বাঙালি আর সমস্যা প্রায় হরিহর আত্মা। সমস্যা যেমন বাঙালির পিছু ছাড়ে না, বাঙালিও তেমনি সমস্যা না থাকলে যেন হাঁপিয়ে পড়ে। এটা গুণ কিংবা দোষ, সে বিচার আপাতত নাহয় মুলতুবি থাক। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাঙালির এমনিতেই সমস্যার অন্ত নেই, নতুন করে আরেকটা সমস্যা খাঁড়া না করাই মঙ্গল। দেশ বিভাগের ছয় দশক অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, অথচ শেকড় ছড়িয়ে থিতু হতে পারে তেমন স্বভূমির সন্ধান বাঙালির বরাতে আজো জুটল না। ত্রিপুরায় যারা বসবাস করছেন তাদের অবস্থা মোটামুটি স্থিতিশীল বলা যায়। উত্তরপূবের অন্যান্য প্রদেশে বসবাস করা বাঙালিরা আজো ‘বহিরাগত’ পরিচয় নিয়েই কোনক্রমে জীবন অতিবাহিত করে চলেছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে সঙ্গীন অবস্থা অসমের বাঙালির। আরো স্পষ্ট করে বললে মূলত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালির অস্তিত্বের সংকট সবচেয়ে গভীর এবং তীব্র। বরাক উপত্যকার বাঙালিরা ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে খানিকটা সুবিধেজনক অবস্থায় রয়েছেন এবং কেবল মাত্র ভাষা-কেন্দ্রিক আন্দোলনের চৌহদ্দিতেই নিরাপত্তার চাবিকাঠি মিলবে এরকম এক ‘ইউটোপিয়া’য় আক্রান্ত হয়ে খোশ-মেজাজে দিনাতিপাত করলেও বস্তুত পরিস্থিতি যে অতটা সরল নয় সেটা বোঝার আগ্রহ সেভাবে চোখে পড়ে না। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এই উদাসীনতা যে জটিল সমস্যা তৈরি করতে পারে তা হৃদয়ঙ্গম করা অবশ্যই দরকার।
বিগত চার দশক যাবৎ ‘বহিরাগত’ দিয়ে শুরু করে ভায়া (via) ‘বিদেশি’ হয়ে অবশেষে ‘বাংলাদেশি’ (? বাঙালি)-তে থমকে থাকা অসম আন্দোলন যে ঘোলাটে রাজনীতির ব্যুহে প্রবেশ করে পালাবার পথ পর্যন্ত খুঁজে পাচ্ছে না তার দরুণ অনেকেই আপাতত স্বস্তি বোধ করছেন, ভবিষ্যতের চিন্তা শিকেয় তুলে দিয়ে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালির পক্ষেও এই অ-বিবেচনা ক্ষতিকারক প্রমাণিত হতে বাধ্য। বিদেশি নাগরিক সংক্রান্ত সমস্যার এক মৌলিক ও চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটে গেছে নয়ের দশকে এসে। অসম গণ পরিষদ দল সরকার গঠনের আগে পর্যন্ত অসমীয়াভাষীরা সমস্যাটিকে ও তৎ সংক্রান্ত আন্দোলনকে তথাকথিত জাতীয় স্বার্থের প্রেক্ষিতেই বিচার বিবেচনা করতে অভ্যস্ত ছিলেন। অ-গ-প দলের দু দফার শাসনকালে এবং বিগত পনেরো বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতায় অধিকাংশের দিবাস্বপ্ন ভাঙতে দেরি হয়নি। দলটির প্রতি যে অনাস্থা নির্বাচনে লাগাতার পরিলক্ষিত তা থেকে একথা স্পষ্ট যে অসমের মানুষ বিদেশি জুজুর চেয়ে রুটি-রুজির সমস্যাকেই মৌলিক সমস্যা রূপে পরিগণিত করার জরুরি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠেছেন। আসু-র আন্দোলনকে বাঙালি বিরোধী বিবেচনা করতে অভ্যস্ত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিদের একাংশও কিন্তু নয়ের দশকে এসে অবস্থান পাল্টেছেন কিয়ৎ পরিমাণে। ’৭১ এর পরে আসা বাঙালিরা বিদেশি সেকথা মেনে নিয়েছেন মূলত ওই সময়ে বি-জে-পি হাওয়া জোরদার থাকার ফলে। অর্থাৎ, আন্দোলনটা এদের কাছে আর সর্বাংশে ‘বাঙালি বিরোধী’ রইল না।
বরাকে একটু ভিন্ন চিত্র দেখা গেল। সেখানে বাংলাদেশি (আরো সঠিক ভাবে বললে মুসলমান বাঙালি)রা হল বিদেশি। ভাষাগত ঐক্যের বিষয়টা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ল। আর তাই অ-গ-প দলের হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এল বাঙালি মুখ, এমনকি নির্বাচিতও হওয়া গেল বিস্ময়কর ভাবে। মোদ্দা কথাটা হল উভয় উপত্যকায়ই সমস্যাটিকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমান বিভাজন প্রকট হল। সেকারণেই অগপ-ভাজপা সমঝোতা সম্ভব হয়, যদিও ভা-জ-পা জাতীয় দল বলে মাঝে মাঝে ‘হিন্দুরা শরণার্থী’ ধুয়ো তোলে।
রাজনৈতিক নানান জটিল সমীকরণের ফলে বাঙালিদের এক হতবুদ্ধি অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছে। যথার্থ কোনও সংগঠন না থাকার ফলে পরিস্থিতি আরো শোচনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে অনেকেই নানান দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করেছেন বিভিন্ন সময়ে, বর্তমান নিবন্ধকারও একটু-আধটু লিখেছেন। তবে এখানে অন্য একটি জরুরি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করব।
তত্ত্বগত ভাবে যারা বিদেশি নয়, অর্থাৎ,৭১ এর আগেই যে বাঙালিরা অসমে এসে বসবাস শুরু করেছেন, স্বাধীনতার আগে কিংবা পরে, তাদের উভয় গোষ্ঠীই কিন্তু এক নতুন প্রজন্মের জন্মদাতা। বাস্তুভিটে ত্যাগ করে স্বেচ্ছায় কিংবা বাধ্য হয়ে যারা এসেছেন, আর নতুন প্রজন্মের যে বাঙালির জন্ম বস্তুত এই উত্তরপূবের কোমল মাটিতে তাদের চিন্তা-চেতনার প্রকৃতি ও পরিধি ভিন্ন হতে বাধ্য। কেননা, বাপ-ঠাকুর্দার মতো এদের কোন ‘হারানো স্বদেশের’ স্মৃতি নেই। অথচ, জ্ঞানচক্ষু মেলার পর থেকেই বাবা-কাকাদের বিলাপের দৌলতে এদের মধ্যে ‘এ ভূমি আমার নয়’ গোছের এক মানসিকতা গড়ে ওঠার অবারিত সু্যোগ পেয়েছে ও ক্রমে বদ্ধমূল হয়েছে। যে মাটিতে শেকড় রয়েছে সেই মাটির সঙ্গেই ফলে তৈরি হয়েছে নিদারুণ এক আত্মিক বিচ্ছিন্নতা। একদিকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এই উদ্বাস্তু মানসিকতা আর অন্যদিকে আশির দশকের আন্দোলন-মার্কা ভাষাকেন্দ্রিক উগ্র-জাতীয়তাবাদী প্রত্যাখ্যান, দুয়ে মিলে বস্তুত দেহে-মনে নিজভূমে পরবাসী হয়েছে এই নতুন প্রজন্মের বাঙালি। দেশভাগের ফলে উদ্বাস্তু হওয়ার থেকেও তা ভয়ানক। মানুষ যখন আত্মিক ভাবে উদ্বাস্তু হয় তখন কোন ভূমিকেই আর স্বভূমি বলে মনে হয় না।
বরাক উপত্যকার বাঙালির ক্ষেত্রেও এই উদ্বাস্তু মানসিকতা বর্তমান যদিও তার চরিত্র আলাদা।
’৬১-র ভাষা আন্দোলন নিয়ে বরাকের বুদ্ধিজীবীদের গৌরবান্বিত ও আবেগাপ্লুত হতে দেখা গেলেও বাস্তবে ধর্মনিরপেক্ষ ভাষিক ঐক্য গড়ে তোলার কোন সদর্থক প্রয়াস দৃষ্টিগোচর হয় না আদৌ। এখনো নির্বাচনের অঙ্ক কষা চলে হিন্দু-ভোটার ও মুসলমান-ভোটারের সংখ্যা কত তার নিরিখে। ভৌগোলিক সান্নিধ্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে ঐক্যের বাতাবরণ তৈরি করতে পারেনি। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অসমীয়া-বাঙালির মধ্যে যে দূরত্ব বরাক উপত্যকায় হিন্দু ও মুসলমান বাঙালির মধ্যেকার দূরত্ব অন্তত পরিমাণগত ভাবে তার চেয়ে কম নয়। সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে হিন্দু-বাঙালির ভূমিকাই মুখ্য। সামাজিক কর্তৃত্বের ভূমিকায় থাকা হিন্দু-বাঙালির অংশটি মূলত অবিভক্ত শ্রীহট্টের অধিবাসী। দেশভাগ ও বিতর্কিত গণভোটের ফলে শ্রীহট্টের যে অংশ ভারতভুক্ত হয় সেখানে এই অংশটি স্বাভাবিক কারণেই সামাজিক আধিপত্য সাব্যস্তের যাবতীয় প্রচেষ্টা আরম্ভ করে। সোজা কথায় ‘দেশের বাড়ির নকল’ তৈরির জন্য ব্যস্ত এবং উৎসাহী হয়ে পড়ে। নিম্ন বর্গের হিন্দু ও মুসলমান বাঙালির সঙ্গে এদের যে দুরত্ব দেশভাগের আগে ছিল দেশ বিভাজনের পরেও তা বহাল রইল। এটা অবশ্যই দুর্ভাগ্যজনক। কর্তৃত্বকারী বাঙালির এই শ্রেণিটি উপায়ান্তরবিহীন হয়ে অসম-ভুক্তি মেনে নিলেও মানসিক ভাবে অসম তথা উত্তরপূর্বাঞ্চলের অন্যান্য প্রদেশের অধিবাসীদের থেকে স্বেচ্ছায় এবং সচেতন ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে রইল। বরং ভাষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এরা কলকাতামুখীনতাকেই জরুরি বলে সাব্যস্ত করে বসল। অর্থাৎ, এদের ‘মনোভূমি’ ও ‘বাসভূমি’ পৃথক হয়ে গেল। শারীরিকভাবে তো ছিলই, মানসিক ভাবেও উদ্বাস্তু হল। উভয় উপত্যকার বাঙালির মধ্যেই এই উদ্বাস্তু-মানসিকতা প্রকট হল, যদিও তার পেছনের ঐতিহাসিক এবং আর্থ-সামাজিক কারণ ভিন্ন। এই বিষয়টি নিয়ে নতুন প্রজন্মের বাঙালির চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে আজ।
অসমের আর্থ-সামাজিক জটিল পরিস্থিতিতে ‘বিদেশি জুজু’র ভয় দেখানোর ‘নিরাপদ’ রাজনীতি অসম তথা অসমের স্বার্থকে যেভাবে জলাঞ্জলি দিয়েছে তার মাশুল কিন্তু গুণতে হচ্ছে ভাষা-ধর্ম নির্বিশেষে সকল অসমবাসীকেই। এই উপলব্ধি ভীষণ জরুরি এসময় – অসমীয়া ও বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ের জন্যই। উভয় সম্প্রদায়ের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন তরুণদের তাই নিজ নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে এ বিষয়ে জনমত গঠনে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। অসমীয়া এবং বাংলাভাষীদের উভয়কেই আজ অথবা কাল এই উপলব্ধি লাভ করতেই হবে, সে প্রক্রিয়া ইতিহাসের নিজস্ব নিয়মেই হয়ত ইতিমধ্যে এক সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিয়েছে। প্রয়োজন কেবল সেই সম্ভাবনাকে চিনে নিয়ে ইতিহাসের গতিপথকে বাধাহীন করার লক্ষ্যে সচেষ্ট হওয়া। উত্তরপূবের নব প্রজন্মের বাঙালির সে উপলব্ধি একেবারেই নেই তা নয়, তবে উপলব্ধি অনুসারে সক্রিয় ভুমিকা গ্রহণের জন্য সচেষ্ট হওয়া দরকার, অবিলম্বে। এটাই সময়ের দাবি, উভয় সম্প্রদায়ের কাছে। দাবি মেনে সেতুবন্ধনের শর্ত পূরণে কৃতকার্য হলে সুদিন আসবে উভয় সম্প্রদায়ের জন্য, অন্যথায় উত্তরপূবের হিন্দু ও মুসলমান বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অন্যতর বিকল্পের অনুসন্ধানে ব্রতী হতে হবে।
৮মে,২০১১
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন