“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ১৯ জুলাই, ২০২৫

“খাইকে পান বেনারস-ওয়ালা”

  “খাইকে পান বেনারস-ওয়ালা”


যে পথ ধরেই হাঁটো, হাঁটি – সেই পথই, অন্তিমে ……।

অন্তিমে যায় কবর, শ্মশানের সত্যে কিংবা অনন্তের মিথ্যায়। ঠিক। তথাপি তার আগেও পথ, আমার, দেখি বেঁকে যায়,শুধুই বেঁকে যায় – কোন দিকে? কোন চুম্বকের টানে?

“বাবুল মোরা নৈহার ছুট হি যায়”। প্রথম শুনেছিলাম রেডিওতে ভেসে আসা। শুনেছিলাম সাইগল সাহেবের কন্ঠে। “বাবুল মোরা নৈহার ছুট হি যায়” – এখনো, এখনই শুনছি। শিল্পীজন কবিতা কৃষ্ণমূর্তি। হ্যাঁ, সেই কবিতা কৃষ্ণমূর্তি যাঁকে ‘শিরখিত’রা জানে ‘ফিল্মি গানের’ ‘আর্টিস্ট’ বলে। ‘ফিল্মি গানের’ ‘আর্টিস্ট’ বলেই শুধু। বালক-সময়ে দেখেছি নিজ পিতা সহ আরো অনেক শিক্ষিত,ভদ্রজনের ‘শিরখিত’ হয়ে যাওয়া – “ফিল্মি গান” বাক্যবন্ধে। “ফিল্মি গান অপো-সোমসকৃতি”। সমোসা’র মতো। তার যেন কোনো জাত নেই। ওপি নাইয়ার থেকে বাপ্পী লাহিড়ি, রফি, কিশোর – সবই। “এক্সেপশন” দেওয়া হতো সাইগল সাহেব বা শচীনকর্তা’কে। কিন্তু কেন? তারাও জানতো না। – বালক বয়সেই, অকালপক্কতার আশীর্বাদে এই সকল প্রশ্ন তুলে বকাঝকা খেয়েছি। প্রশ্নগুলি তুলবার অন্দরে, তখন কোনো ‘চিন্তা’ ছিলনা। ছিল ভালবাসা। “তুম্‌ বিন যাঁয়ু কাঁহা”, “বদন পে সিতারে লপেটে হুয়ে”, “জানিনা কোথায় তুমি হারিয়রে গেছো, আর পাবো কি’না – জানে-জান ঢুন্ডতা ফির রাহা” – যাঁরা গেয়েছেন, যাঁরা আরোপ করেছেন সুর, যাঁরা যন্ত্র অনুষঙ্গে, যাঁরা লিখেছেন – তাঁদের প্রতি ভালবাসা’ই তখন করিয়েছে প্রশ্নগুলি। ওই ভালবাসাই বন্ধুর বাড়ি থেকে স্পিকার ধার করে এনে, টেপ রেকর্ডারে “ও সাথীরে, তেরে বিনা ভি ক্যা জিনা” – বাড়িতে, বাবার সবান্ধব স্টাডি সার্কল দিনে বাজিয়ে দেওয়ার বিদ্রোহও ওই ভালবাসারই ফসল। … পরে, বহু বহু পরে টের পেয়েছি, যে, যে কোনো বিদ্রোহ, যে কোনো বিপ্লব – কোনো না কোনো ভালবাসারই ফসল। 

গো পাঠিকা, হে পাঠক, বিদ্রোহ-বিপ্লব আর ভালবাসার সম্বন্ধ বিষয়ে অন্যত্র বার্তালাপ হবে। অবশ্য হবে। আপাতত বলি, যে, যে “শিরখিত” দিগের বিপক্ষে বিদ্রোহ করেছিলাম, যেহেতু আমিও আদতে সেই শ্রেণীরই – যাদের ‘শ্রম’ বলতে মাস্টারি, ডাক্তারি,উকিলী, দালালি, ম্যানেজারি, যাদের সরাসরি ভূমিকা নেই নৈমিত্তিক চাল-ডাল ফলানোর পরিশ্রমে, ভাগ নেই সাইকেল-রিক্সা বানানোর, বনে উঠবার প্রক্রিয়ায় – কিন্তু যারা ডালভাত খায়, সাইকেলে চেপে ‘কাজে’ যায়-আসে, বেতন-বোনাস পায়। না পেলে “আন্দোলন” করে। — সেই শ্রেণীরই, সেই পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীরই আমিও একজন ফলে “ফিল্মিগান ওপো-সমোসকিতি”রই যমজ বীজ, আমার শ্রেণীর স্বাভানিক নিয়মেই, নিজের অজান্তেই আমার মধ্যেও বেড়ে উঠছিল। উঠেছিল। টের পাইনি। বহুদিন। বহুদিন “বাবুল মোরা” মানে সাইগল হয়ে গিরীজা দেবী, ভীমসেন, কিশোরী আমানকার হয়ে বড়জোর জগ্‌জিৎ সিং। বহুদিন “কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি” মানে শুধুমাত্র শান্তিদেব-সুচিত্রা। – ইত্যাদি। অর্থাৎ অজান্তেই সেই দেখা-চোখ, সেই ভাবা-মন যা আদতে এক রকমের ব্রাহ্মণ্যবাদই, তা’ই আমিও, উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করছিলাম। তফাত এই, যে, আমার লিস্টিতে – কিশোর,রফি,মুকেশ থাকলেও কুমার শানু,অনুরাধা পাড়োয়াল থেকে কবিতা কৃষ্ণমূর্তি — অঘোষিত ওপো-সমোসকিতি”রই যমজ।

টেপ রেকর্ডার চালিয়ে, বাবার মুখামুখি বসে রবিগান,নজরুলগান, “জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা”, রাণার – ইত্যাদি শোনা যেতো। “আ চলকে তুঝে” চালালে, বাবা উঠে যেতো আর “দে দে প্যার দে” — প্রশ্নই নেই। তার অর্থ এই, যে, বাবা’র প্রজন্মের যা কিছু আমার পছন্দের, সেখানেই সামান্য যা কিছু বিনিময়। তার বাইরে …

তার বাইরে “গ্যাপ”। “জেনারেশন গ্যাপ”। “প্রজন্মগত দূরত্ব”। 

আমার বেড়ে উঠবার প্রত্যন্ত মফস্বলেও শব্দবন্ধটি অনেকদিন তূলোবীজের মতো উড়ে উড়ে নামিয়ে এনেছিল প্রায় কুয়াশাই। এবং এক প্রলম্বিত সময় জুড়ে এই শব্দবন্ধটিকে ‘বাস্তব’ বলে মনেও হয়েছিল, আমার, আমাদের। মনে হয়েছিল, আজ টের পাই, যে, আমরা বাধ্য ছিলাম, আমাদের পূর্ব বা তারো পূর্ব প্রজন্মও বাধ্য ছিল। কেননা এই রকমের ধারণার নির্মাণ ও বিস্তার অদ্যকার নয়। ১ম মহাযুদ্ধের পর থেকেই মাথাচাড়া দিতে থাকা এই উদ্ভাবন-চেষ্টা, অন্তিমে, ২য় বিশ্বযুদ্ধ-দিনের বা তার অব্যবহিত পরে পূর্ণরূপে উদ্ভাবিত – যে উদ্ভাবনের আবডালে Talcott Parsons, Karl Mannheim হেন ব্যক্তিরা ছিলেন এবং প্রচার যন্ত্র ছিল তাদের পক্ষে। পক্ষান্তরে  জি.লুকাকস (Georg Lukács b.1885), কে. ম্যানহাইম (Karl Mannheim b.1893), এইচ. মার্কুস (Herbert Marcuse b.1898), সি. রাইট মিলস (C. Wright Mills b.1916), লুই আলথুসার (Louis Althusser b. 1918) – প্রমুখরা, নানান সময়ে, নানান প্রতিযুক্তিতে খারিজ করেছেন “জেনারেশন গ্যাপ” / “প্রজন্মগত দূরত্ব” শব্দবন্ধটির ‘বাস্তব’ হওয়ার গালগল্প। – এ সকল বিষয়ে সম্যক জেনেছি অনেক অনেক অনেক পরের সময়ে, বয়সে। জানবার সঙ্গে সঙ্গে এ’ই স্পষ্ট হয়েছে, যে, কেন আমাদের পূর্ব বা তারও পূর্ব প্রজন্ম জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে বিশ্বাস করেছে, যাপন করেছে দৈনন্দিনে। প্রসঙ্গত মনে আসে “নায়ক” ছবিতে হলিউড বোদ্ধা উঠতি নায়ক আর তার আগের প্রজন্মের যাত্রা-ঘেঁষা অধুনা বয়স্ক পড়তি নায়কের কথোপকথন। নব্য নায়ক, যেহেতু ছবিটি হবে বংকিমের “দেবী চৌধুরানী” নিয়ে, ফলে, সে উপন্যাসটি ও তার সামাজিক প্রেক্ষাপট বিষয়ে পড়াশোনা করে জেনেছে, যে, সেই যুগে পিতাপুত্র কথোপকথন একই সুরে হতোনা। পিতার সুর থাকতো সতত উঁচু তারে বাঁধা। কিন্তু অধুনা বয়স্ক অভিনেতাটি এইসবের ধার ধারেনা। সে তার উচ্চগ্রামে ডায়লগ বলবার ম্যানারিজমে বাঁধা। “দেবী চৌধুরানী” লিখিত হয় ১৮৮৪ তে যা জিমিদারি প্রথার “চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত” (১৭৯৩) দ্বারা গলায় রক্তওঠা যুগ আর দেবী চৌধুরানী উপন্যাসের আবহও তার সামান্য আগ-কালের অর্থাৎ “জেনারেশন গ্যাপ” উদ্ভাবিত হওয়ার অনেক অনেক পূর্বের। তথাপি পিতা-পুত্র তখনও সখা নয়। হাতে গোনা নজির যদিবা মেলেও তাহলেও সেগুলি অত নগণ্য। এখানে প্রশ্ন,পিতা-পুত্র তখনও সখা নয়, ঠিক, কিন্তু কোন পিতা-পুত্র? জমিদার পিতা-পুত্র। পিতা জমিদার। পুত্র উত্তরকালের জমিদার। তাদের একসঙ্গে মাঠে যেতে হয়না – চাষা বাপছেলের মতো, একত্রে। লাংগল চষতে হয়না একই সঙ্গে। বা বাপের করা ফসল কাঁধে করে নিয়ে গিয়ে দিয়ে আসতে হয়না জমিদারবাবুর অট্টালিকায় কিংবা বেচতে হয়না বাজারে। অনেক ক্ষেত্রেই জমিদার পিতার জমদারী খেল্‌ পুত্রকে শিক্ষা করতে হতো নায়েব বাবুর মধ্যস্ততায়। ফলে একের, অন্যের নিজ-নিজস্ব বিশ্বের, খোঁজ খবর না রাখলেও চলতো। প্রায় সমকালীন প্রেক্ষাপটে লিখিত “নীলদর্পন” নাটকে জমিদার ও তার পরিবার তথা সাঙ্গপাঙ্গ দিগের নিজেদের মধ্যে বার্তালাপের সঙ্গে চাষী পরিবারগুলির অন্দর মহলের বাতচিতের তুলনা করলেই এ হয় স্পষ্ট, যে, দুইটি প্রজন্মের মধ্যে বাক্যালাপের সুরটি আদতে নির্নীত শ্রেণীর দ্বারা। শ্রেণী অবস্থানের দ্বারা। “নায়ক” চলচ্চিত্রের সেই একদা স্টেজ-হল্‌ কাঁপানো অভিনেতা, যিনি তখন বয়স্ক, তাঁর গর্জে ওঠা, উঠতি ছোকরার উপরে, সে’ও কি নয় আদতে শ্রেনী সম্পর্ক? আভিধানিক অর্থে দুইটি চরিত্রই পেটি বুর্জোয়া। পেটি বুর্জোয়া আর্টিস্ট। তথাপি, শ্রেনীর অন্দরেও থাকে শ্রেনী। যেমন ভাগ চাষী আর সম্পন্ন চাষী। তেমনি হাভাতে পেটি বুর্জোয়া আর ফেলেছড়িয়ে খাওয়া পেটি বুর্জোয়া। উঠতি অভিনেতাটি তখনো প্রায় হাভাতে। কিন্তু এই সিনেমারই একটি পর্বে আমরা দেখবো, উঠতি অভিনেতা যখন ‘প্রতিষ্ঠিত’, যখন সে ফেলেছড়িয়ে খাওয়া পেটি বুর্জোয়া তখন, ভাগ্য বিপর্যয়ে আগের দৃশ্যের একদা স্টেজ-হল্‌ কাঁপানো অভিনেতা, অধুনা, হাভাতে পেটি বুর্জোয়া। আমরা দেখব ঠিক কিভাবে কথা বলবার স্বর, সুর, বলা বাক্য – সমস্তই পালটে গিয়েছে। – অর্থাৎ প্রজন্ম, “বয়সের সম্মান” এসমস্ত কিছুই নয় ভাব বিনিময়ের প্রকৃত বাস্তবতা। সমস্তই নিহিত আর্থ সামাজিক অবস্থানে। চাষা আর তার ছেলের বা নাতির একত্র বসে বিড়ি টানা ভিন্ন উপায় নেই। একত্র সিগারেট টানা ভিন্ন গতি নেই কলকারখানায় কাজ করা বাপ-ব্যাটা’র, দাদু-নাতির। কিন্তু যে শ্রেণী নিজে শ্রম করেনা, তার পক্ষে এই সকল বিলাসিতা সম্ভব। সম্ভব সামান্য বিড়ি-তামাক সামনে-আফরকে টানাকে কেন্দ্র করে ক্ষমতা এবং সম্মান দেখানো না-দেখানোর নব্য মনু সংহিতা বানিয়ে তোলা। লক্ষ্যনীয় “গণদেবতা” উপন্যাসে গ্রাম-সভা’র ডাকে সভায় যোগ দিতে আসা অনিরুদ্ধ, যে শহুরে, যার মর্মে সামন্তবাদী সম্পর্কগুলিীসেপড়া বুর্জোয়া “শিক্ষাদীক্ষা” হেতু, ক্রমেই ভেঙ্গে যাচ্ছে, সে, তার হাতের সিগারেট টি, সভাস্থ সকলকে দেখিয়েই, শেষ্টান দিয়ে ফেলে দিয়ে সভায় আসে। একই ব্যবহার তারাশংকরের “জলসাঘর” এ দেখা যায়। চলচ্চিত্র “জলসাঘর” এ একই বিষয় দৃষ্ট হয় কিন্তু সামান্য অন্য ভাবে আর এই “সামান্য অন্য”ই দেয় ইঙ্গিত, সত্যজিত রায়ের নিজ শ্রেণী চরিত্রের। – এ’ও শুধু সূত্রাকারেই থাকবে এখন। কেননা এই মুহুর্তে এ নয়, গো পাঠিকা হে পাঠক, আমার এই মুহুর্তের প্রতিপাদ্য।

“খাইকে পান বেনারস-ওয়ালা” গান কর্ণশূল ছিল বাবার। বাবার প্রজন্মের অনেকেরই। কিন্তু কেন? গানের জাত বিচার করে দেখলে দেখা যাবে, এই “টোন” আদতে সেই সুর যাকে “ফোক” বলে নৃত্য করা হয়েছে তখন, হচ্ছে এখনো। গায়কীর অন্দরে রয়েছে কিশোরকুমারের অসাধারন ‘কাজ’। গলার। গায়কীর। তাহলে কেন কর্ণশূল? কেন আমার কাছেও কর্ণশূল মনে হতো কবিতা কৃষ্ণমূর্তির কন্ঠে রবিগান? এখানে, গো পাঠিকা হে পাঠক, বলে রাখি, যে, আশা কিংবা লতা মঙ্গেশকারের রবিগান এতাবৎ আমার বিবমিষা উদ্রেককারী। একটু এগিয়ে গিয়ে, ব্যাখ্যা ছাড়াই বলেরাখি, যে, এর হেতুটি গান গুলির গায়কীতে এই দুই সঙ্গীত মাফিয়ারই, অসততা শিলালিপি হেন। পক্ষান্তরে ওই সময়েই কিশোরকুমার গীত রবিগান, আমার, অদ্যাপি প্রিয়। কিশোরকুমার গীত রবিগান, আমার, অদ্যাপি প্রিয়। কিশোরকুমার গীত রবিগান, আমার প্রিয় ক্লাশ সেভেন আমল থেকেই। আজ ভাবি, এই একটি বীজ আমাতে প্রোথিত, ভাগ্যে, হয়ে গিয়েছিল, কখনো। 

ফিরি সেই প্রশ্নে “খাইকে পান বেনারস-ওয়ালা” আমার বাবা-জেঠা প্রজন্মের কর্ণশূল। কেন?

এমন কি রেজওয়ানা চৌধুরি’র রবিগানও কেন বহুদিন ছিল আমার কর্ণশূল?

ছিল আমার শ্রেণী চরিত্র হেতু। নিজের অজান্তেই আমিও আমার মনু সংহিতা’তে একুশে আইন লিখে ফেলেছিলাম।

ওই আইন গুলি থেকে মুক্তি, ভাবি খনোই হতো কি, যদি না সামান্য সময়ের জন্য হলেও – প্রথমত রাজনীতি করতে গিয়ে, পরে, আই-টি প্রো হওয়ার পূর্বে, টাটাবাবার কারখানায় – কাজ না করতাম যদি? যদি না শুনতাম, ক্রেন-গাড়ি চালক, প্রায় ক-অক্ষর গোমাংস স্বপনের গলায় ভুলে-চুলে গাওয়া রবিগীতি, নজরুল সঙ্গীত। – এই সকল শোনাও কাজে আসতোনা, যদি –

যদি স্নেহ, অপত্য এসে খুলে না দিতো দরজাটি।

পুত্র।

তার বেড়ে উঠবার সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গীত রুচি হ’তে লাগলো নিজস্ব।

ঠিক যে বয়সে আমার হয়েছিল।

কিন্তু, কলেজ-পড়ানো আমার বাবা, যারা ওই “জেনারেশন গ্যাপ” প্রচারের শিকার, তারা আমার নিজস্ব রুচিকে, সঙ্গীত রুচিকে, পেটি বুর্জোয়া, বিশেষত ভারতীয় পেটি বুর্জোয়া শ্রেণী মনোস্বত্বের নিমিত্তই, বুঝে দেখতে আসেননি। পক্ষান্তরে আমি, আইটি-প্রো হলেও, আদতে তো মাইগ্রেন্ট লেবার, বাস করি দেশগ্রামের হাজার মাইল, আদতে হাজার আলোকবর্ষ দূরের নগরে, ফলে আমার সঙ্গ-সঙ্গীর অভাব। ছেলেমেয়ে’র দিকে বেশী করে ধাবিত হই সেই ফাঁকটি পুষিয়ে নিতে। এতদ্‌ভিন্ন এইটুকু সচেতন চেষ্টা, যেহেতু মার্ক্সবাদের ছাত্র মনে করি নিজেকে, সেইহেতু, নিজের মধ্যেকার পেটি বুর্জোয়া ‘আমি’ গুলির ঋণাত্মক মুখগুলিকে চিহ্নিত করতে। ক’রে নিয়ে, চেষা নিতে সেগুলিকে সমঘার করবার। – না, এইভাবে শ্রেণীহীন-ডি-ক্লাসড্‌ হওয়া যায়না। তথাপি, এ’ও তো দেখেছি যে, মূলত “রাইয়ৎ” প্রশ্নে, জমিদার রবিবাবু’র স্পষ্ট অবস্থান ছিল জমিদারী প্রথারই বিপক্ষে। বিষয়টি প্রথম লক্ষ্য করে ভ’য়ে ভ’য়ে ছিলাম – পাছে ‘শ্রেণীশত্রু’, ‘স্টেট-এজেন্ট’ ইত্যাকার সীল না মেরে বসে অন্যেরা। সাহস পেয়েছিলাম প্রায় বিস্মৃত কিন্তু অত্যন্ত সঠিক চিন্তক, বামপন্থী ইতিহাস আলোচক নরহরি কবিরাজের লেখা পড়ে। সে’ও সেই বারো কেলাস নাগাদ। সম্প্রতি তাঁর অনেক গুলি প্রবন্ধ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে শোভনলাল দত্তগুপ্ত’র সম্পাদনায়।

ফিরে আসি নিজের কথায়। নিজ দরকারেই চেষ্টা নিতে লাগলাম পুত্রের নিজস্ব সঙীতরুচি অনুধাবনের। পুত্র, ক্রমে চরম-বাম রাজনীতিতে যুক্ত হলো। এ’তে তারও অনেকগুলি, আরো অনেকগুলি বন্ধ তোরণ, মনের, গেলো ভেঙ্গে। দেখলাম আমাহেন কোনো নব্য, নিজস্ব মনু সংহিতা তার নেই। ক্রমে দেখলাম, নেই কন্যারও। এতে এক রকমের সাহস পেলাম। উদ্যম, উৎসাহ পেলাম। সুচিত্রা’র “কৃষ্ণকলি” শুনে, শুনলাম রেজওয়ানার, রাজেশ্বরী দত্ত’তে থেমে না গিয়ে অদিতি মহসিনে গেলা “বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল” আনতে। দেখলাম, পাচ্ছি। দেখলাম পারছি। টের পেলাম “যে রাতে মোর দুয়ারগুলি” – বেস্ট শুধু রাজেশ্বরী আর দেবব্রত বলা’র অর্থ, মনে করবার অর্থ, আদতে পরোক্ষ বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনের মতোই বানানো, সাজানো মিথ্যা। … সাহসে ভর করে চালিয়ে দিলাম কবিতা কৃষ্ণমূর্তির রবিগান। লিখতে লিখতে, এই মুহুর্তে, যেন কানে বাজছে তাঁর গাওয়া “অরূপ, তোমার বানী”। যন্ত্রানুষঙ্গ নানা গানে, নানা স্থানে — আমার কানের সঙ্গে এখনো মেলেনা কারণ আমরা রবিগান মানেই “যন্ত্রানুষঙ্গ দূর্বাদল চট্টো” দেখে এবং শুনে কাটিয়ে দিয়েছিম অনেক যুগ। 

কি এই যাত্রার অর্থ?

এই যাত্রার, অনেক মাত্রা’র একটি এই, যে এটি টের পাওয়া – আমার সঙ্গে আমার পুত্রকন্যার দূরত্ব ঠিক ততোটুকুই, যতোটুকু দুটি ব্যক্তির মধ্যে না থাকলে ‘ব্যক্তি’ শব্দের অর্থই থাকেনা। কিন্তু সে দূরত্বের হেতু কোনো “প্রজন্ম” নয়। যদি আত্মপ্রশ্নে, যদি আমার আমার-পুত্র বয়সে নিজস্ব সঙ্গীতরুচির সঙ্গে আমার বাবা-জেঠার সঙ্গীতরুচির ব্যবধানের হেতু নিয়ে সচেতন ভাবে ভাবতে, বুঝতে না বসতাম, তাহলে আমার গান-ব্রহ্মান্ড থেকে যেতো আমরণ সীমিত। ছোট। – এই মর্ম-ব্রহ্মান্ড, গানের, ভাবনার,পাঠের — সীমিত থাকা, সীমিত করে রাখাতেই উৎসুক তারা। তারা মানে যাদের লাভের নিমিত্ত, মুনাফার নিমিত্ত  তুমি-আমি, গো পাঠিকা হে পাঠক মাস্টারি, ডাক্তারি,উকিলী, দালালি, ম্যানেজারি ক’রে ক’রে জীবনপাত করে দিয়েছি। দিচ্ছি। সেই পুঁজির বাবা’রা চায় সীমিত। সীমিত মানেই সীমা। সীমা মানেই টুকরো। টুকরো টুকরো। টুকরো গুলিও কিভাবে হবে তার ফর্মুলাও এরাই দেয়। এক টুকরোর সঙ্গে আরেক টুকরো মিলতে না পারার নিমিত্ত তারা প্রচার করে প্রজন্মগত দূরত্ব, জাতিগত দূরত্ব, ধর্মগত দূরত্ব, স্থানগত দূরত্ব। আঙ্গুল দেখিয়ে বলে “এরা উইপোকা”। আজ। কালই আঙ্গুল অন্যদিকে ফিরিয়ে বলে “এরা মঙ্গলসূত্র ছেঁড়া চিল-কাক”। … এই বলা গুলি, এই পুঁজিমালিক তথা শাসকদিগের, ততোক্ষনই মনে হবে সত্য, যেমন আমাদেরো একদা মনে হয়েছিল “প্রজন্মগত দূরত্ব” সত্য, যতোক্ষণ না …। গো পাঠিকা হে পাঠক, ফিরে যাই আরম্ভে। যে পথ ধরেই হাঁটো, হাঁটি – সেই পথই, অন্তিমে যায় শ্রেণী’র, শেণী সংকটের এবং অন্তিমে শ্রেণী সংগ্রামের সত্যে। গানের, গান শুনবার, গান-রুচির ভিতর দিয়ে এসেও আমি দেখি সেই সত্য। দেখি “প্রজন্মগত দূরত্ব”,”জেনারেশন গ্যাপ” — সত্য পেটি বুর্জোয়া, এবং হাঘরে হাভাতে পেটি বুর্জোয়া নয়, শুধুমাত্র খেতে পড়তে পাওয়া আর ফেলে ছড়িয়ে খাওয়া পেটি বুর্জোয়াদের নিমত্ত নির্মীত, বুর্জোয়াদিগের দ্বারা, একটি মীথ-সত্য। – “এই কি প্রয়োগ? কি ‘মোটিভ’?” – এই প্রশ্ন অসৎ ও সৎ দুই অবস্থান থেকেই করা হবে। গো পাঠিকা হে পাঠক, যদিও গভীরতর, জটিলতর বিশ্লেষণের দাবী রাখে প্রশ্নটি, তথাপি, সহজ করে বলি, আগেই যেমন বলেছি – পুঁজির বাবা’রা চায় সীমা। সীমা মানেই টুকরো। টুকরো টুকরো। টুকরো গুলিও কিভাবে হবে তার ফর্মুলাও এরাই দেয়। এক টুকরোর সঙ্গে আরেক টুকরো মিলতে না পারার নিমিত্ত তারা প্রচার করে প্রজন্মগত দূরত্ব, জাতিগত দূরত্ব, ধর্মগত দূরত্ব, স্থানগত দূরত্ব। আঙ্গুল দেখিয়ে বলে “এরা উইপোকা”। আজ। কালই আঙ্গুল অন্যদিকে ফিরিয়ে বলে “এরা মঙ্গলসূত্র ছেঁড়া চিল-কাক”। … এই ভাবে আলগা করে রাখা। আলগা করে রাখবার নানান ফর্মুলার মধ্যে একটি “প্রজন্মগত দূরত্ব”,”জেনারেশন গ্যাপ” যা যুদ্ধোত্তর বিশ্বে, জনমানসে উত্থিত, বিশেষ করে যুবমানসে – পুঁজি ব্যবস্থা বিষয়ে ওঠা সংশয় আর প্রশ্ন গুলিকে বিপথে চালিত করতেই উদ্ভাবিত ও প্রচারিত। নিও লিবারেলি’রা একেই আরো বৃহত্তর জটিলতা নিয়ে হাজির করছে।  কার্ল ম্যানহাইম (Karl Mannheim) এর মতে “ প্রজন্মগুলি তাদের গঠনমূলক বছরগুলিতে ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর   কারণে বিশ্বকে ভিন্নভাবে অনুভব করে  , যা তাদের বিশ্বদৃষ্টিকে ভিন্নভাবে রূপ দেয়”। গো পাঠিকা পাঠক, “বিশ্বদৃষ্টিকে ভিন্নভাবে রূপ দেয়” – কিসের ভিত্তিতে? কেন? – উত্তর মেলেনা। মেলে ফেনানো কূট-তত্ত্ব। উত্তর মেলেনা, কেননা উত্তর অন্যত্র। “বিশ্বদৃষ্টিকে ভিন্নভাবে রূপ দেয়” নিজ নিজ শ্রেণী অবস্থানের কারণে। প্রতিটি বড় যুদ্ধ উৎপাদন সম্পর্ক যা আদতে একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষের সম্পর্কই — কিন্তু মুনাফা কেন্দ্রীক উৎপাদন ব্যবস্থায় যার মধ্যে আর্থ সামাজিকতা’র এসেপড়া অনিবার্য – তা যায় আমূল বদলে, ফলে ওই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, পরিবর্তিত শ্রেণী অবস্থানে, একটি প্রজন্ম যা তার ম্যানহাইম বর্ণিত “গঠনমূলক” বয়ঃসীমায়, তার সঙ্গে তার মাতাপিতা বা মাতামহী-পিতামহী, মাতামহ-পিতামহের মর্মে জাগরিত প্রশ্ন ভিন্ন হবে কেন? ভিন্ন তখনই হওয়া সম্ভব যদি ওই যুদ্ধ-ঘটনা দুই ভিন্ন প্রজন্মকে স্থাপিত করে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীতে। নতুবা “বিশ্বদৃষ্টিকে ভিন্নভাবে রূপ দেয়” – কথাটি নিতান্ত বাগাড়ম্বর।

আমাদের বাপ-জ্যাঠাগনও যদি ব্যবস্থা-দ্বারা নির্ণীত “হাই কালচার” থেকে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হতেন, যদিও ঐতিহাসিক ভাবে এইরূপ আপনা-আপনি “মুক্তি” অসম্ভব – তবু – তর্কের খাতিরে মেনে নিলে, যতি তারা বসে শুনতেন “খাইকে পান বেনারস-ওয়ালা” গান, “ইয়ে হ্যায় বোম্বে মেরী জান” গান — নিশ্চিত, ক্রমে, আসতো অভ্যস্ততা। সম্ভব হতো গভীরতর বিনিময়। কিন্তু অতি সূক্ষতার সঙ্গে তাদের মগজে “জেনারেশন গ্যাপ” কে সত্য এবং বুদ্ধিমান-শিরখিত সত্য বলে চালান দেওয়ার কাজে এই মুনাফা কেন্দ্রীক ব্যবস্থা সফল হয়েছে। অতএব, পরের স্তরটি, নিও লিবারেলি চালিয়াতিটি আনতে, তারা বহুদূর সফল।

গো পাঠিকা হে পাঠক, অন্তিমে আবার বলি, যে যে পথ ধরেই হাঁটো, হাঁটি – সেই পথই, অন্তিমে যায় শ্রেণী’র, শেণী সংকটের এবং অন্তিমে শ্রেণী সংগ্রামের সত্যে। “খাইকে পান বেনারস-ওয়ালা”র সত্যে।



সপ্তর্ষি বিশ্বাস

১৯/০৭/২০২৫

বেঙ্গালোর



=======================================================



মঙ্গলবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

তমসা সিরিজ

 

 

 


 

 

 

 

 

 ।। অভিজিৎ চক্রবর্তী ।।

 

 

এক

 

একা নিরক্ষরা রাত। ওড়ে বাঘছাল।

মা মা বলে ডাকে মনোহর। ভয় পেয়ে ডাকে।

বিষাদ। পংক্তির কাটা মাঠ। ফাঁকে ফাঁকে

সরোবর। তোর লীলা অবাধ। অক্ষর-শিস নাভি থেকে ওঠে

ধ্বনি তো প্রহরের প্রমাদ। লুঠ হবে গ্রহ-তারা

পরমায়ু, যতি। কারক ও ক্রিয়াপদ।

 

 

 

দুই

 

কপালে আলোর ছিটে লাগে। দূর গোধূলি-মায়ার। যাও ছুটে যাও।

ছবি। স্মৃতি। দেহ ভেসে যায় কোলাহলে।

একা জলযান আসে

গোপন। লোকালয়ের। লাল নীল আলো চোখে মুখে।

মাঠেই দাঁড়ালো। তমসা। নিকষ কালো

কালো তো মা-ই আমার।

কান্না শুকিয়ে পাথর। পাথর তো মা-ই।

পাথরের স্তন। চুষতে চুষতে স্ফুরণ

 

তিন

 

জলের ভিতর আর বাইর। রাস্তায়

পানের দোকানেসব কথা জমে ক্ষীর।

নিরক্ষর চাঁদ। উদার জোছনা।

জোছনা না কাচ। পায়ে বিঁধে যায় অনুগত দিন।

দিনের ভেতর না বাহির। পাত

এই সংশয়ে বাজে বীণ

                      বাড়ে ঋণ

 

চার

রাত-সরোবর। চাঁদ নেই। তাই অন্ধ।

দেখে না। কবি দেখে। কবিরা নিশাচর।

নেশাচোর। হাতে পায়ে পাথরঝুনঝুনি। মল।

ধরতে চাইলেই মাছেরা নড়ে খলবল

 

 

 

পাঁচ

 

এরপর ক্ষুধা। এরপর খাড়া

সবার চোখের সামনে দাঁড়া

কাঁদা লেগে রক্ত লেগে ঘাম

জন্মের মাটি দিলাম। তবে

এবার দ্বিগুণ বেগে খাড়া

শীর্ষচূড়া তারায় ভরা

রাত্রিটা দুদিক থেকে নাড়া

 

ছয়

 

তুমি মাটি। কাল ছিলে শিরে

কাল তোমাকে ঘিরে ধূপ-ধূনা-উল্লাস

মন্ত্র ছুঁইয়ে দিয়েছি কপালে। এখন রোদ

এখন সত্যের বোধ। দায়ভার। গাছের তলায়

মেলেছে ক্রোধ। । অথচ কাল মুদ্রা, নৃত্য- বিভঙ্গে। 

ধ্বনি সর্বাঙ্গে। মেঘ ও বাদলাহাওয়া ও যতিচিহ্নের। এখন করুণ

একফোঁটা জলের রেখায়। লক্ষ্যে স্থির

যত গুণ, ডুবে যায়

 

 

সাত

ভেদ করো। তবে তুমি

ঝলসে পড়ো ছুঁয়ে ভূমি

শিরস্নান খোলো ত্রিনয়নী

মারো মারো মারো। জ্বালো ধুনি।

জাগে জাগাও। ভেতরে

আপাদ বিস্তৃত ভূমি। তারপর

ঊর্ধ্বগামী। আঁকাবাঁকা। ওঠো

তুলে ধরো। তুলে ধরো

দেখাও অ-যোনি

 

আট

 

কেঁপে কেঁপে ওঠো। বাজে তারা

মুণ্ডে মালা গাঁথা। গলে তারা

কেঁপে কেঁপে ওঠো। হাড়ের গয়না

বাজো রণে। অক্ষরে নাচাও

ডম্বরু দোলে। শিখায় শিখায় দিহন

শিরায় শিরায় সুনামী। অকারণ

বেজে যায় ঘর হতে শ্মশানভূমি

 

 

 

নয়

 

এরপর কাব্য বলে দিলাম ঊরু। ঊরু নয় ঊরুসন্ধি

এরপর কাব্য বলে দিলাম ক্ষত

চুইয়ে পড়া জল। জলের ভাঁড়ার একা বন্দী।

নগ্নপদে  চ্যাংদোলা হয়ে

জ্বালো চিতা। হাড়ের ভেতর ঘুমিয়ে পিতা।

বাজুক শয়তানি। ব্রহ্মখুলি ফাটুক।

ঝরুক। বৃষ্টি পড়ুক।

এরপর কাব্য বলে দিলাম ধরিয়ে মধ্যমণি।

ঘি-এর বাজার। যজ্ঞথলি।

ঝরুক জোছনা। জোয়ারে ফাটুক সোনার খনি

 

 

 

 

 

দশ

 

ডুবছিনা তো ভেসে উঠছি বন্ধ দুয়ার

মাথার ভেতর একের পর একের জোয়ার

নীলের কথা শুনবে বলে মনের গতি

বিষের বড়ি আহামরি আবার যতি

ধন্দ নিয়ে একাই একা বসত গড়ি

দুখানা দু'দিকে লাগিয়ে নিজেই লড়ি

 

 

 

 

 

 

এগারো

 

তোমার কাছেই ভয়। ভয় মানে বটের ঝুরিঅতিকায়।

জঙ্গল নিবিড়। ভেদ করে যাবে ধড়।

পৌঁছুবেখোলা মাঠ। বৃষ্টিতে ঝাপসা। ধড় আর কী

মুণ্ড খুঁজে পাবে। শুধু যাবে। একা। চেনা পথ

পেরিয়ে। অচেনা। সারি সারি ঘর

দরজার ধড় টোকা দিয়ে যায়।

মুণ্ড নাই। মুণ্ড কী আর পাবে! মুণ্ড তো তোমার হাতের মুঠিতে

চোখ বুজেই আছে

 

 

বারো

 

অথচ তেমনি নীল। ঝড়।

তেমনি উড়ো টিন। ভয়াল। ক্ষুরধার।

হত্যাকাণ্ড ফোঁটা ফোঁটা

চাপ চাপ। জনসভা। মিছিল। তরুণ

কবির লাশ মাড়িয়ে। পলাশ না শিমূল

কাটা হাত-পা আড়াআড়ি। ৪৪০ ভোল্ট

বিদ্যুৎ প্রবাহ। বিষে জর্জর। নীলাভ।

অসুরেরা সারি সারি মাথানত দাঁড়িয়েছে

একটাই অপরাধকবির বই পুড়িয়েছে

 

 

 

 

 

 

 

তেরো

 

 

ফোঁটা ফোঁটা ঠোঁটে। কাটা পথ। প্রুফ দেখা

হল না আবারো। ফাঁকে দেখা যায় ঝড়।

বাতি নেই। অন্ধকার। বেগ পায়। মাথা বলি

না ব্রহ্মতালু। ব্রহ্ম বুঝিনি যদিও। শব্দ

পাইনি এখনো। ধ্বনিজন্ম

কাটে না আর। প্রুফের তলায় চাপা

মাঝে রাস্তা। টেরিকাটা। নানা রঙের আলোয়।

আলো না পানীয়, দোলে সামনে পেছনে।

ফোঁটা ফোঁটা। বই বেরিয়ে যায় আবারো

অপ্রকাশিত। ভুলে ঠাসা। এর মাথা ওর

জুতা। দেব দেবারি হয়। রাক্ষস জনতা।

 

 

 

 

চৌদ্দ

চাঁদ আসিয়াছে। থার্ড ডিগ্রি লাগাও

বোঁ বোঁ মাথা। মাথা তো নেই, মস্তক।

পুস্তকের মত। আপ্রাণ। অযোনিসম্ভূত।

জবা ফুল ফুটিয়াছে।

 

 


বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪

।। এক কিপটে ও এক দল ইঁদুর।।

 

             ।। মাসকুরা বেগম ।।

 


    --"মা-ই গো!ও মা-ই! তুমি কইয়া দেওনা আমার মাঝে কিতা কিতা দোষ আছে! তোমার এই নির্বোধ বেটার ওপর আল্লাহ বোধহয় খুব নারাজ আছইন! নাইলে এত আপদ - বিপদ আইতো কেনে? এই চার-পাঁচ বছরে কি কম লোকসান অইছে! তুমি যদি আঙুইল দিয়া দোষ ত্রুটি দেখাইয়া না দেও তাইলে আমার যে ইহ-পরকাল সব ধ্বংস অই যাইব মাই!' ফজরের নামাজের পর মায়ের পায়ের কাছে বসে মায়ের পা দাবাতে দাবাতে অনুতপ্ত আমিরুল বলছে আর মাঝে মাঝে পরনের সাদা পাঞ্জাবির হাতায় চোখের জল মুছে চলেছে। 

     আমিরুল একজন খুবই কর্মঠ ও সৎ ব্যবসায়ী । সে ও তার স্ত্রী দুজনেই খুব মেহনতি। খাটে প্রচুর। হেলায়- ফেলায় দিন কাটায় না। খরচ করে খুব মেপে-জোখে । লোকজনের সঙ্গে তারা বেশি সম্পর্ক রাখে না । একা একা থাকতে পছন্দ করে। তারা মনে করে সব সম্পর্কের মাঝে কোন না কোন স্বার্থ জড়িত থাকে । আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী তাঁদেরকে "অসামাজিক' "কিপটে' ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষিত করে! কিন্তু তাদের মতে তারা একটু মিতব্যয়ী মাত্র ! আসলে বেশির ভাগ মানুষই তো নিজের সম্বন্ধে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতে পারে না। নিজের ভুলটাকেও যুক্তি দিয়ে সঠিক ধরে নেওয়া মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। 

 আজ থেকে প্রায় চার বছর আগের কথা। একদিন সন্ধ্যার পর আমিরুলের অসহায় দুস্থ বোন মারিয়া তার কাছে এসেছিল । একটু সাহায্যের জন্য হাত পেতেছিল,

--" ভাইজান! একটু টাকা পয়সা দিয়া আমারে সাহায্য করইন। আমার ফুয়াটার স্কুলর সারা বছরর ফি বাকি আছে। ফি দিতে না পারলে যে ফাইনাল পরীক্ষায় বসতে দিব না স্কুল।'

-- "আইজকাইল তো স্কুল ফি লাগে না।'

--"ভাইজান ইতা সুবিধা তো সরকারি স্কুলর ছাত্ররা পায় । আমার মনির যে বেসরকারি স্কুল পড়াশোনা করের....।'

--"তাইলে সরকারি স্কুল পড়তে পাঠাও।'

--"হি যে ক্লাস এইট অব্দি ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করছে এখন হঠাৎ করিয়া সরকারি স্কুল বাংলা মাধ্যম পড়ব কিলা?'

--" খরচ চালাইতে পারো না যদি বেসরকারি স্কুল দিলায় কেনে?'

--"তার আব্বায় দিছে।'

--"তাইলে তার আব্বা টাকা দিব। আমি কেনে দিমু?'

--" তুমি তো জানো ভাইজান তার আব্বার মেঘালয়র কয়লার ব্যবসা আর আগর মত চলের না। দিনে দুই বেলা ভাতের যোগাড়ই অয় না ভালা করিয়া !'

-- " তাইলে ও দিনমজুর করউক, তুমি কাজ কর, নাইলে ছেলের পড়া বাদ দিয়া কাজে পাঠাও । পরের কাছে আত পাততে আসো কেনে? একেবারে লজ্জা শরমের মাথা খাইছো!'

     মারিয়ার মুখ দিয়ে আর কোন কথা বেরুলো না! দুচোখের পানি মুছতে মুছতে নিজের শ্বশুরের ঘুণ পোকায় ধরা কাঠের তৈরি পুরনো আমলের জমিদার বাড়ির ভগ্নাবশেষ এ চলে গেল। কাউকে বলল না ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া অপমানের কথা। তার মনে পড়ে "ভাই বড় ধন, রক্তের বাঁধন '। আপনজনের বদনাম তো লোকের কাছে করা যায় না। তাই হজম করে নিল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে! 

      বোন যদিও কাউকে কিছু বলল না কিন্তু ওপরে থাকা নিরাকার একজন সব দেখলেন, শুনলেন। আর তার সঙ্গে চোখের জল ফেলল আমিরুলের ঘরে লুকিয়ে থাকা একদল ইঁদুর!

      -- "ও আমির! বাপজানরে আল্লাহ তোমায় অত দিছে, একটু সাহায্য করলে তো পারতায়! ফুড়িটারে ইলা খালি আতে বিদায় করা কী ঠিক অইছে?' আমিরুলের বৃদ্ধ মা  ভয়ে ভয়ে ছেলেকে বললেন।

--" মা তুমি আমার ঘরো শান্তিতে থাকো তো। খাও-দাও, ঘুমাও । অন্যের ব্যাপারে নাক গলাতে যাইও না। আমি মেহনত করে দুইকে চার করছি, দান-খয়রাত করে বিলিয়ে দেবার লাগি নায়। আমার কষ্টর উপার্জনে শুধু আমারই অধিকার! আলসেমি করে দিন কাটাচ্ছে আর আমার কাছে আসে 'সাহায্য লাগে' বলে। আরে বাবা আঁচল যতটুকু ততটুকু মেলো না! যত্তসব!' রাগে গজগজ করে আমিরুল বলল।

    মা নিজের অসহায়ত্বের কথা ভেবে ভয়ে চুপচাপ কেটে পড়লেন।

     রাত নিস্তব্ধ হয়ে এসেছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সভা বসল ইঁদুরদের। সভায় আলোচনার বিষয় হল কেমন করে এই আমিরুলকে শিক্ষা দেওয়া যায়। বড্ড অহংকার বেড়েছে যে তার! ইঁদুরের সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে আজ রাতেই হামলা করতে হবে আমিরুলের লাইব্রেরিতে! সব তছনছ করে দিতে হবে! নানা ধরনের বই দিয়ে সারি সারি করে দেয়ালে সাজিয়ে রেখেছে কাঁচের আধুনিক ডিজাইনের আলমারি । কোনদিন একটাও বই হাতে নিয়ে পড়তে তো দেখা যায় না তাকে। শুধু শুধু লোক দেখানো কারবার! পরের ছেলেকে একটু পড়াশোনায় সাহায্য করতে পারে না আর নিজের কচি ছেলের জন্য এত সংগ্রহ!

 

       আরেকদিনের কথা ।   আমিরুলের বড় ভাই আসলেন কিছু টাকার সাহায্য চেয়ে। 

--"ভাইরে! ও ভাই! তোর ভাবীর বড্ড অসুখ ! ডাক্তরে কইছে ইখানো ট্রিটমেন্ট সম্ভব নায়! চেন্নাই নিয়া যাইতে অইব। কিতা করতাম এখন! অত টাকা তো আমার গেছে নাই। থুড়া সায্য কর না আমারে টাকা দিয়া।'

--" কোন ডাক্তরে কইছে? আইজকাইল ডাক্তর ইতাও সব ব্যবসায়ী অই গেছইন। সরকারি মেডিকেল কলেজ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা থাকতে অত খরচ করে চেন্নাই যাওয়ার কী দরকার !' আমিরুল বলল।

--" সোজাসুজি কইয়া দেয় না যে দিতে পারবি না । উপদেশ দিতে যাস্ কেনে? ভাইগ্নাটারে পড়াশোনার লাগি একটু সাহায্য করলি না। আটকাইছে না তার পড়াশোনা। তোর এই ভাবী তাইর হাঁস মুরগি পালন করিয়া জমানো টেকা দিয়া সাহায্যর আত বাড়াইয়া দিছে ভাইগ্নাটারে। তারার দোয়ায় তাই সুস্থ অইয়া উঠব।তোর সায্য লাগতনায়! দেখিস্ তুই!' আমিরুলের কথায় ক্রুদ্ধ হয়ে বড় ভাই গদগদ করে চলে গেলেন ।

      সব শুনে ইঁদুরের দল এবার সিদ্ধান্ত নিল আমিরুলের টাকার সিন্দুকে হামলা করবে! সে ব্যাংকে টাকা জমা রাখেনা কর দিতে হবে বলে। স্ত্রী বায়না এবার স্কুল ছুটির সময় বাংলাদেশে বেড়াতে যাবে । আমিরুলের ও প্রস্তাবটা মন্দ লাগল না ।  তার একজন মাসির বিয়ে হয়েছিল সিলেটে । তাই মাকেও নিয়ে যাবে । মা তাঁর বোনকে দেখে আসবেন । বেশ কয়েক বছর হল দুবোনের সরাসরি দেখাই হয়নি । বরাক উপত্যকার মানুষের কেমন যেন একটা প্রাণের টান আছে বাংলাদেশের সঙ্গে। আত্মীয়তার বন্ধন ।   ভারত, পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ সব মিলে তো এক দেশই ছিল -- ভারত । সবারই তো ছিল একই মিশন, একই ভিশন, একই স্লোগান -- একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ! স্বাধীন ভারত! কিন্তু ব্রিটিশের ষড়যন্ত্রের  ফল স্বরূপ এক দেশ শুধু ভাঙলেই না; পরস্পর চির শত্রু হয়ে রয়ে গেল । যাই হোক সেটা সাতাত্তর বছর আগের কথা! তারপর ফাটল ধরল পাকিস্তানে মাতৃভাষা বাংলার স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার শঙ্কায় ! ফলস্বরূপ জন্ম নিল স্বাধীন বাংলাদেশ! দেশ ভাগের ফলে আমিরুলের স্ত্রীর অনেক আত্মীয় স্বজন বাংলাদেশ রয়ে গেছে । কেউবা সেখানে চাকুরীরত ছিল কেউবা বিয়ে হয়ে সেখানকার বাসিন্দা । ছেলে আবুর ইচ্ছে সিঙ্গাপুর যাবে । 

আমিরুল বলল, "এখন না আব্বু! তোমার দাদিজীরে নিয়া হজ্জ করিয়া ফিরিয়া আসি তারপর সিঙ্গাপুর নিয়ে যাব তোমাদের । আরও দুবছর অপেক্ষা করতে হবে । ঠিক আছে!' 

ছেলে বলল, "ঠিক আছে হবে! তুমি দাদিজীকে নিয়ে হজ্জ করে এসো তারপর আমরা সিঙ্গাপুর যাব। এখন নাহয় বাংলাদেশ ঘুরে আসি।' 

     বিদেশ-ভ্রমণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে কিছু টাকা সিন্দুকে জমা রাখা আছে । ইঁদুরের সর্দার বললেন, "ভাইকে একটু সাহায্য করতে পারে না আবার নিজে স্ত্রী পুত্র নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ করবে! চল! করাচ্ছি বিদেশ ভ্রমণ বেটাকে!' সবাই বলল," চলো! চলো! টাকার পুঁটলি খুলো! সব চিবিয়ে ফেলো!'

     আমিরুলের স্ত্রী আমিরুলের আত্মীয় স্বজনদের বেশি পাত্তা দিত না। এতে আমিরুল স্ত্রীর ওপর খুশি। শুধু তার মায়ের সাথে যেন কোনো খারাপ ব্যবহার না করে সেটা কিন্তু সতর্ক করে দিয়েছে। মাকে খুব ভালোবাসে সে। মায়ের যত্নের কোনো ত্রুটি রাখে না। মায়ের কষ্ট হবে ভেবে অভাবী ভাই বোনের ঘরে মাকে থাকতে দেয় না। মা চটপট করেন কিন্তু কিছু বলেন না । তিনি ভাবেন, "নিজর না আছে জন, না আছে ধন! বাবা! ছেলের ইচ্ছে মত চলাই ভালো!'

     আমিরুলের গেল বছরের ধান খেয়ে দেয়ে, বিক্রি করে এখনও প্রচুর পরিমাণে গোলায় মজুদ রয়েছে। ভেবেছে নতুন ধান উঠানোর আগে বিক্রি করে দেবে - যেটুকু অতিরিক্ত থাকবে। একদিন এক বিধবা বৃদ্ধা এসে আমিরুলের স্ত্রীর কাছে হাত পাতলেন, 

-- " কিছুটা ধান দেও মাই গো? আমার ঘরো চাউল নাই! ঢেকিত বানিয়া কয়টা চাউল ছফা করিয়া ভাত রান্দিতে পারলাম অনে। '

--"টেকা নিয়া আইছো নি ? বাকি নিয়া ফাঁকি দিবায় নি?' আমিরুলের স্ত্রী বলল।

--"আমি মানুষর দুয়ারো দুয়ারো খুঁজিয়া খাওয়া মানুষ গো!  এক সপ্তাহর জ্বরে ভুগিয়া  ফুয়া গেছে গিয়া দুনিয়া ছাড়িয়া। বউ নাতি নাতনি আর আমারে নিয়া পাঁচটা পেট। তোমাদের তো অঢেল দিছে আল্লাহ! আল্লাহর ওয়াআছতে একটু সাহায্য করলে কমবে না।'

--"ইখান কিতা বন্টনখানা নি যে সব আই যাও ইনো! আমরা বিলাইয়া দেওয়ার লাগি ধন সম্পদ সঞ্চয় করি নাই। আমারার ভবিষ্যৎ আছে! ছেলের ভবিষ্যৎ আছে! তখন আমরা বিপদে পড়লে কি তুমি দেখবায়? যাও ইখান থাকি।' আমিরুলের স্ত্রীর তিরস্কার শুনে বৃদ্ধা আপন মনে বিড়বিড় করে চলে গেলেন।

    আমিরুলের স্ত্রী ঘরে মেহমান আসলে শরবত দিলে চা দেয় না আর চায়ের সঙ্গে নাস্তা  দিলে ভাত দেয় না আর ভাত খাওয়ালে চা দেয় না ! কাজের মাসিকে খড়ায়-গণ্ডায় হিসেব করে মাইনে দেয় । কোনদিন যদি কোনো কারণ বসত মাসি কাজে আসতে পারে না সেদিনের মাইনে কেটে দেয়।

     ক্ষেতের মাঠে কচি কচি চারা ধানে চারদিকে সবুজের সমারোহ। আহ: কী নয়ন ভোলানো অপূর্ব দৃশ্য! ক্লান্ত দুচোখ যেন সতেজ হয়ে উঠে ! আরও ক'দিন পরে চারা গাছগুলো বেড়ে উঠবে । ফুটবে ফুল, ছাড়বে ধান। তারপর পাকা সোনালী ধানের মো-মো গন্ধে সুবাসিত হয়ে উঠবে মাঠ-ঘাট ! সে অপেক্ষায় আছে ইঁদুরের দল। নিমন্ত্রণ দিয়ে রেখেছে নিজের আত্মীয় স্বজন, বন্ধু- বান্ধবদের। বুড়ি মা-কে খালি হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার বদলা নেবে তারা!

 

      পাসপোর্ট হয়ে গেছে সবার । বাংলাদেশ যাওয়ার জন্য জমানো টাকার সিন্দুক খোলা হলো। সিন্দুক খুলে সবার মাথায় হাত! একি সব টাকা-পয়সা তছনছ! শুধু মাত্র হজ্জে যাওয়ার জন্য জমানো টাকার পুঁটলিটা অক্ষত অবস্থায় আছে ! 

    আমিরুলের স্ত্রী বলে উঠল, "হজ্জে যাওয়া তো এখনও অনেক  দেরি আছে । কিছুই তো ঠিক হয়নি।  তবে ঐ টাকাগুলো দিয়ে এখন বাংলাদেশ ঘুরে আসি.....।' তার কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই রান্নাঘর থেকে প্রেশার কুকারের সিটি বেজে উঠল। তাই সে দৌড়ে গেল রান্নাঘরে । সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল সে রান্নাঘর থেকে! চিৎকার শুনে সবাই দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, " কী হয়েছে?' 

সে কুঁকড়ে কুঁকড়ে বলল, 

--"আঁধারের মাঝে ইঁদুর আমার পায়ে কামড় মারিয়া দিছে!'

--" কী! এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার! এখনি ডাক্তরের কাছে নিয়া যাইতে অইব! ভ্যাকসিন নিতে অইব! তাড়াতাড়ি চল! আমি গাড়ি বাইর করছি !' আমিরুল এই বলে দৌড়ে গিয়ে গাড়ি বের করে স্ত্রীকে গাড়িতে তুলে ছুটল হাসপাতালে ।

      আমিরুলের চাষবাস দেখা শোনা করে কুটিমিয়া । সে পরদিন সকাল সকাল হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, --" মালিক সর্বনাশ অই গেছে ! মাঠর সব পাকনা ধান নষ্ট করিয়া দিছে ইঁদুর ! কাইল  তো দেখলাম সব ঠিক আছে । এক রাইতে এত ধান নষ্ট করল কী কিলা!' 

    এমনিতেই আগের রাতে ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরে এসে অনুশোচনায় দগ্ধ আমিরুল! অনবরত কেঁদে চলেছে মায়ের পায়ের কাছে বসে আর আত্ম-সমালোচনা করে নিজেকে শুধরানোর পণ করছে। তার ওপর এই সর্বনাশের খবর! স্তব্ধ হয়ে গেছে সে । সে শুধু কুটি মিয়ার কথা গুলো শুনল মায়ের পায়ের কাছে বসে । কিছুই বলতে পারল না কুটিমিয়াকে । 

    আমিরুলের মা উঠে বসলেন। বুকে টেনে নিলেন ছেলেকে। আঁচল দিয়ে ছেলের দুচোখ মুছে দিয়ে আদর করতে করতে বলতে লাগলেন, --"দেখো বাবা! তুমি অনুতপ্ত অইছ, নিজে নিজর দোষ খুঁজার চেষ্টা করছ -- ইতা খুবই ভালা লক্ষণ। তোমার মাঝে কিছু দোষ আছে। মানুষ মাত্রই দোষ - গুন থাকে। ইতা স্বাভাবিক। আমার কর্তব্য আসলো, তোমার ভুলকে দেখাইয়া দেওয়া। কিন্তু অসহায় নারী নিজর স্বার্থটাই দেখে! ভালো পরামর্শ বা উপদেশ দিতেও চিন্তা করে 'যদি বাবা নারাজ হন কিংবা যদি ভাই নারাজ হন কিংবা যদি স্বামী নারাজ হন, তখন এই পরজীবী বাঁচব কেমন করে?' এই ডরে আমরা বেটিনতে নিজর পেটর সন্তানের ওপরেও দাবি কাটাইতে পারি না !'

--" মাইগো! তোমার এত জ্ঞান!' অবাক হয়ে আমিরুল বলল,"তুমি আইজ থাকিয়া তোমার এই অপদার্থ অদম ফুয়ারে নিঃসংকোচে উপদেশ দিও, গালি দিও, মারিও পিটিও। যে ছেলেকে মা ভয় করছে সে ছেলের পরকাল কি হবে? আমি এতদিন দুনিয়ার মোহ মায়ায় অন্ধ ছিলাম! এখন আমার চোখ খুলছে। তুমি যা আদেশ - উপদেশ দিবে আমি মাথা পাতিয়া নিমু । আইজ তুমি কইবায়, আমি শুনমু।'

--" সবই আল্লাহর ইচ্ছায় অয় ! আইজ আমার ফুয়ার অন্তর আত্মা খুলছে -- এটাই আমার অনেক বড় পাওয়া ! দেখ বাবা! তোমার ধন সম্পদ তুমি নিজে কষ্ট করিয়া উপার্জন করেছ ঠিকই কিন্তু এতে তোমার পরিবারের, সমাজের, আত্মীয় স্বজনের,  পাড়া প্রতিবেশীর সবারই কমবেশি হক আছে। দান খয়রাত করলে বালা - মুসিবত দূর অয় । কেউররে খালি হাতে ফিরাইয়া দিও না তাইলে তোমার দুনিয়া আখেরাত ভালো অইব। তোমার বাবার তেমন কিছুই আসলো না তবুও যতটুকু পারতা দান-খয়রাত করতা । কইতা,"দানে ধন কমে না''

-- "তুমি একদম ঠিক কইছো মা! আমি আমার মনে একটি ভুল ধারণা পোষণ করিয়া আসলাম যে আব্বা কেউ যখন কিছু চাইতেই দিয়া দিতেন বলিয়া আমরার ধন সম্পদ সঞ্চয় অইছে না আর সময় সময় আমরার অভাব অনটনে পড়তে অইছে ।এর লাগি আমি আমার ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী কাউকে মূল্য দেই নাই ! কারও প্রয়োজনে সাহায্য করি নাই !  ফল স্বরূপ আমার আলমারি ভর্তি বই নষ্ট হয়েছে, গোলা ভরা ধান নষ্ট হয়েছে, সিন্দুক ভর্তি টাকা নষ্ট হয়েছে, মাঠে পাকা ধান নষ্ট হয়েছে। শেষমেশ আবুর মাকে পর্যন্ত কামড়ালো ইঁদুর ! কিন্তু মা! দেখলে মা! কী আশ্চর্য কাণ্ড! শুধু মাত্র আব্বার বদলা হজ্জের জন্য আর তোমার হজ্জের জন্য যেটুকু টাকা জমা করেছিলাম, সেটুকু যেভাবে রেখেছিলাম সেভাবেই আছে।' 

     পাশে বসে সব শুনছে আমিরুলের স্ত্রী আর চোখের জল ফেলছে। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, ' আম্মাজান! আমার বেআদবি মাফ করবা ! অনেক কিপটামি করছি! কিন্তু আম্মা আইজ বুঝতে পারতেছি কিপটামি করিয়া করিয়া কতটা বিবেক হারাইয়া ফালাইছি! আত্মীয় স্বজনর স্নেহ - মমতা - ভালোবাসার সম্পর্ক গুলোর গুরুত্ব ভুলিয়া গেছি । একটুও সাহায্য সহায়তা করিনি কেউররে কোনদিন । শুধু নিজর কথা ভাবছি । ছিঃ ছিঃ ! নিজর ওপরেই নিজর ঘিন্না লাগের ! এতো অদম আমি! এতো নীচ!'

--"একটা কাম করা যাউক্! কাইল একটা দোয়া - দুরুদ, খানা- দানার আয়োজন করা যাউক্ ! মা তুমি ফোন করিয়া ভাইসাব ও মারিয়ারে এখনই সবরে নিয়া আমরার ঘরো আইতা কইয়া দেও। আমরার হজ্জ্ব যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়াও আলোচনা করতে লাগবো । তখন তো আবু ও তার মার দেখাশোনা তারারেউ করতে অইব । সবরে সঙ্গে নিয়া আয়োজন করব। অসহায় গরীব দুঃখী দুঃস্থদের খাওয়ানো অইব দুবেলা পেট ভরে ।' আমিরুল বলল। 

 আমিরুলের স্ত্রীও খুশি হয়ে বলল, "অয় অয়! ওটাই কর! ভালা অইব। ভাইসাব ও মারিয়ার মনে আমরা কম কষ্ট দিছিনি? এখন তারা কত খুশি অইবা দেখিও !'