।। সপ্তর্ষি বিশ্বাস ।।
"কি বল্লে গা? হ্যান্ডেলাইটিস্? আহা! কি মিষ্টি নাম গো! অমন একটা রোগ আমার হতে পারেনা?"
"আরে হ্যান্ডে না। হ্যান্ডে না, স্পন্ডে ..."
মনে আছে সেই ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে? তাঁর কৌতুক নক্সাগুলো কে? না'কি 'ভকত' সাজতে গিয়ে বাঙ্গালী এসবও ভুলেছে? ভুলবে?
আহা! কি মিষ্টি শব্দ! কি নিদারুণ নাম 'মাওবাদী', 'আরবান নক্সাল', 'দেশ্দ্রোহী' ...। কি দারুণ ব্যবস্থা 'অপারেশন সমাধান'! আহা, 'ভকতেরা', জানেন তো, রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত এঁরাও ছিলেন, না, 'ভকত' নয়। ভক্ত। মনে আসছে একটি শ্যামাগীতিঃ 'বল মা তারা দাঁড়াই কোথা'। সর্বত্র 'মাওবাদী' আমদানি করলে, এভাবে, হে 'ভকতেরা' দাঁড়াই কোথা আর আপনারাই বা কোথায় দাঁড়াবেন? আপনাদের চাল, চাতুরী, শঠতার পাশাপাশি আপনাদের মুর্খামিও জাহির হচ্ছে যে। সঙ্গে এ'ও কি হচ্ছেনা প্রমাণিত, যে, আপনারা আদতেই, অদ্যাপি, 'জুজু', 'কমিনিস্ট-জুজু' ভয়ে দেখছেন দুঃস্বপ্ন, দিবাস্বপ্ন, সঙ্গে বকছেন প্রলাপ? তবে এমনটা যে হবেই সে'ও তো জানাই ছিল। না, হস্তরেখা দেখে নয়, গ্রহ নক্ষত্র গণনা করে নয়, বাটি চালান দিয়ে বা থালাবাটির অর্কেস্ট্রা করে নয়, বৈজ্ঞানিক বিচার বিশ্লেষণের দ্বারা, সেই ১৮৪৭ সালেই: "A spectre is haunting Europe — the spectre of communism. All the powers of old Europe have entered into a holy alliance to exorcise this spectre: Pope and Tsar, Metternich and Guizot, French Radicals and German police-spies. " আহা, 'ভকতেরা', আপনাদের এই 'মাও' দেখা আর 'মাওবাদী' দেখা, সর্বত্র, এরই কি নামান্তর নয়?
তা 'মাওবাদী' কি জিনিস গা? 'আর্বান নক্সাল' কি বস্তু? মাও'এর অপরাধ টি বা গুলি ঠিক কি? কি কি? জানেন? জানবার দরকার আছে? না, নেই, নেতাদের নেই। গো বলয়ের নেই। কিন্তু আপনারা? যারা এদের ডুগডুগিতে নেচে চলেছেন, আপনাদেরও কি নেই? মনে আছে তো তথাকথিত 'চীন যুদ্ধ' আমলে যে সকল মার্জারেরা ললাটে তিলক কেটে 'নেহেরুপন্থি কমিউনিস্ট' সেজে সরকারের 'নীতি'র দাঁড়ি,কমা অব্দি সমর্থন করেছিল, তাদের হাল? ওই নেহেরুই, অব্যবহিত পরেই, তাদের ঢুকিয়েছিল জেলে। তা আপনারা কোন ছার? আজ এরা বাঙ্গালীকে বলছে 'ছারপোকা' এবং তাকে আড়াল দিতে বলছে 'বাংলাদেশীরা ছারপোকা', হে 'ভকতেরা', দিন গেলে, 'বাংলাদেশীরা' উঠে সমস্ত 'বাঙালি’ই হবে তাদের চোখে 'ছারপোকা' এবং অতঃপর দেশজোড়া সেই সমস্ত মানুষেরা যারা তাদের আদানী, আম্বানি তথা মার্কিনি প্রভুদের বণিকিতে অদরকারী। ঠিক যেমন এই মুহূর্তে ডলু চা বাগানের কর্মীরা, শ্রমিকরা। এই সকল দখলের পরে, হে ভকতেরা, তাদের খুনে হাত এসে বসবে তোমার কণ্ঠনালীতেই। আচ্ছা, সেই 'ভকত' করসেবকদের কি হল যারা এই অঞ্চল থেকে, ভক্তিতে আকুল হয়ে গিয়েছিল দাঙা বাধাতে? অন্তিমে কি পেলো তারা? আপনারা, হে পুঁজিবাবার প্রচারক, 'ভকতেরা', কি নিশ্চিত, যে, এন আর সি'তে এদের কারো নাম ওঠেনি? উঠবে না? -- উঠেছে। উঠবে। সবই দরকারের খেলা। কার দরকারের জানেন? ওই মার্ক্স, মাও, লেনিন যাঁকে বলেছেন 'পুঁজি', 'পুঁজিবাদ', তার। আর ওই 'পুঁজি'কে বাড়িয়ে তোলার খেলায় যারা নায়ক, অধিনায়ক, তারা এমনি, একটি একটি করে শ্রেণীকে এনে নামায় পথে। 'চিরস্থায়ী' বন্দোবস্তের প্রথম ধাক্কা কৃষক আর ক্ষেত মজুরদের যাপনে এসে আছড়ে পড়ে তাদের করে দিতে আরম্ভ করেছিল নিঃসম্বল মজুর। কিন্তু ওই ভূস্বামীরা? যারা ভেবেছিল 'যাক শালারা, এবারে আমাদের তো আর চিন্তা নেই', তাদের কি ঘটলো পরিণতি? জানেন? আমি নিশ্চিত জানেন না। আমিও জানব না। এখানে। বলবো জেনে নিন। নিজ প্রয়োজনে জেনে নিন। জানলেই দেখবেন 'মাও', 'মার্ক্স' 'জুজু'দের আর ভয় নয় ভরসা হচ্ছে আর ভয় করতে আরম্ভ করবেন এই সকল জুজুদের যারা সত্যই রক্তচোষা অথচ যাদের হয়ে আপনি চলেছেন তাঁবেদারি করে। কেন করছেন? না' 'আদর্শ' বলবেন না। আপনাদের কোনও আদর্শ নেই। যাদের জন্ম বিলাইতি সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছিষ্টে, হেগড়েকার, গোলওয়াকর, সাভারকার হেন রাজনৈতিক দেউলিয়াদের উদ্যোগে, শ্যামা প্রসাদ হেন বিষাক্তের পিঠে চেপে, অটল বিহারী-লালকৃষ্ণ আদবানির কোচিং'এ, অমিত শা, নরেন্দ্র মুদীহেন ঘোষিত অপরাধীর 'নেতৃত্বে', তারা 'আদর্শ' বলতে ধান্ধান্ধাবাজি ভিন্ন আর বোঝে না কিছুই। 'তারা' মানে, 'গো বলয়'কৃপাধন্য নেতৃবর্গ। আর তাদের লেজুড়েরা?
হায়, 'লেজুড় ভকতেরা' আপনারা তো কিছুই বোঝেন না, জানেন না। আপনারা নিরীহ ভেড়া পাল। কিন্তু আপনাদের ওই 'নেতৃত্ব' জানে আপনার মাংস কতো সুস্বাদু। সুতরাং আপনাকে তারা পালন-পোষণ করছে। করছে সময় মতো মাংস আর লোম দুয়েরই সদ্ব্যবহারের নিমিত্ত। এখানে বলছে 'বাঙাল! ইনো বাঙালে সব খাইল', বিশুদ্ধ বাংলায় বলছে 'মুসলমান, মুসলমানই সব নষ্টের গোড়া'। বলছে 'প্রাইভেটাইজেশান হোক, তোমার তো ভালোই হবে হে, তোমার ছেলের চাকরির চিন্তা থাকবে না ( তুমি তো হিন্দু ভাই আমার --- ফিস্ ফিস্ ফিস্)', 'দেখছ না স্মার্ট সিটি হচ্ছে দিকে দিকে। তুমি কি চাওনা তেমন একটা স্মার্ট সিটিতে বাস করো তুমি?" ... হায়! আপনি গিলছেন। গিলছেন গঙাজলহেন।
হায়, স্মার্ট সিটি মানে ইন্টারনেট, ইস্টিশানে, বিমান বন্দরে। আর বিমান তো ছাড়ুন, রেলভাড়া যেখানে যাচ্ছে, তাতে আপনি আর কদিন রেলেও চাপতে পারবেন কে জানে। তায় ডলার আর রুমি'র মিশ্রিত ঝুলি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্রেতারা এই রেলকেও কিনে নিতে। নিলেই 'জিও' ইন্টারনেট আরও সস্তা হবে! হবেই, কেননা ইন্টারনেট সস্তা নাহলে কিভাবে তাদের 'আইটি সেল' নানান সিনেমার টুকরো কে এডিট করে, 'মুসলমানের সাহস দেখো' বলে ছড়াবে সর্বত্র? কিভাবে 'কাশ্মীর ফাইল' দেখাবে আপনাকে?
হায়, আমার যেখানে দেশবাড়ি, সেই করিমগঞ্জ শহরে 'ইন্টারনেট' আছে, সেখানে থেকে মাসাধিক কাল আমি, আমার বাবার অসুস্থতাকালে, চালিয়েছি 'ওয়ার্কিং ফ্রম হোম', প্রায় 'সমলেস্ লি' কিন্তু ওই শহরেই, সময় মতো, মানে আমার বাবার মৃত্যু শয্যায়, জোগাড় করতে পারিনি অক্সিজেন সিলিন্ডার! পারিনি অর্থাভাবে নয়। কেননা যেহেতু বর্ণহিন্দু, যেহেতু ধূর্ত মধ্যবিত্ত আমিও, তাই আমিও 'প্রাইভেট আন্তর্জাতিক সংস্থা'য় কাজ করি, দেশবাড়ি ছেড়ে, বাস করি সুমহান বাঙালোরে যা কর্ণাটকে এবং যে কর্ণাটক অধুনা বিজেপি'র সমূহ নাজি-উদ্ভাবনের নিরীক্ষা কেন্দ্র। অর্থাৎ আমার পকেটে টাকা থাকা সত্ত্বেও আমি পারিনি, করিমগঞ্জে, বাবার জন্য অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে, যথাসময়ে। এই হেতু আমার বাবার মৃত্যু অন্তত: ৪৮ ঘণ্টা হয়েছে ত্বরান্বিত। কিন্তু মুদীবাবার ইন্টারনেটের ব্যবস্থা রয়েছে এখানেও!
লোক হটিয়ে বিমানবন্দর? উচ্ছেদ? নাহ, নতুন কিছু নয়। নীল চাষের আমলেও ব্রিটিশরা এমনই করেছিল। ধানজমি নিয়েছিল কেড়ে। ফলিয়েছিল নীল। 'আরে নীলও তো ফসলই, ধান ফলাতে পারো আরও নীল পার না?" জানেন তো এর পরিণতি? কিভাবে নীলচাষীরা গেলো উচ্ছন্নে? অতঃপর 'জুটমিল'। আবার উচ্ছেদ। শরীক অনেক। মহামাতা ভিক্টোরিয়া, নানাবিধ বিলাইতি ও স্কটল্যান্ডীয় কোম্পানি, জমিদার স্বয়ং। 'মিলে তোমরা কাজ পাবে। তোমাদের ভর্তুকি দেওয়া হবে, দেওয়া হবে পুনর্বাসন'। কেন মিলে কাজ পাবে এই জম হারানো লোকেরা? 'জুট'এর, 'জুট মেশিনের' কি জানে তারা? কিছুই না। তবু ভাঁওতা দিয়ে হয়, দিতে হবে। দিতে হয়েছিল। কিন্তু কালে দেখা গেলো আঞ্চলিক চাষাদের পরবারের ১ থেকেও কম শতাংশ মানুষ পেলো 'জুট মিলে' কাজ। বড়জোর দারওয়ান, পাখাবরদার ইত্যাদি। বদলে মালিক এনে হাজির করলো 'স্কিলড লেবার', নানা স্থান থেকে। মোদ্দা, সামান্য ভূমি থাকা চাষিকেও হয়ে উঠতে হল শ্রমিকের মতো নিঃস্ব। সে'ও ঘুরে বেড়াতে লাগলো শহরে, গঞ্জে, বন্দরে তার কায়িক শ্রম কে যে কোনও মূল্যে বিক্রি করে বেঁধে থাকতে না নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।
বিমান বন্দরে কি কাজ করবে এই চা-ফলানো মানুষেরা? দারোয়ান, বড়জোর, বড়জোর সাফাইকার। কিন্তু তা'ও পাবে কজন? নতুন জমিতে চা লাগানোর কাজেও যে নিয়োগ করা হবে এদেরই, অর্থাৎ আপনাদেরই, তারই বা ভরসা কোথায়? বিশ্বাস করা কিভাবে ও কেন? দিল্লীতে কৃষকদের আন্দোলন চলাকালীন ও তার পরে কতোটুকু 'শপথ', ওই কৃষকদিগকে, নিয়েছে, মেনে নিয়েছে এই সরকার। সঙ্গে জুটেছে কিছু তথাকথিত', ভোট সর্বস্ব 'বামপন্থি।
'হ্যান্ডেলাইটিস্' নাম যতোই 'মিষ্টি' হোক, আদতে তা এক অসুখই, অসুস্থতাই।
'চ্যালা ভকত'রা সম্ভব হলে 'ভেবে' দেখতে পারো কো কথা গুলি। 'হ্যান্ডেলাইটিস্' যতোই মিষ্টি নাম হোক আদতে তা এক অসুখই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন