“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ২২ মার্চ, ২০২২

।। অন্যরকম।।

               
                
    ।। মাসকুরা বেগম ।।

 

        আমার নাম এতিমা । এতিমা নামটি আমাকে এমনি এমনি দেওয়া হয়নি । কারণ আছে এ নাম রাখার পিছনে । আমার জন্মের এক মাস আগে আমার বাবার সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ! বাবার এই আকস্মিক মৃত্যুতে মা সাংঘাতিকভাবে মানসিক আঘাত প্রাপ্ত হন । বোবা পুতুলের মত হয়ে যান ! হায়রে নিয়তি ! তারপর যা ঘটেছিল তা আরও হৃদয় বিদারক ! একটি শিশুর জন্ম একটি পরিবারে আনন্দের জোয়ার নিয়ে আসে । কিন্তু আমার জন্ম দুঃখের বোঝা নিয়ে এসেছিল ! হায় ! আমার মা ...! হ্যাঁ ! আমার মা আমাকে জন্ম দিয়েই চিরতরে ইহলোক ত্যাগ করেছেন! হারিয়ে ফেলেছি মাকে ! আর ফিরে এল না মা ! কোনদিন এল না ! আমি মা-বাবার মুখই দেখতে পেলাম না ! কেমন ছিল আমার মা ! কেমন ছিল আমার বাবা ! দাদিমার ভারাক্রান্ত হৃদয়ের দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে এসেছিল আমার নাম - এতিমা’ ! দাদিমার প্রাণের স্পন্দন আমি - এতিমা ।

      দাদিমার কাছে শুনেছি আমার জন্মের পর বড় চাচি  বলেছিলেন, - " আমি পারবো না পরের বোঝা টানতে । আমার তিনটি বাচ্চাকেই বড় করব কীভাবে ! তার উপর এই অলক্ষ্মী অপয়া !’ আরও বলেছিলেন, - " গ্রামের সরকারি স্কুলে আমার ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা হবে না । শহরে ভালো স্কুলে পড়াতে হবে । আমরা শহরে চলে যেতে চাই।’

       বড় চাচাও বলেছিলেন, - ‘আমার এখান থেকে শিলচর অফিসে যেতে এক ঘণ্টা সময় লেগে যায় আর শরীরেও সয় না তাই স্থায়ীভাবে ওখানে যাওয়াই ভালো হবে।’

     চাচা-চাচি বাচ্চাদের নিয়ে পরিবার থেকে আলগা হয়ে শহরে চলে গেলেন । তারপর কোনও সময় ছুটি কাটানোর জন্য একটু বেড়াতে আসেন মাত্র । তারা এখন শহরে ভিটে মাটি নিয়ে স্থায়ী বাসিন্দা । দাদিমা বলেন, আসলে নিজের বাচ্চাদের তিনটি কাপড় কিনলে আমার জন্য যে একটি কিনতে হবে, তিন গ্লাস দুধের উপর আরেক গ্লাস যে বাড়তি দুধ লাগবে আমার জন্য, তিনটি চকলেটের জায়গায় চারটি কিনতে হবে - এসব চিন্তা করেই বড় চাচি কেটে পড়েছিলেন নিজের সংসার নিয়ে !

       দুই পিসি তাদের সংসার-স্বামী-সন্তান নিয়ে ব্যস্ত । আমার দায়িত্ব তাঁরা নিতে পারবেন না স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন । গত বৎসর বড় ফুফু  এসেছিলেন তাঁর ছেলের সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে । তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে দাদিমাকে বলতে শুনলাম – ‘কক্ষনোই এ সম্পর্ক হতে পারে না ! তুই না তখন বলেছিলি ‘মাই, এতিমাকে দত্তক দিয়ে দাও । এ বয়সে তোমার এই বাচ্চাটাকে নিয়ে ঝামেলায় পড়ার কী দরকার !  এই মেয়েটিকে আমি যখন বড় করতে পেরেছি, বিয়ে দিতেও পারব । তবে তোর মত নির্দয়ের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেবো না।’ সেদিন যে রাগ করে বড় ফুফু চলে গিয়েছিলেন তারপর আমার বিয়েতেও পর্যন্ত আসেন নি ।

       ছোট চাচি আমাকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন । তখন চাচির নিজের বাচ্চা ছিল না । আমার পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত ছোট চাচা-চাচি  নিজেরা বাচ্চাই নিলেন না । তারপর তাঁদের কোল আলো করে আমার ভাই এসেছে । আরও তিন বছর পর আমার বোন এসেছে । আমি যতটুকু পারি ছোট চাচি আম্মার সহায়তা করি ভালোবেসে । ‘আম্মা’ ‘আব্বা' ডাকি ছোট চাচা - চাচিকে । ভাই - বোন দুটোকে দেখে-শুনে রাখি হৃদয় উজাড় করে ভালোবেসে।

       দাদিমা আমার কোলে মাথাটা রেখে শুয়ে আছেন । খুশি মনে গুড়ো করা পান-সুপারি দিয়ে পান চিবোতে চিবোতে কত গল্প করছেন ! ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন গল্প করতে করতে । সারাদিন রোজা রেখে ইফতার করেছেন যে। বয়স তো কম হয়নি ! আশি বছর পার করেছেন জীবনের! কোনও দিন রোজা রাখা বন্ধ করেননি ! অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছেন আমার মাই মানে দাদিমা। আমি ‘মাই’ ডাকি তাঁকে ।

      সারাদিন কাঠফাটা রোদ আর উৎকট গরমে পিপাসায় প্রায় সব রোজাদারেরা ছটফট করছিল । সূর্যের আলোর ফাঁকে ফাঁকে আকাশে কালো বর্ণের বৈশাখী মেঘ দেখা যাচ্ছিল । লোকজন চাতক পাখির মতো চেয়ে আছে এক পশলা বৃষ্টির আশায়। ইফতারের এক ঘণ্টা আগে এক ঝাপটা কাল বৈশাখী ঝড় প্রকৃতিকে ঠাণ্ডা করার সাথে সাথে ঠাণ্ডা করে দিয়েছে রোজাদারদের প্রাণ । বৈশাখ মাসের বৃষ্টি এক ঝটকায় আসে আবার চলে যায় । বৃষ্টি চলে গেলেও আমেজটা যায় নি। টিনের চালে আম গাছের পাতা থেকে জল পড়ার শব্দ বাজছে সুর তুলে টপটপ-টপটপ। বাইরে বয়ে যাওয়া মৃদুমন্দ ঠাণ্ডা হাওয়া জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকছে আর অফুরন্ত ভালোলাগার ছোঁয়া লাগছে গায়ে ! এই মুহূর্তে প্রকৃতির ফুরফুরে হাওয়া যেমন ভালোলাগার ছোঁয়া দিচ্ছে গায়ে তেমনি আমাদের দাদি-নাতনির মনও খুশিতে ফুরফুর করছে !

          আজ দাদিমার খুশির কারণ আমি । আমার বিয়ে হয়েছে তিন মাস হল । বিয়ের পর এবছরের রমজানের মাসের প্রথম রোজা আজ। এসেছি দাদিমার সঙ্গে ইফতার করতে ! অবাক লাগছে, না ? আজ তো আমার শ্বশুর বাড়িতে থাকার কথা আর বাবার বাড়ি থেকে ঘটা করে ইফতারি দেওয়ার কথা । এটাই তো বরাক উপত্যকার  সমাজের নিয়ম ।

         আজ সকালে তিনজন ভদ্রমহিলা এসেছিলেন আমার শাশুড়ির কাছে । আমার চাচি শাশুড়ি, তিনি নাকি খুবই সম্পদশালী বাবার মেয়ে ! পাশের বাড়ির রুমা পিসি শাশুড়ি, তিনি শ্বশুর বাড়ি থেকে চার দিন পর চলে এসেছিলেন আর কোনদিন ফিরে যাননি কিন্তু কেউ শ্বশুর বাড়িতে কীভাবে চলবে সে বিষয়ে উপদেশ দিতে তিনি পাকা জ্ঞানী ! ওবাড়ির অলির দাদি, তাঁর চার ছেলে থাকতে তাঁর চুলা আলাদা ! ছেলেদের বউদের সঙ্গে তাঁর বনিবনার অভাব ।

       তিন জনেরই মুখ পানসে হয়ে আছে ! বেশি সাড়া শব্দ নেই ! অন্যান্য দিন হলে পান চিবোতে চিবোতে হৈহৈ করে বাড়িতে ঢুকেন ! এমনিতে তাঁদের পানের পিকে রাঙা ঠোঁটের সামনে লিপস্টিকের রংও যেন হার মানায় !

         অলির দাদি শুরু করলেন, - ‘খানো গো, শাহিদের মা ! তোমার বউর ফয়লা ইসতারির গন্ধ বাস ফাইলাম না ।'

- ‘আমরারে তইআ খাইলে ফেট ফুলবো গো ভাবি ।' চাচি শাশুড়ি বললেন ।

- ‘হুনো ভাবি ! বউর বাড়ির কুনতা আইলে সবরে আগে তাকি খইতে লাগে ! ফয়লা ইসতারির মোছা এখলা কুলইন না । ইতা তুমি জানোনা নি ভাবি ?' ফুফু শাশুড়ি বললেন ।

      আমার শাশুড়ি তাঁর ঘরে তাঁদের বসতে দিয়ে চুপচাপ বসে শুনছেন ! আমি আঁটোসাটো হয়ে দাঁড়িয়ে আছি শাশুড়ির পুরনো কাঠের  আলমারিতে গা ঘেঁষে ।

- ‘গতবার হবাড়ির ফখর মাস্টারর বউর ফয়লা দিনকুর ইসতারি সারা গাঁও-এ খাইয়া শেষ করতে ফারছইন না !' দাদি বললেন ।

- ‘আমার ফয়লা দিনকুর ইসতারির খতা মনো নাইনি চাচি ! বাটতে বাটতে শেষ অইছে না, বাদে গরু ছাগলে খাইছইন !' চাচি শাশুড়ি বললেন।

- ‘ওয় ওয় ! তোমার বাড়ির মোছা ইতা ফাউরিমুনি বেটি ! তুমি অইলায় বড়লোক বাফর ফুড়ি । তোমার বাফর কলিজার লাখান কয়জনর কলিজা আছে ।'

- ‘ভাবি তোমার বউর বাড়িত হুনাইয়া রাখছনি । ইলা না আইলে যে তোমার মান সম্মান থাকতো নায় ।' ফুফু শাশুড়ি বললেন ।

         ‘মামনি !' আমার শাশুড়ি হাঁক পাড়লেন । তিনি আমাকে 'এতিমা' ডাকেন না । ‘মামনি' বলে ডাকেন । আমি ভয়ে জড়সড় হয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম – ‘জি আম্মা !'

- ‘মামনি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও ! শাহিদ স্কুল থেকে ফিরে তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে ! তোমার দাদিমার সাথে ইফতার করবে না! তোমাকে ছাড়া আজ প্রথমদিন তাঁর ইফতার মুখে উঠবে কী করে ? বিশটি বছর এক লোকমা কি তোমাকে ছেড়ে মুখে তুলেছেন ? কেমন নাতনি তুমি একবারও বললে না দাদির কাছে গিয়ে ইফতার করার কথা ! আমার অবাক লাগছে !' আমার স্বামী শাহিদ বাজারের লাগোয়া  জনকল্যাণ হাইস্কুলের শিক্ষক ।

     আমি হতবাক !  হতবাক আগন্তুকরা ! দাদি, চাচি ও ফুফুর তিন জনেরই পানসে মুখের যেটুকু ঝলক ছিল নিভে গিয়ে বৈশাখ মাসের আকাশে উড়ে বেড়ানো কালো মেঘের মতো হয়ে গেল !

          মা তাঁদের উদ্দেশ্য করে বললেন -   ‘আপনারা শুনুন ! আমি আগে থেকেই আমার মামনির দাদিকে জানিয়ে দিয়েছি এসব ফালতু কষ্ট যেন আমাদের জন্য না করেন । মা বাবা হারানো এতটুকু দুধের শিশু মেয়েটিকে এত বছর দাদি, চাচা-চাচি লালন-পালন করলেন, শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে মানুষ করলেন । বিয়ে দিলেন । এখন আবার স্বামীর বাড়িতে ভিক্ষা দেবেন কোন দুঃখে ? আমি আপনি কি খাচ্ছি না ? আর কোনদিন আমার বাড়িতে আমার মামনির সামনে দয়া করে এধরনের নিকৃষ্ট কথা-বার্তা বলবেন না ।' তিন জন আগন্তুকই মেঘলা মুখগুলো পেঁচার মত করে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন । 

        স্বামীসহ আমাকে দেখে তো দাদিমা, চাচা-চাচি, চাচাতো ভাই-বোন সবাই অবাক ! দাদিমা আমাকে কতক্ষণ যে জড়িয়ে ধরে ছিলেন টেরই পায়নি ! ভাই বোন দুটো যখন আমার কাপড় ধরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে টান দিল তখন আমার হুস এল ।  বুঝতে পারলাম দাদিমা আজ আমাকে কতটুকু মিস করছিলেন আর আমিও কত শান্তি পাচ্ছিলাম তাঁর বুকে। আমার স্বামী এখানে ইফতার করে ফিরে গেছেন বাড়িতে । মা একা আছেন । যাওয়ার সময় আমাকে বলে গেলেন, - ‘যতদিন ইচ্ছে করে তুমি থাকো । যেদিন মন চাইবে চলে এসো ।'

     মাস ছয়েক আগে আমি সবার সঙ্গে ছোট চাচির বড় ভাইয়ের মেয়ের বিয়েতে গিয়েছিলাম । সেখানে আমার শাশুড়ি আমাকে দেখেছিলেন আর পছন্দ করে ফেললেন ছেলের বউ করার জন্য । কী দেখে যে তাঁর আমাকে পছন্দ হয়েছে আমি ভেবেই পাই না ! আমি তো আর আহামরি কোনও সুন্দরীও না ! সাধারণ চেহারা, সাধারণ গড়ন, সাধারণ রং আমার । স্বামীও বলে প্রথম দিনেই সে নাকি আমার প্রেমে পড়ে গেছে। আমার ডিগ্রি কোর্সটা এখনও শেষ হয়নি । সমস্যা নেই । মা বলেছেন, -‘তোমার যত ইচ্ছে পড়।'

       দাদিমা বলছেন, - ‘কালকেই ফিরে যা তুই । এত ভালো শাশুড়িকে একা ছেড়ে থাকিস না । খুব যত্ন করবি । তোর সুখ শান্তিতে ভরা সংসার দেখছি । এখন নিশ্চিন্তে দুচোখ মুজতে পারব।'

        সবাই খুব খুশি আমার শাশুড়ি মায়ের ব্যবহারে । চাচা ইফতার করেই ছুটেছেন বাজারে বেয়াইনের জন্য শাড়ি কিনতে ! চাচি টিফিনে কী কী দেবেন পরিকল্পনা করছেন ! দাদিমা নাকি ক্ষীর বানিয়ে দেবেন ! 

আমি বলছি – ‘এসব নিয়ে গেলে মা যদি কিছু বলেন ?'

চাচা অভিমানের সুরে বলে উঠলেন, - ‘কেন কিছু বলবেন ? আমরা তাঁর উপর খুশি হয়ে কি কিছু উপহার দিতে পারি না ?'

      আমার ভীষণ ভালো লাগছে । সবকিছু যেন একেবারে অন্যরকম ! নেই কোনও খরচা পাতির চিন্তা, নেই কোনও জাঁকজমক, নেই কোনও উদ্বেগ, নেই কোনও মনোমালিন্য ! সবাই খুশি আজ । ভীষণ খুশি !!!

 ( এই ‘অন্যরকম' গল্পটি নববার্তা প্রসঙ্গে ১৮/০৭/২০২১ প্রকাশিত হয়েছিল )

 

 

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
    

সোমবার, ২১ মার্চ, ২০২২

করোনায় অতিরিক্ত মৃত্যু এবং অতিমারী নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা

 ।। দেবাশিস ভট্টাচার্য, মুম্বাই।। 



নকল্যাণ সংক্রান্ত যে কোনও সরকারি পরিকল্পনাই নির্ভর করে পরিসংখ্যানগত তথ্য এবং তার বিশ্লেষণের ওপর। এর যে কোনও একটি, অথবা উভয়েই, যদি সঠিক না হয় তাহলে সেই পরিকল্পনা যে আশানুরূপ ফলপ্রসূ হবে না, তা বলাই বাহুল্য। করোনা-উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে অতিমারি নিয়ে সরকারি পরিকল্পনার বিষয়ে একই কথা বলা যায়। স্মরণ করা যেতে পারে যে এই অতিমারির চাপে বিশ্বজুড়ে চিকিৎসা পরিসেবা কিভাবে প্রায় ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। তাই ভবিষ্যতে এইধরনের অতিমারির মুকাবিলা করার জন্য সঠিক পরিকল্পনা যে খুব জরুরি সে নিয়ে কোনও দ্বিমত থাকতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন অতিমারি নিয়ে সঠিক তথ্য এবং তথ্যের পর্যালোচনা। তথ্য বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। তবে এরমধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে করোনার কারণে যে মৃত্যু হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান।

করোনাকালে আমরা অনেকেই প্রিয়জন হারিয়েছি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই ডেথ সার্টিফিকেটে হার্ট ফেইলিওর বা অন্যান্য কারণ দেখানো হয়েছে। এখন প্রশ্ন হল করোনা নিগেটিভ হওয়ার পর যদি কোনও ব্যক্তির করোনা সৃষ্ট জটিলতার কারণে মৃত্যু হয় তাহলে মৃত্যুর কারণ করোনা বলা যাবেনা কেন? চিকিৎসা সেবা কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে এরকম একটা যুক্তি দেখানো হয়েছে বলে শোনা যায় যে করোনা নিগেটিভ হবার পর যেহেতু মৃত্যু হয়েছে তাই কারণ হিসেবে করোনা দেখানো হয়নি। কিন্তু এই যুক্তি অনেকেরই ঠিক বোধগম্য হয়নি। এমনকি চিকিৎসক মহলেও নয়। আবার এই অতিমারি যখন শুরু হয়েছিল তখনও কোনও সুস্পষ্ট নীতি না থাকার দরুন মৃত্যু সংখ্যা কম দেখানো হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত টেস্টিং কিট না থাকায় রোগীর মৃত্যুর কারণ নির্ধারণ করা যায়নি। এছাড়াও রাজনৈতিক ইত্যাদি আরও অন্যান্য কারণেও বিশ্বজুড়েই করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা এবং হার কম দেখানো হয়েছে।

 এইভাবে করোনা'কে মৃত্যুর কারণ হিসেবে না দেখানোর জন্য একদিকে যেমন হাজার হাজার পরিবার সরকারি অনুদান ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন অন্যদিকে অতিমারি নিয়ে যাঁরা, বিশেষ করে প্রশাসনিক স্তরে, কাজ করছেন তাঁদের এক বিশেষ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কারণ করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা এবং মৃত্যুর হার কম দেখানোর ফলে এই অতিমারির সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। এর চাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ভবিষ্যতে অতিমারি নিয়ন্ত্রণ এবং চিকিৎসা পরিসেবাজনিত নীতিনির্ধারণী পরিকল্পনাও যে ত্রুটিমুক্ত হবে না সেটাই স্বাভাবিক।

 এই পরিপ্রেক্ষিতে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নীতিনির্ধারকদের কাছে করোনার প্রভাবে অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যা এবং মরটেলি রেট নির্ধারণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। অতিরিক্ত মৃত্যু হার অতিমারির প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাবের পরিমাণ নির্ধারণ করতে আবশ্যক হয়। অতিরিক্ত মৃত্যু হার হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট স্থানে একটি নির্দিষ্ট সময়কালে মোট আনুমানিক মৃত্যুর সংখ্যা এবং অতিমারির অনুপস্থিতিতে প্রত্যাশিত মৃত্যুর সংখ্যার পার্থক্য। পর্যাপ্ত এবং সঠিক পরিসংখ্যানের অভাবে কাজটা বেশ কঠিন। তথাপি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যান্য কিছু সংগঠন বিভিন্ন ধরনের স্ট্যাটিস্টিক্যাল মডেল ব্যাবহার করে করোনার প্রভাবে অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যা এবং হার বের করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক "দা ইকোনমিস্ট’ এই বিষয়ে কিছু প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ‘নেচার’ ম্যাগাজিনেও এই সমস্যা নিয়ে কিছু আলোচনা বেরিয়েছে।

 অতি সম্প্রতি ‘দা লেনসেট’ নামে এক বিখ্যাত সাপ্তাহিক মেডিকেল জার্নালে বিশ্বের ১৯১টি দেশ এবং ২৫২টি রাজ্যে করোনা জনিত মৃত্যুর সংখ্যা এবং মৃত্যুর হার নিয়ে একটি গবেষণামূলক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সময়কাল হচ্ছে ১ জানুয়ারি ২০২০ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২১ । দেখা গেছে এই সময়কালে গোটা বিশ্বে করোনা জনিত মৃত্যুর সংখ্যা যেখানে ৫.৯৪ মিলিয়ন দেখানো হয়েছিল, সেখানে এই প্রতিবেদন অনুযায়ী মৃত্যুর সংখ্যা ছিল প্রায় তিনগুণ, অর্থাৎ ১৮.২ মিলিয়ন। অতিরিক্ত মৃত্যুর হার ছিল, প্রতি এক লাখে, ১২০.৩ জন। তাৎপর্যপূর্ণভাবে বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে ভারতবর্ষেই করোনাজনিত অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যা ছিল সবচাইতে বেশি (৪.০৭ মিলিয়ন), অর্থাৎ প্রকাশিত তথ্যের (৪,৮৯,০০০) চাইতে প্রায় আট গুণ বেশি। এরপর আমেরিকা (১.১৩ মিলিয়ন) এবং রাশিয়া (১.০৭ মিলিয়ন)। অতিরিক্ত মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি ছিল রাশিয়ায় (৩৭৪.৬ জন প্রতি লাখে)।

"লেনসেট" ভারতবর্ষের প্রতিটি রাজ্যের আলাদা করে এই পরিসংখ্যান বের করেছে। আসামে মৃত্যুর সংখ্যা দেখানো হয়েছিল ৬১৬০ জন। অথচ "লেনসেট’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় কুড়ি গুণ বেশি (১,১৯,০০০ জন)। এই অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যা সবচাইতে বেশি মহারাষ্ট্রে (৬,১৬,০০০), যদিও দেখানো হয়েছে ১,৪২,০০০ জন। একইভাবে, আসামে মৃত্যুর হার দেখানো হয়েছিল (প্রতি লাখে) ৯.১ জন, কিন্তু প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৭৬.৬ জন। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে এই ব্যবধান ছিল ১৮.৩ জনের বিপরীতে ১৫২.৫ জন।

 এই স্ট্যাটিস্টিক্যাল মডেল নিয়ে মতানৈক্য থাকতেই পারে। আমারও আছে। একটা কারণ হল স্ট্যাটিস্টিক্যাল মডেল কতটুকু সঠিক হবে তা নির্ভর করে সরকার দ্বারা প্রকাশিত তথ্যের উপর। এই তথ্য কতটা ত্রুটিমুক্ত তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ আছে। কিন্তু একটা কথা পরিষ্কার যে গোটা বিশ্বেই নানা কারণে করোনার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাবে মৃত্যুর সংখ্যা এবং মৃত্যুর হার কম দেখানো হয়েছে। বিভিন্ন গবেষণামূলক প্রতিবেদনে এই বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে। এর ফলস্বরূপ এই অতিমারির সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। তাই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা এই অতিমারির কারণে মৃত্যুর সংখ্যা এবং হার নির্ধারণ করা, ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে হলেও, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


তথ্যসূত্র : https://www.thelancet.com/journals/lancet/article/PIIS0140-6736(21)02796-3/fulltext

বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ, ২০২২

ইচ্ছে পাখি

।। মিঠুন ভট্টাচার্য ।।

(C)Image loan:ছবিঋণ


 

 

 

 

 

 

 

ইচ্ছে হয় -
আবীর হয়ে
চুলে মুখ গুঁজে থাকি,
মেজেন্টা রঙে
গালে লেপ্টে থাকি
অনন্ত।
 ইচ্ছে হয় -
তোমার কথাশব্দের ঝরনায়
বয়ে যাই,
বৃষ্টি হয়ে
উত্তাপ  শুষে নিই,
শ্রাবণধারায়
সবুজে ভরিয়ে দিই।
ইচ্ছে হয়-
শরত-শিউলি গন্ধে
নাকফুল হই,
শীতের কাঁথায় সুতো হয়ে
পিঁপড়ের মত ছুঁয়ে যাই।
আবার  ইচ্ছে জাগে
বসন্তের পরাগ হয়ে গায়ে জড়াই।
 


ভানুমতী

        ।। শৈলেন দাস।। 
(C)Image:ছবিঋণ

                                           
     করিমগঞ্জ জেলার একটি প্রত্যন্ত অঞ্চল ফাকুয়া গ্রাম। এশিয়ার বৃহত্তম জলাভূমি শনবিলের পশ্চিম পারে  অবস্থিত এটি। শিলচর থেকে আমার এখানে  আসার মূল কারণ হল নিখিলদাকে দেওয়া একটি প্রতিশ্রুতি পালন মাত্র। নিখিলদা ফাকুয়া গ্রামের একজন সুপরিচিত যুবক। শিক্ষকতা, সামাজিক কাজ, এনজিও চালানো সবকিছুতেই সে সবার আগে থাকে এই গ্রামে। নিখিলদা পড়াশোনা করেছে শিলচরে থেকে এবং আমার সাথে তার পরিচয় একই বাড়িতে ভাড়া থাকার সুবাদে। ছাত্রজীবন থেকেই নিখিলদা একটু আধটু টিউশন পড়াত। আমি যদিও কোনদিন তার কাছে টিউশন পড়িনি তবে পড়াশোনার বিভিন্ন বিষয় বা সমস্যা নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হত এবং বিষয়গুলি আমি যেভাবে ব্যাখ্যা করতাম তা নিখিলদার খুব ভাল লাগত। আমরা দুজনই সাইন্স স্ট্রিমের ছাত্র ছিলাম।

    কলেজের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার সময় নিখিলদা প্রতিবারই আমাকে সাথে নিয়ে যাওয়ার কথা বলত কিন্তু নানা অসুবিধার কারণে আমার যাওয়া হত না। নিখিলদা যে বছর স্নাতক তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে পাকাপাকিভাবে গ্রামে চলে যায় সে বছর আমিও স্নাতক প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দিয়েছি। তবুও সে বছরই নিখিলদা আমাকে দিয়ে এই প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেয় যে আমি গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করার পর তাদের গ্রামে অন্তত এক সপ্তাহের জন্য অবশ্যই বেড়াতে যাব। তারপর দুবছর কেটে গেছে। আমি সেই প্রতিশ্রুতি বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম কিন্তু যেদিন ফাইনাল ইয়ারের শেষ পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে আসলাম ঘরে ঢুকেই দেখি নিখিলদা বসে আছে। পূর্ব প্রতিশ্রুতি মত আমাকে পরের দিনই সকালে ট্রেনে করে তার সাথে ফাকুয়া গ্রামে যেতেই হবে।

    ফাকুয়া রেলস্টেশন এবং তার আশেপাশের  দৃশ্য খুবই মনোরম। ছোট ছোট টিলার মাঝখান দিয়ে রেল লাইন গিয়েছে। বর্ষার বৃষ্টিস্নাত দিনে যেন মনে হয় শৈল শহর হাফলং। ট্রেন থেকে নেমেই নিখিলদা আমাকে নিয়ে একটি চায়ের দোকানে ঢুকে। সেখানে  তার বন্ধুস্থানীয় কয়েকজনের সাথে আমাকে আলাপ করিয়ে দেয়। শিলচর থেকে এসেছি, নিখিলদার ভাতৃপ্ৰর্তীম একজন মেধাবী ছাত্র আমি তাই সবাই  খুব খাতির করল আমাকে। দুয়েকজন নিখিলদাকে বলল আমাকে তাদের বাড়িতে একদিন নিয়ে যেতে। গ্রামের মানুষ এমনই আন্তরিক হয়।

    দু দিন কেটে গেছে ফাকুয়া গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরাঘুরি করে। এরিমধ্যে নিখিলদার বন্ধুদের বাড়িতেও গিয়েছি সময় করে। ফাকুয়ার কলোনি এলাকার পর থেকেই শুরু হয়েছে শনবিলের হাওর। বিস্তৃত এই জলাভূমি যেন সমুদ্র সদৃশ। স্থানীয় লোকজন এখানে শুকনোর মরসুমে চাষবাস করে এবং বর্ষায় মাছ ধরার পাশাপাশি অনেকেই হাঁস প্রতিপালন করে। পড়ন্ত বিকেলে ডিঙি নৌকায় শনবিলে ঘুরতে গিয়ে প্রায় তিনশোরও বেশি হাঁসকে একসাথে দল বেঁধে ঘরে ফিরতে দেখে আমার দুচোখ জুড়িয়ে গেল। নৈসর্গিক এই দৃশ্য ভোলার নয়।

    তৃতীয় দিন সকালে নিখিলদা বলল- আজ ভানুদের বাড়িতে তোর দুপুরে খাওয়ার নিমন্ত্রণ আছে। কাজেই আজ আর কোথাও বের হওয়ার দরকার নেই। তুই বিশ্রাম কর, আমি দরকারি একটা কাজ সেরে আসি। সময়মত এসে নিয়ে যাব তোকে। দুদিন ঘুরাঘুরি করে আমিও কিছুটা ক্লান্ত বোধ করছিলাম তাই নিখিলদার প্রস্তাবে বেশ খুশিই হলাম। তবে খটকা লাগল ওই ভানুর নাম শুনে। এই অতি অল্প সময়ে নিখিলদার সব বন্ধুদের সাথে আমার মোটামুটি আলাপ হয়ে গেছে, তাদের মধ্যে কারও নাম ভানু বলে তো শুনিনি। যা-ই হোক আমি আর এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাইনি। দুপুরে গেলেই তা জানা যাবে।

    ছোট্ট একটি টিলা, চার পাশে আম কাঁঠাল সুপারির এবং নানা ফুলের গাছ।  ঘরের সামনে নিকানো উঠোন। দরজার সামনে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন তরুণী। আমি কোন মতে উঠোন পেরুলাম তার দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থেকেই। নিখিলদা বলল - কি রে ভানু, কাকাবাবু ঘরে আছেন? আমি যেন চমকে উঠলাম। সে মিষ্টি হেসে বলল- 'হ্যাঁ দাদা, তোমরা বস। আমি বাবাকে ডেকে দিচ্ছি।' নিখিলদা আমাকে বলল- জানিস সতীশ, ভানুমতী খুব ভালো এবং বুদ্ধিমতী মেয়ে। করিমগঞ্জে থেকে পড়াশোনা করে, এবার এইচ এস ফাইনাল দিয়েছে। এন্ট্রান্স একজাম দেবে, যদি না পায় তবে তোর মতই ফিজিক্স নিয়ে পড়বে। কয়েকদিনের জন্য বাড়িতে এসেছে। এখানে সায়েন্স পড়ানোর মত কেউ নেই তাই যে কয়দিন এখানে আছিস তোকে হেল্প করতে হবে তাকে।' আমার তো ভিরমি খাওয়ার উপক্রম। 'কি বলছ তুমি? আমি কি করে পড়াব তাকে?' বলেই করুণ মুখে তাকালাম নিখিলদার দিকে। এরই মধ্যে ভানুমতীর বাবা এসে পড়লেন তাই প্রসঙ্গ বদলে গেল আমাদের। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর নিখিলদা ভানুমতীর বাবাকে বলল- 'কাকু, ও যে কয়দিন এখানে আছে ভানুকে পড়াশোনায় সাহায্য করব।' ভদ্রলোক দেখলাম বেশ আশ্বস্ত বোধ করলেন। আমি মতলবি নিখিলদাকে বকা দিলাম মনে মনে।

    পরদিন থেকে যথারীতি আমাদের ক্লাস শুরু হল। অপ্রস্তুত শিক্ষক হিসেবে আমি যেমন বেশি কথা বলতাম না ভানুমতীও দেখলাম বেশ গুছিয়ে কম কথায় নিজের সমস্যাগুলো আলোচনা করত আমার সাথে। গাণিতিক সমস্যাগুলো একটু ধরিয়ে দিলেই সে করে নিত নিজের থেকে। আমাদের পূর্ব পরিচিতি ছিলনা তবুও ভানুমতী ফ্রি-ভাবেই কথা বলত আমার সাথে। আমার সঙ্কোচ ছিল ঠিকই কিন্তু ভানুমতী যখন লিখায় ব্যস্ত থাকত আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত থাকিয়ে থাকতাম তার দিকে। মেয়েদের সিক্সথ সেন্স খুবই প্রবল তাই মাঝেমাঝে ভানুমতী হঠাৎ মাথা তুলে অস্বস্তিতে ফেলে দিত আমাকে।

    প্রায় এক সপ্তাহ চলেছিল আমাদের ক্লাস। তারপর আমি চলে আসি। ভানুমতীর আর কোন খবর নেওয়া হয়নি আমার। আড়াই বছর পর আবার আমি ফাকুয়া গ্রামে আসি একটি সামাজিক সংস্থার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। সৌজন্যে সেই নিখিলদাই। অনুষ্ঠান প্রায় শুরু হতেই চলেছে, আমি পুরনো পরিচিত কয়েকজনের সাথে কথা বলছিলাম মঞ্চের একপাশে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ খেয়াল করলাম একজন যুবতী অদূরে একথালা ফুল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মন্ত্রমুগ্ধের মত আমার দিকে তাকিয়ে। কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল আমার ভানুমতীকে চিনে নিতে। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য সে সেজে এসেছে। কপালে টিপ, কানে দুল, খোঁপায় লাল গেঁদা ফুল, সবুজে হলুদ শাড়ী পরে যেন সাক্ষাৎ এক পরী। খুশির ঝিলিক তার চোখেমুখে। আমি একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি ভানুমতীর সাথে কথা বলতে এমন সময় মাইকে আমার নাম ঘোষণা হয়ে গেল মঞ্চে গিয়ে আসন গ্রহণ করতে। তাই আমার কথা হয়ে উঠেনি ভানুমতীর সাথে। মঞ্চে উঠে বসে আছি, কিছুই ভালো লাগছে না আমার। অজানা এক ব্যাকুলতা কাজ করছে আমার মধ্যে। এরই মাঝে ঘোষণা হয়েছে স্বাগত ভাষণ দিতে মঞ্চে আসছে কৃতি ছাত্রী ভানুমতী। আমার মন যেন খুশিতে নেচে উঠেছে। পোডিয়ামে কোনাকুনি ভাবে দাঁড়িয়েছে ভানুমতী। অতিথির আসন থেকে ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে তাকে। কম কথায় সুন্দর করে গুছিয়ে বক্তব্য রাখছে সে, চোখে মুখে একরাশ মুগ্ধতা। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে আছি তার দিকে, খেয়ালই নেই সামনে শ'খানেক জনতা বসে আছে। পাশ থেকে নিখিলদা ফিসফিস করে  বলল- 'ভানু এখন দেখতে অনেক সুন্দর হয়েছে। সে ফিজিক্স নিয়েই পড়াশোনা করে। মাঝেমাঝে তোর কথা জিজ্ঞেস করে আমাকে।' সেদিন আর ভানুমতীর সাথে দেখা হয়নি। মঞ্চ থেকে নেমেই আমাদের চলে যেতে হয়েছিল ষ্টেশনের পাশের একটি ফাস্টফুডের দোকানে, শিলচর থেকে আমরা যারা গিয়েছিলাম তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় সেখানে। খাওয়া দাওয়া সেরে সোজাসুজি গাড়িতে উঠে পড়তে হয় আমাদের, রাত হয়ে গিয়েছিল অনেক। তাছাড়া গাড়ি আমার নিজের ছিলনা।

    প্রায় দুবছর পর আজ শিলচর মেইন ব্রাঞ্চে এলআইসি'র প্রিমিয়াম দিতে এসে দেখি কাউন্টারে ভানুমতী বসে আছে। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছিল না। তবে এবারও কথা বলার সুযোগ নেই। মানুষের দীর্ঘ লাইন, আমি কয়েকজনের পরে। কম্পিউটার থেকে চোখ সরাবার জু নেই ভানুর। আমি কাউন্টারে পৌঁছে টাকা দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলাম- 'কেমন আছো ভানু?' সে এক পলক চোখ তুলে তাকাল। তৎক্ষণাৎ একটা খুশির ঝলক ফুটে উঠল তার চোখে। 'ভালো' বলেই আবার চোখ রাখল মনিটরে। প্রিন্ট হতে থাকল আমার রিসিপ্ট। এর মধ্যেই পিছন থেকে একজন বলে উঠল- 'দিদি, গল্প পড়ে করবেন। আগে ছাড়ুন আমাদের।' রিসিপ্ট এর প্রিন্ট নিয়ে ভানুমতী চটপট কি লিখল তারপর আমাকে দিয়ে বলল -'খুলে দেখো কিন্তু।' আমার ইচ্ছে ছিল কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি সেখানে। অন্য আরেকজনের কাছ থেকে টাকা নিতে নিতে ভানুমতী হাসি মুখে ভ্রু নাচিয়ে আমাকে ইশারা করল চলে যেতে।

    ভিড় থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছি। রিসিপ্ট এর ভাঁজ খুলে দেখে আমার মন খুশিতে নেচে উঠল। কম কথায় ভানু সব গুছিয়ে বলে দিয়েছে। নিজের মোবাইল নম্বরের পাশে ইউনিভার্সেল সেই চিহ্ন এঁকে দিয়েছে যা 'জবা দিল কি ধড়কন' বুঝায়। দারুণ খুশিতে ভানুর নম্বরটি আমার মোবাইলে সেভ করতে করতে আমি  বেরিয়ে আসলাম বাইরে।


শুক্রবার, ১১ মার্চ, ২০২২

নদী -কথা


।। মিঠুন ভট্টাচার্য।।

(C)Image:ছবিঋণ


 

 

 

 

 

অনেক আব্দার জমে
আমি পাহাড় হই।
আমি প্রশ্রয় দিই
নদীকে
আমার শরীরের ঢাল বেয়ে নেমে যেতে।
আমার উচ্চতায়
হিমশীতল স্পর্শ,
বসন্তের আবহে
কাঁপুনি ধরা রোমাঞ্চ।
যেতে যেতে মাটির উষ্ণতা নিয়ে
সমতলে বয়ে যায়
ঈষদুষ্ণ জল।
আস্তানায় মিশে
লোনাজলে বিস্বাদ।