এই তো সেদিন। মানে কুড়ি ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭। অর্থাৎ রাজ্যটার বয়স সবেমাত্র ৩৪ বছর। অবশ্যি তার আগে আরো ষোল বছর (১৯৭২-১৯৮৭র ১৯ ফেব্রুয়ারি) সে কেন্দ্র শাসিত ছিল। এরও আগে? স্বাধীনতার পর থেকে ’৭১ সাল অব্দি তো এই লুসাই পাহাড় ছিল তো আসাম রাজ্যেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যদিও যাতায়াতের জন্য সমতলের বাসিন্দাদের বিশেষ পাস দরকার হত। সে আরেক কথা। ‘বেঙ্গল রেগুলেশন’। সেটা না হয় পরে বলছি। কিন্তু এক্ষুনি যেটা বলতে চাইছিলাম, তা হলো, প্রাণী এবং উদ্ভিদদের বংশবিস্তার সাধারণত: দুভাবে হয়। অযৌন এবং যৌন প্রক্রিয়া। (ইংরেজিতে Asexual এবং Sexual)। অ্যামিবা জাতীয় নিচুবর্গের প্রাণীদের দেহ Asexual বা অযৌন প্রক্রিয়াতে (Binary fission) দ্বিখণ্ডিত হয়ে এক থেকে দুই, দুই থেকে চারটি অ্যামিবা সৃষ্টি হয়। তাহলে, মোদ্দা কথা এটাই যে, ওই চারটি দেহে যে জিন-ক্রমোজম রয়েছে, সবই একই দেহ থেকে সৃষ্ট। মেঘালয় বলুন, কিম্বা নাগাল্যাণ্ড, মনিপুর বলুন কিম্বা অরুণাচল প্রদেশ - একই দেহ থেকে সৃষ্ট ভায়েরা নিজেদের মধ্যে এত লাঠা-লাঠিতে ব্যস্ত কেন? ইতর প্রাণীদের মধ্যেও যে এমন ঘটনা বিরল!
বলতে চাইছিলাম, যে পাহাড়টাকে স্থানীয়রা ‘রেংটি-পাহাড়’ বলে চেনেন, তার পোশাকি নাম, ‘ইনার লাইন রিসার্ভ ফরেস্ট’ ( Inner Line Reserve Forest, বা সংক্ষেপে ILRF)। ১৯৮৩ সালের বেঙ্গল ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রেগুলেশন আইনমতে ১৮৭৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন আসামের কাছাড় জেলার দক্ষিণপ্রান্তের ভূখণ্ডকে এই ‘ইনার লাইন’ ঘোষণা করা হয়। যদিও এরও প্রায় দুবছর পর, অর্থাৎ ১৮৭৬-৭৭ সালে গেজেট নোটিফিকেশনের মধ্য দিয়ে ওই পাহাড়ের কেন্দ্রস্থ স্থানের ৩৩৯ বর্গ মাইল এলাকাকে রিসার্ভ ফরেস্টের আওতায় আনা হয়, এবং পরিধি অঞ্চলের আরও ৪৮৯ বর্গ মাইল এলাকা ‘আন-রিসার্ভড’ রাখা হয়েছিল। (In 1876 a total area of 825 square miles was set apart as Unreserved Forest, of which 336 square miles are within, and 489 without, 'the Inner Line'. – হান্টার, ১৮৭৯ )। এ তো গেলো তখনকার কথা। সেদিনের তুলনায় আজকের দিনের এই ইনার লাইন রিসার্ভ ফরেস্ট প্রায় ৬.১৬ মাইল (বা প্রায় ১০ বর্গ কিলোমিটার) কমেছে, এবং ৮১৮.৮৪ বর্গ মাইল (অর্থাৎ ১৩১৭.৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বর্তমানের রেংটি পাহাড়।
পাশের দেওয়া ছবি থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এই
বিশাল এলাকা জুড়ে যে রিসার্ভ ফরেস্টটি বিস্তৃত, বর্তমান ভৌগোলিক মানচিত্র অনুযায়ী তার পরিধি এলাকার সীমানা
আনুমানিক ৪০ শতাংশ
আসামের (কাছাড় এবং হাইলাকান্দি জেলার) সঙ্গে জুড়ে রয়েছে, বাকি আরও আনুমানিক ৪০ শতাংশ মিজোরামের সাথে এবং পরিধি অঞ্চলের বাকি ২০
শতাংশ রয়েছে পাশের
রাজ্য মনিপুরের সাথে।
ফরেস্ট
বিভাগের অনুমতি ক্রমে এবং গবেষণার স্বার্থে গত দেড় কিম্বা দুই দশক ধরে আমাদের ছেলেরা
প্রায়ই এই ইনার লাইন
অঞ্চলে যেতে হচ্ছে। তুলনামূলক ভাবে সহজ গন্তব্য স্থল গুলো হচ্ছে, বালিচুরি, একারথল, নাগাথল,
নক্সাটিল্লা, লোহারবন্দ। আরও দক্ষিণে এগিয়ে গেলে শেওড়াথল, হাডাম্মাবস্তি, পানছড়া
ইত্যাদি গ্রাম। অঞ্চলগুলোতে প্রবেশ করলে ‘অরণ্যের
রোদন’ প্রায়ই চোখে পড়ে।
যত্ন-আত্তির সেরকম ভাবে করা হচ্ছে না ঠিকই, তবুও
এই রিসার্ভ ফরেস্টের বিভিন্ন জায়গা বেশ কিছু মূল্যবান গাছ এবং দুর্লভ প্রজাতির
প্রাণীর এখনও আবাসস্থল। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের সদর্থক ভূমিকার ফলে ইনার
লাইনের আসামের (অর্থাৎ কাছাড় ও হাইলাকান্দি জেলার) আওতায় থাকা স্থান গুলোতে জীববৈচিত্র্য নিয়ে
কম বেশি গবেষণা
তথা সংরক্ষণের কাজ চলছে যদিও, কিন্তু
পার্শ্ববর্তী মিজোরাম রাজ্যে একই ধরনের প্রতিষ্ঠান থাকা সত্বেও, রেংটি পাহাড় নিয়ে সেরকম কোনও কাজ প্রকাশিত গবেষণাপত্রে চোখে পড়ে নি!
মিজোরাম অধ্যুষিত ইনার লাইনের ৪০ শতাংশ অঞ্চলে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে প্রাধান্য
পেয়েছে, এরকম কোন গবেষণার খবর নিশ্চয়ই
সংরক্ষণবাদীদের কাছে সুখকর হবে। আসলে ‘রেংটি-পাহাড়’
বলুন কিম্বা ‘ইনার লাইন রিসার্ভ ফরেস্ট’, এই বিশাল পাহাড়ি এলাকা এবং এর মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিচিত্র
সব মূল্যবান উদ্ভিদ এবং প্রাণীকুলের সঠিক সংরক্ষণের জন্য তিন তিনটি রাজ্যও সরকারের ( আসাম,
মিজোরাম এবং মনিপুর) সদর্থক ভূমিকা পালনের জন্য যৌথ
আলোচনা টেবিলে বসা প্রয়োজন। বিপুল জীববৈচিত্রে ভরপুর এই পাহাড় নির্দ্বিধায় একটি জাতীয় উদ্যান,
নিদেনপক্ষে একটা অভয়ারণ্যের দাবী রাখতেই পারে। এ তো
গেল ইতিবাচক দিক। সম্ভাবনার কথা। এ যাবত ঘটে যাওয়া যাবতীয় সমস্যার 'পেনাসিয়া'।
(বলাবাহুল্য, কেন্দ্রের উদ্যোগেই
জাতীয় উদ্যান কোথাও
স্থাপন করা যেতে পারে।)
এর
উল্টোদিকে, অর্থাৎ, নেতিবাচক দিকগুলো হচ্ছে, সাম্প্রতিক অতীতেই অর্থাৎ এই করোনা-কালীন সময়েই আমরা পত্র-পত্রিকায় দেখতে
পেয়েছি, শিলচর- আইজল সড়কের
আসাম প্রান্তের প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাতে মিজোরা চেক-গেট বসিয়ে দিয়েছিল। কলাশিব জেলার
লোকেদের সঙ্গে
আসামের কাছাড় জেলার প্রান্তীয় গ্রামের বাসিন্দাদের সংঘর্ষ এখন প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা! এ
ছাড়াও দক্ষিণ করিমগঞ্জ জেলার লোকেদের সাথে মিজোরামের লোকেদের সংঘর্ষ প্রায়ই খবরে বেরোয়।
একদিকে আসামের জমি মিজো অধিগ্রহণের অভিযোগ তো রয়েছেই। মিজোদের পাল্টা অভিযোগ, আসাম প্রান্তে থাকা অবৈধ বাংলাদেশিরা এ সমস্ত
ঝামেলা পাকাচ্ছে। আসলে এই সমস্ত অভিযোগ- পাল্টা অভিযোগের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করতে
গেলে ব্রিটিশ জমানায় ফিরে যেতে হবে… যখন
সাহেবরা তাদের প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ‘ইনার
লাইন’ নামক বিভাজন রেখা টেনে দিয়েছিল। কিন্তু
বিসমিল্লায় গলদ-টা সেই থেকেই থেকে গেছে। স্বাধীন ভারতে রাজ্যগুলো পৃথকীকরণের সময়
আন্তঃরাজ্য সীমানার এই বিভাজন রেখাগুলো সুস্পষ্টভাবে টেনে দেওয়া হয়নি বলেই
আজকের দিনে অশান্তির এই বাতাবরণ। সীমানা নির্ধারণ প্রসঙ্গে উত্তর পূর্বের প্রায়
প্রত্যেক রাজ্যেরই এক একটা স্বতন্ত্র ধারনা, এবং
এই বদ্ধমূল ধারনাই আন্তঃরাজ্য সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু।
আপাতত: যদিও আসাম এবং
মিজোরাম, এই দুই রাজ্য সরকারের
মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা অনুযায়ী সীমান্ত ঘেঁষা এলাকাতে স্থিতাবস্থা অর্থাৎ ‘স্টেটাস-কুও’ বজায় রাখার কথা, কিন্তু
বাস্তবে যদি দুপক্ষই তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করত, তবে তো আর উটকো খবরগুলো পত্র-পত্রিকায় ইদানীং বেরুত না!
হ্যাঁ, শুরুতেই বলেছি, বেঙ্গল রেগুলেশন’ প্রসঙ্গটা নিয়ে পরে বলব। বলতে চাইছিলাম, আসাম মিজোরাম সীমানা বিবাদের পেছনে রয়েছে দুটো নোটিফিকেশন। প্রথমটা
১৮৭৫ সালের - যা
দিয়ে লুসাই পাহাড়কে কাছাড়ের সমতল থেকে আলাদা করা হয়েছিল, এবং দ্বিতীয়টা ১৯৩৩ সালের, যা
দিয়ে এই একই পাহাড়কে মনিপুর থেকে আলাদা করা হয়েছিল। মিজোরাম বিশ্বাস করে যে আসাম মিজোরাম
সীমানা ১৮৭৩ সালের ‘বেঙ্গল ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রেগুলেশন’
(BEFR Act) (যার নোটিফিকেশন ১৮৭৫ সালে বেরিয়েছিল) মোতাবেক হওয়া উচিত। মিজোদের
দ্বিতীয় অভিযোগ, ১৯৩৩ সালের মনিপুর
থেকে ওই লুসাই
পাহাড়-কে আলাদা করার সময় মিজো সমাজের লোকদের মতামত নেওয়া হয় নি!
এবার তাহলে দেখা যাক এ
ব্যাপারে ‘বেঙ্গল ইস্টার্ন
ফ্রন্টিয়ার রেগুলেশন’-এর বক্তব্য কি? ১৮৭৩ সালের এই BEFR Regulation
(Regulation 5 of 1873)-এ উল্লেখ রয়েছে যে,সেটা প্রযোজ্য হবে তৎকালীন কামরূপ,
দরং, নগাঁও, শিবসাগর,
গারো পাহাড় অধ্যুষিত গোয়ালপাড়া জেলা,
খাসি ও জয়ন্তিয়া পাহাড়, নাগা পাহাড় এবং সেই সময়ের কাছাড় জেলাতে। এই আইনের ব্যাপ্তি
প্রসঙ্গে পরের পাতায় আরও বলা আছে যে ‘শিডিউল্ড
ডিসট্রিক্ট এক্ট, ১৮৭৪’ ( XIV of
1874, Section- 5) প্রযোজ্য হবে
গোয়ালপাড়া জেলার পূর্বপ্রান্ত (ইস্টার্ন ডুয়ার্স), নাগা পাহাড়ের মোককচাং, সদিয়া,
বালিপাড়া এবং লখিমপুর ফ্রন্টলাইন এলাকা
এবং কাছাড় জেলার
লুসাই পাহাড় এলাকা গুলোতে। ওখানে আরও বলা রয়েছে, It shall be Lawful for
the state Government to prescribe, and from time to time alter by notification
in the official Gazette, a line to be called ‘The Inner Line’ in each of the
above named district… অর্থাৎ সরকার ( মানে,
অবিভক্ত রাজ্য সরকার) সময় সময়ে এই ইনার লাইন
সীমানার সংশোধন অথবা সংবর্ধন করতে পারতেন। ইনার লাইন এলাকাতে সমতলের বাসিন্দাদের অনধিকার প্রবেশ
সম্পর্কে বলা আছে,
‘Any one…. if goes beyond such line without a pass, shall be liable, on
conviction before a magistrate to imprisonment…. Which may extend to one year,
to a fine not exceeding one thousand rupees or both…. অর্থাৎ সে ব্রিটিশ হোক বা ভারতীয়, অবৈধ প্রবেশকারীদের এক বছরের জেল এবং/ অথবা ১০০০ টাকা (১৮৭৩ সালের মূল্যমানে)
জরিমানা হতে পারত। নিঃসন্দেহে উপজাতি এলাকার লোকেদের স্বতন্ত্র যে জীবন প্রণালী, তা বাইরের লোকেদের
সংমিশ্রণে যাতে শঙ্করায়িত না হয়,
তাই তেমন এক খানা আইন। এতটুকু তো ঠিকই আছে।
কিন্তু,
সমস্যা হল ওই রেগুলেশনে বর্ণিত ‘State’
অর্থাৎ রাজ্যের সংজ্ঞায় ! ১৮৭৩ সালের আসাম রাজ্য,(মাদার-অ্যামিবা) যা থেকে গত দেড়শ বছরে অনেক গুলো রাজ্য
ছিটকে বেরিয়ে গেছে…, সেটাকে জোড়া দেওয়ার
মতো কোনো ‘রাজনৈতিক রসায়ন’,
অথবা ‘কুইক-ফিক্স’ পাওয়া
কি সম্ভব?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন