“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ১৪ জুলাই, ২০২১

শর্মী'দি

 

                                                       ।।  শৈলেন দাস ।।


র্মীদিদের বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবে প্রথমে আমি একাই আসি মাধ্যমিক পাশ করার পর। শহরের একদম পাশে অথচ শহর নয় এমন একটি জায়গায় শর্মীদিদের বাড়িটি। এই এলাকায় বাড়ি ভাড়া অনেকটা কম তাছাড়া আমার কলেজের একদম পাশে। গ্রামে বাবার রুজিরোজগারের তেমন সুবিধা হচ্ছিলনা এবং একা থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে আমারও অসুবিধা হচ্ছিল অনেক। তাই আমি উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর আমাদের গ্রামের বাড়ি বিক্রি করে আমরা শর্মীদিদের বাড়িতেই সপরিবারে ভাড়াটে হিসাবে থাকতে শুরু করি। যা আজ অবধি চলছে। দীর্ঘ দিন একই বাড়িতে থাকার ফলে শর্মীদিদের সাথে আমাদের সম্পর্ক এমন হয়েছে যে বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে আমরা একই পরিবারের দুটি অংশ।

     শর্মীদি মানুষ হিসেবে খুব ভাল এবং মিশুকে। তাই আমার মায়ের সাথে ওর খুব অন্তরঙ্গতা। প্রথমদিকে আমিও খুব মিশতাম শর্মীদির সাথে। কিন্তু ডিগ্রিতে উঠার সাথে সাথেই আমি ধীরে ধীরে শর্মীদির থেকে দূরত্ব বাড়াতে থাকি। এর একটা কারণ হল শর্মীদির পোশাক সেন্স। বাড়িতে শর্মীদি সব সময়ই যেন একটু বেশী খোলামেলা। এমন এমন ঢিলেঢালা ঘরোয়া পোশাক পরে অসাবধানতা বশত: নুয়ে কোন কাজ করলে বুকের উপরের অংশ অনেকটা দেখা যায়। আরেকটি কারণ হল আমার সাথে শর্মীদির আদিখ্যেতা দেখানো। অহেতুক আমার শরীরের প্রশংসা করা, নিজে কোথাও বেরোনোর জন্য সাজগোজ করেছে তো আমাকে এসে বলবে 'দেখনা কেমন লাগছে?'। অনেক বার তো এমন টাইট ফিটিং চুড়িদার পরে আসে যেন শর্মীদি ইচ্ছে করেই নিজের ক্লিভেজ দেখতে চায় আমাকে। তৃতীয় কারণটা হল আমার ভীতি ও সন্দেহ। কৈশোরের সঙ্গদোষে এমন কিছু গল্পের বই পড়া হয়ে গিয়েছিল আমার যেগুলি উত্তেজিত যৌবনের বিকৃত রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়। এমনই একটা গল্প ছিল একজন বয়স্ক যুবতী কর্তৃক তার থেকে বয়সে ছোট যুবকদের ফুসলিয়ে বিকৃত তৃপ্তি লাভের। কেন জানি আমার সন্দেহ হত শর্মীদি অনুরূপ কিছু আমার সাথেও করতে চায়। এখানে বলে রাখা ভাল যে শর্মীদি আমার থেকে কমেও আট নয় বছরের বড় হবে এবং শর্মীদিকে নিয়ে আমার ভাবনা বা ধারণা যাই হোক না কেন আমার মা বাবা বা শর্মীদিদের পরিবারের কারও কাছে  শর্মীদির এই খোলামেলা আচরণ ভুল কোন সঙ্কেত মনে হয়নি কখনও।

আমি শর্মীদিকে যতই এড়িয়ে চলি না কেন শর্মীদি যেন আমাকে তার জালে পুরতে মরিয়া। তাই প্রায়ই আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে যেতে চাইত। শপিংয়ে যাবে তো আমাকে বলত 'চল না প্লিজ, একা যেতে ভাল লাগেনা'। একবার তো আমার মাকে বলে কয়ে রাজি করিয়ে নিল আমাকে নিয়ে ওদের কাকুর বাড়িতে দুদিনের জন্য বেড়াতে যেতে। আমি কিন্তু প্রতিবারই কোন না কোন অজুহাতে এড়িয়ে গিয়েছি সেসব। আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে গিয়েছিল যে শর্মীদি আমার সাথে তার কু-বাসনা পূরণ করেই ছাড়বে। তাই আমার কোন খরচ লাগবেনা জেনেও আমি রাজি হইনি শর্মীদির সাথে এবারও গুয়াহাটি আসতে। 

     লোয়ার প্রাইমারি টেট পাস করেছি আমরা দুজনেই। আমার ডি এল এড করা ছিলনা, শর্মীদির ডি এল এড ছিল কিন্তু মার্কস এর পার্সেন্টেজ কম হওয়ায় মেধা তালিকায় নাম আসেনি আমাদের দুজনেরই। কিন্তু আসাম সরকার হঠাৎ করে টেট উত্তীর্ণ যারাই অ্যাপ্লাই করেছিল তাদের সবাইকে স্টেট পুল হিসাবে একইদিনে একযোগে গুয়াহাটিতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। শর্মীদিদের নিজস্ব গাড়ি আছে, ড্রাইভ করবে ওর ভাই রাজদা। তাই শর্মীদি খুব আগ্রহ ও আনন্দে মাকে বলল 'অভি'র বাসের টিকিট কাটার প্রয়োজন নেই, আমাদের সাথে গাড়িতেই যাবে'। আমি আমার এক বন্ধুর গাড়িতে গুয়াহাটি যাব - এই সামান্য মিথ্যে কথাটি আগেই মাকে বলে রেখেছিলাম এবং মা শর্মীদিকে তা জানিয়ে দেওয়ায় আপদ আপাতত কাটল। কিন্তু এই ঘটনায় শর্মীদি মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে খুব। তাই গুয়াহাটি  রওনা দেওয়ার দিন একবারের জন্যও আসেনি আমার ঘরে।

মিথ্যা বলে আপদ দূর করে ছিলাম ঠিকই কিন্তু সমস্যায় পড়েছি পরে। নাইট সুপারে আমার টিকিট ছিল পিছনের সিটের এবং গাড়ির সিটগুলিও সুবিধার ছিলনা। তাছাড়া ড্রাইভার গাড়িটিকে এমনভাবে চালাচ্ছিল যে একজন প্যাসেঞ্জার তো রীতিমতো ঝগড়া করেও ড্রাইভারকে বাগে আনতে পারল না। গাড়িতে ঘুম হয়নি একটুও। বমি বমি ভাব করছিল সারা রাত। যাই হোক, সকালে খানাপাড়া এলাকায় যখন নামি তখনই জ্বরজ্বর ভাব করছিল। শরীর ভাল লাগছিল না তবু সামান্য কিছু খেয়ে  ধীরে ধীরে রওয়ানা দিলাম সরুসাজাই স্টেডিয়ামের দিকে। সেখানে আমাদের নিয়োগপত্র দেওয়া হবে। শারীরিক অস্বস্তি নিয়ে আমি ঢুলতে ঢুলতে স্টেডিয়ামের ভিতরে ঢুকছি। দেখি, শিকার হাত ছাড়া হওয়া আহত বাঘিনীর মত গেটের বাম পাশে দাঁড়িয়ে আছে শর্মীদি। আমি না দেখার ভান করে ডান দিক দিয়ে গেটের ভিতর ঢুকে পড়ি।

স্টেডিয়ামের ভিতর মানুষ ভর্তি। মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রী বসে আছেন, বক্তব্য রাখছেন কোন একজন শিক্ষাধিকারিক। চাকুরী প্রত্যাশীরা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে নির্ধারিত টেবিলের দিকে। নিজেদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার সংগ্রহ করতে হবে সেখান থেকেই। কাঠফাটা রোদে অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে আমি আমার নিয়োগপত্র  হাতে পেয়ে ভিড় ঠেলে কোন মতে বেরিয়ে এসেছি। সামনেই একটি খালি প্লাস্টিকের চেয়ারের হাতলে ধরে কোন মতে বসেছি তারপর মিনিট পাঁচেক আর কিছু বলতে পারিনি। চোখেমুখে জলের ঝাপটা পড়ায় চোখ খুলেছি, দেখি আমার দিকে ঝুঁকে বাতাস করছে শর্মীদি। আশেপাশে কয়েকজন মানুষের ভিড়। আমি একটু ধাতস্থ হওয়ায় শর্মীদি তার বাঁহাতে আমার বাঁহাতটি ধরে ডানহাত আমার পিঠে রেখে বলল 'চল এবার গাড়িতে যাওয়া যাক'। রাজদা আমার ব্যাগ এবং ফাইল পত্র তুলে নিল।

গাড়িতে উঠার পর আমার শরীর কাঁপছিল। শর্মীদি ছোট একটি টাওয়েল তার উরুতে বিছিয়ে আমাকে সেখানে মাথা রেখে ঘুমাতে বলল। অন্যসময় হলে ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই বিচ্ছিরি মনে হত। কিন্তু শর্মীদি যে এত অমায়িক স্নেহ করেন আমাকে কোনদিনও আমি এমন ভাবিনি। দু হাত জোর করে গালের নিচে রেখে আমি শুয়ে পড়লাম শর্মীদির কোলে।

গাড়ি শহর এলাকা ছাড়িয়ে শিলংয়ের পাহাড়ি রাস্তায় ঢুকে পড়েছে। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময় তাই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। হালকা ঘুমের মধ্যে টের পেলাম শর্মীদি তার হাত আমার মাথার উপর বুলিয়ে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে আলতো করে চুলে মুঠো করে টেনে দিতে লাগল, মাথায় তেল দেওয়ার সময় যেমনটা আমার মা করে দেয়। বলে বোঝাতে পারবনা, কী যে ভাল লাগছিল আমার। আমি অনুশোচনায়  কাতর হয়ে তার মুখের দিকে তাকালাম, স্মিত হাসি ছড়িয়ে আছে তার মুখ জুড়ে। 

 

কোন মন্তব্য নেই: