“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

যাত্রা পথে বিশ্বাসঘাতক

                    ।। মাসকুরা বেগম ।।

 

  

   

(C)Image:ছবি

  চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া নোনা জল আর কলমের কালিতে একাকার হয়ে যাচ্ছে যেন  লেখাগুলো। ভাগ্যিস সেটা স্মার্ট বল পেন ছিল ! দোয়াতের কালির কলম হলে তো পুরো লেখাটাই ভিজে নষ্ট হয়ে যেত ! লেখায় শেষ টান দিয়ে বন্ধ করে  ডায়রিটা টেবিলের উপর রেখে দেয় খুশি। অঝোরে বেয়ে চলা অশ্রু বিন্দুগুলো মুছে ফেলে সে । প্রচণ্ড কী এক অদ্ভুত  অনুভূতি হয় নিজের শরীরে-মনে ! সমস্ত সংসার-জীবনের মায়াজাল, মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন কারো কথা মনে পড়ছে না এই মুহূর্তে তার ! শুধু মনের মধ্যে একটা ভীষণ চাপা কষ্ট অনুভূত হচ্ছে। নিজের কাছে নিজেকে খুব দোষী মনে হচ্ছে । শাস্তি তো নিজেকে দিতেই হবে। তার নিজের সাথে সাথে যে মা-বাবার সম্মানটাও ধুলোয় মিশে গেছে। মা-বাবার কথা মনে পড়তে খুব কষ্ট হয় কিন্তু কাঁদে না সে । ডায়েরীটা আবার হাতে নিয়ে এক পাতায় লিখে " SORRY MAA SORRY ABBA" কলমটা ভিতরে রেখে বন্ধ করে দেয় ডাইরিটা।

 

         আসলেই কি দোষী ছিল খুশি ! কাউকে বিশ্বাস করা কি দোষের ! খুশি বিশ্বাস করেছিল এক লম্পটকে। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পোস্ট গ্রাজুয়েশনের ছাত্রী খুশি । মেধাবী ছাত্রী সে। বিশ্ববিদ্যালয় নিজের শহর থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। তাই তাকে হোস্টেলেই থাকতে হয় । এর আগে কোনোদিন ঘর থেকে, মা-বাবা আর ছোট ভাই এর থেকে দূরে থাকতে হয়নি তাকে । তাই খুব মিস করে সবাইকে। নিজের শহরের পরিচিত কারো সাথে দেখা হলে খুব ভালো লাগে তার । ভীষণ এক্সাইটেড হয়ে যায় সে।

 

       খুশির প্রতিবেশী ছেলে পিন্টু বায়োলজিতে এম এস সি বলে খুশি শুনেছে । সেদিন খুশির ডিপার্টমেন্টের পাশে তার আবির্ভাব দেখে খুশি অবাক হয়ে গিয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিল এটা-সেটা - অনেক কিছু। নিজের ঘরের, নিজের শহরের খবর নিয়ে খুশি হয়েছিল খুশি। 

 

      " আপনি এখানে কী করছেন পিন্টুদা ?" - জিজ্ঞেস করেছিল খুশি ।

" আমি পিএইচডি করছি বায়োলজিতে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া লেগেই থাকে। তোমার খবর নিতে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে এসেছি।" পিন্টু জবাব দিয়েছিল।

" ও আচ্ছা ! খুব ভালো !"

 

       মাঝেমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের এখানে সেখানে খুশির দেখা হয়ে যায় পিন্টুর সাথে। দু-চারটি কথা ও হয় । পিন্টু নানা ছলে তাদের আলাপচারিতা দীর্ঘক্ষণ ধরে চালিয়ে যেতে চায়। খুশি দরকারি কথা বার্তা বলে চলে যায়। সে টেরই পায়নি পিন্টুর মনে কী আছে ! পিন্টু কী চায় ! তার সাথে মেলামেশার যে কিছু উদ্দেশ্য আছে পিন্টুর ! - এর কিছুই বুঝতে পারেনি খুশি আর বুঝার ইচ্ছে ও হয়নি কখনো । 

 

      শনিবার ক্লাস শেষে তড়িঘড়ি হোস্টেলে গিয়ে খুশি আগে থেকেই গুছিয়ে রাখা ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে বিকেল দুইটায় বাস স্ট্যান্ডে এসে উপস্থিত হলো। টিকিট কাটতে গিয়ে হঠাৎ চেনা স্বর শুনে ঘুরে দেখে পিন্টু । তাকে বলল, -" তুমি ঘরে যাবে নাকি খুশি ?"

" হ্যাঁ ! পিন্টুদা ! আপনি ?" 

" আমিও ঘরে যাবো। তুমি দাঁড়াও । টিকিটটা আমি কাটছি !"

" ঠিক আছে ! হবে।"

 

       টিকিট কেটে এসে পিন্টু বলল, " বাস আধঘণ্টা পরে ছাড়বে। চলো না এই রেস্টুরেন্ট থেকে কিছু একটা খেয়ে আসি । সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি । তোমার মুখটাও শুকিয়ে গেছে ! নিশ্চয়ই কিছু খাওয়া দাওয়া হয়নি !"

 

      হ্যাঁ ! সত্যিই ! তাড়াহুড়োর মধ্যে খুশির কিছুই খাওয়া হয়নি । তাই সে খাওয়ার কথা শুনে না বলতে পারেনি ! কিন্তু খুশি তো আন্দাজই করতে পারেনি যে এই খাওয়ার পরিণতি তার জন্য কতো ভয়ঙ্কর হয়ে প্রকাশ পাবে একদিন !

 

      যথাসময়ে বাসে উঠে পাশাপাশি সিটে বসে বিভিন্ন আলাপচারিতার  মধ্যে তারা পৌঁছে যায়  গন্তব্য স্থলে। কোনো ধরনের  আপত্তিকর ব্যবহার লক্ষ্যই করেনি খুশি যে খারাপ কিছু সন্দেহ করতে পারে পিন্টুকে নিয়ে ! ঘরে এসে মাকে বলল পিন্টুর কথা । মা ও তার মতো স্বাভাবিক ভাবেই নিলেন সবকথা শুনে। 

 

 

       সোমবার দিন সকালে আবার পিন্টুর সাথে দেখা হয়ে যায় বাস স্ট্যান্ডে। পিন্টু টিকিট কেটে নিয়ে আসে। পাশাপাশি সিটে বসে যাচ্ছে তারা। আজ পিন্টু কিছুটা বেশি চুপচাপ ! অর্ধেক রাস্তা কেউ কোনো কথা বলছে না ! এমনিতেই খুশি আলতু-ফালতু কথা কম বলে । হঠাৎ পিন্টু শুরু করলো, " খুশি !"

" হ্যাঁ ! পিন্টুদা কিছু বলছেন !"

" খুশি ! খুশি আমি ! আমি তোমাকে ভালোবাসি !"

         আঁতকে উঠে খুশি, মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, " হো-য়া-ট !" বাসের জোরালো ব্রেক আর পিন্টুর অবাঞ্ছিত প্রস্তাবে এক আকস্মিক ঝাঁকুনি খেলো খুশি !

        " অসম্ভব ! এরকম ভাবলেন কী করে আপনি ! ছিঃ ! একথা বলতে একবারও লজ্জা করলো না আপনার ! আমি আপনার ছোট বোন নাদিয়ার সমান ! আমি আপনাকে দাদা ডাকি !" 

 

        "তো কী হলো ! তোমাকে বলতে যা একটু দেরি হয়ে গেছে ! তুমি যখন ক্লাস নাইনের ছাত্রী তখন থেকেই আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি যখন স্কুলে যেতে তোমার চুলের দুই বিনুনির মধ্যে ফুটে উঠত তোমার সুন্দর মিষ্টি চেহারা, কালো কালো মায়াবী দুটো চোখ ! আমি কোনো দিনই ভুলতে পারিনা তোমার সেই চেহারা ! প্লিজ 'না' বলো না লক্ষীটি । তোমাকে না পেলে আমি মরে যাবো !"এই বলেই বাসের সিটের হাতের মধ্যে শক্ত করে ধরে রাখা খুশির হাতটি খপ করে ধরে ফেলে পিন্টু।

 

       হাতটা ছাড়িয়ে খুশি টাস করে এক চড় মারবে বলে হাত উঠিয়ে আবার নিজেকে সামলে নিলো । ভাবল " বাস ভর্তি মানুষ কী ভাববে!"

"কী হলো ! কিছু বলো না খুশি !" - পিন্টু আবার বলল।

" প্লিজ মুখটা বন্ধ করুন, আমাকে একটু একা থাকতে দিন। "

" ওকে ওকে মাই ডিয়ার ! ভাবো, ভাবতে থাকো । ভাবলেই তো আমাকে খুঁজে পাবে তোমার হৃদয়ে । "

       পিন্টুর কথাগুলো শুনে যেন খুশির কান দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে ! রাগে মাথাটা ফেটে যাচ্ছে যেন ! চলন্ত বাসের দমকা হাওয়া আর খুশির মস্তিষ্কে বয়ে চলা উথাল পাথাল ঝড় যেন একাকার হয়ে যাচ্ছে ।  নিস্তব্ধ হয়ে আছে খুশি আর কখন যে বাস বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে টেরই পায়নি সে।

 

       বাস থেকে নেমে পিন্টু আবার এক কুটিল হাঁসি হেঁসে বলল, " খুশি আমি কল দেবো । নিশ্চয়ই পজিটিভ রিপ্লাই পাবো। বাই ডার্লিং !"

 

      কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে গার্লস হোস্টেলের দিকে হনহনিয়ে চলে গেল খুশি। ব্যাগটা রেখে হাত-মুখ ধুয়ে চলে যায় ক্লাসের দিকে । যেতে যেতে রাস্তায় দেখা হয়  বান্ধবী মুনমুনের সঙ্গে। মুনমুন বায়োলজিতে এম এস সি করছে । তারা দুজন একই শহরেরই বড় হয়েছে । একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়েছে । মুনমুনের খুশিকে দেখে বুঝতে বাকি রইলো না যে কিছু একটা হয়েছে ! সে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, " খুশি তোকে এতো অন্যরকম লাগছে কেন ? কী হয়েছে তোর ?"

 

       খুশি পিন্টুর সবকথা বলে মুনমুনকে । মুনমুনের হাঁসি পেয়ে যায় পিন্টুর মিথ্যে বানিয়ে বলা কথাগুলো শুনে। পিন্টুর অতীতের অনেক কথা জানা আছে মুনমুনের। মুনমুনের দিদি পিন্টুর সাথে দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে একই সঙ্গে পড়ত । পিন্টুর এম এস সি-টাই নাকি সম্পূর্ণ করা হয়নি। ফাইনাল ইয়ারে থাকতে সেখানে একটি মেয়ের সঙ্গে কেলেঙ্কারি করে মারধর খেয়ে রাতারাতি আসামে চলে এসেছিল আর কোনোদিন সে দিল্লি ইউনিভার্সিটির দিকে পা মাড়ায় নি । আর সে যদি বায়োলজিতে পিএইচডি করে থাকতো তবে নিশ্চয়ই মুনমুনের সঙ্গে দেখা হত তার ডিপার্টমেন্টে। যেহেতু তারা একই ডিপার্টমেন্টের ছাত্র । 

 

      সব শুনে মাথায় হাত দিয়ে ঘাসের উপর বসে পড়ে খুশি ।  এ কোন লম্পটের পাল্লায় পড়লো সে। তখনই তার মোবাইলটা রিং করে উঠে । চেয়ে দেখে পিন্টুর নম্বর। মুনমুনকে দেখালে সে বলল, - " ধর ফোনটা আর দুচার কথা শুনিয়ে দেয়।"

      খুশি ফোনটা রিসিভ করেই শুরু করে দিলো, " লম্পট ! শয়তান ! মিথ্যুক ! তুই এখানে পিএইচডি করতে আসিস নি ! আমার পেছন ছেড়ে দেয় না নইলে খুব খারাপ হবে বলে দিচ্ছি।"

      "হ্যাঁ তুমি ঠিক জেনেছ সুন্দরী আমি এখানে পিএইচডি করতে আসিনি। এসেছি তোমাকে পেতে । তোমাকে না পেলে আমি বাঁচবো না।"

"এটা তো দিল্লির মেয়েটাকেও বলেছিলি কিন্তু সে তো তোর জীবনে আসলো না । তাও তো বেঁচে আছিস দিব্যি ........।" বলে  ফোনটা তৎক্ষণাৎ কেটে দেয় সে। 

 

      আবার কল আসলে মুনমুন ফোনটা নিয়ে নাম্বারটা সাইলেন্ট মুডে রেখে দেয়। আর মুনমুন বলে গেল, " তুই বিন্দাস থাক ! কিচ্ছু করতে পারবে না ঐ ফালতুটা ।"

" ওকে ! তোর দেরি হয়ে যাচ্ছে ।যা তুই ক্লাসে যা । বাই !"

" তুই ও ক্লাসে যা । টেক কেয়ার ! বাই ! "

 

       খুশির মোবাইলে অনবরত কল আর মেসেজ করে যেতে থাকে পিন্টু। সে কোনো জবাব দেয় না।  পিছনে ঘুরতে থাকে সে পাত্তা দেয় না। তারপর একদিন খুশির হোয়াটসএপে পিন্টুর পাঠানো কয়েকটি ফটো আর মেসেজ দেখে পায়ের নিচের মাটি যেন সরে যায় খুশির । 

" ফটোগুলো লাগবে কি ?" " চলো না আমাদের সাত বছরের ভালোবাসার শেষ পরিণতিতে পৌঁছাই ।" " মত না দিলে পরিণাম ভালো হবে না।" - ইত্যাদি বিভিন্ন অবাঞ্ছিত মেসেজ আসতে থাকে ।

 

       কোনো জবাব দেয় না খুশি । সে ভাবতে থাকে কেন, কীভাবে তার সঙ্গে পিন্টু এরকম করছে ? ঐ দিন রেস্টুরেন্টে একসঙ্গে বসে খাবার ছবি, বাসে পাশাপাশি সিটে বসা ছবি ! কী করে উঠল পিন্টু ? সবকিছু কি পূর্ব পরিকল্পিত ছিল ? তৃতীয় কেউ তো ছিল পিন্টুর সঙ্গে ! আর পিন্টুর কথামতো ফটো তুলছিল ! এখন কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না খুশি । 

 

       কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে ঘরে চলে এসেছে খুশি । এবার বাবাকে বলেছিল যে তাকে গিয়ে নিয়ে আসতে বলেছিল তার শরীর খারাপ লাগছে। ঘরে এসে কাউকে কিছু বলেনি। এদিকে পিন্টু কল আর মেসেজ করে অতিষ্ঠ করে তুলছে তাকে । 

 

        আজ দুপুরে সে শুয়ে আছে তার মা পাগলের মত দৌড়ে এসে ডাকতে লাগলেন। সে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো । মায়ের হাতে বাবার মোবাইল ! বাবার মোবাইলে খুশি যা দেখল তাতে যেন তার হুঁশ উড়ে গেল ! পিন্টু ফেসবুকে  ফটোগুলো আপলোড করে ক্যাপশনে লিখেছে, " খুব শীঘ্রই পরিণত হতে চলছে আমাদের সাত বছরের প্রেম !" 

 

      কী বলবে সে মাকে ? কোথা থেকে বলবে সে ? বাবাকে মুখ দেখাবে কী করে ? কোনো কথা বেরুচ্ছে না তার মুখ দিয়ে । মা ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, " এসব কী মা ? বল না ।" 

 

      " আমি কিচ্ছু জানিনা মা ।........" কেঁদে কেঁদে বলে যায় যতটুকু বলা সম্ভব হয়েছে । মায়ের মুখ দেখে বুঝতে বাকি রইলো না যে মা-বাবা কতটুকু সমস্যায় পড়েছেন এই ব্যাপারটা নিয়ে। তাদের মান সম্মানে কতটা আঘাত লেগেছে । বাবার  সামনে আর বেরুতেই পারছে না খুশি। 

 

       নিজের ফেসবুক সারাদিন থেকে লগ-ইন  করেনি তাই  মোবাইলটা হাতে নিয়ে লগ-ইন করে দেখে ''একী ! তাকে ট্যাগ করেই পোস্ট করেছে পিন্টু আর কী সব মুখরোচক মেজাজ গরম করা কমেন্টস ! '' এদিকে বন্ধুদের ফোন আসতে থাকে সে রিসিভ করে না। বিভিন্ন ধরনের মেসেজ আসতে থাকে সে রিপ্লাই করে না । মোবাইলটা সাইলেন্ট করে রেখে দেয় । মুনমুনও অনবরত কল করছে, মেসেজ করছে কিন্তু খুশি কথা বলছে না। তার মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না যে। মা রুমে এনে খাবার দাবার দিচ্ছেন কিন্তু মা-বাবার বা তার কারো মুখে খাবার দাবার উঠছে না । 

 

       খুশির মনে যত সব নেতিবাচক চিন্তা আসছে ! ''কতদিন আমি মুখ লুকিয়ে বোবা হয়ে থাকতে পারব !  সামনে যে ভবিষ্যৎ পড়ে আছে তার মুকাবিলা করব কেমন করে ! কোনো ভালো ছেলে কি এসব দেখার পর আমাকে বিয়ে করতে আসবে ! আমার সব আশা- আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন যেন ধুয়াশায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেছে ! মা, আব্বা এই সমাজে মুখ দেখাবে কেমন করে ! আমি আর বেঁচে থেকে লাভ কী ! আমার এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া উচিত !........." কাঁদতে কাঁদতে  ডাইরিটা হাতে নিয়ে নিজের শেষ কথাগুলো লিখে ফেলে ! 

 

      নিয়তির ইচ্ছে বোধহয় অন্য কিছু ছিল তাই তো গলায় ফাঁস দেওয়ার আগে ভেজানো দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করতে ভুলে যায় খুশি । মা তাকে ডাকতে এসে দেখেন খুশি তার পরনের ওড়নাটা  সিলিং ফ্যানের সাথে বেঁধে গলায়  দেওয়ার চেষ্টা করছে । মায়ের চিৎকারে সবাই এসে জড়ো হয় । খুশি অবাক হয়ে দেখে মুনমুন ও তার দিদি এসেছে ! 

 

      বাবা বলেন, " আমরা কি তোকে কিছু বলেছি ? বকাবকি করেছি ? অবিশ্বাস করেছি ? তুই কি আমাদের কথা একবার ও ভাবলি না ? এতো স্বার্থপর তুই !"

 

     খুশি কিছু বলতে পারে না শুধু মা-বাবার বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে চলে ।

 

      " মুনমুনরা এসে সব বলেছে । আমরা একটু চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম ঠিকই । এখন বুঝতে পেরেছি । কিন্তু তোকে তো কোনো দোষ দেই নি । তুই এ কী করতে বসেছিলি ?" - কেঁদে কেঁদে মা বললেন । 

 

        মুনমুন বলল, " তোকে ফোনে না পেয়েই আমি বুঝেছি যে তুই আঘাতটা সহ্য করতে পারছিস না নিশ্চয় । আর আন্টি আঙ্কলই বা কী ভাবছেন ? কী করছেন ? তাই দিদিকে নিয়ে চলে এলাম কিন্তু তুই এতো বড় পাগলামি করবি তা তো ভাবিনি !" 

 

      মুনমুনের দিদি বললেন, " শাস্তি যে দোষ করেছে তাকে দেবে । নিজেকে কেন দিচ্ছ ! তুমি আত্মঘাতী হলে কি এর সমাধান হবে ? তুমি কাপুরুষের মত চলে যাবে আর নিত্যদিন নতুন নতুন মেয়েরা ঐ বিশ্বাসঘাতকদের শিকার হবে ।তোমাকে হতে হবে বীরাঙ্গনা ! সহায়তা করতে হবে আরো দশটা মেয়েকে ।"

 

       এক ঝলক হাঁসি ফুটে উঠে খুশির মুখে আর মুনমুনের দিদির হাতে হাত রেখে বলল, " আমি নতুন করে বাঁচবো দিদি। আইনি ব্যবস্থা নেবো ঐ বিশ্বাসঘাতকের বিরুদ্ধে । সচেতনতা শিবির গড়ে তুলবো মেয়েদের জন্য । জীবনে ভালো কিছু করার চেষ্টা করবো ।" খুশির খুশিতে সবাই খুশি হয়ে উঠে ।

 

 

 

বিষয় : ছোটগল্প

 

মাসকুরা বেগম।

গুয়াহাটি । আসাম ।

 

 

 

 

কোন মন্তব্য নেই: