।। বিদ্যুৎ চক্রবর্তী ।।
সাহিত্যের তৃতীয়
ভুবনে বর্তমানে বাংলা ছোট পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন এর ক্ষেত্রটি যে এক বৃহৎ আকার
ধারণ করেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যেই সাত সাতটি সম্মেলনের উদযাপন তারই
সাক্ষ্য বহন করছে। স্বাভাবিক ভাবেই ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাও পিছিয়ে থাকেনি মোটেও।
ইদানীং স্বল্প সময়ের ব্যবধানে প্রকাশিত হলো আসামের দুই প্রান্তের দুই উল্লেখনীয়
বাংলা ছোট পত্রিকা – ‘উজান’ ও ‘সাগ্নিক’ এর সাম্প্রতিকতম সংখ্যা। উজান আসামের
বাণিজ্যিক শহর তিনসুকিয়া থেকে বেরোল ‘উজান’-এর ১৪তম সংখ্যা আর নিম্ন আসামের বাসুগাঁও থেকে ‘সাগ্নিক’-এর ২৬তম সংখ্যা। একসাথে দুটি সংখ্যা হাতে আসতেই এর একটি তুলনাত্মক
পর্যালোচনার লোভ সংবরণ করা গেল না। উদ্দেশ্য – সমকালীন
আসামের বাংলা ভাষা সাহিত্য চর্চার হাল হকিকৎ জনসমক্ষে প্রতিভাত করা।
পর্যালোচনার জন্য এই দুই পত্রিকাকে বেছে নেওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে
উভয়ের কলেবরগত সাদৃশ্য তথা হালে অনুষ্ঠিত সপ্তম উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় বাংলা ছোট
পত্রিকার গুয়াহাটি সম্মেলনে উভয়ের সদম্ভ উপস্থিতি। পত্রিকা প্রকাশের ধরণ ও বক্তব্য
উভয় ক্ষেত্রেই পত্রিকা গোষ্ঠী তথা সম্পাদকের সামাজিক দায়বদ্ধতা অত্যন্ত স্পষ্ট
ভাবে ফুটে উঠেছে। ‘উজান’ বিষয় ভিত্তিক হলেও ‘সাগ্নিক’ তা নয়। ১২৮ পৃষ্ঠার সাগ্নিকে মোট ৯টি
প্রবন্ধ, ২১টি কবিতা, ১১টি ছোটগল্প তথা
নিয়মিত বিভাগ রয়েছে। বিপরীতে ১৩৬ পৃষ্ঠার উজানে রয়েছে মোট ৮টি বিষয়ভিত্তিক নিবন্ধ,৬টি অন্যান্য নিবন্ধ, ২০টি কবিতা, ৬টি ছোটগল্প, ১টি বড়গল্প ও নিয়মিত বিভাগ।
একটি
পত্রিকা প্রকাশের এই বিশাল কর্মযজ্ঞে সম্পাদকের সার্বিক কর্মকুশলতার এক স্পষ্ট
প্রতিচ্ছবি সহজেই অনুধাবনযোগ্য। ঘটনাচক্রে এই নিবন্ধ লেখক উজান পত্রিকার সঙ্গে
ওতপ্রোত ভাবে জড়িত থাকার ফলে এবং পূর্ববর্তী সংখ্যার সম্পাদক হওয়ার কারণে তা
অত্যন্ত সুজ্ঞাত। উজান পত্রিকায় এক নির্দিষ্ট সম্পাদকমণ্ডলী থাকার ফলে সম্পাদকের
একার মাথায় যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে না কিন্তু সাগ্নিকের ক্ষেত্রে তা
নয়। সাগ্নিকের সম্পাদকের বক্তব্য বা কর্মতৎপরতার ছবি তাই পত্রিকা পঠনের মাধ্যমে
স্পষ্ট প্রতীয়মান।
বিষয় ভিত্তিক হওয়ার ফলে উজানের প্রবন্ধ বিভাগ স্বাভাবিক ভাবেই অধিক
পুষ্ট। ‘মাতৃভাষা মাধ্যমের শিক্ষা’ বিষয়ের উপর একাধিক
তথ্যবহুল নিবন্ধের সমাহার ঘটেছে পত্রিকায়। বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য সঞ্জীব দেব
লস্কর, ধ্রুবজ্যোতি দে, বাণী সেন ও
সুশান্ত করের নিবন্ধ। এঁরা প্রত্যেকেই শিক্ষা বিভাগের সঙ্গে আজীবন জড়িত থাকার ফলে
বিষয়ের উপর যথার্থ আলোকপাত করতে সক্ষম হয়েছেন। এ ছাড়াও দিলীপ কুমার দে তথা অনিল
দাশ পুরকায়স্থের নিবন্ধও উল্লেখযোগ্য। অন্যান্য নিবন্ধে সঙ্গীত সমালোচক অসিত রায়,বর্ষীয়ান সাংস্কৃতিক কর্মী ও উজান সাহিত্য গোষ্ঠীর বর্তমান প্রধান সুজয়
কুমার রায় ও মলয় ঘোষের নিবন্ধ উল্লেখযোগ্য। শনবিল নিয়ে মৃগাঙ্ক পুরকায়স্থের নিবন্ধ
বিশেষভাবে উল্লেখনীয়।
সাগ্নিকের প্রবন্ধ বিভাগ তুলনামূলক ভাবে সংক্ষিপ্ত ও বিক্ষিপ্ত হওয়া
সত্ত্বেও দু’টি নিবন্ধ বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। প্রমোদ নাথের ‘লোকাচার, লোকবিশ্বাস, লৌকিকতা
এবং আদিম আদিবাসী টোটো সম্প্রদায়’ প্রবন্ধটি সমাজ দর্পণের
পরিপ্রেক্ষিতে তথ্যসম্ভারে সমৃদ্ধ এক অতি প্রয়োজনীয় দলিল। প্রবন্ধ বিভাগের যাবতীয়
খামতি সম্পাদক প্রদ্যোৎ গোস্বামী পুষিয়ে দিয়েছেন কড়ায় গণ্ডায় তাঁর এক বিশেষ
নিবন্ধের মাধ্যমে। ‘ইতিহাসের আলোকে অসমিয়া বাঙালি সম্পর্ক’
নিবন্ধটি সার্বিক ভাবে উপস্থাপিত এক অতি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবেই
জায়গা করে নিতে সম্ভব ইতিহাসের পাতায়। তথ্য,বিশ্লেষণ ও
বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে লিখিত সাগ্রহে রাখার মতো এই নিবন্ধটি নিঃসন্দেহে সাগ্নিককে
করে তুলেছে এক অতি আবশ্যকীয় পাঠ্য পত্রিকা। নিবন্ধটির কিছু লাইন উল্লেখ করাটা
এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। “কী এই ডি ভোটার ?
ডি ভোটার মানে হলো ডাউটফুল ভোটার বা সন্দেহজনক নাগরিক। হঠাৎ করেই
ভোটার তালিকাতে কারো নামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে এই ডি। এ রাজ্যের বাঙালি জীবনে
যেন উগ্রপন্থার চেয়েও ভয়ানক হয়ে উঠেছে এই ডি। ডি আসলে এমন এক দৈত্যের নাম যা যেকোনো
সময়ে যে কোন মানুষের ঘাড়ে চেপে বসতে পারে। আর একবার ঘাড়ে চাপলে জীবনকে দুর্বিষহ
করে তুলতে কোন কসুরই সে বাদ রাখে না”। “দেশ মানে এমন এক খণ্ড মৃত্তিকা যা মানুষকে লালন করে, পালন করে পরম মমতায়। আর যখন সেই ভূমিখণ্ড বা ভৌগোলিক পরিসীমার প্রতি
মানুষের মনে মাতৃভাবের উন্মেষ ঘটে তখন সেটা দেশ থেকে রূপান্তরিত হয় স্বদেশে”। “বছরের পর বছর শুধু একে অপরের প্রতি দোষ চাপানোর
এই সাপ লুডো খেলায় এই প্রদেশটার লোকসান বৈ লাভ কিছু হয়নি”।
কবিতায় সাগ্নিক নিঃসন্দেহে টেক্কা দিয়েছে উজানকে। দু’টি
পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছে বর্তমানের কিছু সাড়া জাগানো কবির কবিতা। ২১টি কবিতায়
ঋদ্ধ সাগ্নিকে রয়েছেন বিকাশ সরকার, দেবলীনা সেনগুপ্ত,
চিরশ্রী দেবনাথ, অভিজিত চক্রবর্তীর মতো কবিরা।
নবাগত হিসেবে রীতা চক্রবর্তী,সমীর চক্রবর্তী নজর কেড়েছেন।
অপর দিকে ২০ টি কবিতায় সজ্জিত উজানে রয়েছেন মিলন কান্তি দত্ত, অভিজিত চক্রবর্তী,রামচন্দ্র পাল, শ্রীভদ্রের মতো কবিরা। উদীয়মান কবিদের মধ্যে স্বস্তিসাধন চক্রবর্তী ও রাজা
চক্রবর্তীর নাম উল্লেখযোগ্য।
ছোটগল্পে সংখ্যার বিচারে সাগ্নিক এগিয়ে থাকলেও ধারে ও ভারে উজানই
এগিয়ে। খ্যাতিমান গল্পকারেরও ছড়াছড়ি এখানে। নীলদীপ চক্রবর্তী, মানব
রতন মুখোপাধ্যায়, পদ্মশ্রী মজুমদার, অর্পিতা
বিশ্বাস বর্তমানের চর্চিত গল্পকার। এই প্রতিবেদকেরও রয়েছে একটি গল্প। বিপরীতে
প্রবন্ধ বিভাগেরই মতো গল্প বিভাগের যাবতীয় খামতি থেকে সাগ্নিককে এক যথাযোগ্য
স্থানে উঠিয়ে দিয়েছেন ধীরাজ চক্রবর্তী তাঁর ‘এক গুচ্ছ
অণুগল্প’-এর মাধ্যমে। অসাধারণ মুন্সিয়ানায় উপস্থাপন করেছেন
ছয় ছয়টি অতি উচ্চ মানের অণুগল্প।
উজানের সম্পাদকীয় - সম্পাদকীয় সমিতির পরিবেশনা। এ ক্ষেত্রে সাগ্নিকের
সম্পাদকীয় তুলনামূলক ভাবে বিষয় বৈচিত্র্যে ও ভাষার বাঁধনে অধিক আকর্ষণীয় তথা
মূল্যবান। একটি ছোট পত্রিকার সম্পাদকীয়তেই সেই পত্রিকার একটি সম্যক চিত্র পরিস্ফুট
হয়ে থাকে। সেই বিবেচনায় উভয় পত্রিকাতেই সম্পাদকের ভাবনায় সমকালীন সাহিত্য ভাবনা
স্পষ্ট ভাবেই চিত্রিত হয়েছে।
উজানের ‘উজান’ ও ভাটির 'সাগ্নিক' নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখার প্রয়াসে
চেষ্টার কসুর করেনি কোথাও এবং সেই প্রচেষ্টায় দু’টি পত্রিকাই
একশো ভাগ সফল। সযত্নে রক্ষা করে রাখার মতো যথেষ্ট রসদ মজুত রয়েছে উভয় পত্রিকাতেই।
সাগ্নিকে
বানান ভুলের পরিমাণ খুবই কম কিন্তু বহু জায়গায় ‘ড়’ ও ‘র’-এর পারস্পরিক
স্থানচ্যুতি পঠন বিভ্রান্তি ঘটিয়েছে। সম্পাদকের বিশেষ নিবন্ধও এর থেকে মুক্ত নয়।
উজানের গত সংখ্যায় যেখানে ভুল বানান খুঁজে পেতে ঘাম ঝরাতে হয়েছিল সেখানে এবার
বানান ভুলের আধিক্য খুবই পীড়াদায়ক হয়েছে। মায় প্রচ্ছদেও বানান ভুল খুবই দৃষ্টিকটু
হয়েছে। সম্পাদকীয় সমিতিকে পরবর্তীতে আরোও সজাগ হতে হবে এতে সন্দেহ নেই।
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণে উভয় পত্রিকাই অত্যন্ত আকর্ষণীয়। দু’টি
ছোট পত্রিকার মধ্যে যে পারস্পরিক সম্বন্ধ রয়েছে তা হলো এই যে উভয় ক্ষেত্রেই দুই
পত্রিকা গোষ্ঠী বাংলা সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে ভাষা ও সাহিত্যের পাশাপাশি
সামাজিক এক দায়বদ্ধতা নিরলস ভাবে বজায় রেখে চলেছে। আজকের ঝুঁকিপূর্ণ ও স্রোতের
বিপরীতমুখী সামাজিক পরিবেশেও এই তাগিদ, এই নিরলস ব্রত বাংলা
ভাষা সাহিত্যের রসাস্বাদনে যদি আগ্রহী করে তুলতে পারে একজনও অনুরাগী পাঠককে তবেই
সার্থক হবে এই প্রয়াস। সদিয়া থেকে ধুবড়ি – বলা ভাল তিনসুকিয়া
থেকে বাসুগাঁও – মহাবাহুর প্রবাহিত জলরাশিতে যদি সিঞ্চিত হয়
সাহিত্যের অমৃত রস আর সেই রসে সিক্ত হয় উঠতি প্রজন্ম তবেই সার্থক হবে ‘উজান’ ও ‘সাগ্নিক’-এর পথচলা।
- - - - - - - - - - - - - - -
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন