“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ১ মে, ২০২১

অক্সিজেন অক্সিজেন এভরিহোয়্যার, নট আ বাবল টু ব্রিদ!




 

।। পার্থঙ্কর চৌধুরী।।

(C)বার্তালিপি

 



         সামুয়েল টেইলর কোলেরিজের ‘ রাইম অব দ্য এন্সিয়েন্ট মেরিনার’-কবিতার সেই বিখ্যাত লাইনটি মনে আছে তো….. মাঝদরিয়ায় নাবিক হাহাকার করে চেঁচাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘জল, চারদিকে জল, কিন্তু হায়… এক ফোঁটা জল নেই!’  ভারতের প্রাণকেন্দ্রে গত সপ্তাহে জনা পঁচিশেক লোকের মর্মান্তিক মৃত্যু সেই লাইনগুলোর আক্ষরিক অর্থে পুনরাবৃত্তি হচ্ছে!  শুধু জলের বদলে আমাদের বলতে হচ্ছে -  ‘অক্সিজেন, অক্সিজেন এভরিহোয়ার, নট আ বাবল টু ব্রিদ…!’ যদিও প্রাথমিক ভাবে মৃত্যুর জন্য মারণ ভাইরাস-ই দায়ী, তবুও জীবনদায়ী ‘অম্লজান’ পেলে তাঁরা হয়ত: বা শেষ সংগ্রাম আরেকটু হলেও চালিয়ে যেতেন!

হ্যাঁ। ‘অম্লজান’ শব্দটা সেকেলে। ‘নোমেন অব্লিটাম’। মাতৃভাষায় পড়া ছেলেমেয়েদের কাছেও শব্দটা আনকোরা নতুন ঠেকবে! তাহলে আর… ( না…, ওই দুর্মুখানন্দের মন্তব্য অবতারণ করে পত্রিকার জায়গা নষ্ট করার অভিপ্রায় এই মুহূর্তে নেই….., সে না হয় পরে হবে ’খন…!) বরং যে শব্দটা সবার মুখে মুখে চালু, সেটাই বলি, ‘অক্সিজেন’। আজকের দিনে সবচেয়ে মহার্ঘ হয়ে ওঠা সেই অদৃশ্য অথচ অপরিহার্য অক্সিজেন।

এখন মৃত্যুর মিছিল…! প্রত্যেক দিনই নতুন নতুন চেনা-জানা-দের পজিটিভ হওয়া নতুবা ভাইরাসের ছোবলে মৃত্যুর খবর আমাদের সবারই ‘বেঁচে থাকার আশা’-টাকে খাদের মুখে টেনে নিচ্ছে। হচ্ছে বৈ কি? যে শহরে যত বেশি ঘন-বসতি, সেগুলো থেকেই যেন বেশি বেশি  আতঙ্ক আর উদ্বেগের খবরগুলো আসছে ইদানীং! যাবতীয় সব-কিছুর বাইরে এসে, সময়টা সত্যিকার অর্থেই মানুষের পাশে মানুষ দাঁড়ানোর। টুইট- টিপ্পনী করার সময় এটা নয়, মামাবাবু…!

AAP-নারাও মাইরি…! আট আট খানা ‘পি-এস-এ’ প্লান্ট এর বরাদ্দ পেয়ে এখন অব্দি মাত্র এক!  আমাদের মত কর্মচারীদের এক দিনের মাইনে থেকে পাওয়া টাকা দিয়েই তো সেটা করার কথা ছিল! তাহলে? আর শুধুমাত্র কি AAP-নি? যেখানে একটা ‘পি-এস-এ’ প্লান্ট  স্থাপন করতে মাত্র দু সপ্তাহ সময় লাগে, সেখানে গেলো ডিসেম্বরে গোটা দেশে ১৬২ খানা বরাদ্দকৃত  প্লান্ট এর মধ্যে মাত্র তেত্রিশ! যে যাই বলুক না কেন, ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ টা আসবে কি আসবে না… সবাই যেন বিষয়টা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। তাই  সবখানেই এই ‘যদ-ভবিষ্য’ মানসিকতা! এর থেকে বেরিয়ে না আসলে কি করে চলবে? সারা দেশে যে ৫৫১ টা প্ল্যান্ট বসানো চাই।

টেকনোলজি সর্বস্ব আধুনিক জীবনে অক্সিজেনের ব্যবহার সর্বত্র। মহাকাশে রকেট ছাড়ার সময়ও প্রচুর পরিমাণের সিলিন্ডার ওখানে গুঁজে দেওয়া হয়। এছাড়াও কল-কারখানায়, ওয়েল্ডিং ইত্যাদি বিভিন্ন কাজেও রয়েছে প্রচুর পরিমাণ অক্সিজেনের ব্যবহার। হাসপাতালের রোগীদের জন্য এর চাহিদা তো রয়েছেই। তবে যে কথাটা এখানে বলে নেওয়া দরকার, তা হল, কল কারখানায় ব্যবহার করা আর রোগীদের জন্য ব্যবহৃত অক্সিজেন, এ দুটোর বানানোর পদ্ধতি কিন্তু আলাদা।

বলছিলাম, মাটিতে যেখানে আপনি পা রেখেছেন, সেখান থেকে  আকাশের দিকে সোজা লাইন ধরে এগোলে, ৮ থেকে ১০ ( সর্বোচ্চ ১৪.৫) কিলোমিটার জুড়ে যতটুকু জায়গা, সেটা ট্রপোস্ফিয়ার। ট্রপোস্ফিয়ারের পর রয়েছে, স্ট্রেটোস্ফিয়ার, মেসোস্ফিয়ার এবং এর পর থার্মোস্ফিয়ার। এদের অন্তর্বর্তী স্থান গুলোতে রয়েছে স্ট্রেটোপোজ, মেসোপোজ ইত্যাদি, এবং সব উপরে অর্থাৎ থার্মোস্ফিয়ারের মধ্যেই রয়েছে আয়নোস্ফিয়ার। এই সাত-সাতটা স্তরের মধ্যে শুধুমাত্র নিচের ৮-১০ কিলোমিটার, অর্থাৎ আমরা যেখানে রয়েছি, সেটাই অক্সিজেনের একমাত্র ঠিকানা।

স্বল্প পরিসরে যদি কেউ পরীক্ষাগারে অক্সিজেন বানাতে চান, তাহলে সহজ উপায় হল  জলকে তড়িৎ-বিশ্লেষণ (বা Electrolysis) করে। অবশ্য এটা অত্যন্ত ধীর পদ্ধতি এবং ধরুন ৫-৬ ঘণ্টায় সাকুল্যে ৮ থেকে ১০ গ্রাম  বানানো যেতে পারে। ওই যে দুটো আলাদা পদ্ধতির কথা বলছিলাম, তার প্রথমটা, অর্থাৎ কারখানায় ব্যবহৃত অম্লজান হিমশীতল (অর্থাৎ, ক্রায়োজেনিক) পদ্ধতিতে বানানো হয়, এবং রোগীদের নাকে গুঁজে দেওয়ার জন্য PSA ( অর্থাৎ Pressure Swing Adsorption) পদ্ধতিতে এটা বানানো হয়। বায়ুমণ্ডলে তো বেশ কিছু গ্যাস মিলে মিশে রয়েছে। এই প্রেসার সুইং পদ্ধতিতে একটা শোষক (বা adsorbant, জিওলাইট বা এক্টিভেটেড  কার্বন) ব্যবহার করা হয়।  নির্দিষ্ট গ্যাসের আণবিক ধর্ম (molecular characteristics) এবং শোষক পদার্থের প্রতি আকর্ষণের ( affinity for the adsorbent) মাত্রার উপর নির্ভর করেই গ্যাসীয় মিশ্রণ থেকে এক একটা গ্যাসকে আলাদা করা হয়। হাসপাতালে ব্যবহৃত জীবনদায়ী অক্সিজেন বানানোর পদ্ধতি এটাই। বিশুদ্ধতার দিক দিয়ে বলতে হয়, প্রেসার সুইং পদ্ধতিতে বানানো অম্লজান ৯৯শতাংশ খাঁটি, যেখানে ক্রায়োজেনিক পদ্ধতির বিশুদ্ধতার মাত্রা শতকরা ৯০-৯৩ শতাংশ।

 

দেশ-বিদেশের বেশ কিছু কোম্পানি রয়েছে যাদের পেশাই হচ্ছে এই মেশিনগুলো বানানো। ছোট-খাট একটা মেশিনের দাম তেমন আহামরি কিছু নয়। এই ধরুন দিনে ২৪-২৫টা সিলিন্ডার ভর্তি করা যাবে, সেরকম একটা মেশিন প্রায় ৩২-৩৩ লাখ টাকাতেই হয়ে যায়। এ কাজটা দু-সপ্তাহের মধ্যেই করে নেওয়া যায়। আর এর জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা? বেশি থাকলে ভালো, তবে ন্যূনতম একটা দশ বাই দশ কিম্বা বারো বাই বারো কোঠা হলেই চলে। চেষ্টা করলে আজকের দিনে যে কেউ এটাকে ‘স্টার্ট-আপ’ হিসেবে নিতে পারেন। এটাই যেখানে ন্যূনতম চাহিদা, সেখানে ‘AAP-নার’ এত বড় ‘ভুল” কেন হল…? প্রশ্নটা থেকেই যায়…! আদালতে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দিল্লীর পরিধি অঞ্চলের হাজার কিলোমিটার ব্যাসার্ধের এলাকাতে নাকি কোনো ‘প্রেসার সুইং’ প্ল্যান্ট নেই!

 তবে হ্যাঁ, একটা কথা! প্ল্যান্ট যেখানই বসানো হোক না কেন, যে বাতাসটা (অর্থাৎ Raw materials) থেকে অক্সিজেন, বিশেষ করে রোগীদের ব্যবহারের জন্য বানানো হবে, সেটা তো কলুষ-মুক্ত হওয়া চাই। ২০১৪ সালে চালানো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার  গোটা বিশ্বের ১৬৫০ টা শহরের মধ্যে চালানো এক সমীক্ষা মতে রাজধানী দিল্লীর বাতাসের মান নাকি একেবারে নিচুতলায়…!


সচরাচর বাতাসে থাকা মিশ্র গ্যাসের মধ্যে অক্সিজেনের ভাগ ২১%। সেটা আমাজনের ঘন জঙ্গল হোক, কিম্বা কালো-ধোঁওয়ায় ছেয়ে যাওয়া কোন শিল্প-প্রতিষ্ঠানের অঙ্গন হোক। তারতম্য হয় বাতাসে ভেসে থাকা বিভিন্ন ভাসমান দুষক-কণার মাত্রায়। তাই অপেক্ষাকৃত ভালো পরিমণ্ডলে প্ল্যান্ট স্থাপন নিঃসন্দেহে অপেক্ষাকৃত ভালো ফলদায়ী। আর এই ভালো পরিমণ্ডল সৃষ্টি করার উদ্যোগ তো দেশবাসীর উপরই বর্তাচ্ছে। লোকশিক্ষা দুভাবে হয়। এক দেখে; দুই ঠেকে। ইদানীং আমাদের দ্বিতীয় অভিজ্ঞতাটা হয়েছে।

ভাবছিলাম, উত্তর পূর্বের কথা। একটু চেষ্টা করলে সিলিন্ডারের বাইরেও তো ‘ক্লিন-এয়ার’ আমাদের এখানে সহজেই সম্ভব। প্রয়োজন শুধু সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার।  বর্ষার মরশুম তো এসেই গেল… অন্যান্য খালি জায়গায় চারা রোপণের পাশাপাশি এ মরশুমে বড় বড় সড়কের দু মাথায় জীবনদায়ী গাছ তো লাগানো যেতে পারে। আরেকটা কথা। অক্সিজেন সৃষ্টি করতে বটগাছের জুড়ি নেই। যতদিন বাঁচে, ২৪X৭ অক্সিজেন সে দিয়েই যায়। এছাড়া অন্যান্য ফলমূল আর ওষধি গাছ তো রয়েছেই। সে গুলোও তো পশু পাখি ছাড়াও জীবজগতের অন্যান্য প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে সক্ষম।

এ প্রান্তটা সাত বোনের। তাই বলছিলাম, আরও ভালো হয়, পাশাপাশি থাকা দুই রাজ্য (এবং তাদের বন বিভাগ) যদি সীমান্ত এলাকাতে যৌথউদ্যোগে এ কাজটা শুরু করে। এতে করে, গাছ লাগানোর পাশাপাশি ভাতৃত্ববোধের অনন্য নজিরও গড়ে তোলা যেতে পারে। এর জন্য দরকার পাশাপাশি থাকা রাজ্যগুলির সরকারি উদ্যোগ। সবাই মিলে সাত বোনের দেশে এরকম ‘বৃক্ষ-সেতু’ গড়ে তোলতে পারলে অক্সিজেন সংকট (Nature’s Oxygen Crunch) প্রতিরোধ করার পাশাপাশি পাশের রাজ্যের সাথে ‘মনের মিল’ স্থাপনের জন্য এর থেকে আর ভালো পথ হতে পারে না…!

তৃতীয় ঢেউ আসার আগেও যে হাতে আর খুব একটা সময় নেই…!  

 

কোন মন্তব্য নেই: