“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

ভাষার বর্তমান অবর্তমান




   ।।  শিবানী ভট্টাচার্য দে ।।

 
(C)Image:


কিছুদিন আগে ট্রেনে একটা বাঙালি পরিবারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। আমরা বেঙালুরু যাচ্ছি, ওরা ও। ভুবনেশ্বর থেকে উঠেছে ট্রেনে। স্বামী, স্ত্রী, একটা বছরচারেকের বাচ্চা মেয়ে । প্রাথমিক পরিচয়ে জানলাম, স্বামীটি বেঙালুরুতে আইটি সেক্টরে কাজ করেন, বাড়ি ভুবনেশ্বর। আমার হাতে একটা বাংলা অ আ ক খ বই, হাওড়া স্টেশন থেকে কিনেছি, আমার তিন বছরের নাতিকে দেব বলে। সেই বইটা পরিবারের মহিলাটি নিলেন দেখতে। বাচ্চাকে দেখাতে নয়, বইটা নিয়ে নিজেই পড়তে থাকলেন, খুব  সাবলীল নয়, একটু থেমে থেমে। তাঁর কাছ থেকে স্বামীটিও নিলেন, তিনি শুধু বইটি উলটে পালটে দেখলেন, ঠিক  যেভাবে ছোট শিশু উলটে পালটে ছবি দেখে, তারপর দেখলাম স্ত্রীকে বইয়ে আঙ্গুল দেখিয়ে এটা সেটা জিগ্যেস করছেন। স্ত্রী জিগ্যেস করলেন, বইটি কোত্থেকে নিয়েছি। আমি বললাম, এবং যোগ করলাম, বাচ্চার জন্য এরকম বই নিতে পারেন। উনি নিজেদের কথা বললেন, নিজে কিছুটা বাংলা লিখতে পড়তে জানেন, বাড়িতে শিখেছেন। তাঁর স্বামীটি একেবারেই জানেন না। তাঁদের পরিবার অনেক  বছর থেকেই ওড়িশাতে, সেখানে  তারা বাংলা শেখার সুযোগ পাননি। স্কুলে ওড়িয়াই ছিল প্রথম ভাষা। ওড়িশার  বালেশ্বর, কটক, ভুবনেশ্বর, পুরী, এইসব জায়গাতে একসময় প্রচুর বাঙালি ছিল। এখনও অনেক আছে, কিন্তু স্কুলে  বাধ্যতামূলক ওড়িয়া পড়ানো হয়। বাংলা স্কুল যা ছিল সব উঠে গেছে। বুঝলাম কেন ভদ্রলোকটি অ আ ক খ বইটার শুধু ছবি দেখছিলেন এবং তাঁর স্ত্রীকে কী লেখা আছে জিগ্যেস  করেছিলেন। বাংলার একটা প্রাথমিক বইতে দুজন বয়ঃপ্রাপ্ত  বাঙালি এত আগ্রহ দেখাচ্ছেন, চিত্রটা বড় করুণ লাগল। কিন্তু এই চিত্র এখন সারাদেশেই, ভাষিক সংখ্যালঘুদের মধ্যে কমবেশি দ্রষ্টব্য।  
রাজ্যে রাজ্যে ভাষিক সংখ্যালঘুদের স্থানীয় ভাষা শেখানোর জন্য জবরদস্তি চলে। দেশের অন্যান্য ভাষার স্কুল খুলবার সুযোগ নেই সংখ্যাগুরুর দাপটেফরাসি জার্মান চিনা জাপানি --- বিদেশি ভাষা শেখানো হতে পারে, কিন্তু প্রতিবেশীর মাতৃভাষাতে বড় অ্যালার্জি ।  অথচ এই বিবদমান ভাষিক গোষ্ঠীর কোনো লোক যখন অন্য রাজ্যে বা বিদেশে যায়তখন মাতৃভাষা ছাড়াই পড়াশোনা, কাজকর্ম, ভাবের  আদানপ্রদান সব যেমন করেই হোক চালায়।      
বড়বড় ভাষাগোষ্ঠীগুলো ছাড়া পৃথিবীতে জনজাতিদের কত ভাষা রয়েছে। তাদেরও মাতৃভাষার আবেগ  আছে।  তবুও অল্পসংখ্যক ভাষা, যেগুলো রাজ্যের/রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা পায়, সেগুলো ছাড়া আরো কত  ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। অনেক ছোট ভাষাগোষ্ঠীর ভাষা বড় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত হয়ে যাচ্ছে। উর্দু খেয়ে ফেলছে পাকিস্তানের সিন্ধি, পাঞ্জাবি, কাশ্মীরী (ভারত এবং পাকিস্তান উভয় দেশের প্রভাবান্বিত অঞ্চলের), হিন্দি  গ্রাস করে ফেলেছে রাজস্থানি, অবধি, ভোজপুরী ইত্যাদি ভাষাকে, এমন কি বাংলা সহ অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় তার প্রভাব বেড়ে চলছে দিন দিন। পূর্ব-আফ্রিকায় সোয়াহিলি, যে ভাষাটি গঠিত হয়েছিল আরবি ও লোহিত সাগর তীরবর্তী আফ্রিকীয় দেশগুলোর নানা ভাষার সংমিশ্রণে, সে এখন গ্রাস করছে সমস্ত পূর্ব আফ্রিকীয় ভাষাগুলোকে, ইংলিশ, পর্তুগিজ স্প্যানিশ গ্রাস করছে আমেরিকার আদিবাসীদের ভাষাগুলোকেউদাহরণ আরো বাড়ানো যায়।
তবে, ভাষার পলিটিক্স বোঝানোর উদ্দেশ্য আমার নয়, যদিও শিবের গীত গেয়ে ফেলেছি। আমার অভিজ্ঞতা বলে, প্রতিকূল পরিবেশে মাতৃভাষা শেখার ক্ষেত্রে মেয়েরা কিছুটা এগিয়ে। যেমন বেশির ভাগ বাঙালি পরিবারে মেয়েদের ছোটবেলা থেকেই  মাথায় ঢোকানো হয়,(সেটাও অবশ্য আরেকধরণের পলিটিক্স)তাকে লক্ষ্মীমেয়ে হতে হবে, পরিবারের সংস্কার রাখতে হবে তাকেই,(সে সংস্কার সু বা কু যাই হোক না কেন) তাই অন্তত দৈনন্দিন লক্ষ্মীদেবীর পাঁচালিটুকু  সে  যেন পড়তে পারে, তাছাড়া পরিবারের লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারে, দৈনন্দিন হিসেব রাখতে পারে। তাই তাকে প্রাথমিক  বাংলা লেখাপড়া শেখানো জরুরি মনে করা হয়, স্কুলে তাকে যে ভাষাই পড়ানো হোক না কেন। ছেলেদের সে বালাই নেই, তাকে তো আর অপরিচিত বাড়িতে বছরের পর বছর মানিয়ে থাকতে হবেনা, লক্ষ্মী মঙ্গলচন্ডীর পাঁচালি পড়তে হবেনা । তাই সে যদি বলে আমি বাংলা পড়ব না, আমার বাংলা পড়ার দরকার নেই, তাকে কেউ জবরদস্তি করেনা। মাতৃভাষা বলেই সেটা শিখব---এমন শেখার উদগ্র  ইচ্ছা কজনেরই বা থাকে।   
যতদিন মোবাইলের রমরমা হয়নি, লোকে চিঠি লিখত, তাতে কিছুটা ভাষাচর্চা হত। সাধারণ লোক, বিশেষ করে বয়স্ক মহিলারা মাতৃভাষা অন্য ভাষা খুব কমই জানতেন। তারা মাতৃভাষায় চিঠিপত্র লিখতেন, তাদেরকে চিঠি লিখাও হত সেই ভাষায়। তার ফলেও ইংরাজি বা অন্য মাধ্যমের ছেলেমেয়েদের মাতৃভাষা শেখা হয়ে যেত, স্কুলে, না হলেও বাড়িতে। এক্ষেত্রে উদাহরণ দিতে একটি চেনাজানা বাঙালি পরিবারের কথা বলি। এই পরিবারের মেয়েরা তাদের বাবার কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির সুবাদে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে পড়ত, তাই তাদের স্কুলে বাংলা শিখার সুযোগ হয়নি। তাদের মা বলত, ‘বাংলা না শিখলে তুমি দিদার কাছে বা ঠাম্মার কাছে চিঠি লেখবে কী করে? তারা তো ইংরাজি বোঝে না, হিন্দি ও  জানেনা।মেয়েরা দুজনেই বৃদ্ধা দুজনকে ভালবাসত, তাই দূরস্থ ঠাম্মা-দিদার সঙ্গে সংযোগের তাগিদে তারা বাংলা লেখতে পড়তে শিখে গিয়েছিল। এরপর তাদের সাহিত্য ধরতে কঠিন হয়নি। কিন্তু হাল আমলের বাচ্চাদের ওই কথা বলাও যাবেনা, এখন হোয়াট্‌স-অ্যাপ মেসেজ-এর যুগ। এত এত  ছেলেমেয়ে নিত্য পাশ করে বেরোচ্ছে, তাদের কজন মাতৃভাষা শুদ্ধ করে লিখতে পড়তে পারে? এমন কি কিছু স্কুলকলেজের শিক্ষক, গবেষকদের ও যে ভাষাজ্ঞান দেখা যায় (ফেসবুকে দর্শনীয়) তাতে ভাষার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বলে মনে হয় না। আজকাল লেখাপড়ার সময় ভাষার শুদ্ধতাকে মান্যতা দেওয়া হয়নাবানানে, বাক্য-গঠনে, প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অজস্র ভুল দেখা যায়। অন্য শক্তিশালী ভাষার দেদার শব্দ ঢুকে অনেক ভাষা তার চেহারা পালটে ফেলছে। এভাবেই ধ্বংসের দিকে (না পরিবর্তনের দিকে?) এগোচ্ছে ভাষাগুলো।  
তা, বাঁচার লড়াইয়ে যোগ্যতমই জিতবে, এই যুক্তি শুধু জীবজগৎ নয়, ভাষার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।  যে ভাষাভাষী মানুষ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী, তাদের অধ্যুষিত ভূখণ্ডে তাদের ভাষাই টিকে থাকবে, অন্যকে বিদায় নিতে হবে। সর্বোপরি, মাতৃভাষাকে ভালো বাসতে হবে, তাকে যথাযোগ্য ব্যবহার করতে হবে। ভালোবাসলে সবকিছুরই আয়ু বেড়ে যায়। নইলে  হাহুতাশ করে লাভ নেই।



কোন মন্তব্য নেই: