“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

ফরিয়াদ

  
(C)Image:ছবি

 (ডঃ আল্লামা তৈয়বুর রহমান বড়ভুইয়া স্মরণে)
       
  










     রফিক উদ্দিন লস্কর
লোকিত ছিলো যাহার জীবন
প্রস্ফুটিত গোলাপের মতো,
শিরক বিদ'আত করেছ উচ্ছেদ
তুমি মাড়িয়েছো বাঁধা শত।
তুমি চলে গেছো...রেখে মোদের
আজ শোক সাগরে ভাসমান,
তপ্ত অশ্রু ঝরায় শত শত শিষ্যরা
তরু-লতা,পশু-পাখি আসমান।
নেমেছে সর্বমহলে শোকের মাতম
নীরবে কাঁদে আজ শহর গ্রাম,
জাতির হৃদয়পটে তুমি চিরজাগ্রত
স্বর্ণাক্ষরে খচিত তোমার নাম।
আমি প্রভু সমীপে করি ফরিয়াদ
গভীর রাতের মোনাজাতে,
তুমি উন্নত মাকাম দিওগো তাঁকে
জান্নাতুল ফেরদাউসে।।

'উজান' ও 'সাগ্নিক'


।। বিদ্যুৎ চক্রবর্তী ।।

 সাহিত্যের তৃতীয় ভুবনে বর্তমানে বাংলা ছোট পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন এর ক্ষেত্রটি যে এক বৃহৎ আকার ধারণ করেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যেই সাত সাতটি সম্মেলনের উদযাপন তারই সাক্ষ্য বহন করছে। স্বাভাবিক ভাবেই ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাও পিছিয়ে থাকেনি মোটেও। ইদানীং স্বল্প সময়ের ব্যবধানে প্রকাশিত হলো আসামের দুই প্রান্তের দুই উল্লেখনীয় বাংলা ছোট পত্রিকা – ‘উজানসাগ্নিকএর সাম্প্রতিকতম সংখ্যা। উজান আসামের বাণিজ্যিক শহর তিনসুকিয়া থেকে বেরোল উজান’-এর ১৪তম সংখ্যা আর নিম্ন আসামের বাসুগাঁও থেকে সাগ্নিক’-এর ২৬তম সংখ্যা। একসাথে দুটি সংখ্যা হাতে আসতেই এর একটি তুলনাত্মক পর্যালোচনার লোভ সংবরণ করা গেল না। উদ্দেশ্য সমকালীন আসামের বাংলা ভাষা সাহিত্য চর্চার হাল হকিকৎ জনসমক্ষে প্রতিভাত করা।

পর্যালোচনার জন্য এই দুই পত্রিকাকে বেছে নেওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে উভয়ের কলেবরগত সাদৃশ্য তথা হালে অনুষ্ঠিত সপ্তম উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় বাংলা ছোট পত্রিকার গুয়াহাটি সম্মেলনে উভয়ের সদম্ভ উপস্থিতি। পত্রিকা প্রকাশের ধরণ ও বক্তব্য উভয় ক্ষেত্রেই পত্রিকা গোষ্ঠী তথা সম্পাদকের সামাজিক দায়বদ্ধতা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে। উজানবিষয় ভিত্তিক হলেও সাগ্নিকতা নয়। ১২৮ পৃষ্ঠার সাগ্নিকে মোট ৯টি প্রবন্ধ, ২১টি কবিতা, ১১টি ছোটগল্প তথা নিয়মিত বিভাগ রয়েছে। বিপরীতে ১৩৬ পৃষ্ঠার উজানে রয়েছে মোট ৮টি বিষয়ভিত্তিক নিবন্ধ,৬টি অন্যান্য নিবন্ধ, ২০টি কবিতা, ৬টি ছোটগল্প, ১টি বড়গল্প ও নিয়মিত বিভাগ।
একটি পত্রিকা প্রকাশের এই বিশাল কর্মযজ্ঞে সম্পাদকের সার্বিক কর্মকুশলতার এক স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি সহজেই অনুধাবনযোগ্য। ঘটনাচক্রে এই নিবন্ধ লেখক উজান পত্রিকার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত থাকার ফলে এবং পূর্ববর্তী সংখ্যার সম্পাদক হওয়ার কারণে তা অত্যন্ত সুজ্ঞাত। উজান পত্রিকায় এক নির্দিষ্ট সম্পাদকমণ্ডলী থাকার ফলে সম্পাদকের একার মাথায় যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে না কিন্তু সাগ্নিকের ক্ষেত্রে তা নয়। সাগ্নিকের সম্পাদকের বক্তব্য বা কর্মতৎপরতার ছবি তাই পত্রিকা পঠনের মাধ্যমে স্পষ্ট প্রতীয়মান।
বিষয় ভিত্তিক হওয়ার ফলে উজানের প্রবন্ধ বিভাগ স্বাভাবিক ভাবেই অধিক পুষ্ট। মাতৃভাষা মাধ্যমের শিক্ষাবিষয়ের উপর একাধিক তথ্যবহুল নিবন্ধের সমাহার ঘটেছে পত্রিকায়। বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য সঞ্জীব দেব লস্কর, ধ্রুবজ্যোতি দে, বাণী সেন ও সুশান্ত করের নিবন্ধ। এঁরা প্রত্যেকেই শিক্ষা বিভাগের সঙ্গে আজীবন জড়িত থাকার ফলে বিষয়ের উপর যথার্থ আলোকপাত করতে সক্ষম হয়েছেন। এ ছাড়াও দিলীপ কুমার দে তথা অনিল দাশ পুরকায়স্থের নিবন্ধও উল্লেখযোগ্য। অন্যান্য নিবন্ধে সঙ্গীত সমালোচক অসিত রায়,বর্ষীয়ান সাংস্কৃতিক কর্মী ও উজান সাহিত্য গোষ্ঠীর বর্তমান প্রধান সুজয় কুমার রায় ও মলয় ঘোষের নিবন্ধ উল্লেখযোগ্য। শনবিল নিয়ে মৃগাঙ্ক পুরকায়স্থের নিবন্ধ বিশেষভাবে উল্লেখনীয়।
সাগ্নিকের প্রবন্ধ বিভাগ তুলনামূলক ভাবে সংক্ষিপ্ত ও বিক্ষিপ্ত হওয়া সত্ত্বেও দুটি নিবন্ধ বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। প্রমোদ নাথের লোকাচার, লোকবিশ্বাস, লৌকিকতা এবং আদিম আদিবাসী টোটো সম্প্রদায়প্রবন্ধটি সমাজ দর্পণের পরিপ্রেক্ষিতে তথ্যসম্ভারে সমৃদ্ধ এক অতি প্রয়োজনীয় দলিল। প্রবন্ধ বিভাগের যাবতীয় খামতি সম্পাদক প্রদ্যোৎ গোস্বামী পুষিয়ে দিয়েছেন কড়ায় গণ্ডায় তাঁর এক বিশেষ নিবন্ধের মাধ্যমে। ইতিহাসের আলোকে অসমিয়া বাঙালি সম্পর্কনিবন্ধটি সার্বিক ভাবে উপস্থাপিত এক অতি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবেই জায়গা করে নিতে সম্ভব ইতিহাসের পাতায়। তথ্য,বিশ্লেষণ ও বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে লিখিত সাগ্রহে রাখার মতো এই নিবন্ধটি নিঃসন্দেহে সাগ্নিককে করে তুলেছে এক অতি আবশ্যকীয় পাঠ্য পত্রিকা। নিবন্ধটির কিছু লাইন উল্লেখ করাটা এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। কী এই ডি ভোটার ? ডি ভোটার মানে হলো ডাউটফুল ভোটার বা সন্দেহজনক নাগরিক। হঠাৎ করেই ভোটার তালিকাতে কারো নামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে এই ডি। এ রাজ্যের বাঙালি জীবনে যেন উগ্রপন্থার চেয়েও ভয়ানক হয়ে উঠেছে এই ডি। ডি আসলে এমন এক দৈত্যের নাম যা যেকোনো সময়ে যে কোন মানুষের ঘাড়ে চেপে বসতে পারে। আর একবার ঘাড়ে চাপলে জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে কোন কসুরই সে বাদ রাখে নাদেশ মানে এমন এক খণ্ড মৃত্তিকা যা মানুষকে লালন করে, পালন করে পরম মমতায়। আর যখন সেই ভূমিখণ্ড বা ভৌগোলিক পরিসীমার প্রতি মানুষের মনে মাতৃভাবের উন্মেষ ঘটে তখন সেটা দেশ থেকে রূপান্তরিত হয় স্বদেশেবছরের পর বছর শুধু একে অপরের প্রতি দোষ চাপানোর এই সাপ লুডো খেলায় এই প্রদেশটার লোকসান বৈ লাভ কিছু হয়নি

কবিতায় সাগ্নিক নিঃসন্দেহে টেক্কা দিয়েছে উজানকে। দুটি পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছে বর্তমানের কিছু সাড়া জাগানো কবির কবিতা। ২১টি কবিতায় ঋদ্ধ সাগ্নিকে রয়েছেন বিকাশ সরকার, দেবলীনা সেনগুপ্ত, চিরশ্রী দেবনাথ, অভিজিত চক্রবর্তীর মতো কবিরা। নবাগত হিসেবে রীতা চক্রবর্তী,সমীর চক্রবর্তী নজর কেড়েছেন। অপর দিকে ২০ টি কবিতায় সজ্জিত উজানে রয়েছেন মিলন কান্তি দত্ত, অভিজিত চক্রবর্তী,রামচন্দ্র পাল, শ্রীভদ্রের মতো কবিরা। উদীয়মান কবিদের মধ্যে স্বস্তিসাধন চক্রবর্তী ও রাজা চক্রবর্তীর নাম উল্লেখযোগ্য।
ছোটগল্পে সংখ্যার বিচারে সাগ্নিক এগিয়ে থাকলেও ধারে ও ভারে উজানই এগিয়ে। খ্যাতিমান গল্পকারেরও ছড়াছড়ি এখানে। নীলদীপ চক্রবর্তী, মানব রতন মুখোপাধ্যায়, পদ্মশ্রী মজুমদার, অর্পিতা বিশ্বাস বর্তমানের চর্চিত গল্পকার। এই প্রতিবেদকেরও রয়েছে একটি গল্প। বিপরীতে প্রবন্ধ বিভাগেরই মতো গল্প বিভাগের যাবতীয় খামতি থেকে সাগ্নিককে এক যথাযোগ্য স্থানে উঠিয়ে দিয়েছেন ধীরাজ চক্রবর্তী তাঁর এক গুচ্ছ অণুগল্প’-এর মাধ্যমে। অসাধারণ মুন্সিয়ানায় উপস্থাপন করেছেন ছয় ছয়টি অতি উচ্চ মানের অণুগল্প।
উজানের সম্পাদকীয় - সম্পাদকীয় সমিতির পরিবেশনা। এ ক্ষেত্রে সাগ্নিকের সম্পাদকীয় তুলনামূলক ভাবে বিষয় বৈচিত্র্যে ও ভাষার বাঁধনে অধিক আকর্ষণীয় তথা মূল্যবান। একটি ছোট পত্রিকার সম্পাদকীয়তেই সেই পত্রিকার একটি সম্যক চিত্র পরিস্ফুট হয়ে থাকে। সেই বিবেচনায় উভয় পত্রিকাতেই সম্পাদকের ভাবনায় সমকালীন সাহিত্য ভাবনা স্পষ্ট ভাবেই চিত্রিত হয়েছে।
উজানের উজানও ভাটির 'সাগ্নিক' নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখার প্রয়াসে চেষ্টার কসুর করেনি কোথাও এবং সেই প্রচেষ্টায় দুটি পত্রিকাই একশো ভাগ সফল। সযত্নে রক্ষা করে রাখার মতো যথেষ্ট রসদ মজুত রয়েছে উভয় পত্রিকাতেই।
সাগ্নিকে বানান ভুলের পরিমাণ খুবই কম কিন্তু বহু জায়গায় ’-এর পারস্পরিক স্থানচ্যুতি পঠন বিভ্রান্তি ঘটিয়েছে। সম্পাদকের বিশেষ নিবন্ধও এর থেকে মুক্ত নয়। উজানের গত সংখ্যায় যেখানে ভুল বানান খুঁজে পেতে ঘাম ঝরাতে হয়েছিল সেখানে এবার বানান ভুলের আধিক্য খুবই পীড়াদায়ক হয়েছে। মায় প্রচ্ছদেও বানান ভুল খুবই দৃষ্টিকটু হয়েছে। সম্পাদকীয় সমিতিকে পরবর্তীতে আরোও সজাগ হতে হবে এতে সন্দেহ নেই।
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণে উভয় পত্রিকাই অত্যন্ত আকর্ষণীয়। দুটি ছোট পত্রিকার মধ্যে যে পারস্পরিক সম্বন্ধ রয়েছে তা হলো এই যে উভয় ক্ষেত্রেই দুই পত্রিকা গোষ্ঠী বাংলা সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে ভাষা ও সাহিত্যের পাশাপাশি সামাজিক এক দায়বদ্ধতা নিরলস ভাবে বজায় রেখে চলেছে। আজকের ঝুঁকিপূর্ণ ও স্রোতের বিপরীতমুখী সামাজিক পরিবেশেও এই তাগিদ, এই নিরলস ব্রত বাংলা ভাষা সাহিত্যের রসাস্বাদনে যদি আগ্রহী করে তুলতে পারে একজনও অনুরাগী পাঠককে তবেই সার্থক হবে এই প্রয়াস। সদিয়া থেকে ধুবড়ি বলা ভাল তিনসুকিয়া থেকে বাসুগাঁও মহাবাহুর প্রবাহিত জলরাশিতে যদি সিঞ্চিত হয় সাহিত্যের অমৃত রস আর সেই রসে সিক্ত হয় উঠতি প্রজন্ম তবেই সার্থক হবে উজানসাগ্নিক’-এর পথচলা।
         - - - - - - - - - - - - - - -




নিস্তব্ধ এ শহরটা

             
          


















  রফিক উদ্দিন লস্কর



ব্দটা হাওয়ায় ভেসে কানে আসে যেই,
টলমল চোখ দুটি কারো মুখে হাসি নেই।

যখনি থেমে গেছে বুকের শেষ স্পন্দন,
বৃক্ষ লতা, লক্ষ জনতার নীরব ক্রন্দন।
ঘন কালো মেঘে আজ আকাশ ঘেরা, 

নীড় হারা পাখি,হবে কি তার ফেরা?
যিনি কালের মহীরুহ আর প্রজ্ঞা প্রবর,
যার অবসানে হলো আজ রিক্ত চরাচর।
কেমনে এগোই বেদনার পাহাড় বেয়ে,
তবুও একটু চলা ম্লান মুখ চেয়ে চেয়ে।
অনুভাবিত,এ শূন্যতা আর হবেনা পূরণ, 

শোক সাগরে দিশেহারা সকল ভক্তগণ।
উন্নত চরিত্র মাঝে সঠিক পথের দিশারি,
হারিয়ে এই শান্তির দূত করি আহাজারি।


বৃহস্পতিবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

ভাষার বর্তমান অবর্তমান




   ।।  শিবানী ভট্টাচার্য দে ।।

 
(C)Image:


কিছুদিন আগে ট্রেনে একটা বাঙালি পরিবারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। আমরা বেঙালুরু যাচ্ছি, ওরা ও। ভুবনেশ্বর থেকে উঠেছে ট্রেনে। স্বামী, স্ত্রী, একটা বছরচারেকের বাচ্চা মেয়ে । প্রাথমিক পরিচয়ে জানলাম, স্বামীটি বেঙালুরুতে আইটি সেক্টরে কাজ করেন, বাড়ি ভুবনেশ্বর। আমার হাতে একটা বাংলা অ আ ক খ বই, হাওড়া স্টেশন থেকে কিনেছি, আমার তিন বছরের নাতিকে দেব বলে। সেই বইটা পরিবারের মহিলাটি নিলেন দেখতে। বাচ্চাকে দেখাতে নয়, বইটা নিয়ে নিজেই পড়তে থাকলেন, খুব  সাবলীল নয়, একটু থেমে থেমে। তাঁর কাছ থেকে স্বামীটিও নিলেন, তিনি শুধু বইটি উলটে পালটে দেখলেন, ঠিক  যেভাবে ছোট শিশু উলটে পালটে ছবি দেখে, তারপর দেখলাম স্ত্রীকে বইয়ে আঙ্গুল দেখিয়ে এটা সেটা জিগ্যেস করছেন। স্ত্রী জিগ্যেস করলেন, বইটি কোত্থেকে নিয়েছি। আমি বললাম, এবং যোগ করলাম, বাচ্চার জন্য এরকম বই নিতে পারেন। উনি নিজেদের কথা বললেন, নিজে কিছুটা বাংলা লিখতে পড়তে জানেন, বাড়িতে শিখেছেন। তাঁর স্বামীটি একেবারেই জানেন না। তাঁদের পরিবার অনেক  বছর থেকেই ওড়িশাতে, সেখানে  তারা বাংলা শেখার সুযোগ পাননি। স্কুলে ওড়িয়াই ছিল প্রথম ভাষা। ওড়িশার  বালেশ্বর, কটক, ভুবনেশ্বর, পুরী, এইসব জায়গাতে একসময় প্রচুর বাঙালি ছিল। এখনও অনেক আছে, কিন্তু স্কুলে  বাধ্যতামূলক ওড়িয়া পড়ানো হয়। বাংলা স্কুল যা ছিল সব উঠে গেছে। বুঝলাম কেন ভদ্রলোকটি অ আ ক খ বইটার শুধু ছবি দেখছিলেন এবং তাঁর স্ত্রীকে কী লেখা আছে জিগ্যেস  করেছিলেন। বাংলার একটা প্রাথমিক বইতে দুজন বয়ঃপ্রাপ্ত  বাঙালি এত আগ্রহ দেখাচ্ছেন, চিত্রটা বড় করুণ লাগল। কিন্তু এই চিত্র এখন সারাদেশেই, ভাষিক সংখ্যালঘুদের মধ্যে কমবেশি দ্রষ্টব্য।  
রাজ্যে রাজ্যে ভাষিক সংখ্যালঘুদের স্থানীয় ভাষা শেখানোর জন্য জবরদস্তি চলে। দেশের অন্যান্য ভাষার স্কুল খুলবার সুযোগ নেই সংখ্যাগুরুর দাপটেফরাসি জার্মান চিনা জাপানি --- বিদেশি ভাষা শেখানো হতে পারে, কিন্তু প্রতিবেশীর মাতৃভাষাতে বড় অ্যালার্জি ।  অথচ এই বিবদমান ভাষিক গোষ্ঠীর কোনো লোক যখন অন্য রাজ্যে বা বিদেশে যায়তখন মাতৃভাষা ছাড়াই পড়াশোনা, কাজকর্ম, ভাবের  আদানপ্রদান সব যেমন করেই হোক চালায়।      
বড়বড় ভাষাগোষ্ঠীগুলো ছাড়া পৃথিবীতে জনজাতিদের কত ভাষা রয়েছে। তাদেরও মাতৃভাষার আবেগ  আছে।  তবুও অল্পসংখ্যক ভাষা, যেগুলো রাজ্যের/রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা পায়, সেগুলো ছাড়া আরো কত  ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। অনেক ছোট ভাষাগোষ্ঠীর ভাষা বড় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত হয়ে যাচ্ছে। উর্দু খেয়ে ফেলছে পাকিস্তানের সিন্ধি, পাঞ্জাবি, কাশ্মীরী (ভারত এবং পাকিস্তান উভয় দেশের প্রভাবান্বিত অঞ্চলের), হিন্দি  গ্রাস করে ফেলেছে রাজস্থানি, অবধি, ভোজপুরী ইত্যাদি ভাষাকে, এমন কি বাংলা সহ অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় তার প্রভাব বেড়ে চলছে দিন দিন। পূর্ব-আফ্রিকায় সোয়াহিলি, যে ভাষাটি গঠিত হয়েছিল আরবি ও লোহিত সাগর তীরবর্তী আফ্রিকীয় দেশগুলোর নানা ভাষার সংমিশ্রণে, সে এখন গ্রাস করছে সমস্ত পূর্ব আফ্রিকীয় ভাষাগুলোকে, ইংলিশ, পর্তুগিজ স্প্যানিশ গ্রাস করছে আমেরিকার আদিবাসীদের ভাষাগুলোকেউদাহরণ আরো বাড়ানো যায়।
তবে, ভাষার পলিটিক্স বোঝানোর উদ্দেশ্য আমার নয়, যদিও শিবের গীত গেয়ে ফেলেছি। আমার অভিজ্ঞতা বলে, প্রতিকূল পরিবেশে মাতৃভাষা শেখার ক্ষেত্রে মেয়েরা কিছুটা এগিয়ে। যেমন বেশির ভাগ বাঙালি পরিবারে মেয়েদের ছোটবেলা থেকেই  মাথায় ঢোকানো হয়,(সেটাও অবশ্য আরেকধরণের পলিটিক্স)তাকে লক্ষ্মীমেয়ে হতে হবে, পরিবারের সংস্কার রাখতে হবে তাকেই,(সে সংস্কার সু বা কু যাই হোক না কেন) তাই অন্তত দৈনন্দিন লক্ষ্মীদেবীর পাঁচালিটুকু  সে  যেন পড়তে পারে, তাছাড়া পরিবারের লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারে, দৈনন্দিন হিসেব রাখতে পারে। তাই তাকে প্রাথমিক  বাংলা লেখাপড়া শেখানো জরুরি মনে করা হয়, স্কুলে তাকে যে ভাষাই পড়ানো হোক না কেন। ছেলেদের সে বালাই নেই, তাকে তো আর অপরিচিত বাড়িতে বছরের পর বছর মানিয়ে থাকতে হবেনা, লক্ষ্মী মঙ্গলচন্ডীর পাঁচালি পড়তে হবেনা । তাই সে যদি বলে আমি বাংলা পড়ব না, আমার বাংলা পড়ার দরকার নেই, তাকে কেউ জবরদস্তি করেনা। মাতৃভাষা বলেই সেটা শিখব---এমন শেখার উদগ্র  ইচ্ছা কজনেরই বা থাকে।   
যতদিন মোবাইলের রমরমা হয়নি, লোকে চিঠি লিখত, তাতে কিছুটা ভাষাচর্চা হত। সাধারণ লোক, বিশেষ করে বয়স্ক মহিলারা মাতৃভাষা অন্য ভাষা খুব কমই জানতেন। তারা মাতৃভাষায় চিঠিপত্র লিখতেন, তাদেরকে চিঠি লিখাও হত সেই ভাষায়। তার ফলেও ইংরাজি বা অন্য মাধ্যমের ছেলেমেয়েদের মাতৃভাষা শেখা হয়ে যেত, স্কুলে, না হলেও বাড়িতে। এক্ষেত্রে উদাহরণ দিতে একটি চেনাজানা বাঙালি পরিবারের কথা বলি। এই পরিবারের মেয়েরা তাদের বাবার কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির সুবাদে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে পড়ত, তাই তাদের স্কুলে বাংলা শিখার সুযোগ হয়নি। তাদের মা বলত, ‘বাংলা না শিখলে তুমি দিদার কাছে বা ঠাম্মার কাছে চিঠি লেখবে কী করে? তারা তো ইংরাজি বোঝে না, হিন্দি ও  জানেনা।মেয়েরা দুজনেই বৃদ্ধা দুজনকে ভালবাসত, তাই দূরস্থ ঠাম্মা-দিদার সঙ্গে সংযোগের তাগিদে তারা বাংলা লেখতে পড়তে শিখে গিয়েছিল। এরপর তাদের সাহিত্য ধরতে কঠিন হয়নি। কিন্তু হাল আমলের বাচ্চাদের ওই কথা বলাও যাবেনা, এখন হোয়াট্‌স-অ্যাপ মেসেজ-এর যুগ। এত এত  ছেলেমেয়ে নিত্য পাশ করে বেরোচ্ছে, তাদের কজন মাতৃভাষা শুদ্ধ করে লিখতে পড়তে পারে? এমন কি কিছু স্কুলকলেজের শিক্ষক, গবেষকদের ও যে ভাষাজ্ঞান দেখা যায় (ফেসবুকে দর্শনীয়) তাতে ভাষার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বলে মনে হয় না। আজকাল লেখাপড়ার সময় ভাষার শুদ্ধতাকে মান্যতা দেওয়া হয়নাবানানে, বাক্য-গঠনে, প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অজস্র ভুল দেখা যায়। অন্য শক্তিশালী ভাষার দেদার শব্দ ঢুকে অনেক ভাষা তার চেহারা পালটে ফেলছে। এভাবেই ধ্বংসের দিকে (না পরিবর্তনের দিকে?) এগোচ্ছে ভাষাগুলো।  
তা, বাঁচার লড়াইয়ে যোগ্যতমই জিতবে, এই যুক্তি শুধু জীবজগৎ নয়, ভাষার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।  যে ভাষাভাষী মানুষ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী, তাদের অধ্যুষিত ভূখণ্ডে তাদের ভাষাই টিকে থাকবে, অন্যকে বিদায় নিতে হবে। সর্বোপরি, মাতৃভাষাকে ভালো বাসতে হবে, তাকে যথাযোগ্য ব্যবহার করতে হবে। ভালোবাসলে সবকিছুরই আয়ু বেড়ে যায়। নইলে  হাহুতাশ করে লাভ নেই।