।।শৈলেন দাস।।
মালিনী বিল শিলচর শহর সংলগ্ন এক সুপরিচিত স্লাম।
শ্রমজীবী প্রান্তিক মানুষের বাসভূমি এই এলাকা আশির দশক পর্যন্ত ছিল এক পরিত্যক্ত
জলাভূমি। তখন শহুরে বাবুদের কাছে এখানকার জমির কোন মূল্য ছিলনা বরং জঙ্গলময় খালি
জায়গা হওয়ায় পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষ তটস্থ থাকত এই ভয়ে যে কখন জঙ্গল
পেরিয়ে চোর ডাকাত এসে পড়ে তাদের ঘরে ।
বিশ্বায়নের ছোঁয়া লেগে শহর শিলচরের শরীর যখন ক্রমশ:
বেড়ে উঠছিল তখন ক্রমবর্ধমান শ্রমিকের চাহিদা পূরণ করতে গ্রাম বরাকের শ্রমজীবী
মানুষ ধীরে ধীরে শহরমুখী হতে শুরু করে। এরই অঙ্গ হিসাবে কিছু সংখ্যক মানুষ বসতি
স্থাপন করতে শুরু করে মালিনীবিলে। এছাড়াও শহরের আশপাশের অন্যান্য স্লাম এলাকা
থেকে অনেক মানুষ আসে যারা মূলত ছিল ওই সব এলাকার ভাড়াটিয়া।
মালিনী বিলের অধিকাংশ মানুষই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী
কৈবর্ত এবং বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত। এখানে বসতি স্থাপন করতে এসে এই মানুষগুলো
প্রথমে লড়াই শুরু করে প্রকৃতির সাথে। জলাভূমির উপর বাঁশের চালা বানিয়ে তার উপর
ঘর বেঁধে বসবাস। নেই কোন পথ ঘাট, পানীয় জল। তার উপর বর্ষায়
প্রায়ই বাঁশ বেতের তৈরি ঘরগুলি ভেঙ্গে পড়ত বান
তুফানে। তাদের দ্বিতীয় লড়াই ছিল পার্শ্ববর্তী একাংশ পুরনো মানুষের সাথে। মিথ্যা
অপবাদ দেওয়া এবং সুযোগ পেলেই নানা অজুহাতে তাদের হেনস্থা করতে দ্বিধাবোধ করত না
তারা।
জীবন ও জীবীকার তাগিদে পরিত্যক্ত জলাভূমিতে বিবিধ
প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে কোনোমতে টিকে থাকতে থাকতে মালীনিবিলের
বাসিন্দারা ধীরে ধীরে নিজস্ব পরিচিতি লাভ করতে শুরু করে। মজবুত হতে থাকে তাদের
আর্থ-সামাজিক অবস্থান। সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও কেউ কেউ সুনাম অর্জন
করতে থাকে নিজেদের অধ্যবসায় এবং কর্মের মাধ্যমে। কিন্তু শহর সংলগ্ন এলাকায় থেকে
শহুরে পরিবেশে বসবাস করেও সামগ্রিকভাবে মালীনিবিলবাসীরা আশানুরূপ উন্নতি করতে
পারেনি। বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে হাতে গুনা কয়েকজনই সামান্য সফল হয়েছে।
মালিনী বিলের বাসিন্দাদের সম্পর্কে শুরুর দিকে কিছু
মানুষ যে ভ্রান্ত ধারণা এবং বিরূপ মনোভাব পোষণ করত তা বর্তমানে কিছুটা কমেছে এবং
তা সম্ভব হয়েছে এখানকার মানুষের সারল্য এবং সততার কারণে। নিজেদের কর্ম গুণ দিনে
দিনে বিকশিত করে বৃহত্তর সমাজকে উন্নত পরিষেবা দিয়ে চলেছে তারা সততার সাথে। ফলে
ধীরে ধীরে অনেকের আস্থাভাজন প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছে তারা। তবুও একাংশ মানুষ এখনও
এমন রয়েছে যাদের কাছে মালিনীবিলের মানুষ মানেই সব দোষের দোষী।
যে জলাভূমির জলকাদা পায়ে লাগলে এক সময় ভদ্রলোকেরা
নিজেদের অশুচি মনে করত, ঘৃণা করত এখানকার মাছ, ফসল এবং মাটিকে। ব্রাত্যজনের যত্নআত্তি এবং প্রাণের স্পর্শে তা আজ হয়ে
উঠেছে যেন সোনা তুল্য। যে কেউ মনে এই অভিলাষ পোষণ করে, যদি
একটুকরো জমির দখল পাওয়া যেত! কিন্তু পাবে কি করে? এখানে তো
শ্রমজীবীদের বাস। তাই সময়ে সময়ে ব্লুপ্রিন্ট তৈরি হয়েছে উচ্ছেদের। চোর ডাকাত
অপবাদ দিয়ে মারা হয়েছে এখানকার নিরীহদের। মালিনী বিলের বাসিন্দাদের জমির পাট্টা
দেওয়ার জন্য সরকারি প্রক্রিয়া অনেকদূর এগিয়েও বাতিল হয়ে গিয়েছে কোন অদৃশ্য
হাতের কারসাজিতে।
যেখানে শিক্ষার হার কম এবং নাগরিক সুবিধা অপ্রতুল
সেখানে সামান্য উচ্ছৃঙ্খলতা এবং অসামাজিকতা খুব একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। তবুও
মালিনী বিলের মানুষ বৃহত্তর সমাজের সাথে মেলামেশা করা এবং মত বিনিময়ের
ক্ষেত্রে যথেষ্ট সংযমী। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় এই এলাকা এবং এখানকার মানুষের খারাপ
দিকগুলো তুলে ধরার জন্য গণমাধ্যমগুলোর ঔৎসক্য এবং তৎপরতা অতিমাত্রিক, একাংশ বুদ্ধিজীবী সুযোগ পেলেই তাদের উপর অপবাদের দায় চাপিয়ে দেওয়ার
মানসিকতা পোষণ করে। তাদের ঘরে বিনা নোটিশে রাতের আঁধারে পুলিশ ঢুকে যেতে পারে। এত
সবের পরও এখানকার সহজ সরল মানুষ এই স্বপ্নে বিভোর যে একদিন ঠিকই যাবতীয় অপবাদ ঘুচে সত্য এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন