“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ১৬ জুলাই, ২০২১

মায়ের ইদ

 

                     ।। মাসকুরা বেগম ।।

  

 

(C)Image:ছবি

        মি আনিশা।ক্লাস ফাইভে পড়ি।কোরবানির ইদের আনন্দ পূর্ণ দিন ঘনিয়ে আসছে।দিনটি উপভোগ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি।দিনটিতে পরিধান করার জন্য কী পোশাক কিনব?কোনটা পোশাক পরলে বেশি সুন্দর লাগবে? কী কী খাব? কোথায় কোথায় বেড়াতে যাব?বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেব!কত শত পরিকল্পনা!সকালে একটি পরিকল্পনা করছি তো আবার বিকালে সেটি বদলে ফেলছি !নতুনভাবে পরিকল্পনা করছি । 

       এত আনন্দের মধ্যে ও মাঝে মাঝে আমার মনটা বিষন্ন হয়ে উঠছে!কেন?ভাবছি।ভাবছি। ওহ্ !বুঝতে পারছি কী কারণে আমার মনটা খারাপ লাগছে!গত বছর ইদের কয়দিন আগে থেকে আমি জ্বরে ভুগছিলাম।তাই বাইরে বেরুতে পারিনি। বাড়িতেই সময় কাটাচ্ছিলাম। ওই ইদে বাড়িতে থাকার সুবাদে যে দৃশ্যগুলো লক্ষ করেছিলাম সেই ছবিগুলো বার বার মনে পড়ছে ইদ আসবারসঙ্গে সঙ্গেই ।

     সেই ইদের তিন দিন আগের কথা।সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম মায়ের আজকের সকাল-দুপুরের খাবার রান্না করা শেষ !মা কখন উঠলেন আর এত কাজ করলেন! বাবা ফজরের নামাজ পড়ে তো ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।আটটার সময় উঠলেন বাবা।দাদিমা বিছানায় বসে কোরআন শরীফ পড়ছেন আর মাঝে মাঝে উঠে নফল নামাজ পড়ছেন।বাবা উঠতেই মা ঝটপট সকালের নাস্তা খাবার টেবিলে সাজিয়ে ফেললেন।আমার শরীর খারাপ থাকায় মা আমাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিলেন। আমার ছোট ভাইকেও খাওয়ালেন।নিজে খেতে বসলেন আর উঠলেন।কী খেলেন আর কীভাবে এত তাড়াতাড়ি শেষ করলেন!আমার মাথায় ঢুকলো না।সবাইকে খাইয়ে রান্নাঘরের সবকিছু গুছিয়ে কোমর বেঁধে লেগে গেলেন কাজে।বাবা চলে গেলেন অফিসে।

 

     সমস্ত ঘর মানে ছাদ থেকে মেজ অবধি সব ঝেড়ে-মুছে পরিষ্কার করলেন।দরজা- জানলার পর্দা,কোশন কভার,বেড কভার, ইত্যাদি সবকিছু ধুয়ে ফেললেন।মাঝখানে হাত মুখ ধুয়ে একবার দাদিমাকে চা করে দিলেন।তারপর আবার আমাদের সবাইকে দুপুরের খাবার খাওয়ালেন।বিকাল তিনটার পর স্নান করলেন।নামাজ পড়লেন - জোহরের কাজা আর আছর একসাথে। সাধারণতঃ মা দুপুর বারোটা- একটার মধ্যে স্নান করে নেন আর যোহরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে নামাজ পড়ে নেন। মা ছোট ভাইকে তারপর আমাকে ঘুম পাড়িয়ে ভাত খেয়েছিলেন বোধহয়।

      সন্ধ্যার পর বাবা অফিস থেকে ফিরে এলে মা সবাইকে চা-নাস্তা দিয়ে কাপড় চোপড় গুছিয়ে রাখলেন। দরজা-জানালার পর্দাগুলো লাগালেন।রাত্রের খাবার রান্না করলেন।তারপর ইদের পিঠা তৈরির জন্য আরও কিছু টুকিটাকি কাজ রান্নাঘরে করে রাখলেন।আমার এসব এত ধরণা নেই।কত কিছুর নামই জানিনা।আমার দিনের বেলার ঘুমটা খুব ভালো হয়েছিল তাই ঘুম আসছিলনা রাত্রে।মা রাত বারোটায় আমার পাশে এসে শুয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন।মায়ের মুখের দিকে চেয়ে বুঝতে পেরেছিলাম - মা খুব ক্লান্ত।আমার ঘুম ধরার আগেই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে মা আধশুয়া অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়লেন।মা সারাদিন একা এত কাজ করলেন তারপর আমার আর ভাইয়ের এটা সেটা কাজ তো আছেই - খাবার দাবার খাওয়ানো,ওষুধ-পাতি খাওয়ানো,স্নান করানো, পোশাক পরানো ইত্যাদি ।

     পরদিন আবার ঘুম থেকে উঠেই মা মেট্রো ট্রেনের মত চলতে শুরু করলেন। পাশের বাড়ির ঢেকি থেকে চাল গুঁড়ো করে আনলেন,নারিকেল কুরিয়ে রাখলেন,ময়দা দিয়ে আরও কী সব করলেন।আমি কী আর চিনতে পারি এত কিছু? আমি জানি মাকে জিজ্ঞেস করলেই বকাবকি করবেন – তোর পড়াশোনা নাই নাকি..........' ইত্যাদি ইত্যাদি।আমি ভয়ে পালাই।

     তার পরদিন ও সারাদিন মা কাজে ব্যস্ত।বেশিরভাগ সময় রান্নাঘরে কাটাচ্ছিলেন।আমাকে রান্নাঘরে ডুকতেই দেন না  সন্ধ্যায় ঘুম থেকে উঠে দেখি নারকেলের নাড়ু,মালপোয়া,চালের পিঠা,মশলা পিঠা,নিমকি,বিস্কুট,কেক,লালমোহন,সন্দেশ  ইত্যাদি সাজিয়ে রাখা।আমি চোখ দুটো বড় বড় করে শুধু দেখছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম।ওই কয়দিন থেকে মা রাত্রে বারোটার আগে বিছানায় যেতেই পারেননি ।

      আমাদের বহু প্রতিক্ষার ইদের দিনটি চলে এসেছিল।আমরা খুশিতে আত্মহারা।মা ঘুম থেকে উঠেই ঘর-দোর পরিপাটি করলেন,পায়েস বানালেন,চিকেন বিরিয়ানি বানালেন।আমাদের স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরিয়ে দিলেন।সুগন্ধি মাখালেন। আমাকে পরির মত সাজালেন।আমি বার বার নিজেকে আয়নার সামনে দেখছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম মা এত সুন্দর করে সাজাতে জানে! 

     মাকে বললাম, - ‘মা তুমি ও একটু মেকআপ কর না। মেকআপ এ কত দক্ষ হাত তোমার।কত সুন্দর লাগবে তোমাকে!'

মা বললেন, - ‘দূর পাগলি ! এখন আমার সাজগোজ করার সময় নাকি?তোদের মত থাকতে কত সাজগোজ করতাম।' 

      টেবিলে সবার জন্য খাবার পরিবেশন করে মা স্নান করতে গিয়েছিলেন। ইদের খুশিতে আমরা ভাই-বোন নিজের হাতেই খেয়েছিলাম আমাদের প্রিয় চিকেন বিরিয়ানি আর পায়েস।বাবা স্নান করে,পাঞ্জাবি কুর্তা পরে,সুগন্ধি মেখে,একটুখানি খাওয়া দাওয়া করে নামাজে চলে গিয়েছিলেন।দাদিমা স্নান করে নতুন মুগা রঙের তাঁতের শাড়িটা পরে ঘরে বাইরে হাঁটছিলেন।মা, বাবার দেওয়া জামদানি শাড়িটা হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে হাত বুলিয়ে দেখছিলেন।দেখে মনে হচ্ছিল,শাড়িটা মায়ের খুব পছন্দ হয়েছে।কিন্তু মাকে দেখলাম একটা সুতির শাড়ি পরছেন যেটা সেদিন ফেরিওয়ালার কাছ থেকে চারশো টাকা দিয়ে কিনেছিলেন মা নিজে

 

- ‘মা মা তুমি এই শাড়িটা পরছ কেন? বাবা যেটা এনেছে ওটা পরো না ।' দৌড়ে এসে আমি বলেছিলাম ।

- ‘না রে মা।এটা অনেক দামি শাড়ি।এটা পরে কাজ করলে নষ্ট হয়ে যাবে। থাক্ কোথাও যাওয়ার সময় পরব।' মা বলেছিলেন।

       মা ও দাদিমা এক সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করে মা আবার কাজে লেগে গিয়েছিলেন।বেশি বেশি করে পেঁয়াজ,রসুন,আদা ইত্যাদি মশলা বাটা করছিলেন।বাবা কোরবানি দিতে চলে গিয়েছিলেন।তিনটি ছাগল কোরবানি করেছিলেন।মাংস নিয়ে ঘরে ফিরে বাবা ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছিলেন।মা বসে পড়েছিলেন মাংস কাটতে।কিছুটা মাংস কেটে ধুয়ে রান্না করলেন,পোলাও বানালেন।তারপর সবাইকে দুপুরের খেতে দিয়ে আবার বাকি মাংসগুলো কাটতে বসেছিলেন । 

     দাদিমা মুখে পান চিবুতে চিবুতে এসে বলেছিলেন, - ‘কী গো সকাল থেকে বিকাল হয়ে যাচ্ছে এখনও মাংস কাটা শেষ হলো না !'

   বিকাল চারটায় মা স্নান করে,নামাজ পড়ে,খাওয়া দাওয়া করেছিলেন।বিকালে অনেক লোকজন এসেছিলেন - প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন,বাবার বন্ধুরা এবং অফিসের সহকর্মীরা।মা সবাইকে হাসি খুশিতে আপ্যায়ন করছিলেন। কোনো ক্লান্তি নেই,ক্লেশ নেই !

   রাত সাড়ে তিনটায় আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল।কারো কান্নার শব্দ যেন শুনতে পাচ্ছিলাম।একটু খেয়াল করলাম।বুঝতে পারলাম মা জায়নামাজে বসে দুহাত তুলে কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, - ‘আল্লাহ গো আমায় ক্ষমা করে দাও!আমি এক মহাপাপী!আজ এশার নামাজ না পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।এখন যে নামাজ পড়লাম তুমি দয়া করে কবুল করে নাও।এই কয়দিন থেকে কত নামাজ কাযা করেছি। তুমি কবুল করে নাও গো আল্লাহ। আমায় ক্ষমা করে দাও।আমি সংসারের কাজ-কর্মগুলো সুনিপুণভাবে সময়ের মধ্যে শেষ করতে পারি না তাই তোমার উপসনা সঠিকভাবে পালন করতে পারি না।আমাকে সময়ানুবর্তি ও নিয়মানুবর্তি হতে সাহায্য কর,মাবুদ!আল্লাহ গো আমার দোয়া তুমি কবুল করে নাও।আমাকে ক্ষমা করে দাও। তোমার উপাসনা করার শক্তি দাও । সংসারের কাজ-কর্ম করার শক্তি দাও ।............।'

      আমার দুচোখ দিয়ে নোনা গরম জল গড়িয়ে পড়েছিল সেই রাত্রে।চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকলাম।আমি জানি,মা এশার নামাজ পড়তে পারেনি ছোট ভাইয়ের জন্য।আমার পাঁচ বছরের ভাইটা মাকে ছাড়া ঘুমাচ্ছিলনা,কাঁদছিল।তাই মা তাকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।আবার ইদ আসছে সবার জন্য খুশি নিয়ে।আবার মায়ের ওই কষ্টের সাক্ষী হতে হবে আমাকে।তাইতো মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে।আচ্ছা!ইদ কাদের জন্য? শুধু কি বাচ্চাদের জন্য,বাবাদের জন্য, বাবাদের অফিসের সহকর্মী কিংবা বন্ধুদের জন্য,আত্মীয় স্বজনের জন্য? মায়েদের জন্য ইদ সুখের না কষ্টের? মাকে জিজ্ঞেস করলে বলবে আমাদের সুখ তো কাজের মধ্যেই'। আমি নিজে নিজে খুঁজছি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কিন্তু আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছিনা!

 

 

 

কোন মন্তব্য নেই: