“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ১ এপ্রিল, ২০১৯

তর্পণ


।। সুপ্রদীপ দত্তরায় ।।

ছেলেটি সত্যি  অভাগা । গান কবিতা নাটক নিয়ে থাকতো, পাগল ছেলে ,  শেখার ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ । অনুষ্ঠান করতে খুব ভালবাসতো সে। এই নিয়েই তার যত বায়নাক্কা। কোন অহংকার ছিল না, মিশতে পারতো সবার সাথে সহজে ভাবে। বয়স কত হতে পারে?  ৪০-৪২  ঘরে মিষ্টি একটা বৌ আর ফুটফুটে একটা ছোট্ট পরী । জীবনের যে সময়টা ছেলে মেয়েরা বাবা মায়ের আস্কারাতে  হৈ হৈ করে বেড়ায় সেই সময়েতে সে তার ক্যান্সার রোগাক্রান্ত মাকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। অভ্যস্ত হাতে মায়ের শুশ্রূষা । বাবা বামপন্থী কর্মী তাই স্বভাবতই অভাবের সংসার । ছেলেটি মাকে নিয়ে ব্যস্ত ।ঔষধ হাসপাতাল আর শুশ্রূষা । একদিন অনেক রোগ ভোগের পর মা মারা গেলেন,তখনই বাবা ব্রেইন স্ট্রোকে শয্যাশায়ী । তারপর আবার যুদ্ধ । একসময়ে বাবাও মারা গেলেন । ততদিনে সে ঋণগ্রস্ত । ঘরে একটা বৌ এসেছে,এসেছে একটা মিষ্টি পরী । চিকিৎসার খরচ চালাতে চালাতে পৈতৃক ব্যবসা লাটে উঠেছে ।শেষমেশ একসময়ে বন্ধ। প্রচণ্ড আর্থিক অনটন। খুব পরিশ্রম করতে পারতো,রেডিওতে ডিউটি, পত্রিকা অফিসে কাজ -- সংসারে দুবেলা ভাতের ব্যবস্থা তো করতে হবে । তারই ফাঁকে ফাঁকে কবিতা গানের অনুষ্ঠান । মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত লাগতো ওকে । তবু উৎসাহে কোন ভাটা নেই। এরই ফাঁকে ভাগ্যক্রমে সেইলস্  একটা কাজ জুটলো । এবারে বুঝি ঠাকুর মুখ তুলে তাকিয়েছেন। তখনই আবার  ধরা পড়লো বৌটিরও সেই একই রোগ,প্রাথমিক পর্যায়ে । মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত । ডাক্তার বলেছেন প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর চেন্নাই এই চেক আপ। বার তিনেক গিয়েও ছিল। সামর্থ্য কোথায় ?  ডাক্তার বললেন যখন গৌহাটি আসব ওখানে দেখিও । একটা সুরাহা হলো। এবারে অসুস্থ হলো সে নিজে ।বসন্ত । খুব বাজে ভাবে অসুস্থ ।প্রচণ্ড জ্বর,কয়েকদিন ধরে খাওয়া দাওয়া বন্ধ।সেই রাত্রে ও সে প্রচণ্ড অসুস্থ ছিল । ডাক্তারের কাছেও গিয়েছিল, ডাক্তার চেম্বারে ছিলেন না ।যখন এলেন তখন ওর যাবার মত শক্তি নেই।রাতে অনেক বারই বমি হবার পরে অচেতন হয়ে শুয়েছিল। বৌ অনেক রাত অবধি শুশ্রূষা করে ঘুমিয়ে আছে ভেবে যখন অন্য ঘরে শুতে গেল,তখনই দুর্ঘটনাটি ঘটে । মশারি সে কোনকালেই গুঁজত না। ঘরে মশার উৎপাতে কয়েল জ্বালানো ছিল। কখন অসাবধানে মশারি ঝুলে কয়েলে লাগে কেউ বলতে পারে না । বাকিটা সবাই জানেন । ডাক্তাররা বলছেন কার্ডিয়াক এরেস্ট। পরিবার বলছে হয়তো সে আগেই মারা গেছে নইলে বাঁচার জন্য শেষ চেষ্টা একটা অবশ্যই নিত। পত্রিকা বলছে অন্য কিছু। সার কথা মিহিরেশ আর আমাদের মধ্যে নেই।
আজকাল যারা ওর বাড়িতে যাচ্ছেন,ওর ফুটফুটে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেন নি এমন ব্যক্তি বোধহয় খুব কম। ডাকলেই ছুটে চলে আসে কোলে । গলায় ধরে শরীরের সাথে সাপটে থাকে। বুকটা জুড়িয়ে যায়। স্বামী হারিয়ে ওর সদ্য বিধবা বৌটি যখন কেঁদে কেঁদে স্মৃতিচারণ করে তখন ছোট্ট শিশুটি মাকে আদর করে চোখ মুছিয়ে দেয় । বলে ,"কেঁদো না মা, কেঁদো না, কাঁদতে নেই যে ।"
 


কোন মন্তব্য নেই: