“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ২৬ জুলাই, ২০২১

যে ক'টা দিন পৃথিবীতে ৷৷ পঞ্চদশ পর্ব

।। ১৫।। 

 


(C)Imageঃছবি

আমার শ্বশুরের চোখ এই বেলা আবারও কেমন ছলছল করে উঠল। ডান হাতের বুড়ো আর তর্জনী দিয়ে চশমার ফাঁক দিয়ে চোখ দুটো চেপে ধরে বসে রইলেন কিছুক্ষণ! 

- আব্বা!

- বিয়ে করেই তোমার মা'কে নিয়ে আহমেদাবাদ চলে আসি।

- "হোয়াট দ্য..." ডটের শব্দটা সহ পুরো বাক্যটা  আর চমকানো একসাথেই মনে মনে করা হল। 

- ওলিমাকে এভাবে একা রেখে যাওয়াটা ঠিক হবে না বললেন ভাইসাব! 

এবারে চমকটা কেটে স্বাভাবিক হলাম আমি আর মনে মনে বললাম, এই মাঝরাতে এক বিছানায় বসে কেউ গল্প করলে তাঁকে ফ্রেন্ড ভাবা যেতেই পারে, আর বন্ধুদের মধ্যে টুকটাক বিলেতি চলেই, কিয়া বোলতা হ্যায় আলিম! 

- এক উইকেন্ডের বিকেলে সুনীল আর আমি আহমেদাবাদের জুহাপুরা এলাকায় ঘর খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম টু লেট টাঙানো নাদিম ভাইদের ঘর আর তার পরদিনই তোমার শাশুড়িকে নিয়ে সুনীলদের ঘর থেকে এখানে চলে আসি। 

মনে মনে বললাম, এ-ই তো কত সুন্দর করে সঠিক ভক্যাবুলারির প্রয়োগ হল, হঠাৎ করে "তোমার মা'কে বিয়ে" শুনলে কার মাথা ঠিক থাকে! 

 

- নাদিম ভাইদের ঘরের ঠিক পেছনের ঘরটাতেই আমরা থাকতাম। আসলে সেটাই তাঁদের আসল ঘর ছিল। একটু পুরনো ধাঁচের যদিও, কিন্তু সেটা ভাড়া দেবেন বলেই বেশ ঠিকঠাক করে রেখেছিলেন। আর নাদিম ভাই আর আয়েশা ভাবি সামনের নতুন ঘরটাতে। বেশ একটা পরিবারের মত থাকতে লাগলাম আমরা,এরই মাঝে নাদিয়ার জন্ম।আমাদের আনন্দের সীমা রইলো না। ধীরে ধীরে নাদিয়া বড় হতে থাকল আর আমাদের সকলের চোখের মনি হয়ে উঠল সে। আর তারপর সেই... 

 

আব্বা হঠাৎ করে হু হু কেঁদে উঠলেন। আব্বার কান্নায় আমারও কান্না পাবে পাবে অবস্থা। আব্বাকে জড়িয়ে ধরলাম এই বার। প্রায় মিনিট পাঁচেক এভাবেই ধরে রইলাম। তারপর আবার শুরু করলেন।

 

আলিম ভাই, আইয়ে দেখিয়ে বলে চিৎকার করে উঠলেন নাদিম ভাই। দৌড়ে গিয়ে দেখি টিভিতে সবরমতি এক্সপ্রেসের অগ্নিকাণ্ডের খবর আর সেই সাথে বিভিন্ন যায়গায় দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ার খবর। সে দিনটা ছিল বুধবার। অফিসে বেরুব বলে রেডি হচ্ছিলাম, কিন্তু দাঙ্গার খবরে কেমন যেন একটা অশান্তি বোধ করলাম। সুনীলকে ফোন করতেই বলল, ঘর থেকে না বেরুতে শুনেছে জুহাপুরার বিভিন্ন যায়গা থেকেও নাকি অগ্নিসংযোগের খবর আসছে, দোকানপাট জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমার ফোন শেষ হতে না হতেই নাদিম ভাই বাইরে দৌড় দিলেন। আমি কী করব ভেবে পাচ্ছি না। আয়েশা ভাবি তখন দ্বিতীয় বারের মত অন্তঃসত্ত্বা। তিনি আমাকে তাড়া দেন যে করেই হোক নাদিম ভাইকে ঘরে ফিরিয়ে আনতে। বেলা একটার মত আর আমি হন্য হয়ে নাদিম ভাইকে খুঁজছি সারা জুহাপুরায়। না তিনি তাঁর দোকানেও নেই। দোকান বন্ধ। দাঙ্গার খবর শুনতেই পুরো বাজার এলাকা শ্মশানের ন্যায় নিস্তব্ধ। ঝাঁপে ঝাঁপে শাটার পড়া আর লোকজনের দৌড়াদৌড়িতে আমি বিকেল তিনটের দিকে ঘরে ফিরি। এক ভয়ংকর উৎকণ্ঠায় আমাদের সকলের প্রাণ যায় যায় অবস্থা। মাগরিবের একটু আগেই ফিরলেন নাদিম ভাই। সারা শরীরে আতংকের ছাপ মাখা যেন, কেঁদে কেঁদে বললেন উসমানপুরার গোডাউন জ্বালিয়ে ছাই করে দিয়েছে মহেশ পাণ্ডের দল। দুধেশ্বর,গিরিধর নগর,মধুপুরার বেশ ক'টি বাড়ি আর মসজিদেও আগুন দিয়েছে, শাহ আলম রওজাও ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে, এরা আরও বড় প্ল্যান নিয়ে আসছে আলিম ভাই, আর বড় প্ল্যান নিয়ে..বলেই মাটিতে ধপাস করে বসে গেলেন। 

 

ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল আমি সুনীলকে ফোন লাগালাম আসল ব্যাপারটা জানতে। সে বলল গোধরা স্টেশনে আসতেই সবরমতি এক্সপ্রেসের এক কম্পার্টমেন্টে আগুন লেগে যায় আর সেখানে ছিলেন অযোধ্যা ফেরত বেশ কিছু করসেবক! আর সেটা নাকি মুসলমানরা লাগিয়েছে। ঘটনার শুরু সেই থেকে, তবে মনে হচ্ছে বাকি যায়গায় মুসলমানরা তাঁদের উপর আক্রমণের প্রতি উত্তর দিতে গিয়েই ঘটনাটা খারাপ আকার ধারণ করে। 

 

আমি একটা ভয়ংকর অবস্থার আঁচ পেলাম যেন, আমাদের জুহাপুরার যে এরিয়ায় আমরা থাকি এটা একটা রেসিডেনশিয়েল এলাকা,আর মোটামুটি সবই বড় বড় ব্যবসায়ী! আমাদের আশপাশ থেকে এখনও কোনও অপ্রীতিকর খবর আসে নি, তবে মনে হচ্ছিল খুব খারাপ কিছু একটা হতে চলেছে। কারণ যে ভাবে সকাল পৌনে ন'টার ঘটনা বারো ঘণ্টা পুরো করতে না করতেই এ অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

 

আয়েশা ভাবি বারবার বেহুঁশ হচ্ছিলেন। তাঁকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু এই অবস্থায় আমরা কারুরই ঘর থেকে বের হওয়ার উপায় নেই! কোনোমতে রাতটা কাটিয়ে পরদিন আটাশ ফেব্রুয়ারি ভোর হতেই সকল মিলে আমেনা খাতুন মাল্টি স্প্যাশালিটি হস্পিট্যালের উদ্দেশ্যে রওনা হই। নাদিয়াকে ঘুমন্ত অবস্থায়ই বুকে করে আমি, ওলিমা, নাদিম ভাই আর আয়েশা ভাবি একটা ট্যাক্সিতে চাপি। কিন্তু সেই ট্যাক্সিটা কুরেশি টেক্সটাইলস পৌঁছাতেই দেখি একদল লোক দোকানের তালা ভাঙতে খুন্তি শাবল নিয়ে ব্যস্ত, নাদিম ভাই গাড়ি থামিয়ে কাছে যেতেই হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়, এই ফাঁকে আয়েশ ভাবি ও গাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড় লাগালেন! আমি কিছু বোঝার আগেই দেখলাম আয়েশা ভাবি মাটিতে লুটিয়ে পড়ছেন, নাদিম ভাই ভাবিকে ওঠাতে যেতেই কেউ তাঁর ঘাড়ে ছুরি চালাল, ড্রাইভার আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে তারপর হঠাৎ-ই স্পীড বাড়িয়ে দিল। আমরা দু'জনই বোধহয় জ্ঞান হারা হলাম, হুঁশ যখন ফিরে তখন আমরা সুনীলের ঘরে। 

 

ক্রমশ: 


কোন মন্তব্য নেই: