“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ২৬ জুলাই, ২০২১

যে ক'টা দিন পৃথিবীতে ৷৷ চতুর্দশ পর্ব

।। মিফতাহ উদ-দ্বীন ।।

 

(C)Image:ছবি


।। ১৪ ।। 

 

আব্বাকে একটু অস্থির দেখাচ্ছে যেন! কখনো সোফায় বসছেন কখনো বা মশারির পাশে বসে আছেন। কিছু একটা বলবেন মনে হচ্ছে। 

-- আমি মশারির গুণটা খুলে দিচ্ছি দাঁড়ান!

-- না, না ঠিক আছে, আমি বসছি না। চলে যাব...আসলে...

আব্বা এবার একটু পানি খেলেন। আমি নাদিয়ার এভাবে চলে যাওয়াটা থেকেও আসলে বেরিয়ে আসতে পারছি না। আহ বেচারি। কই, একটু সোহাগের আশায় হয়তো কাছে এসেছিল, সেও দিলাম নষ্ট করে। আমি দাড়িয়েই আছি...

-- তুমি বাইরে ছিলে না

আমি হ্যাঁ না কি বলব, কিছুই বুঝতে পারছি না

-- হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি তো বাইরে ছিলে, তা হঠাৎ করে চলে আসলে যে...আচ্ছা, তুমি বাঙালোর ছিলে না

একটা দীর্ঘনিশ্বাসের মাধ্যমে 'বাইরে' নিহিতার্থ টা হৃদয়ঙ্গম করে বললাম..

-- জ্বী, এম্ফ্যাসিস বাঙালোরে ছিলাম 'বছর তারপর চেন্নাইতে উইপ্রো জয়েন করি। 

তাঁর কথা বলার ভঙ্গিতে একটা অস্থিরতার ছাপ দেখে আমি কাবেরী নদীর দুই প্রেমিক যুগলকে একবাক্যে বসিয়ে চাইলাম তাঁর অস্থিরতাকে একটা স্থিতিশীলতায় আনি। 

-- ওহ, তা চলে আসলে...?

জানি না হঠাৎ করে ইন্টার্ভিউয়ের কারণ, আর - জানিনা এর শেষ কবে হবে! মনে মনে কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই বললাম...

-- আব্বা, মা' থেকে দূরে থাকার কোনও অর্থ খুঁজে পাচ্ছিলাম না আসলে। বছরে একবার হপ্তা দশদিনের জন্য এসে তারপর চলে যাওয়াটা কেমন লাগত আমার কাছে, তাছাড়া...

আমি কথা শেষ করার আগেই দেখলাম তিনি একটু স্থিরাবস্থা খুঁজছেন। ভাবলাম, যাক বাঁচা গেলো। এবার আমি দেরি না করেই মশারির সামনের দুই গুন খুলেই আব্বাকে পা তুলে বসতে বলে নিজেও একপাশে বসে গেলাম। আব্বার ঠিক অপরের পাশটায়। তিনি জানু পেতে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন নীচের দিকে তাকিয়ে। আমি গল্পের অপেক্ষায়

 

-- আমি রুরকি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে 'ভেল'- জয়েন করলাম পঁচানব্বুইয়ে। ঠিকঠাকই চলছিল সব। প্রায় চারবছর চাকরি করার পর কেন জানি ভূপালে আর  থাকতে মন চাইল না। আসলে  সুনীল জৈন নামের এক কলিগ বেশ 'মাস থেকেই বলছিল আলিম ভাই, চলেন আর ছাড়ি। এখানে থাকতে আর  ভালো লাগছে না। আমি প্রথম প্রথম কারণ খুঁজে পেতাম না। কী ভালো চাকরি, তাছাড়া সরকারি কোয়ার্টার, ভালো ইন্সেন্টিভস! অথচ সে থাকতে চাইছে না। তাছাড়া সেও তো ভূপালের। রুরকিতে আমরা একই ব্যাচের ছিলাম। তখন থেকেই পরিচয়! একদিন ক্যান্টিনে কারণটা জিজ্ঞেস করতেই কেমন যেন উদাস হয়ে গেল। তারপর যা বলল...

 

এবার আলিম ভাই একটু থামলেন যেন। ওহ, সরি, আব্বা। আমার শ্বশুর! মনে মনে ভাবছি যেভাবে নাটকীয় ভাবে গল্পের শুরু করেছেন রাত 'টায় যে শেষ হয়

 

-- ঈশ ভোপাল নে মেরা বহত কুছ ছিনা হ্যায়

দেখলাম সুনীল সাবের ভুত আব্বার শরীরে মিশে একাকারএবার বোধ হয় পুরো সেশন হিন্দিতেই হবে। আমি একটা অদ্ভুত রকমের পুলক যেন অনুভব করছি সারা শরীরে। নিঝুম রাত, ঝিঁঝিঁ পোকারাও বোধহয় ঘুমিয়ে গেছে, আর  জেগে আছি আমি আর  আমার গল্পকার শ্বশুর! আব্বা হঠাৎ করে হিন্দিটা বলেই যেন একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন, নতুন জামাইয়ের সাথে এমন ডিটেলে ক্যারেক্টারে ঢুকে যাওয়াটা ঠিক হবে না ভেবেই হয়তো বললেন, তাঁর মা ভোপাল গ্যাস ট্রাজেডিতে মারা গেছেন। এর পরপরই তাদের পুরো পরিবার আহমেদাবাদ শিফট হয়ে যায়। কিছুদিন পর তার বাবাও স্ট্রোকে মারা যান। হয়তো স্ত্রী' এই হঠাৎ মৃত্যুটা মেনে নিতে পারেন নি বলেই। কিন্তু ক্যাম্পাস ইন্টার্ভিউয়ে তাঁকে সেই ভূপালেই আসতে হল আবার। 

 

প্রথম দিকে তাঁর ঘটনাটা জানতে পারিনি। কিন্তু পরে যখন এই ঘটনার পেছনে সরকার আর কর্পোরেট সংস্থার ঘাপলা সামনে আসতে থাকে, তখন থেকেই সে আর  থাকতে চাইত না, আর আমাকেও থাকতে দেবে না। অগত্যা রিজাইন দিয়ে নিরানব্বই সালে সেইলের আহমেদাবাদ অফিস জয়েন করলাম দু'জনই। সে তার ঘর থেকে অফিস আসা যাওয়া করত, আর  আমি নাদিম ভাই আর আয়েশা ভাবির ঘরে পেয়িং গেস্ট!

 

আমি গল্প শুনতে শুনতে মনে মনে ভেল আর সেল নিয়ে ভাবছি! আর  ভাবছি এঁদের ফুল ফর্মই বা কীভাবে জিজ্ঞেস করি! শ্বশুর নেটওয়ার্কও নেই যে চুপি চুপি দেখে নেব। 

 

ক্রমশ: 

 

#যেকটাদিনপৃথিবীতে

 

কোন মন্তব্য নেই: