” (পৃ: ১৮৭) ‘করতে হবে’ নয়, ‘করা হবে’। ঠিক এই ভাষাতেই এরা চার দশক ধরে প্রচারটি করে আসছিলেন। মানে নিজেরা ক্ষমতাতে এলে এটা করবেন। এইভাবে একটি আশা জাগিয়ে নিজেদের ক্ষমতা দখল সম্ভব করেছেন। এর আগে যখনই প্রশ্ন উঠেছে, বাঙালি হিন্দু তবে এতো ডি-ভোটার কেন, কেন বা যায় ডিটেনশন ক্যাম্পে?---তারা জবাব দিয়েছেন, ক্ষমতাতে এলে সেসব হবে না। অথচ, গেল চারবছরেও সেসব হচ্ছে। এই লেখাটি তৈরির সময়েও হচ্ছে।
শুধু হচ্ছেই নয়, বহু আগে থেকেই হাফিজ রশিদ চৌধুরীর মতো নাগরিক অধিকার সংগ্রামী বলছিলেন, আই এম ডি টি উঠে গেলে বেশি বিপদে পড়বেন বাঙালি হিন্দুরাই। কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈও বলেছিলেন, অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে বাঙালি হিন্দুই বেশি। শিলচরের সাংসদ বলেছিলেন ডি-ভোটারের সংখ্যা দেখেই মুখ্যমন্ত্রী সেসব বলেছিলেন। কিন্তু কথাগুলোতে কি কিছু ক্ষুণ্ণ হলেন অরিজিৎ? তিনি দেখলেন, “ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি মুসলমান নেতারা আসুর সঙ্গে সন্ধি করে নিচ্ছেন।” (পৃ: ১৮৭) ঘটনা মোটেও সেরকম ঘটেনি। অন্তত ঘটনার প্রধান স্রোত প্রবাহ কখনোই এমন ছিল না যে আসু “...সংখ্যালঘুদের আশ্বাস দিতে জেলায় জেলায় সদ্ভাবনা দিবস করে বেড়াচ্ছে।” (পৃ: ১৮৮) তখনো তিনি ইউ এম এফ-এ ছিলেন হাফিজ রশিদ, শিলচরে গিয়ে বলেছিলেন, ১৯৭১এর পরে আসা হিন্দুরা নির্যাতিত হয়েই এদেশে এসেছেন, তাদের জন্যে নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। হাফিজ রশিদকে পরে আমরা দল পাল্টাতে দেখেছি দু’বার কিন্তু বিদেশি প্রশ্নে স্থিতি পালটাতে দেখিনি। তবু যেন খানিক উষ্মার সঙ্গেই অরিজিতের প্রশ্ন—এই কথাগুলো কি তিনি ব্রহ্মপুত্রে গিয়ে বলতে পারবেন? আসু বা জমিয়তকে গিয়ে বোঝাতে পারবেন? প্রশ্ন হলো, তিনি একা কেন সেই দায়িত্ব নিতে যাবেন? অরিজিৎ এর পরে ইউ এম এফের প্রতিষ্ঠাপক নেতা গোলাম ওসমানীর কেবল মুসলমানের নেতা হয়ে উঠা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। ততদিনে আসলে তিনি কংগ্রেসেও চলে গেছিলেন। কিন্তু তার আগেই তো হিন্দু মুসলমানের এই যৌথ দল ছেড়ে হিন্দু নেতারা বিদায় নিয়েছিলেন--- কংগ্রেসে। অর্থাৎ কংগ্রেসে গিয়েই হিন্দুরা করছিলেন হিন্দু রাজনীতি---যেমন অর্ধেন্দু দে। মুসলমানেরা করছিলেন মুসলমানের রাজনীতি—যেমন গোলাম ওসমানী। কিন্তু অন্যদিকে আরেক ঘটনা ঘটছিল, আই এম ডি টি বাতিলের পরে পরেই আসলে ক্ষুব্ধ-ত্রস্ত মুসলমানদের নিয়ে আসরে দেখা দেন মৌলানা বদরুদ্দিন আজমল। মুসলমানের নেতা হিসেবেও গোলাম ওসমানী ততদিনে নিষ্প্রভ। আমাদের মনে পড়বে, শেষজীবনে তাঁর বহু করুণ কেচ্ছা সংবাদ পত্রের শিরোনামে যেভাবে বেরুচ্ছিল---তাতে তাঁকে এক বিয়োগান্তক নাটকের নায়ক বলেই তো মনে হয়। এই আই ডি ইউ এফ-এ প্রথমে হাফিজ রশিদও যোগ দিয়েছিলেন। পরে সম্ভবত তাঁর খানিক ‘বাম-সমাজবাদী’ ঝোঁকের জন্যে সেই দলও তিনি ত্যাগ করেন। এ আই ডি ইউ এফ-এরই শুধু জন্ম হয় নি। ২০০৮ থেকে ২০১২ বলতে গেলে একের পরে এক ঘটনাতে উত্তাল থেকেছে ভাটি অসম। এ আই ডি ইউ-এফের উত্থানে উৎসাহী হয়ে এক বিধায়ক ঘোষণা দিয়েছিলেন, মুসলমানেরা আবার বাংলাতে ফিরে আসতে চান। তারা সম্মেলন করবেন। উদালগুড়ি হত্যালীলা তাকে স্থগিত করে দেয়। ২০০৮এর অক্টোবরে গুয়াহাটি বঙ্গাইগাঁও ইত্যাদি শহরে ভয়াবহ বোমাবাজিতে বহু লোকের প্রাণ কেড়ে নেয় বডো উগ্রপন্থীরা। সারা রাজ্যে গুজব ছড়ায় এই সব বাংলাদেশীদের কাজ।--- আর ২০১২র কোকড়াঝাড়ের গণহত্যা এবং উচ্ছেদ অব্দি তা গড়িয়েছিল। তরুণ গগৈকে নির্বাচনে লড়তে গিয়ে বলতে হয়েছিল, Who is Badaruddin! সামান্য সম্ভাবনা দেখা গেলেই আসু হুঙ্কার ছেড়েছে, অসমে বাংলাদেশীকে মুখ্যমন্ত্রী হতে দেওয়া হবে না। এবং গেল লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে সেই সব হুঙ্কারই গিয়ে পরিণত হয়েছিল, শরাইঘাটের শেষ রণে। জাতি-মাটি-ভেটি রক্ষার আহ্বানে। সেই আহ্বান এতোই তীব্র ছিল যে উনিশের বরাক উপত্যকাও, বরাকেই মাটিতে এই সব স্লোগান তো বটেই, ‘জয় আই অসম’ স্লোগানও ‘ভারত মাতা কি জয়’-এর সঙ্গে সহ্য করে নিয়েছিল। সুতরাং মুসলমানের সঙ্গে আসু নেতারা, বা অসমিয়া মধ্যবিত্ত আঁতাত করে নিয়েছিলেন—এই তথ্য সত্য নয়। এমন কি এই সময়ে এন আর সি-র পাইলট প্রকল্পের বিরোধিতা করতে গিয়ে ২০১০এর ২১ জুলাই আমসুর চার তরুণ সদস্য মাজম আলি, মাইদুল ইসলাম মোল্লা, সিরাজুল হক এবং মতলেব আলি *
শহীদের মৃত্যু বরণ করেছিলেন। তাঁদের মৃত্যু গোটা এন আর সি প্রক্রিয়াকে হিন্দু বাঙালির জন্যেও সহজ করে দিল। তবু অসমিয়া সংবাদ মাধ্যম যখন বরপেটা কাণ্ড বলে এর নিন্দে মন্দ করে গেল, বাঙালি হিন্দু কিন্তু নীরব রইলেন। অথচ, এই পুরো সময়ে সব চাইতে বেশি---বিদেশী বলে আইনি জটাজালে জড়িয়েছেন বাঙালি হিন্দুই। এক কথাতে বলা চলে ব্যাপক সামাজিক রাজনৈতিক জটাজালে মুসলমানকে জড়ানো হলো, হিন্দু নীরব রইল। কোকড়াঝাড় গণহত্যার সময়ে যদিও কিছু কিছু সহানুভূতির ঢেউ উঠতে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু সেই ব্যতিক্রম বাদ দিলে মুসলমানের হেনস্তাতে হিন্দু রইলেন নীরব, অথচ ডি-ভোটার ইত্যাদি প্রশ্নে মুসলমান পক্ষ নিয়মিত লড়ে গেছেন। হতে পারে ব্যক্তিগত মামলা আদির ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে। এমন কি এন আর সি-র প্রশ্নে হিন্দু পক্ষ বলতে গেলে সরব হলেন কখন? ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৭তে যখন প্রথম খসড়াতে নাম কম এলো বরাক উপত্যকা এবং ভাটি অসমে। একমাত্র তখনি প্রথম বরাকে এমন গগণভেদী আওয়াজ উঠল যে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রীও গর্জে উঠলেন, আর অসমিয়া সংবাদ মাধ্যমও ক্ষোভের কারণ কিছু না বুঝেই প্রথম বারের মতো বরাকের লোকজনকে বলল, বাংলাদেশী পক্ষের হয়ে ষড়যন্ত্রকারী, এন আর সি বানচাল প্রয়াসী। এর আগে তাবৎ অপবাদই তো বদরুদ্দিন আজমল, তার দল আর আমসুর মতো সংগঠনগুলোর জন্যেই বরাদ্দ ছিল।
চার শহীদের নাম বেরোয় খুব কম কাগজে |
যাই হোক, তাতে অরিজিতের এই উপলব্ধি আরো বেশি সত্য প্রমাণিত হয়, “ ভাষা এক হলেও বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানের মধ্যে এখনও কোনও আত্মিক যোগাযোগ নেই। আমরা এখনও দুই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা, মাতৃভাষা আজও সেতুবন্ধনের কাজ করে উঠতে পারে নি। অবিশ্বাস, সন্দেহ, অশ্রদ্ধা এই বিচ্ছিন্নতাকে আরও নিটোল, আরও মজবুত করে তুলেছে।” (পৃ: ১৮৮) তাঁর স্পষ্টোক্তি “মহান একুশে আর মহান উনিশে নিয়ে কিছু বুদ্ধিজীবীর বাগাড়ম্বর নিছকই ভণ্ডামি। আঁতলামি।” (পৃ: ১৮৮)
সারা রাজ্যের সহযোগী ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতির দাবিতে ১৯৬১র আন্দোলন যখন বরাকের আঞ্চলিক ভাষার স্বীকৃতিতে থেমে গেল—তখন থেকেই এটা নিশ্চিত হয়ে গেল যে দুই উপত্যকার ভাগ্য দুই ভিন্ন পথে হাঁটবে। আরো একবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, হিন্দু-মুসলমানে দুই উপত্যকার বাঙালির এক মঞ্চে আসবার। সেটি ইউএম এফ রাজনৈতিক দলের জন্মের মধ্য দিয়ে। শুধু ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার থেকেই সতেরো জন বিধায়কের নির্বাচিত হওয়া মুখের কথা নয়। এমন কি সেবা সার্কুলার বিরোধী আন্দোলনে বাকি জনজাতিদের সঙ্গেও বাঙালি ঐক্য গড়ে উঠেছিল। সেই বৃত্তান্তের দিকে অরিজিৎ এগোন নি। ইউএম এফের উত্থানে শঙ্কিত উগ্রজাতীয়তাবাদীরা তার অন্যতম নেতৃত্ব কালীপদ সেনকে হত্যা করেছিল। বাঙালি তাঁকেও শহীদের মর্যাদা দেওয়া তো দূর, মনে রাখবারও দরকার মনে করে নি। এই নিয়ে আক্ষেপের কথা লিখেছেন অরিজিৎ। দুই উপত্যকার মানুষের সঙ্গে কাজ করেছিলেন, কার্বি সহ জনজাতি আন্দোলনের প্রতি সহমর্মী ছিলেন সাংবাদিক রবিজিৎ চৌধুরী। তাঁর স্মরণে শিলচরে অনুষ্ঠিত এক স্মরণ সভাতে অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বিদগ্ধ অধ্যাপক তথা লেখক গবেষক---যাদের বৌদ্ধিক নেতৃত্ব বললেই সঠিক বলা হয়—সেই তপোধীর ভট্টাচার্য এবং সুবীর করের বক্তব্য তুলে এনেছেন অরিজিৎ। তাতে বাঙালি মনন বোঝা যায়। রীতিমত প্রতিনিধিত্বমূলক। সভাতে সুবীর কর বললেন, কেবল বরাকের বাঙালি ঐক্যের কথা ভাবলেই চলবে না। ব্রহ্মপুত্রের কথাও ভাবতে হবে। সেই প্রসঙ্গেই সম্ভবত, তপোধীর ভট্টাচার্য ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি সম্পর্কে ‘গামোছা সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী’ বিশেষণটি ব্যবহার করেন। এটি বরাকে প্রচলিত একটি জনপ্রিয় বয়ান। বিশেষণের মানে হলো, এরা অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছেন, এদের সঙ্গে ‘ঐক্যে’র কথা বলে লাভ নেই। অরিজিৎ প্রশ্ন রেখেছেন একই কথা যার স্মরণে সেদিন সভা হচ্ছিল, সেই রবিজিৎ চৌধুরী সম্পর্কেও প্রযোজ্য কিনা। প্রযোজ্য কি না কালীপদ সেনকে নিয়েও। একই কথা অবশ্য মুসলমান সম্পর্কে বলতে গিয়ে বহু বিদগ্ধজনেও ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘মৌলবাদী’ বিশেষণগুলোও ব্যবহার করেন। অরিজিৎকেই দেখা গেল প্রথম সহানুভূতির সঙ্গে প্রশ্ন করছেন, তপোধীর কি “...লুইতপারের সেইসব বাঙালি মুসলমানের কথা বোঝাতে চেয়েছেন, যাঁরা পেট ও পিঠের তাগিদে সেন্সাসবাবুদের সামনে বলেন, ‘লিখ্যা লন আমরা অহম্যা।’” (পৃ: ১৯১) সুবীর বাবুও যে বাঙালির সঙ্গে ঐক্যের কথা বললেন, তারা কি হিন্দু না মুসলমান? সেই প্রশ্নও রেখেছেন। আমরা কিন্তু সম্প্রতি শিলচরে তথাগত রায়ের একটি অতি সাম্প্রদায়িক বই উন্মোচনের সভাতে সুবীর করের মনের কথাটি জেনে গেছি। এহ বাহ্য, অরিজিৎ ক্ষোভে জানিয়েছেন চিরিং চাপরি যুব মঞ্চ যখন উজান অসমে ব্যাপক ‘বাংলাদেশী’ বিতাড়নের অভিযান শুরু করেছিল বরাক উপত্যকার ভাষা শহীদ স্মরণের কোনো মঞ্চ থেকে কিন্তু প্রতিবাদ উঠে নি, নিদেন পক্ষে বুদ্ধিজীবীরাও টু শব্দটি করেন নি। “এই নির্লিপ্তির কারণ কি এটাই যে, উজান অসমের ওরা তো আসলে মুসলমান। বাঙালি নয়, ওরা তো আসলে ‘বঙ্গাল’।” (পৃ: ১৯২) তিনি অবশ্য ব্রহ্মপুত্রের বাঙালিরও বরাকের সিলেটিদের সম্পর্কে অবজ্ঞা, উপেক্ষা, এমন কি বিদ্বেষের কথারও উল্লেখ করেছেন। কোথাও তাঁর অভিজ্ঞতা সেরকম হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা বলে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনেও সিলেটিরা মোটেও ফেলনা নন---রীতিমত নেতৃত্বেই আছেন। আমাদের এক অসমিয়া বন্ধু একবার রসিকতা করে বলেছেন---হিন্দু কিংবা মুসলমান অসমে বাঙালির নেতৃত্ব সিলেটিই। মইনুল হক কিংবা গোলাম ওসমানী কিংবা হাফিজ রশিদ কিংবা বদরুদ্দিন আজমল। অর্ধেন্দু দে কিংবা শিলাদিত্য দেব সিলেটিই। সিলেটি অধ্যুষিত হোজাই জেলা তথা শহরকে বাদ দিয়ে এই মুহূর্তে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি রাজনীতির কথা ভাবাই যেতে পারে না। বৌদ্ধিক জগতেও সেই পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ, যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য, রাজমোহন নাথ, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ধারাবাহিকতা এখনো অটুট। নাম নাই বা নিলাম। সুতরাং সিলেটি বিদ্বেষের কথা আসে না। তবে ক্ষোভ একটি আছে। ব্রহ্মপুত্রের সমস্যা বরাক বোঝে না। রেলকলোনি এবং রেলশহরগুলোর আরেকটি সমস্যা আছে। রেলে সিলেটি বরাকউপত্যকাতেও সেরকম নেই। এদের প্রব্রজনের স্থান-কালের ইতিবৃত্তও ভিন্ন। মোটামুটি রেলকে ঘিরেই যেন এদের জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ। এরা মূলত কুমিল্লার মানুষ। কিছু চট্টগ্রাম-নোয়াখালি থেকেও এসেছিলেন সেই ব্রিটিশভারতেই রেলবসানোর সঙ্গে করে। চাবাগানে সম্ভবত বাংলাদেশ থেকে একটি মিশ্র প্রব্রজন ঘটেছে —এবং ঢাকা থেকেও অনেকে এসেছিলেন। সবাই রেলে বা চা-বাগানে চাকরি করতে নয়। ব্যবসা করতেও এসেছেন। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাজারগুলোতে সিলেটি প্রায় দেখাই যাবে না। ভাটি অসমে রংপুর দিনাজপুরের মানুষজনও দুর্লভ নন—যাদের অনেকেই এখন আর উত্তর-পশ্চিমবাংলার মানুষজন থেকে স্বতন্ত্র করা কঠিন। তাঁদের মনস্তত্ত্ব সিলেটি মনস্তত্ত্ব থেকে অনেকটাই স্বতন্ত্র। ইতিহাস স্বতন্ত্র বলেও। সিলেটকে নিয়ে যে ইতিহাসে বেশ ক’বার দোলনা দোলানো হয়েছে এবং শেষে সিলেট বিভাজিত হয়েছে, সেরকম অভিজ্ঞতা তাদের নেই। সিলেটের তবুও কিছুটা অসমে থেকেছে, তাদের সবটাই পাকিস্তানে চলে গেছে। তাদের একটি বড় অংশ কিন্তু শরণার্থীদেরও উত্তরসূরি নন। তাদের আসলেই বাংলা দেশে সব হারাবার স্মৃতি নেই, তার আগেই এখানে তাদের প্রাপ্তির ভাগটাও কম কিছু নয়। অসমে তারা কে কতটা প্রাচীন এই নিয়ে গৌরববোধও একটা কাজ করে। ফলে সিলেটি সত্তা তাদের কাছে একটি স্বতন্ত্র সত্তা।
মোটাদাগে সিলেটি ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণামুখী প্রবাহের পূব পাড়ের সব বাংলা ভাষাবৈচিত্র্যেরই সহোদরা। ‘শতায়ুর ইতি বক্তব্যে’, এদের সবারই দশা ‘হতায়ুর ইতি ভাষিনাম’---মানে, ‘স/শ’ কে এরা সবাই ‘হ’ উচ্চারণ করেন , এরা সবাই বাংলার অভিশ্রুতি নন, অপিনিহিতি পরিবারের সদস্য---মানে, কথা বলতে গিয়ে শব্দগুলোতে প্রায়ই একটি ‘ই’ নিয়ে এসে ঢিলেঢালা করে ফেলেন, এমন কি ময়মনসিঙহিরাও। তবু ওদিকে যেমন চট্টগ্রামী, এদিকে সেরকমই সিলেটিকে আলাদা করে চেনা যায়। ঢাকাইয়া আবার অভিজাত রাজধানীর ভাষা। যার কাছাকাছি উত্তরের ময়মনসিঙহি, দক্ষিণের কুমিল্লা। ফলে সিলেটি-চাঁটগাইয়া নিয়ে এদের হাসাহাসির একটি ব্যাপার মনে হয় খুব পুরোনো। অরিজিৎকে তাই শৈশবে যোরহাটের বন্ধুরা খেপাতো। এই খেপানোর জেরে তো চাঁটগেয়েরা নিজেদের ভাষা প্রায় ভুলেই গেছেন বলতে গেলে। ঢাকাইয়া-কুমিল্লা-ময়মনসিঙহি মিলে যে একটা মিশ্র কথ্যভাষা গড়ে উঠেছে তাবৎ রেলশহরগুলোতে, এবং তারই বিস্তারে গোটা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে সেইভাষাতেই তাঁরাও স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। এমন কি উজান অসমে সিলেটিরাও সেই টান এড়াতে পারেন না। এই ভাষার বৈচিত্র্য যে খুব একটা বড় সাংঘর্ষিক সমস্যা তৈরি করেছে, সেরকমটি মনে হয় না। তবে পরস্পর সম্পর্কে ঔদাসীন্য এবং সংযোগের সমস্যা তো তৈরি করে। সেরকম আরো কিছু শ্রেণি, গোষ্ঠী, এবং ইতিহাসের বৈচিত্র্যও সমস্যাকে জটিল করে রেখেছে। আমাদের অভিজ্ঞতাতে দেখেছি, শহরের বাঙালির গ্রামের বাঙালি সম্পর্কে বহু সময় কোনো সাধারণ জ্ঞানটুকুও নেই, এদের অস্তিত্ব সম্পর্কেও এরা জানেন না। ৮৩র আসাম আন্দোলনে যে অঞ্জন চক্রবর্তী, রবি মিত্র ছাড়াও কয়েক হাজার দলিত বাঙালি হিন্দু ব্রহ্মপুত্রের চর অঞ্চলে মারা গেছিলেন, গৃহহারা হয়েছিলেন—সেই সত্য তো বাঙালি হিন্দু বয়ানে একেবারেই অনুপস্থিত। অত সম্প্রতি আমাদের অসমিয়া বন্ধু দিগন্ত শর্মার বই ‘৮৩র অসমত নিপীড়িত বাঙালি’ না হলে তো আমাদের জানাই হতো না সেই সব সত্য। এবং সেরকম সমস্যা বরাক উপত্যকা সম্পর্কেও সত্য। ১৯৬১ বা ১৯৮৬র ভাষা আন্দোলনে---পুলিশের মার খেয়ে আন্দোলনকারীদের তাই গ্রামে গিয়ে লুকোবার জায়গাই ছিল না। অসমের বাঙালি মধ্যবিত্তের স্মৃতিতে গ্রামের কথা বিশেষ নেই, আছে শহর থেকে শহরান্তরের কথা---অরিজিতের স্মৃতিচারণাও তার থেকে ব্যতিক্রম নয়। এমনটি বাঘাবাঘা অসমিয়া ব্যক্তিত্বের জীবনে মিলবে না, তাদের প্রায় প্রত্যেকের একটি ‘নিশ্চিন্দিপুর’ রয়েছে। এদের প্রত্যেকের জীবনে কিছু ‘কাঠনিবারি ঘাটে’র স্মৃতি কথা রয়েছে। অসমের কোনো বাঙালি মুসলমানের সেই সমস্যা নেই, নেই প্রাচীন কাছাড়ি হিন্দুদেরও। নেই বহু দলিত মানুষেরও—কিন্তু তাদের থেকে তো উঠে আসা সেরকম মধ্যবিত্তও নেই।
যাই হোক, তাঁর এই সিদ্ধান্ত সঠিক যে “অসমের বাঙালির সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি-ই হচ্ছে, আত্মপরিচয়ের স্বরূপ ও সংজ্ঞা আজও নির্ধারণ করতে পারেনি তারা।” (পৃ: ১৯২) এর পরেই লিখেছেন, “আমরা আগে বাঙালি , নাকি আগে হিন্দু বা মুসলমান।” এই নিয়ে সমস্যা আছে। সমস্যা যে আছে- তিনিও লিখছেন। আমরা উনিশে মে দিনে বাঙালি হই, পরদিনই ধর্মে ফিরে যাই। উনিশের চেতনা যদি কেবল—বাঙালি চেতনা হয়---তবে মেনে নেওয়া ভালো—সে কেবল এক সাংস্কৃতিক চেতনা। রাজনৈতিক চেতনা—একই সময়ে দুটিকেই স্বীকার করে। আর অস্বীকার করবার উপায় কই যখন দেশজুড়ে চেতনাটি কাজ করে। আমরা তো বাকি দেশ বা প্রদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন সত্তা নই—তা যতই একাংশ অন্য অংশকে ‘দেশদ্রোহী’ বলে চিহ্নিত করুন। সমস্যা হচ্ছে সেইসব সংযোগের কথা মনে রেখে বৃত্তের বাইরের বিন্দু এবং রেখাগুলো জোড়া---যুগপৎ দুই চেতনাকে সম্মান এবং স্বীকৃতি দিয়ে তাকে গণতান্ত্রিক মোড় দেবার সমস্যা। তিনি আই এম ডি টি নিয়ে কথা বলছিলেন। এই প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছেন, “আইনটির অপমৃত্যু কি দুটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মধ্যে সেতুবন্ধনের সূত্র হয়ে উঠতে পারে না?” (পৃ: ১৯২) পারে যে নি, আমরা পরের এক দশকে দেখলাম। কিন্তু বরাক ব্রহ্মপুত্র আবার এক হয়েছিল ‘শরাই ঘাটের ‘সাম্প্রতিক’ শেষ রণে।’ বাঙালি হিন্দু দুই উপত্যকাতেই আস্থা রাখল-- তাদের জন্যে রাজপত্র এসেছে, ডিটেনশন ক্যাম্প গুড়িয়ে যাবে, নাগরিক বিধি সংশোধিত হবে, বিদেশী বলে কেউ থাকবে না। শরণার্থী নাগরিকত্ব পাবেন, মুসলমান ‘অনুপ্রবেশকারী’ বিদেয় হবেন। এর পেছনকার শ্রেণিমৈত্রীর রাজনীতিটি আমরা ব্যাখ্যা করে এসেছি।স্বাভাবিক ভাবেই সেই রণের প্রতিপক্ষ ছিলেন দুই উপত্যকাতেই সম্প্রদায় হিসেবে মুসলমান । আই এম ডি টি আইন বাতিল নিয়ে যে কিছু বুদ্ধিজীবী আর রাজনৈতিক কর্মী বাদ দিলে বাঙালি হিন্দুর মধ্যে দুই উপত্যকাতেই কোনো ক্ষোভ ছিল সেরকম তথ্য দিয়ে দাবি করা যাবে না। ফলে মুসলমানেরাও এটিকে কোনো রাজনৈতিক ইস্যু করবার সাহসই করতে পারলেন না। নইলে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধেও যে বিদ্রোহ করা যায় সে নজির সম্প্রতি দেখিয়েছেন দেশের দলিতরা, যখন আদালত তপশিলি জাতি-জনজাতির উপর নিপীড়ন সংক্রান্ত ১৯৮৯র একটি আইনের অধীনে মামলা করা খানিক কঠিন করে দিয়ে রায় দেয়। সাতজন দলিত সেই বিদ্রোহে প্রাণও দিয়েছেন। আই এম ডি টি আইন---কিন্তু মূলত হিন্দু দলিত এবং মুসলমানদেরই যৌথ বিষয়। আমরা কি বাঙালি হিন্দুর দলিত চেতনা নিয়ে ভাবতে রাজি আছি? অরিজিৎও সেই প্রশ্নে নীরব।
সুবোধ বিশ্বাসেরা কিন্তু সেই দলিতদেরই সংগঠিত করতে গেছিলেন শিলাপাথার সহ ব্রহ্মপুত্রের অন্যত্র। শুরুতেই তাদের মুখ থুবড়ে পড়তে হয়েছিল—শুধু হিন্দু মনস্তত্ত্ব এবং শ্রেণিসমূহের স্বার্থের জন্যে। অরিজিৎ অবশ্য ঘটনাটির উল্লেখ করেছেন ‘রাজকুমারীর গান ও ধামাইল’ অধ্যায়ে। (পৃ:২০০) অসমিয়া-বাঙালির সামাজিক সাংস্কৃতিক সম্পর্কের টানাপোড়েনের কথা বলতে গিয়ে উগ্রজাতীয়তাবাদী তাপ এবং চাপের কথা লিখেছেন সঠিকভাবেই। তাঁর বোকাখাতের মামাকে গিয়ে দুধ দিয়ে আসুর শহীদ বেদি ধুইয়ে দিয়ে শিলাপাথারের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছিল—সেই অপমানকর করুণ কাহিনির কথাও লিখেছেন। কিন্তু সুবোধ বিশ্বাস এবং তাঁর সংগঠনের সঙ্গে নিত্য উঠাবসা করা সংগঠনগুলোও যে পরদিনই তাঁর সঙ্গে সমস্ত সংস্রব অস্বীকার করে গোটা ব্রহ্মপুত্রে ‘জয় আই অসম’ স্লোগান দিয়ে গা বাঁচালো—একে কেবল ‘বাঙালির ঘাড়ে ক’টা মাথা’ দিয়ে ব্যাখ্যা করলে সবটা করা হয় না। এই অধ্যায়ে অবশ্য এই নিয়ে এর বেশি এগোনো সম্ভব ছিল না। প্রসঙ্গ এখানে ভিন্ন। কিন্তু আমাদের প্রসঙ্গান্তরে যেতে হচ্ছে।
শিলাপাথার সম্ভবত কিছু বহিরাগত নেতাদের ‘ষড়যন্ত্র’ মাত্র ছিল না, সম্ভবত ‘নমঃশূদ্র’দের ক্ষোভের আঁচও তারা পেয়েছিলেন, এবং জুড়তে চেয়েছিলেন নমঃশূদ্রদের সর্বভারতীয় সংগ্রামের সঙ্গে। যার জন্যে প্রায় গোটা বিশেক সমাবেশের পরিকল্পনা ছিল। শিলাপাথারেই কেবল নয়। সেখানে শুরু হয়েছিল মাত্র। শুরুতেই ঘাড়টা ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল। এবং ‘নিরাপত্তা বিলাসী’ বাঙালি মধ্যবিত্ত একে ‘উপদ্রব’ মাত্র জ্ঞানে সংশ্রব ত্যাগ করে আত্মরক্ষা করেছেন। সুবোধ বিশ্বাসকে গ্রেপ্তার করেই কিন্তু ধেমাজি উপনির্বাচনটি জেতা গেছিল। হিন্দুত্ববাদের কাছে সেই বিজয়টি জরুরি ছিল, সুবোধ বিশ্বাস এবং সহযোগীদের মুক্তি নয়—তাদের সংগ্রামও নয়। এই বিক্ষোভ মাথা চাড়া দিলে কেবল যে উগ্রঅসমিয়া জাতীয়তাবাদীদেরই বিপদ ছিল -- এমনটা নয়। সম্ভবত অসমের বাঙালি বর্ণহিন্দু বাঙালি রাজনীতিও প্রত্যাহ্বানের মুখে পড়ে যেত। এই ঘটনা এবং পরবর্তী ‘নগাওঁকাণ্ড’ দেখিয়েছে ---হিন্দুত্বের হাত ধরে অসমে হিন্দু বাঙালি ক্ষমতা দখল করে ফেলেছেন বলে ‘পরবর্তন’ পরবর্তীকালে যে একটি ‘ভাব’ গড়ে উঠেছিল তা কত বড় ‘ভ্রম’ ছিল। এই পথ যে অসম্ভবের পথ, সেই ‘জ্ঞান’টুকু যত দ্রুত হয় ততই মঙ্গল।
বিচ্ছিন্নতার সমস্যা তো সুবোধ বিশ্বাসদেরও ছিল। মাথার উপরে ক্ষমতাসীন ‘হিন্দুত্ববাদ’ আর শহুরে মধ্যবিত্ত ভরসা করে ‘বাঙালিআনা’র নামে ‘নম:শূদ্র’ বিদ্রোহও অসম্ভব---তাও দেখিয়েছে। আমরা যে উলম্ব সমঝোতা এবং আনুভূমিক মার-এর কথা লিখে এলাম—শিলাপাথার এবং তৎপরবর্তী ঘটনা তার উজ্জ্বল নিদর্শন। বলা হচ্ছে যে আসুর অফিসে তারা আক্রমণ করেন নি, বরং খোঁচানোটা সেদিক থেকেই ছিল, এবং ‘আক্রমণ’টা বানানো গল্প। গল্প বানানো হলেও, সেই সুযোগ বহু কমে যেতো, যদি এই বাঙালি নিপীড়িত প্রতিবেশীর সংগ্রামে নিজেদের জড়ায় এবং নিজেদের সংগ্রামের স্বার্থে তাদের সঙ্গে সংলাপ চালায়, আস্থাতে নেয়। এবং সেটি যদি সম্ভব নাও হয়ে উঠে, চর অঞ্চলের নমঃশূদ্র এবং ময়মনসিংহী মুসলমানদের তো ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আচারঅনুষ্ঠানগুলো বাদ দিলে ইতিহাস, সংস্কৃতি, বহু ক্ষেত্রে মুখের ভাষা (সরকারিভাবে যদিও ভিন্ন), অর্থনীতি, এবং শ্রেণি চরিত্রটাসহ প্রায় সবই তো এক। তফাৎ শুধু এই যে মুসলমানে ডি-ভোটার হবার বাইরেও বাংলাদেশী বলে পথে ঘাটে অপমান এবং শারীরিক আক্রমণের শিকার হন। নমঃশূদ্র এবং অন্য দলিতরা বাংলাদেশী সন্দেহে ডি-ভোটার হন। অর্থাৎ নিপীড়ক এক, নিপীড়নের লক্ষ্য এক, পদ্ধতি ভিন্ন। তারা কেন এক হয়ে পরস্পরের লড়াইটা লড়তে না পারবেন। না পারবার জন্যে অবস্থা এই যে এখনো সুবোধ বিশ্বাস এবং তার সঙ্গীরা জেলে রয়েছেন—কেউ জানে না কোন আইনে। বিচার চলছে বলেও কোনো সংবাদ নেই। কিন্তু সেই ঐক্যের পথ যদি অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্যের আজকালে লেখা প্রবন্ধের পথ হয়, তবে তা হবে আকাশ কুসুম। ভাষা এদের কাছে কোনো বিষয়ই নয় , বড় সড় সমস্যাই নয়—এই কথাটি মনে রাখা ভালো। নিজেকে যিনি বাঙালি বলেন, তিনিও সন্তানকে হয় অসমিয়া নতুবা সামান্য টাকা থাকলে ইংরেজি স্কুলেই পাঠাচ্ছেন।আগে তো নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি এবং সম্মানটুকু আদায় করতে হবে। এই ঐক্যকে এভাবেও তো পারিভাষিক রূপ দেওয়া দেওয়া যায় ‘বাঙালি হিন্দু এবং অভিবাসী অসমীয়া মুসলমানের ঐক্য’ , ‘শ্রমজীবী মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের ঐক্য।’ নিজেদের বাঙালি বলে ঘোষণা না দেওয়া অব্দি কি অভিবাসী মুসলমানের সঙ্গে ব্রাহ্মণের জলঅচল সংস্কারের মতো কিছুতেই এক হয়ে লড়া যাবে না?
‘নিপীড়িত প্রতিবেশীর সংগ্রামে’ বাঙালির নিজেদের জড়ানো নিয়ে অরিজিৎ বিশেষ ভাবেন নি। কিন্তু প্রতিবেশীর শিল্প-সাহিত্য তথা বৌদ্ধিক সংগ্রামের অংশ হবার সমস্যা নিয়ে ভেবেছেন। সেরকম দুটি নিবন্ধ আছে। একটি ‘মিয়া কবিতা’ । যার প্রসঙ্গে আমরা আসব শেষে। আরটি ‘রাজকুমারীর গান ও ধামাইল।’ কাজিরাঙ্গাতে ইউনিসেফের একটি অনুষ্ঠানে জিনা রাজকুমারীর একটি অনুষ্ঠানে অসমের তাবৎ জনগোষ্ঠীর লোক নৃত্য এবং গীত দেখেছেন, দেখেন নি ধামাইল। ধামাইল সেখানে ব্রাত্য হয়ে রইল। ব্যক্তি জিনাকে আমরা নচিকেতার সহযোগী হয়ে গানের কর্মশালা করতে দেখেছি। কালিকাপ্রসাদের মৃত্যুর পর দোহারের সঙ্গী হয়ে মুম্বাই গিয়ে অনুষ্ঠান করতে দেখেছি। ব্যতিক্রম মাসডোর উদ্যোগে। কিন্তু এটি সত্য যে অসমের সংস্কৃতি সরকারি বা বা অধিকাংশ বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক বয়ানে তথা অনুষ্ঠানে বাঙালি ব্রাত্য থাকে। ধামাইল তো থাকবেই। অসম মানে বাঙালি নয়---সেরকম একটি প্রাতিষ্ঠানিক ধারণা আছে। বাঙালির কথা যারা স্মরণে রাখেন, তাদেরও আক্ষেপ বাঙালি অসমিয়া সাহিত্য সংস্কৃতির খবর রাখেন না। শান্তিনিকেতনী কবি নবকান্ত বরুয়া অসম সাহিত্য সভার সভাপতি হলে পরে নেওয়া একটি সাক্ষাৎকারের কথা উল্লেখ করেছেন অরিজিৎ। উল্লেখ করেছেন এককালে গুয়াহাটি থেকে নিজের সম্পাদনাতে প্রকাশিত ছোটকাগজ ‘প্রাসঙ্গিক’-এ ধ্রুবজ্যোতি বরার লেখা নিবন্ধ ‘অসমের বন্ধ্যা বাঙালি’র কথা। সেখানে তিনি অনুযোগ করেছেন, এখানকার কবিতাতে ব্রহ্মপুত্র অনুপস্থিত, স্থানীয় আশা আকাঙ্ক্ষার লেশমাত্র লিখেছেন, “অসমের বাঙালির ‘অসমের বাঙালি’র বাইরে আর কোনও পরিচয় নেই। এই পরিচয়ই তাদের চেতনা এবং সৃষ্টির ভিত্তি হতে হবে। আমরা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি, এই বৃহৎ প্রতিভাবান সমাজের মধ্য থেকে এক সৃষ্টিশীল নতুন প্রতিভার জন্ম হবে। শেষ হবে বন্ধ্যাত্বের বেদনা।” (পৃ:১৯৬) বাঙালির প্রতি শ্রদ্ধা এবং সহানুভূতি বক্তব্যে স্পষ্ট। তত্ত্ব হিসেবেও এটি খাটি। লেখাটি পড়ে কবি অনুরূপা বিশ্বাস ব্রহ্মপুত্র নিয়ে তাঁর একটি অপ্রকাশিত কবিতা প্রাসঙ্গিকে পাঠান। তিনি ধ্রুবজ্যোতি বরার দেখাকে খণ্ডন করেন নি। আমরাও করি না সবটা, অরিজিৎও করেন নি পুরোপুরি। কিন্তু তিনি স্পষ্টই লিখেছেন, “...ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার একটি বড় শ্রেণি, যাঁরা লেখালেখি বা সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা এ-রাজ্যের বাঙালিদের সাহিত্যের সাহিত্য চর্চা বা শিল্পচর্চা সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল নন। এর একটি বড় কারণও রয়েছে।” আমরা কারণের কথাতে পরে আসছি। ধ্রুবজ্যোতি বরা অমলেন্দু গুহও পড়েন নি ভাবতে কষ্ট হয়, যার একটি কাব্যগ্রন্থের নাম ‘ লুইতপারের গাথা’। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কাব্যগ্রন্থের নাম ‘সীমান্ত প্রহরী’ যার অনেকগুলোরই অসমিয়া রূপও তাঁরই লেখা। ‘সীমান্তের চিঠি’, ‘সীমান্তের গাথা’ ‘সাকিন আসাম, ১৯৮৩’র উজ্জ্বল কবির নাম ঊর্ধ্বেন্দু দাশ। তাঁর কয়েকটি পঙক্তি আছে এরকমও, এখানে ‘মফসসল’ কে আসাম তথা পূর্বোত্তর বলে পড়তে হবে।
...
যশোকামী কবি, তুমি ভেবে দেখো মফসসলে কত কিছু নেই। ...
মফসসল মানে চাপা পাড়াগাঁর অন্ধকার, লণ্ঠন-রহস্য, পচা পিছুটান, ক্লেদ—
গ্রামীণ বিষাদ ছুঁয়ে চাষাড়ে কবির জীর্ণ মলিন কাঁথার ফোঁড়, তেল-চিটচিটে
নোংরা লিটল ম্যাগ, ম্যাদামারা কবি-সম্মেলন, ত্রাহি গানের উৎপাত, চাঁচাছোলা
ভাষণের অত্যাচার , জোলো আপ্যায়ন, ধুলো-কাদায়-লোপাট পথে ভূত হয়ে ফেরা।–
পরবাস আরো বেশি ক্লান্তিকর, পশ্চিমে ততটা নয়, পূবদিকে যতটা দুঃসহ—
ওখানে লণ্ঠন কিংবা ভৌতিক রহস্য নেই: শুধু গ্রানিটের দীর্ঘ ওঠানামা, ভারী
নদীর গর্জন; হিংস্র মানুষ ও পশুতে ভরা নিওলিথ-অরণ্যের জমাট আঁধার।–
ওখানে বাঙালি যারা, নিতান্ত ছাগল—কেউই বাংলা জানে না; এই কলকাতা হতে
নেহাত কাগজপত্র কিছু রোজই উড়ে গিয়ে এখানে ওদের মোটামুটি মানুষ রেখেছে;
পদ্যের ব্যাপারে ওরা নির্ঘাত পিছিয়ে আছে একশো বছর , আর
দুঃখের কথা কী বলব,---
অমন রবীন্দ্রনাথ, তেনাকেও মিনিমাম তিনজোড়া লাথির ঘায়ে যারা অনায়াসে
ধুলোয় লুটোলো,--ঘোর মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করে, রমণী দমন করে, যারা
শুধু কবিতার জন্যে ভুবন পেরিয়ে এসে, শিল্পকে পেঁদিয়ে করল তুরুপের তাস—
সেসব বিশ্রুতকীর্তি, তুলকালাম প্রতিভার নাম এরা স্বপ্নেও শোনেনি।
...
...
যশোকামী কবি, তুমি ভেবে দেখো মফসসলে কত কিছু নেই। ...
মফসসল মানে চাপা পাড়াগাঁর অন্ধকার, লণ্ঠন-রহস্য, পচা পিছুটান, ক্লেদ—
গ্রামীণ বিষাদ ছুঁয়ে চাষাড়ে কবির জীর্ণ মলিন কাঁথার ফোঁড়, তেল-চিটচিটে
নোংরা লিটল ম্যাগ, ম্যাদামারা কবি-সম্মেলন, ত্রাহি গানের উৎপাত, চাঁচাছোলা
ভাষণের অত্যাচার , জোলো আপ্যায়ন, ধুলো-কাদায়-লোপাট পথে ভূত হয়ে ফেরা।–
পরবাস আরো বেশি ক্লান্তিকর, পশ্চিমে ততটা নয়, পূবদিকে যতটা দুঃসহ—
ওখানে লণ্ঠন কিংবা ভৌতিক রহস্য নেই: শুধু গ্রানিটের দীর্ঘ ওঠানামা, ভারী
নদীর গর্জন; হিংস্র মানুষ ও পশুতে ভরা নিওলিথ-অরণ্যের জমাট আঁধার।–
ওখানে বাঙালি যারা, নিতান্ত ছাগল—কেউই বাংলা জানে না; এই কলকাতা হতে
নেহাত কাগজপত্র কিছু রোজই উড়ে গিয়ে এখানে ওদের মোটামুটি মানুষ রেখেছে;
পদ্যের ব্যাপারে ওরা নির্ঘাত পিছিয়ে আছে একশো বছর , আর
দুঃখের কথা কী বলব,---
অমন রবীন্দ্রনাথ, তেনাকেও মিনিমাম তিনজোড়া লাথির ঘায়ে যারা অনায়াসে
ধুলোয় লুটোলো,--ঘোর মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করে, রমণী দমন করে, যারা
শুধু কবিতার জন্যে ভুবন পেরিয়ে এসে, শিল্পকে পেঁদিয়ে করল তুরুপের তাস—
সেসব বিশ্রুতকীর্তি, তুলকালাম প্রতিভার নাম এরা স্বপ্নেও শোনেনি।
...
(জাহাজডুবির পূর্বসংকেত; নির্বাচিত কবিতা; পৃ:১৪২)
বিজয় কুমার ভট্টাচার্যের খ্যাতি আছে, অসমিয়া জাতীয়তাবাদ বিরোধী, ভাষা শহীদ স্মরণেই লিখেছেন অধিকাংশ কবিতা। সেই তিনিও তো লিখেছেন ‘ভ্রমণের কবিতা’ :
চলো না তোমাকে নিয়ে একবার ঘুরে আসি
এসেছে সময়, মনোময়, শুনো দূর
দূরান্তের বাঁশি।
সবাই তো নৌকা বায় ভাটিয়াল স্রোতে—
আমরা উজানে যাবো
গোয়ালপাড়ার গানে গানে,
ঠিকানা হারাবো মাঝপথে।
দূরের পাহাড় বুঝি কামনার নীলাচল
এখনো অভিশাপের মোরগ ডাকে
পাথরের চোখে ঝরে
জল।
কে কোথায় করেছে নির্মাণ, অলৌকিক জলযান,
স্বর্গের সিঁড়ি
তোমাকে নিয়েই যাবো, যেখানে পাগলাদিয়া,
লোহিত, সুবনশিরি।
মেঘে মেঘে মেঘালয়, আবৃত তুষারে
স্নান সেরে নিতে পারো তুমি
বিডন , বিশপ শাওয়ারে।
এখানেই হিমালয় অরণ্যের নানাকথা কয়,
পাইনের বনে ঝড় তোলে জয়ন্তিয়া নারীর প্রণয়।
...
সেরকম দেবেন্দ্র কুমার পাল চৌধুরীর ‘হাফলং হিল’ থেকে শুরু করে সঞ্জয় চক্রবর্তীর অতি সাম্প্রতিক কবিতা ‘আমি একা নির্জন ঘরে’-র মতো অসংখ্য কবিতার নজির আমরা তুলে দিতে পারি যা সবের সংবাদ কিছু ব্যতিক্রমী ব্যক্তি বাদ দিলে ধ্রুবজ্যোতি বরারা রাখেন না। ‘সুরমা গাঙর পানি’ , ‘সাতপুরুষ’, ‘শরাইঘাট এক প্রেম কাহিনি’ , ‘লোহিত পারের উপকথা’ ইত্যাদি উপন্যাস এবং অসংখ্য ছোটগল্পের কথা নাই বা লিখলাম। সত্য বটে এই সব সংবাদ শুধু যে অসমিয়ারাই রাখেন না, তাই না,সাধারণ ভাবে বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজও রাখেন না। সেখানেই আসে অরিজিতের ‘কারণ’গুলোর কথা। অসম আন্দোলনের সময় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে বাংলা কাগজ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সিনেমা শো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ফলে এখানকার “...বাঙালির ঘাড়ে ক’টা মাথা যে তাঁরা প্রকাশ্যে সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা করবেন?...” (পৃ:১৯৭) কিন্তু পরবর্তী দশকে তো পরিস্থিতি পালটেছিল। দ্য সেন্টিনেল গোষ্ঠী বের করেছিল বাংলা দৈনিক ‘সময় প্রবাহ’। “ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাংলা সাহিত্য চর্চার একটি উর্বরক্ষেত্র হয়ে ওঠে সময় প্রবাহ।” (পৃ:১৯৭) তাতে অসমের কথাই থাকত। কিন্তু অসম আন্দোলনের দিনগুলোর কথা কি উঠে এসেছিল? আসা কি সম্ভব ছিল ‘নির্ভীক কলমে’? এখানকার বাংলা নাটক আদি চর্চার অনুষ্ঠানও হয়, সেখানে অসমিয়া দর্শকও থাকেন। কিন্তু অরিজিতের সংগত প্রশ্ন, “উত্তাল আশির দশক বলুন বা শিলাপাথার-পরবর্তী সময়ের কথাই বলুন, অসমের বাঙালির সাহিত্য –সংস্কৃতি চর্চায় সময় ও সমাজের সৎ ও নির্ভীক প্রতিফলন কি কখনোই সম্ভব?” ফলে ‘বন্ধ্যাত্বের বেদনা' কাটাতে অসমের বাঙালিকে ধ্রুবজ্যোতি বরার পরামর্শ যথেষ্ট হচ্ছে না। ঊর্ধ্বেন্দু দাশ তাই লিখেছিলেন,
“...
ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো
স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি
হাতে কিছু প্রত্ন শস্য, নাভিমূলে মহাবোধি অরণ্যের বীজ...
তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যস্ত –শাসন!—
সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে
তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়;
হেমশস্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল
ফুলের মশাল!—
(স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি; নির্বাচিত কবিতা; পৃ:১১৪)
সুতরাং ‘মাটির তত্ত্ব’ বাঙালি কবি বোঝেন, ‘মাটির সমস্যা’ অসমিয়া কথা-সাহিত্যিক বোঝেন না। ২০১৬র বিধানসভা নির্বাচনের সময় একটি টিভি চ্যানেল তারাপুর অসমিয়া বস্তিতে গিয়ে প্রচার করছিলেন, বড় কষ্টে তাঁরা ‘বিহু সংস্কৃতি’ বাঁচিয়ে রেখেছেন। অরিজিৎ ফোনে চ্যানেলে আপত্তি জানিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন, এখানকার দুর্গাপুজোর মণ্ডপে যখন বিহু গান বাজে তখন চ্যানেলে সেগুলো উঠে আসে না। তিনি যা লেখেন নি, সে হলো সেখানে প্রশাসনিক উদ্যোগে বিহু হয়, আর সেই সংবাদও চ্যানেলগুলোতে আসে না। অসমিয়া বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও “...বরাক উপত্যকায় আমন্ত্রিত হয়ে এলে মনে হয় তাঁরা যেন ভিন কোন রাজ্যে এসেছেন।” (পৃ:১৯৮) বরাক উপত্যকাতে অসমিয়া অনুষ্ঠানে বাঙালিরাও ‘গামোছা’ পরেন, কেউ বাধা দেয় না। কিন্তু বিশুদ্ধ বাঙালি অনুষ্ঠানে ‘গামোছা’ পরতে মানা করলে কি তাকে বলা যাবে ‘গামোছা’ তথা অসমিয়া সংস্কৃতি বিরোধী?
ব্যক্তিগত পর্যায়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে অশান্ত সময়ের কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে অসমিয়া বাঙালি প্রতিবেশী হয়ে থাকতে অসুবিধে নেই। কিন্তু “সার্বিকভাবে কি অসমিয়া মূলস্রোত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিদের শামিল করে নিতে পেরেছে?” (পৃ:২০০)এই প্রশ্ন অরিজিতেরই। এই কথাও তো উল্লেখ করা যেতো, উলটে বাঙালি কেন অসমিয়া ভাষাকে বরণ করে নেয় না, নিজেকে অসমিয়া বলে পরিচয় দেয় না—এই ক্ষোভ যেখানে আছে---সেখানে ধ্রুবজ্যোতি বরার স্বপ্ন পূরণের পথ কতটা কুসুমাস্তীর্ণ বোঝাই তো যায়। তিনি অধ্যায়টি শেষ করে এই লিখে, “ জিনা রাজকুমারীর অনুষ্ঠানমালায় ধামাইল ব্রাত্য কেন এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে হবে অসমিয়া সাহিত্য সংস্কৃতির অগ্রণী ব্যক্তিদেরই। তাঁদের এটা অনুধাবন করতে হবে যে জিনা রাজকুমারীর অনুষ্ঠানমালায় ধামাইল যতদিন ব্রাত্য হয়ে থাকবে ততদিন বৃহত্তর অসমিয়া সমাজও কাঁঠালের আমসত্ত্ব হয়েই থাকবে।” (পৃ:২০১) সত্য বটে। কিন্তু একই কথা কি আমরা বৃহত্তর বাঙালি সমাজ তথা হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের বেলাও উচ্চারণ করতে রাজি আছি? অরিজিৎ কিন্তু ‘কাঠালের আমসত্ত্ব’ কথাটি সেখানেও ব্যবহার করেছেন। সেখানেও কি আমরা লিখতে এবং বলতে রাজি আছি এমন বহু ‘ব্রাত্য কেন?’ এমনকি আমরাতো প্রশ্নটিকে সম্প্রসারিত করে এই অব্দিও নিয়ে যেতে ইচ্ছুক, কেন বা দৈনিক যুগশঙ্খে ব্রাত্য নিয়মিত উত্তর সম্পাদকীয়ে হিন্দুত্ববাদী লেখকদের মুসলমান প্রতিরূপ? আমরা নামোল্লেখ করলাম না। বুদ্ধিমানে বুঝে যাবেন। সেখানে কেন মুসলমানকে উপস্থিত হলেও হতে হবে ক্বচিৎ কদাচিৎ কেবলই অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্য কিংবা অরিজিৎ আদিত্যেরই প্রতিরূপে। এই সব প্রশ্নের উত্তর কিন্তু সন্ধান করতে হবে, ‘সাহিত্য সংস্কৃতির বাঙালি হিন্দু অগ্রণী ব্যক্তিদেরই।’
আমাদের এই প্রশ্নের সরাসরি দুটি কারণ, এক বাঙালি যেমন ভাষিক সংখ্যালঘু, মুসলমান সেভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু। ফলে তাদের ব্রাত্য দশার জন্যে দায়ী সংখ্যাগুরু সমাজ, সংখ্যাগুরু সমাজেরই আরেক অংশকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে স্পষ্টতই ‘শ্রেণিভেদ’। আমরা মিয়া কবিতা নিয়ে কথা বলবো, এবং স্পষ্টতই দেখা যাবে অন্তর্বস্তুতে সেই ‘শ্রেণিভেদ’ নজরে পড়বে। আমাদের প্রশ্নটি অরিজিৎকে নয়, কারণ তিনি তো প্রায়শ্চিত্তটি শুরুই করেছেন। বাকি বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত তাতে রাজি হবে কি না। আমরা দেখেছি, সেখানে বহু ‘বাম উদার’, ‘অসাম্প্রদায়িক’ বাঙালি হিন্দু মেধাজীবীরও বয়ান পালটে যায়, সব সময়েই যেন উদ্যোগটি তারা নয়, নিতে হবে ‘অপর’কে, অন্যপক্ষকে। কোনো বাঙালি হিন্দু অগ্রণী ভূমিকা নিলে উঠে ‘তোষামোদে’র অভিযোগ। পরামর্শ দেওয়া হয়, মুসলমান মৌলবাদও সমান বিপদ। অর্থাৎ মৌলবাদ বিরোধী সমদূরত্বের লাইন এরা নেন, এবং কার্যত কখনো কখনো দেখা যায় হিন্দুত্ববাদী শিবির ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। তথাগত রায়ের বই উন্মোচনী সভাতে অধ্যাপক সুবীর করের ভূমিকা সেরকমই ছিল। বিল সমর্থন করতে গিয়ে আরো বহু ব্যক্তি সংগঠনকেও সেই লাইন নিতে দেখা গেছে। ঠিক একই কথা কিন্তু বহু বাম-অসমিয়া অসমিয়া-বাঙালি সম্পর্কের বেলাও বলে থাকেন। অধ্যাপক হীরেন গোঁহাই এবং আরো কেউ কেউ বহুদিন ধরে এমনটাই বলে আসছেন।এবং শেষমেশ দাঁড়ায় এমন যে তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে অসমিয়া জাতীয়তাবাদের প্রতিভূ হয়ে দাঁড়ান। এক জায়গাতে দুই পক্ষ মিলে মিশে একাকারও হয়ে যান। হিন্দু-বাম অংশ আক্ষেপ করেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় কারণে মার খেয়ে আসা হিন্দুদের কী হবে! আর অসমিয়া বাম অংশ প্রচার করেন, তারা যদি চলেই আসেন তবে অসমের ‘খিলঞ্জিয়া’ অস্তিত্বের কী হবে! অথচ, অরিজিৎ দেখিয়েছেন, দুই আতঙ্কেরই বিশেষ কোনো ভিত্তি নেই। এইখানেই অরিজিৎ মৌলিক।
অরিজিৎ সেখানে সাহিত্য খুঁড়েও সন্ধান করেছেন অসমে ‘মিঞা মুসলমান’দের কী হবে? আমরা মাঝে ‘মিয়া কবিতা’ প্রবন্ধের কথা ছেড়ে এসেছি। নতুন প্রজন্মের ময়মনসিংহী মুসলমান তরুণদের নতুন সাহিত্যকে ধরে তাদের আবেগটুকু বুঝবার চেষ্টা করেছেন। করেছেন শ্রদ্ধার সঙ্গে। এই কাজটিই তো হয়ে উঠে না। অসমিয়াতে হয়। দেখাদেখি সম্প্রতি ‘নাইন্থ কলাম’ কাগজও চর অঞ্চলের মানুষ, মানুষের ভাষা-সাহিত্য, জীবন-জীবিকা নিয়ে একটি সংখ্যা করেছেন। বরাক উপত্যকাতে সেরকম নজির বিরল। অবশ্য অসমিয়া জাতীয়তাবাদ বিরোধী লেখালেখিতে, ময়মন সিংহীরা নিজেদের ‘অসমিয়া’ পরিচয় দেবার জন্যে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে হতাশাটি ব্যক্ত করা হয়। বিশ্বাসভাজনও যে হয়ে উঠবার দরকার পড়ে সেই উদ্যোগ সেরকম নজরে পড়ে না। সেদিক থেকেও অরিজিৎ ব্যতিক্রমী নজির গড়লেন।
২০১৬র বিধানসভা নির্বাচনের সময় প্রচণ্ড হতাশার থেকে বরপেটার ড০ হাফিজ আহমদ এমনি এমনি ফেসবুকে লিখে দিলেন,“ লিখি লোয়া,মই এজন মিঞা’ মানে একটি কবিতা। সেই শুরু ‘মিঞা কবিতা’র আন্দোলন। অচিরেই যা সারা বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমের নজর কেড়ে নিল। তিনি বামপন্থী চরচাপরি সাহিত্য পরিষদের সভাপতি। ‘অসমিয়া সাহিত্যে বঙ্গমূলীয় মুসলমানের অবদান ‘নিয়ে পিএচডি করেছেন। এই কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ করেন সেলিম হুসেন। অনেকেই হাফিজের দেখাদেখি কবিতা লিখতে শুরু করেন। সেলিম ‘ইটামুগুর’ নামে একটি ফেসবুক পেজ শুরু করেন। কবিতাগুলোর নাম ‘মিঞা কবিতা’ তাঁরই দেওয়া। কলকাতার হিন্দিভাষী অধ্যাপক মহম্মদ রিয়াজ। কেমব্রিজের ট্রিনিটিতে এই নিয়ে তিনি একটি সেমিনার পেপারও পড়ে আসেন। ধীরে ধীরে এই আন্দোলনকে সংবাদ করে ‘আল জাজিরা’ও। তাঁরা যে কবিতা লিখছেন ময়মনসিংহী মুখের ভাষাতেও। সে রকম অনেকগুলো কবিতার টুকরো অরিজিৎ তুলেও দিয়েছেন। তার একটি এরকম, “কিছুই লাগবো না তোমার;/ মাত্র আমার যা প্রাপ্য তাই দাও।/ আমার নাম আমি নিজেই বানামু একদিন/ নিজের দমেই।’ ‘নাম’ মানে তো পরিচয়। স্বাধীনতার আগে থেকেই এরা নিজেদের অসমিয়া বলে পরিচয় দিয়ে এসেছেন, অরজিৎ লিখছেন, “১৯৮৩-তে নেলি গণহত্যার পর মুসলিমরা ভয়ঙ্কর অস্তিত্ব সংকটে পড়েন। সুতীব্র বিপন্নতা তাঁদের নতুন করে ‘অসমিয়া’ করে তোলে।” (পৃ: ১৮৩) কোনো প্রীতির থেকে নয় সেলিম কটনে পড়বার সময়ই অনুভব করেন, “...অসমিয়া এবং আমাদের মধ্যে একটা প্রাচীর রয়েছে।” (পৃ: ১৮১) তারপরেও মার্কিন ব্লেক কবিতার লেখকেরা যেমন মার্কিন-ইংরেজির থেকে বেরিয়ে আসবার জন্যে লেখেন নি প্রতিবাদী কবিতা, বরং তার ভেতরেই সম্মানের জায়গাটুকু আদায় করে নিতে চান, ‘মিঞা কবিতা’র লেখকদেরও বাসনা তাইই। সেলিম জোরের সঙ্গেই নিজের পরিচয় দেন ‘বঙ্গীয় মূলের অসমিয়া মুসলিম’ বলে। কেউ যদি নিজেদের বাঙালি পরিচয় দিতেও চান তাতে ‘আমার কোনো আপত্তি নেই’— (পৃ: ১৮১) তিনি বলেন বটে। কিন্তু বিষয়টি এতো সহজ নয়। অধ্যাপক জ্যোতির্ময় জানা এক জায়গাতে লিখেছিলেন, অসম “আন্দোলনের সময় বাঙালি হিন্দুর বিরুদ্ধে বহুকথিত conspiracy theory যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করবার মতো করে পূর্ববঙ্গমূলের মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল invasion theory।” ( অনুবাদ আমাদের। আন্দোলন আরু মতান্তর; অসম আন্দোলন—প্রতিশ্রুতি আরু ফলশ্রুতি; সম্পাদনা: ড০ হীরেন গোঁহাই, ড০ দিলীপ বরা; বনলতা; ২০০১; পৃ:১৭১) এখনো যারা ভাষার ভিত্তিতে জাতিগঠনে বিশ্বাস করেন, তাদের মধ্যে বহু ‘বামপন্থী’ও আছেন, তারা বাঙালি হিন্দুর উপস্থাপনা সেরকমই করে থাকেন। হেমন্ত বেজবরুয়া লিখছেন এক জায়গাতে, ২০০১এর আদম সুমারিতে অসমে বাঙালির সংখ্যা কমে গেল, কারণ ‘আমরা বাঙালি’র প্ররোচনাতে পড়ে আগে নিজেদের অসমিয়া বলে পরিচয় দিতেন সেরকম বহু বাঙালি হিন্দু নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দিতে শুরু করেন। (অসম সাহিত্য সভা, অসমীয়া ভাষা আরু চরচাপরিবাসী মুসলমান; চর-চাপরির জনজীবন—সংঘাত আরু সৌরভ; সম্পাদনা: শহীদুল ইসলাম, টুনুজ্যোতি গগৈ; পৃথিবী প্রকাশন, গুয়াহাটি; ২০১০; পৃ: ৮৩) তিনি লিখছেন, “...চর-চাপরিবাসী মুসলমানেরা উগ্র বাঙালি জাতীয়তবাদীদের প্ররোচনা প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের মাতৃভাষা অসমিয়া বলেই পরিচয় দিলেন। বিশ্বাসঘাতকতা করলেন বাঙালি হিন্দুরা।” (অনুবাদ আমাদের। পৃ:৮৩) কিন্তু ১৯৯১র আদম সুমারিতে বুঝি কেউ কেউ নিজেদের বাঙালি লিখিয়েছিলেন, হাফিজ আহমেদের এমনটাই দাবি,“...চর-চাপরিবাসী অসমীয়াদের কেন্দ্র করে অন্য এক উগ্র-জাতীয়তাবাদী শক্তির ষড়যন্ত্র ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছিল। ১৯৯১ সনের আদমশুমারির সময় একাংশ উগ্র বাঙালি জাতীয়তবাদী চর-চাপরিবাসীদের মধ্যে অসম আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হওয়া ক্ষোভের সুযোগ নিয়ে তাদের বাঙালি সাজাতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। গোলাম ওসমানীর মতো একাংশ বাংলাপ্রেমী রাজনীতিবিদও এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন।” (অনুবাদ আমাদের। অসম সাহিত্য সভা আরু চর-চাপরিবাসী অসমিয়া মুসলমান; চর-চাপরির জনজীবন—সংঘাত আরু সৌরভ; সম্পাদনা: শহীদুল ইসলাম, টুনুজ্যোতি গগৈ; পৃথিবী প্রকাশন, গুয়াহাটি; ২০১০; পৃ: ৮৭ ) গোলাম ওসমানীর কথাটি কতটা সত্য, কতটা অতিরঞ্জিত সেটি তলিয়ে দেখা চাই। কিন্তু অধ্যাপক জ্যোতির্ময় জানা কথিত ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্বে’র বিস্তারটি স্পষ্ট। হতে পারে লেখকের এই তথ্য সত্য,“ ‘আমরা বাঙালি’র মতো সংগঠনও অসম সবসময়েই বাংলাভাষী প্রধান রাজ্য ছিল এবং ২০০১এর আদমসুমারিতে এই সত্য উদঘাটন হ’বে বলে ভারতের আদমশুমারি আয়ুক্তকে শুমারি চলা অবস্থাতেই স্মারকপত্র দিয়েছিল।” (পৃ: ৮৭) কিন্তু সংগঠনটির কি এতোটাই প্রভাব এবং প্রতিপত্তি আদৌ অসমে রয়েছে, যে তাদের প্ররোচনাতে পড়েই আগে নিজেদের অসমিয়া লেখাতেন সেরকম বাঙালি হিন্দুরা নিজেদের বাঙালি লেখালেন বলেই এক লাফে রাজ্যে বাঙালির সংখ্যা ২১.৬৭ থেকে বেড়ে ২০০১এ ২৭.৫৪ শতাংশ হয়ে গেল? হাফিজ আহমেদের কিন্তু এমনটাই দাবি। অর্থাৎ স্বাভাবিক ভাষান্তর মেনে নিতে কেউ প্রস্তুত নন। মুসলমান মৌলবাদ বিরোধিতার নামে থাক না থাক বহু বাম যেমন জামাত –এ-ইসলামীর নাম করেন, থাক না থাক ‘আমরা বাঙালি’র নাম করবার যুক্তিটিও অন্যদিকে একই। একটি যথেচ্ছ বয়ান নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু একে মুসলমান মৌলবাদের সঙ্গে মিলিয়ে লাভ নেই, যা বরাক উপত্যকার বাঘাবাঘা মৌলবাদ বিশেষজ্ঞরাও করে থাকেন। পাঁচু গোপাল চক্রবর্তী লিখছেন, এককালে তো আসামে সবাই বাংলাতেই লেখাপড়া করতেন। কিন্তু অসমে অসমিয়া ভাষাপ্রচলনের পর থেকে বাকি সবাই অসমিয়াতেই লেখাপড়া শুরু করলেন। কিন্তু ময়মনসিংহ বা পুব বাংলার অন্যান্য জেলার থেকে যেসব হিন্দু পমুয়ারা এলেন তারা শহরে নগরে বাস করতে শুরু করলেন। “তাঁরা বাংলা ভাষা ত্যাগ না করে সেই ভাষাতে শিক্ষা গ্রহণ করছেন এবং তাঁরা অসম রাজ্যকে জীবিকার ঠাঁই হিসেবে ব্যবহার করেন কিন্তু প্রাণ পশ্চিমবঙ্গের দিকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে থাকেন।” (অনুবাদ আমাদের। অসমর চর-চাপরির ভাষা;চর-চাপরির জনজীবন—সংঘাত আরু সৌরভ; পৃ: ১৩২) সেই ব্রিটিশ শাসনের শুরুতেই অসমে সরকারি ভাষা প্রচলনের দায় থেকে বই লিখে বাঙালিকে মুক্ত করেছিলেন শিবনাথ বর্মণ এবং প্রসেঞ্জিত চৌধুরী। তবু পাঁচু গোপালেরা সেই জনপ্রিয় বয়ানেই এখনো ভরসা করেন, বাঙালির,“ই এক অভিসন্ধির অংশ আছিল বুলি ধরি ল’লে নিশ্চয় ভুল নহ’ব।”(পৃ: ১৩২) সবই এই ‘ধরি ল’লে’র উপরে চলছে। এমন কি ভাষা বিশ্লেষণটাও চলে। ময়মনসিংহী ভাষা যে বাংলা নয়ই তার প্রমাণ দিতে মান বাংলার উপরে ভরসা করা হয়। বাংলাদেশের ময়মনসিংহী বা বাকি ভাষাবৈচিত্র্যের ধারেকাছেও কেউ যান না। কিন্তু যাওয়াটা এই মুহূর্তে নিরাপদও নয়। আর বাঙালি হিন্দু পক্ষেও ‘উগ্রজাতীয়তাবাদ’ নেই একেবারে, তাদের কোনো ‘ধরি ল’লে’র ব্যাপার স্যাপার নেই---এহেন ‘প্রমাণপত্র’ যোগাতে আমরাও প্রস্তুত নই। গোয়ালপাড়াটা বাংলা প্রেসিডেন্সিতে ছিল বলেই যে সেখানকার সবাই এককালে বাঙালি ছিলেন, এমন অন্ধ বিশ্বাস তো বাঙালি হিন্দুরও আছে। এবং সেই বিশ্বাস লালন করবার সময় তাঁরা দিব্যি ভুলে যান, যে এর পরে আর অসম অসমিয়াদের জন্যে তত্ত্বকে খারিজ করা চলে না। গোয়ালপাড়াতে বডো –রাজবংশী ইত্যাদি জনজাতিদের কী অবস্থান ছিল,কেন ছিল—সেই সব প্রশ্ন তুলবার সাহস এবং সততা কোনো বাঙালি লেখকের আছে বলে আজ অব্দি দেখিনি। শ্রেণিমৈত্রী আর বলে কাকে! কিন্তু সেই সব তর্কে আমরা যাচ্ছি না। আমরা শুধু এইটুকুন দেখালাম যে ‘মিঞা’ মুসলমানের নিজেদের ‘বাঙালি’ বলে দাবি করাটা এতো সহজ নয়, আর বাঙালি হিন্দুরও উচিত নয় তাদের বাঙালি বলে টানাটানি করে যাওয়া। সেরকম যে কোনো কাজকেই ‘অভিসন্ধি’ বা ‘ষড়যন্ত্রে’র অংশ হিসেবে দেখা হবে। বরং ফণীন্দ্র কুমার দেবচৌধুরীর অবস্থানই সব চাইতে গণতান্ত্রিক। মিঞা কবিতা লিখতে লিখতে তাঁরা যদি কোনোদিন নিজেদের ভাষাকে ‘মিঞা ভাষা’ও নাম দিয়ে দেন—সেই বাস্তবতাকেও মেনে নেবার গণতান্ত্রিক বোধ অসমিয়াদের তো হওয়া দরকারই, প্রতিজন বাঙালির হওয়া দরকার, যদি তার নিজের সমানাধিকারের আকাঙ্ক্ষা হয় আন্তরিক।বাঙালির উচিত রাজবংশীদের ভাষা আন্দোলনকে উনিশের চেতনাতে সম্মান জানানো। সেই ভাষাকেও বাংলা বলে পশ্চিমবঙ্গীয় উগ্রজাতীয়তাবাদী শাসকশ্রেণির মতো গোঁ ধরা নয়।
যারা উনিশ নিয়ে কবিতা লেখেন এবং যারা মিঞা কবিতার লেখক--- তারা কেবল সম্প্রদায় এবং হিসেবেই ভিন্ন নন। শ্রেণি হিসেবেও ভিন্ন। উনিশ নিয়ে মুসলমান কবিতে লিখলেও ভিন্ন। পাশাপাশি দুই কবিতা সমাহার নিয়ে অধ্যয়ন করলেই দেখা যাবে, ‘মিঞা কবিতার কবিদের খেটেখাওয়া মানুষের শ্রেণি উৎসটি স্পষ্ট। যারা ময়মনসিংহী মুসলমানদের ‘বাঙালি করে’ কেবল ভাষার ভিত্তিতে জাতি গঠন করতে চান, তারা সেরকম দু’চারটি কবিতায় নিজেদের মুখখানা দেখে নিলেই বুঝে যাবেন, এতোদিনকার ‘অভিসন্ধি’ ব্যর্থ কেন হয়। আমরা একটি কবিতা পুরো তুলে দিলাম, লিখেছেন কাজি নীল। তাঁর হরফটিও হুবহু রেখে দিলাম।
মিঞা হয় নে নহয়
ৰাস্তায় পিচ দেওয়া কাম কৰতাছি
কালা আলকাতৰা আমাৰে প্ৰশ্ন কৰে
মিঞা হয় নে নহয়?
কালা আলকাতৰা আমাৰে প্ৰশ্ন কৰে
মিঞা হয় নে নহয়?
পিয়াসে গলা ফাঁটতাছে পানী খামু
ষ্টীলেৰ গেলাস আমাৰে প্ৰশ্ন কৰে
মিঞা হয় নে নহয়?
ষ্টীলেৰ গেলাস আমাৰে প্ৰশ্ন কৰে
মিঞা হয় নে নহয়?
ৰবিবাৰেৰ দিন হাটে যাইয়া খাড়াইছি
শালাৰ বিলাতী নাই আমাৰে সন্দেহ কৰে
মিঞা হয় নে নহয়!
শালাৰ বিলাতী নাই আমাৰে সন্দেহ কৰে
মিঞা হয় নে নহয়!
ৰইদে ঘাইমা অস্থিৰ গাছেৰ তলে জিৰাইতাছি
ছালছাড়া কুইত্তা আমাৰে জিজ্ঞাস কৰে
মিঞা হয় নে নহয়?
ছালছাড়া কুইত্তা আমাৰে জিজ্ঞাস কৰে
মিঞা হয় নে নহয়?
মাছ মাৰুম নামছি পাগাৰে
দুইটেহাৰ খেতাজাল আমাৰে হইছ কৰে
মিঞা হয় নে নহয়?
দুইটেহাৰ খেতাজাল আমাৰে হইছ কৰে
মিঞা হয় নে নহয়?
যামু বিয়াইন বাৰী সাইজা গুইজা বাইৰ হইছি
মৰাৰ লুঙ্গি আমাৰ মুহি আঙুল তোলে
মিঞা হয় নে নহয়!
মৰাৰ লুঙ্গি আমাৰ মুহি আঙুল তোলে
মিঞা হয় নে নহয়!
শিৱসাগৰে চাইটে গেছি লেবাৰি কৰুম
জাতিৰ দালাল আমাৰ ফেলে খেইদা আহে
কেলা মিঞা হয় নে নহয়!
জাতিৰ দালাল আমাৰ ফেলে খেইদা আহে
কেলা মিঞা হয় নে নহয়!
হয় বা নহয়েৰ কোনো বাইনাৰীতে আমি নাই
জবাব তো বাই উৰবো বাতাসে... হাওয়ায়...
জবাব তো বাই উৰবো বাতাসে... হাওয়ায়...
তাৰপৰেও আমি বেভোৰে কিসব ভাবতাছি
হঠাৎ এ কি! আমি নিজেৰেই নিজে প্ৰশ্ন কৰি
মিঞা হয় নে নহয়!!
হঠাৎ এ কি! আমি নিজেৰেই নিজে প্ৰশ্ন কৰি
মিঞা হয় নে নহয়!!
উনিশের কবিতা কেউ কখনো এরকমটি পড়েছেন? যতদিন না পড়েছেন, ততদিন কবির এই প্রত্যয়কে সম্মান জানানো ভালো,“আমার নাম আমি নিজেই বানামু একদিন/ নিজের দমেই।” হিন্দু মুসলমান, অসমিয়া-বাঙালি বিপ্রতীপ (বাইনাৰী) ধারণার বাইরে গিয়ে বিশ্বাস রাখা ভালো, “জবাব তো বাই উৰবো বাতাসে... হাওয়ায়...।”
‘লিগ্যাসি কোড ১৯.০৫.১৯৬১’ বইটির শেষ অধ্যায়। এ অনেকটা উপসংহার পুরো বইটির। এখানেও সেই আক্ষেপ—বরাকে ব্রহ্মপুত্রে, হিন্দুতে –মুসলমানে খণ্ডিত বাঙালি সত্তা নিয়ে। যে সংকটে পুরো বাঙালি সমাজ পড়েছে, “খণ্ডিত জাতি সত্তা নিয়ে বাঙালি এই সংকট প্রতিহত করতে পারবে না।” (পৃ:২০৪) যথার্থ। কিন্তু নেতৃত্ব নেবে কে? কে পালন করবে অগ্রণী ভূমিকা? বরাকের বাঙালি? যে মনে করে ব্রহ্মপুত্রের বাঙালি বরণ করে নিয়েছে ‘গামোছা সংস্কৃতি’? হয়ে গেছে অসমিয়া? ব্রহ্মপুত্রের বাঙালি? যে ভাবে তার বিপত্তির মূলে বরাকের সিলেটি? হিন্দু বাঙালি? যে ভাবে মুসলমানের জন্যেই তার যত দুর্দশা? মুসলমান বাঙালি? যেভাবে হিন্দু বাঙালি ভরসার যোগ্যই নয়? এক জায়গাতে কিন্তু অরিজিতও সামাজিক অভ্যাস বশেই সম্ভবত লিখে ফেলেছেন, “বাঙালি মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা এই বার্তা পৌঁছে দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তা নির্মাণে সদর্থক ভূমিকা নেবেন, এটাই সময়ের দাবি।” (পৃ:২০৫) বার্তাটি এই যে বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়ে যেসব হিন্দু এ-পারে এসেছেন, মানবতার মাপদণ্ডে তাদের বিচার করতে হবে। সমস্যা এই যে এহেন বিচারে আমাদেরও আপত্তি নেই। কিন্তু যারা ২০১৪তে রাজপত্র নিয়ে এলেন, ২০১৬তে নাগরিক আইনে সংশোধনী প্রস্তাব করলেন, তারা এবং তাদের প্রস্তাবের সমর্থক হিন্দু বাঙালির অধিকাংশেরই যে মনের ইচ্ছে, মুসলমান মাত্রেই অনুপ্রবেশকারী—এবং তাদের তাড়ানো চাই। ‘অনুপ্রবেশকারী’দের উপরে ব্রহ্মপুত্রে তো আক্রমণ হচ্ছেই, বরাক উপত্যকার শহরাঞ্চলেও সেই মুসলমান আর নিরাপদে নেই। সামান্য ছুতোতেই আক্রমণ নামছে। এবং ব্যবহৃত হচ্ছে ‘উদ্বাস্তুর আবেগ’,ব্যবহৃতও হচ্ছেন দলিত দরিদ্র মানুষ। এভাবে ‘মুসলমান বুদ্ধিজীবী’দের মানবিক বিচারের সুযোগটাই তো কেড়ে নেওয়া হচ্ছে,অমানবিকতার শিকার তো এদেশে অসমে মুসলমানই হচ্ছেন। তার পরে প্রশ্ন -- মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলে কিছু কি রয়েছে সেরকম? হিন্দুর সঙ্গে টেক্কা দেবার মতো? এই সব প্রশ্ন কি আমাদের মনে কাজ করে? ব্রহ্মপুত্রের চর অঞ্চলে শিক্ষার হার যে এখনো অতি কম, মাত্র ১৯% অরিজিতই তো লিখেছেন। বরাকে কি চেহারাটি অন্যরকম? যে ছোট্ট মধ্যবিত্ত অংশ গ্রামীণ কৃষিজীবী পরিবার থেকে গড়েও উঠেছেন তাদের মধ্য থেকে লেখক গবেষক শিক্ষক সাংবাদিকদের সংখ্যা কতটা? তাঁরা বার্তা দিলেও কোথায় দেবেন? মঞ্চ কোথায়? দু’চারটি মুসলমান মালিকানা কাগজ বা টিভি চ্যানেল থাকলেও কি সেগুলো মুসলমানের মুখ হবার মতো স্বাধীন? তবু তো নিত্যদিন হিন্দু মালিকানা কাগজে যেখানে সরাসরি মুসলমান বিদ্বেষ ছড়ানো হয়, সেখানে এবং মুসলমান মালিকানাধীন কাগজে, যেখানেও আসলে মুসলমান কর্মীরা সংখ্যালঘুই---দু’পাঁচজন মুসলমানে সম্প্রীতির কথাই লিখে চলেন। কার ঘাড়ে মাথা ক’টা যে বাংলাদেশের হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়া চলবে না বলে নিবন্ধ লিখবেন? বস্তুত, বার্তা তারা ঠিকই দিয়েছেন। বরাকে বহু ধর্মীয় সংগঠন এবং ব্যক্তিও নাগরিক বিলের পক্ষে কথা বলেছেন। বাকিরা নীরব থেকেছেন। ব্রহ্মপুত্রেও আত্মরক্ষার খাতিরে যদিও বা অনেকেই বিল বিরোধী স্থিতি নিয়েছেন,এবং ‘অসমিয়ার অস্তিত্বের’ পক্ষে সরব হয়েছেন, বাস্তবে কিন্তু বিল বিরোধী আন্দোলনে মুসলমান দুই উপত্যকাতেই অনুপস্থিত সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে। কেউ কি কিছু বার্তা পাচ্ছেন? আমরা তা মনে করছি না। যার কথা বলবার কোনো স্বাধীনতাই নেই, মঞ্চই নেই তার কথাতে কেউ বিশ্বাস করে না। কিছু ব্যক্তিকে বিশ্বাসে নিতে পারে, সমাজকে নেয় না।
তাই ২০১০এর ২১ জুলাই থেকে ২০১৭র ৩০ জুনে একাধিক মুসলমান মারা গেলেন এন আর সি, ডি-ভোটার প্রশ্নে। তাদের সেই অগ্রণী ভূমিকাতে কোনো সাড়াই দিল না হিন্দু সমাজ। ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৭তে বরাক উপত্যকার থেকে প্রথম যখন হিন্দু পক্ষ থেকেও আওয়াজ উঠল, সেখানকার মুসলমানও কিন্তু তাতে সাড়া দিলেন। সেই আগুনে জল ঢালতে নাগরিক বিলের জেপিসিকে বরাকে পাঠানো হলো দু’দিনের জন্যে। ব্রহ্মপুত্রে বাঙালি বিদ্বেষের আগুন জ্বলল। আবার সেই আগুনে ঘি জল ঢালতে দুর্বল নথি, ডি-ভোটারের পরিবারের বাকি সদস্যদের সন্ধান যখন শুরু হলো গোটা আসামে--- তিনসুকিয়াতে সর্বাধিক বাঙালি হিন্দুকে জেলে পোরা হলো। দেখা গেল, এর বিরুদ্ধে রাজ্যে সবচাইতে বেশি সরব হলেন জমিয়ত উলেমা সহ মুসলমান প্রধান সংগঠনগুলোই। ব্রহ্মপুত্রের বাঙালি হিন্দু সংগঠনগুলো যে কাগজে বিবৃতি দেবার বাইরে বিশেষ কিছু করল দেখা গেল না। কেউ কেউ বরং জেপিসির সামনে বিলের পক্ষে স্মারক পত্র দিয়েও, বিল বিরোধী সমাবেশে যোগ দিয়ে গা বাঁচালেন। মুসলমান সংগঠনগুলো কিন্তু প্রায় একাই লড়ে যাচ্ছেন, নিঃসঙ্গ প্রায়। তাঁদের নেতৃত্বে কিন্তু আলখেল্লাধারীরাই । তাতে কি সমস্যা কিছু হচ্ছে? এ যাবত তাদের অর্জনের সুবিধে বাঙালি হিন্দুও নিয়েছেন, নইলে এন আর সি-র পাইলট প্রজেক্টে তো কেবল ১৯৫১র ভোটার তালিকা, আর ১৯৬৬ ও ৭১এর ভোটার তালিকার কথাই বলা হয়েছিল। যে চৌদ্দটি নথি পরে এন আর সি কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে নিল সে তো ২০১০এর ‘বরপেটা কাণ্ডে’র মৃতপ্রাণদের দান। আজ অব্দি কি ২১ জুলাইর ভাষা শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানে সেসব কথা উচ্চারিত হলো? বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্তের কি উচিত নয়, তাতে অগ্রণী ভূমিকে নেওয়া?
কিন্তু অরিজিতের মতো কিছু ব্যতিক্রমী বাদ দিলে বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্তও সেই ভূমিকা নেবেন না। আমরা আশাও করি না। বিল বিরোধী আন্দোলনে কিছু বাম ব্যক্তিত্বের উগ্রজাতীয়তবাদী প্রবণতারই মতো, বরাকে বিল সমর্থনের আন্দোলনে কিছু বাম ব্যক্তিত্বেরও হিন্দুত্ববাদী ঝোঁক করুণভাবে সামনে চলে এসেছে। রাজ্যের কোথাও তা আর গোপনে নেই। তারা অন্তর থেকে বিশ্বাস করেন, ৭১এর পরে আসা মুসলমান রাজ্যে নেই। সুতরাং মুসলমানের পীড়িত হবার প্রশ্নই নেই। যা কিছু পীড়নের শিকার ‘প্রান্তিক হিন্দু’। বাংলাদেশেও। অসমেও। এবং তাঁরা আশা করছেন, মুসলমানের উচিত সেই সব হিন্দুর পাশে দাঁড়ানো। নিজেদের তাঁরা অসাম্প্রদায়িক বলেও দাবি করছেন। কিন্তু সাহস করছেন না, এই কথা বলবার, যে মুসলমান অনুপ্রবেশকারী তাড়াবার প্রচার বন্ধ করো। ‘মুসলমানে দেশ নিয়ে গেলে টের পাবে’—এহেন ‘হিন্দু বাঙালিয়ানা’র বিদ্বেষ বন্ধ করো।
অন্যদিকে এন আর সি যন্ত্রনা নিয়ে যে পক্ষটি বরাক থেকে হিন্দু মুসলমান বাঙালি ঐক্যের ডাকও দিচ্ছেন—তাঁদের ভূমিকা সম্পর্কে তো অরিজিতই লিখেছেন,“এন আর সি নিয়ে বাঙালি অধ্যুষিত বরাক উপত্যকায় আবেগের যে আস্ফালন হচ্ছে, সে আস্ফালনে যুক্তির ধার নেই। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার লক্ষ লক্ষ বাঙালির কথা চিন্তাই করছেন না বরাকের এই প্রতিবাদীরা। বরাকের এই বাঙালিরা চান, ভাষার ইস্যুতে, জাতির ইস্যুতে কলকাতার বাঙালি তাঁদের পাশে থাকুন, কিন্তু তাঁরা নিজেরা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালির পাশে থাকবেন না। এ কেমন স্ববিরোধিতা?” (পৃ: ২০৫) অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্যের আজকালে লেখা ‘আসামে বাঙালির শরসয্যা’ প্রবন্ধ, আগেপরে সেখানে অনেকগুলো সভা এবং তার পরবর্তী বিতর্ক, ব্রহ্মপুত্র বাঙালির পালটা উদ্বেগ এর নজির।
অন্যদিকে এন আর সি যন্ত্রনা নিয়ে যে পক্ষটি বরাক থেকে হিন্দু মুসলমান বাঙালি ঐক্যের ডাকও দিচ্ছেন—তাঁদের ভূমিকা সম্পর্কে তো অরিজিতই লিখেছেন,“এন আর সি নিয়ে বাঙালি অধ্যুষিত বরাক উপত্যকায় আবেগের যে আস্ফালন হচ্ছে, সে আস্ফালনে যুক্তির ধার নেই। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার লক্ষ লক্ষ বাঙালির কথা চিন্তাই করছেন না বরাকের এই প্রতিবাদীরা। বরাকের এই বাঙালিরা চান, ভাষার ইস্যুতে, জাতির ইস্যুতে কলকাতার বাঙালি তাঁদের পাশে থাকুন, কিন্তু তাঁরা নিজেরা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালির পাশে থাকবেন না। এ কেমন স্ববিরোধিতা?” (পৃ: ২০৫) অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্যের আজকালে লেখা ‘আসামে বাঙালির শরসয্যা’ প্রবন্ধ, আগেপরে সেখানে অনেকগুলো সভা এবং তার পরবর্তী বিতর্ক, ব্রহ্মপুত্র বাঙালির পালটা উদ্বেগ এর নজির।
সুতরাং ‘কাঠালের আমসত্ত্বে’ আমাদেরও আস্থা নেই বিশেষ। আমরা আশা করছি, যে এন আর সি হয়ে যাবার পরে বাদ পড়ে যাওয়া মানুষ নিয়ে কী হবে---সেই নিয়ে অসমিয়া সমাজ দ্বিধা বিভক্ত হবেন। একদল ফ্যাসিবাদী কায়দাতে বলতেই পারেন, এদের ডিটেনশন ক্যাম্পে পুরে রাখো। তাতে যে অসমিয়া সমাজেরও সম্মান কিছু বাড়বে না, সেসব বুঝবার মতো বহু অসমিয়া গণতান্ত্রিক মন তখন সামনে আসবে। এবং তাতে যে বিতর্ক দেখা দেবে---তাতেই অসম চুক্তির মতো হলেও ‘মন থেকে না নিলেও মেনে নেবার’ মতো কিছু ঐকমত্য গড়ে উঠবে। ইতিমধ্যেই হীরেন গোঁহাই গত ১৩ জুলাই আমার অসমে একটি প্রবন্ধ লিখে দাবি করেছেন, এন আর সি থেকে বাদ পড়া মানুষকে তৎক্ষণাৎ বিদেশী ট্রাইব্যুনালের কাছে পাঠানো উচিত নয়। ধনিরা টাকা দিয়ে দলিলাদি সংগ্রহ করে ফেললেও দরিদ্ররা আইনত নাগরিক হলেও দলিলাদি নাও থাকতে পারে। ইত্যাদি। তিনি যে মাস কয় আগে এই নিয়ে দিল্লিতে এক সভাতে উপস্থিত হবার ফলে ‘মাদানি পার্টি’র প্রতিষ্ঠাতার অভিধা পেয়েছেন, থানাপুলিশও তাঁকে এবং তাঁর সহকর্মীদের করতে হয়েছে সেই সত্যও যেন আমরা ভুলে না যাই। মুসলমানকে সঙ্গে নিয়ে ‘অসমিয়া জাতিগঠন প্রক্রিয়ার’ রাজনীতি করবার স্বার্থেও তাঁকে এই লড়াইতে থাকতে হবে। আর তর্কের খাতিরে তিনি বাঙালি হিন্দু প্রশ্নে নীরব থাকবেন মেনেও যদি নিই, তবু এই মানতে অসুবিধে কই যে এ যাবত মুসলমানদের তাবৎ লড়াইর সুবিধে হিন্দুরা ভোগ করেছেন, বিল বিতর্ক বাদ দিয়ে। অসমিয়া সমাজেরও একটি বড় অংশের বাসনা আছে, বাংলাদেশী প্রশ্নটি চিরদিনের জন্যে অসমের রাজনীতির থেকে বিদেয় হোক, আর বাকি রুটি রুজির প্রশ্ন সামনে চলে আসুক। কারণ রুটি রুজির প্রশ্ন জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে বিব্রত রাখে। তার পরেও যেটুকু অসমিয়া জাতীয়তাবাদ এবং হিন্দুত্ববাদের দাপট থাকবে—তার বিরুদ্ধে যদি অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্তার লড়াইকেও দাঁড়াতে হয়, তবে সে মধ্যবিত্তকে দিয়ে হবে না। বাঙালি বানিয়াদের কিছুই যায় আসে না, তারা ভাষা সংস্কৃতি বিপন্ন হলে। সাধারণ সাংস্কৃতিক সমাবেশে আর ধর্মীয় সমাবেশে লোক জড়ো হবার অনুপাতই তা স্পষ্ট দেখিয়ে দেয়। বাঙালি বানিয়া এখনো অসম তথা পূর্বোত্তরে মাড়োয়ারিদের ছোট শরিক তথা দিল্লির শাসক শ্রেণির সহযোগী মিত্র অসমিয়া মধ্যবিত্তেরই মতো। হিন্দু ঐক্যের ডাকে তারা তাই সহজ বোধ করে। তার বিপরীতে মুসলমান ঐক্যের ডাক একটি সীমার বাইরে কোনো কাজে আসেনা বোঝবার মতো বুদ্ধি মুসলমানের রয়েছে। নির্বাচনেও তারা মুসলমান প্রার্থীকে নয়, সেই প্রার্থীকেই পছন্দ করেন যিনি প্রথমত হিন্দুত্ববাদী এবং দ্বিতীয়ত উগ্র-অসমীয়া জাতীয়তাবাদীদের পরাস্ত করবেন। সম্প্রতি অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্যের আজকাল পত্রিকাতে প্রকাশিত লেখা এবং একই সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমে হীরেন গোঁহাইর জাতীয়তবাদী এবং দুজনেরই বামপন্থী অবস্থান নিয়ে জোর বিতর্কের সময়ে তাত্ত্বিক এবং সমাজ কর্মী অরূপ বৈশ্য নিজের ফেসবুক দেয়ালে লিখেছেন এরকম,“বামপন্থী বলতে আমি তাদেরকেই বুঝি যারা শ্রমিক শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সবকিছুকে বিচার করেন। সেই হিসেবে আমরা হীরেন গোঁহাইর কঠোর সমালোচক, আর তপোধীরবাবুর সমালোচক ততটুকু যতটুকু তিনি নিজেকে বাঙালি জাতির প্রতিনিধি মনে করেন। আসামের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে এটা জলজল পটপট যে মধ্যশ্রেণির একাংশ বিত্ত পুঁজির চেইনে ঢুকে গেছে, আগে যারা স্থানীয়ভাবে ঠিকা পেতেন তারা এখন এডিবি-বিশ্বব্যাংক ফাণ্ডেড দেশি-বিদেশি বহুজাতিক ঠিকাদার কোম্পানির স্থানীয় এজেন্ট, তাদের কোনো স্বাধীন সত্তা নেই, স্বাধীন কোনো আঞ্চলিক বুর্জোয়া নেই - যারা আছেন তাদের মৃত্যু পরোয়ানা ঘোষিত হয়ে গেছে, ছোট ব্যবসায়ীরা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে, দিল্লির অথবা বৃহৎ মিডিয়া ব্যারনদের কৃপাধন্য না হয়ে মিডিয়া চালানোও মুস্কিল, নব প্রজন্মের মধ্যবিত্তের বড় অংশ সস্তা মানসিক শ্রমে বড়-বুর্জোয়ার সেবা করতে বাধ্য হচ্ছে, মোটা মাইনের এক ক্ষুদ্র শিক্ষিত অংশ আয়েশের মধ্যে থেকে জাতীয়তাবাদের গান গাইছে। প্রাদেশিক ক্ষমতা গ্লোরিফায়েড মিউনিসিপালিটির মত, সুতরাং আঞ্চলিক মধ্যবিত্তের ক্ষমতা সীমিত। এই গোটা মধ্যবিত্তের নেতৃত্বের পক্ষে সুস্থ জাতীয়তাবাদের নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব নয়, তাই জাতীয়তাবাদ, তা অসমীয়া কিংবা বাঙালি যাই হোক, বৈচিত্র্যের অভ্যন্তরে প্রতিযোগিতায় অধ:পতিত হয়েছে, আর জাতীয়তাবাদ বিকাশের প্রধান বাধা বিত্ত পুঁজি ও তাদের সেবাদাস অতি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ক্ষমতা খেলা দেখছে, প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করবে বলে। উল্টোদিকে গসিপ করার ও গ্রাম সমাজকে পৃথিবী ভাবার কৃষক অর্থনীতি প্রায় সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত, তার জায়গা নিয়েছে এক নতুন ও বিশাল অসংগঠিত শ্রমবাহিনী যারা জাতি-ধর্ম-বর্ণের দিক দিয়ে মিশ্র প্রকৃতির, কাজের ও বেঁচে থাকার দৈনন্দিন সংগ্রামের সূত্রে এক অসচেতন ঐক্যে আবদ্ধ। এই অসচেতন ঐক্যকে সচেতন ঐক্যের দিকে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে এই প্রতিযোগিতামূলক জাতীয়তাবাদ উল্টোদিকে অর্থাৎ ঐক্য ভাঙার দিকে পরিচালিত করার বিপদ সৃষ্টি করে। এখনো যে কোনো পক্ষই সাধারণ মানুষের তেমন কোনো সাড়া পাচ্ছে না তার আসল রহস্য এখানেই নিহিত। এই বাস্তবতাকে সামনে রেখেই বামপন্থী দায়িত্ব নির্ধারণ করা জরুরি। বামপন্থার পুনর্জাগরণের জন্য এ এক উত্তম সুযোগ, যদি না বামপন্থীরা প্রতিযোগিতামূলক জাতীয়তাবাদে গা ভাসিয়ে দেন, আর মধ্যবিত্তের নতুন মানসিক শ্রমে যুক্ত অংশ সুস্থ গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদের ধ্বজা তুলেন। আশার কথা এই যে নতুনভাবে দেখতে সক্ষম একদল নতুন প্রজন্মের আওয়াজ ক্ষীণ হলেও শুনতে পাওয়া যাচ্ছে।” এই যুক্তির তিনি বিস্তৃত ব্যাখ্যা রেখেছেন নিজের স্বাভিমান ব্লগে একটি ইংরেজি প্রবন্ধে ‘Assam imbroglio anddemocratic politics’ শিরোনামে। গতিকে আমরা অরিজিতের তাবৎ গণতান্ত্রিক চিন্তা এবং প্রস্তাবকে সম্মান জানিয়েও ‘কাঠালের আমসত্ত্ব’ তত্ত্বের সম্ভাবনাকে নাকচ করে কাজি নীলের সেই মিঞা কবিতাতে এসে মনে হয় নির্বিঘ্নেই দাঁড়াতে পারি,
হয় বা নহয়েৰ কোনো বাইনাৰীতে আমি নাই
জবাব তো বাই উৰবো বাতাসে... হাওয়ায়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন