।। দেবাশিস ভট্টাচার্য, মুম্বাই।।
জনকল্যাণ সংক্রান্ত যে কোনও সরকারি পরিকল্পনাই নির্ভর করে পরিসংখ্যানগত তথ্য এবং তার বিশ্লেষণের ওপর। এর যে কোনও একটি, অথবা উভয়েই, যদি সঠিক না হয় তাহলে সেই পরিকল্পনা যে আশানুরূপ ফলপ্রসূ হবে না, তা বলাই বাহুল্য। করোনা-উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে অতিমারি নিয়ে সরকারি পরিকল্পনার বিষয়ে একই কথা বলা যায়। স্মরণ করা যেতে পারে যে এই অতিমারির চাপে বিশ্বজুড়ে চিকিৎসা পরিসেবা কিভাবে প্রায় ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। তাই ভবিষ্যতে এইধরনের অতিমারির মুকাবিলা করার জন্য সঠিক পরিকল্পনা যে খুব জরুরি সে নিয়ে কোনও দ্বিমত থাকতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন অতিমারি নিয়ে সঠিক তথ্য এবং তথ্যের পর্যালোচনা। তথ্য বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। তবে এরমধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে করোনার কারণে যে মৃত্যু হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান।
করোনাকালে আমরা অনেকেই প্রিয়জন হারিয়েছি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই ডেথ সার্টিফিকেটে হার্ট ফেইলিওর বা অন্যান্য কারণ দেখানো হয়েছে। এখন প্রশ্ন হল করোনা নিগেটিভ হওয়ার পর যদি কোনও ব্যক্তির করোনা সৃষ্ট জটিলতার কারণে মৃত্যু হয় তাহলে মৃত্যুর কারণ করোনা বলা যাবেনা কেন? চিকিৎসা সেবা কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে এরকম একটা যুক্তি দেখানো হয়েছে বলে শোনা যায় যে করোনা নিগেটিভ হবার পর যেহেতু মৃত্যু হয়েছে তাই কারণ হিসেবে করোনা দেখানো হয়নি। কিন্তু এই যুক্তি অনেকেরই ঠিক বোধগম্য হয়নি। এমনকি চিকিৎসক মহলেও নয়। আবার এই অতিমারি যখন শুরু হয়েছিল তখনও কোনও সুস্পষ্ট নীতি না থাকার দরুন মৃত্যু সংখ্যা কম দেখানো হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত টেস্টিং কিট না থাকায় রোগীর মৃত্যুর কারণ নির্ধারণ করা যায়নি। এছাড়াও রাজনৈতিক ইত্যাদি আরও অন্যান্য কারণেও বিশ্বজুড়েই করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা এবং হার কম দেখানো হয়েছে।
এইভাবে করোনা'কে মৃত্যুর কারণ হিসেবে না দেখানোর জন্য একদিকে যেমন হাজার হাজার পরিবার সরকারি অনুদান ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন অন্যদিকে অতিমারি নিয়ে যাঁরা, বিশেষ করে প্রশাসনিক স্তরে, কাজ করছেন তাঁদের এক বিশেষ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কারণ করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা এবং মৃত্যুর হার কম দেখানোর ফলে এই অতিমারির সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। এর চাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ভবিষ্যতে অতিমারি নিয়ন্ত্রণ এবং চিকিৎসা পরিসেবাজনিত নীতিনির্ধারণী পরিকল্পনাও যে ত্রুটিমুক্ত হবে না সেটাই স্বাভাবিক।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নীতিনির্ধারকদের কাছে করোনার প্রভাবে অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যা এবং মরটেলি রেট নির্ধারণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। অতিরিক্ত মৃত্যু হার অতিমারির প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাবের পরিমাণ নির্ধারণ করতে আবশ্যক হয়। অতিরিক্ত মৃত্যু হার হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট স্থানে একটি নির্দিষ্ট সময়কালে মোট আনুমানিক মৃত্যুর সংখ্যা এবং অতিমারির অনুপস্থিতিতে প্রত্যাশিত মৃত্যুর সংখ্যার পার্থক্য। পর্যাপ্ত এবং সঠিক পরিসংখ্যানের অভাবে কাজটা বেশ কঠিন। তথাপি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যান্য কিছু সংগঠন বিভিন্ন ধরনের স্ট্যাটিস্টিক্যাল মডেল ব্যাবহার করে করোনার প্রভাবে অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যা এবং হার বের করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক "দা ইকোনমিস্ট’ এই বিষয়ে কিছু প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ‘নেচার’ ম্যাগাজিনেও এই সমস্যা নিয়ে কিছু আলোচনা বেরিয়েছে।
অতি সম্প্রতি ‘দা লেনসেট’ নামে এক বিখ্যাত সাপ্তাহিক মেডিকেল জার্নালে বিশ্বের ১৯১টি দেশ এবং ২৫২টি রাজ্যে করোনা জনিত মৃত্যুর সংখ্যা এবং মৃত্যুর হার নিয়ে একটি গবেষণামূলক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সময়কাল হচ্ছে ১ জানুয়ারি ২০২০ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২১ । দেখা গেছে এই সময়কালে গোটা বিশ্বে করোনা জনিত মৃত্যুর সংখ্যা যেখানে ৫.৯৪ মিলিয়ন দেখানো হয়েছিল, সেখানে এই প্রতিবেদন অনুযায়ী মৃত্যুর সংখ্যা ছিল প্রায় তিনগুণ, অর্থাৎ ১৮.২ মিলিয়ন। অতিরিক্ত মৃত্যুর হার ছিল, প্রতি এক লাখে, ১২০.৩ জন। তাৎপর্যপূর্ণভাবে বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে ভারতবর্ষেই করোনাজনিত অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যা ছিল সবচাইতে বেশি (৪.০৭ মিলিয়ন), অর্থাৎ প্রকাশিত তথ্যের (৪,৮৯,০০০) চাইতে প্রায় আট গুণ বেশি। এরপর আমেরিকা (১.১৩ মিলিয়ন) এবং রাশিয়া (১.০৭ মিলিয়ন)। অতিরিক্ত মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি ছিল রাশিয়ায় (৩৭৪.৬ জন প্রতি লাখে)।
"লেনসেট" ভারতবর্ষের প্রতিটি রাজ্যের আলাদা করে এই পরিসংখ্যান বের করেছে। আসামে মৃত্যুর সংখ্যা দেখানো হয়েছিল ৬১৬০ জন। অথচ "লেনসেট’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় কুড়ি গুণ বেশি (১,১৯,০০০ জন)। এই অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যা সবচাইতে বেশি মহারাষ্ট্রে (৬,১৬,০০০), যদিও দেখানো হয়েছে ১,৪২,০০০ জন। একইভাবে, আসামে মৃত্যুর হার দেখানো হয়েছিল (প্রতি লাখে) ৯.১ জন, কিন্তু প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৭৬.৬ জন। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে এই ব্যবধান ছিল ১৮.৩ জনের বিপরীতে ১৫২.৫ জন।
এই স্ট্যাটিস্টিক্যাল মডেল নিয়ে মতানৈক্য থাকতেই পারে। আমারও আছে। একটা কারণ হল স্ট্যাটিস্টিক্যাল মডেল কতটুকু সঠিক হবে তা নির্ভর করে সরকার দ্বারা প্রকাশিত তথ্যের উপর। এই তথ্য কতটা ত্রুটিমুক্ত তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ আছে। কিন্তু একটা কথা পরিষ্কার যে গোটা বিশ্বেই নানা কারণে করোনার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাবে মৃত্যুর সংখ্যা এবং মৃত্যুর হার কম দেখানো হয়েছে। বিভিন্ন গবেষণামূলক প্রতিবেদনে এই বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে। এর ফলস্বরূপ এই অতিমারির সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। তাই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা এই অতিমারির কারণে মৃত্যুর সংখ্যা এবং হার নির্ধারণ করা, ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে হলেও, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্যসূত্র : https://www.thelancet.com/journals/lancet/article/PIIS0140-6736(21)02796-3/fulltext
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন