“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ২৬ জুলাই, ২০২১

যে ক'টা দিন পৃথিবীতে ৷৷ চতুর্থ পর্ব

।। ।। 

 

(C)Image:ছবি

ওয়ালিমার খুব জোর প্রস্তুতি চলছে ঘরে বাইরে। রান্নাঘরে মশলা বাঁটা হচ্ছে তিনটে গ্রাইন্ডারে। কাজগুলো করছে রুশনা। রুশনা আমাদের গ্রামেরই তবইর মেয়ে। দু দু'বার বিয়ে দিয়ে সংসার বাঁধতে পারে নি সে।  এখন ভায়ের ঘরে থাকে। বড় ভালো মেয়ে। যেমন তবই, তেমনি তাঁর মেয়ে। তবইর একটা গল্প আমাদের বাড়িতে পুরো হিট। প্রথম প্রথম যখন আমাদের ঘরে ল্যান্ডলাইনে ফোন আসে, তখনকার ঘটনা। একনাগাড়ে ফোন বেজেই চলছে। ধরার মত কেউ নেই। মা ঘরের বাইরে কোথাও। তবই আমাদের ঘরে কাজ করত তখন। ফোনের আওয়াজ শুনে পাশে গিয়ে বলত, কেউ ঘরে নেই, একটু পরে করো। তারপর ফোন যখন রিং করে করে বন্ধ হয়ে যেত, সে চলে আসত। এরকম দু তিনবার হওয়ার পর একটু রেগেই গেল তবই। দরজা থেকেই জোরে জোরে বললবিবি আসলে এমনিই বলব  এখন আর ডেকো না।ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আমাদের পাশের ঘরের এক ভাবি এখনো সেদিনের সেই ঘটনা বলে হেসে লুটোপুটি খান। তবই মারা গেছে আজ  দু বছর। রুশনা যখন মায়ের কাছে থাকত তখন বেশ হাসিখুশি স্বভাবের ছিল। এখন বেশ হাসতে দেখা যায় না তাঁকে

 

বাড়ির আরও  দু একজন চাচী, ভাবিদের নিয়ে মা বসে আছেন এক ঘরে। সুপারি কাটছেন সেখানে 'জন মিলে। রৌনক, খালা আর  আমার ছোট দুই ভাই বোন সুনামগঞ্জের বড় খালার সাথে ভিডিও কলে। বাড়ির ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের দৌড়াদৌড়িতে ঘর যেন একবারে সরগরম। আমি আমার শোবার ঘরটাতে একটা স্ক্যান করে দেখলাম নাদিয়া নামক কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। আসরের প্রায় শেষ ওয়াক্ত তখন।পরে রান্নাঘরের পাশের এক রুম থেকে হাসির খিলখিল আওয়াজে সেখানে ঢুঁ মারতেই দেখা পেলাম মেহদি হাতে মিস নাদিয়া কুরেশি আরও  কয়েকজন মেয়ের মাঝখানে বসে আমাকে ইশারা করছেন। আমি থাম্বস আপ  দেখিয়ে বুঝালাম চালিয়ে যাও। নাদিয়ার সাথে বাড়ির মেয়েদের এমন সখ্যতা দেখে ভালোই লাগল। 

 

আব্বা মতিন চাচা সহ আরও  কয়েকজনকে নিয়ে প্যান্ডেলে বসে গল্প করছেন। মতিন চাচার সাথে আব্বার বড় টান। যেন দু'জনেই দু'জনের জানের জান! মতিন চাচা প্রায়ই আসেন আমাদের ঘরে। বিয়ের দিন সকালবেলার মসজিদের ওই ঘটনা ছাড়া মতিন চাচার কোনও কিছুতেই কোনোদিন বিরক্তবোধ করি নি। কালকের ঘটনা মনে পড়ায় বেশ হাসি পেলো। 

 

আজ   সকালে কী হয়েছিলো?” নাদিয়ার এমন প্রশ্নে একটু চমকে গেলাম যেন

--- কই, কিছু নাতো! মানে কখন?

--- সকালে নাস্তা খেতে গিয়ে দেখলাম পুরো খেলেন না, হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলেন

--- ওহ, তা- 

--- হ্যাঁ, তা- 

নাদিয়ার এই কথা রিপিট করাটার ভঙ্গিটা আমার যেমন ভালো লাগল, তাঁর চেয়ে বেশি ভালো লাগল এই ভেবে যে সে এত নিখুঁত খেয়াল রাখে কীভাবে! একটা ভালো লাগা আবারও যেন ছেয়ে গেল নিজেকে। হাসলাম মনে মনে, তবে সেটা প্রকাশ বোধ হয় হয়েই গেল। 

--- আজকাল দেখি খুব হাসছেন, আমার কি কিছু... 

বুঝলাম যে সকালে আমার বলা কথাটিরই হুবহু নকল। আমি একটু জোরে হাসলাম এবার, সঙ্গে সে ও। তবে তাঁর টা আওয়াজ করে নয়। মুখ মেলে। দাঁতগুলো সব ঝকঝক করছে যেন। 

--- তারপর

--- তারপর কী?

--- কিছু বলছিলাম একটু আগে

--- হ্যাঁ হ্যাঁ বলতে বলতে বলতে আমি চিন্তা করছি কী বলছিল, এবং মনেও পড়ে গেল সকালে নাস্তার টেবিলে অন্যমনস্কতার কথাটা। 

--- আসলে এমনিই। না, মানে ওই শফির ওই অসহায় চেহারাটা আসলে, একজন বাপের এমন চেহারা...

--- হুমম

সে হুমম বলে কিছুক্ষণ বসে রইলো

--- কী হল?

--- ফেসবুকে তো কোনোদিন এসব নিয়ে লিখতে দেখিনি। সারাক্ষণই তো শুধু তিস্তা কে নিয়ে...

এবার আমার চক্ষু বাহির হতে হতে যেন ওর মুখের উপর গিয়ে পড়ছিল। একটা ইলেকট্রিক শক যেন খেলাম। কিছুতেই কিছু মেলাতে পারছি না যেন! আর সে বেশ নির্বিকার

--- ফেসবুক?

--- হ্যাঁ, ফেসবুক, বলেই তাঁর ঠোঁট দুটো চেপে ধরে আমাকে চোখ দিয়ে বলল যেন এবার যাবে কোথা!

আমার উপরতলার সকল কৌতূহলী ইন্দ্রিয়গুলোকে স্বাভাবিক ভাবে ফিরিয়ে আনতে সে নিজেই বলে গেল

--- আমি আপনার লেখা সব পড়ি। একটা মিস করিনি আজ  অব্ধি। আর  তিস্তা পড়ার পর থেকে যেন...

সে থেমে গেল। আমি একটা এইট এন্ড হাফ রেটিং পাওয়া দুর্দান্ত মালয়ালম প্রেমের ছবির যেন শুরু দেখতে পেলাম নাদিয়া কুরেশির  থেমে যাওয়া অর্ধেক কথাতে। 

 

ক্রমশ: 

 

#যেকটাদিনপৃথিবীতে

 

কোন মন্তব্য নেই: