“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ২৬ জুলাই, ২০২১

যে ক'টা দিন পৃথিবীতে ৷৷ ষষ্ঠ পর্ব

 ।। মিফতাহ উদ-দ্বীন।।

 

।। ৬।। 

 

(C)departmag.com

ওয়ালিমায় আমার শ্বশুরের সাথে শাশুড়িকেও আসতে দেখে কেমন যেন একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ করলাম দু-একজনের মাঝে। ব্যাপারটা বাইরে থেকে অন্দরমহলেই বুঝলাম বেশি আলোচনা হচ্ছে, আলোচনার ধরণটা যদিও ফিসসিস টাইপ, তথাপি আমার কেমন যেন বিরক্তিকর মনে হল। এটাও যে মানুষের আলোচনার একটা বিষয়বস্তু হতে পারে সেই ভেবেই আমি ভেতরে ভেতরে পাকাচ্ছিলাম। পাকানোর আরেকটা কারণও আছে সে পরে বলছি। এখানে আমার ভয় হচ্ছিল ব্যাপারটা না তাঁদের কানে পৌঁছে যায়। শ্বশুর শাশুড়ি আর চার পাঁচটা বাচ্চা ছেলে মেয়ে সহ মোট সাতাশ জন এসেছেন। এদের সবাইকে প্যান্ডেলে না বসিয়ে সোজা ড্রয়িংরুমে নিয়ে আসা হয়। খাতিরদারিতে যাতে কোনও ত্রুটি না হয় সে খেয়াল রাখছেন মতিন চাচা। আব্বা প্যান্ডেলে গ্রামের মানুষদের খাবারের তদারকি করছেন। সেখানেও একটা ফিসফাস ছিল তবে সে মিটে গেছে। কারণ'টা যদিও আমি, তবে সে ভুল ছিল না শুদ্ধ ছিল সে নিয়ে একটা আলোচনা যে হবে বাড়িতে সে টের পেয়েছি তখনই। 

 

দাওয়াত দিতে গিয়ে আমি গ্রামের দুটি বিশেষ সম্প্রদায়ের বাড়ির লোকজনদের "আপনাদের সবার দাওয়াত’ বলে এসেছি। আর জোহরের পরপরই প্যান্ডেলের প্রায় সব টেবিলেই ছোট ছোট বাচ্চা আর তাঁদের বাবারা! কানাঘুষার সেই শুরু! এদেরকে দাওয়াত করল? এভাবে কেউ দাওয়াত করে নাকি? এখন আমন্ত্রিতরা কোথায় বসবেন? বের করে আনা হোক, তাঁদের প্রত্যেকেরই বাচ্চাদেরকে কেন আনতে হবে, এখন এঁদের সাথে ওরা কীভাবে বসবেন? ব্যাস, একটা অস্বস্তিকর অবস্থা শুরুতেই। বুঝলাম যে দাওয়াত দেয়াও একটা আর্ট, আর সেটা ভালো করে জানি না বলেই হয়তো এ অবস্থা। কিন্তু যা বুঝলাম না, সে হচ্ছে মানুষের মাঝে চৌধুরী, তাপাদার, কিরান, মাইমাল এসব বানাল কে! আমার কাছে তো সবই গ্রামের মানুষ! কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার সেখান থেকে সরে পড়াটাই ছিল বুদ্ধিমানের কাজ, যদিও আব্বা এসে বললেন, টেবিল ফুল হয়ে গেলে খাবার পরিবেশন করতে, তিনি আর এব্যাপারে কোনও আলোচনা চান না! 

 

আমার শাশুড়িকে দেখলাম তাঁর মেয়ের সাথে বসে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে আছেন। চোখ মুছছেন একটু পরপরই! আমি কাছে গিয়ে সালাম দিতেই তড়িঘড়ি চোখ মুছলেন। আমাকে এভাবে হঠাৎ দেখে একটু অস্বস্তি বোধ করলেনই যেন মনে হল, সেটা কাঁটিয়ে উঠেই বললেন, বস বাবা। আমি মিনিট দু-একের মধ্যে মনে মনে "ভালো তো আম্মা’, "শরীর ঠিক আছে তো’, টাইপ কিছু চির অহেতুক প্রশ্ন ভেতরে ভেতরে কয়বার রিহার্সাল দিয়ে দেখলাম আমার দ্বারা এমন ডেলিভারি দেয়া সম্ভব নয়, ডায়লগগুলো গুলে খেয়ে কিছুটা উদ্ভ্রান্তের মত বেরিয়ে গেলাম রুম থেকে। জানি না মা মেয়ে কী ভাবলেন। তবে যেতে যেতে উনার কান্নায় একটু মায়া হল যেন, দূর থেকে এক পলক দেখলাম আবারও মা মেয়েকে! 

 

"কী রে আনিস, তোর বাবা কই গেল?’ মতিন চাচার প্রশ্নে উত্তর দেবার আগেই দেখি আব্বা আসছেন ঘরের দিকে। "তোমার খবর নেই, এদিকে বেয়াই সাহেব পাগল তোমার সাথে গল্প করবেন বলে!’ আব্বা ইশারায় বললেন আগে খাইয়ে নিই, বলেই নতুন বেয়াই সাহেব সহ সকলকে নিয়ে প্যান্ডেলে ঢুকে পড়লেন। আমি পুরো ঘরে এক চক্কর দিয়ে ঠাণ্ডা কিছু আছে কি না খুঁজতে খুঁজতে আবারও আমার রুমে। আসলে নাদিয়াকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল, সেই ভোর সকালে সে পাশে ছিল, এরপর আর কাছে যেতেই পারিনি। 

 

- মা'র সাথে কোনও কথা বললেন না যে!

- আমি? না, মানে, ইয়ে, আসলে...

- কী আবোলতাবোল বলছেন?

- আমি আসলে ঘাবড়ে গেছিলাম।

- কেন? নাদিয়ার কপালে ভাঁজ 

- উনি কাঁদছিলেন দেখে! 

- ওহ, আচ্ছা!

- আচ্ছা, উনি কাঁদছিলেন কেন?

- ও মা, সে আমি কী জানি, আপনিই জিজ্ঞেস করে নেবেন। 

আমি কী বলব ভেবে না পেয়ে তাঁকে একবার জড়িয়ে ধরতে চাইলাম, একটু এগোলামও, কিন্তু ধরা হল না।

- ভাবি, চলেন খেতে যাব।

আফসানার এই হঠাৎ নেমন্তন্নে একটু ভয় পেয়ে গেলাম যেন। নাদিয়া একটা মুচকি হেসে বলল,

- ভালোই হল! 

- কী?

- আপার আসাটা!

- হুমম। 

একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে বেরিয়ে যেতেই শুনি "আহহারে!’। নাদিয়া মুখ টিপে হাসছে। 

পেছনে ফিরেতেই সে ফুড়ুৎ। 

 

ক্রমশ: 

 

#যেকটাদিনপৃথিবীতে

 

কোন মন্তব্য নেই: