।। শৈলেন দাস।।
করিমগঞ্জ জেলার একটি প্রত্যন্ত অঞ্চল ফাকুয়া গ্রাম। এশিয়ার বৃহত্তম জলাভূমি শনবিলের পশ্চিম পারে অবস্থিত এটি। শিলচর থেকে আমার এখানে আসার মূল কারণ হল নিখিলদাকে দেওয়া একটি প্রতিশ্রুতি পালন মাত্র। নিখিলদা ফাকুয়া গ্রামের একজন সুপরিচিত যুবক। শিক্ষকতা, সামাজিক কাজ, এনজিও চালানো সবকিছুতেই সে সবার আগে থাকে এই গ্রামে। নিখিলদা পড়াশোনা করেছে শিলচরে থেকে এবং আমার সাথে তার পরিচয় একই বাড়িতে ভাড়া থাকার সুবাদে। ছাত্রজীবন থেকেই নিখিলদা একটু আধটু টিউশন পড়াত। আমি যদিও কোনদিন তার কাছে টিউশন পড়িনি তবে পড়াশোনার বিভিন্ন বিষয় বা সমস্যা নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হত এবং বিষয়গুলি আমি যেভাবে ব্যাখ্যা করতাম তা নিখিলদার খুব ভাল লাগত। আমরা দুজনই সাইন্স স্ট্রিমের ছাত্র ছিলাম।
কলেজের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার সময় নিখিলদা প্রতিবারই আমাকে সাথে নিয়ে যাওয়ার কথা বলত কিন্তু নানা অসুবিধার কারণে আমার যাওয়া হত না। নিখিলদা যে বছর স্নাতক তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে পাকাপাকিভাবে গ্রামে চলে যায় সে বছর আমিও স্নাতক প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দিয়েছি। তবুও সে বছরই নিখিলদা আমাকে দিয়ে এই প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেয় যে আমি গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করার পর তাদের গ্রামে অন্তত এক সপ্তাহের জন্য অবশ্যই বেড়াতে যাব। তারপর দুবছর কেটে গেছে। আমি সেই প্রতিশ্রুতি বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম কিন্তু যেদিন ফাইনাল ইয়ারের শেষ পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে আসলাম ঘরে ঢুকেই দেখি নিখিলদা বসে আছে। পূর্ব প্রতিশ্রুতি মত আমাকে পরের দিনই সকালে ট্রেনে করে তার সাথে ফাকুয়া গ্রামে যেতেই হবে।
ফাকুয়া রেলস্টেশন এবং তার আশেপাশের দৃশ্য খুবই মনোরম। ছোট ছোট টিলার মাঝখান দিয়ে রেল লাইন গিয়েছে। বর্ষার বৃষ্টিস্নাত দিনে যেন মনে হয় শৈল শহর হাফলং। ট্রেন থেকে নেমেই নিখিলদা আমাকে নিয়ে একটি চায়ের দোকানে ঢুকে। সেখানে তার বন্ধুস্থানীয় কয়েকজনের সাথে আমাকে আলাপ করিয়ে দেয়। শিলচর থেকে এসেছি, নিখিলদার ভাতৃপ্ৰর্তীম একজন মেধাবী ছাত্র আমি তাই সবাই খুব খাতির করল আমাকে। দুয়েকজন নিখিলদাকে বলল আমাকে তাদের বাড়িতে একদিন নিয়ে যেতে। গ্রামের মানুষ এমনই আন্তরিক হয়।
দু দিন কেটে গেছে ফাকুয়া গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরাঘুরি করে। এরিমধ্যে নিখিলদার বন্ধুদের বাড়িতেও গিয়েছি সময় করে। ফাকুয়ার কলোনি এলাকার পর থেকেই শুরু হয়েছে শনবিলের হাওর। বিস্তৃত এই জলাভূমি যেন সমুদ্র সদৃশ। স্থানীয় লোকজন এখানে শুকনোর মরসুমে চাষবাস করে এবং বর্ষায় মাছ ধরার পাশাপাশি অনেকেই হাঁস প্রতিপালন করে। পড়ন্ত বিকেলে ডিঙি নৌকায় শনবিলে ঘুরতে গিয়ে প্রায় তিনশোরও বেশি হাঁসকে একসাথে দল বেঁধে ঘরে ফিরতে দেখে আমার দুচোখ জুড়িয়ে গেল। নৈসর্গিক এই দৃশ্য ভোলার নয়।
তৃতীয় দিন সকালে নিখিলদা বলল- আজ ভানুদের বাড়িতে তোর দুপুরে খাওয়ার নিমন্ত্রণ আছে। কাজেই আজ আর কোথাও বের হওয়ার দরকার নেই। তুই বিশ্রাম কর, আমি দরকারি একটা কাজ সেরে আসি। সময়মত এসে নিয়ে যাব তোকে। দুদিন ঘুরাঘুরি করে আমিও কিছুটা ক্লান্ত বোধ করছিলাম তাই নিখিলদার প্রস্তাবে বেশ খুশিই হলাম। তবে খটকা লাগল ওই ভানুর নাম শুনে। এই অতি অল্প সময়ে নিখিলদার সব বন্ধুদের সাথে আমার মোটামুটি আলাপ হয়ে গেছে, তাদের মধ্যে কারও নাম ভানু বলে তো শুনিনি। যা-ই হোক আমি আর এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাইনি। দুপুরে গেলেই তা জানা যাবে।
ছোট্ট একটি টিলা, চার পাশে আম কাঁঠাল সুপারির এবং নানা ফুলের গাছ। ঘরের সামনে নিকানো উঠোন। দরজার সামনে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন তরুণী। আমি কোন মতে উঠোন পেরুলাম তার দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থেকেই। নিখিলদা বলল - কি রে ভানু, কাকাবাবু ঘরে আছেন? আমি যেন চমকে উঠলাম। সে মিষ্টি হেসে বলল- 'হ্যাঁ দাদা, তোমরা বস। আমি বাবাকে ডেকে দিচ্ছি।' নিখিলদা আমাকে বলল- জানিস সতীশ, ভানুমতী খুব ভালো এবং বুদ্ধিমতী মেয়ে। করিমগঞ্জে থেকে পড়াশোনা করে, এবার এইচ এস ফাইনাল দিয়েছে। এন্ট্রান্স একজাম দেবে, যদি না পায় তবে তোর মতই ফিজিক্স নিয়ে পড়বে। কয়েকদিনের জন্য বাড়িতে এসেছে। এখানে সায়েন্স পড়ানোর মত কেউ নেই তাই যে কয়দিন এখানে আছিস তোকে হেল্প করতে হবে তাকে।' আমার তো ভিরমি খাওয়ার উপক্রম। 'কি বলছ তুমি? আমি কি করে পড়াব তাকে?' বলেই করুণ মুখে তাকালাম নিখিলদার দিকে। এরই মধ্যে ভানুমতীর বাবা এসে পড়লেন তাই প্রসঙ্গ বদলে গেল আমাদের। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর নিখিলদা ভানুমতীর বাবাকে বলল- 'কাকু, ও যে কয়দিন এখানে আছে ভানুকে পড়াশোনায় সাহায্য করব।' ভদ্রলোক দেখলাম বেশ আশ্বস্ত বোধ করলেন। আমি মতলবি নিখিলদাকে বকা দিলাম মনে মনে।
পরদিন থেকে যথারীতি আমাদের ক্লাস শুরু হল। অপ্রস্তুত শিক্ষক হিসেবে আমি যেমন বেশি কথা বলতাম না ভানুমতীও দেখলাম বেশ গুছিয়ে কম কথায় নিজের সমস্যাগুলো আলোচনা করত আমার সাথে। গাণিতিক সমস্যাগুলো একটু ধরিয়ে দিলেই সে করে নিত নিজের থেকে। আমাদের পূর্ব পরিচিতি ছিলনা তবুও ভানুমতী ফ্রি-ভাবেই কথা বলত আমার সাথে। আমার সঙ্কোচ ছিল ঠিকই কিন্তু ভানুমতী যখন লিখায় ব্যস্ত থাকত আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত থাকিয়ে থাকতাম তার দিকে। মেয়েদের সিক্সথ সেন্স খুবই প্রবল তাই মাঝেমাঝে ভানুমতী হঠাৎ মাথা তুলে অস্বস্তিতে ফেলে দিত আমাকে।
প্রায় এক সপ্তাহ চলেছিল আমাদের ক্লাস। তারপর আমি চলে আসি। ভানুমতীর আর কোন খবর নেওয়া হয়নি আমার। আড়াই বছর পর আবার আমি ফাকুয়া গ্রামে আসি একটি সামাজিক সংস্থার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। সৌজন্যে সেই নিখিলদাই। অনুষ্ঠান প্রায় শুরু হতেই চলেছে, আমি পুরনো পরিচিত কয়েকজনের সাথে কথা বলছিলাম মঞ্চের একপাশে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ খেয়াল করলাম একজন যুবতী অদূরে একথালা ফুল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মন্ত্রমুগ্ধের মত আমার দিকে তাকিয়ে। কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল আমার ভানুমতীকে চিনে নিতে। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য সে সেজে এসেছে। কপালে টিপ, কানে দুল, খোঁপায় লাল গেঁদা ফুল, সবুজে হলুদ শাড়ী পরে যেন সাক্ষাৎ এক পরী। খুশির ঝিলিক তার চোখেমুখে। আমি একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি ভানুমতীর সাথে কথা বলতে এমন সময় মাইকে আমার নাম ঘোষণা হয়ে গেল মঞ্চে গিয়ে আসন গ্রহণ করতে। তাই আমার কথা হয়ে উঠেনি ভানুমতীর সাথে। মঞ্চে উঠে বসে আছি, কিছুই ভালো লাগছে না আমার। অজানা এক ব্যাকুলতা কাজ করছে আমার মধ্যে। এরই মাঝে ঘোষণা হয়েছে স্বাগত ভাষণ দিতে মঞ্চে আসছে কৃতি ছাত্রী ভানুমতী। আমার মন যেন খুশিতে নেচে উঠেছে। পোডিয়ামে কোনাকুনি ভাবে দাঁড়িয়েছে ভানুমতী। অতিথির আসন থেকে ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে তাকে। কম কথায় সুন্দর করে গুছিয়ে বক্তব্য রাখছে সে, চোখে মুখে একরাশ মুগ্ধতা। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে আছি তার দিকে, খেয়ালই নেই সামনে শ'খানেক জনতা বসে আছে। পাশ থেকে নিখিলদা ফিসফিস করে বলল- 'ভানু এখন দেখতে অনেক সুন্দর হয়েছে। সে ফিজিক্স নিয়েই পড়াশোনা করে। মাঝেমাঝে তোর কথা জিজ্ঞেস করে আমাকে।' সেদিন আর ভানুমতীর সাথে দেখা হয়নি। মঞ্চ থেকে নেমেই আমাদের চলে যেতে হয়েছিল ষ্টেশনের পাশের একটি ফাস্টফুডের দোকানে, শিলচর থেকে আমরা যারা গিয়েছিলাম তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় সেখানে। খাওয়া দাওয়া সেরে সোজাসুজি গাড়িতে উঠে পড়তে হয় আমাদের, রাত হয়ে গিয়েছিল অনেক। তাছাড়া গাড়ি আমার নিজের ছিলনা।
প্রায় দুবছর পর আজ শিলচর মেইন ব্রাঞ্চে এলআইসি'র প্রিমিয়াম দিতে এসে দেখি কাউন্টারে ভানুমতী বসে আছে। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছিল না। তবে এবারও কথা বলার সুযোগ নেই। মানুষের দীর্ঘ লাইন, আমি কয়েকজনের পরে। কম্পিউটার থেকে চোখ সরাবার জু নেই ভানুর। আমি কাউন্টারে পৌঁছে টাকা দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলাম- 'কেমন আছো ভানু?' সে এক পলক চোখ তুলে তাকাল। তৎক্ষণাৎ একটা খুশির ঝলক ফুটে উঠল তার চোখে। 'ভালো' বলেই আবার চোখ রাখল মনিটরে। প্রিন্ট হতে থাকল আমার রিসিপ্ট। এর মধ্যেই পিছন থেকে একজন বলে উঠল- 'দিদি, গল্প পড়ে করবেন। আগে ছাড়ুন আমাদের।' রিসিপ্ট এর প্রিন্ট নিয়ে ভানুমতী চটপট কি লিখল তারপর আমাকে দিয়ে বলল -'খুলে দেখো কিন্তু।' আমার ইচ্ছে ছিল কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি সেখানে। অন্য আরেকজনের কাছ থেকে টাকা নিতে নিতে ভানুমতী হাসি মুখে ভ্রু নাচিয়ে আমাকে ইশারা করল চলে যেতে।
ভিড় থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছি। রিসিপ্ট এর ভাঁজ খুলে দেখে আমার মন খুশিতে নেচে উঠল। কম কথায় ভানু সব গুছিয়ে বলে দিয়েছে। নিজের মোবাইল নম্বরের পাশে ইউনিভার্সেল সেই চিহ্ন এঁকে দিয়েছে যা 'জবা দিল কি ধড়কন' বুঝায়। দারুণ খুশিতে ভানুর নম্বরটি আমার মোবাইলে সেভ করতে করতে আমি বেরিয়ে আসলাম বাইরে।
কলেজের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার সময় নিখিলদা প্রতিবারই আমাকে সাথে নিয়ে যাওয়ার কথা বলত কিন্তু নানা অসুবিধার কারণে আমার যাওয়া হত না। নিখিলদা যে বছর স্নাতক তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে পাকাপাকিভাবে গ্রামে চলে যায় সে বছর আমিও স্নাতক প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দিয়েছি। তবুও সে বছরই নিখিলদা আমাকে দিয়ে এই প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেয় যে আমি গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করার পর তাদের গ্রামে অন্তত এক সপ্তাহের জন্য অবশ্যই বেড়াতে যাব। তারপর দুবছর কেটে গেছে। আমি সেই প্রতিশ্রুতি বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম কিন্তু যেদিন ফাইনাল ইয়ারের শেষ পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে আসলাম ঘরে ঢুকেই দেখি নিখিলদা বসে আছে। পূর্ব প্রতিশ্রুতি মত আমাকে পরের দিনই সকালে ট্রেনে করে তার সাথে ফাকুয়া গ্রামে যেতেই হবে।
ফাকুয়া রেলস্টেশন এবং তার আশেপাশের দৃশ্য খুবই মনোরম। ছোট ছোট টিলার মাঝখান দিয়ে রেল লাইন গিয়েছে। বর্ষার বৃষ্টিস্নাত দিনে যেন মনে হয় শৈল শহর হাফলং। ট্রেন থেকে নেমেই নিখিলদা আমাকে নিয়ে একটি চায়ের দোকানে ঢুকে। সেখানে তার বন্ধুস্থানীয় কয়েকজনের সাথে আমাকে আলাপ করিয়ে দেয়। শিলচর থেকে এসেছি, নিখিলদার ভাতৃপ্ৰর্তীম একজন মেধাবী ছাত্র আমি তাই সবাই খুব খাতির করল আমাকে। দুয়েকজন নিখিলদাকে বলল আমাকে তাদের বাড়িতে একদিন নিয়ে যেতে। গ্রামের মানুষ এমনই আন্তরিক হয়।
দু দিন কেটে গেছে ফাকুয়া গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরাঘুরি করে। এরিমধ্যে নিখিলদার বন্ধুদের বাড়িতেও গিয়েছি সময় করে। ফাকুয়ার কলোনি এলাকার পর থেকেই শুরু হয়েছে শনবিলের হাওর। বিস্তৃত এই জলাভূমি যেন সমুদ্র সদৃশ। স্থানীয় লোকজন এখানে শুকনোর মরসুমে চাষবাস করে এবং বর্ষায় মাছ ধরার পাশাপাশি অনেকেই হাঁস প্রতিপালন করে। পড়ন্ত বিকেলে ডিঙি নৌকায় শনবিলে ঘুরতে গিয়ে প্রায় তিনশোরও বেশি হাঁসকে একসাথে দল বেঁধে ঘরে ফিরতে দেখে আমার দুচোখ জুড়িয়ে গেল। নৈসর্গিক এই দৃশ্য ভোলার নয়।
তৃতীয় দিন সকালে নিখিলদা বলল- আজ ভানুদের বাড়িতে তোর দুপুরে খাওয়ার নিমন্ত্রণ আছে। কাজেই আজ আর কোথাও বের হওয়ার দরকার নেই। তুই বিশ্রাম কর, আমি দরকারি একটা কাজ সেরে আসি। সময়মত এসে নিয়ে যাব তোকে। দুদিন ঘুরাঘুরি করে আমিও কিছুটা ক্লান্ত বোধ করছিলাম তাই নিখিলদার প্রস্তাবে বেশ খুশিই হলাম। তবে খটকা লাগল ওই ভানুর নাম শুনে। এই অতি অল্প সময়ে নিখিলদার সব বন্ধুদের সাথে আমার মোটামুটি আলাপ হয়ে গেছে, তাদের মধ্যে কারও নাম ভানু বলে তো শুনিনি। যা-ই হোক আমি আর এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাইনি। দুপুরে গেলেই তা জানা যাবে।
ছোট্ট একটি টিলা, চার পাশে আম কাঁঠাল সুপারির এবং নানা ফুলের গাছ। ঘরের সামনে নিকানো উঠোন। দরজার সামনে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন তরুণী। আমি কোন মতে উঠোন পেরুলাম তার দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থেকেই। নিখিলদা বলল - কি রে ভানু, কাকাবাবু ঘরে আছেন? আমি যেন চমকে উঠলাম। সে মিষ্টি হেসে বলল- 'হ্যাঁ দাদা, তোমরা বস। আমি বাবাকে ডেকে দিচ্ছি।' নিখিলদা আমাকে বলল- জানিস সতীশ, ভানুমতী খুব ভালো এবং বুদ্ধিমতী মেয়ে। করিমগঞ্জে থেকে পড়াশোনা করে, এবার এইচ এস ফাইনাল দিয়েছে। এন্ট্রান্স একজাম দেবে, যদি না পায় তবে তোর মতই ফিজিক্স নিয়ে পড়বে। কয়েকদিনের জন্য বাড়িতে এসেছে। এখানে সায়েন্স পড়ানোর মত কেউ নেই তাই যে কয়দিন এখানে আছিস তোকে হেল্প করতে হবে তাকে।' আমার তো ভিরমি খাওয়ার উপক্রম। 'কি বলছ তুমি? আমি কি করে পড়াব তাকে?' বলেই করুণ মুখে তাকালাম নিখিলদার দিকে। এরই মধ্যে ভানুমতীর বাবা এসে পড়লেন তাই প্রসঙ্গ বদলে গেল আমাদের। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর নিখিলদা ভানুমতীর বাবাকে বলল- 'কাকু, ও যে কয়দিন এখানে আছে ভানুকে পড়াশোনায় সাহায্য করব।' ভদ্রলোক দেখলাম বেশ আশ্বস্ত বোধ করলেন। আমি মতলবি নিখিলদাকে বকা দিলাম মনে মনে।
পরদিন থেকে যথারীতি আমাদের ক্লাস শুরু হল। অপ্রস্তুত শিক্ষক হিসেবে আমি যেমন বেশি কথা বলতাম না ভানুমতীও দেখলাম বেশ গুছিয়ে কম কথায় নিজের সমস্যাগুলো আলোচনা করত আমার সাথে। গাণিতিক সমস্যাগুলো একটু ধরিয়ে দিলেই সে করে নিত নিজের থেকে। আমাদের পূর্ব পরিচিতি ছিলনা তবুও ভানুমতী ফ্রি-ভাবেই কথা বলত আমার সাথে। আমার সঙ্কোচ ছিল ঠিকই কিন্তু ভানুমতী যখন লিখায় ব্যস্ত থাকত আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত থাকিয়ে থাকতাম তার দিকে। মেয়েদের সিক্সথ সেন্স খুবই প্রবল তাই মাঝেমাঝে ভানুমতী হঠাৎ মাথা তুলে অস্বস্তিতে ফেলে দিত আমাকে।
প্রায় এক সপ্তাহ চলেছিল আমাদের ক্লাস। তারপর আমি চলে আসি। ভানুমতীর আর কোন খবর নেওয়া হয়নি আমার। আড়াই বছর পর আবার আমি ফাকুয়া গ্রামে আসি একটি সামাজিক সংস্থার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। সৌজন্যে সেই নিখিলদাই। অনুষ্ঠান প্রায় শুরু হতেই চলেছে, আমি পুরনো পরিচিত কয়েকজনের সাথে কথা বলছিলাম মঞ্চের একপাশে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ খেয়াল করলাম একজন যুবতী অদূরে একথালা ফুল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মন্ত্রমুগ্ধের মত আমার দিকে তাকিয়ে। কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল আমার ভানুমতীকে চিনে নিতে। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য সে সেজে এসেছে। কপালে টিপ, কানে দুল, খোঁপায় লাল গেঁদা ফুল, সবুজে হলুদ শাড়ী পরে যেন সাক্ষাৎ এক পরী। খুশির ঝিলিক তার চোখেমুখে। আমি একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি ভানুমতীর সাথে কথা বলতে এমন সময় মাইকে আমার নাম ঘোষণা হয়ে গেল মঞ্চে গিয়ে আসন গ্রহণ করতে। তাই আমার কথা হয়ে উঠেনি ভানুমতীর সাথে। মঞ্চে উঠে বসে আছি, কিছুই ভালো লাগছে না আমার। অজানা এক ব্যাকুলতা কাজ করছে আমার মধ্যে। এরই মাঝে ঘোষণা হয়েছে স্বাগত ভাষণ দিতে মঞ্চে আসছে কৃতি ছাত্রী ভানুমতী। আমার মন যেন খুশিতে নেচে উঠেছে। পোডিয়ামে কোনাকুনি ভাবে দাঁড়িয়েছে ভানুমতী। অতিথির আসন থেকে ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে তাকে। কম কথায় সুন্দর করে গুছিয়ে বক্তব্য রাখছে সে, চোখে মুখে একরাশ মুগ্ধতা। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে আছি তার দিকে, খেয়ালই নেই সামনে শ'খানেক জনতা বসে আছে। পাশ থেকে নিখিলদা ফিসফিস করে বলল- 'ভানু এখন দেখতে অনেক সুন্দর হয়েছে। সে ফিজিক্স নিয়েই পড়াশোনা করে। মাঝেমাঝে তোর কথা জিজ্ঞেস করে আমাকে।' সেদিন আর ভানুমতীর সাথে দেখা হয়নি। মঞ্চ থেকে নেমেই আমাদের চলে যেতে হয়েছিল ষ্টেশনের পাশের একটি ফাস্টফুডের দোকানে, শিলচর থেকে আমরা যারা গিয়েছিলাম তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় সেখানে। খাওয়া দাওয়া সেরে সোজাসুজি গাড়িতে উঠে পড়তে হয় আমাদের, রাত হয়ে গিয়েছিল অনেক। তাছাড়া গাড়ি আমার নিজের ছিলনা।
প্রায় দুবছর পর আজ শিলচর মেইন ব্রাঞ্চে এলআইসি'র প্রিমিয়াম দিতে এসে দেখি কাউন্টারে ভানুমতী বসে আছে। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছিল না। তবে এবারও কথা বলার সুযোগ নেই। মানুষের দীর্ঘ লাইন, আমি কয়েকজনের পরে। কম্পিউটার থেকে চোখ সরাবার জু নেই ভানুর। আমি কাউন্টারে পৌঁছে টাকা দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলাম- 'কেমন আছো ভানু?' সে এক পলক চোখ তুলে তাকাল। তৎক্ষণাৎ একটা খুশির ঝলক ফুটে উঠল তার চোখে। 'ভালো' বলেই আবার চোখ রাখল মনিটরে। প্রিন্ট হতে থাকল আমার রিসিপ্ট। এর মধ্যেই পিছন থেকে একজন বলে উঠল- 'দিদি, গল্প পড়ে করবেন। আগে ছাড়ুন আমাদের।' রিসিপ্ট এর প্রিন্ট নিয়ে ভানুমতী চটপট কি লিখল তারপর আমাকে দিয়ে বলল -'খুলে দেখো কিন্তু।' আমার ইচ্ছে ছিল কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি সেখানে। অন্য আরেকজনের কাছ থেকে টাকা নিতে নিতে ভানুমতী হাসি মুখে ভ্রু নাচিয়ে আমাকে ইশারা করল চলে যেতে।
ভিড় থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছি। রিসিপ্ট এর ভাঁজ খুলে দেখে আমার মন খুশিতে নেচে উঠল। কম কথায় ভানু সব গুছিয়ে বলে দিয়েছে। নিজের মোবাইল নম্বরের পাশে ইউনিভার্সেল সেই চিহ্ন এঁকে দিয়েছে যা 'জবা দিল কি ধড়কন' বুঝায়। দারুণ খুশিতে ভানুর নম্বরটি আমার মোবাইলে সেভ করতে করতে আমি বেরিয়ে আসলাম বাইরে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন