।। ৭।।
খালা খালুর সাথেই চলে গেলেন মাগরিবের কিছুক্ষণ আগেই। রৌনক তাঁর এক বন্ধুর বাসায় চলে গেল তাঁরও একটু আগে। কাল সেখান থেকেই দু'জন কোটার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবে। এন্ট্রান্সের কোচিঙের জন্য ফাহিম আর রৌনক কোটাতেই থাকে। ফাহিম আমাদের মতিন চাচার ভায়রার ছেলে। বাকি কুটুম্বরাও সবাই যার যার ঘরে ফিরলেন। হঠাৎ করেই ঘরটা কেমন কেমন খালি খালি হয়ে গেল। মা ওয়ালিমাতে আসা মিঠাইগুলো ঘরে ঘরে পাঠাচ্ছেন মন্টুকে দিয়ে। রুশনার ভাতিজা মন্টু। রুশনাকে আজ থেকে যেতে বলছেন মা। ঘরদোর পরিষ্কার করে একেবারে কাল যাবে ও। আফসানা নাদিয়ার পাশে শুয়ে শুয়ে মোবাইলে প্যান্ডেলের মানুষদের খাবারের দৃশ্যগুলো দেখাচ্ছে। খাবারের সময় মানুষের বিভিন্ন ভঙ্গিগুলোকে নিয়ে কোলাজ বানানো, এডিট করে ভিডিও বানানো এগুলো তাঁর নেশা। আব্বা আর আরিফ ক্যাটারারদের বিল মেটাচ্ছেন আর আমি চারদিক একপ্রস্ত চক্কর মেরে ছাদের উপর বসে অন্ধকার আকাশে তারা খুঁজছি।
আসলে তারা খুঁজতে খুঁজতে আমি কয়টা জিনিস মনে মনে ভাবছিলাম। আমার শ্বশুরের নাম আলিম উদ্দিন আর শাশুড়ি ওলিমা বেগম, অথচ তাঁদের মেয়ের নাম নাদিয়া কুরেশি। কেমন যেন একটা বেমানান মনে হচ্ছিল সব কিছু। তাছাড়া নাদিয়ার চেহারার সাথে ও শ্বশুর শাশুড়ির চেহারায় কোনও মিল নেই। নাদিয়া ফর্সা করে লম্বা চেহারার আর মা বাবা দু'জনেই মাঝারি সাইজের গোল চেহারার। শ্যামলা গড়ন। নাদিয়া মা বাবার একমাত্র মেয়ে। তাই বোধহয় তারা দু'জনই বেশ ভাবুক ছিলেন আজ আমাদের ঘরে আসার পর থেকেই। একমাত্র মেয়েকে ছাড়া কীভাবেই বা থাকবেন এখন। সবই আল্লাহর লীলা!
"ভাইয়া, চা খাবে’ চিৎকার আমার ভাবনাটায় যেন সাময়িক যতি টানল। নীচে এসে আফসানাকে বললাম দেখি, তোর মোবাইলটা দে তো। চা খেতে খেতে আফসানার তোলা ফটোগুলো দেখছিলাম। "তোর ভাবি কই?’ প্রশ্নে ইশারায় রুমে শুয়ে আছে দেখাল। ভাবলাম উঠে যাই, কিন্তু গেলাম না কী জানি কে ভেবে।
-- ফটোগ্রাফার তুই?
-- না, রৌনক।
-- বেশ ভালো হয়েছে, ফটোগুলো।
ফটো দেখতে দেখতে একপর্যায়ে একটা ভিডিও-ও দেখলাম, পুরো প্যান্ডেলের। হঠাৎই শফির কথা মনে পড়ে গেল। ভিডিওটা বার বার দেখলাম, কিন্তু কোথাও শফিকে দেখতে পেলাম না। আহা, বেচারাকে দাওয়াতই দেয়া হয় নি বোধ হয়।
-- মা, ও মা, খাবার কেমন রয়েছে আজকের?
-- এখন? মা'র চোখে আশ্চর্য চিহ্ন!
-- না, খাওয়ার জন্য নয়, এক যায়গায় দেব।
-- ওহ, আচ্ছা।
আফসানাকে বললাম যা তো কিছু মাংস, মাছ, ডিম আর ভাত দিয়ে দু'টো টিফিন রেডি কর।
এশার আজান হচ্ছে মসজিদে। আমি বেরিয়ে পড়লাম টিফিন দু'টো নিয়ে শফির ঘরের উদ্দেশ্যে। এবার তারাগুলো বেশ ঝলমল করছে আকাশে, সন্ধ্যার সময় কিছুটা মেঘলা থাকায় হয়তো তারা বেশ দেখা যাচ্ছিল না। আমি আবার ও তারা গুনতে গুনতে সামনে এগোচ্ছি। কিন্তু আসলেই কি এগোতে পারছি, নাদিয়া কুরেশি বারবার পিছু টানছে। এ কেমন খটকা।
-- শফি ঘরে আছো কি? কোনও শব্দ নেই। ঘুমিয়ে গেল না-কি? দেখলাম ভেতরে থেকে একটা টর্চের আলো বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসছে সিনেমা হলের প্রজেক্টর লাইটের মত। এবার একটু জোরে ডাক দিতেই কে যেন বেরিয়ে এল। আলোটা পেছনে থাকায় মুখটা অন্ধকারে দেখা যাচ্ছিল না। কাছে আসতেই সে সালাম করল।
-- ঘুমিয়ে গেছিলে না কি?
-- না, ওই আলোটা, মানে, কেরোসিন....
বুঝলাম, কেরোসিন ফুরিয়ে গেছে টর্চটা জ্বালিয়ে রেখে সবাই ঘুমের প্রস্তুতিতে।
-- খাওয়া দাওয়া?
-- হা?
প্রশ্নটা কঠিন হয়ে গেল না-কি উত্তর জানা নেই, বুঝা গেল না। আমি টিফিন দু'টো হাতে দিয়ে বললাম, কাল টিফিন ফেরত নিতে আসবো। --নাসিমা, বাইরে আয় তো মা!
দেখলাম দু'জন বেরিয়ে এলেন। নাসিমাকে দেখেই চিনে ফেললাম, কারণ অপরজন ছেলে। ফরিদ নাম। জোড়ের ভাইবোন। ক্লাস থ্রিতে পড়ে। একটা তৃপ্তির স্বাদ চোখে মেখে বাড়ির পথ ধরলাম।
ক্রমশ:
#যেকটাদিনপৃথিবীতে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন