“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ২১ জুলাই, ২০২১

বৈতনিক সন্তান


                                    ।। পৃথ্বীশ দত্ত ।।

     


     সংবাদ পাওয়া মাত্রই মুম্বাই থেকে মর্নিং ফ্লাইটে ছুটে এলেন অবনীশ,সন্ধ্যায় চেন্নাই থেকে এলেন আবীর।নানা ঝামেলার মধ্যেও তাদের ছুটে আসতে হল। এমন সংবাদ পেয়ে চুপ করে বসে থাকা যায় না। নাড়ির টান বড়োই বেপরোয়া, মাধ্যাকর্ষণ শক্তির চেয়েও শক্তিশালী।পাছে লোকে কিছু বলুক বা না বলুক, সেটা মুখ্য নয় । 

           গাঁয়ের লোকরা যে কিছুই বলছে অথবা বলবে নাতা নয়।তাদের প্রতিটি রন্ধ্র অবনীশ ও আবীরের চেনা আছে ভালো মতো।সামান্য একটি ছিদ্রকে অনায়াসে সুড়ঙ্গ বানিয়ে ফেলতে তাদের বিকল্প নেই।পিএনপিসি-র রসমুদ্রায় বুদ হয়ে থাকে আড্ডা তরঙ্গ।সুরেন্দ্র'র ছেলে বাঁটুল মাস্টারের মেয়ের সাথে প্রেম করে তাতে তোদের কি!কিন্তু না,সেটাও যেন ভারতবর্ষের একটি জটিল সমস্যা।ক্ষেতের আল থেকে চা-স্টলের বারান্দা,সবেতেই সেটা আলোচ্য বিষয়।যতদিন পর্যন্ত না নতুন কোন ইস্যুর সন্ধান পাওয়া যায়,ততদিন একটা বিষয়ই চর্বিতচর্বণ হতে থাকে।সেইদিকটাও যে দুই ভাইকে একেবারে ভাবায় নি তা নয়।তাই কালবিলম্ব না করে ত্বরিতে বাড়িতে চলে এলেন দুই ভাই ।

           এসেই প্রথম তলব করলেন নিধিরামকে।নিধিরামেরও  বিধি বাম।তাকে নীরবে হজম করতে হল একেকটা আত্মঘাতী বাক্যবাণ।দায়িত্বে গাফিলতি করলে কটু কথা শুনতেই হবে।অবনীশ বললেন-- আমরা দুভাই মিলে মাসকাবারে তোর একাউন্টে সাড়ে আট হাজার টাকা পাঠাচ্ছি নিয়মিত ।

           নিধি বিনত হয়ে বলল- আপনাদের দয়াতেই বেঁচে আছি দাভাই !

       -- বাড়ির সুপোরি, নারকেল তুই-ই নিস্ !

       -- আজ্ঞে নেই ।

       -- পুকুরের মাছ কে নেয় ?

       -- আজ্ঞে, আমি ।

       -- ফোন করে যখন বলিস,দাভাই ঘরে টিন লাগাব, হাজার তিনেক টাকা যদি দেন..... ।দিয়েছি কিনা বল ?

       -- আজ্ঞে,দিয়েছেন ।

       -- অথচ,আমাদের মাকে তুই এভাবে ফেলে চলে গেলি ?

       -- কী করব দাভাই.....

       -- করব মানে ? আমাদের মা কি আমাদের পর ! মায়ের চেয়ে আপন কেউ আছে ? নেহাত তিনি আমাদের সঙ্গে থাকতে চান না, নইলে কিছুর অভাব আছে তার ।

           ছেলেদের সঙ্গে গিয়ে থাকতে চান না বলেই গায়ের বাড়িতে মাকে ফেলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন দুই ভাই।সেই নিয়ে বিস্তর সমস্যাও তৈরি হয়েছিল।কিছুতেই ছেলেদের কাছে গিয়ে থাকবেন না,প্রীতিলতা গো ধরে বসে আছেন।ফ্ল্যাটের কুঠরিতে খাঁচা খাঁচা জীবন তার ভালো লাগে না।একবার গিয়েও ছিলেন।কিন্তু একমাসও থাকতে পারেন নি।যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল।নাতি-নাতনিরাও ব্যস্ত।সেই সকালে বাসে চেপে ওরা স্কুলে যায়,আর ফিরতে ফিরতে বেলা তিন-সাড়েতিন।তারপর ওদের একটু ঘুমিয়ে নিয়ে নৈশ-পাঠের জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়।রোববারেও মুক্তি নেই।কেউ গীটার তো কেউ কম্পিউটার ক্লাস নিয়ে যান্ত্রিক।কতকিছু তাদের জানতে হয়,শিখতে হয়,এত পাঠ।ঠাম্মির সঙ্গে লেপ্টে থাকার লগ্ন তাদের বয়েই যায় জীবন গড়ার কসরত করতে গিয়ে।অর্জুন যেমন করে ধ্যানস্ত হয়েছিলেন একটি পাখির নীল কণ্ঠের দিকে,প্রীতিলতার মনে হয়,বড় শহরের মানুষগুলো যেন ছুটতে থাকে একটি বিন্দুর দিকে একনিষ্ঠ লক্ষ্য হিসাবে।সেই দুরন্ত গতির মধ্যে পড়ে,ডানে-বাঁয়ে তাকানোর তাদের অবকাশ নেই।ওরা শুধুই ছুটছে।অসহ্য লাগে প্রীতিলতার।

           সীমান্ত লাগোয়া এই গকুলনগর গ্রামের ঘাসে,মেঠো রাস্তায় এবং বাতাসে বাতাসে মিশে আছে যৌবনের কত স্মৃতি। যৌবন থেকে বার্ধক্যের কত তরঙ্গরেখা।কত ইতিহাস মিশে আছে ইট পাথরে,ধূলিকণায়। দাদাশ্বশুরের সেই ভিটেমাটি,পশ্চিমে নারকেল সুপোরির বাগান,উত্তরে ঠাকুরঘর,প্রতি পূর্ণিমায় পুজো হতো নারায়ণ ঠাকুরের এবং বসন্তে বাসন্তী পুজো।পূর্বদিকে পুকুর,এখন সেটি  শাপলাময়,শান বাঁধানো প্রশস্ত পুকুর-ঘাট,তার দু'ধারে সারি সারি গন্ধরাজ ফুলের সমাহার।একসময় সন্ধ্যায় উজ্জ্বল হয়ে উঠত বৈঠকখানা মানুষের কোলাহলে।বসতো গল্পের আসর।এই সব স্মৃতিকে জড়িয়ে ধরেই প্রীতিলতা পড়ে রয়েছেন গকুলনগর গ্রামে।এখনো রোজ কেউ না কেউ আসে, বসে গল্প করে,পান চিবুতে চিবুতে অন্তত কিছুটা সময় হলেও রাঙিয়ে দিয়ে যায়।প্রীতিলতার দিন কাটে স্মৃতির আস্বাদে,চেনা মানুষের চরম সাহচর্যে,পরম তৃপ্তিতে।এই আনন্দময় রাজপাট, এই একান্ত করে আপন পৃথিবীর মোহ আঁকড়ে থাকা,এই যে মেদুরতাময় স্মৃতির সাতকাহন -- এই নিয়েই প্রীতিলতার দিন কেটে যায়।বেশ তো কেটে যাচ্ছে।তবু ছেলেদের মনে হয় নিজগৃহেই যেন তাদের মা আশ্রমবাসী ।

           একান্ত নিরুপায় হয়েই ছেলেরা মায়ের ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়েছিলেন। অবশেষে মায়ের দেখভালের জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল তারই পছন্দের একজন বৈতনিক ক্যায়ারটেকার।গ্রামের ছেলে সেই নিধিরামই দায়িত্বশীল এক বেতনভোগী সন্তান। বড়ই সহজ সরল ভোলাভালা ছেলেটি প্রীতিলতার সর্বক্ষণের সঙ্গী। প্রীতিলতার কাছেও সে খুব আদরের ও পছন্দের। বিশ্বাস আর পুত্রস্নেহের নিষ্পাপ বলয়ে বেঁধে রেখেছেন নিধিরামকে। দীর্ঘদিন ধরে সেও প্রীতিলতার সাথে ছায়ার মত আছে। কিন্তু দায়িত্ব পালন করে করে হঠাত্‍ যেন তীরে এসে নোঙ্গর ফেলার মুহূর্তে নৌকা ডুবিয়ে দেওয়ার অবস্থা ।

          ছোট ছেলে আবীর ক্ষিপ্ত হলেন-- এত টাকা পয়সা দেই তোকে,তবু এত অবজ্ঞা করে মাকে একলা ঘরে ফেলে চলে গেলি ?

         অবনীশ বললেন-- একজন বুড়ো মানুষ একা বাড়িতে তিনদিন থেকে জ্বরে কাতরাচ্ছেন! তোর কি মায়া-দয়া নেই নিধি?

         নিধি সাতখুনের আসামির মত সংকুচিত    বিগলিত হয়ে বলল--- কী করবো দাভাই, আমার মা যে হঠাৎ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাই যেতে হল।মায়ের চেয়ে বড় তো কেউ না! এবার আপনারই বলুন !

                           ****

 

৬টি মন্তব্য:

Unknown বলেছেন...

আপনার লেখা গল্পটা পড়ে মন মুগ্ধ হয়ে গেলাম অসাধারণ অসাধারণ!এইভাবে আরো বেশি বেশি গল্প চাই !

Unknown বলেছেন...

Exlant

Arghya বলেছেন...

পৃথ্বীশ দা ,
আমার মা সময় বলতেন তোমার লেখার মধ্যে মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার মত লেখা। তাই মা মত বলতে হয় আজও গল্পের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার মত লেখা।

Unknown বলেছেন...

বর্তমান ব্যস্ত জীবনের একটি জ্বলন্ত সমস্যা ,খুব সুন্দর করে তুলে ধরলে।এর সমাধানও হারিয়ে গেছে ব্যস্ত জীবনে ।দারুণ ।খুব ভালো লাগলো।

দীপাঞ্জন পাল বলেছেন...

কিছু বলার নেই, সত্যি বলতে আমার বলার মতো ভাষা নেই।

Unknown বলেছেন...

Darun Darun