“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ২৫ জুলাই, ২০২১

গ্রামের নিকাশি ব্যবস্থা : একটি পর্যালোচনা

 ।। সাদিক মোহাম্মদ লস্কর ।।

গ্রামে এক সময় জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা খুব সুন্দর ছিল। মানুষের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে একটি ছিল এই ব্যবস্থা করা ও তার পরিচর্যা করা। প্রতিটি গ্রামে আমরা যে সব নালা দেখি তার বেশির ভাগ মানুষের তৈরি। শাসকরাও খুব গুরুত্ব দিতেন এই ব্যাপারে। কিন্তু যখনই মানুষ সরকার নির্ভর হতে শুরু করল তখন থেকেই বিপর্যয় নেমে এল। কারণ মানুষ এখন আর নিজেদের নালা নিজেরা পরিষ্কার রাখে না আর করেও না। আর সরকারি ব্যবস্থায় এতে এখন জোর নেই, কারণ মাটি ভরাট করলে হিসেবে প্রচুর গরমিল করা যায়, নিকাশি ব্যবস্থা ঠিক হয়ে গেলে এই কেলেঙ্কারির দরকার পড়বে না। এভাবে প্রচুর সরকারি পয়সার অপচয় হচ্ছে, টিলা ধ্বংস করে জলাশয় ভরা হচ্ছে ও নিকাশি ব্যবস্থাকে পুরোপুরি নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। এতে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় নেমে আসছে বা অনেকটা এসেই গেছে।

প্রাচীন ভারতের নিকাশি ব্যবস্থা বড় উন্নত ছিল। হরাপ্পা-মহেঞ্জোদারো তো এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বৈদিক যুগেও রাজ্য বা গ্রামের কেন্দ্র বা পুরকে ঘিরে খাই খনন করা হত, এছাড়াও গ্রামের বা রাজ্যের সীমাকে ঘিরে খাই খনন করা হত। এতে জল নিষ্কাশন, জল সংরক্ষণ, জল সরবরাহ, জলপথ ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা হয়ে যেত। নিরাপত্তা বলতে বহিঃশত্রু ও বন্যপ্রাণীর আক্রমণ প্রতিহত করার কথাই বলা হচ্ছে। কাছাড়ের বাঁশকান্দি গ্রামে এ ধরণের দুটি খাই আছে, যাদের নাম গড়খাই ও পুরখাই। পুরখাই নাম বদলে পইরখাইও (পরিখা?) বলা হয়। বরাক নদীর সঙ্গে বাদ্রি উপনদী বা মদ্রি ছড়াকে সংযুক্ত করেছিল গড়খাই। কোনও শাসকের সীমা ছিল এই গড়খাই। আর পুরখাইর মাঝখানে ছিল তাঁর বা তাঁদের সদর। এর পর বরাকের গতিপথ বদলে গেল, সৃষ্ট হল তিনটি আনুয়া। কালের স্রোতে হারিয়ে গেল সেই শাসককুল। জাতীয় সড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে গড়খাইর সঙ্গে আনুয়ার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হল। পুরখাই প্রায় নিশ্চিহ্ন। সেই ইতিহাস বিলুপ্ত হয়ে গেছে অবহেলায়। এমন অনেক প্রাচীন নিকাশি ব্যবস্থা আজ প্রায় নিশ্চিহ্ন  হয়ে গেছে।

নতুনের আগ্রহে প্রাচীনকে অবহেলা ও অস্বীকার করে আমরা নিজেদের এক ভয়ঙ্কর অবস্থানে নিয়ে এসেছি। কিছু জিনিস যে শাশ্বত হয়, চিরন্তন হয়, সে খেয়াল আমরা রাখি না। যার প্রায়শ্চিত্ত আমাদের করতে হবে অনেক মূল্য দিয়ে। তাই আজ চারদিকে জমা জল আর জনপদে হাহাকার। গত কয়েক দশক ধরে দেশ উন্নত হয়েছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু তার সমান্তরালে উন্নয়নের সংজ্ঞায় এক গভীর ও দীর্ঘ ফাটল ধরেছে। ব্যক্তিগত লাভের চাকচিক্যে আমাদের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেছে। আর অস্পষ্ট দৃষ্টি নিয়ে আমরা সেই ফাটলের দিকেই এগিয়ে চলেছি। টেকসই উন্নয়নের কথা আন্তরিকভাবে যারা বলেন তাঁরা প্রায় একঘরে। বাকি সব ওই ফাটল বড় করার কাজই করছেন।

আমদের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গত কয়েক দশক ধরে নিকাশি ব্যবস্থাকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছে। আগে মানুষ নিজেদের গলির কাজ নিজেরাই করত। এখন প্রত্যেকটি গলিকেই গাড়ি চলার উপযোগী করতে প্রস্থ বাড়ানো হয়েছে। এতে প্রত্যক্ষ শিকার হয়েছে নিকাশি ব্যবস্থা। একসময় কেউ খেয়াল করেনি যে গাড়ি চলতে হলে গলিটা জলে ডুবে থাকলে চলবে না। এখন গ্রামাঞ্চলের প্রায় প্রত্যেকটি গলিই জলমগ্ন থাকে বর্ষাকালে। আর এ নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ-মামলা লেগেই আছে। নিকাশি ব্যবস্থা না থাকায় গলির উচ্চতা বাড়াতেই বাড়িগুলো জলমগ্ন হয়ে যায়। তাই জমাজল থেকে বাঁচতে বাড়ির উচ্চতা বাড়াতে হয়। বাড়িগুলো উঁচু হতেই আবার গলি ডুবে যায়, আবার গলিতে মাটি ভরানোর কাজ করতে হয়। এই অন্তহীন প্রক্রিয়া চলতেই আছে। গ্রামের গোপথ ভরে রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে, যা একসময় গোবাদি পশুর চলাচল ও জল নিষ্কাশনের জন্য ব্যবহৃত হত।

পূর্ত বিভাগের আওতায় রয়েছে জাতীয় সড়ক ও প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা। আগে এই সড়কগুলোর পাশ থেকেই মাটি তুলে উচ্চতা বৃদ্ধি করা হত। ফলে রাস্তার দুপাশে বড় বড় নালা ছিল, যা জল নিষ্কাশন ও জল সংরক্ষণ ছাড়াও মাছের যোগান দিত। এখন তো রয়েছে সহজলভ্য টিলামাটি। এভাবে সড়কের প্রস্থ ও উচ্চতা বাড়িয়ে নিকাশি ব্যবস্থাকে হত্যা করা হয়েছে। গ্রামের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ও বাজার এলাকা এখন পুঁতিগন্ধময় অস্বাস্থ্যকর। ফল-ফসল-মাছ উৎপাদন এখন কমে গেছে। ফলে রোজগার ও স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার সহজ শিকার বরাকের আনাচে কানাচে থাকা অজস্র টিলা। গত এক দশকে টিলাগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এতে প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। মাটি কাটায় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও রাখে হরি মারে কে! পরিবেশের এত ক্ষতি করেও জমা জলের সমস্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

নতুন সরকার এখন নতুন বাণী নিয়ে এসেছে। পুরাতনকে চাপা দিয়ে প্রাচীনের দিকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে চলার চেষ্টা করছে। এই অবস্থায় প্রাচীন ভারতের নিকাশি ব্যবস্থার ঐতিহ্যকে গুরুত্ব না দিলে চলবে না। প্রাকৃতিক বা মানুষের তৈরি জলাশয় সংরক্ষণ ও খননের ব্যবস্থা করতে হবে। এগুলোকে অবৈধ দখলদারি থেকে মুক্ত করতে হবে। নতুন করে নিকাশি নালা খনন করতে হবে। সংকীর্ণ গলির নিচে হিউম পাইপ দিয়ে জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। পূর্ত বিভাগের আওতায় থাকা সড়কের দুপাশে প্রশস্ত নালা খনন করতে হবে। কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় করতে হবে। খাস জমিগুলো যেন মানুষের লোভের শিকার না হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

 

কোন মন্তব্য নেই: