বাংলা অনুবাদ: সুশান্ত কর
পা |
ড়ে দম হয়ে পড়ে থাকা কয়লার পাহাড়গুলো, ধ্বসে জীর্ণ ব্রহ্মপুত্রের পাড়, পানি শুকোতে বেরিয়ে পড়া ঝাউবনে ভরা বালিচরের সবুজ ঢেউগুলো নড়তে নড়তে দৃষ্টির বাইরে মিলিয়ে যাচ্ছে। বর্ষাতে ব্রহ্মপুত্রের পানি গিয়ে পাথর বিছানো বড়রাস্তা অব্দি পৌঁছয়। এখন শুকিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে বেশ খানিকটা নেমে আসতে হয় । বালির উপরে বাঁশের মসৃণ তর্জা ইত্যাদি ফেলে মানুষের আসা যাওয়ার পথ করে দেয়া হয়েছে। একমাত্র চায়ের দোকানটি বালিতে পোতা বাঁশের চাঙের উপরে খেরের একটা চালাঘরে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে। কেরাসিন টিন তালি দিয়ে তৈরি ঝাঁপ-দরজাটি তুলে রাখাতে চালাঘরের পাশে আরো একখানা চালা হয়ে গেছে। তার নিচের বাঁশের খোঁটা চারটার উপরে দুফাল করে বাঁশ ফেলে দেবার সঙ্গে সঙ্গে সেটি একটি সুন্দর বেঞ্চ । তাতে বসে চা খান, বিড়ি কিনুন, সিগারেট জ্বালান, কথা বলুন।
আমি এসবের কিছুই করছিলাম না। শুধু সিঁদুর বাটির মতো হয়ে এসেছিল যে বেলাটি, তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। জাহাজ আসবে সেই রাত নটায়, মানে সেটিই নিয়ম। বেলা থাকতেই আমি ঘাটে এসে পৌঁছে গেলাম। দেখতে না দেখতে ছোট ছোট ঢেউগুলো ছোট ছোট আঙুলে টপাটপ সিঁদুরগুলো ছেনে গায়ে মেখে কোথাও কচি-কাঁচার আসর দেখতে চলে গেল। কেউ যেন বা সমস্ত সিঁদুর রাগে ওদের গায়েই ফেলে দিল,শূন্য কপালের নারীর মতোই দেখাচ্ছে ।
বড় একা বোধ হচ্ছিল। যাত্রী দেখি আসছেই না। জনাদুই নেপালি,সস্ত্রীক। জনাকয় চা বাগানের মজদুর। চায়ের বাক্স আনা আর কয়লা নিয়ে যাওয়া চাবাগানের মটরগুলোই এতো সময় ধরে কাঠনিবারি ঘাটকে সজীব করে রেখেছিল। দূরের চা বাগানের কলঘরের অস্পষ্ট ধোঁয়াগুলো ইতিমধ্যে আঁধারে মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে। কালো অসুরের মতো অন্ধকার বোটটা, তাতে কাজ করা খালাসি,মজুর শ্রেণির কয়েকটি লোক,চা দোকানের ছোট্ট পরিবারটি আর আমরা যাত্রী নামের কয়েকটি মানুষকে একা পেয়ে ঘিরে ফেলল।
হর হর শব্দের সঙ্গে ঘুঙুরের ঝনঝননি কৌতূহল বাড়িয়ে তুলল। দোকানের খের-ইকড়ার বেড়ার ফাঁক দিয়ে একটি গরুগাড়ি নজরে এলো। গাড়োয়ানটি মেনে এসে ধীরে ধীরে জোয়াল নামিয়ে দিল। গরু দু’টো এখানে ওখানে এক আধটু খেয়ে শুঁকতে শুরু করল,যদি আর কিছু পায়। গাড়ির সামনের পর্দার সবুজ রঙটা তখনি চোখে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে মনটাও সজীব হয়ে পর্দার মতোই কাঁপতে শুরু করল।ছটফটে পনেরো-ষোল বছরের ছেলে একটি ঝাঁপ দিয়ে নেলে এল।গাড়োয়ানের সঙ্গে ধরাধরি করে টিনের ট্রাঙ্ক একটা নামিয়ে মাটিতে রাখল। ঠেলে-টেনে বাক্সটি গাড়োয়ানের মাথাতে চাপল। ছেলেটি আগে আগে পথ দেখিয়ে বোটের দিকে নিয়ে গেল
আরো একবার মন কাঁপতে শুরু করল। গাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা মূর্তিটি স্পষ্ট নজরে পড়ছে। কারণ আলোর ঝুলে থাকা শেষ কণাগুলো ঠিক তখনি অদৃশ্য হয়ে গেল। গায়ের কাপড় ঝেড়েটেরে নদীর দিকে তাকিয়ে দাঁড়াল। ছেলেটা আর গাড়োয়ান ফিরে কাছে এল। হোল্ডল আদি দুই এক পদ জিনিস গাড়ির ভেতর থেকে বের করে ধীরে ধীরে বোটের জন্যে পা বাড়াল। আমার নজর তাদের অনুসরণ করে গেল।
খানিক পরে ছেলেটি আর গাড়োয়ান আবার বেরিয়ে এল। দোকানের কাছে এসে তাকে চা খেতে পয়সা দিয়ে তাড়াতাড়ি গরু জুড়ে দিতে নির্দেশ দিল,“ভালোয় ভালোয় এসে পৌঁছেছি,বলবি। বুঝেছিস?”
তাকে বুঝিয়ে ছেলেটি বোটে ফিরে গেল। গাড়োয়ান এক সিঙ্গেল চা আর ‘কল’ বিস্কুট একটা নাকেমুখে গিলল। দোকানের কাছে অপেক্ষারত তার সগোত্র যাত্রী শ্রমিকের প্রশ্নের জবাব দিল, “দশ মাইল যেতে হবে।”
গাড়ির দশ মাইলের যাত্রা আরম্ভ হল। ঘাটে যে লেম্পটি জ্বালিয়েছিল বহুদূর অব্দি তার আলো টিম টিম করে জ্বলছিল। এক পাক নিতেই হঠাৎ লুকিয়ে গেল।
***
বোটের এক মাথাতে মোমবাতির ক্ষীণ এক আলো ঝিলিক দিল। মনে হয় ওরাও সেই জায়গাটিই বেছে নিয়েছে। আমার লাগেজটাও সেখানেই আছে। পুরো বোটে ওটাই আরামের জায়গা। বোটে যাবার পথের মুখেও একটি হ্যারিকেন একটু আগে জ্বলে উঠেছিল,দোকানের মুখে আরেকটা।এই তিনটি আলোর খুঁটিতে অন্ধকারের তাঁবুটি মজবুত করে টানিয়ে দিল। কোথাও খসে যাওয়া মাটির চাঙড় একটি সামান্য নড়াচড়া করে গিয়ে জলে ঝাঁপ দিল, টুপুং! খুব কাছেই, জলের জোয়ালে গুটি কয় চেলা মাছের খিকখিক করে হাসবার শব্দ স্পষ্ট শোনা গেল। কয়লার দমের দিকে তাকালাম। রূপকথার ছদ্মবেশী রাক্ষসীদের মতো আমার দিকে খাঁই খাঁই করে তেড়ে এল।
বোটের আমার জায়গাটিতে যাবার জন্যে (নতুন যাত্রীদের সম্পর্কে জানতে) মন আমার আনচান শুরু করে দিল। কাঠের মজবুত সাঁকো দিয়ে বোটের ভেতরে যাব বলে পা বাড়ালাম। বোটের মিটমিটে অন্ধকারে চায়ের বাক্স, রং, আলকাতরা, শুটকি, পোড়া কয়লা সবকিছুর গন্ধ যেন লাওপানি১ খেয়ে নিয়ে কোরাস শুরু করে দিয়েছে। বহুবছর পরে যেন কেউ একটা বড়সড় বরপেরা২ নাকের আগে খুলে দিয়েছে। ফ্লেটের৩ গন্ধ আমার খুব প্রিয় । খালাসি আদি শ্রেণির কিছু মানুষ জাহাজ আসবার আগেই খাওয়া দাওয়া শেষ করতে ব্যস্ত।
আমি যেখানে লাগেজ রেখেছি তার থেকে সামান্য দূরে নেপালি পরিবারটি কম্বল পেড়ে নিয়ে টানা সুরের একটি গান শুরু করে দিয়েছে। তারথেকেও আরেকটু দূরে সাঁওতাল কি ওড়িয়া কতকগুলো লোক গোল করে বসে মুড়মুড় করে কিছু চিবোচ্ছে। মনে হয় চাল ভাজা হবে। আর ঠিক আমার মালের কাছে,আমার সুটকেসের গা লাগিয়ে হোল্ডলটি মেলে ছেলেটি শুয়ে শুয়ে মোমবাতির আলোতে একটি ইংরেজি ফিল্ম পত্রিকা মেলে তন্ময় হয়ে গেছে। শিয়রে বসে মেয়েটি কাগজটির দিকে নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে আছে।
আমি কী করব ভেবে না পেয়ে সুটকেসটাই সামান্য নাড়াচাড়া করলাম। মেয়েটি আমার দিকে নজর ফেরালো।কিন্তু মোমের আলো ভেদ করে আমাকে দেখবার জন্যে ওকে খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে হল। লাভের মধ্যে মোমের আলোতে ফ্রেম বন্দি ওর মুখ আমিই বরং দেখে নেবার সুবিধে পেলাম। ছেলেটি পত্রিকাতে হাত রেখে সেই অবস্থাতেই আমার দিকে তাকাচ্ছিল। আমি খানিক হেলে সুটকেসটা নাড়াচাড়া করবার ফলে আমার আমার মুখের উপরেও মোমের আলো গড়িয়ে গেল। ছেলেটি ধড়মড় করে উঠে বসল। আর মেয়েটিও দেখি ঘুমটাটা খোঁপা অব্দি তুলে দিল।
“আপনার সুটকেস? আমরা অল্প পাশ সরিয়ে রেখেছিলাম। আমরা গুটিয়ে বসব, আপনি বিছানা পাতুন।”
এতো চেনা সুরে কথাগুলো বলল ছেলেটি যে আমি কিছু থতমত খেয়ে গেলাম। খুব তাড়াতাড়ি মানুষের পরিচয় ভুলে যাই বলে অনেক জায়গাতে বেশ ক’বার লজ্জা পেয়েছিলাম। কিন্তু মিছাই---কোথাও ওকে দেখেছি বলে মনে পড়ল না।
“না,না!ঠিক আছে। তোমরা (ঘুমটা!),মানে তুমি ভালো করেই বসো। আমার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
আমি আমার কম্বলে প্যাঁচানো বিছানার পোটলাটি (নোংরা হয়ে গেছে) আঙুলের কৌশলে ইতিমধ্যে সুটকেসের আড়ালে ঠেলে দিলাম। কিন্তু এই যে সুটকেসটাকে প্রহরী করে দিলাম তারও যে রঙ খসে গেছে ---সেই সব কী করে সামাল দিই? অবশ্য এটি ছিল ভালো বংশেরই, মূলে ইংরেজি স্টিলের। কিন্তু মূলের সন্ধান কেই বা করে! জিনিস দুটো উঠাতে দেখে ছেলেটি অভিমানে চেঁচিয়ে উঠল,“ আপনি অন্য জায়গাতে যেতে চাইছেন বুঝি! আমরা কিন্তু তবে খারাপ পাব।”
ও সত্যি সত্যি ওদের পাতানো হোল্ডল গোটাতে শুরু করল।
“নাহে, তোমরা আরাম কর না। জাহাজ সেই কোন রাতেই বা আসে? সময়ের ঠিক নেই, আর কখনো বা আসেও না।”
“সে জন্যেই তো আপনি এখানে থাকুন। যাত্রীও নেই,তায় অসমিয়া মানুষও নেই। দিদি আর আমি সেসব কথাই বলছিলাম। কেউ একজনকে যদি সঙ্গী পেতাম...!”
বুঝলাম,ছেলেটিরও দিদির সমানই ভয় হচ্ছে। আমিও আমার ভেগাবণ্ড মার্কা সুটকেস আর কাপড়ের পোটলা সরিয়ে নিতে সামান্য কৌশল করেছিলাম। এখন আমার কাপড়ের পোটলা ওড়নার আড়ালের থেকে বেরোতে পারে। পোটলাটা মেলে দিয়ে ওদের পায়ের দিকে বসে পড়লাম।
“টিকিট কাটবার সময় হলোই যেন মনে হচ্ছে। আমি খবর নিয়ে আসি। কই অব্দি কাটতে হবে?” টিকিট কাটার তখনো সময় ছিল । কিন্তু জিজ্ঞেস করবার আর কোনো কথাই খোঁজে পেলাম না।
“আমাদের যোরহাট যাচ্ছি।”। ছেলেটি ব্যতিব্যস্ত হয়ে বসে জবাব দিল।
“যোরহাট?আজ তো জাহাজ ডাউন!” আমি চমকে গিয়ে জবাব দিলাম।কারণ জাহাজের খবর রাখে না আদার ব্যাপারী। আর ওদের সেই ব্যাপারী হবার কোনো লক্ষণই নেই।
ছেলেটি আমার চিন্তার ভার লঘু করতে পেয়ে বেশ পুলকিত বোধ করল। পঞ্চম মানের ছেলে যদি ষষ্ঠ মানের ছেলেকে কিছু একটা বুঝিয়ে দিতে হয় তবে যেমন পুলক অনুভব করে সেরকম উল্লাসে আমাকে বুঝিয়ে দিল যে তারা ডাউন স্টিমারে গিয়ে শিলঘাটে নামবে। সেখান থেকে ষ্টেট ট্রান্সপোর্টে গিয়ে যোরহাট পৌঁছুবে।
“আমাদের কালকের মধ্যেই গিয়ে যোরহাট পেতে হবে, খুব জরুরি।”
অর্থ নয়,কথাগুলোই আমাকে আকর্ষণ করছিল বেশি। বৌটি স্বাভাবিক লজ্জাতে একপাশে বসেছিল যদিও,এক একবার আবছা মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল যেন সেও এই আলাপে সক্রিয় অংশ নিচ্ছে।মুখে টু শব্দটি না করে নিজেকে এভাবে জীবন্ত করতে পারবার এই অদ্ভুত গুণটির কথাই আমি মনে মনে ভাবছিলাম। বেশিদিন মনে হয় না বিয়ে হয়েছে বলে।শরীরে হলদির ছাপ মোমের ক্ষীণ আলোতে আমি স্পষ্ট দেখেছি। গায়ের দোলাইখানার৪ থেকে,চুলের থেকে বিয়ের তেল-হলদির তুলতুলে একটা গন্ধের স্রোত আমার নাকে এসে মোহনা সাজিয়েছে যেন। একটি পরিপূর্ণ মুখ,লম্বা বেলুনের মতো গোল গোল হাত,গায়ের উজ্জ্বল হলদেটে রং এবং অসমিয়া পাটের কাপড়জোড়ার রং মিলে যেন একটি ছবির মতো দেখাচ্ছে ওকে। এমনতর গঠন আজকাল খুব একটা দেখা যায় না।
হঠাৎই মনে পড়ে গেল---ছেলেটি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিল। উত্তর না পেয়ে ইসপিসও করছে।
“ও,হ্যাঁ। কী জিজ্ঞেস করলে---আমার কথা? আমিও শিলঘাটেই যাব,শিলঘাটের কাছেই আমাদের বাড়ি।”
“তবে তো ভালোই হলো।জাহাজ রাতেই শিলঘাট পেয়ে যায়। আপনার সঙ্গে পাওয়াতে অনেক সুবিধে হলো। তাই নারে দিদি?”
‘দিদি’পত্রিকাটিরই পাতা ওলটাচ্ছিল।কান ছিল আমাদের কথাতে।সম্মতি জানিয়ে ভায়ের দিকে মাথা তুলে তাকিয়ে রইল। হাসিটা যেন কেউ পাকা রঙ দিয়ে পুরো মুখে ছাপ মেরে বসিয়ে দিয়েছে। নইলে কপালটি বা হাসে কী করে? নাক,চোখ,থুতনি সবাই কি হাসতে পারে? এমন ঘন কালো ভুরু হাসতে পারে?
অন্য দিনের হিসেবে জাহাজ আসবার সময় হল। আমি খবরাখবর নিয়ে আসবার জন্যে তৈরি হলাম। টিকিট কাটবার জন্যে ছেলেটি পয়সা বের করতে যাচ্ছিল। আমি বাধা দিয়ে বললাম তখনো টিকেটের ঘণ্টা দেয় নি, আর টিকেট দিলেও আমার পয়সাতেই আনতে পারব। পরে দিয়ে দেবেখন।
“জাহাজ আসার সময় থাকলে চা খেয়ে আসতে পারি নিশ্চয়?”
ছেলেটি দিদির মুখের দিকে তাকাল। দিদি হোল্ডলটা দুএকবার আঙুলে খোঁচাখুঁচি করে নিজেকেই জিজ্ঞেস করল, “ফ্লাস্কটা গেল কই!”
এই প্রথম কথা শুনলাম। গভীর অথচ মাখনের মতো কোমল— এমনতর বৰ্ণনা মানুষের গলাতে খাপ খায় কি না বলতে পারব না। ছেলেটি ফ্লাস্কটা বের করে দিল। আমি ফ্লাস্কটা নিয়ে রেলিঙের কাছে গেলাম। কাছেই একটি শুশুক মাথা তুলে রাত কত হলো একবার দেখে গেল। কোথাও বা মাটি খানিকটা হড়হড় করে খসে পড়ল। নদীর বুকে দূরের বাগিচার থেকে মাদলের ক্লান্ত বোল ভেসে আসছে।
টিকিট দেবার বুঝি আশা নেই। জাহাজ কী জানি কই বালিচরে লেগে ধরেছে। টিকিট মাস্টার বিরক্তিভরে বলল। গেল ভূমিকম্পে বুঝি টিকিট মাস্টারের ঘুমে পাকাপাকি বালিচর বসিয়ে গেছে। চা দোকানির পরিবার খাওয়া দাওয়া শেষ করে উঠল। ছেলেমেয়েরা বাঁশের চাং একটার থেকে দোকানের জিনিসপত্র নামিয়ে শোবার যোগাড়যন্ত্র করছে। সামনের চাঙে গদি ফেলে মাঝবয়সী মোটাগাট্টা দোকানি আরো তিনটি লোকের সঙ্গে ব্রিজ খেলাতে মগ্ন। আমি গিয়ে কাছে পাবার সঙ্গে সঙ্গে একজন বলে উঠল,“দশটা বেজে গেছে,যেতে হবে।” “এই খেল!”—অন্য একজন তাস শাফল করতে করতে বলল।আমাকে কেউ দেখেনি। আমি রসভঙ্গ না করে খেলা দেখতে থাকলাম। হার্ট ওয়ান,স্পেড ওয়ান,ন’ট্রাম্প,টু ক্লাবস,থ্রি ডায়মণ্ডস,ডবল ইত্যাদি বাজি ফুটার শব্দের মতো ফুটতে শুরু করল। খেলা শুরু এবং শেষ হল। শেষ খেলার জন্যে যারা জোর করল সেই পক্ষ,অর্থাৎ দোকানিটিও বেশ ‘ডাউন’ খেলো। তারপরে তিনজনেই যাবার জন্যে পা বাড়াল। বুঝলাম, তিনজনই চা-বাগানের কর্মচারী। রাতে এখানে ব্রিজ খেলে।
দোকানির স্পেডের মত হয়ে পড়া মুখখানা দেখে বেশ মায়া হচ্ছিল। এবারে আমাকে লক্ষ করল। “আপনার কিছু চাই
কি?”, বড় নম্র স্বরে জিজ্ঞেস করল।
“চা লাগছিল,দিতে পারবেন কি?” শোবার আয়োজন করা ছেলে-মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“নিশ্চয়!আজ মনে হয় জাহাজ আসবেই না!”
ছোট্ট একটি ছেলে ইতিমধ্যে ঝাঁপ দিয়ে এসে কাছে দাঁড়ালই, “এক কাপ?”
আমি ফ্লাস্কটা ছেলেটার দিকে এগিয়ে দিলাম,“ তিন।”
“অ! আপনার পরিবার আছে?” চাহ-দোকানি বলে গেল,“কিছু অসুবিধে হলে জানাবেন।খাওয়া-দাওয়া করতে চাইলেও সব সুবিধে করে দেব।রাতেও চা,গরম পানি কিছু লাগলে নিয়ে যাবেন।”
বড় মোটাগাট্টা শ্যামবর্ণের মধ্যবয়সী মানুষটি।মুখে একটি কোমলতা আছে।কথাতে আন্তরিকতার সুর। দুইএক কথাতে টের পেলাম ছেলেমেয়েগুলোর মা নেই। ওদের নিয়েই ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে ছোট্ট সংসার বসিয়ে আছে।
পৃথিবীর মানুষগুলোকে এতো ভালো লাগছিল।এত আদর,স্নেহ, সহানুভূতি। মনটা ভালো লাগল। ধন্যবাদসূচক কথা-বার্তা দু-চারটা বলে চায়ের দাম দিয়ে বোটে ফিরে এলাম,প্রায় একঘণ্টার মাথায়।টিকিট মাস্টারের থেকে বুঝলাম,জাহাজ আসবার আশা নেই।এলেও আসবে সেই ভোর রাতে। দুই সারি চা-বাক্সের মধ্য দিয়ে সংকীর্ণ পথ দিয়ে আমাদের জায়গার দিকে এগোলাম।
চাল-ভাজা পার্টিটি নাকে মুড়ি ফোটাচ্ছে। নেপালি পরিবারটির গান তখন সপ্তমে ওঠা কানে পড়েছিল।এখন সেটিই অষ্টমে পৌঁছে আড়মোড়া ভাঙ্গছে আর দীর্ঘ হাই তুলছে।
‘ফিল্ম ম্যাগাজিন’খানাও আরামে আমাদের ছেলেটির বুকে শুয়ে পড়েছে। বেচারা রাতের জন্যে এক সঙ্গী পেয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হয়ে পড়েছে। দিদিটি শিওরে আমার জন্যে পথ চেয়ে বসেছিল নিশ্চয়। আমার দেখা পেয়ে,ধীরে ধীরে ওকে জাগালো,“বরুণ,চা খাবি না?” স্বরে অনাবশ্যক ব্যস্ততা নেই,কাজে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। বুঝলাম আত্ম-বিশ্বাস তার আছে যেমন,তেমনি অন্যের উপরও আস্থা রাখে। আমার সংকোচ অনেকটাই কেটে গেল।
“বরুণ”,আমি ডাকলাম। তিনজনেই চা খেতে বসে গেলাম।মাটির গ্লাস তিনটা দোকান থেকেই এনেছিলাম।তারা সুটকেস থেকে নারকেলের নাড়ু আরো দুই এক প্রকার খাবার জিনিস বের করল। আমি আমার ভাগটি নিয়ে খানিক সরে যাবার চেষ্টা করতেই আপত্তি উঠল। বাধ্য হয়ে যেখানে বসেছিলাম,সেখানে বসেই খেলাম।
“তোমাদের বিছানাখানা ভালো করে পেড়ে নাও বরুণ,মশারিও টানিয়ে নাও। তোমরা ভালো করে শুতে পারবে।”
“জাহাজ আসবে না?” আমার মনে হলো দু’জনেই একসঙ্গেই বলে উঠেছিল।
“কী হবে বরুণ?” বড় চিন্তাতে পড়ে দিদি জিজ্ঞেস করল। চিন্তা যে মানুষকে সুন্দর করে তুলতেও পারে আগে হলে
বিশ্বাস করতে পারতাম না। কিন্তু এতো যে চিন্তা হলো?
“খুব কি জরুরি কাজ আছে,বরুণ? যোরহাটে?” হঠাৎ মুখের থেকে বেরিয়ে গেল কথাগুলো।
“কাল যে করেই হোক যোরহাট গিয়ে পেতে হবে।” এইবার সরাসরি দিদিই আমাকে জবাব দিল,অবশ্য মাথা নুয়ে।
“কালকের ব্যবস্থা কাল ভাবব,তাই না বরুণ?” আমার কথাতে বরুণ একটা বড় সমর্থন পেল।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। মিছেমিছি দিদি কীসব যে ভাবে। ‘থাকবি না’ বলে লিখেছে। তুই তো মাইনর পাস,‘থাকবি না’ মানে জানিস না বুঝি?”
“কিন্তু ‘কাম শাৰ্প’ যে?” ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অল্প লজ্জা মাখানো হেসে বলল।
“জামাইবাবু কেমন মানুষ জানিস না? সামান্য মাথা ব্যথা একটা হলেও মরব কি বাঁচব বলে তোর খবর করে। সে জন্যেই ‘কাম শাৰ্প’।”
মমবাতির আলোতে দেখলাম পুরো মুখখানা অপূর্ব লাল হয়ে পড়েছে। ‘থাকবি না,‘কাম শাৰ্প’ ---কীই বা রহস্য ঢুকে আছে কথা ক’টিতে!
“কোনো অসুখ কি?”
“জামাইবাবুর সাইকেল এক্সিডেন্ট। হাসপাতালে আছেন,টেলিগ্রাম পাবার দুদিন হল,আমি ছিলাম না।স্কুল বন্ধ হওয়াতে কাল এসে পৌঁছেছি।বাগানে পাতার সময়,সিজন টাইম।বাগানের পাতার সময়, সিজন টাইম, বাবাও ছুটি নিতে পারেন না।”
আমি বারে বারে অনুরোধ করবার ফলে বরুণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিছানা পাড়ল। বড় যত্নে মশারিটাও তিন কোণা করে টাঙানো হল। দিদি বিনা বাক্যব্যয়ে শুয়ে পড়ল। দু-চারটা কথার থেকে বরুণদের বিষয়ে অল্প-স্বল্প জানতে পারলাম। আমার এড্ৰেসটাও লিখে নিল। অল্প পরে বরুণও শুয়ে পড়ল।
ব্ৰহ্মপুত্রের ওপাড়ের কাজিরাঙার অন্ধকারের মধ্যে একটা বাঘ শিকারের পথে ঘাপটি মেরে বসে আছে (নিশ্চয়!) দূরের বালি চরে। কাশ আর ঝাউবনের ফাঁকে ব্রহ্মপুত্রের কালো বিস্তৃত জলধারাতে এক একটা রহস্য শুয়ে শুয়ে জ্বলছে নিভছে। তারাগুলোও দল বেঁধে আকাশ থেকে নেমে রহস্যটা কী,উঁকি দিয়ে দেখছে। বোটের খুব কাছেই পাড়টিতে বসে জট বাঁধা চুলে জনা কয় ধোপানী মেয়ে কাপড় কাচছে,‘চপ-চপাৎ’ । ধ্যাৎ! ঢেউগুলো হে!
ছেলেটি অর্থাৎ বরুণ টাউনের হাইস্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ে। বাবা,কী নাম যেন বলল? চা বাগান একটিতে টি- হাউসে কাজ করে। হেড টি হাউস? হবে,সেরকম কিছু। দশ মাইল দূরে ঘাটের থেকে।দিদির বিয়ের দেড় বছর হল।
এক সপ্তাহ না হতেই ডেকে পাঠিয়েছে।সামান্য আঘাত। কিন্তু ‘কাম শাৰ্প যে’! না দেখে থাকতেই পারে না।বড় মিল দুটিতে…। আজকের রাতটি যদি দেড় বছর আগেকার হত। আর আমারও তো এখন সাইকেল এক্সিডেন্ট হয় নি… ধেৎ!
মোমটা বাতাসে নিভে গেল । অন্ধকারে ভালো লাগছিল, কিন্তু উচিত হবে না যেন মনে হল। দিয়াশলাইটা জ্বাললাম । আধা খাওয়া মিক্সচার একটা পেয়ে সেটিই জ্বালিয়ে মোমটার দিকে জ্বলা কাঠিটা এগিয়ে নিচ্ছিলাম।চমকে গেলাম।দিদির গলা--- “ অন্ধকারেই যদি ঘুম আসে ।”
“শোও নি?”
“চিলমিল। ঘুম আসেই না দেখছি।”
স্বাভাবিক। মোম জ্বাললাম না। রেলিঙে ভর দিয়ে জাহাজ আসা দিকটায় স্থির তাকিয়ে থাকলাম গিয়ে। মোমের আলোতে হবে না,জাহাজের আলো আনতেই হবে।কত সময় সেরকম ছিলাম,বলতে পারব না। হঠাৎ হুলস্থূল শুরু হয়ে গেল । জাহাজ,জাহাজ,আলো ইত্যাদি শব্দের সঙ্গে সঙ্গে টিকিটের ঘণ্টা আর পা চালানোর দুপ-দাপ শব্দ।আমি তাড়াতাড়ি করে মোমটা জ্বালিয়ে দিলাম। দিদি উঠে বসল, দুই হাতে ধাক্কা দিয়ে বরুণকে জাগালো । বরুণও চকমক খেয়ে উঠে বসল ।
“জাহাজ এসেছে বরুণ।” যেন বহু হুলস্থূল আর অপেক্ষার শেষে ‘ছেলে একটি জন্মেছে’ --- এমন একটা সংবাদই দিলাম। আমি ওকে বিছানা বাঁধতে বলে টিকিট আনতে গেলাম।
টিকিট-মাস্টারের মুখখানা দেখেই বুঝলাম কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। জাহাজের থেকে সিগন্যাল পেয়েছে,মেরামতি করতে হবে।ফলে টিকিট দেরি করে দেবে। খুড়িয়ে খুড়িয়ে জাহাজটি কাছ চেপে আসছে। বরুণ এসে অল্প পরে আমার কাছে দাঁড়ালো। খবরটা দিলে,দিদিকে বলতে আবার ফিরে গেল।
রাত ভোর হয়ে এসেছে।
***
পাড়ের দিকে নেমে গেলাম।কিছু একটা ব্যবস্থার কথা ভাবতেই হবে।এদের আজ যোরহাট যেতেই হবে। প্ৰাতঃকৃত্যাদির পরে কড়া করে চা এক কাপ খেয়ে তন্দ্রাটুকু ঝেড়ে ফেললাম ৷ গরম লুচি ভাজিয়ে ভালো করে তিন কাপ চা করালাম। জাহাজ এলো আর দু-একজন যাত্রী নামল। দেখলাম বরুণ আর একটি ছেলে পাড়ে নেমে আসছে।
“দাদা দাদা!মামু এসেছে।জাহাজে এসেছে যোরহাট থেকে।দেখুন,আমি না বলছিলাম,চিন্তার কোনো কারণ নেই বলে!”
মামু রাতের ঘুম ক্ষতি করে এসেছে, কালো পড়ে গেছে। দিদির সম্পর্কিত দেবর, বরুণের প্ৰায় সমবয়সী বা অল্প বড় হবে।
“যোরহাটের খবর কী?” মামুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম,বরুণই টপ করে উত্তর দিল,“ভালো,আমাদের যেতে দেরি হওয়াতে নিতে পাঠিয়েছেন ।”
“নিতে কেন?”
“যায় যদি নিয়ে যাই। না হলে আমিই কিছু ঘোরা ফেরা করে যাই, এই বলে এলাম।” এবারে মামু বলল ।
“তাহলে এখন কী করবে?”
“বৌদি যেতে চাইছে,যেভাবেই হোক।সুতরাং নাও ভাড়া করে যোরহাটের প্রথম বাস ধরব।জাহাজ বালিতে লেগেছিল, কিছু একটা খারাপ হয়েছে।মেরামতি করলে তবে যাব।ফলে জাহাজে গেলে দেরি হবে।”
“তাহলে বরুণ,দিদির স্নানাদি করবার ব্যবস্থা করে দাও গিয়ে। যাও। আমি চা নিয়ে যাচ্ছি।”
বরুণ হাতের ফ্লাস্কটি আমাকে দিল,দুজনেই ফিরে গেল ।
ওদের ঘণ্টাখানিক সময় দিয়ে দোকানির ছেলে একটির হাতে চা-জলপান নিয়ে বোটে যখন গেলাম,বরুণের দিদি স্নান টান করে মামুর সঙ্গে মনের আনন্দে কথা বলছে। রাতের চিন্তার ছাপ মুখে নেই ।
“তোমাকে প্রথমে দেখে আমার বুকটা একেবারে কেঁপে উঠেছিল।”
“ বললাম না, না যাও যদি বাগানে ফিরে যেতে পারো।”
“না না,আমাকে রেখে তোমরা দুজনে এসে যেও।তুমি এলে,ভালোই হল। কাল রাতে এক ভদ্রলোক আমাদের বড় উপকার ….।”
আমি এসে উপস্থিত হয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি করে ঘুমটা আরো খানিকটা টেনে নিয়ে লাজে লাল হয়ে গেল।
“বরুণ কই গেল ?” আমি মামুর দিকে তাকালাম ।
“হাত মুখ ধুতে গিয়ে আসেই নি।” উত্তর দিল মামুর বৌদি। সঙ্গে সঙ্গে চা ঢেলে দিতে লেগে গেল। মামু আর আমাকে চাহ-জলপান এগিয়ে দিল।
“আমার জন্যে নয়,আমি এইমাত্ৰ খেয়ে এসেছি।”
“আবার খেতে হবে।”
বাঃ! চায়ের গ্লাস নিয়ে সামান্য সরে এলাম।
“নৌকা বন্দোবস্ত করে এসেছি।তাড়াতাড়ি কাজ সেরে ফেলাই ভাল। চা ঠাণ্ডা হবে,বরুণের জন্যে অপেক্ষা না করাই ভালো। তাই না মামু?”
“হ্যাঁ,এখনই। যোরহাটের মটর নটাতে শিলঘাট পেয়ে যাবে।”
***
পশ্চিমা মাঝি বরুণ-মামুর গানের সুরে সুরে বৈঠা মারতে শুরু করল।
ব্ৰহ্মপুত্ৰ গঙ্গা মাই,
মথুরা পুরিতে যাই
বাতাসে দুলছে গাঁও
পার লাগিয়ে দাও নাও।
ভাটির টানে নৌকা তিরের বেগে যেতে শুরু করল। বরুণের দিদি আর মামুর বৌদির দিকে (আমার? আমার কী?) তাকালাম। একান্ত মনে বরুণদের গান শুনছে। গানের বোলে তালে তালে মুখে লেগে থাকা হাসিটাও নীরবে উঠানামা করছে। আর সিঁদুরের ফোটাটা! কী টগমগে লাল আগুনের টুকরো সেটি! ভোরের রোদে মুখের রং কাঁচা সোনার--- না কাঁচা হলদির মতো হয়ে পড়েছে। সোনার বরণ প্রাণহীন।
একটি সুখী বাড়ির ছবি। শাশুড়ি,শ্বশুর,দেওর,‘তোকে না দেখে থাকতেই পারে না যে’ একজন স্বামী। সেই জন্যেই ‘কাম শার্প’,‘তুই তো মাইনর পাস,‘থাকবি না’ মানে জানিস না বুঝি?’,‘আবার খেতে হবে …’!
আমার বাগানে বাগানে চাকরি খোঁজে বেড়ানো ভেগাবণ্ডের জীবনের বহু দিনের ভেতর একটা দিন, বহু রাতের ভেতর একটা রাত এসেছিল,— নৌকা যতই শিলঘাটের কাছে চেপে আসছিল, ততই মনটা খা খা করতে শুরু করছিল।
হঠাৎ চোখে পড়ল বরুণের দিদির ফোটাটি রক্তের মতো টগমগ করতে শুরু করেছে। নৌকার থেকে মাথাটি অল্প হেলে দেয়াতে ঢেউর প্রতিবিম্বগুলো মুখের উপর দিয়ে চিকমিক করে পার হয়ে গেল। ঢেউতে যেন ফোটাটি ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়ে যাবে।
নৌকা ঘাটে চাপল। শিলঘাট।
চা-পর্ব শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে মটর এসে গেল।সরকারি বাস—ঘড়ি ধরে চলে। এইখানে আমাদের ছাড়াছাড়ি। বরুণ আর দিদি মটরের সেকেন্ড সিটে বসল গিয়ে। বরুণের মুখে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ।
“কখনো বা যোরহাট গেলে দিদির ওখানেও যাবেন,ঠিকানা মনে আছে তো?” বরুণের দিদিও আন্তরিকতাপূর্ণ
দৃষ্টিতেই বরুণ থেকে বেশি কথা বলে ফেলল ।
“আর কাঠনিবারি ঘাট দিয়ে যাওয়া পড়লে আমাদের বাগানের বাড়িতে যাবেনই ।”
মৌখিক ভদ্রতা মাত্র নয়,অন্তরের আহ্বান। মটর হর্ন দিল। দিদি আস্তে করে দুই হাত কপালে তুলে নমস্কার জানালো। প্রতিনমস্কার করলাম। কিন্তু মামু?
মামু চায়ের দোকান থেকে উঠেই নি।ড্রাইভারকে বলে চা দোকানে গেলাম,মামুকে পাঠাতে।মামু সিগারেটে সিলাই-কল চালাচ্ছে।
“মটর যাচ্ছে যে,মামু!”
সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে মামু বসার থেকে উঠে দাঁড়াল,
“বড় ভাল লাগল আপনাকে পেয়ে …।” উত্তেজিত ব্যস্ততাতে মামু আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
“আবার কখনো দেখা হবে। মটর যাচ্ছে যে,এখন যাও।”
একরকম ঠেলাই মেরে দিলাম।আবার হর্নের শব্দ।উত্তেজনায় ঘেমে গেছে মামু।
“যাই, যাই কী করে? দাদার মটর এক্সিডেন্ট হে— পরদিনই সব শেষ! আমি তো অভিনয় করে আসছি।”
মামু ঝাঁপ দিয়ে মটরে উঠল গিয়ে ।
মটরের চাকা ক’টি দ্রুত ঘুরে কামাখ্যা পাহাড়ের ভাঁজে অদৃশ্য হয়ে গেল।
প্ৰথম প্ৰকাশ: রামধেনু, ৯ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, জ্যৈষ্ঠ ১৮৭৮ শক (১৯৫৬ সন)
শব্দার্থ:
১) লাওপানিঃ জনজাতিদের ঘরে তৈরি মদ
২) বরপেরা: সেকেলে বক্সখাট । বাংলাতে সিন্দুকই বলে। কিন্তু সিন্দুক বললে তাতে যে বাসনপত্র রাখা যেত, আর উপরে
শোয়াও যেত তা বোঝা যায় না বলে মূল অসমিয়া শব্দটি রেখে দিলাম।
৩) ফ্লেট: জাহাজ না নৌকার পাটাতনের সম্প্রসারিত অংশ , যার উপর দিয়ে পাড় থেকে জাহাজে যাত্রী উঠানামা করে।
৪) দোলাই: এক বিশেষ গড়নের অসমিয়া পোশাক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন