“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ২৮ জুলাই, ২০২১

লিলি

                                                         ।। শৈলেন দাস ।।

 

(C)Image:ছবি

  গতকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া কয়েকটি ফটো এবং একটি ভিডিও দেখার পর থেকেই সতীশের মন ভারাক্রান্ত আর আজ বহুল প্রচারিত স্থানীয় দৈনিক কাগজ যে বিচ্ছিরি একটা শিরোনাম দিয়ে ওই ভাইরাল খবরটি ছেপেছে তাতে সে অনেকটা মর্মাহত। একটি মেয়ের সাহসিকতার কথা রয়েছে খবরটিতে অথচ শিরোনামটা অবমাননাকর! সতীশ ব্যাপারটাকে এত পার্সোনালি নিয়েছে কারণ যে মেয়েটিকে নিয়ে এই খবর, সে আগে থেকেই তাকে চিনে। তার নাম লিলি।

 

    বছর দুয়েক আগের ঘটনা। কোন এক সন্ধ্যায় শহরের ব্যস্ততম এলাকায় সতীশ প্রথমবার স্ট্রিট লাইটের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল লিলিকে। ছিমছাম, সাদা সালোয়ার কামিজ পড়ে একটি মেয়েকে এমন অসময়ে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সতীশের কেমন যেন খটকা লাগল। সে এগিয়ে যাবে মেয়েটির সাথে কথা বলতে, হঠাৎ একটি মারুতি ভ্যান এসে থামল লিলির সামনে এবং সে চটপট উঠে পড়ল তাতে। তিনদিন পর সেই একই জায়গায় একই পরিস্থিতিতে অন্য একটি গাড়ি থামিয়ে অপর একজন বলল 'চল'। লিলি তখন এদিক ওদিক তাকিয়ে মিনিট খানেক সময় নিয়ে ইতস্তত করে উঠে পড়ল গাড়িতে। অদূরে চায়ের দোকানে বসে থাকা সতীশের মনে হল লিলি সম্ভবত বুঝতে পেরেছে যে সে লক্ষ করছে তাকে।

 

    সেদিনই চা দোকানীর কাছ থেকে লিলির যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করল সতীশ। মেয়েটির বাবার যকৃতে ক্যান্সার। ছোট্ট দুটি ভাই বোন, মা আর দিদিমাকে নিয়ে তার সংসার। শহরের বৃহত্তম স্লাম এলাকার একসময়ের সচ্ছল পরিবারের মেয়ে ছিল সে। পাঁচটি পেট পালার দায়িত্ব যখন কাঁধে পড়ল তখন সাহস করে পয়সা উপার্জনের সহজ রাস্তায় নেমে পড়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না তার। 

 

    এর কিছুদিন পর সতীশ আবার লিলিকে দেখেছিল মিশন প্রাঙ্গণে। সারদা মায়ের জন্মদিনে বয়সের ভারে ন্যুব্জ বৃদ্ধা দিদিমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল মিশনের এক কোণে। সতীশ এগিয়ে গেল লিলির কাছে এবং টিপ্পনী করল - 'কোন সময় কে কোথায় যে দাঁড়ায় আজকাল বোঝা বড় দায়'। লিলি বুঝতে পেরেছিল সতীশ তাকে উদ্দেশ্য করেই বলছে কথাগুলি। তবুও কোন প্রত্যুত্তর দেয়নি সে। শুধু দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল তার চোখ থেকে। সমাজে তার পেশা নিষিদ্ধ তবু সেদিন লিলিকে অশুদ্ধ বা অশুচি মনে হয়নি সতীশের। বরং সেদিন নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়েছিল তার। 

 

    সংবাদ যাই হোক শিরোনামে চমক থাকা চাই। তাই লিলির নামের আগে 'যৌনকর্মী' শব্দটি জুড়ে দিল ব্যবসাসফল পত্রিকার সুচতুর এডিটর। একবারও ভেবে দেখল না যে লিলি যৌনকর্মী হিসেবে নয় দায়িত্ব পালন করেছে সুযোগ্য কন্যার। তাছাড়া খবরের ভিতরের অংশে পরোক্ষে লিলির জীবনের নেগেটিভ দিকই যেন তুলে ধরা হয়েছে বেশি করে। করোনা সংক্রমণের অজুহাতে ছেলেমেয়েরা যেখানে মা-বাবার  মৃতদেহ সমঝে নিতে অস্বীকার করছে সেখানে লিলি কোভিড আক্রান্ত পিতার শব একাই শ্মশানে নিয়ে গিয়ে দাহ করেছে, তাকে তো সামান্য সম্মান দেখানো দরকার।

 

    নিষিদ্ধ পেশায় জড়িয়ে থাকলেও যৌনকর্মীদেরও পরিবার থাকে এবং পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালনে ওরা অনেক ব্যতিক্রমী সাহসী - একথা মানুষকে জানাতে হবে। তাই লিলিকে নিয়ে একটা স্টোরি করল সতীশ এবং পাঠিয়ে দিল কয়েকটি দৈনিক কাগজে। কোন কোন কাগজ স্টোরিটি প্রকাশ করে এখন সেটাই দেখার।

 

 

 

সোমবার, ২৬ জুলাই, ২০২১

যে ক'টা দিন পৃথিবীতে ৷৷ পঞ্চদশ পর্ব

।। ১৫।। 

 


(C)Imageঃছবি

আমার শ্বশুরের চোখ এই বেলা আবারও কেমন ছলছল করে উঠল। ডান হাতের বুড়ো আর তর্জনী দিয়ে চশমার ফাঁক দিয়ে চোখ দুটো চেপে ধরে বসে রইলেন কিছুক্ষণ! 

- আব্বা!

- বিয়ে করেই তোমার মা'কে নিয়ে আহমেদাবাদ চলে আসি।

- "হোয়াট দ্য..." ডটের শব্দটা সহ পুরো বাক্যটা  আর চমকানো একসাথেই মনে মনে করা হল। 

- ওলিমাকে এভাবে একা রেখে যাওয়াটা ঠিক হবে না বললেন ভাইসাব! 

এবারে চমকটা কেটে স্বাভাবিক হলাম আমি আর মনে মনে বললাম, এই মাঝরাতে এক বিছানায় বসে কেউ গল্প করলে তাঁকে ফ্রেন্ড ভাবা যেতেই পারে, আর বন্ধুদের মধ্যে টুকটাক বিলেতি চলেই, কিয়া বোলতা হ্যায় আলিম! 

- এক উইকেন্ডের বিকেলে সুনীল আর আমি আহমেদাবাদের জুহাপুরা এলাকায় ঘর খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম টু লেট টাঙানো নাদিম ভাইদের ঘর আর তার পরদিনই তোমার শাশুড়িকে নিয়ে সুনীলদের ঘর থেকে এখানে চলে আসি। 

মনে মনে বললাম, এ-ই তো কত সুন্দর করে সঠিক ভক্যাবুলারির প্রয়োগ হল, হঠাৎ করে "তোমার মা'কে বিয়ে" শুনলে কার মাথা ঠিক থাকে! 

 

- নাদিম ভাইদের ঘরের ঠিক পেছনের ঘরটাতেই আমরা থাকতাম। আসলে সেটাই তাঁদের আসল ঘর ছিল। একটু পুরনো ধাঁচের যদিও, কিন্তু সেটা ভাড়া দেবেন বলেই বেশ ঠিকঠাক করে রেখেছিলেন। আর নাদিম ভাই আর আয়েশা ভাবি সামনের নতুন ঘরটাতে। বেশ একটা পরিবারের মত থাকতে লাগলাম আমরা,এরই মাঝে নাদিয়ার জন্ম।আমাদের আনন্দের সীমা রইলো না। ধীরে ধীরে নাদিয়া বড় হতে থাকল আর আমাদের সকলের চোখের মনি হয়ে উঠল সে। আর তারপর সেই... 

 

আব্বা হঠাৎ করে হু হু কেঁদে উঠলেন। আব্বার কান্নায় আমারও কান্না পাবে পাবে অবস্থা। আব্বাকে জড়িয়ে ধরলাম এই বার। প্রায় মিনিট পাঁচেক এভাবেই ধরে রইলাম। তারপর আবার শুরু করলেন।

 

আলিম ভাই, আইয়ে দেখিয়ে বলে চিৎকার করে উঠলেন নাদিম ভাই। দৌড়ে গিয়ে দেখি টিভিতে সবরমতি এক্সপ্রেসের অগ্নিকাণ্ডের খবর আর সেই সাথে বিভিন্ন যায়গায় দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ার খবর। সে দিনটা ছিল বুধবার। অফিসে বেরুব বলে রেডি হচ্ছিলাম, কিন্তু দাঙ্গার খবরে কেমন যেন একটা অশান্তি বোধ করলাম। সুনীলকে ফোন করতেই বলল, ঘর থেকে না বেরুতে শুনেছে জুহাপুরার বিভিন্ন যায়গা থেকেও নাকি অগ্নিসংযোগের খবর আসছে, দোকানপাট জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমার ফোন শেষ হতে না হতেই নাদিম ভাই বাইরে দৌড় দিলেন। আমি কী করব ভেবে পাচ্ছি না। আয়েশা ভাবি তখন দ্বিতীয় বারের মত অন্তঃসত্ত্বা। তিনি আমাকে তাড়া দেন যে করেই হোক নাদিম ভাইকে ঘরে ফিরিয়ে আনতে। বেলা একটার মত আর আমি হন্য হয়ে নাদিম ভাইকে খুঁজছি সারা জুহাপুরায়। না তিনি তাঁর দোকানেও নেই। দোকান বন্ধ। দাঙ্গার খবর শুনতেই পুরো বাজার এলাকা শ্মশানের ন্যায় নিস্তব্ধ। ঝাঁপে ঝাঁপে শাটার পড়া আর লোকজনের দৌড়াদৌড়িতে আমি বিকেল তিনটের দিকে ঘরে ফিরি। এক ভয়ংকর উৎকণ্ঠায় আমাদের সকলের প্রাণ যায় যায় অবস্থা। মাগরিবের একটু আগেই ফিরলেন নাদিম ভাই। সারা শরীরে আতংকের ছাপ মাখা যেন, কেঁদে কেঁদে বললেন উসমানপুরার গোডাউন জ্বালিয়ে ছাই করে দিয়েছে মহেশ পাণ্ডের দল। দুধেশ্বর,গিরিধর নগর,মধুপুরার বেশ ক'টি বাড়ি আর মসজিদেও আগুন দিয়েছে, শাহ আলম রওজাও ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে, এরা আরও বড় প্ল্যান নিয়ে আসছে আলিম ভাই, আর বড় প্ল্যান নিয়ে..বলেই মাটিতে ধপাস করে বসে গেলেন। 

 

ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল আমি সুনীলকে ফোন লাগালাম আসল ব্যাপারটা জানতে। সে বলল গোধরা স্টেশনে আসতেই সবরমতি এক্সপ্রেসের এক কম্পার্টমেন্টে আগুন লেগে যায় আর সেখানে ছিলেন অযোধ্যা ফেরত বেশ কিছু করসেবক! আর সেটা নাকি মুসলমানরা লাগিয়েছে। ঘটনার শুরু সেই থেকে, তবে মনে হচ্ছে বাকি যায়গায় মুসলমানরা তাঁদের উপর আক্রমণের প্রতি উত্তর দিতে গিয়েই ঘটনাটা খারাপ আকার ধারণ করে। 

 

আমি একটা ভয়ংকর অবস্থার আঁচ পেলাম যেন, আমাদের জুহাপুরার যে এরিয়ায় আমরা থাকি এটা একটা রেসিডেনশিয়েল এলাকা,আর মোটামুটি সবই বড় বড় ব্যবসায়ী! আমাদের আশপাশ থেকে এখনও কোনও অপ্রীতিকর খবর আসে নি, তবে মনে হচ্ছিল খুব খারাপ কিছু একটা হতে চলেছে। কারণ যে ভাবে সকাল পৌনে ন'টার ঘটনা বারো ঘণ্টা পুরো করতে না করতেই এ অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

 

আয়েশা ভাবি বারবার বেহুঁশ হচ্ছিলেন। তাঁকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু এই অবস্থায় আমরা কারুরই ঘর থেকে বের হওয়ার উপায় নেই! কোনোমতে রাতটা কাটিয়ে পরদিন আটাশ ফেব্রুয়ারি ভোর হতেই সকল মিলে আমেনা খাতুন মাল্টি স্প্যাশালিটি হস্পিট্যালের উদ্দেশ্যে রওনা হই। নাদিয়াকে ঘুমন্ত অবস্থায়ই বুকে করে আমি, ওলিমা, নাদিম ভাই আর আয়েশা ভাবি একটা ট্যাক্সিতে চাপি। কিন্তু সেই ট্যাক্সিটা কুরেশি টেক্সটাইলস পৌঁছাতেই দেখি একদল লোক দোকানের তালা ভাঙতে খুন্তি শাবল নিয়ে ব্যস্ত, নাদিম ভাই গাড়ি থামিয়ে কাছে যেতেই হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়, এই ফাঁকে আয়েশ ভাবি ও গাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড় লাগালেন! আমি কিছু বোঝার আগেই দেখলাম আয়েশা ভাবি মাটিতে লুটিয়ে পড়ছেন, নাদিম ভাই ভাবিকে ওঠাতে যেতেই কেউ তাঁর ঘাড়ে ছুরি চালাল, ড্রাইভার আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে তারপর হঠাৎ-ই স্পীড বাড়িয়ে দিল। আমরা দু'জনই বোধহয় জ্ঞান হারা হলাম, হুঁশ যখন ফিরে তখন আমরা সুনীলের ঘরে। 

 

ক্রমশ: 


যে ক'টা দিন পৃথিবীতে ৷৷ চতুর্দশ পর্ব

।। মিফতাহ উদ-দ্বীন ।।

 

(C)Image:ছবি


।। ১৪ ।। 

 

আব্বাকে একটু অস্থির দেখাচ্ছে যেন! কখনো সোফায় বসছেন কখনো বা মশারির পাশে বসে আছেন। কিছু একটা বলবেন মনে হচ্ছে। 

-- আমি মশারির গুণটা খুলে দিচ্ছি দাঁড়ান!

-- না, না ঠিক আছে, আমি বসছি না। চলে যাব...আসলে...

আব্বা এবার একটু পানি খেলেন। আমি নাদিয়ার এভাবে চলে যাওয়াটা থেকেও আসলে বেরিয়ে আসতে পারছি না। আহ বেচারি। কই, একটু সোহাগের আশায় হয়তো কাছে এসেছিল, সেও দিলাম নষ্ট করে। আমি দাড়িয়েই আছি...

-- তুমি বাইরে ছিলে না

আমি হ্যাঁ না কি বলব, কিছুই বুঝতে পারছি না

-- হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি তো বাইরে ছিলে, তা হঠাৎ করে চলে আসলে যে...আচ্ছা, তুমি বাঙালোর ছিলে না

একটা দীর্ঘনিশ্বাসের মাধ্যমে 'বাইরে' নিহিতার্থ টা হৃদয়ঙ্গম করে বললাম..

-- জ্বী, এম্ফ্যাসিস বাঙালোরে ছিলাম 'বছর তারপর চেন্নাইতে উইপ্রো জয়েন করি। 

তাঁর কথা বলার ভঙ্গিতে একটা অস্থিরতার ছাপ দেখে আমি কাবেরী নদীর দুই প্রেমিক যুগলকে একবাক্যে বসিয়ে চাইলাম তাঁর অস্থিরতাকে একটা স্থিতিশীলতায় আনি। 

-- ওহ, তা চলে আসলে...?

জানি না হঠাৎ করে ইন্টার্ভিউয়ের কারণ, আর - জানিনা এর শেষ কবে হবে! মনে মনে কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই বললাম...

-- আব্বা, মা' থেকে দূরে থাকার কোনও অর্থ খুঁজে পাচ্ছিলাম না আসলে। বছরে একবার হপ্তা দশদিনের জন্য এসে তারপর চলে যাওয়াটা কেমন লাগত আমার কাছে, তাছাড়া...

আমি কথা শেষ করার আগেই দেখলাম তিনি একটু স্থিরাবস্থা খুঁজছেন। ভাবলাম, যাক বাঁচা গেলো। এবার আমি দেরি না করেই মশারির সামনের দুই গুন খুলেই আব্বাকে পা তুলে বসতে বলে নিজেও একপাশে বসে গেলাম। আব্বার ঠিক অপরের পাশটায়। তিনি জানু পেতে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন নীচের দিকে তাকিয়ে। আমি গল্পের অপেক্ষায়

 

-- আমি রুরকি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে 'ভেল'- জয়েন করলাম পঁচানব্বুইয়ে। ঠিকঠাকই চলছিল সব। প্রায় চারবছর চাকরি করার পর কেন জানি ভূপালে আর  থাকতে মন চাইল না। আসলে  সুনীল জৈন নামের এক কলিগ বেশ 'মাস থেকেই বলছিল আলিম ভাই, চলেন আর ছাড়ি। এখানে থাকতে আর  ভালো লাগছে না। আমি প্রথম প্রথম কারণ খুঁজে পেতাম না। কী ভালো চাকরি, তাছাড়া সরকারি কোয়ার্টার, ভালো ইন্সেন্টিভস! অথচ সে থাকতে চাইছে না। তাছাড়া সেও তো ভূপালের। রুরকিতে আমরা একই ব্যাচের ছিলাম। তখন থেকেই পরিচয়! একদিন ক্যান্টিনে কারণটা জিজ্ঞেস করতেই কেমন যেন উদাস হয়ে গেল। তারপর যা বলল...

 

এবার আলিম ভাই একটু থামলেন যেন। ওহ, সরি, আব্বা। আমার শ্বশুর! মনে মনে ভাবছি যেভাবে নাটকীয় ভাবে গল্পের শুরু করেছেন রাত 'টায় যে শেষ হয়

 

-- ঈশ ভোপাল নে মেরা বহত কুছ ছিনা হ্যায়

দেখলাম সুনীল সাবের ভুত আব্বার শরীরে মিশে একাকারএবার বোধ হয় পুরো সেশন হিন্দিতেই হবে। আমি একটা অদ্ভুত রকমের পুলক যেন অনুভব করছি সারা শরীরে। নিঝুম রাত, ঝিঁঝিঁ পোকারাও বোধহয় ঘুমিয়ে গেছে, আর  জেগে আছি আমি আর  আমার গল্পকার শ্বশুর! আব্বা হঠাৎ করে হিন্দিটা বলেই যেন একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন, নতুন জামাইয়ের সাথে এমন ডিটেলে ক্যারেক্টারে ঢুকে যাওয়াটা ঠিক হবে না ভেবেই হয়তো বললেন, তাঁর মা ভোপাল গ্যাস ট্রাজেডিতে মারা গেছেন। এর পরপরই তাদের পুরো পরিবার আহমেদাবাদ শিফট হয়ে যায়। কিছুদিন পর তার বাবাও স্ট্রোকে মারা যান। হয়তো স্ত্রী' এই হঠাৎ মৃত্যুটা মেনে নিতে পারেন নি বলেই। কিন্তু ক্যাম্পাস ইন্টার্ভিউয়ে তাঁকে সেই ভূপালেই আসতে হল আবার। 

 

প্রথম দিকে তাঁর ঘটনাটা জানতে পারিনি। কিন্তু পরে যখন এই ঘটনার পেছনে সরকার আর কর্পোরেট সংস্থার ঘাপলা সামনে আসতে থাকে, তখন থেকেই সে আর  থাকতে চাইত না, আর আমাকেও থাকতে দেবে না। অগত্যা রিজাইন দিয়ে নিরানব্বই সালে সেইলের আহমেদাবাদ অফিস জয়েন করলাম দু'জনই। সে তার ঘর থেকে অফিস আসা যাওয়া করত, আর  আমি নাদিম ভাই আর আয়েশা ভাবির ঘরে পেয়িং গেস্ট!

 

আমি গল্প শুনতে শুনতে মনে মনে ভেল আর সেল নিয়ে ভাবছি! আর  ভাবছি এঁদের ফুল ফর্মই বা কীভাবে জিজ্ঞেস করি! শ্বশুর নেটওয়ার্কও নেই যে চুপি চুপি দেখে নেব। 

 

ক্রমশ: 

 

#যেকটাদিনপৃথিবীতে