“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৯

ছায়া

।। সুপ্রদীপ দত্তরায়।।

(C)Image:ছবি

মস্ত শরীরে একটা অসহ্য যন্ত্রণা, একসাথে অনেকগুলো যন্ত্রে সমস্যা ।ডাক্তারদের নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম । হাসপাতালে বাস্তবিকই এখন পৌষ মাস চলছে। পাশে হাতখানা হাতের উপর রেখে মীরা চুপচাপ । পাশেই বসা কিন্তু অনেক দুরে । দুর বলতে অনেক দুরে, সহস্র যোজন কিংবা তারও বেশি , সে এক অন্য জগত। চাইলেই দুটো মন একসাথে পৌছাতে পারে না সেখানে । কোথাও না কোথাও একটা ফারাক থেকে যায় । এই একটা জায়গাতে সুবীরের বিজ্ঞান এখনো কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারেনি ।
মীরার জন্যে মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয় , জীবনে সুখ জিনিসটা ওর জীবনে প্রসাদের মত কণামাত্রই থেকে গেল । অথচ যে রূপ আর গুণ নিয়ে সে পৃথিবীতে এসেছিল তাতে তার মত মেয়ের রাণীর মত জীবন হওয়ার  কথা । আবারও প্রশ্ন, সব রাণীরা কি সুখী হয় ? সুখ তবে কি?  ভালবাসা বস্তুটি সুবীরের ঠিক মাথায় ঢোকে না, চোখে দেখা যায় না যে। সুবীরের এযাবৎ পড়াশুনাতে ভালবাসা, প্রেম এসবের বৈজ্ঞানিক কোন ব্যাখ্যা নেই। ওসব কবিদের কল্পনাতে সম্ভব । ওদের সাহিত্যে আকাশের সীমা থাকে, মনের থাকে জানালা,  ফাগুনে পলাশে নাকি আগুন লাগে , স্মৃতি নাকি মমি হয় মনের পিরামিডে।  সুবীরের আর ভাবতে ভালো লাগছে না। মাথাটা তে অসহ্য যন্ত্রণা । তবু মীরার জন্য দুঃখ হয়। চুলে তার হেমন্তের ছোঁয়া, চামড়াতে সেই টানটান ভাব আর নেই। তবু তারই মধ্যে এক অদ্ভুত সৌন্দর্য, চোখ ফেরানো যায় না । সুবীরের তাকাতে খুব কষ্ট হচ্ছে । চোখে আলো সহ্য হচ্ছেে না। ঘরের আলোটা কমানো , তবু চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছে । আজকাল সব কিছু ঝাপসা লাগে । মুখ দেখে কাউকে চিনতে পারা যায় না । এই মুহূর্তে সুবীরের মনে হলো একটা ছায়া এসে ঘরে ঢুকছে। কপালে একটা সূক্ষ্ম ভাঁজ দেখা দিয়ে আবারও মিলিয়ে গেছে । না: মনে করতে পারছে না লোকটাকে। ছায়ার কথা মনে আসতেই ছোটবেলার কথাগুলো হঠাৎই মনে হলো । একটা সময়ে সুবীর ছায়াকে খুব ভয় পেত । আশ্চর্যের কিছু ব্যাপার নয়, ওই বয়সে অনেকেই ভয় পেত ছায়াকে। অনেক বয়েস অবধি বাথরুমে একাএকা যেতে ভয় পেত সে । মনে হতো এই বুঝি ওর কিছু একটা হয়ে যাবে । মা বলতেন, " বোকা ছেলে, ছায়াকে বুঝি ভয় করতে হয়?  ওতো তোর বন্ধু । তোকে জন্মের সময়ে যখন প্রথম কোলে তুলে নিই, তখন তোর খেলার সাথী হিসেবে ওকেও আমি তুলে এনেছিলাম । সেই থেকেই তো সে তোর সাথে আছে।
--- " কিন্তু ওতো সবসময়ে আমার সাথে থাকে না মা --।"
--- " কে বললে সে কথা ? ও সবসময়ই তোর সঙ্গে আছে । যখন তুই ঘুমিয়ে থাকিস তখনও সে জেগে থেকে তোকে পাহারা দেয় । আগামী দিনেও দেবে । যতদিন তুই এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকবি ঠিক ততদিন ।"
-- "কিন্তু মা ও যে আমার সাথে একটিবারও কথা বলে না ।"
--" বলবে না, কক্ষনো বলবে না , আমি ওকে বারণ করে দিয়েছি ; কারণ পৃথিবীতে  যত ঝগড়া তার অধিকাংশই জেনে রাখিস কথার ভুল বোঝাবুঝিতে সৃষ্টি ।"
মায়ের কথাগুলোতে কেমন যেন সম্মোহনী থাকে , তর্ক করা যায় না, কিন্তু ---।
সুবীর একবার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল । রাশভারী এই লোকটার অনেক কথাই সুবীর বুঝতে পারে না । দুয়েক বার ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করার পর খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে বলেছিলেন, " ও কিচ্ছু না, ওতে ভয় করার কিছু নেই ।"
-- "কিন্তু বাবা, আমি যে ওকে দেখতে পাই, আমার ভীষণ ভয় হয়। "
উনি পত্রিকাটি ভাঁজ করে কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, " এই যে ছায়া তুমি দেখতে পাচ্ছো, আসলে ওটা তুমিই । 
বাবার কথাগুলো বড় অদ্ভুত, বোঝা যায় না ।
একটু থেমে তিনি আবার  বললেন --- "এ বড় কঠিন বিষয়, এই যে ছায়া তুমি দেখতে পাচ্ছো , সে তুমি আছো বলেই তার অস্তিত্ব । আরো গভীরে গিয়ে যদি দেখতে যাও , তবে বলবো এই ছায়াটাই আসলে তুমি আর যে তুমি আমার সাথে কথা বলছো সে তোমার অহং । যখন তোমার স্বার্থ সিদ্ধি হয়, তোমার অহং তখন পরিতৃপ্তি লাভ করে, তুমি খুশি  হও, আবার যখন তোমার স্বার্থবুদ্ধিতে সংঘাত লাগে তোমার অহং রুষ্ট  হয়, তুমি খুব  কষ্ট পাও। তোমার মন খারাপ হয়। এই যে তুমি ভয় পাচ্ছো, সে তোমার অহং এর নিরাপত্তার অভাব বোধ । যতক্ষণ তোমার মধ্যে তোমার অহং বেঁচে থাকবে ততদিন তোমার মুক্তি নেই। আর তোমার মুক্তি নেই মানেই হচ্ছে তোমার ছায়ার মুক্তি নেই । শাস্ত্র পড়লে সব জানতে পারবে ।"
বাবা প্রাচীনপন্থী সংস্কৃতে পণ্ডিত, বিজ্ঞানের সব যুক্তি মেনে নিতে পারেন না । রাগ করতেন,  বলতেন, " তোদের বিজ্ঞান তো সেদিনকার ছোকরা । শাস্ত্র যদি তোদের জ্ঞান চক্ষু খুলে না দিত, তবে তোদের বিজ্ঞানকে আজও আঁতুড়ঘরে হাত পা ছুঁড়তে হতো।"
বাবা মায়ের কথা মনে আসতেই অনেক অনেক ছবি একে একে ভেসে আসতে লাগলো। সুবীর অনুভব করতে পারছে, ঘরে একটা একটা করে অনেকগুলো ছায়ার ধীরে ধীরে ভিড় জমে গেছে । মুখগুলো খুব চেনা চেনা লাগছে । সুবীরের ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, তবু কেন যেন  চিনতে কষ্ট হচ্ছে না। ভিড় থেকে একটা আটপৌরে শাড়ী পরা মহিলা ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন । এই ছায়াটা সুবীরের খুব পরিচিত । চোখে দুটো অভিমানে ছলছল করে উঠলো । উনি এগিয়ে এলেন । ডান হাতটা আলতো করে সুবীরের কপালে ছোঁয়াতেই মনে হলো , যেন সমস্ত যন্ত্রণা উনি তার হাতের মধ্য দিয়ে শুষে নিচ্ছেন। সুবীর অস্পষ্ট শব্দে বললে, " এতদিনে তোমার সময় হলো মা ? আমার যে ভীষণ কষ্ট ---।" ওনার চোখে অপার শান্তি । যেন সমস্ত কষ্ট মুছে নিতেই উনি এসেছেন। সুবীরের দুচোখে না চাইতেই জলের ফোঁটা । এক পলকের জন্যে মীরার জন্য মনটা কেমন করে উঠলো । ওর অবর্তমানে মীরার কি হবে ?  ওকে যদি সঙ্গে রাখা যেত । সুবীর শরীরের সমস্ত শক্তি ঢেলে দিয়ে মীরার হাতটাকে শক্ত করে ধরার চেষ্টা কবলো।  সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নার্সটা খুব যত্ন করে মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্কটা খুলে নিচ্ছে । এখন যে শরীরে আর কোন কষ্ট নেই। সুবীর নিজের ছায়াটাকে খোঁজার চেষ্টা নিল , কিন্তু নেই। তবে কি - ?   যা হোক হবে,  সুবীর আর ভাবতে চায় না ।........

শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৯

ভুল ভাঙবে একদিন

      ।। রফিক উদ্দিন লস্কর ।।

(C)Image:ছবি








রা আছে ওদের মতো করে
বদলাবে না'কি কোনদিন!?
প্রযুক্তির যুগে বিশ্ব অনেক এগিয়ে
তবুও ওরা রয়েছে অন্ধকূপে।
সংকীর্ণতার চাদরে ঘেরা মন
মানসিকতারও হয়নি পরিবর্তন।
শুধু খোলসে ভদ্রতা...
অন্তরে ঘৃণার পাহাড় শৃঙ্গ।
উদারতার হাত অনেক নিম্নগামী
ছানিপড়া চোখে কি আর দেখবে!
তবে! পাল্টা আঘাতে একদিন
বুঝে নেবে নাহয় শুধরে নেবে,
নিজেকে নিয়ে জগত চলেনা
চলার পথে কাঠখড়ও কাজ দেয়।
ইটপাটকেল তো আলাদা,
ভদ্রতার কাছে মানায় না।
তবে, সুবচন কাজ দিতে পারে
আর তখন সময় হবে কণ্ঠাগত।


শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৯

আকাশ

।। সুপ্রদীপ দত্তরায়।।









কাশের ঠিকানাটি শুধু অশ্বত্থ জানে
সে কখন আসে কখন যায়
কখন কোথায় ঘুরে বেড়ায়
শুধুমাত্র অশ্বত্থই খবর রাখে।
এই যে মেঘ , ভালোবেসে গা জড়িয়ে আছে ,
কানে কানে কখন কি ভালবাসার পাঠ দিচ্ছে,
অশ্বত্থ চোখ বুজে সব বলে দিতে পারে ,
এমনই তাদের সম্পর্ক।
ছোটবেলা থেকেই তার আকাশের সাথে
প্রকাশহীন নিবিড় বন্ধুত্ব ।
মাঝে মাঝে তার রাগ হয় , বিরক্তি লাগে,
এত কিসের খুনসুটি ? বেলেল্লাপনা
প্রকাশ্যে লোমশ বুকে নির্লজ্জতায় মুখ ঘষা,
এতো সুস্থ নয়, ছিন্নমতী, চঞ্চলতা ।
আকাশ তখনও নির্বিকার
স্নিগ্ধ হাসি ঠোঁটে , চোখে তার বিস্ময় অপার ।
মেঘ যখন রেগে যায়,
প্রচন্ড আক্রোশে সমস্ত সুন্দরকে ধংস করতে উদ্যত,
অশ্বত্থ ভয়ে ভয়ে ইষ্ট স্মরণ করে --
আকাশ তখন শান্ত, শীতল ;
অবাক হয়ে মেঘকে দেখে আর ভাবে
এত রূপ মেঘ কোথায় লুকিয়ে রাখে।
আর ঠিক এই কারণেই আকাশকে ঘিরে
অশ্বত্থের মনে এক বিশাল দুর্বলতা ।
পৃথিবীর মানুষগুলোও আকাশের মত --
ভীষণ নরম, তুলতুলে, আবার বজ্রের মত কঠিন
সকল পরিস্থিতিতে পঞ্চমে সুর।
পার্থক্য শুধু একটিই
আকাশের মত বিশাল মনটা কারো নেই, আর -- ?
আর, মানুষগুলো কেমন যেন বীর্যহীণ,
শত আঘাতেও প্রতিবাদ করতে জানে না ,
সংকটের ত্রিসন্ধ্যায় ওরা সুখের স্বপ্ন দেখে হায়।

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৯

আমি সেই আমি

     ।। রফিক উদ্দিন লস্কর ।।

(C)Image:ছবি









কদিন তো এমনই ছিলো
ছিলোনা তো কোন হাত পা,
তবুও দৌড়ে শরীক হয়েছি
কল্পনা করতে পারিনা যা।
আমি যে তখন যুদ্ধ করেছি
চল্লিশ লক্ষ সৈন্যের সাথে,
পাগলের মতো ছুটছে ওরা
চার পাঁচশো রয়েছে হাতে।
কেউ যে মরেছে  ক্লান্ত হয়ে
পরাজিত হয়েছে কতেক,
উর্বর আসনটা দখল করি
আমি মহাশক্তিশালী এক।
আমার শুরু সংগ্রাম দিয়ে
একা ছিলাম তখনি আমি,
যুদ্ধ করে যে পেয়েছি প্রাণ
সেদিনটাতেও যাইনি থামি।

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৯

অতএব আজাদি

।। জাহিদ রুদ্র।।
(C)Image:ছবি











কে    আমি...
কেন আজাদি বলি! বলবো ভাত চাই ওটা দাও
পনেরো লাখ চাইনা শুধু
জীবিকা চাই--
 
তাও ভাত আর কিছু নয়
কারণ আমার প্রতিটা কাজ শুরু হয়
পরম করুণাময় অশেষ দয়ালু
 
মহান কৃষকের নামে যার হাত ধরে সভ‍্যতার শুরু।
কি ?প্রগতি, হ্যাঁ সে তো অনেক হয়েছে
উজ্জ্বলা হয়েছে গরীবের উনুনে ও টি পি'র মতো
আবাস হয়েছে কাঁচা থেকে পাকার মতো
সন্ত্রাসী মরেছে সেনাবাহিনীর গোরস্থানে,
আর আপনি বলছেন রেনেসাঁ---
নিশ্চয় সেটা হয়েছে সারা ইউরোপ জুড়ে।
প্লেটো সক্রেটিস ভিঞ্চি আর দেকার্তে
সকলেই পাকস্থলীতে পুষেছে মগজ
কারণ ভাত,
আর পৃথিবীর মাতৃভাষা আজও ক্ষুধা।
পৃথিবীটা ক্ষুধার পা চাটে আজ থেকে নয়
সেই আদিম থেকে,
যেহেতু ক্ষুধা মহামতি,তাই
যুদ্ধ আর বুলেটের মিথস্ক্রিয়ায় চেয়েছিল ক্ষুধা নিবারণ।
কিন্তু বাবু, ক্ষুধার জ্বালায় 
কীসের আজাদি কীসের জিন্দাবাদ?
আমার চিৎকার হবে ভাত-ভাত-ভাত,
অতএব
পতাকা রাষ্ট্রগান ও সংবিধান
ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলুন
কারণ
 
আমার সিনেমা হবে
ভাত দে হারামজাদা


সোমবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১৯

হাঁদারাম

  ।। রফিক উদ্দিন লস্কর ।।

(C)Image:ছবি











কটা ছেলে এমন আছে
সবকিছুতে হাসে,
কাজের বেলা কাজ নেই
সবটুকু সে নাশে!
পড়াশোনাও তেমন নেই
নিজেই বলে বেশ,
দেখলে বলবে আস্ত ভূত
মাথায় লম্বা কেশ।
ইদানীং যে রাজনীতিতে
জড়ায়েছে তারে,
দলবদল তার রোজদিন
কী'বা আর পারে!
নিজেকে ভাবে মহাজ্ঞানী
গোবর মাথায় নিয়ে,
সবখানে তার ঠেলাঠেলি
সব কুটবুদ্ধি দিয়ে।

রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৯

যায় দিন

।। রফিক উদ্দিন লস্কর ।।

(C)Image:ছবি







প্রজাপতি ফুলে বসে
মধু করে পান,
উড়ে উড়ে ভোমরাও
করে যায় গান।
ফুলটুসি বসে আছে
কানন ছায়ায়,
গগনে মেঘের ভেলা
পাল তুলে যায়।

শুক্রবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৯

নববর্ষের কবিতা

।। চিরশ্রী দেবনাথ।।

(C)Image:ছবি











সেছে নববর্ষ অর্ণবমেঘে, এই পৃথিবীতে আবার
যারা চলে গেছে, অকালে অঝোরে ঋতুচিহ্ন নিয়ে
সকল নৃশংসতা,  বিষ ও আগুনের মতো হৃদয়ে ধারণ করে
ক্ষমা করো তোমরা এই পৃথিবীরে,  সদ্যজাত বঙ্গাব্দকে    
আসতে হয় ক্ষীণ ধর্মবোধ আর শ্বেতপ্রদাহ নিয়ে নিয়ম করে
তাই আসা, তাই আসা, তপ্ত অসীম কালবৈশাখীর সাথে 
মধ্যরাতে পিচ ঢালা রাস্তায় ঐ  নীলাভ হিমকর ধরাচ্ছে নেশা
কাচের আলো দুপাশের বাড়ি থেকে পড়ছে ভেঙেচুরে বুঁদ হয়ে  জল ছিটকে চলে যাচ্ছে গাড়ি, নির্জনতা পছন্দ করেনি সে 
তরুণ ড্রাইভার বন্দিশের ঠিকানা বদলাচ্ছে বার বার
তাই দেখে ফ্রক পরা কিশোরী পুনর্বার নেমেছে বর্ষবরণে
দুহাতের খই ভরা ডালায় তার বারোটি মাস রাখা সুঘ্রাণে
কাঁচা কাঁঠালের আসক্তি কষ লেগে যাচ্ছে হাতে ও স্পর্শে
মথুরা শহর যেমন করে পারে না ভুলতে দূর বৃন্দগ্রামকে
আজকাল নির্বাচনী প্রচারের পর যুবকের দল ফিরে যায়
সঙ্গে কি থাকে, কি লাভ , কি হয় আসলে, তবুও অমোঘ নেশা, 
সমুদ্র দ্বীপ যেমন করে দার্ঢ্য থাকে ঢেউয়ের একান্ত রিরংসায়,  
অশ্রু ও রক্ত ভুলে গনতন্ত্র ধরতে চায় কেবল এক প্রত্যয়ী হাত ;
 শ্লোগান মিথ্যা হয়, প্রতিশ্রুতিও, তবুও দেশ বলে
জাগিয়ে রাখো ; জেগে থাকো ; হাজার অন্ধকার আলোরই মতন অবশেষে, পথ শেষে ; তাই এই নববর্ষ মায়াময়, রোদময় ;
বৈশাখে জন্ম নেওয়া পাখি শিস্ দিতে শিখেছে আজই, খিস্তিও ;
তার শিশুকাল নিস্তব্ধতা শেখেনি, অচিরেই আছড়ে পড়েছে যৌবন ; প্লাবন তাই সমকালে, আগামীতে উর্বরা পলি, সতন্ত্র শস্যক্ষেত্র।




শনিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৯

সূর্য প্রণাম


।। বিদ্যুৎ চক্রবর্তী ।।


(C)Image:ছবি








কিছু ক্ষণ দৌড়ঝাঁপ ঠা ঠা রোদ্দুরে
কিছু ক্ষণ একঘেয়ে আলসেমি -
চলমানতার সাতকাহনে
দোদুল্যমান যাত্রাপথ ।
দহন কালেও সরাসরি চেনামুখ সব
ছায়াময় রাতে আসে কিছু
প্রোথিত মূলের কায়াহীন অবয়ব।
বেঁচে থাকার অতীত রসদ নিয়ে
উঠে আসে কৃতজ্ঞ হৃদপিণ্ডের
অলিন্দ পেরিয়ে স্পষ্ট কোলাজ হয়ে,
অপার সুখের উত্থিত আকরে আকরে।

অচেনা সূর্য এসে ধরেছিল হাত,
মৃত্যুফেরত কিছু পরিচিত আত্মা
আজও বয়ে চলে শিরায় শিরায়।
আজও সূর্যালোক ফিরে ফিরে আসে
অপ্রত্যক্ষে - রাতের গভীরতায়।
বিজন রাতের প্রমোদ বিহারে মগ্ন
প্রসন্ন ক্ষণেও নমস্য আলোকচিত্র,
সঘনে উন্মোচিত আজ জীবন রহস্য
অজানিতে করযোড় সূর্য প্রণামে।
আঁধারি আলোয় সিঞ্চিত হোক
প্রজন্মের সঞ্চিত শ্রদ্ধা, উৎস আলোয়।

বৃহস্পতিবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৯

কন্ঠীবদল

।। চিরশ্রী দেবনাথ।।

(C) Image:ছবি





]





শ্যামলীরাই বোস্টমী। জেলা উত্তর ত্রিপুরা। গ্রাম পলাশকুঞ্জ
সাড়ে কুড়ি বছরে কণ্ঠীবদল।
তখন ফাগুনমাস। বেহায়া বাতাস। দুজোড়া ধুতি চাদর।
পলাশফুল পড়ে পড়ে পিছল হয়ে থাকে আখড়ার প্রাঙ্গণ।
তিলক মুছে তিনবার মাছ খাওয়া হয়েছে।
দুবার মুরগীর ঝোল। তিনখানা হিন্দি ফিল্ম। নাচ গান।
এটুকুই অবৈধ বসন্ত। বাকি সব কীর্তন। সপ্তমীর জ্যোৎস্না।
শিউলি, কাঞ্চন, রংহীন জবা তুলে তুলে নারায়ণের চরণে।
দোলের দিন সবুজ রঙ, গোলাপি আবির, সঙ্গীর পুরাতন মুখে  ভিক্ষাকষ্ট  শুধু। 
পুণ্যের মাস। কার্তিকের কুয়াশা মেখে মেখে শহরের অলিগলি ঘোরা হয়। 
একজন মরল, দ্বিতীয়জনের লগে কণ্ঠীবদল। 
শ্যামলীরাই  হাসে না। নামগান করে। 
তৃতীয়জন এলেই বা কী। বয়স তার এখন সাঁইত্রিশ। 
ভরা হাতে মাছ কাটতে ইচ্ছা হয়। রক্ত ধুয়ে তেলে হলুদে জমিয়ে গন্ধ ছাড়তে ইচ্ছা হয়।
না হয় সন্ধ্যাবেলা একটু তুলসীতলা। বাকি মাছভাত আর রমণ।
সে হবার জো নেই।
 অথচ ভক্তি নেই। 
ঘোর সংসার বুকের ভেতর। 
ঘরবাড়ি উঠোন চুলা আর পুকুরঘাট সমেত।
গাছভর্তি আমের বোল। কষা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে ফাগুন চৈত্র মাসে, আর পুকুরের জলে গা ধুতে ধুতে লাক্স সাবানের ফেনায় ফেনায় ধুয়ে যাচ্ছে বোস্টমী রঙ। 
তিলকের মারপ্যাঁচ,তুলসীমালার বৈরাগ্য।
ট্রেনে কইরা আসাম যাওয়ার সময় দুই মেয়ের সঙ্গে দেখা।
ভরা যৌবন।
 বিবাহের রঙ নাই কপালে। কিন্তু বোঝা যায় মাংস ছুঁয়েছে তারা। কই কণ্ঠীবদল তো হয় নাই।
জীবন্ত স্বাধীন। শ্যামলীরাই কীর্তনের সুর তোলে। দশটাকা,দশটাকা দেয় দুজনে।
কয় আশীর্বাদ করো যেন  আজ রোজগার হয়,আমরাও বোস্টমী,ঘর আছে, ঘর নাই। বাইরে বেরুলেই  টাকা।
বাড়ি ফিরলে জিগায় টাকা আনছো নি?
তবুও তোমাদের  তো ভণিতা নাই,শ্যামলীরাই তর্ক করে।
হি হি ! ভণিতা ! ছুরির মতো হাসি। নাহ্ ভণিতা নাই, রং-খেলার দিন কৃষ্ণ আসে খেলতে।
তার চোখে দেখা যায় এই  বসন্তকাল।
গোপী মেয়েদের ব্যথা।
কত কত রঙ নিয়ে আমরা পদাবলী লিখে যাই।
মানুষ ভুল করে ভাবে ধর্মের গান, অথচ এসব
আসলে নাড়ি ছেঁড়া অশৌচ কাল। 


বুধবার, ৩ এপ্রিল, ২০১৯

পুলওয়ামা

।। সুপ্রদীপ দত্তরায় ।।









কটা ভয়ঙ্কর সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে 
অদ্ভুত উৎকট পরিস্থিতি ,
আনাচে কানাচে উৎকণ্ঠা আর শঙ্কা 
দেশপ্রেমে এখন শুধুই জোয়ার, 
বিপন্ন একাত্মবোধ, জাতীয় সংহতি ।
মনে ভয়, হয়তো আবারো হয়, 
জাতি দাঙ্গা --
চুরাশি দৌরাত্ম্য  দুর তো নয়।
পথে ঘাটে, নির্জনে, এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে
পৈশাচিক আক্রোশ, সে ভয়ঙ্কর দেশপ্রেম ---
আমার সত্যিই ভীষণ ভয়।
পুলওয়ামা পরবর্তী যা ঘটেছে দেশে , 
কাশ্মীর চাই, কাশ্মীরী নয় --
এ কোন অন্যায় আবেদন ?
জাতি বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা , দেশপ্রেম তো নয় ।
শহীদের কফিন ঘিরে ভোটের রাজনীতি 
মনের ঈশান কোনে পুঞ্জীভূত মেঘ
সত্য বলার স্বাধীনতাকে টুঁটি চেপে ধরা ?
প্রচারের আলোতে খোঁজে আত্মতৃপ্তির আশ
হে ঈশ্বর,  ওদের মূর্খের স্বর্গে বাস  
এদেশ এখন কোন অশিক্ষিত বন্যদের নয় ।
পুলওয়ামাতে যা ঘটে গেল সেদিন --
তার জন্যে হোক  প্রতিবাদ,  তীব্র তিরস্কার ।
যত রক্ত ঝরিয়েছে সেনা, অতর্কিতে 
কুচক্রীর আত্মঘাতী হামলায়, 
হৃদয়ের প্রতিটি কোষ, শুধু আমি নই
আসমুদ্র হিমাচল কেঁদেছে যন্ত্রণায় ।
ঘন আর্তনাদ আর বোবা আক্রোশে।
কোনও হিন্দু কিংবা মুসলমান নয়--,
নয় কোনও শিখ, পার্সি কিংবা পাঠান , 
কেঁদেছে প্রতিটি ভারতীয় অন্তর
ভারত মায়ের ওরা সাচ্চা সন্তান ।
এসো, হে বন্ধু, হে উদ্দীপ্ত ভারতবাসী 
এই দুর্দিনে, হাতে রাখি হাত ,
ঊর্ধ্বে উঠে সব - ধর্ম, বর্ণ, জাত
এসো বাঙালি, গুজরাটি , কিন্নরী  কাশ্মীরী
এসো খোলা দিল উড়িয়া তামিল
এসো সংহত হই, সংযত হই
সংহতির শপথ নিলাম এবার
এদেশ আমার, এদেশ তোমার ,
শুভবুদ্ধি থাকা সকল ভারতবাসীর
যোগ্য জবাবে গর্জে উঠুক সুতীব্র প্রতিরোধ 


চিরকূট

।। সুপ্রদীপ দত্তরায় ।।


(C)Image:ছবি







প্রথমে একটা বোমা
সবে সকালবেলা চায়ের টেবিলে বসেছে সে
সামনে চায়ের পেয়ালা, হাতে খবরের কাগজ, 
ঠোঁট আর বাদামী অমৃতে এখনও বিস্তর ফারাক ।
তখনই আরো একটা ।
ততক্ষণে একজোড়া ঠোঁট 
নিমেষে শুষে নিয়েছে একচুমুক তিক্ততা ।
সার্জিক্যাল এট্যাকে সে যথারীতি হতবাক।
তারপর ?
তারপর,  ক্রমাগত বর্ষণ, একটানা একুশ মিনিট ।
যখন থামলো, তখন সব শেষ, 
বাইরে বারুদের পোড়া গন্ধ, 
ভেতরে বিষাক্ত ঝাঁঝ ।
জানতেও পারলে না, তোমাদের সৃজনশীল ভূমিকায়
প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে ঘরে ঘরে কত হিরোশীমা, নাগাশাকি , 
তোমাদেরই অজান্তে ।

মঙ্গলবার, ২ এপ্রিল, ২০১৯

কঙ্কনা

।। সুপ্রদীপ দত্তরায়।।

(C)Image:ছবি







ঙ্কনা, আজ  আর অঙ্ক না ,
বুকে ডম্বরু, পার্সে ঠনঠনা ।
তবু প্রেম করি, চলো প্রেম করি
ফোনে কল করি, মনে ফুলকলি ,
এসো চুলবুলি, এই মন খেলায় ।
এই দুপুরবেলায় , চল কাঁঠালতলায়
সেথায় উদার গলায় , আমি কোকিলকে ডেকে
শুধু বলবো --,
কী ????
ভালবাসা পুঁথি পড়ে হয় না ,
ভালবাসা পুঁথি ঘেঁটে  হয় না ,
ভালবাসা পুঁথি মেনে  হয় না।।
চৈতি আকাশ, মনে উদাস বাতাস
ক্ষণে খুনসুটি আর  ক্ষণে দীর্ঘ যে শ্বাস
এত তৃষ্ণা ঠোঁটে, ঠোঁটের কোলাজ ফোটে
তোমার আস্কারাতে , আমার শাসন টুটে
ঘামে ভেজা বুকে, শত পদ্ম ফোটে
আমি কানে কানে তোমার মুখটা টেনে শুধু বলবো -,
কি ??
ভালবাসা পুঁথি পড়ে  হয় না ,
ভালবাসা পুঁথি ঘেঁটে  হয় না ,
ভালবাসা পুঁথি মেনে  হয় না।।
কঙ্কনা, না না অঙ্ক না,
এতো তাড়া কিসে, হাতে শঙ্খ না,
চলো প্রেম করি, ফোনে কল করি
প্রেমে ডুব মারি, বুকে কোৎ মারি
রাগে, অনুরাগে, যেন মন ভরে না ।
বিয়ে করবোও না, ঘানি টানবোও না,
ধরা দেবও না শুধু ওই ছাদনাতলায়।
বিয়ে বিগড়ে যখন যায়, ঘরে শান্তি যে হারায়
মনের এই আশঙ্কায়, নেড়া আমি শুধু বলবো --,
কি ???
ভালবাসা পুঁথি পড়ে  হয় না ,
ভালবাসা পুঁথি ঘেঁটে  হয় না ,
ভালবাসা পুঁথি মেনে  হয় না ।।

সোমবার, ১ এপ্রিল, ২০১৯

তর্পণ


।। সুপ্রদীপ দত্তরায় ।।

ছেলেটি সত্যি  অভাগা । গান কবিতা নাটক নিয়ে থাকতো, পাগল ছেলে ,  শেখার ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ । অনুষ্ঠান করতে খুব ভালবাসতো সে। এই নিয়েই তার যত বায়নাক্কা। কোন অহংকার ছিল না, মিশতে পারতো সবার সাথে সহজে ভাবে। বয়স কত হতে পারে?  ৪০-৪২  ঘরে মিষ্টি একটা বৌ আর ফুটফুটে একটা ছোট্ট পরী । জীবনের যে সময়টা ছেলে মেয়েরা বাবা মায়ের আস্কারাতে  হৈ হৈ করে বেড়ায় সেই সময়েতে সে তার ক্যান্সার রোগাক্রান্ত মাকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। অভ্যস্ত হাতে মায়ের শুশ্রূষা । বাবা বামপন্থী কর্মী তাই স্বভাবতই অভাবের সংসার । ছেলেটি মাকে নিয়ে ব্যস্ত ।ঔষধ হাসপাতাল আর শুশ্রূষা । একদিন অনেক রোগ ভোগের পর মা মারা গেলেন,তখনই বাবা ব্রেইন স্ট্রোকে শয্যাশায়ী । তারপর আবার যুদ্ধ । একসময়ে বাবাও মারা গেলেন । ততদিনে সে ঋণগ্রস্ত । ঘরে একটা বৌ এসেছে,এসেছে একটা মিষ্টি পরী । চিকিৎসার খরচ চালাতে চালাতে পৈতৃক ব্যবসা লাটে উঠেছে ।শেষমেশ একসময়ে বন্ধ। প্রচণ্ড আর্থিক অনটন। খুব পরিশ্রম করতে পারতো,রেডিওতে ডিউটি, পত্রিকা অফিসে কাজ -- সংসারে দুবেলা ভাতের ব্যবস্থা তো করতে হবে । তারই ফাঁকে ফাঁকে কবিতা গানের অনুষ্ঠান । মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত লাগতো ওকে । তবু উৎসাহে কোন ভাটা নেই। এরই ফাঁকে ভাগ্যক্রমে সেইলস্  একটা কাজ জুটলো । এবারে বুঝি ঠাকুর মুখ তুলে তাকিয়েছেন। তখনই আবার  ধরা পড়লো বৌটিরও সেই একই রোগ,প্রাথমিক পর্যায়ে । মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত । ডাক্তার বলেছেন প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর চেন্নাই এই চেক আপ। বার তিনেক গিয়েও ছিল। সামর্থ্য কোথায় ?  ডাক্তার বললেন যখন গৌহাটি আসব ওখানে দেখিও । একটা সুরাহা হলো। এবারে অসুস্থ হলো সে নিজে ।বসন্ত । খুব বাজে ভাবে অসুস্থ ।প্রচণ্ড জ্বর,কয়েকদিন ধরে খাওয়া দাওয়া বন্ধ।সেই রাত্রে ও সে প্রচণ্ড অসুস্থ ছিল । ডাক্তারের কাছেও গিয়েছিল, ডাক্তার চেম্বারে ছিলেন না ।যখন এলেন তখন ওর যাবার মত শক্তি নেই।রাতে অনেক বারই বমি হবার পরে অচেতন হয়ে শুয়েছিল। বৌ অনেক রাত অবধি শুশ্রূষা করে ঘুমিয়ে আছে ভেবে যখন অন্য ঘরে শুতে গেল,তখনই দুর্ঘটনাটি ঘটে । মশারি সে কোনকালেই গুঁজত না। ঘরে মশার উৎপাতে কয়েল জ্বালানো ছিল। কখন অসাবধানে মশারি ঝুলে কয়েলে লাগে কেউ বলতে পারে না । বাকিটা সবাই জানেন । ডাক্তাররা বলছেন কার্ডিয়াক এরেস্ট। পরিবার বলছে হয়তো সে আগেই মারা গেছে নইলে বাঁচার জন্য শেষ চেষ্টা একটা অবশ্যই নিত। পত্রিকা বলছে অন্য কিছু। সার কথা মিহিরেশ আর আমাদের মধ্যে নেই।
আজকাল যারা ওর বাড়িতে যাচ্ছেন,ওর ফুটফুটে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেন নি এমন ব্যক্তি বোধহয় খুব কম। ডাকলেই ছুটে চলে আসে কোলে । গলায় ধরে শরীরের সাথে সাপটে থাকে। বুকটা জুড়িয়ে যায়। স্বামী হারিয়ে ওর সদ্য বিধবা বৌটি যখন কেঁদে কেঁদে স্মৃতিচারণ করে তখন ছোট্ট শিশুটি মাকে আদর করে চোখ মুছিয়ে দেয় । বলে ,"কেঁদো না মা, কেঁদো না, কাঁদতে নেই যে ।"
 


ভাই

।। সুপ্রদীপ দত্তরায়।।
(C)Image:ছবি


















-- সুপ্রদীপদা, একটা কথা ছিল বলার,
-- বল্ ,  এখন বুঝি সময় হলো আসার?
-- আমি আর  আসতে পারলাম কোথায়?
ডিউটি ছিল, বিকেলবেলা রেডিওতে,
আজ কি মিটিং ছিল তোমার?
-- হ্যা, সামনেই তো গানমেলা প্রোগ্রাম ।
তারই পরিকল্পনা, তর্ক আর বিচার ।
-- আমার জন্য জায়গা আছে তো?
-- জানি না রে, ওসব তো ওরাই করে ঠিক
আমার শুধু থাকতে হয় তাই থাকা,
নইলে কোথায় আমার সময় আছে
দেখবো এসব দিক ।
-- তবু দাদা, তুমি যদি বলে দাও না --।
-- কি ?
না মানে তোমার কথাতো কেউ ফেলে না।
-- দুর পাগল,  ওসব কথার কথা,  বাজে কথা
আমার কথা কেউ শোনে না ।
-- তবু দাদা, বেশি না, দুটো গান, সন্ধ্যাবেলা ।
-- ওরে বাবা ! সন্ধ্যাবেলা ? হবে না, অসম্ভব ।
-- প্লিজ দাদা, তুমি বললে সব সম্ভব ।
-- কি মুস্কিল, বল দেখি ? আচ্ছা, দাঁড়া, দেখি।
-- দেখি না দাদা, প্লিজ ,  দেখি মানেই ফাঁকি। ........
----ফাঁকি তো তুই দিলি ভাই ।
নিঃশব্দে, নিজের যন্ত্রণাকে,
নিজের মধ্যে দুমরে মুচরে
অভিমানে চলে গেলি,
একটা সুযোগ দিলি না কাউকে ।
আমরা যখন খবর পেলাম
ততক্ষণে অনেক দেরি
তুই তখন অনেক দুরের যাত্রী।
তোর যাত্রাপথ ঘিরে অসংখ্য প্রহরী
পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, ডেনড্রোবিয়াম;
শিউলি, মাধবী ডালিয়াতো আছেই
স্বর্নচাঁপা সূর্যমুখীর বাহার বিচিত্রময় ।
আমাদের অভাব কি ওখানেতে অনুভব হয় ?
বল্ না রে ?
জানিস ভাই, তোর মৃত্যু নিয়ে এখন অনেক কথা
কেউ বলে আত্মহত্যা, কেউ বলে অসম্ভব ।
কেউ বলে হতেও পারে,
এ জগতে সবই সম্ভব ।
কথাটা হয়তো কাউকে বোঝানো যাবে না --
কতটা আগুন  জ্বললে বুকে  
শরীরে আগুন তুচ্ছ হয়,
আত্মহত্যাও আত্মসুখ হয়
অভাগা ছাড়া আর কেউ বোঝে না ওসব ।
তীব্র তুফান যখন সমুদ্র কাঁপায়
সৈকত কাঁদে তান্ডবতায় ,
পৃথিবী কি থেমে থাকে তখনো?
জীবনটাতো যুদ্ধক্ষেত্র
চারুকলা -- ছলাকলা-- চলচ্চিত্র ,
রক্তক্ষরণ ধৈর্য ধরে  নারে।
তোর মৃত্যু শুধু একটা মৃত্যু নয় রে
একটা স্বপ্নের মৃত্যু, একটা শিল্পীর মৃত্যু
একটা যুদ্ধের মৃত্যু, সংগ্রামের মৃত্যু
একটা ইচ্ছার মৃত্যু, আস্থার মৃত্যু,
তোর মৃত্যু আক্ষরিক অর্থে
একটা কবিতার অপমৃত্যু ।
তোর যে অনেক সাধ ছিল ভাই,
স্বপ্ন ছিল , অনেক কিছুরই প্রতিভা ছিল,
পূর্ণতা তোর অপূর্ণ রইল, পূর্ণ হলো না ।
তোকে ঘিরে অনেক স্মৃতি, টুকরো কথা
চায়ের কাপে অনেক আড্ডা,
হাস্যরস, গল্পগাঁথা।
চোখটা বারবার ঝাপসা হয়ে যায় ,
কেন যে বুঝতে পারি নারে।