“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ২৯ জুলাই, ২০১৮

মানুষের মন জয় করুন নিজের ব্যবহার দিয়ে


।।জাকারিয়া ইছলাম।।


        প্রত্যেকেই তার কাঙ্ক্ষিত বস্তু লাভের জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করে থাকে। সম্পদের জন্য যে লালায়িত সে তা অর্জনের নিমিত্তে ও সমৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন রকমের কলাকৌশল ব্যবহার করে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের বিভিন্ন পদ্ধতি আবিষ্কার করতে সর্বদা সচেষ্ট থাকে।



(ফটো গুগল ডটকম তেকে)


স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো দর্শকদের মন জয় করার জন্য আধুনিক বিভিন্ন প্রোগ্রাম ও নতুন নতুন অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে থাকে। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ও সঞ্চালকদেরকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় যাতে তারা দর্শকদেরকে আকৃষ্ট করে তাদেরকে অনুষ্ঠান দেখতে আগ্রহী করতে পারেন। একই কথা প্রিন্টমিডিয়া ও বেতারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
অনুরূপভাবে পণ্য বা সেবার উৎপাদকের (প্রোডাক্ট প্রমোটারদের মাধ্যমে) ক্রেতাদের মন জয় করার জন্য কতরকমের পদ্ধতি অবলম্বন করে। যেসব কলাকৌশলের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি করা যায় সেসব কলাকৌশল জানতে এবং সেগুলোকে কাজে লাগাতে সবার মধ্যেই কমবেশি আগ্রহ দেখা যায়।
মানুষের মন বা হুদয় জয় করার অনেক পদ্ধতি ও কলাকৌশল রয়েছে। মনে করেন আপনি একটি সভায় উপস্থিত হলেন। সেখানে প্রায় চল্লিশজন মানুষ রয়েছেন। আপনি তাদের সঙ্গে হাত মেলাতে লাগলেন। প্রথমে একজনকে গুড মর্নিং বলে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। সে কোনরকম হাতের অংশবিশেষ এগিয়ে দিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল 'ধন্যবাদ'। আপনি দ্বিতীয়জনের কাছে গেলেন। সে পাশের একজনের সঙ্গে কথা বলছিল। আপনার গুড মর্নিং শুনে সে হতচকিত কণ্ঠে জবাব দিল এবং আপনার দিকে না তাকিয়েই হাত বাড়িয়ে দিল। তৃতীয়জন তার মোবাইল ফোনে কথা বলছিল। আপনি গুড মর্নিং বলায় সে হাত বাড়িয়ে দিল। কোন রকম হাত মিলিয়ে তবে সৌজন্যস্বরূপ কিছু বলল না, এমন কি আপনার প্রতি কোন আগ্রহ দেখালও না। আর চতুর্থজন আপনাকে আসতে দেখেই গুড মর্নিং বলে দাঁড়িয়ে গেল। চোখে চোখ পড়তেই হাসিমুখে আপনার সঙ্গে কথা বলল। তার হুদয়ের গভীর থেকে আপনার আবেগ প্রকাশ করে আপনার সাথে হাত মেলাল। আপনার সঙ্গে সাক্ষাত করতে পেরে সে বেশ আনন্দিত হয়েছে অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে এটা প্রকাশ করলো। অথচ আপনিও তাকে চেনেন না, আর সেও আপনাকে চেনে না।
এভাবেই আপনি সকলের সাথে গুড মর্নিং বলে হাত মিলিয়ে পরিচয়ের পর্ব শেষ করলেন। এখন বলেন তো, এই চারজন লোকের মধ্যে কার প্রতি আপনার আকর্ষণ সৃষ্টি হবে?
         নিশ্চিত চতুর্থ লোকটির প্রতি আপনি অন্য রকম আকর্ষণবোধ করবেন। অথচ আপনি তাকে চেনেন না। তার নামও জানেন না, সে কোথায় কাজ করে, কী তার পেশা কিছুই জানেন না। তা সত্ত্বেও সে আপনার হুদয়রাজ্য জয় করে ফেলেছে। আর এটা সে কোন টাকা পয়সা কিংবা বড় কোন পদের ক্ষমতার দাপটে করে নি। করে নি বংশমর্যাদার বলে। সে আপনার হুদয়রাজ্য জয় করেছে কেবল কৌশলী আচরণের মাধ্যমে।
এতে প্রতীয়মান হলো, শক্তি, সম্পদ, সৌন্দর্য ও পেশার বড়ত্ব দিয়ে মানুষের হুদয়ে জয় করা যায় না। বস্তুতঃ মানুষের হুদয় এর চেয়েও অনেক সহজে জয় করা যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও খুব কম মানুষ অন্যের হুদয় জয় করতে পারে। আমার মনে আছে, আমি যখন কলেজে পড়তাম তখন আমার সাথে একটা ছেলে পড়ত(সে আমার বন্ধু ছিলো) সে একবার মারাত্মক মানসিক রোগাক্রান্ত ছিল। তার পিতা আমার কলেজের  একজন প্রফেসার ছিলেন। তার বাবার সাথে আমার খুব ভালো রিলেশন ছিলো। আমি অনেক সময় আমার বন্ধুকে সাহায্য করেছি। আমি মাঝে মাঝে তাদের বাড়িতে বেড়াতে যেতাম। তাদের বাড়িটি দেখতে ছিল রাজপ্রসাদের মতো। তার পিতার বৈঠকখানায় সবসময় অতিথিদের এতো ভিড় তাকত যে, সামান্য ফাঁকা জায়গাও থাকত না। তার প্রতি মানুষের এতো ভালবাসা ও আগ্রহ দেখে আমি খুব অবাক হতাম।
অনেক বছর পর। একদিন আমি তাদের বাড়িতে গেলাম। তখন তিনি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন।
আমি তার সে বৈঠকখানায় প্রবেশ করলাম। কামরাটির দিকে তাকালাম। কামরাটির বর্তমান অবস্থা দেখে আমি আশ্চর্য হলাম। সেখানে পঞ্চাশটির অধিক চেয়ার পড়ে আছে। কিন্তু কামরায় কেউ নেই। একজন বুয়া তাকে চা-কফি দিয়ে যাচ্ছে। আমি সেখানে তার সঙ্গে কিছুক্ষণ বসলাম। বের হওয়ার পর ভাবতে লাগলাম, তিনি যখন চাকুরিতে ছিলেন তখন তার কেমন অবস্থা ছিল আর বর্তমানে তার অবস্থা কী? আগে কেন মানুষ তার কাছে আসত? কেন তারা তাকে ভালবাসত? এখন তাকে কেন সেরূপ ভালবাসে না? কেন তার বৈঠকখানায় আগের মতো ভিড় নেই?
আমি বুঝতে পারলাম,  তাই তিনি সদাচরণ এবং অমায়িক ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের হুদয়-রাজ্যকে জয় করতে পারেন নি। মানুষ তারকাছে আসতো তার পদমর্যাদার কারণে, তার চাকরির ক্ষমতা ও প্রভাবের কারণে। ব্যক্তিত্ব ও চারিত্রিক গুণের কারণে নয়। আজ যেহেতু তার চাকরি নেই তাই তার সে ক্ষমতাও নেই। তাই আগের মতো উপচে পড়া সে ভিড়ও নেই।
আপনি মানুষের সাথে এমন ভাবে কথা বলেন, যেন তারা ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে ভালবাসে। তারা যেন আপনার কথা, আপনার হাসি, আপনার বিনম্র আচরণে মুগ্ধ হয়ে আপনাকে ভালবাসে। তারা যেন আপনাকে ভালবাসে। অন্যের দোষ দেখেও তা পাশকেটে যাওয়ার মহৎ গুণের কারণে এবং অন্যের বিপদে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেয়ার মানসিকতার জন্য। তাদের আন্তরিকতা ও ভালবাসা যেন আপনার পদমর্যাদা ও অর্থের কারণে না হয়; বরং তা যেন হয় আপনার প্রতি তাদের হুদয়ের ভালবাসার কারণে। যে ব্যক্তি তার স্ত্রী-সন্তানকে অর্থ-সম্পদ, খাবার-দাবারসহ সব চাহিদা পূরণ করে, সে হয়তো তাদের উদর-তুষ্টি লাভ করতে পারে কিন্তু তাদের হুদয়ের ভালবাসা লাভ করতে পারে না।যে তা সন্তানকে পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ দেয়, কিন্তু তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে, সে তাদেরকে আর্থিকভাবে খুশি করতে পারলেও তাদের মনের রাজ্যে প্রবেশ করতে পারে না।
যদি আপনি দেখেন, বিপদে পড়ে কোন যুবক তার বন্ধু বা তার পরিচিত কোন ব্যক্তির শরণাপন্ন হয়েছে কিন্তু নিজের বাবাকে জানায় নি তাহলে এতে আশ্চর্য হবেন না। কারণ, তার বাবা তার হৃদয়কে জয় করতে পারে নি, ভাঙতে পারেনি তার ও সন্তানের মাঝে বিদ্যমান অদৃশ্য দেয়াল। অথচ তার বন্ধু কিংবা পরিচিত কেও তার হুদয়রাজ্য অবলীলায় জয় করে ফেলেছে। অনেক সময় মারাত্মক দুশমনও হুদয় জয় করে ফেলতে পারে। তবে এর জন্য দরকার হৃদয়কাড়া আচরণগত দক্ষতা আর মানুষ কে আপন করে নেয়ার সুন্দর কৌশল।
আরেকটি বিষয় ভেবে দেখুন। কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে আপনি হয়তো লক্ষ্য করেছেন, তারা যখন কোন সভায়/মিটিঙে উপস্থিত হয়ে বসার জন্য জায়গা খুঁজতে থাকে তখন উপস্থিত লোকদের মাঝে একধরণের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। সবাই তাকে ডাকতে তাকে, সবাই তাকে নিজের পাশে বসতে অনুরোধ করে। বলেন তো এমনটি কেন হয়? কেন তার প্রতি সকলের এতো আগ্রহ! কেন সবাই তার পাশে বসতে চায়? কেউ একজন আপনাকে হয়তো রাত্রের খাবার জন্য ডিনারের ইনভাইট করল কোন এক রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টের নিয়ম হল, প্রত্যেকে নিজ চাহিদা মতো ডিশ থেকে নিজ নিজ প্লেটে খাবার নিয়ে নেবে। তার পর কোন একটা গোল টেবিলে বসে খাবে। সেখানে আপনি হয়তো দেখে থাকবেন যে, কেউ নিজের প্লেট পূর্ণ করার আগেই অনেকে তাকে ইশারা করে বলতে থাকে, ‘এই যে এখানে ফাঁকা জায়গা আছে, এখানে বসুন। প্রত্যেকেই চায় সে তার সঙ্গে বসুক।
কিন্তু ঠিক সেখানে অন্য একজন তার প্লেট পূর্ণ করে এদিকে সেদিকে তাকাচ্ছে অথচ কেউ তাকে ডাকছে না। কেউ তার প্রতি কোন ভ্রূক্ষেপ করছে না। সে একাকী কোন একটি টেবিলে গিয়ে বসে খেয়ে নিচ্ছে।
প্রথমজনের প্রতি মানুষের এতো আগ্রহ, অথচ দ্বিতীয়জনের প্রতি কোন আগ্রহ নেই। এর কারণ কী? কিছু মানুষ এমনও আছেন যে, তারা যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের প্রতি অন্যদের মনের টান অনুভূতি হতে থাকে। যেন তাদের হাতে বিশেষ চুম্বক আছে, যেটি দিয়ে দূর থেকেও তারা অন্যদের হৃদয়-মন আকর্ষণ করে থাকে। এরা কিভাবে অন্যদের হুদয় জয় করলেন? বস্তুত এটা হল বুদ্ধিবৃত্তিক এমন কিছু কলাকৌশল যার মাধ্যমে একজন মানুষ অন্য মানুষের হৃদয়কে জয় করতে পারে। করতে পারে মানুষের ভালবাসা অর্জন।

শেষ কথা
অন্যের হৃদয় জয় করার এবং তাদের ভালবাসা অর্জনের ক্ষমতা আমাদের জীবনকে করতে পারে আরো সুখময়, প্রাণবন্ত ও উপভোগ্য।  



কোন মন্তব্য নেই: