“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

জন্মদাগ

শৈলেন দাস তৃষা আর আমি একই ক্লাস্টারে চাকরি করি। স্কুল আলাদা হলেও দুজনেরই বাড়ি শিলচর হওয়ায় স্কুলে আসা যাওয়ার সময় আমাদের দেখা হয়ে যায় প্রায়ই। অন্নপূর্ণা ঘাটের নতুন সেতু পেরিয়ে স্কুলে যাওয়ার সময় আমি মোটরসাইকেল নিয়ে ওর অটো বা ইরিক্সাকে ওভারটেক করছি, এমন সময় প্রায়ই চোখাচোখি হয় আমাদের। এক্ষেত্রে আমার কোন বিশেষ আগ্রহ বা তৃষার সিক্সথ সেন্স কাজ করে কিনা তা আমি বুঝে উঠতে পারিনা। তবে কেন জানি আমি টের পেয়ে যাই যে আমার সামনের অটোতে তৃষা রয়েছে এবং সম্ভবত তৃষার ক্ষেত্রেও তাই হয় নয়তো এমন সংযোগ ঘটে কি করে! এক ক্লাস্টার মিটিংয়ে তৃষার সাথে আমার প্রথম দেখা হয় সেন্টার স্কুলে। বাম হাতে গোলাপী রঙের ছাতা এবং হালকা নীল রঙের শিপনের শাড়ির সাথে ম্যাচিং করা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে মুখে হাসি হাসি ভাব এনে এগিয়ে আসছিল সে মেইন গেট পেরিয়ে। আমি সবে মাত্র নিজের বাইকটিকে স্ট্যান্ড করেছি। বড় বড় চোখ আর জোড়া ভ্রু সাথে কোমর পর্যন্ত বিন্যস্ত চুলে এত মায়াময় লাগছিল যে আমি পলক ফেলতে পারছিলামনা। পরবর্তীতে বহুবার আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে এবং সহজ বন্ধুত্বের সম্পর্কও গড়ে উঠে এরই মধ্যে। ক্লাস্টার মিটিং বা সহকর্মী কারোর বাড়ির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হলে কথা হতো, হাসি ঠাট্টাও হতো। এইটুকুই, ব্যস। এর বাইরে অন্যকোন ভাবনা কাজ করেনি আমার মধ্যে। তবে কৌতূহল একটা ছিল। তৃষার নাভির বাঁ পাশে কিছুটা দূরে সব সময় একটি রুমাল গুঁজা থাকত অথবা শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে রাখা হত সেখানে। কাউকে জিজ্ঞেস করব সেকথা তেমন সাহস যুগিয়ে উঠতে পারিনি আমি, পাছে সবাই মন্দ ভাবে। সেদিন ছিল একাডেমিক ক্যালেন্ডারের শেষ ক্লাস্টার মিটিং। মিটিংয়ের সময় পরিবর্তন হয়েছে, সি আর সি সি সাহেবের দেওয়া এই বার্তাটি আমি এবং তৃষা দুইজনেই খেয়াল করিনি। তাই পূর্ব নির্ধারিত সময়েই পৌঁছে যাই আমরা। যদিও তৃষা এসেছে মিনিট দশেক পরে। সামান্য কিছু কথাবার্তা হল আমাদের। এর মধ্যে তৃষা কি যেন মনে করে উঠে দাঁড়ালো 'সবাই আসতে যেহেতু বাকি আছে তাই আজকের মিটিং এর বিষয়টি আমি বোর্ডে লিখে নিই।' বলেই একটু হাসল। এই হাসিটা আমার কাছে রহস্যময় মনে হল যেন। বোর্ডের দিকে এগিয়ে যেতেই আমাকে অবাক করে নাভির কাছ থেকে রুমালটি খুলে নিল। টেবিল থেকে চক ডাস্টার নেওয়ার আছিলায় রুমালটি রেখে দিল সেখানে। আশ্চর্য, শাড়ির আঁচলটিও আজ পেছায় নি কোমরে। আমি বিস্ময় নিয়ে যখন সাত পাঁচ ভাবছি তখন আমার সব কৌতূহলের অবসান ঘটিয়ে সে ঘুরে দাঁড়ালো আমার দিকে। শঙ্খের আদলে একখানা হালকা কালো রঙের দাগ উঁকি দিয়ে আছে তৃষার নাভির পাশে। কয়েক কদম এগিয়ে এসে সে অনেকটা নার্ভাস হয়ে বলল 'এটা আমার জন্মদাগ, আমার আত্মীয় বা প্রিয়জন ছাড়া সাধারণত কেউ জানে না এটির কথা। আজ তোমাকে মানে আপনি, আই মিন তুমি জানলে।' তৃষার কথাগুলি আমার মনে যে অনুভূতির সৃষ্টি করেছে তার চেয়েও বেশি মুগ্ধ করেছে ওর চোখের ভাষা। যেন প্রাচীন সরোবরের স্নিগ্ধ ছায়ায় হারিয়ে যাওয়ার আকুল প্রার্থনা। আমি বিষ্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠার আগেই সিআরসিসি সাহেবের গলা 'তোমাদের শেষ?' 'আমাদের শেষ মানে! আমাদের কি শেষ? আমি ততমত খেয়ে প্রশ্ন করতেই উনি হেসে বললেন - তৃষা তোমাকে ভালোবাসে। সেকথা বলার কোন সুযোগ পাচ্ছিল না। তাই আজ ইচ্ছে করেই মিটিং এর সময় পরিবর্তন করেছি তোমাদের না জানিয়ে। লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া তৃষার মুখ থেকে চোখ নামিয়ে আমি কিছু বলতে যাব এমনিই অন্যান্য কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষিকা দরজায় হাজির। তাই প্রসঙ্গ বদল করে নিলাম আমরা। এই ফাঁকে তৃষাও কাউকে বুঝতে না দিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিল সন্তর্পনে। মিটিং এর পর সেদিন আর কোন কথা হয়নি আমাদের। আমি তাড়াতাড়ি মিটিং থেকে বের হয়ে এসেছিলাম। জানিনা তৃষা বা সিআরসিসি সাহেব ব্যাপারটা কিভাবে নিয়েছেন। বাইক চালাতে চালাতে ভাবছি তৃষার কথা আর তার জন্মদাগের কথা। মনের মিলন হলে সামান্য এই জন্মদাগ কোন প্রতিবন্ধকতা হতে পারে না প্রেম পরিণয়ের ক্ষেত্রে। এত রূপ সৌন্দর্য থাকা সত্বেও সম্পর্কের শুরুতে এই বিষয়টিকে আমার নজরে এনেছে মানে এটাকে সে তার দুর্বলতা ভাবে। কিন্তু আমার দুর্বলতা অন্য জায়গায়। সংকীর্ণ সমাজ ব্যবস্থা জন্মের মত যে অদৃশ্য দাগ কেটে রেখেছে আমাদের মধ্যে তা আমি মুছি কি করে? পারিবারিক রক্ষণশীলতার বাইরে গিয়ে তৃষাকে আপন করে নিতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে আমাকে। বর্তমান সময়ে স্বনির্ভর একজন যুবক হিসাবে ইচ্ছে করলে অনায়াসেই এই সামাজিক কুসংস্কারকে আমি তুরি মেরে উড়িয়ে দিতে পারি। কিন্তু ঋতিকা, তাকে আমি এড়াই কি করে? ঋতিকার কথা মনে পড়তেই ভাবনার সাথে সাথে আমার বাইকের গতিও থেমে গেল। কল আসছে মোবাইলে। ফোন কানে লাগাতেই ওপাশ থেকে মা বলছেন 'অনীক, তোর মনে আছে তো আজ ঋতিকাকে দেখতে যাওয়ার কথা? তাড়াতাড়ি আয়, তোর বাবা পঞ্জিকা দেখে শুভ সময় ঠিক করেছেন। দেরী হলে ক্ষ্যাপে যাবেন কিন্তু।' বলেই ফোন কেটে দিলেন। অনেক খোঁজাখুঁজি করে কুষ্টি, গোত্র আরও কি কি মিলার পর সমন্ধ ঠিক হয়েছে আমাদের। আনওফিসিয়ালি দেখাও হয়েছে দুবার। এমন এক সন্ধিক্ষণে কি সিদ্ধান্ত নেব আমি? কে দেবে আমাকে পরামর্শ? আজ আমার প্রচুর মনোবল দরকার। বাইক স্টার্ট দিয়ে ধীরে ধীরে এগুচ্ছি, সামনেই খোলা প্রান্তর। দুধপাতিলের সোনালী শাইল ধান ক্ষেতের উপর হঠাৎ এক খন্ড মেঘের ছায়া দেখে বেশ রোমাঞ্চিত হলাম আমি। এ যেন তৃষার সেই জন্মদাগ। নিজের অজান্তেই মোটরসাইকেলের এক্সিলেটর দাবিয়ে গান ধরলাম - মে আ রাহা হু বাওয়পস। মেরা ইন্তেজার করনা, তুঝে সামনে বিঠাকে তুজসে হি প্যার করনা।

কোন মন্তব্য নেই: