।। ১০।।
(C)Imageঃছবি |
বাদ ফজরের ঘুমের মত মজার জিনিস দুনিয়াতে আর দুইটা নাই। কিন্তু গুণীজনেরা বলেন ফজর বাদের ঘুম মানে পুরো দিনটাকে নষ্ট করা। এ সময়টা বরকতের। আমি ভাবি ঘুমের মত বরকতের জিনিস কি আর দ্বিতীয় আছে! আমি তো তাঁকেই আদর করে সারা গায়ে মাখি। এই সময়ের স্বপ্নগুলো রূপকথাকেও হার মানায়। যেমনটা তোমার কল্পনায়ও আসেনি কোনোদিন, সে রকম চরিত্র, জায়গা আর প্লটের তুমি লিড রোলে। রাজু হিরানি বা সঞ্জয় লীলা ভানসালি কোন ছাই। টং টং বেল বেজেই চলছে। তুমি স্কুল শুরুর বাঁশিতে দৌড়ে গিয়ে ক্লাস ফাইভের সামনে হাঁপাচ্ছ। শুক্লা ম্যাডাম একটুকু ও বুড়ো হননি। শ্যামলা চেহারার শুক্লা ম্যাডামের গালে পালস চকোলেট না কি সুপারি তুমি তাঁর কিছুই জাননা। শুধু দেখছ হালকা লিপ্সটিকে ম্যাম বই হাতে ক্লাসের মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলছেন। সবাই ব্যস্ত সুন্দরবনের ব্যাঘ্র সভা শুনবে। ঐ তো দেবজ্যোতি, অমিত পণ্ডিত, ঋতুরাজ, স্বরূপ দাস, নীলোৎপল, জিয়াউলরা, সবাই বসে আছে। এরা কিন্তু আর আগের বয়সী নয়, সবারই মুখে দাড়ি, গোঁফ এসে গেছে। তুমি গিয়ে বেঞ্চে বসে অবাক দৃষ্টিতে তাঁদের দেখছ আর চেহারার সাথে নাম মেলাচ্ছ।ক্লাস শুরু প্রায় অথচ ঘণ্টিটা এখনো বেজেই চলছে। তুমি কিছুটা বিরক্ত বোধ করছ এখন। কী দরকার এখন আর ঘণ্টি বাজাবার? ক্লাস তো বসেই আছে। হালকা ঝাঁকুনিতে ধড়ফড়িয়ে উঠে দেখলে শুক্লা ম্যাডাম, আর নীলোৎপল জিয়াউলরা আলাদীনের জীনের মত ধোঁয়ার মত মিশে যাচ্ছে, আর সেই ধোঁয়াতেই দেখলে দাড়িয়ে আছে ভেজা চুলে তোমার পরমা সুন্দরী বউ।
-- কেউ যেন ডাকছে বাইরে। গ্রিলের এল ড্রপ দিয়ে সেই কখন থেকে ঢংঢং করছে।
-- হাহ! হুম দেখছি।
চোখ কচলাতে কচলাতে গিয়ে দেখি ফরিদ দাঁড়িয়ে, হাতে টিফিন দু’টো! আমার বিরক্তিটা নিমেষেই কেটে গেল শফির ছেলেটাকে দেখে। “ভেতরে আয়” বলতেই সে টিফিন দু”টো বারান্দায় রেখে দৌড়ে পালাল। আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলাম দৌড়টা। মনে হল এই ছেলেটাই আসলে পঙখীরাজের ঘোড়া। আমাকে তাঁর ঢংঢং শব্দে নিয়ে গেল প্রায় পঁচিশ বছর আগে।
প্রস্তুতি প্রায় শেষ! নাসির চাচা এগারোটা বাজতে না বাজতেই গাড়ি নিয়ে ঘরের সামনে। আমি একটা অদ্ভুত অনুভূতিতে আচ্ছন্ন যেন। ঠিক কেমন সে ভালো করে বুঝতে ও পারছি না। আব্বা, মাকে সালাম দিয়ে বললাম, “মা যাই!” পিত্রালয় থেকে শ্বশুর বাড়িতে ফেরা কালীন মেয়েদের মনের যে অবস্থা, ঠিক তেমনই একটা ভাব আসতে লাগল মনে মনে। “হোয়াটস হ্যাপেনিং উইদ মি”, এমন কেন হচ্ছে! আমার মনের এই অদ্ভুত নাটকীয় অবস্থায় নিজেই বিব্রত বোধ করতে শুরু করলাম যেন। সোজা গিয়েই গাড়ির সামনের সীটে বসে বললাম, “চল, নাসির চা!”
গাড়ি ছাড়ার প্রায় মিনিট দশ হয়ে গেল। আমি নাসির চাচার সাথে লকডাউনকালীন রুজিরোজগারের খবর নিচ্ছি একমনে। হঠাৎ দেখলাম নাদিয়া পেছনের সীটের ড্রাইভারের পাশের কোণায় গিয়ে আমাকে ইশারায় কিছু বলছে। বুঝলাম যে “আমি সামনে কেন, আমার পেছনে বসা উচিৎ!” সেটাই আকার ইংগিতে বুঝাচ্ছে। আমি তখন-ই দুই সিটের মাঝখান দিয়ে পেছনে চলে আসি। এবার সে হাসতে হাসতে খুন। কিছু বলতে পারে না, শুধুই হেসেই যাচ্ছে। তবে সেটা আওয়াজ করে নয়, শরীর দিয়ে হাসছে যেন। পুরো শরীরটা কাঁপছে তাঁর হাসিতে। মুখ টিপে ধরে কিছুক্ষণ পরপরই কেঁপে চলছে। আমি দেখলাম আমি যদি এবার আমার ভুলটাকে রেক্টিফাই করতে পুনরায় আগের যায়গায় চলে যাই, যেমন এসেছিলাম, তবে সে নির্ঘাত মারা যাবে। হাসতে হাসতে মারা যাবে!
নাসির চাচার সাথে কন্টেন্টটাই শ্রেয় মনে করলাম এই বেলা। সে হাসুক।
-- আর বল চাচা!
-- কি আর বলব চাচা? আমরা গরীবরাই মরছি আর মরব। আপনাদের তো চিন্তা নেই, সরকারি চাকরি আছে, ঘরে বসে বসে বেতন গুনছেন। এবার আমি একটু দমে গেলাম যেন। আমার সমস্যা এই যে আমি আর দশটা মানুষের মত নিজেকে ডিফেন্ড করতে পারি না। অন্য কেউ হলে হ্যান ত্যান যুক্তি দিয়ে নাসির চাচা আর তাঁকে এক করে ফেলত। ইন ফ্যাক্ট নাসির চাচা থেকে ও যে সে সকল দিক দিয়ে দুখী সেটা প্রমাণ করে ফেলত। আমার নীরবতায় নাসির চাচা বলে চললেন...
-- গাড়ির ই এম আই ভরব কীভাবে সে চিন্তায় ঘুম হয় না। বন্ধনের কিস্তি ও বাকি পড়ে আছে। ই এম আই অলরেডি পাঁচটা মিস হয়ে গেছে, বলেছে ছ নম্বরটাতে সব একসাথে পরিশোধ না করতে পারলে গাড়ি নিয়ে যাবে। আর বন্ধনের কিসসা তো জানেনই!
আমি ই এম আই আর বন্ধন সব-কটিই দেখলাম এক বিরাট সমস্যা। তাছাড়া বন্ধনটা অপশনাল হলে ও ই এম আইর ব্যাপারটা কোম্পানিগুলো জোর করে চাপিয়ে দেয়। ই এম আই ছাড়া গাড়িই পাওয়া যায় না। মানুষের জীবনে সুদ টাকে কিভাবে ওতপ্রোত ভাবে মিশিয়ে দেয় এই কর্পোরেট সংস্থাগুলো ভাবতেই গা শিউরে উঠল। নাসির চাচা বলে চললেন...
-- সেদিন পুলিশের তাড়া খেয়ে দৌড়ে সড়কের লাগা নতুন কালভার্টে পড়ে শফির কোমর টা-ই যেন ভেঙে গেছে! কালো হয়ে গেছে পুরো কোমর। মানুষ কি নিত্যপ্রয়োজনেও ঘর থেকে বেরুবে না? এ কী শুরু হল চাচা?
আমি ফরিদের সকালের মায়াবী চেহারাটা মনে করে শফির অবস্থাটা আপাতত ভুলতে চাইলাম।
ক্রমশ:
#যেকটাদিনপৃথিবীতে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন