“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ১৯ জুলাই, ২০২৫

“খাইকে পান বেনারস-ওয়ালা”

  “খাইকে পান বেনারস-ওয়ালা”


যে পথ ধরেই হাঁটো, হাঁটি – সেই পথই, অন্তিমে ……।

অন্তিমে যায় কবর, শ্মশানের সত্যে কিংবা অনন্তের মিথ্যায়। ঠিক। তথাপি তার আগেও পথ, আমার, দেখি বেঁকে যায়,শুধুই বেঁকে যায় – কোন দিকে? কোন চুম্বকের টানে?

“বাবুল মোরা নৈহার ছুট হি যায়”। প্রথম শুনেছিলাম রেডিওতে ভেসে আসা। শুনেছিলাম সাইগল সাহেবের কন্ঠে। “বাবুল মোরা নৈহার ছুট হি যায়” – এখনো, এখনই শুনছি। শিল্পীজন কবিতা কৃষ্ণমূর্তি। হ্যাঁ, সেই কবিতা কৃষ্ণমূর্তি যাঁকে ‘শিরখিত’রা জানে ‘ফিল্মি গানের’ ‘আর্টিস্ট’ বলে। ‘ফিল্মি গানের’ ‘আর্টিস্ট’ বলেই শুধু। বালক-সময়ে দেখেছি নিজ পিতা সহ আরো অনেক শিক্ষিত,ভদ্রজনের ‘শিরখিত’ হয়ে যাওয়া – “ফিল্মি গান” বাক্যবন্ধে। “ফিল্মি গান অপো-সোমসকৃতি”। সমোসা’র মতো। তার যেন কোনো জাত নেই। ওপি নাইয়ার থেকে বাপ্পী লাহিড়ি, রফি, কিশোর – সবই। “এক্সেপশন” দেওয়া হতো সাইগল সাহেব বা শচীনকর্তা’কে। কিন্তু কেন? তারাও জানতো না। – বালক বয়সেই, অকালপক্কতার আশীর্বাদে এই সকল প্রশ্ন তুলে বকাঝকা খেয়েছি। প্রশ্নগুলি তুলবার অন্দরে, তখন কোনো ‘চিন্তা’ ছিলনা। ছিল ভালবাসা। “তুম্‌ বিন যাঁয়ু কাঁহা”, “বদন পে সিতারে লপেটে হুয়ে”, “জানিনা কোথায় তুমি হারিয়রে গেছো, আর পাবো কি’না – জানে-জান ঢুন্ডতা ফির রাহা” – যাঁরা গেয়েছেন, যাঁরা আরোপ করেছেন সুর, যাঁরা যন্ত্র অনুষঙ্গে, যাঁরা লিখেছেন – তাঁদের প্রতি ভালবাসা’ই তখন করিয়েছে প্রশ্নগুলি। ওই ভালবাসাই বন্ধুর বাড়ি থেকে স্পিকার ধার করে এনে, টেপ রেকর্ডারে “ও সাথীরে, তেরে বিনা ভি ক্যা জিনা” – বাড়িতে, বাবার সবান্ধব স্টাডি সার্কল দিনে বাজিয়ে দেওয়ার বিদ্রোহও ওই ভালবাসারই ফসল। … পরে, বহু বহু পরে টের পেয়েছি, যে, যে কোনো বিদ্রোহ, যে কোনো বিপ্লব – কোনো না কোনো ভালবাসারই ফসল। 

গো পাঠিকা, হে পাঠক, বিদ্রোহ-বিপ্লব আর ভালবাসার সম্বন্ধ বিষয়ে অন্যত্র বার্তালাপ হবে। অবশ্য হবে। আপাতত বলি, যে, যে “শিরখিত” দিগের বিপক্ষে বিদ্রোহ করেছিলাম, যেহেতু আমিও আদতে সেই শ্রেণীরই – যাদের ‘শ্রম’ বলতে মাস্টারি, ডাক্তারি,উকিলী, দালালি, ম্যানেজারি, যাদের সরাসরি ভূমিকা নেই নৈমিত্তিক চাল-ডাল ফলানোর পরিশ্রমে, ভাগ নেই সাইকেল-রিক্সা বানানোর, বনে উঠবার প্রক্রিয়ায় – কিন্তু যারা ডালভাত খায়, সাইকেলে চেপে ‘কাজে’ যায়-আসে, বেতন-বোনাস পায়। না পেলে “আন্দোলন” করে। — সেই শ্রেণীরই, সেই পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীরই আমিও একজন ফলে “ফিল্মিগান ওপো-সমোসকিতি”রই যমজ বীজ, আমার শ্রেণীর স্বাভানিক নিয়মেই, নিজের অজান্তেই আমার মধ্যেও বেড়ে উঠছিল। উঠেছিল। টের পাইনি। বহুদিন। বহুদিন “বাবুল মোরা” মানে সাইগল হয়ে গিরীজা দেবী, ভীমসেন, কিশোরী আমানকার হয়ে বড়জোর জগ্‌জিৎ সিং। বহুদিন “কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি” মানে শুধুমাত্র শান্তিদেব-সুচিত্রা। – ইত্যাদি। অর্থাৎ অজান্তেই সেই দেখা-চোখ, সেই ভাবা-মন যা আদতে এক রকমের ব্রাহ্মণ্যবাদই, তা’ই আমিও, উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করছিলাম। তফাত এই, যে, আমার লিস্টিতে – কিশোর,রফি,মুকেশ থাকলেও কুমার শানু,অনুরাধা পাড়োয়াল থেকে কবিতা কৃষ্ণমূর্তি — অঘোষিত ওপো-সমোসকিতি”রই যমজ।

টেপ রেকর্ডার চালিয়ে, বাবার মুখামুখি বসে রবিগান,নজরুলগান, “জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা”, রাণার – ইত্যাদি শোনা যেতো। “আ চলকে তুঝে” চালালে, বাবা উঠে যেতো আর “দে দে প্যার দে” — প্রশ্নই নেই। তার অর্থ এই, যে, বাবা’র প্রজন্মের যা কিছু আমার পছন্দের, সেখানেই সামান্য যা কিছু বিনিময়। তার বাইরে …

তার বাইরে “গ্যাপ”। “জেনারেশন গ্যাপ”। “প্রজন্মগত দূরত্ব”। 

আমার বেড়ে উঠবার প্রত্যন্ত মফস্বলেও শব্দবন্ধটি অনেকদিন তূলোবীজের মতো উড়ে উড়ে নামিয়ে এনেছিল প্রায় কুয়াশাই। এবং এক প্রলম্বিত সময় জুড়ে এই শব্দবন্ধটিকে ‘বাস্তব’ বলে মনেও হয়েছিল, আমার, আমাদের। মনে হয়েছিল, আজ টের পাই, যে, আমরা বাধ্য ছিলাম, আমাদের পূর্ব বা তারো পূর্ব প্রজন্মও বাধ্য ছিল। কেননা এই রকমের ধারণার নির্মাণ ও বিস্তার অদ্যকার নয়। ১ম মহাযুদ্ধের পর থেকেই মাথাচাড়া দিতে থাকা এই উদ্ভাবন-চেষ্টা, অন্তিমে, ২য় বিশ্বযুদ্ধ-দিনের বা তার অব্যবহিত পরে পূর্ণরূপে উদ্ভাবিত – যে উদ্ভাবনের আবডালে Talcott Parsons, Karl Mannheim হেন ব্যক্তিরা ছিলেন এবং প্রচার যন্ত্র ছিল তাদের পক্ষে। পক্ষান্তরে  জি.লুকাকস (Georg Lukács b.1885), কে. ম্যানহাইম (Karl Mannheim b.1893), এইচ. মার্কুস (Herbert Marcuse b.1898), সি. রাইট মিলস (C. Wright Mills b.1916), লুই আলথুসার (Louis Althusser b. 1918) – প্রমুখরা, নানান সময়ে, নানান প্রতিযুক্তিতে খারিজ করেছেন “জেনারেশন গ্যাপ” / “প্রজন্মগত দূরত্ব” শব্দবন্ধটির ‘বাস্তব’ হওয়ার গালগল্প। – এ সকল বিষয়ে সম্যক জেনেছি অনেক অনেক অনেক পরের সময়ে, বয়সে। জানবার সঙ্গে সঙ্গে এ’ই স্পষ্ট হয়েছে, যে, কেন আমাদের পূর্ব বা তারও পূর্ব প্রজন্ম জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে বিশ্বাস করেছে, যাপন করেছে দৈনন্দিনে। প্রসঙ্গত মনে আসে “নায়ক” ছবিতে হলিউড বোদ্ধা উঠতি নায়ক আর তার আগের প্রজন্মের যাত্রা-ঘেঁষা অধুনা বয়স্ক পড়তি নায়কের কথোপকথন। নব্য নায়ক, যেহেতু ছবিটি হবে বংকিমের “দেবী চৌধুরানী” নিয়ে, ফলে, সে উপন্যাসটি ও তার সামাজিক প্রেক্ষাপট বিষয়ে পড়াশোনা করে জেনেছে, যে, সেই যুগে পিতাপুত্র কথোপকথন একই সুরে হতোনা। পিতার সুর থাকতো সতত উঁচু তারে বাঁধা। কিন্তু অধুনা বয়স্ক অভিনেতাটি এইসবের ধার ধারেনা। সে তার উচ্চগ্রামে ডায়লগ বলবার ম্যানারিজমে বাঁধা। “দেবী চৌধুরানী” লিখিত হয় ১৮৮৪ তে যা জিমিদারি প্রথার “চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত” (১৭৯৩) দ্বারা গলায় রক্তওঠা যুগ আর দেবী চৌধুরানী উপন্যাসের আবহও তার সামান্য আগ-কালের অর্থাৎ “জেনারেশন গ্যাপ” উদ্ভাবিত হওয়ার অনেক অনেক পূর্বের। তথাপি পিতা-পুত্র তখনও সখা নয়। হাতে গোনা নজির যদিবা মেলেও তাহলেও সেগুলি অত নগণ্য। এখানে প্রশ্ন,পিতা-পুত্র তখনও সখা নয়, ঠিক, কিন্তু কোন পিতা-পুত্র? জমিদার পিতা-পুত্র। পিতা জমিদার। পুত্র উত্তরকালের জমিদার। তাদের একসঙ্গে মাঠে যেতে হয়না – চাষা বাপছেলের মতো, একত্রে। লাংগল চষতে হয়না একই সঙ্গে। বা বাপের করা ফসল কাঁধে করে নিয়ে গিয়ে দিয়ে আসতে হয়না জমিদারবাবুর অট্টালিকায় কিংবা বেচতে হয়না বাজারে। অনেক ক্ষেত্রেই জমিদার পিতার জমদারী খেল্‌ পুত্রকে শিক্ষা করতে হতো নায়েব বাবুর মধ্যস্ততায়। ফলে একের, অন্যের নিজ-নিজস্ব বিশ্বের, খোঁজ খবর না রাখলেও চলতো। প্রায় সমকালীন প্রেক্ষাপটে লিখিত “নীলদর্পন” নাটকে জমিদার ও তার পরিবার তথা সাঙ্গপাঙ্গ দিগের নিজেদের মধ্যে বার্তালাপের সঙ্গে চাষী পরিবারগুলির অন্দর মহলের বাতচিতের তুলনা করলেই এ হয় স্পষ্ট, যে, দুইটি প্রজন্মের মধ্যে বাক্যালাপের সুরটি আদতে নির্নীত শ্রেণীর দ্বারা। শ্রেণী অবস্থানের দ্বারা। “নায়ক” চলচ্চিত্রের সেই একদা স্টেজ-হল্‌ কাঁপানো অভিনেতা, যিনি তখন বয়স্ক, তাঁর গর্জে ওঠা, উঠতি ছোকরার উপরে, সে’ও কি নয় আদতে শ্রেনী সম্পর্ক? আভিধানিক অর্থে দুইটি চরিত্রই পেটি বুর্জোয়া। পেটি বুর্জোয়া আর্টিস্ট। তথাপি, শ্রেনীর অন্দরেও থাকে শ্রেনী। যেমন ভাগ চাষী আর সম্পন্ন চাষী। তেমনি হাভাতে পেটি বুর্জোয়া আর ফেলেছড়িয়ে খাওয়া পেটি বুর্জোয়া। উঠতি অভিনেতাটি তখনো প্রায় হাভাতে। কিন্তু এই সিনেমারই একটি পর্বে আমরা দেখবো, উঠতি অভিনেতা যখন ‘প্রতিষ্ঠিত’, যখন সে ফেলেছড়িয়ে খাওয়া পেটি বুর্জোয়া তখন, ভাগ্য বিপর্যয়ে আগের দৃশ্যের একদা স্টেজ-হল্‌ কাঁপানো অভিনেতা, অধুনা, হাভাতে পেটি বুর্জোয়া। আমরা দেখব ঠিক কিভাবে কথা বলবার স্বর, সুর, বলা বাক্য – সমস্তই পালটে গিয়েছে। – অর্থাৎ প্রজন্ম, “বয়সের সম্মান” এসমস্ত কিছুই নয় ভাব বিনিময়ের প্রকৃত বাস্তবতা। সমস্তই নিহিত আর্থ সামাজিক অবস্থানে। চাষা আর তার ছেলের বা নাতির একত্র বসে বিড়ি টানা ভিন্ন উপায় নেই। একত্র সিগারেট টানা ভিন্ন গতি নেই কলকারখানায় কাজ করা বাপ-ব্যাটা’র, দাদু-নাতির। কিন্তু যে শ্রেণী নিজে শ্রম করেনা, তার পক্ষে এই সকল বিলাসিতা সম্ভব। সম্ভব সামান্য বিড়ি-তামাক সামনে-আফরকে টানাকে কেন্দ্র করে ক্ষমতা এবং সম্মান দেখানো না-দেখানোর নব্য মনু সংহিতা বানিয়ে তোলা। লক্ষ্যনীয় “গণদেবতা” উপন্যাসে গ্রাম-সভা’র ডাকে সভায় যোগ দিতে আসা অনিরুদ্ধ, যে শহুরে, যার মর্মে সামন্তবাদী সম্পর্কগুলিীসেপড়া বুর্জোয়া “শিক্ষাদীক্ষা” হেতু, ক্রমেই ভেঙ্গে যাচ্ছে, সে, তার হাতের সিগারেট টি, সভাস্থ সকলকে দেখিয়েই, শেষ্টান দিয়ে ফেলে দিয়ে সভায় আসে। একই ব্যবহার তারাশংকরের “জলসাঘর” এ দেখা যায়। চলচ্চিত্র “জলসাঘর” এ একই বিষয় দৃষ্ট হয় কিন্তু সামান্য অন্য ভাবে আর এই “সামান্য অন্য”ই দেয় ইঙ্গিত, সত্যজিত রায়ের নিজ শ্রেণী চরিত্রের। – এ’ও শুধু সূত্রাকারেই থাকবে এখন। কেননা এই মুহুর্তে এ নয়, গো পাঠিকা হে পাঠক, আমার এই মুহুর্তের প্রতিপাদ্য।

“খাইকে পান বেনারস-ওয়ালা” গান কর্ণশূল ছিল বাবার। বাবার প্রজন্মের অনেকেরই। কিন্তু কেন? গানের জাত বিচার করে দেখলে দেখা যাবে, এই “টোন” আদতে সেই সুর যাকে “ফোক” বলে নৃত্য করা হয়েছে তখন, হচ্ছে এখনো। গায়কীর অন্দরে রয়েছে কিশোরকুমারের অসাধারন ‘কাজ’। গলার। গায়কীর। তাহলে কেন কর্ণশূল? কেন আমার কাছেও কর্ণশূল মনে হতো কবিতা কৃষ্ণমূর্তির কন্ঠে রবিগান? এখানে, গো পাঠিকা হে পাঠক, বলে রাখি, যে, আশা কিংবা লতা মঙ্গেশকারের রবিগান এতাবৎ আমার বিবমিষা উদ্রেককারী। একটু এগিয়ে গিয়ে, ব্যাখ্যা ছাড়াই বলেরাখি, যে, এর হেতুটি গান গুলির গায়কীতে এই দুই সঙ্গীত মাফিয়ারই, অসততা শিলালিপি হেন। পক্ষান্তরে ওই সময়েই কিশোরকুমার গীত রবিগান, আমার, অদ্যাপি প্রিয়। কিশোরকুমার গীত রবিগান, আমার, অদ্যাপি প্রিয়। কিশোরকুমার গীত রবিগান, আমার প্রিয় ক্লাশ সেভেন আমল থেকেই। আজ ভাবি, এই একটি বীজ আমাতে প্রোথিত, ভাগ্যে, হয়ে গিয়েছিল, কখনো। 

ফিরি সেই প্রশ্নে “খাইকে পান বেনারস-ওয়ালা” আমার বাবা-জেঠা প্রজন্মের কর্ণশূল। কেন?

এমন কি রেজওয়ানা চৌধুরি’র রবিগানও কেন বহুদিন ছিল আমার কর্ণশূল?

ছিল আমার শ্রেণী চরিত্র হেতু। নিজের অজান্তেই আমিও আমার মনু সংহিতা’তে একুশে আইন লিখে ফেলেছিলাম।

ওই আইন গুলি থেকে মুক্তি, ভাবি খনোই হতো কি, যদি না সামান্য সময়ের জন্য হলেও – প্রথমত রাজনীতি করতে গিয়ে, পরে, আই-টি প্রো হওয়ার পূর্বে, টাটাবাবার কারখানায় – কাজ না করতাম যদি? যদি না শুনতাম, ক্রেন-গাড়ি চালক, প্রায় ক-অক্ষর গোমাংস স্বপনের গলায় ভুলে-চুলে গাওয়া রবিগীতি, নজরুল সঙ্গীত। – এই সকল শোনাও কাজে আসতোনা, যদি –

যদি স্নেহ, অপত্য এসে খুলে না দিতো দরজাটি।

পুত্র।

তার বেড়ে উঠবার সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গীত রুচি হ’তে লাগলো নিজস্ব।

ঠিক যে বয়সে আমার হয়েছিল।

কিন্তু, কলেজ-পড়ানো আমার বাবা, যারা ওই “জেনারেশন গ্যাপ” প্রচারের শিকার, তারা আমার নিজস্ব রুচিকে, সঙ্গীত রুচিকে, পেটি বুর্জোয়া, বিশেষত ভারতীয় পেটি বুর্জোয়া শ্রেণী মনোস্বত্বের নিমিত্তই, বুঝে দেখতে আসেননি। পক্ষান্তরে আমি, আইটি-প্রো হলেও, আদতে তো মাইগ্রেন্ট লেবার, বাস করি দেশগ্রামের হাজার মাইল, আদতে হাজার আলোকবর্ষ দূরের নগরে, ফলে আমার সঙ্গ-সঙ্গীর অভাব। ছেলেমেয়ে’র দিকে বেশী করে ধাবিত হই সেই ফাঁকটি পুষিয়ে নিতে। এতদ্‌ভিন্ন এইটুকু সচেতন চেষ্টা, যেহেতু মার্ক্সবাদের ছাত্র মনে করি নিজেকে, সেইহেতু, নিজের মধ্যেকার পেটি বুর্জোয়া ‘আমি’ গুলির ঋণাত্মক মুখগুলিকে চিহ্নিত করতে। ক’রে নিয়ে, চেষা নিতে সেগুলিকে সমঘার করবার। – না, এইভাবে শ্রেণীহীন-ডি-ক্লাসড্‌ হওয়া যায়না। তথাপি, এ’ও তো দেখেছি যে, মূলত “রাইয়ৎ” প্রশ্নে, জমিদার রবিবাবু’র স্পষ্ট অবস্থান ছিল জমিদারী প্রথারই বিপক্ষে। বিষয়টি প্রথম লক্ষ্য করে ভ’য়ে ভ’য়ে ছিলাম – পাছে ‘শ্রেণীশত্রু’, ‘স্টেট-এজেন্ট’ ইত্যাকার সীল না মেরে বসে অন্যেরা। সাহস পেয়েছিলাম প্রায় বিস্মৃত কিন্তু অত্যন্ত সঠিক চিন্তক, বামপন্থী ইতিহাস আলোচক নরহরি কবিরাজের লেখা পড়ে। সে’ও সেই বারো কেলাস নাগাদ। সম্প্রতি তাঁর অনেক গুলি প্রবন্ধ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে শোভনলাল দত্তগুপ্ত’র সম্পাদনায়।

ফিরে আসি নিজের কথায়। নিজ দরকারেই চেষ্টা নিতে লাগলাম পুত্রের নিজস্ব সঙীতরুচি অনুধাবনের। পুত্র, ক্রমে চরম-বাম রাজনীতিতে যুক্ত হলো। এ’তে তারও অনেকগুলি, আরো অনেকগুলি বন্ধ তোরণ, মনের, গেলো ভেঙ্গে। দেখলাম আমাহেন কোনো নব্য, নিজস্ব মনু সংহিতা তার নেই। ক্রমে দেখলাম, নেই কন্যারও। এতে এক রকমের সাহস পেলাম। উদ্যম, উৎসাহ পেলাম। সুচিত্রা’র “কৃষ্ণকলি” শুনে, শুনলাম রেজওয়ানার, রাজেশ্বরী দত্ত’তে থেমে না গিয়ে অদিতি মহসিনে গেলা “বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল” আনতে। দেখলাম, পাচ্ছি। দেখলাম পারছি। টের পেলাম “যে রাতে মোর দুয়ারগুলি” – বেস্ট শুধু রাজেশ্বরী আর দেবব্রত বলা’র অর্থ, মনে করবার অর্থ, আদতে পরোক্ষ বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনের মতোই বানানো, সাজানো মিথ্যা। … সাহসে ভর করে চালিয়ে দিলাম কবিতা কৃষ্ণমূর্তির রবিগান। লিখতে লিখতে, এই মুহুর্তে, যেন কানে বাজছে তাঁর গাওয়া “অরূপ, তোমার বানী”। যন্ত্রানুষঙ্গ নানা গানে, নানা স্থানে — আমার কানের সঙ্গে এখনো মেলেনা কারণ আমরা রবিগান মানেই “যন্ত্রানুষঙ্গ দূর্বাদল চট্টো” দেখে এবং শুনে কাটিয়ে দিয়েছিম অনেক যুগ। 

কি এই যাত্রার অর্থ?

এই যাত্রার, অনেক মাত্রা’র একটি এই, যে এটি টের পাওয়া – আমার সঙ্গে আমার পুত্রকন্যার দূরত্ব ঠিক ততোটুকুই, যতোটুকু দুটি ব্যক্তির মধ্যে না থাকলে ‘ব্যক্তি’ শব্দের অর্থই থাকেনা। কিন্তু সে দূরত্বের হেতু কোনো “প্রজন্ম” নয়। যদি আত্মপ্রশ্নে, যদি আমার আমার-পুত্র বয়সে নিজস্ব সঙ্গীতরুচির সঙ্গে আমার বাবা-জেঠার সঙ্গীতরুচির ব্যবধানের হেতু নিয়ে সচেতন ভাবে ভাবতে, বুঝতে না বসতাম, তাহলে আমার গান-ব্রহ্মান্ড থেকে যেতো আমরণ সীমিত। ছোট। – এই মর্ম-ব্রহ্মান্ড, গানের, ভাবনার,পাঠের — সীমিত থাকা, সীমিত করে রাখাতেই উৎসুক তারা। তারা মানে যাদের লাভের নিমিত্ত, মুনাফার নিমিত্ত  তুমি-আমি, গো পাঠিকা হে পাঠক মাস্টারি, ডাক্তারি,উকিলী, দালালি, ম্যানেজারি ক’রে ক’রে জীবনপাত করে দিয়েছি। দিচ্ছি। সেই পুঁজির বাবা’রা চায় সীমিত। সীমিত মানেই সীমা। সীমা মানেই টুকরো। টুকরো টুকরো। টুকরো গুলিও কিভাবে হবে তার ফর্মুলাও এরাই দেয়। এক টুকরোর সঙ্গে আরেক টুকরো মিলতে না পারার নিমিত্ত তারা প্রচার করে প্রজন্মগত দূরত্ব, জাতিগত দূরত্ব, ধর্মগত দূরত্ব, স্থানগত দূরত্ব। আঙ্গুল দেখিয়ে বলে “এরা উইপোকা”। আজ। কালই আঙ্গুল অন্যদিকে ফিরিয়ে বলে “এরা মঙ্গলসূত্র ছেঁড়া চিল-কাক”। … এই বলা গুলি, এই পুঁজিমালিক তথা শাসকদিগের, ততোক্ষনই মনে হবে সত্য, যেমন আমাদেরো একদা মনে হয়েছিল “প্রজন্মগত দূরত্ব” সত্য, যতোক্ষণ না …। গো পাঠিকা হে পাঠক, ফিরে যাই আরম্ভে। যে পথ ধরেই হাঁটো, হাঁটি – সেই পথই, অন্তিমে যায় শ্রেণী’র, শেণী সংকটের এবং অন্তিমে শ্রেণী সংগ্রামের সত্যে। গানের, গান শুনবার, গান-রুচির ভিতর দিয়ে এসেও আমি দেখি সেই সত্য। দেখি “প্রজন্মগত দূরত্ব”,”জেনারেশন গ্যাপ” — সত্য পেটি বুর্জোয়া, এবং হাঘরে হাভাতে পেটি বুর্জোয়া নয়, শুধুমাত্র খেতে পড়তে পাওয়া আর ফেলে ছড়িয়ে খাওয়া পেটি বুর্জোয়াদের নিমত্ত নির্মীত, বুর্জোয়াদিগের দ্বারা, একটি মীথ-সত্য। – “এই কি প্রয়োগ? কি ‘মোটিভ’?” – এই প্রশ্ন অসৎ ও সৎ দুই অবস্থান থেকেই করা হবে। গো পাঠিকা হে পাঠক, যদিও গভীরতর, জটিলতর বিশ্লেষণের দাবী রাখে প্রশ্নটি, তথাপি, সহজ করে বলি, আগেই যেমন বলেছি – পুঁজির বাবা’রা চায় সীমা। সীমা মানেই টুকরো। টুকরো টুকরো। টুকরো গুলিও কিভাবে হবে তার ফর্মুলাও এরাই দেয়। এক টুকরোর সঙ্গে আরেক টুকরো মিলতে না পারার নিমিত্ত তারা প্রচার করে প্রজন্মগত দূরত্ব, জাতিগত দূরত্ব, ধর্মগত দূরত্ব, স্থানগত দূরত্ব। আঙ্গুল দেখিয়ে বলে “এরা উইপোকা”। আজ। কালই আঙ্গুল অন্যদিকে ফিরিয়ে বলে “এরা মঙ্গলসূত্র ছেঁড়া চিল-কাক”। … এই ভাবে আলগা করে রাখা। আলগা করে রাখবার নানান ফর্মুলার মধ্যে একটি “প্রজন্মগত দূরত্ব”,”জেনারেশন গ্যাপ” যা যুদ্ধোত্তর বিশ্বে, জনমানসে উত্থিত, বিশেষ করে যুবমানসে – পুঁজি ব্যবস্থা বিষয়ে ওঠা সংশয় আর প্রশ্ন গুলিকে বিপথে চালিত করতেই উদ্ভাবিত ও প্রচারিত। নিও লিবারেলি’রা একেই আরো বৃহত্তর জটিলতা নিয়ে হাজির করছে।  কার্ল ম্যানহাইম (Karl Mannheim) এর মতে “ প্রজন্মগুলি তাদের গঠনমূলক বছরগুলিতে ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর   কারণে বিশ্বকে ভিন্নভাবে অনুভব করে  , যা তাদের বিশ্বদৃষ্টিকে ভিন্নভাবে রূপ দেয়”। গো পাঠিকা পাঠক, “বিশ্বদৃষ্টিকে ভিন্নভাবে রূপ দেয়” – কিসের ভিত্তিতে? কেন? – উত্তর মেলেনা। মেলে ফেনানো কূট-তত্ত্ব। উত্তর মেলেনা, কেননা উত্তর অন্যত্র। “বিশ্বদৃষ্টিকে ভিন্নভাবে রূপ দেয়” নিজ নিজ শ্রেণী অবস্থানের কারণে। প্রতিটি বড় যুদ্ধ উৎপাদন সম্পর্ক যা আদতে একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষের সম্পর্কই — কিন্তু মুনাফা কেন্দ্রীক উৎপাদন ব্যবস্থায় যার মধ্যে আর্থ সামাজিকতা’র এসেপড়া অনিবার্য – তা যায় আমূল বদলে, ফলে ওই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, পরিবর্তিত শ্রেণী অবস্থানে, একটি প্রজন্ম যা তার ম্যানহাইম বর্ণিত “গঠনমূলক” বয়ঃসীমায়, তার সঙ্গে তার মাতাপিতা বা মাতামহী-পিতামহী, মাতামহ-পিতামহের মর্মে জাগরিত প্রশ্ন ভিন্ন হবে কেন? ভিন্ন তখনই হওয়া সম্ভব যদি ওই যুদ্ধ-ঘটনা দুই ভিন্ন প্রজন্মকে স্থাপিত করে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীতে। নতুবা “বিশ্বদৃষ্টিকে ভিন্নভাবে রূপ দেয়” – কথাটি নিতান্ত বাগাড়ম্বর।

আমাদের বাপ-জ্যাঠাগনও যদি ব্যবস্থা-দ্বারা নির্ণীত “হাই কালচার” থেকে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হতেন, যদিও ঐতিহাসিক ভাবে এইরূপ আপনা-আপনি “মুক্তি” অসম্ভব – তবু – তর্কের খাতিরে মেনে নিলে, যতি তারা বসে শুনতেন “খাইকে পান বেনারস-ওয়ালা” গান, “ইয়ে হ্যায় বোম্বে মেরী জান” গান — নিশ্চিত, ক্রমে, আসতো অভ্যস্ততা। সম্ভব হতো গভীরতর বিনিময়। কিন্তু অতি সূক্ষতার সঙ্গে তাদের মগজে “জেনারেশন গ্যাপ” কে সত্য এবং বুদ্ধিমান-শিরখিত সত্য বলে চালান দেওয়ার কাজে এই মুনাফা কেন্দ্রীক ব্যবস্থা সফল হয়েছে। অতএব, পরের স্তরটি, নিও লিবারেলি চালিয়াতিটি আনতে, তারা বহুদূর সফল।

গো পাঠিকা হে পাঠক, অন্তিমে আবার বলি, যে যে পথ ধরেই হাঁটো, হাঁটি – সেই পথই, অন্তিমে যায় শ্রেণী’র, শেণী সংকটের এবং অন্তিমে শ্রেণী সংগ্রামের সত্যে। “খাইকে পান বেনারস-ওয়ালা”র সত্যে।



সপ্তর্ষি বিশ্বাস

১৯/০৭/২০২৫

বেঙ্গালোর



=======================================================



কোন মন্তব্য নেই: