ছোট বেলা দুটো বিষয় আমার খুবই আশ্চর্য লাগতো। দ্বিতীয়টা হচ্ছে, শত শত পিঁপড়ের লাইন ধরে চলা। অবাক করে দিতো ওদের শৃঙ্খলা পরায়ণতা দেখে। তখন কেউ একজন আমাকে একটা আতশ কাচ উপহার দিয়েছিলেন। সেটা দিয়ে খুব ধৈর্য ধরে দেখতাম কেমন করে একটা পিঁপড়ে চলতে চলতে আরেকটা পিঁপড়ের নাকে নাক লাগিয়ে কুশল বিনিময় করছে। তার মাঝে মাঝে কয়েকটা পিঁপড়ে মিলে বড় একটা চিনির দানা বা একটা শুকনো মশলা মাখানো অর্ধেক মটর দানা "জোর লাগাকে হরিসসা" বলে বলে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তারপর সবাই একে একে ছোট্ট একটা মাটির গর্তে বা দেওয়ালের ফাঁকে লুকিয়ে যাচ্ছে। কখনো বাবার এভারেডি টর্চ নিয়ে আসতাম, মাটিতে প্রায় শুয়ে শুয়ে টর্চ জ্বালিয়ে দেখার চেষ্টা করতাম ওরা যাচ্ছে কোথায়। আমার সবচাইতে আকর্ষণীয় লাগতো বর্ষার শুরুতে মাটি ভেজার প্রাকমুহূর্তে সন্ধ্যের সময় গাঢ় বাদামি রঙের 'তেলি' পিঁপড়ের দল যখন মার্চ করে চলতো।
আর প্রথমটা হচ্ছে, সন্ধের পর রাতের আকাশে টিম টিম করে জ্বলে থাকা রাশি রাশি বাতির মেলা। কিছু লাল, কিছু নীল, আর কিছু হলদে, বাকি সব সাদা। কিছু মিট মিট করছে, আর কিছু স্থির। মিট মিট তারাগুলো মনে হতো কথা বলতে চাইছে। যেমন "ওহে বাঁচা, কেমন আছো? এমন করে কি দেখছো? কি জানতে চাও?" সপ্তর্ষি মন্ডলের সাত তারা মিলে এরকম প্রশ্নবোধক চিহ্ন বানিয়ে রেখেছে শুধু আমাকে টিজ করবে বলে। এত্ত বড় আকাশে এরকম একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন কেনো? কালপুরুষ যে কবে থেকে এরকম একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। কোমরের নিচের তরোয়ালটার কি ধার এখনও আছে? না খোলা আকাশের ধুলোবালি আর জ্ঞলীয়বাস্প তাতে জং ধরিয়েছে? আর হাথের ধনুকটা? আকাশ বিস্তৃত এত্তবড় ধনুক কে বানিয়েছে? আর তাতে গুনটা কে জুড়িয়েছে? পুরো রাত মিটি মিটি তারারার দল আকাশের এদিক থেকে ওদিকে পালায়, কিন্তু আবার তারা ফিরে আসে প্রতি সন্ধ্যায়। তার থেকেও বেশি আশ্চর্য্য লাগতো, ভোর বেলার পূবের দিকে দিগন্তের খানিকটা উপরে জ্বল জ্বল করতে থাকা একটা একলা তারাকে দেখে। কিছুক্ষন পরেই সূর্য্য কাকু চলে আসবেন, হারিয়ে যাবে আমার ঝলমলে একলা তারা। তাই এই ক্ষণিকের উপস্থিতি নিয়ে আসা একলা তারার গুরুত্বই ছিল আলাদা। দুর্গো পূজোর সময় ফুল তোলার দায়িত্ব ছিল আমি সহ গ্রামের আরও কিছু কচি-কাচার কাঁধে। ভোরবেলা, পরনে গামছা, খালি গা আর হাতে ফুলের সাঁজি নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। আমার ফুল তোলা শুরু হতো বাড়ির পূর্ব দিকে থাকা পুকুর পাড়ের গাছের ফুল দিয়ে। পুকুরের পরেই আছে বিস্তীর্ণ মাধবপুর হাওর। ওই দিগন্তের উপর ঝলমলে আমার একলা তারা। এদিকে চারিদিকে কাঠ গোলাপের গন্ধ। দৃষ্টি আমার বার বার চলে যায় পুব আকাশের একলা তারায়। উফ কী না দৃশ্য!
আমার কাছে খোলা আকাশ আজও একই রকম। কোনো পরিসীমা নেই! গ্রহ, তারা, উল্কা, নীহারিকার কোনো গুনতি নেই। থাকলেও আমি জানি না। একেকটা গ্রহ, শুধু পাথর, ওতে হাওয়া নেই, বাতাস নেই। আর কিছু গ্রহে শুধুই হাওয়া বাতাস। কিছু তারা জ্বলতে জ্বলতে মরে গিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। আবার কিছু মরে গিয়েও শান্ত হতে পারেনি। অনন্ত এক কালোগুহায় পরিণত, আর আশপাশের সবকিছু গিলে নিতে উদ্যত! আর কিছু তারা তো এখনও নীহারিকা মায়ের গর্ভে। একদিন তারাও পূর্ণ তারা হবে, ওদেরও কিছু গ্রহ-উপগ্রহ নিয়ে ছোট্টো সাজানো পরিবার হবে। এরকমই একদিন আমাদের সূর্য্য কাকার জন্ম, আর আজ আট গ্রহ নিয়ে সাজানো সৌর পরিবার। মাথা তোলে তাকালেই এখনো মনেহয়, ওই আকাশ, ওখানেই তো সৃষ্টির সব রহস্য।
কী যে হাজি বাজি লিখলাম, এসবের কোনো মানে হয়? সারা বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে লক্ষ-কোটি-অক্ষৌহিনী গ্রহ-তারা-কালোগহ্বর থাকলেও ওগুলো নিয়ে বেশী বেশী ভেবে শুধু সময় নষ্ট। শুধু ভাবুন, শনি আর বৃহস্পতি মশাই কোথায় আছেন? আপনার ঘাড়ে, না পশ্চাদে? আর বুধ বাবুকে কে কাবু করতে পারলেই তো কেল্লা ফতে, জেনে নিন যে সুন্দর-ফুট-ফুটে একটা কেউ আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। রাহু-কেতুর যদিওবা নৈসর্গিক (physical) কোনো অস্তিত্ব নেই, তবুও ওরা কিন্তু খুবই দুষ্টূ। মাঝে মাঝে একে তাকে খেয়ে ফেলে আপনার বাড়া ভাতে জল ঢালতে পারে। তাই আমার মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে সৃষ্টি-রহস্য নিয়ে ভাবনা ছাড়ুন, আর তাড়া তাড়ি করে IGNOU বা BHU থেকে জ্যোতিষ বিদ্যায় একটা ডিগ্রি নিন। তাতে আপনার আর পকেটের মঙ্গল। তা না করে বেশিদিন আকাশ পানে চাহিয়া থাকিলে, হা মুখে পঙ্খী নিষ্কাশ বর্ষণের প্রবল সম্ভাবনা!
প্রথম প্রকাশ এখানে: দ্য পাই লাইফ ব্লগ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন