“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২১

অশিক্ষিতের শিক্ষার 'দীক্ষা', সপ্তর্ষি বিশ্বাস

 অশিক্ষিতের শিক্ষার 'দীক্ষা'

সপ্তর্ষি বিশ্বাস

 ১।

 "তোমাদের যদি বলি প্রথম মহাযুদ্ধের কিছু পরে আলিপুরের হাওয়া-আপিসের ভূকম্পন-মানযন্ত্রে শ-তিনেক মাইল দূরের পৃথিবীর মাটির ওপর নয়, বঙ্গোপসাগরের জলের নিচে এমন একটা দারুণ ভূমিকম্প ধরা পড়ে যাতে সমুদ্র তোলপাড় হয়ে গেছল এবং তারই সঙ্গে যদি বলি চাটগাঁয়ের কক্সবাজারে শুঁটকি মাছের বাজার বছরের মাঝামাঝি অত্যন্ত চড়ে যায় , এবং এই দুই অসংলগ্ন কথার সঙ্গে যদি জুড়ে দিই যে জলঝড় নেই - পৌষ মাসের শেষাশেষি একদিন কক্সবাজারের জেলে-নৌকোর এক বিরাট বহর আশ্চর্য ভাবে সমুদ্রের মাঝে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় , তাদের কারো পাত্তাই পাওয়া যায় না - তাহলে তোমরা এই তিনটি ছাড়া ছাড়া ব্যাপারের মধ্যে কোন সম্বন্ধ না পেয়ে নিশ্চয়ই আমায় পাগল ভাববে।

কিন্তু এই তিনটি পৃথক ব্যাপার এর ভেতর কি ভয়ঙ্কর সম্বন্ধে যে আছে তাই তোমাদের আজ বলতে বসেছি।"

প্রেমেন্দ্র মিত্রের “কালাপানির অতলে” নামের বিজ্ঞান নির্ভর দুরন্ত কাহিনীটির আরম্ভ এইভাবে।

                             কাহিনীর অন্তিমে আবিষ্কৃত হয় সেই সূত্রটি যার দ্বারা এই সকল আপাতঃ বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলি পরস্পর সংশ্রববদ্ধ। “ক্যায়োস” থিয়োরি’র অন্তর্গত “বাটারফ্লাই এফেক্ট” ইত্যাদি “রকেট-সাইন্স-সুলভ” তত্ত্ব ইত্যাদির দিকে না গিয়েও, সহজ কথায় বলা যায়, যে, ঠিক যেভাবে প্রেমেন্দ্র মিত্র উল্লিখিত আপাতঃ বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলি পরস্পর সংশ্রববদ্ধ তেমনি বরাকের বাজারে আলু, পেঁয়াজের দাম হঠাৎ বেড়ে ওঠা কিংবা কমে যাওয়া, নাইজিরিয়ার কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠির মধ্যে হঠাৎই কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব, গ্রীসদেশের নির্বাচন ও দক্ষিণমেরুতে তাপমানের পরিবর্তন এরাও, হয়তো দেখা যেতে পারে, পরস্পরের সঙ্গে গাঁথা কোনো অদৃশ্য সূত্রে। ঠিক সেইভাবে  বরাক বা দাক্ষিণাত্যের কোনো প্রত্যন্ত ইস্কুলে, নিচু ক্লাসের কিছু ছেলেমেয়ের ইতিহাস বা অংকে কম নম্বর পাওয়ার সঙ্গে বিশ্ব জুড়ে আমাজন-হেন ই-বাজারের উত্থান, চাঁদ-মঙ্গল ইত্যাদিতে হানা দেওয়ার সাম্প্রতিক চেষ্টাচরিত্র, চাষীদের আত্মহত্যা বা চাষীদের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরস্পর সম্পর্ক ততোদূর ‘অদৃশ্য’ নয়। … সোজা কথায় আর সমস্ত কিছুর মতনই ‘শিক্ষা’ বা ‘শিক্ষাব্যবস্থা’ও নয় কোনো ভুঁইফোড় অথবা স্বয়ম্ভূ জানোয়ার। এবং এ’ও হয় সত্য, যে, এই কথাগুলি কিছু নতুন নয় যেমন নতুন নয় এই সত্যও, যে “বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে”র আবডালে এই সকল আপ্তবাক্যের রচয়িতারাই যে “শিক্ষা”কে করে রেখেছিলেন তাঁদের কুক্ষিগত। বেশী যুক্তি তর্কে না গিয়ে বলি, যে, সেই সর্বজনবিদিত “সত্যকাম” যখনঃ

“কহিলা কোকিলকণ্ঠে সুধাস্নিগ্ধস্বরে,

"ভগবন্‌, ব্রহ্মবিদ্যাশিক্ষা-অভিলাষী

আসিয়াছি দীক্ষাতরে কুশক্ষেত্রবাসী,

সত্যকাম নাম মোর।'

তখন “… স্মিতহাসে

ব্রহ্মর্ষি কহিলা তারে স্নেহশান্ত ভাষে,

"কুশল হউক সৌম্য। গোত্র কী তোমার?

বৎস, শুধু ব্রাহ্মণের কাছে অধিকার

ব্রহ্মবিদ্যালাভে”…

এই “অধিকার” থাকা আর না থাকার মধ্যে, এই ব্রাহ্মণ আর অব্রাহ্মণের ভেদের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে, অদ্যাপি, “শিক্ষা”র, “শিক্ষা ব্যবস্থা”র আদি ও অন্তিম, সর্বজনবিদিত তবু – “রহস্যকাহিনী”। অথচ রহস্যের সমাধানসূত্রটিও রয়েছে সেই ছান্দোগ্যোপনিষৎ’এর কাহিনীতেই যা রবীন্দ্রনাথের ‘ব্রাহ্মণ’ কবিতার প্রেরণা । তথাপি শিক্ষার এই জাত পাতগত অধিকারের প্রশ্নটি নিয়ে লড়তে হয়েছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকেও। অথচ তারো বহুপূর্বেই এই ভারতবর্ষের ইতিহাসে দেখা যায়, যে, গণিকাদের শিক্ষার ভার গ্রহণ করছে রাজা-রাজড়ার দল কিন্তু তখনো 'শূদ্রের' অধিকার সম্মত নয় 'ব্রহ্মবিদ্যা' লাভে। সুকুমারী ভট্টাচার্যের গবেষণা থেকে জানা যায়, যে,  তৎকালে অনেক গণিকাই ছিলেন সে কালের মানে শিক্ষিতা - নৃত্যগীতাদি ছাড়াও। সমস্যাটি এই নয়, যে, 'গণিকারা' কেন শিক্ষিত হবে, প্রশ্নটি এই, যে রাজা-রাজড়াদের এই উদ্যমের মূলটি ঠিক কোথায়? - এই উৎসাহের মূলটি এই, যে, 'গণিকা' এমন একটি 'পণ্য' যা রাজা-বাদশা ও তাঁর নন্দী-ভৃঙ্গিদের দ্বারা হয় সরাসরি ব্যবহৃত। কিন্তু 'শূদ্র' যদি 'ব্রহ্মবিদ্যায়' বলীয়ান হয় তাহলে রাজার বেগাড় খাটবে কে? খাটবে কারা? এমতাবস্থায় 'শিক্ষা' বা তার 'ব্যবস্থা' নিয়ে যতো উচ্চ এবং গহন ভাবনা, গবেষণাই হোক্‌ না কেন, এতে আদত 'শিক্ষা'র কোনো রকমফের ঘটছেনা এবং ঘটেওনি যে তার প্রমাণ বিদ্যাসাগরের সময়েও তাঁকে লড়তে হয়েছে এ নিয়ে।

                                                 বিদ্যাসাগরের সময়ে অবশ্য ঐতিহাসিক বাস্তবতা একটু ভিন্ন। তখন নিজ দরকারেই ভারতীয়দিগকে "শিক্ষিত" করবার দায় নিয়েছে ইংরেজ প্রভুরা । তবে সেই 'শিক্ষা' কিন্তু ভারতবাসীকে 'বিদ্বান' করে 'সর্বত্র' পূজিত করবার প্রয়োজনে নয়। দক্ষ করণিক শ্রেণী প্রস্তুত করবার প্রয়োজনে। এই স্থানীয় করণিক দল নামমাত্র বেতনে করে দেবে সেসব কাজ যার জন্য বহু পাউন্ড-শিলিং পুড়িয়ে তখন বিলাইতি যুবকদের আনতে হচ্ছিল এই সকল উপনিবেশে। আনার পরেও তাদের বেতনও ছিল বিপুল। ঠিক যেমন ভারতে ‘সফটওয়ার ইঙ্গিনীয়ার’ তৈরী করে শস্তায় কাজ চালাচ্ছে এমেরিকা, এই সময়ে।  কিন্তু সততই যা ঘটে তা হলো রাজশক্তি, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, পুঁজি-শক্তি নিজেদের অর্থনৈতিক লাভের নিমিত্ত যা'ই আমদানী করে তা'ই, ক্রমে জনতা প্রয়োগ করে হয় নিজেদের বিকাশে। … খনি থেকে, কারখানা থেকে পণ্যকে জাহাজ ঘাটে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে যে রেলগাড়ির আমদানী করেছিল পুঁজি-প্রভুরা সেই রেলে বাহিত হয়েই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পরেছিল ইউরোপীয় চিন্তাবীদদের গ্রন্থাদি। ঠিক একই ভাবে একটি কেরাণী প্রজন্মের জন্ম দেওয়ার নিমিত্ত ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার এবং শিক্ষা থেকে জাতপাতকে যথা সম্ভব দূরে রাখবার চেষ্টা নেয় ইংরেজ-প্রভুরা আর সেই সকল চেষ্টাই তৎকালীন, তথাকথিত এ দেশী 'নবজাগরণের' 'অব্‌জেকটিভ্‌ রিয়্যালিটি' । এর সঙ্গে অবশ্যই রামমোহন, বিদ্যাসাগর প্রমুখদের 'সাবজেক্‌টিভ্‌ এফোর্ট' না থাকলে ঘটতে পারতো না ঘটনাটি। এ ক্ষেত্রে এ'ও সত্য, যে, শিক্ষা বা ইংরেজি শিক্ষা'র পক্ষে রামমোহনের ওকালতি আর বিদ্যাসাগরের উদ্যমের অন্তর্গত উদ্দেশ্য  পরস্পর বিরোধী। বংগীয় তথা ভারতবর্ষীয় বণিক শ্রেণীর প্রতিভূ, রামমোহন রায় ইত্যাদিরাও কিন্তু আদতে, সেই সময়ে, চাইছিল ইংরেজদের ছত্রছায়াতলে থেকেই, গড়ে নিতে, যাকে সহজ কথায় বলাযায় 'জাতীয় পুঁজিপতি শ্রেণী' আর সেই জাতীয় পুঁজিপতি দেরও প্রয়োজন ছিল ইংরেজি শিক্ষার। “শিক্ষা বিস্তারের”। পক্ষান্তরে বিদ্যাসাগর পালন করেছিলেন সমাজ সচেতন সেই নেতার ভূমিকা যাঁর কাছে ব্যক্তির উন্নতি আর গোষ্ঠীর উন্নতি অঙ্গাঙ্গী জড়িত।... না, এই কথাগুলিও নয় নতুন কিছু। 'ভারতে বৃটিশ শাসন' বিষয়ে কার্ল মার্ক্সের অনতিবিস্তৃত রচনাগুলির কথা যদি বাদও দিই, হালের বিনয় ঘোষ, বদরুদ্দিন উমর  প্রমুখদের কাছেও আমরা শুনেছি প্রায় একই বৃত্তান্ত, যে বৃত্তান্তের মূল কথা 'শিক্ষা' ও তার 'ব্যবস্থা'ও আদতে নিয়ন্ত্রিত শাসক শ্রেণীর দ্বারা আর শাসকশ্রেণীকে নির্মাণ করে কারা? সহজ উত্তর জগৎ শেঠেরা। অতএব সিরাজের বৃহত্তর স্বার্থের সঙ্গে যখনই জগৎশেঠদের ক্ষুদ্র স্বার্থের সংঘাত ঘটে তখনই শোণিতধারায় ভেসে যায় পলাশীর প্রান্তর।

    অতএব এই 'সিরাজ-নির্মাতা' জগৎ শেঠেরাই বকলমে নিয়ন্ত্রণ করে, মুদ্রা ও মুদ্রাস্ফীতির মতোই, শিক্ষাকেও।



 ২।

   অতি সরলীকরণ এবং পদে পদে ফুট্‌নোট্‌ না দেওয়ার দোষ যে ধরবেন অনেকেই সে ব্যাপারে অভিহিত হয়েই আমি হাত দিয়েছি এই রচনায় তাই এই ভাবেই এগিয়ে যাবো কেননা আমার এই অক্ষর চেষ্টা কোনো শিক্ষাবিদের নিমিত্ত নয়, গবেষকদিগের নিমিত্তও নয় - কেননা আমরা দেখেছি প্রয়োগহীন, জনবিচ্ছিন্ন তত্ত্ব-প্রবক্তা ও ব্যাখ্যাতাদিগের কারো কারো মর্মে সদিচ্ছা থাকলেও প্রয়োগহীন তত্ত্বচর্চা দ্বারা আদতে তাঁরা যা করেন, অন্তিমে, তা সর্বদা এই বণিক-শাসক ঐক্যের পক্ষে না গেলেও পারেনা দাঁড়িয়ে থাকতে বিপক্ষেও। আমি নিজেও নই, কোনো অর্থেই শিক্ষাবিদ আর আমার নিজস্ব যাপন অভিজ্ঞতা আমাকে অদ্যাপি বলে, যে, “শিক্ষা”কে “শিক্ষাবিদ”দের থাবার বাইরে নিয়ে আসাই শিক্ষা ও তার ব্যবস্থাকে কোনো সঠিক দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রথম শর্ত। এটিই ছিল রবীন্দ্রনাথেরো মূল প্রতিপাদ্য তাঁর নিজস্ব শিক্ষা ও শিক্ষার ব্যবস্থার আয়োজনক্ষেত্রে। … তবে কালের এবং পুঁজি সর্বস্ব সভ্যতার যোগসাজশে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাটি যে বহু পূর্বেই বিচূর্ণ সে'ও আজ রাষ্ট্র হয়েগেছে অনেকদিন।

 

   “শিক্ষাবিদ” প্রসঙ্গে একটি কথা এখানেই বলে নিই, যেহেতু প্রসংগটি এবং মানুষটিও ঘুরে ফিরে আসবেন এই রচনার পরবর্তী অংশে, যে, 'সমস্ত পন্ড করাই' যাঁদের কাজ, সেই 'পন্ডিত'রা তাঁকে কি বলেন জানিনা, তবে আমি শিক্ষাবিদ বলতে বুঝি PAULO FREIRE, যাঁকে, পরে 'পাওলো ফ্রাই' লিখবো, তাঁকে বা তাঁর মতন মানুষদের। পাওলো ফ্রাই' এর পরিচিতি লেখা হয়েছে এইভাবেঃ Paulo Freire was a radical educator from Brazil whose work was tied to struggles for human freedom and dignity. He constantly experimented with and thought about how to connect learning and teaching among the poor and oppressed with the radical transformation of society. For Freire, this meant struggling for a world where everyone counts equally and is treated with dignity – a world in which economic and political power are radically democratised. - এবং এই পরিচিতিটি লেখা লিখিত হয়েছে কাদের দ্বারা? না, কোনো বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রচারপত্রে নয়। এটি প্রকাশিত হয়েছে Tricontinental: Institute for Social Research দ্বারা প্রচারিত একটি দলিলে। অর্থাৎ “শিক্ষা” যে সমাজ ও ব্যবস্থারই একটি অঙ্গ তা আবারো, হয়, প্রমাণিত।

                       পাওলো ফ্রাই'এ যাওয়ার আগে বলি, যে, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ও তার ব্যবস্থা বিষয়ক ভাবনার অতলে আমি যে কথাটি বার বারই টের পাই তা ১৮৬৯ সালের ১০ অগাস্ট জেনারেল কাইন্সিলের অধিবেশনে “শিক্ষা” ও “শিক্ষা ব্যবস্থা” প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে যা বলেছিলেন কার্ল মার্ক্সঃ “ … there was a peculiar difficulty connected with this (Education)  question. On the one hand a change of social circumstances was required to establish a proper system of education, on the other hand a proper system of education was required to bring about a change of social circumstances; we must therefore commence where we were.” এই পুনঃপৌনিকতার বৃত্ত থেকে বার হয়ে আসার পথ হিসেবে শুধুমাত্র একটি ভিন্নধর্মী বিদ্যালয় বা বিশ্ব বিদ্যালয় স্থাপন করা নিশ্চয়ই নয় অন্তিম তথাপি তৎসময়ের নিরিখে শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতী একটি অনুধাবনীয় সূচনা । 'সূচনা' বলছি, কেননা 'জার্মান আইডিওলোজি' বিষয়ে বলতে গিয়ে মার্ক্স-এঞ্জেলস্‌ বলেছিলেনঃ “The ideas of the ruling class are in every epoch, the ruling ideas: i.e., the class which is the ruling material force of society is at the same time its ruling intellectual force. The class which has the means of material production at its disposal, consequently also controls the means of mental production so that the ideas of those who lack the means of mental production are on the whole subject to it. The ruling ideas are nothing more than the idea the ideal expression of the dominant material relations.”

   সারাংশের ভাবার্থ করলে মোটামোটি এই দাঁড়ায়, যে,

  “ ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়েই শাসকেরা তাদের নিজেদের মতামত ও ধারণাগুলি দ্বারা শুধুমাত্র সমাজের ভিতরের বস্তুগত, অর্থাৎ পণ্যোৎপাদনের শক্তিগুলিকে, নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করেই থামেনা। এই শাসকরাই নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে, উঠতে চায় চিন্তাগত, বুদ্ধিগত এবং মেধাগত শক্তিরো। পণ্য বস্তুর উৎপাদনের মাধ্যমগুলি, অর্থাৎ নানাবিধ যন্ত্র ও নিয়মগুলির মতনই , এই শাসকেরা নিয়ন্ত্রণ করতে চায় জনতার দৈনন্দিন চিন্তা ভাবনা, মতামত, মেধা ও মানসিকতাকেও। এই জনতার চেতনা ও চৈতন্যের নিয়ন্ত্রণের নিমিত্ত শাসকেরা আমদানী করে কিছু 'আদর্শ', 'সংজ্ঞা' বা 'রীতি'র। এইসব আদর্শ', 'সংজ্ঞা' এবং 'রীতি' আদতে শাসকদের শাসক হয়েই নিজের টিঁকে থাকবার ও পণ্য বস্তুর উৎপাদনের উপর নিজ অধিকার বজায় রাখবার সহায়ক নামতা”, চরিত্রপাঠ, সমাজবিদ্যা এমন কি সাহিত্যও। এই সকল ‘আদর্শ', 'সংজ্ঞা' বা 'রীতি' যা শাসক-বণিক ‘ইয়ারি’র সন্ততি এবং সহায়ক, তাকেই প্রচার করবার ব্যবস্থাটি, হয়, সেই কালের, সেই মানচিত্রের “শিক্ষা ব্যবস্থা।  রবীন্দ্রনাথের 'তোতাকাহিনী'র খাঁচাটির মতন 'ব্যবস্থা'টির অন্তর্গত ছেঁড়া-ফাড়া পুঁথিগুলি, হয়, 'শিক্ষা'। বহিরঙ্গে যা ঘটে, তা, সময়ে সময়ে খাঁচাটি সারানো, বড়জোর নতুন খাঁচার ‘ডিজাইন’ আমদানী, পুঁথির হরফের, প্রচ্ছদের হেরফের।  আর কিছু নয়।

      এখানে এসে মনে আসছে একটি সাম্প্রতিক বিজ্ঞাপনের কথা। সম্ভবতঃ 'রেমন্ড্‌স্‌' কোম্পানীর। এতে দেখা যায় একটি বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলের মতন দেখতে ছোকরা ইন্টারনেটে, অন্‌ লাইনে, ক্লিক্‌ করে করে বেছে নিচ্ছে তার স্যুটের রঙ, কেতা, বোতাম, সূতো ইত্যাদি ইত্যাদি। সে এক একটি ক্লিক করছে আর সঙ্গে সঙ্গে পর্দায় দেখা যাচ্ছে যে সে'ই কাঁচি দিয়ে কাটছে কাপড়, বোতাম সেলাই করছে এবং অবশেষে তোয়ের হয়ে যাচ্ছে তার স্যুট। তখন বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে “এখন নিজের স্যুট নিজেই তৈরী করে নিন”।

 

          এই গোটা বিজ্ঞাপনটি প্রকৃত প্রস্তাবে একটি বড়লোকি স্যুটের হয়ে ওঠার প্রতিটি পর্য্যায়ের আবডালে, সূতো কাটা থেকে বোতাম সেলাই অব্দি, যতো শ্রমিকজনের যতো শ্রম মিশে আছে সেই সমস্তকে অস্বীকার করে, অপমান করে উচ্চ ক্রয়ক্ষমতা সম্পন্ন ক্রেতাকে দিচ্ছে আজব এক আত্মতুষ্টি। চিন্তাশক্তি বিরিহিত ‘আম্‌’ এর শূন্য মস্তিষ্কে বিজ্ঞাপনদাতা ভরে দিচ্ছে তার নিজের মতামত ঠিক যেভাবে “শিক্ষা” নামক যন্ত্রকে ব্যবহার করে বৃহত্তর “আম্‌” এর মগজে শাসকদল পুরে দিচ্ছে শাসকের সহায়র ভাবনা, চিন্তা, আদর্শ। 

শ্রমের দ্বারা নির্মীত বস্তুর সঙ্গে শ্রমিকের সম্পর্ককে মুছে তো দেওয়া হয়েছে বহু আগেই, এখন, এই বা এই রকমের বিজ্ঞাপনের দ্বারা জানা যাচ্ছে, যে, শ্রমের 'ইন্টেলেকচুয়াল মালিকানা'ও দিয়ে দেওয়া হচ্ছে উচ্চ ক্রয় ক্ষমতা সম্পন্ন ক্রেতাকে। - এটাই উদ্দেশ্য শাসক গোষ্ঠীর কেননা এতেই মুনাফা তার বণিক বন্ধুর অতএব এই উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্ত তার প্রয়োজন সততই এমন এক “তোতাকাহিনী'র খাঁচা যা “শিক্ষা ব্যবস্থা' হয়ে ‘আম্‌ তোতা'কে গিলিয়ে যাবে সেই সকল পুঁথি পত্তর – দর্শন, ইতিহাস এমন কি বিজ্ঞানও যা “আম্‌ তোতা”কে করে তুলবে এই শাসকদের উপর আরো নির্ভরশীল। অন্তিমে, গোটা পনেরো দেশী-বিদেশী ডিগ্রী নিয়ে বাজারে নামা 'শিক্ষিত'টি নিজেও ভাবে সে আদতেই বানিয়েছে বা বানাতে সক্ষম তার নিজের স্যুট, নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম, “ম্যানেজ” করতে সক্ষম তার “সাবোর্ডিনেট” দিগকে, তার পারিপার্শ্বকে। আর একই ধারণা সে’ও যাবে প্রচার করে। ক্রমে সে হয়ে উঠবে নিজেই একজন  ' নেক্সট্‌ জেন্‌ ' বিজ্ঞাপন বণিক-শাসক ‘সিন্ডিকেট’এর। এই কথাটিই আমরা পূর্বাহ্নে শুনেছি মার্ক্স-এঞ্জেলসের মুখে, একটু অন্য ভাবে।

               'শিক্ষা' বলতে এই বণিক সভ্যতার লক্ষ্য মাত্র একটিইঃ 'শিক্ষিত' দালাল, পটু এবং 'বাধ্য' মজুর, জ্ঞান-বিজ্ঞান মজুর ( যথা 'আইটি সেক্টর') ইত্যাদির জন্মদান, প্রসার ও প্রচার। 'Man and Heredity' লেখক  G.W.Roderick এর “Education and industry in the 19th Century” নিবন্ধে পাচ্ছি, যে ' In Britain, “The key issue in education at the turn of the century was related to the spread of education for the lower orders’. In this, the influence of religion was dominant. The aim was to produce a god fearing, law-abiding and industrious workforce: sober, honest, literate citizens imbued with a sense of duty… Training of the mind and formation of character were paramount objectives of the private schools and grammar schools, largely the preserve of the upper classes…”

 

      বহিরঙ্গে যাই হোক, গহনে, Roderick বর্ণিত পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি?

 


 

 

৩।

শিক্ষার সঙ্গে আর্থ সামাজিক শ্রেণীর সম্পর্কের জটিল দ্বান্দ্বিকতাকে নিবিড় ভাবে অনুধাবন করেছেন Antonio Gramsci যাঁকে আমরা এর পর থেকে উল্লেখ করব ‘গ্রামসি’ বলে। গ্রামসির মতে শাসক শ্রেণী শাসিত জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করে দুটি উপায়ে। প্রথমতঃ ক্ষমতার স্পষ্ট বা অস্পষ্ট প্রদর্শনে ও প্রয়োগে। যেহেতু শাসকদল, তুমি-আমি তার বিপক্ষে দাঁরালে কিংবা সেই রকম সম্ভাবনা দেখাদিলে, পারে, অবলীলায়কেড়ে নিতে আমার, তোমার জীবিকা নির্বাহের উপায়, তার পুলিশ এবং মিলিটারি নামধেয় গুন্ডা বাহিনীর দ্বারা, আইন-আদালত-প্রহসনের দ্বারা, কেলখানা নামক ব্যবস্থার দ্বারা পারে আমাদের নিঃশেষ করে দিতে, সুতরাং আমার-তোমার, আম্‌-জনতা-তোতা’র উপায় থাকেনা শাসকের অনাচারের, লোভের, ক্ষমতার মুখোমুখি দাঁড়াবার। তথাপি পরিস্থিতি বিষয়ে জনতা অতিক্রমও করে, করেছে এই সকল ভীতিকে। পক্ষান্তরে শাসকদলের দ্বারা যারা সর্বাধিক শোষিত ও নিপীড়িত তারাও, ইতিহাসের নানান পর্য্যায়ে, দেখা গেছে, সেই শাসকদলেরই ধ্বজাধারী হয়ে উঠতে। এই ‘তথাপি’র রহস্য ভেদের ইঙ্গিত দিয়েছেন গ্রামসী।

জনতাকে নিয়ন্ত্রণের নিমিত্ত শাসকদল গ্রহণ করে আরেকটি সূক্ষ পন্থাও। সেই পন্থাটি জনমনের মনস্তাত্ত্বিক দখলদারী। জনতার সমাজ চেতনাকে চালিত করে শাসকদলের স্বার্থে। এই চালচিত্রটি’র নির্মাণে শাসকদল প্রচার করে, নানা উপায়ে, শাসকদলের পক্ষে সুবিধাজনক যাপনচিত্রটি। এতে যা হয় তোতা-জনতা যে সকল সিদ্ধান্ত কে তার নিজের নেওয়া সিদ্ধান্ত এবং তার পক্ষে উপকারী সিদ্ধান্ত বলে ধরে নেয়, সেগুলি আদতে শাসকদলেরই সিদ্ধান্ত এবং শাসকদলের স্বাস্থের জন্যই উপকারী। ক্রমে তোতা-জনতা যে সকল মতামত, ধ্যান ধারণাকে মনে করে নেয় তার সহজাত চেতনা ( কমন্‌সেন্স্‌) তা আদতে শাসকদলেরই ইস্তাহারের সার। অতএব বল প্রয়োগ ছাড়াই বশ মানে তোতা-জনতা। গণহত্যাকে, দাঙ্গাকে নির্ণয় করে নেয় ‘দেশপ্রেম’ বলে। ধর্ষনপটু সেনাদলকে জানায় সালাম, শুভেচ্ছা – তাদের দ্বারাই নিপীড়িত হওয়া সত্ত্বেও। - শাসক শ্রেণীর দ্বারা নির্মীত নিজেদের এই সুবিধাজনক চালচিত্রকেই যা  শাসকদলের “আদর্শ” কিংবা “অন্বিষ্ট”কে একটি সংস্কৃতি, একটি বিশ্ব দর্শনে পরিণত করে তা জনতাকে গুলে খাইয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াটিকেই hegemony বলেছেন গ্রামসি।এই প্রক্রিয়াটিতে  “শিক্ষা” এবং তার “ব্যবস্থা” পালন করে কিছু কিছু মুখ্য ভূমিকা। তবে এই ‘চালচিত্র’ স্থান কাল বিশেষে হয় ভিন্ন। মনেপড়ছে ‘দেশপ্রেম’ hegemony’র সেই গপ্প যা আমরা ইস্কুলের নিচু কেলাসে পড়তাম। ‘লাচিত বরফুকন’ নামে একটা লোক তার মামাকে সর্ব সমক্ষে খুন করে বলে উঠলো “দেশ হইতে মামা বড় নয়” আর সঙ্গে সঙ্গেই সে “খুনী” থেকে হয়ে গেলো “দেশপ্রেমিক”। হায়! আমাদের ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাস বইয়ে  মোহম্মদ বিন তুঘলককে স্রেফ ‘পাগলা রাজা’ই বলা হলো। বলা হলোনা প্রতিষ্ঠিত রাজ্য চালন ব্যবস্থার ত্রুটিগুলি তিনিই যে পেরেছিলেন হৃদয়ঙ্গম করতে। পলাশীর যুদ্ধের বিশ্বাসঘাতক হিসাবে পাঠ্য বইয়ে লেখা রইলো শুধু মীর্জাফরের নাম, উমিচাঁদ, জগৎশেঠহেন হিন্দু বিশ্বাসঘাতকদের প্রসঙ্গ হলো এড়িয়ে যাওয়া। …ভারতবর্ষের মতো দেশে, যেখানে, অতি অল্প শতাংশ শিশুরই সঙ্গতি থাকে পাঠশালার গন্ডি পার হয়ে হাই স্কুলে যাওয়ার, আরো কম যায় কেলাস সেভেন থেকে উঁচুতে, আরো কম শতাংশ … এমতাবস্থায় কেলাস সেভেন অব্দি পড়ানো ইতিহাসে, সমাজবিদ্যায়, চরিত্রপাঠে যা সমস্ত তারা দেখে “ছাপার অক্ষরে” তা’ই তার পরবর্তী যাপনের “জ্ঞান”। হায়! আমি নিশ্চিত প্রতিজন পাঠ পাঠিকা তাদের ইস্কুল কলেজের সিলেবাসে পঠিত বিষয়, কাহিনী গুলি ফিরে ভাবলে এরকম উদ্দেশ্য প্রণোদিত অনেক কাহনই পারবেন শনাক্ত করতে। এই মুহুর্তে সিলেবাস বদলের হিড়িক-রহস্য আরো সহজবোধ্য। ইদানীং শাসকদলের hegemony প্রক্রিয়ায় নিচু কেলাসের সিলেবাসের সঙ্গে এসে জুতেছে “সোসাল মিডিয়া” – ফলতঃ পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে জটিলতর।

           প্রতিষ্ঠিত র hegemony বিকল্প চালচিত্র অঙ্কনের যে চেষ্টা, শিক্ষা ক্ষেত্রে পাওলো ফ্রাই তারই বাস্তবায়নের পথিকৃৎ। গ্রামসী’র প্রাথমিক পরিচয় আমি উদ্ধৃত করেছি পূর্বেই। এইবার আসি তাঁর জীবনের সেই পর্বে যখন আমেরিকা্র মদতপুষ্ট দক্ষিণপন্থীদের দ্বারা আক্রান্ত হল ব্রাজিল। পাওলো তখন ব্রাজিলে। স্কুল শিক্ষকতার পাশাপাশি চলছের তাঁর বিকল্প শিক্ষাদান প্রণালী নিয়ে হাতে কলমে কাজ। ব্রাজিল আক্রান্ত হলে পাওলো কারাবরণ করেন ১৯৬৪ সালে এবং সত্তর দিনের মতো কারাবাসের পরে তিনি বিতাড়িত হন ব্রাজিল থেকে। এই নির্বাসনের কালেই তিনি চিলি এবং অন্যত্র নিরত থাকেন তাঁর কাজে। এই সময়কালেরই ফসল তাঁর Pedagogy of the Oppressed

৪।

 

নিতান্তই ‘নিরীহ’ শিক্ষক পাওলো কে কেন করতে হয়েছিল কারাবরণ অথবা যেতে হয়েছিল নির্বাসনে? কেননা তাঁর আবিষ্কৃত আদান-প্রদান প্রক্রিয়াটি ভীত করে তুলেছিল তদানীন্তন শিক্ষা বণিকদের – যে শিক্ষা বণিকেরা মূলত শাসকদলেরই পৃষ্ঠ পোষক। পাওলো’র ‘ব্যবস্থা’কে শিক্ষা ‘শিক্ষা দান’ বলে ‘আদান প্রদান’ বলাই শ্রেয় বলে মনেহয় আমার। পাওলো’র “ডায়ালগ” কথাটিকেই আমি নিয়েছি ‘আদান-প্রদান’ অর্থে। পাওলোর মতেঃ ‘…dialogue is a way of knowing and should never be viewed as a mere tactic to involve students in a particular task. We have to make this point very clear. I engage in dialogue not necessarily because I like the other person. I engage in dialogue because I recognize the social and not merely the individualistic character of the process of knowing. In this sense, dialogue presents itself as an indispensable component of the process of both learning and knowing.’ … প্রথমেই লক্ষ্যণীয় ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠিতে পৌঁছানো, তাঁর, ব্যক্তিকে গভীরতর ভাবে জানার উদ্দেশে। নিজের মনোজগতের বিবর্তন বিষয়ে পাওলো বলেনঃ Why deny it? I was afraid of freedom. I am no longer afraid! … তাঁর এই ‘ফ্রিডম্‌’ এক সর্বাত্মক ‘স্বাধীন’। এই ‘স্বাধীন’ টিরই বিকাশ চায়না, চায়নি, চাইবেনা শাসকশ্রেণী কদাপি। শাসক শ্রেণীর এই ‘না চাওয়ার’ প্রথম স্বরূপটি ধরা পড়ে তাদের দ্বারা চর্চিত “শিক্ষা দান” এর প্রক্রিয়ায় যেখানেঃ

(a) the teacher teaches and the students are taught; (b) the teacher knows everything and the students know nothing; (c) the teacher thinks and the students are thought about; (d) the teacher talks and the students listen—meekly; (e) the teacher disciplines and the students are disciplined;(f) the teacher chooses and enforces his choice, and the students comply;

(g) the teacher acts and the students have the illusion of acting through the action of the teacher; (h) the teacher chooses the program content, and the students (who were not consulted) adapt to it; (i) the teacher confuses the authority of knowledge with his or her own professional authority, which she and he sets in opposition to the freedom of the students; (j) the teacher is the Subject of the learning process, while the pupils are mere objects.

 

এই “শিক্ষা দান” প্রক্রিয়াকে পাওলো বলেছেন ‘banking concept of education’ যেখানেঃ ‘ knowledge is a gift bestowed by those who consider themselves knowledgeable upon those whom they consider to know nothing. Projecting an absolute ignorance onto others, a characteristic of the ideology)of oppression, negates education and knowledge as processes of inquiry.’

 

এর বিপরীতে পাওলো প্রতিষ্ঠা করেন Dialogic। সাধারণ অর্থে ‘ডায়লজিক’ বোঝায় এমন এক ‘কথোপকথন’, ভাবনার এমন এক ‘আদান প্রদান’ যার দ্বারা ক্রমশঃ স্পষ্ট হতে থাকে, বলা ভালো অবয়ব নিতে থাকে, কোনো ধারণা, কোনো সংজ্ঞা, কোনো অন্বিষ্ট সত্য – কথোপকথনে অংশগ্রহণকারীদের মর্মে। তারা সকলেই “অনুধাবন” করতে থাকে ‘আলোচ্য’টিকে, একত্রে। একত্রে তবু ভিন্ন ভিন্ন ভাবে। অর্থাৎ এখানে ‘মাস্টর-বাবু’ বা  ‘দিদিমণি’ বা ‘পোবেচার স্যার’ আর থাকেন না, থাকতে পারেন না জ্ঞানের ‘দাতা’র ভূমিকায়। সুতরাং ‘শিক্ষাবিদ’ বলে আর ‘তোতাকাহিনীর’ কোনো রাজশ্যালক থাকা সম্ভব নয় এখানে। অতএব খাঁচাটিও হয় উধাও। ফলতঃ ‘ছাত্র-ছাত্রী’ও আর থাকেন না সেই আম্‌ তোতা পাখি’ হয়ে বা থাকতে পারেন না ‘ অংক ভুল হলে ‘কান ধরে ওঠবোস করো, দশবার’ হয়ে। এই ‘ডায়লজিক’কে অংশগ্রহণকারী প্রতিজনের মর্মেই, আদতে, রূপ নিতে থাকে এক ‘স্বাধীন’ যা শাসকশ্রেণীর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সাবেক ‘শিক্ষা ব্যবস্থা’ চায়না কদাপি।

 

মর্মে এই ‘অনুধাবন স্পৃহা’র জন্মদানই, আমার বোধ বুদ্ধি মতো, পাওলোর একটি মূল অনুভব। অনুধাবন-স্পৃহা’কেই সর্বাগ্রে স্থাপিত করবার গহনে, তিনি উদ্ধৃত করেন লেনিন কথিত বাক্যটিঃ

Lenin's famous statement: "Without a revolutionary theory there can be no revolutionary movement"  বাক্যটি, পাওলোর অনুভবে, জ্ঞাপন করে, যে “ means that a revolution is achieved .... with reflection and action directed at the structures to be transformed”

পাওলো ফ্রাই এর জীবন ও চিন্তা নিয়ে এই পরিসরে খুব বেশী কিছু আর লেখা সম্ভব নয়। তাছাড়া আমার নিজের সীমিত, এতাবৎ অনুধাবনে, এর চেয়ে খুব বেশী বলতে যাওয়াও হয়তো অনুচিত। তবে ‘শিক্ষা’ নিয়ে, শিক্ষার ‘ব্যবস্থা’ নিয়ে প্রকৃতই যাঁরা আন্দোলিত, গহনে, তাঁদের প্রত্যেক কে অনুরোধ করবো গ্রন্থটি পাঠ করতে। অন্ততঃ একবার।

 

 

৫।

রচনা আর দীর্ঘ করবোনা। অন্তিমে এসে আবার একবার যাবো আরম্ভে, প্রেমেন্দ্র মিত্রের সেই গল্পের শুরু-ভাগে …

হ্যাঁ। এই গল্পের মতনই “শিক্ষা”, “ব্যবস্থা”, “কল কারখানা”, “মালিকানা”, “মজুরী”, “এন আর সি”, “কোভিড”, “শাহরুক খান”, “সানি লিয়োনী”, “রবীন্দ্রনাথ”, “চে গুয়েভারা”, “সন্তোষ মোহন”, “অমিত শাহ্‌” সক্কলেই পরস্পরের সঙ্গে সংশ্রব বদ্ধ। এই সংশ্রবের সূত্রেই “শিক্ষা” নিয়ে বলতে বসে এসে পড়েন আন্তোনিও গ্রামসী থেকে পাওলো ফ্রাই থেকে … আর এই যে ‘এসে পড়া’, ‘শিক্ষা’ নিয়ে ‘রচনা’য় ‘শিক্ষা, ব্যবস্থা ও শিক্ষাবিদ’ ভিন্ন আর সমস্তের তা’ই প্রমাণ করে বর্তমান লেখজনের ‘অশিক্ষা’ এবং এই ‘অশিক্ষা’র চক্রবালে বর্তমান লেখক আমন্ত্রণ করে প্রত্যেককে, ‘বক্তৃতা’ শুনতে নয় যোগ দিতে ‘ডায়লজিক’এ।

১০ই ডিসেম্বর, ২০২০

বেঙ্গালোর

https://amarsonarbanglaamitomaybhalobasi.blogspot.com/2021/04/blog-post_25.html

 

 কৃতজ্ঞতাঃ 'অস্তিত্ব' পত্রিকা, জয়শ্রী ভূষণ

 

 

বৃহস্পতিবার, ২২ এপ্রিল, ২০২১

সদ্য প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষকে শ্রদ্ধাঞ্জলি

শোকাহত আর্তি 

ঝোড়োমেঘ
(সিক্তা বিশ্বাস)
২২/৪/২১ইং, 
হায়দ্রাবাদ। 

কেমন তুমি চলে গেলে বন্ধ করে কলমখানি
জেনেই গেছো ঢের দিয়েছো 
কদ্দূর নেবার ক্ষমতাখানি! 
অহং তুমি, আশা তুমি, সখ মেটাবার আদতখানি, 
তাই কি বুঝে লিখেছিলে 
'ছুটি' নামের কাব্যখানি! 
অমোঘ প্রয়াস ছিল তোমার দুর্বলেরে সবল করা, 
দুর্বার দুর্দম্য লেখায় মেরুদণ্ডহীনের মেরুদণ্ড গড়া!
কত ছিল শেখার বাকি এরই মধ্যে এমন ফাঁকি!
বাংলা-বাগান অগোছালো মালীর যে আজ বড়ই অভাব! 
কেমন তোমায় টেনে নিল কালের ডাকের অনড় স্বভাব।!
যেখানে থাকো ভালো থেকো আশীষটুকু বজায় রেখো,
বাঙালি যেন সবল থাকে বাংলা মাকে যত্নে রাখে।

বিনম্র শ্রদ্ধা 🙏🙏

শনিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২১

সংক্ষেপের সার





 
।। সিক্তা বিশ্বাস ।।
 

দিনে দিনে কতো যে হয় শিক্ষা । সংক্ষেপই আসল দীক্ষা! সংক্ষেপই ব্যস্ত জীবনের সংরক্ষণ ও সফলতার একমাত্র উপায়। তবে এর নমুনা কুনু কুনু সময় তাজ্জব করে। 
           আজকে পুরানা পাড়ার নিমাইকাকারে নববর্ষের প্রণাম করতে গিয়া আমার সংক্ষেপের বোধোদয় হইছে! কলিংবেল টিফতেই  কাকায় দরজা খুলিয়া আমারে দেখিয়াই গুজা হইয়া মাথা নওয়াইয়া শুভ নববর্ষ,শুভ নববর্ষ কইয়া নমস্কার দেওয়া আরম্ভ করলা, আর ইতা দেখিয়া আমি তানরে  প্রণামের বদলা পাশ কাটাইয়া এক দৌড়ে কাকিমার কাছে গিয়া কইলাম, কাকার কিতা মাথাত দুষ হইছেনি গো! আমারে নইয়া নমস্কার দিরা!!
              কাকিমায় কইলা আইজ তাইন খুব ধাক্কা খাইছইন ! ভাতিজিরে নববর্ষের স্নেহাশীর্বাদ পাঠাইসলা সংক্ষিপ্ত উত্তর দেখিয়া আমারে ডাকিয়া কইন , তারার ব্যস্ততা ও সংক্ষেপে সারার কাছে খালি আমরা নায় আমরার কৃষ্টি-কালচার ও মরিয়া ভুত!!

                           **********

মঙ্গলবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২১

অন্তর্গত ধাঁধাঃ ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি-পরিসর


।। সপ্তর্ষি বিশ্বাস ।।




১।

প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম ও আপোষের মূল্যে যার প্রতিষ্ঠা তা অবশ্যই গোষ্ঠী। আবার গোষ্ঠী গঠিত ব্যক্তি দ্বারা। আর ব্যক্তি সমাজ নির্মাণ করে আবার সমাজের দ্বারাই সে হয়, হতে থাকে নির্মিত। এই দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়াটি আজ ইতিহাসসিদ্ধ। তথাপি ব্যক্তিমানুষের গহনের, বিস্তারের ঠিক কতোটুকু অনুধাবন করতে সক্ষম ইতিহাস? ঠিক কোনখানে মানুষের গোষ্ঠীযাপন হয়ে যায় ব্যক্তিজীবন থেকে একেবারেই আলাদা? না আদৌ হয়ে যায় কি আলাদা কখনোই? এই প্রশ্নেরই বা ঠিক কতোটুকু অনুধাবন করতে সক্ষম ইতিহাস? সমাজবিদ্যা? এমন কি ব্যক্তি মানুষটির আত্মজীবনীও?

এমন আত্মজীবনী অদ্যাবধি লিখিত হয়েছে কি যা প্রকৃতই আত্মজীবনীকারের প্রকৃত ছবি? এমন কি অতি নিভৃতে দিনলিপি লিখে রাখা কোনো ব্যক্তি যে মুহূর্তে টের পায়, যে তার এই লিপি, গোপনে অন্য কোনো ব্যক্তি, সে যেই হোক পাঠ করছে, তন্মাত্র তার দিনলিপির রেখাপথও বেঁকে যায় কাঁচের ভিতর দিয়ে বেঁকে যাওয়া আলোরেখার মতো। আর যে ব্যক্তি জানে, যে কখনো তার দিনলিপিটির প্রকাশিত, মুদ্রিত হয়ে পরবার সামান্যতম সম্ভাবনা আছে -- সেই দিনলিপিতে আর যাই হোক ব্যক্তিটিকে আর পাওয়া যায়না।

আত্ম কাহনের গতি পথের এই যে প্রতিসরণতা নির্ভর করে, কাঁচটি বা যে বস্তুর ভিতর চিরে চলেছে আলোরেখাটি তার প্রতিসরাংক উপরেই। যে আত্মজীবনী লিখিত লোকশিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজনে এবং লিখতে বসবার আগেই যে লেখক জানে তার আত্মজীবনটি চলেছে মুদ্রিত বা পঠিত হতে তার প্রকৃত জীবন-গল্পের সঙ্গে লিখিতজীবন-গল্পের মধ্যকার কোণটি, বেঁকে যাওয়াটির সঙ্গে যে আত্মজীবনী লিখতে বসেছে কালো রুনুথেকে সাদা রুনুসাজতে তার প্রতিসরণ-কোণ, হয় ভিন্ন। অর্থাৎ আমি নাকচ করে দিচ্ছি, দিতে চাইছি ব্যক্তির অন্তর্গত ইতিহাসকে জানার নিরিখে, এমন কি, তার দিনিলিপিও। দিচ্ছি কেননা একটি ব্যক্তি গহনে ততোটুকুই আদত ব্যক্তিযতোটুকু কে সে ঢেকে রাখে। বরং সে অনেক অনেক বেশি স্বচ্ছতায় আপনাকে প্রকাশ করে তার শিল্পে।

কিন্তু না তো প্রতিটি ব্যক্তি সক্ষম দিনলিপি কিংবা আত্মজীবনী লিখতে, শিল্প সৃষ্টি তো দূরস্থান। অতএব সমাজ,রাষ্ট্র,শ্রেণি যে কোনো কিছুরই ইতিহাসের সঙ্গে, তার গতির সঙ্গে সংগতি রেখে গোষ্ঠীর ইতিহাস ও দ্বন্দ্ব যায় যতোদূর অনুধাবন করা তার এক সহস্রাংশও যায়না ব্যক্তি ইতিহাসকে অনুধাবন করা। ইতিহাস-ভিত্তিক সফলতম রচনাতেও যে সকল চরিত্র হয়ে ওঠে রক্ত মাংসের তারাও আদতে তৎকালীন সমাজদের, রাষ্ট্রের ইসিহাসের ছাঁচে ঢেলে নিয়ে নির্মিত। এখানে এসেও আরেকবার ফিরে যেতে হয় সেই প্রশ্নেই যার ভিত্তিতে আমার এই অক্ষরযাত্রাঃ ঠিক কোনখানে মানুষের গোষ্ঠীযাপন হয়ে যায় ব্যক্তিজীবন থেকে একেবারেই আলাদা? না আদৌ হয়ে যায় কি আলাদা কখনোই?

এমত চিন্তা, ব্যক্তি আর গোষ্ঠীর সম্পর্ক নিয়ে নানা কালে নানাজনের মতো আমার মর্মে তরঙ্গ তুলেছে তোলে। মার্কসবাদের ছাত্র ও সাধ্যানুযায়ী অনুগামী হওয়ায় হয়তো একটু বেশি ভাবিত করে বিষয়টি -- প্রায় প্রতিক্ষেত্রেই। মহাভারত প্রতিবার পাঠেই ভাবি পঞ্চপাণ্ডবযূথটিকে যতোটা জানলাম ততোটা কি জানলাম প্রতিজন পাণ্ডব কে? কোনো কোনো দৃশ্যে এদের অন্তর্গত ব্যক্তিত্বের ভিন্নতা, তিক্ততা নিজ নিজ অবয়বে এসে দাঁড়ালেও অন্তিমে আবার মিশে গেছে তাদের পাণ্ডবত্বে। সহস্র বাধা সত্ত্বেও যুধিষ্ঠির নিরত হয়নি বার বার জুয়া খেলা থাকে। বিকর্ণসহ আরো অনেকের দ্বিমত সত্ত্বেও কৌরব পক্ষ অন্তিমে যুদ্ধেই নেমেছে। অর্থাৎ কোয়ান্টিটিএখানেও নিয়ন্ত্রণ করেছে কোয়ালিটিকে। ঠিক তত পরিমাণ বাধা অন্য ভ্রাতারা দিতে পারেনি যুধিষ্ঠিরকে যাতে সে বিরত হয় জুয়াখেলা থেকে বা কৌরব পক্ষীয়দের অনেক ব্যক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে থাকলেও তাদের কোয়ান্টিটিছিলনা ততটা যতটা হলে যুদ্ধ হতনা।এই এক উদাহরণ মাত্র। সমস্ত সাহিত্যে, ইতিহাসে, সমাজ বিজ্ঞানে আদতে মানুষের এই ব্যক্তিআর গোষ্ঠীচরিত্রের দ্বন্দ্ব আমাকে আকর্ষিত করে, ভাবিত করে।

বছর চার পাঁচ আগে Allianz Franceh সদস্য হয়েছিলাম আর সেখানেই একদিন উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে চোখে এলো এই পংক্তিগুলিঃ The boundaries of private life are not laid down once and for all; the division of human activity between public and private spheres is subject to change. Private life makes sense only in relation to public life; its history is first of all the history of its definition. ……. On one side of the protective barriers private life coincided more or less exactly with family life.

গ্রন্থটি নিয়ে বসে পড়লাম। গ্রন্থ পাঠ করে তথ্য যা শতকরা ৯৯.৯৯ ভাগই অনর্থক সংগ্রহ আমার গ্রন্থ পাঠের চালিকাশক্তি নয়। চালিকাশক্তি নয় জ্ঞান সংগ্রহ করাও। পড়তে ভালো লাগাই প্রথম শর্ত। দ্বিতীয় শর্ত বিষয়টি। বিষয়টি যদি মর্মকে স্পর্শ করে কোনোভাবে। ... অতএব এই পঙক্তিগুলি আমাকে বিদ্ধ করল। ওলটাতে ওলটাতে দেখি অন্যত্র রয়েছে লিখিত: Private and family life are not the same. Within the family group the individual continues to have a world of his own. But because there are few sources to tell us about individual experience, we …study private life as if it were synonymous with family life.গ্রন্থটি রেন্ট নিয়ে এলাম। কিন্তু পড়তে গিয়ে দেখলাম এটি ঠিক একবারে পড়ে ফেলবারগ্রন্থ নয়। অতএব কিনে রাখলাম গ্রন্থটি। ২০১৭ সালে। তারপর মাঝে মাঝেই উল্টে পাল্টে পড়েছি নানান সময়ে। এইবার বইটি খুলে বসেছিলাম একটি সম্পূর্ণ অন্য অনুষঙ্গে - প্রুস্তের হৃত সময়ের অন্বেষা দ্বিতীয় খণ্ডটি পড়তে পড়তে আবার মনে এল গ্রন্থটির কথা যার পরিচয় এইরূপ:A History of Private Life, Volume V: Riddles of Identity in Modern Times by Antoine Prost (Editor), Gérard Vincent (Editor), Phillippe Ariès (Series Editor), Georges Duby (Series Editor), Arthur Goldhammer (Translator) প্রুস্ত পাঠ করতে করতে গ্রন্থটির কথা মনে পড়বার সচেতন হেতুটি এই যে খণ্ডে রচিত হৃত সময়ের অন্বেষা’ (In Search of Lost Time বা Remembrance of Things Past)-তে প্রুস্তের বহুমাত্রিক চেষ্টার মধ্যে একটি অবশ্যই ব্যক্তি মানুষএর চেতনা-পরিধির বিস্তার-রেখাটির আবিষ্কার। এতদ্‌ভিন্ন A History of Private Life : Riddles of Identity in Modern Times -এর মূল ভূগোল ফরাসি দেশ এবং ফরাসি দেশের সেইসব স্থানেরও উল্লেখ রয়েছে যারা প্রুস্তের রচনাতেও হাজির। ...

আগে খাবলা’ ‘খাবলাপড়েছিলাম তবে এবার গ্রন্থটিতে নিবিষ্ট হলাম অবলীলায়।ইতিহাসবিদ Eric Hobsbawm মানব গোষ্ঠী ইতিহাসকে যে চারভাগে ভাগ করে চারটি অনন্য গ্রন্থ রচনা করেছেন সেগুলি এই:

The Age of Revolution: Europe 1789–1848

The Age of Capital: 1848–1875

The Age of Empire: 1875–1914

The Age of Extremes: The Short Twentieth Century, 1914–1991

আর Riddles of Identity in Modern Times যে কালক্রমকে ছুঁয়ে আছে তা মোটামোটিভাবে The Age of Extremes এরই সমান্তরাল। প্রুস্তের মহা-উপন্যাস ২য় বিশ্বযুদ্ধ অবধি বিস্তারিত হরে পারেনা কেননা ১৯২২ সালেই গত হয়েছেন প্রুস্ত। প্রুস্তের মহা-উপন্যাস Hobsbawm এর The Age of Empire হয়ে The Age of Extremes এর প্রথমাংশ আর Riddles of Identity in Modern Times-এরও প্রথমাংশই ছুঁয়ে থাকে। ... তবে প্রুস্তের মহা-উপন্যাসের গ্রন্থি মোচনে না Hobsbawm , না তো Riddles of Identity in Modern Times কোনো সূত্র দেয়। বরং Hobsbawm এর The Age of Extremes আর Riddles of Identity in Modern Times, পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে, পরিপূরক নানান প্রেক্ষিতে।

 

 

২।

মনেপড়ে তওবা টেক্‌ সিংকে।

মনে আছে তওবা টেক্‌ সিংকে? সাদাত মান্টো সেই তবা টেক্‌ সিং’? কী ছিল তার অন্তর্গত ব্যক্তি পরিসর? ‘তবা টেক সিংনামক স্থান হিন্দুস্থানে নাকি পাকিস্তানে -- এই প্রশ্নটি ভিন্ন ছিল কি কিছু আদৌ? কি ছিল সেই ৪৭সালে পাকিস্তান থেকে হিন্দুস্থানে, হিন্দুস্থান থেকে পাকিস্তানে উদ্বাস্তু হয়ে আসা সংখ্যাতীত ব্যক্তি অন্তর্গত পরিসর ? এই মুহূর্তে, ‘ভারতবর্ষনামক দেশে, এন আর সি- নামে ডিটেনশন ক্যাম্পে পড়েথাকা, মুহুর্মুহু মরতে থাকা ব্যক্তিদের কি অবশিষ্ট আছে কোনো অন্তর্গত পরিসর? আসামের বঙ্গালখেদাআন্দোলনের কথা ভাবি … ‘ব্যক্তি পরিসরের কাহিনি ফিরে যায় গোষ্ঠীর ইতিহাসে: Despite the traditional notion that France welcomes immigrants and has a long tradition of hospitality, all signs are that the bulk of the population was and is xenophobic. Take, for example, the hysterical proclamations of the extreme right in the 1930s and the almost universally accepted equation of unemployed with the number of immigrants. ... এই বা এই সকল equation এর universally accepted হয়ে যাওয়ার মর্মে নিহিত যে xenophobia তাও ব্যক্তির পরিসর থেকে উঠে এসে ক্রমে হয়ে ওঠে গোষ্ঠীর আর তাই কেড়ে নেয় অন্য অন্য ব্যক্তি অন্তর্গত পরিসর। দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে কবি-উচ্চারণের আবডালে এই সকল অন্ধকারই আদতে গিলে খায়, খাচ্ছে, খাবে শুধু ব্যক্তির নয়, গোষ্ঠীরও অন্তর্গত পরিসরকে যেখানে আবাদ হওয়ার কথা ছিল রামপ্রসাদী’ ‘সোনার।

সাদাত মান্টো তবা টেক্‌ সিংহেন যাঁরা চেতনা আর অর্ধচেতনার মধ্য পরিসরে হয় গেলো হারিয়ে , তাঁদের সঙ্গে হারিয়ে গেলো একটি যুগ। এইবার তাকানো যাক তাঁদের দিকে যাঁরা উদ্বাস্তু উল্কি নিয়ে টিকে গেলেন স্থানেকিংবা স্থানেতাঁদের, প্রত্যেকের, ব্যক্তি-পরিসরের দিকে, ব্যক্তি-পরিসরের সন্ধানে। যেহেতু Poverty eliminates differences and makes private life uniform. তাই উদ্বাস্তুউল্কি দাগা ব্যক্তিরা স্থানে-স্থানে নিজেদেরকে দুমড়ে মুচড়ে মানিয়ে নিলেন দশ ফুট বাই দশ ফুট এর পরিসর তথা ব্যক্তি-পরিসরে। অর্থাৎ এঁদেরও থাকল না কোনো ব্যক্তি পরিসর। অদ্যকার ওলা-উবের ক্যাব আর হাজার হাজার হোম্‌ ডেলিভারি এপের চালচিত্রে দাঁড়িয়ে পাঠ করি: In the 1920s and 1930s many workers came to France without their families. Denounced as ‘lawless nomads’ they lived in conditions that made private life impossible. No bed ever went unoccupied in hotels for unmarried workers: while the night shift worked, they day shift slept on just-vacated sheets.

তখন আবারো নিশ্চিত হই যে আদতে পুঁজি ভিত্তিক সভ্যতা স্থপতিরা চায়নি, চায়না তাদের নিজস্ব বৃত্তটির বাইরে আর কারোর থাকুক কোনো পরিসর। আশ্চর্য এই যে ১৯২০-৩০-এ ইতালি বা পোলদের যে অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিল পরদেশ ফ্রান্সে, প্যারিসে, অদ্য ভারতবর্ষীয় আচ্ছে দিন’- এই দেশটিরই রাজ্য আসাম, ত্রিপুরা, মনিপুর,নাগাল্যাণ্ডের বাসিন্দাদেরও উদ্বাস্তুউল্কিটি দৃশ্যাতীত করোটিতে এঁকে নিয়ে এইভাবেই বোম্বে,বেঙ্গালোর,মাদ্রাজ,দিল্লিতে সম্মুখীন হতে হচ্ছে এই সর্বাত্মক পরিসরহীনতার। ব্যক্তিথেকে প্রেতহয়ে যাওয়ার। মনে কি আসেন না জীবনানন্দ: কাছে দূরে কেবলই গ্রাম পতনের শব্দ হয়...” ... আজকের এই সকল পরিসরহীন প্রেতেদের মর্মে উঁকি দিলেও কি আমরা দেখতে পাব না যে কোনোদিনব্যক্তি হয়ে তার স্বভূমিতে প্রত্যাবর্তনের স্বপ্নটিই তার একমাত্র ব্যক্তিগত জীবন’ , ঠিক যেমন এখানে বলেছেন লেখকেরা: It is no exaggeration to say that such dreams were the extent of their private life, their only compensation for the long, tiring hours of work and the bleak conditions in which they lived.

 

 

৩।

এই একটি মাত্রা  গ্রন্থটির যা আমাকে আলোড়িত, আন্দোলিত করেছে সর্বাধিক পুঁজিবাদের এই নিয়তিহয়ে ওঠা -- শুধুমাত্র কলে, কারখানায়,যুদ্ধ মাঠে নয়। ব্যক্তির অন্তর্গত ন্যূনতম পরিসরকেও কেড়ে নেওয়ার এই কাহন শোনা একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে, একটি ভিন্ন দেশের, ভিন্ন সময়ের ইতিহাস থেকে যা আমার দেশের শুধু নয় পৃথিবীর সব দেশেই এতাবৎ প্রাসঙ্গিক এবং যতদিন এই পুঁজিতার লগ্নীর প্রয়োজনে জমে ওঠা অন্তর্গত পুঁজকে বলবে সভ্যতা’ - থেকে যাবে প্রাসঙ্গিক ততদিনই।