বছর দুয়েক আগের ঘটনা। কোন এক সন্ধ্যায় শহরের ব্যস্ততম এলাকায় সতীশ প্রথমবার স্ট্রিট লাইটের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল লিলিকে। ছিমছাম, সাদা সালোয়ার কামিজ পড়ে একটি মেয়েকে এমন অসময়ে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সতীশের কেমন যেন খটকা লাগল। সে এগিয়ে যাবে মেয়েটির সাথে কথা বলতে, হঠাৎ একটি মারুতি ভ্যান এসে থামল লিলির সামনে এবং সে চটপট উঠে পড়ল তাতে। তিনদিন পর সেই একই জায়গায় একই পরিস্থিতিতে অন্য একটি গাড়ি থামিয়ে অপর একজন বলল 'চল'। লিলি তখন এদিক ওদিক তাকিয়ে মিনিট খানেক সময় নিয়ে ইতস্তত করে উঠে পড়ল গাড়িতে। অদূরে চায়ের দোকানে বসে থাকা সতীশের মনে হল লিলি সম্ভবত বুঝতে পেরেছে যে সে লক্ষ করছে তাকে।
সেদিনই চা দোকানীর কাছ থেকে লিলির যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করল সতীশ। মেয়েটির বাবার যকৃতে ক্যান্সার। ছোট্ট দুটি ভাই বোন, মা আর দিদিমাকে নিয়ে তার সংসার। শহরের বৃহত্তম স্লাম এলাকার একসময়ের সচ্ছল পরিবারের মেয়ে ছিল সে। পাঁচটি পেট পালার দায়িত্ব যখন কাঁধে পড়ল তখন সাহস করে পয়সা উপার্জনের সহজ রাস্তায় নেমে পড়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না তার।
এর কিছুদিন পর সতীশ আবার লিলিকে দেখেছিল মিশন প্রাঙ্গণে। সারদা মায়ের জন্মদিনে বয়সের ভারে ন্যুব্জ বৃদ্ধা দিদিমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল মিশনের এক কোণে। সতীশ এগিয়ে গেল লিলির কাছে এবং টিপ্পনী করল - 'কোন সময় কে কোথায় যে দাঁড়ায় আজকাল বোঝা বড় দায়'। লিলি বুঝতে পেরেছিল সতীশ তাকে উদ্দেশ্য করেই বলছে কথাগুলি। তবুও কোন প্রত্যুত্তর দেয়নি সে। শুধু দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল তার চোখ থেকে। সমাজে তার পেশা নিষিদ্ধ তবু সেদিন লিলিকে অশুদ্ধ বা অশুচি মনে হয়নি সতীশের। বরং সেদিন নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়েছিল তার।
সংবাদ যাই হোক শিরোনামে চমক থাকা চাই। তাই লিলির নামের আগে 'যৌনকর্মী' শব্দটি জুড়ে দিল ব্যবসাসফল পত্রিকার সুচতুর এডিটর। একবারও ভেবে দেখল না যে লিলি যৌনকর্মী হিসেবে নয় দায়িত্ব পালন করেছে সুযোগ্য কন্যার। তাছাড়া খবরের ভিতরের অংশে পরোক্ষে লিলির জীবনের নেগেটিভ দিকই যেন তুলে ধরা হয়েছে বেশি করে। করোনা সংক্রমণের অজুহাতে ছেলেমেয়েরা যেখানে মা-বাবার মৃতদেহ সমঝে নিতে অস্বীকার করছে সেখানে লিলি কোভিড আক্রান্ত পিতার শব একাই শ্মশানে নিয়ে গিয়ে দাহ করেছে, তাকে তো সামান্য সম্মান দেখানো দরকার।
নিষিদ্ধ পেশায় জড়িয়ে থাকলেও যৌনকর্মীদেরও পরিবার থাকে এবং পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালনে ওরা অনেক ব্যতিক্রমী সাহসী - একথা মানুষকে জানাতে হবে। তাই লিলিকে নিয়ে একটা স্টোরি করল সতীশ এবং পাঠিয়ে দিল কয়েকটি দৈনিক কাগজে। কোন কোন কাগজ স্টোরিটি প্রকাশ করে এখন সেটাই দেখার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন