“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৯

ছায়া

।। সুপ্রদীপ দত্তরায়।।

(C)Image:ছবি

মস্ত শরীরে একটা অসহ্য যন্ত্রণা, একসাথে অনেকগুলো যন্ত্রে সমস্যা ।ডাক্তারদের নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম । হাসপাতালে বাস্তবিকই এখন পৌষ মাস চলছে। পাশে হাতখানা হাতের উপর রেখে মীরা চুপচাপ । পাশেই বসা কিন্তু অনেক দুরে । দুর বলতে অনেক দুরে, সহস্র যোজন কিংবা তারও বেশি , সে এক অন্য জগত। চাইলেই দুটো মন একসাথে পৌছাতে পারে না সেখানে । কোথাও না কোথাও একটা ফারাক থেকে যায় । এই একটা জায়গাতে সুবীরের বিজ্ঞান এখনো কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারেনি ।
মীরার জন্যে মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয় , জীবনে সুখ জিনিসটা ওর জীবনে প্রসাদের মত কণামাত্রই থেকে গেল । অথচ যে রূপ আর গুণ নিয়ে সে পৃথিবীতে এসেছিল তাতে তার মত মেয়ের রাণীর মত জীবন হওয়ার  কথা । আবারও প্রশ্ন, সব রাণীরা কি সুখী হয় ? সুখ তবে কি?  ভালবাসা বস্তুটি সুবীরের ঠিক মাথায় ঢোকে না, চোখে দেখা যায় না যে। সুবীরের এযাবৎ পড়াশুনাতে ভালবাসা, প্রেম এসবের বৈজ্ঞানিক কোন ব্যাখ্যা নেই। ওসব কবিদের কল্পনাতে সম্ভব । ওদের সাহিত্যে আকাশের সীমা থাকে, মনের থাকে জানালা,  ফাগুনে পলাশে নাকি আগুন লাগে , স্মৃতি নাকি মমি হয় মনের পিরামিডে।  সুবীরের আর ভাবতে ভালো লাগছে না। মাথাটা তে অসহ্য যন্ত্রণা । তবু মীরার জন্য দুঃখ হয়। চুলে তার হেমন্তের ছোঁয়া, চামড়াতে সেই টানটান ভাব আর নেই। তবু তারই মধ্যে এক অদ্ভুত সৌন্দর্য, চোখ ফেরানো যায় না । সুবীরের তাকাতে খুব কষ্ট হচ্ছে । চোখে আলো সহ্য হচ্ছেে না। ঘরের আলোটা কমানো , তবু চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছে । আজকাল সব কিছু ঝাপসা লাগে । মুখ দেখে কাউকে চিনতে পারা যায় না । এই মুহূর্তে সুবীরের মনে হলো একটা ছায়া এসে ঘরে ঢুকছে। কপালে একটা সূক্ষ্ম ভাঁজ দেখা দিয়ে আবারও মিলিয়ে গেছে । না: মনে করতে পারছে না লোকটাকে। ছায়ার কথা মনে আসতেই ছোটবেলার কথাগুলো হঠাৎই মনে হলো । একটা সময়ে সুবীর ছায়াকে খুব ভয় পেত । আশ্চর্যের কিছু ব্যাপার নয়, ওই বয়সে অনেকেই ভয় পেত ছায়াকে। অনেক বয়েস অবধি বাথরুমে একাএকা যেতে ভয় পেত সে । মনে হতো এই বুঝি ওর কিছু একটা হয়ে যাবে । মা বলতেন, " বোকা ছেলে, ছায়াকে বুঝি ভয় করতে হয়?  ওতো তোর বন্ধু । তোকে জন্মের সময়ে যখন প্রথম কোলে তুলে নিই, তখন তোর খেলার সাথী হিসেবে ওকেও আমি তুলে এনেছিলাম । সেই থেকেই তো সে তোর সাথে আছে।
--- " কিন্তু ওতো সবসময়ে আমার সাথে থাকে না মা --।"
--- " কে বললে সে কথা ? ও সবসময়ই তোর সঙ্গে আছে । যখন তুই ঘুমিয়ে থাকিস তখনও সে জেগে থেকে তোকে পাহারা দেয় । আগামী দিনেও দেবে । যতদিন তুই এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকবি ঠিক ততদিন ।"
-- "কিন্তু মা ও যে আমার সাথে একটিবারও কথা বলে না ।"
--" বলবে না, কক্ষনো বলবে না , আমি ওকে বারণ করে দিয়েছি ; কারণ পৃথিবীতে  যত ঝগড়া তার অধিকাংশই জেনে রাখিস কথার ভুল বোঝাবুঝিতে সৃষ্টি ।"
মায়ের কথাগুলোতে কেমন যেন সম্মোহনী থাকে , তর্ক করা যায় না, কিন্তু ---।
সুবীর একবার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল । রাশভারী এই লোকটার অনেক কথাই সুবীর বুঝতে পারে না । দুয়েক বার ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করার পর খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে বলেছিলেন, " ও কিচ্ছু না, ওতে ভয় করার কিছু নেই ।"
-- "কিন্তু বাবা, আমি যে ওকে দেখতে পাই, আমার ভীষণ ভয় হয়। "
উনি পত্রিকাটি ভাঁজ করে কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, " এই যে ছায়া তুমি দেখতে পাচ্ছো, আসলে ওটা তুমিই । 
বাবার কথাগুলো বড় অদ্ভুত, বোঝা যায় না ।
একটু থেমে তিনি আবার  বললেন --- "এ বড় কঠিন বিষয়, এই যে ছায়া তুমি দেখতে পাচ্ছো , সে তুমি আছো বলেই তার অস্তিত্ব । আরো গভীরে গিয়ে যদি দেখতে যাও , তবে বলবো এই ছায়াটাই আসলে তুমি আর যে তুমি আমার সাথে কথা বলছো সে তোমার অহং । যখন তোমার স্বার্থ সিদ্ধি হয়, তোমার অহং তখন পরিতৃপ্তি লাভ করে, তুমি খুশি  হও, আবার যখন তোমার স্বার্থবুদ্ধিতে সংঘাত লাগে তোমার অহং রুষ্ট  হয়, তুমি খুব  কষ্ট পাও। তোমার মন খারাপ হয়। এই যে তুমি ভয় পাচ্ছো, সে তোমার অহং এর নিরাপত্তার অভাব বোধ । যতক্ষণ তোমার মধ্যে তোমার অহং বেঁচে থাকবে ততদিন তোমার মুক্তি নেই। আর তোমার মুক্তি নেই মানেই হচ্ছে তোমার ছায়ার মুক্তি নেই । শাস্ত্র পড়লে সব জানতে পারবে ।"
বাবা প্রাচীনপন্থী সংস্কৃতে পণ্ডিত, বিজ্ঞানের সব যুক্তি মেনে নিতে পারেন না । রাগ করতেন,  বলতেন, " তোদের বিজ্ঞান তো সেদিনকার ছোকরা । শাস্ত্র যদি তোদের জ্ঞান চক্ষু খুলে না দিত, তবে তোদের বিজ্ঞানকে আজও আঁতুড়ঘরে হাত পা ছুঁড়তে হতো।"
বাবা মায়ের কথা মনে আসতেই অনেক অনেক ছবি একে একে ভেসে আসতে লাগলো। সুবীর অনুভব করতে পারছে, ঘরে একটা একটা করে অনেকগুলো ছায়ার ধীরে ধীরে ভিড় জমে গেছে । মুখগুলো খুব চেনা চেনা লাগছে । সুবীরের ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, তবু কেন যেন  চিনতে কষ্ট হচ্ছে না। ভিড় থেকে একটা আটপৌরে শাড়ী পরা মহিলা ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন । এই ছায়াটা সুবীরের খুব পরিচিত । চোখে দুটো অভিমানে ছলছল করে উঠলো । উনি এগিয়ে এলেন । ডান হাতটা আলতো করে সুবীরের কপালে ছোঁয়াতেই মনে হলো , যেন সমস্ত যন্ত্রণা উনি তার হাতের মধ্য দিয়ে শুষে নিচ্ছেন। সুবীর অস্পষ্ট শব্দে বললে, " এতদিনে তোমার সময় হলো মা ? আমার যে ভীষণ কষ্ট ---।" ওনার চোখে অপার শান্তি । যেন সমস্ত কষ্ট মুছে নিতেই উনি এসেছেন। সুবীরের দুচোখে না চাইতেই জলের ফোঁটা । এক পলকের জন্যে মীরার জন্য মনটা কেমন করে উঠলো । ওর অবর্তমানে মীরার কি হবে ?  ওকে যদি সঙ্গে রাখা যেত । সুবীর শরীরের সমস্ত শক্তি ঢেলে দিয়ে মীরার হাতটাকে শক্ত করে ধরার চেষ্টা কবলো।  সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নার্সটা খুব যত্ন করে মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্কটা খুলে নিচ্ছে । এখন যে শরীরে আর কোন কষ্ট নেই। সুবীর নিজের ছায়াটাকে খোঁজার চেষ্টা নিল , কিন্তু নেই। তবে কি - ?   যা হোক হবে,  সুবীর আর ভাবতে চায় না ।........

কোন মন্তব্য নেই: