“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ৪ জানুয়ারী, ২০২১

সিঁদুর

  ।। জয়শ্রী ভূষণ। ।

 

 

…..নেক দিন পর এমন আজব কথাকেও খুব গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে জুঁই। সাধারণত জুঁই ওসবের ধার কোনদিনই ধারেনি। আজকাল তো  এই শব্দগুলো শুনলেই গা রিরি করে। এক ধাক্কায় মনে হয় জীবন বই এর পাতা একের পর এক উলটে যাচ্ছে। সব ভুলে থাকতে চায়। একেকটা শব্দ যেন ঝড়ের মত হঠাৎ করেই সব তোলপাড় করে দেয়।

 

…..অনেকদিন পর, আবার যেন হঠাৎ করেই কেমন একটু ভাবুক, ইমোশনাল নস্টালজিক সব হয়ে পড়ছে।…...যেদিন লাস্ট রাগ করে ফোনটা কেটে দিয়েছিল, অনেকদিন হবে, কয়েকমাস তো হবেই, উল্টোপাল্টা কথা শুনলেই মোবাইল কেটে দেয়। আসলে রাগে রিরি করে, কী করবে বুঝতে পারে না। সেদিনও কী কথায় রাগ করেছে মনেও নেই। আজকাল আরও বেশি বদমেজাজি হয়েছে। এরপরও অনেকবার ফোন করেছে কিন্তু নিজেকে নিয়ে অযথা আবদার দাঁত চেপে সহ্য করলেও, দেশ রাজনীতি নিয়ে জ্ঞান এক্কেবারেই সহ্য হয় না। কাঁচের ঘরে বসে শীতল হিমেল হাওয়ায় এসি রুমের এসব জ্ঞানদান এক্কেবারে মাথা গরম করে দেয়। 

 

   আজকাল আবার হঠাৎ করেই একদল নব্য রাজনীতিবিদ। তারা দেশ, অর্থনীতি খুব বোঝে, শুধু বোঝেই না সবাইকে বোঝানোটাতেই জুঁই এর প্রেসার হাই হয়ে যায়। যাহোক  এসব নিয়ে ভাবতে চায়না, তাই দুম করে ফোন কাট । জাহান্নমে যাক চুলোয় যাক সব। এমন ভাবেই নিজেকে নিয়ে এলোমেলো থাকার প্রয়াস খুব করে আজকাল। যত্তসব, কেন যে ফোন করে আর জুঁইও যে কেন ফোন ধরে। আসলে ওই যে মনের ভেতরে বিবেক মশাই বসা। সেই বিবেকই যত নষ্টের গোঁড়া।  জুঁইকে সব সময় খোঁচাতে থাকে। সব কিছু নিয়ে ব্যাটা বিবেক তোর অত মাথাব্যথাটা কেন রে ।  মাঝে মাঝে নিজের মনকে গাইগুই করে গুঁতো মেরে বিবেক ব্যাটাকে কাৎ করার চেষ্টা করলেও এই পাজি বিবেক সব সামলে ঠিক আবার আসবে পেছন পেছন। তাই জুঁই এর হয়েছে মহা জ্বালা।  সব কিছুই ওকে ভীষণ ভাবায়। 

 

….সবাই বলতো, বলতো কি এখনো বলে, খুব ঈর্ষণীয়, স্মার্ট, সুন্দরীতাতে কী সেটা জুঁই এর বোধগম্য হয় না। যখনই কেউ এমন প্রশংসা করে, মনটাকে নিয়ে বিবেক সোজা জঙ্গলে। জুঁই শুধু হরিণের ছবি দেখতে পায়। যে হরিণ দেখলেই, শুধু হরিণের কথা না, যে কোন সুন্দর পাখি,পশু দেখলেই মানুষের মুখে এক কথা " হেভভি টেস্টি হবে রে"।  মানে, বলে লাভ নেই এত সুন্দর পশু পাখি দেখলেই জিভে জল চলে আসে কী করে আজ অব্ধি জুঁই বুঝে উঠতে পারলো না। এই হয়েছে আর এক জ্বালা, জুঁইও নিজের প্রশংসা শুনলেও ওদের জিভের জল যেন দেখতে পায়। এই করতে করতে প্রশংসা গ্রহণ করা প্রায় ভুলেই গেছে মেয়েটি। এমন মুখ কাটা সে, অনেককে তো সোজাসাপটা প্রশ্নই করে বসে- " আচ্ছা বলুন তো হরিণ দেখলে কোন কথাটা মনে হয়, অবশ্যই উত্তর আসে হরিণের মাংস যায়ায়ায়ায়ায়ায়া স্বাদ। সব সময় না তবে এক আধবার বলেছে প্লিজ আমি হরিণের মাংস না" বলেই হো হো করে হেসে উঠা। মনে মনে হয়তো রেগে-মেগে লাল হয়ে বমি ভাব করছিল,তবুও হেসে যদি একটু বোঝানো যায় সেই অদম্য চেষ্টা।ওসব আজকাল একটু কম করেই করে, আজকাল শুধুই চুপ করে শ্যেনদৃষ্টি প্রদর্শন করে।  যাই হোক যা বলছিলাম এই যে এত গৌরচন্দ্রিকা  শুধুমাত্র একটি শব্দ "সিঁদুর" নিয়ে, সত্যি আজ জুঁই এর কেন যেন মনে হচ্ছে এই শব্দ নিয়ে এত ভাবাভাবির কি কোনও  প্রয়োজন আছে আজও। 

...জুঁই এর বিয়ের প্রায় দশবছর হতে চলল। খুউউব সুন্দর ফুটফুটে ছয় বছরের একটা মেয়ে আছে ওর। অনেক নাম আছে কিন্তু জুঁই কেন জানি "জান"  ছাড়া কিছুই ডাকতে পারে না। এনিয়ে বাড়িতে অনেকেই অনেক কিছু বলে। আসলে এই মেয়েটির জন্যেই জুঁই বোধহয় বেঁচে আছে। সত্যিই জানের টুকরো মিষ্টি মেয়েটি। এই বাচ্চা মেয়েটি জুঁই এর জীবনের অনেক না পাওয়ার স্বাদ মিটিয়ে দিয়েছে।  দশ বছর, হ্যাঁ দশটি বছর পেরিয়ে এসেছে। একেক সময় জুঁই ভাবতে বসলে শুধুই কাঁদতে থাকে অন্ধকার ঘরে। আসলে এই পাওয়া না - পাওয়া গুলো সবই ভার্চুয়াল।  এই যেমন ভালোবাসা এটা যদিও দুর্লভ কিন্তু কেন জানি না এই পৃথিবীতে ভালোবাসাও আসলে ভার্চুয়ালই। জানকে পেয়ে জুঁই আসলে রিয়েলিটির স্বাদ পেয়েছে। ছোটবেলা পড়েছিল ফুল আর শিশু এই দুই নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর। সত্যি তাই। তবুও মাঝে মাঝে মনখারাপের দল হানা দেয়,ঝড়ের মত এলোমেলো করে দেয় মনের ভেতরের কষ্টগুলোকে। জুঁই প্রায় ১৫ বছর হলো এয়ারপোর্টে অথরিটি ডিপার্টমেন্টে   প্যাসেঞ্জার সার্ভিস  বিভাগের অফিসার হিসেবে দায়িত্বে আছে । কত রকম মানুষের সাথে কত ভাবে পরিচয়।  কিন্তু ঘরে সেই ভারতীয় নারী তার চিরাচরিত পুরুষতান্ত্রিক প্রথায় অসম্মানের বোঝা কাঁধে নিয়ে অনবরত ব্যতিব্যস্ত। বিয়ের আগে এই সমস্যা ছিল না। বাপের বাড়িতে জুঁই নিজেকে কখনোই মেয়ে বলে ভাবারও সময় পায়নি। এখন ভাবলে অবাকই লাগে। বাবার সমান কাকু পিসিদের সাথে মতের মিল না হলেই সেই চিল চীৎকার দিয়ে ঝগড়া। আরে ছোট হয়েছি বলে কি নিজের মত জাহির করবো না। অনেক সময় ভুল হলেও চিল্লি দিয়েই বিজয় ধ্বজা উড়িয়ে দিত। পরে অনেক বার এজন্য আড়ি করে থাকতো বড়রা। সেই আড়ি ভাঙ্গতে দুই কাপ চাই যথেষ্ট ছিল। তবে নিজের ভুলটাও মাথায় হাত বুলিয়ে বাবা কাকা পিসিরা বুঝিয়ে দিতেন। সেই বাড়ির মেয়ে যখন বিয়ের পর জানতে পারলো, মেয়ে আসলে একটা চাবি দেওয়া পুতুল, বিশেষ করে বাড়ির বৌ। রেগেমেগে কাই হয়ে গেছিল। শোভন বিয়ের পরেই যেন এক অন্য মানুষ হয়ে গেছিল। পরে আস্তে আস্তে জুঁই বুঝতে পেরেছিল, এই বাড়িতে বিয়ে করে আনার জন্য প্রথম যোগ্যতা ছিল ওর চাকুরী। তারপর তার চেহারা এবং বাকিসব। এই বাকি সব কিছুর জন্য গোটা শ্বশুরবাড়ির মানুষের নাকি সম্মান হানি হতো। প্রথম প্রথম বিয়ের পর বৌ রা নাইটি পরে না, জোরে কথা বলে না, কথার মাঝে কথা বলে না, সব ব্যাপারে বড়দের মাঝে নাক গলায় না, শুনতে শুনতে কান কপাল ঝালাপালা হয়ে গেছিল। কিন্তু বাইরে থেকে শোভনের সাথে মেলামেশা করলে কিন্তু এগুলো বোঝা একেবারেই অসম্ভব। এমন একটা পরিবারে এসে জুঁই যেন অথৈ জলে পড়েছে  বলে মনে হচ্ছিল।  সেই সাথে উপরি পাওনা চড় থাপ্পড়, মাঝে মাঝে ঘুষি। যে মেয়ে বাপের বাড়িতে কারও হাতে কখনো একটা কানমলাও খায়নি, তার মানসিক অবস্থা কী রকম হতে পারে অবশ্যই অনুমানযোগ্য। এসব বাপের বাড়িতে কী করে বলবে, এতো নিজের লজ্জা, সেই লজ্জায় নিজে কুঁকড়ে থাকতো। এক সময় ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিল জুঁই। সেই সিদ্ধান্তের নিকুচি করতেই জুঁই এর জীবনে এল জান। মেয়ের জন্ম দিয়েছে বলেও শাশুড়ি কম কথা বলেননি। পাশে বসে শোভন চুপ করে শুনে গেছে ওর মায়ের কথা। তবে সেদিন জুঁই হঠাৎ করেই চীৎকার করে উঠেছিল শাশুড়ির উপরে। আপনার লজ্জা করে না, ঘেন্না হয় আপনাকে দেখে আমার। আপনি আপনার মায়ের পেটে থাকার সময় আপনাকে নিয়ে এই কথা শুনতে কী রকম লাগবে আপনার। কেন জানি না সেদিনের পর থেকে শোভন এবং শাশুড়ি দুজনেই চুপচাপ হয়ে গেছিলেন। সেই সাথে জুঁইও চুপ হয়ে গেছিল আরও। জানের জন্মের পর বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছিল ডিভোর্সের কিন্তু সামাজিক ভাবে তাদের সম্মানহানি ঘটতে পারে এমন কাজ তারা কখনোই হতে দেবে না। সেই থেকেই আস্তে আস্তে জুঁই আবার যেন নিজের দিকে ফিরে তাকাবার প্রয়াস শুরু করলো। নিজের মত করে বাঁচার এক আন্তরিক প্রয়াস বললে ভুল হবে, এ যেন এক অন্যরকম যুদ্ধ। আস্তে আস্তে সব সয়ে এল, জুঁই আজকাল শাখা সিঁদুর কিছুই পড়ে না। আজকাল শোভনও অনেকটা অন্যরকম। মেয়ে বলতে অজ্ঞান। জুঁইকে নিয়েও অনেকটাই সহজ হয়েছে। তার পেছনে একটা কারণ অবশ্যই কাজ করেছে। সামাজিকভাবে জুঁই এর গ্রহণ যোগ্যতা অনেকটাই বেশি। এই যে মেয়েদের সামাজিক পরিবৃত্ত পরিধি, এটা থাকা খুব দরকার। জুঁই অবশ্য হিসেব করে এগুলো করে নি। কিছুটা নিজেকে বাঁচানো, আগলে রাখার জন্যেই মানুষের সাথে মেলামেশা বাড়িয়ে দিয়েছিল। আসলে ঘরে আসতে ভয় পেত কিছু বছর আগেও। আজ কি অশান্তি হবে। কী কারণে ঝগড়াঝাঁটি হবে। আস্তে আস্তে জুঁই একটা জিনিস বুঝে গেছিল, নীরব থাকাও একটা বিশাল প্রতিবাদ। নীরবতারও একটা ভাষা আছে, শব্দ আছে। সে সারাক্ষণ নিজের সাথে কথা বলত। এই করতে করতে জুঁই আবিষ্কার করলো সে আর একা নয়। তার এক অন্য সত্তা আছে যে ভীষণ ভাবে তাকে আগলে রাখে,বন্ধুর মতো পাশে আছেভালো মন্দ বিচার করে। সেই কবে থেকে জুঁই এর বন্ধুত্ব হয়ে গেল বিবেকের সাথে সে নিজেই জানে না। আজকাল সে এক উড়ন্ত পাখি খোলা আকাশে। সব কিছুকে মানিয়ে নিয়ে সব বাঁধা পেরিয়ে আজ সে আবার নিজেকে নিয়ে, নিজের ভালো লাগা, নিজের শখ, নিজস্বতা নিয়ে এক আপ্রাণ প্রয়াস করে ভালো থাকার। আসলেও ভালো থাকাও একটা আর্টশিল্প। যে কোন খানেই নিজের মত করে বাঁচাটাই হচ্ছে জীবন যাপন।  বাইরে থেকে দেখে  মনে হওয়া ভালো থাকা মানুষগুলো আসলে ভেতরে ভেতরে কোন না কোন ভাবে অনবরত হোঁচট খেয়ে যাচ্ছেই, জুঁই এই ভেবেই সব মানিয়ে নিয়েছিল,যে সবার জীবনেই কিছু না পাওয়া থেকে যায়, একেক জনের একেক রকম। নিজেকে  বদ্ধ খাঁচায় পুরে দিয়েছিল , কিন্তু  আবার কখন যেন সেই খাঁচার দরজা খুলে আকাশে উড়তে শুরু করেছিল মনে করতে পারছে না। আরে যাহ্ অনেক হাবিজাবি চিন্তার ঢেউ আছড়ে পড়েছে যেন আজ। এই বন্ধ করো বন্ধ করো বলছি, জুঁই ধমক দিয়ে বিবেক ব্যাটার কান মলে দিল….

আজ সকালে যীশুর ফোনটা ধরেই নিল। টেবিলের উপর রাখা মোবাইলটা বেজেই চলছিল। স্ক্রিনে নামটা ভেসে উঠতেই সেদিনের ফোন কাটার কথা মনে পড়ে গেল। তারপরও দু-তিন বার ফোন করেছিল।  আজকাল যীশুও জুঁই এর রগচটা ভাবটা বুঝে গেছে।  তাই ওকে ঘাটায় না। অনেক বোঝায় জুঁইকে, তুই যেমন আছিস তেমন থেকেও আমার সাথে থাক না। আমি যে তোকে ভালোবাসি বুঝিস না কেন। এসব শুনলেই কেন জানি না জুঁই এর হরিণের কথাই মনে পড়ে। সটান ফোন কেটে দেয়, ফোন ধরে না, মাসের পর মাস। অবাক হয়ে যায় যখন আবার যীশুর ফোন বা মেসেজ পায়। মনে মনে বিবেক বোঝাতে থাকে জুঁইকে যা পাচ্ছ তাই নাও না বাপু। অত দেমাক কেন। ঘরের জন তো ফিরেও চায় না। মনের ভেতরের এই সব কপচানি শুনতে শুনতে একেক সময় জুঁই এর মনে হয় সত্যিই বোধহয় যীশু ওকে ভীষণ ভালোবাসে। ইসস এত ধুর ছাই এর পরেও তাই হয়তো ফোন করে মেসেজ করে। সত্যি কি একেই ভালোবাসা বলে, জানি না। ধ্যাৎ  আবার কী সব ছাইপাঁশ ভাবনারা ভিড় করেছে মনে। এই যা যা বলে পাশ কাটিয়ে জুঁই এমনি করেই নিজের কাজকর্ম নিয়েই নিজেকে ব্যস্ত রাখে। তবে আজ যীশুর কথাটা কিছুতেই মাথা থেকে যাচ্ছে না, মানে সরানো যাচ্ছে না কেন যে বুঝতে পারছে না। আর এই জন্যেই হয়তো এত কথার জঞ্জাল জমেছে মনে। 

কিছুদিন ধরেই যীশু জুঁই এর কান খেয়ে নিচ্ছে দুই দিনের জন্য কোথাও বেড়াতে যাবে। এসব জুঁই এক কান দিয়ে শোনে আর এক কান দিয়ে বের করে দেয়। কথায় কথায় অনেক কিছু বলল আজও।  তবে আজ জুঁই একদম সাবধান করে দিয়েছে, শোন জ্ঞান দিবি না, রাজনীতি সমাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা কর, তোর বিদ্যা আমার উপর জাহির করিস না। নাহলে ফোন রাখ। জুঁই যতই ক্যাঁকক্যাঁক করে কথা বলুক না কেন যীশু ততই শান্ত হয়ে বলে আচ্ছা আচ্ছা তুই ক্ষেপিস না বলবো না। এত রেগে যাস কেনো রে। একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে জুঁই, যীশু কখনোই জুঁই এর ব্যক্তিগত বা বিবাহিত জীবন নিয়ে কোন প্রশ্ন তেমন করে না। এই ব্যাপারটা জুঁই এর বেশ লাগে। তারমানে যীশু ব্যক্তি জুঁইকে যথেষ্ট সম্মান করে। এই জন্য এই সব ভেবেই বাকি সব বিরক্তিকে এক পাশে রেখে ফোনটা এখনো মাঝে মধ্যে রিসিভ করে। কিন্তু আজ….যীশু কথা বলতে বলতে  কী বলল….!

এগুলো যীশুর স্বভাব। যতই জুঁই বলে শোন তুই দিদি বলে ডাকিস না কেন রে। বলবে তুই আমার থেকে এক বছরের জুনিয়র আর তাছাড়া তোকে দেখে আমার ছোট মনে হয়। বয়েসটা স্রেফ একটা সংখ্যা। তুই ওসব বুঝবি না। যীশু সেই কবে জুঁইদের বাড়িতে ওকে দেখে হাঁ হয়ে তাকিয়ে ছিল সেই গল্প শোনাতে থাকে। তারপর কবে প্রথম, কয়েক বছর আগে নীল শাড়ি পরা দেখে পাগল হয়ে গেছিল সেই সব শোনাতেইই থাকে। আজ কিন্তু প্রথম বলল- জুঁই শোন না, তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো। ভেবে উত্তর দিবি। তার আগে বল রাগ করবি না। ক্ষেপে গিয়ে ফোন রেখে দিবি না। তাহলেই বলবো। ইসসস তোর কি আমাকে না চটালেই হয় না। এত ইনিয়ে বিনিয়ে ফিল্মি স্টাইলে ভূমিকা বন্ধ করে সোজা কথায় কী বলবি বল, জুঁই বলে উঠলো । যীশু বলল- একদিন আমি তোকে সিঁদুর পড়াতে চাই। দিবি আমায়, শুধু একবার। মনে মনে আবার বিরক্ত হয়ে উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন করলো জুঁই -কী হবে লাগিয়ে ? যত্তসব বলেই জুঁই বলে উঠলো এই যীশু তোর বিয়ের আলাপগুলোর কী খবর রে। যীশুর অবাক করা কথা, আমার মত ছয় ফুট লম্বা এত হ্যাণ্ডসাম ছেলেকে নিয়ে তোর সমস্যা কোথায়, আমি তো তোকে কিচ্ছু ছেড়ে আসতে বলছি না। কাউকে বিয়ে করি আর না করি তুই তো তুইই থাকবি। তোর জায়গা কাউকেই দেওয়া যাবে না। শুধু একবার আমায় তোকে সিঁদুর লাগাতে দিবি। দে না প্লিজ….। যীশুর সিঁদুর লাগানোর এই কথাটা কিছুতেই কান থেকে সরাতে পারছে না। বেজেই চলেছে এক নাগাড়ে। কিন্তু জুঁই সিঁদুর নিয়ে ভাবতে ভাবতে ভাবছে ইসসসসস্ যীশুর মত যদি জুঁইও কাউকে এভাবে পাশে পাবার কথা ভাবতে  পারতো । জুঁই এর কানে ভেসে আসছে কথাগুলো আবার...যীশু ফোনের ওপার থেকে বলছে…..একবার দিবি আমায়, তোকে সিঁদুর দিয়ে দেব শুধু একবার, আমি মনে মনে জানবো আমার একজন আছে শুধু আমার…..। জুঁই বারবার করে বলেছে এই শোন যীশু এই ডিসেম্বরে বিয়েটা করে নে। আর তারপর তোর বৌ এর সাথে আমায় ভালো করে পরিচয় করিয়ে দিবি কিন্তু। তখন চোখে লুকোচুরি খেলবি না কিন্তু...হাসতে হাসতে জুঁই ফোনটা আজও রেখে দিয়েছিল।  কিন্তু অনেকদিন পর সিঁদুরের লাল রঙ যেন চোখের জলে মিশে বেরঙা হয়ে যাচ্ছে। এমন কেন হয়, ভালোবাসা গুলো কেন এমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। শোভন কেন এমন করে কথা বলে না কখনো। ভেতর থেকে বিবেক আবার একটা চিমটি কেটে দিল মাথায়। তোর শিক্ষা হয় না কেন রে জীবন থেকে। যা পাচ্ছিস তাতেই খুশী থাকা শিখতে পারিস নাশোনা তো অভ্যেস কর। সিঁদুর এর এক অন্য মানে যেন আজ যীশু জানিয়ে দিল। জুঁই বিবেককে আজও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে জানকে নিয়ে খেলতে খেলতে ঘুম পাড়িয়ে সকালে অফিসের জন্য সব কিছু রেডি করে বিছানায় শুয়ে চোখ বুজে নিল। বিবেককে একটু হেসে বলল আচ্ছা আচ্ছা এটাই অনেক।  কেউ একজন ভালোবেসে সিঁদুরের মানে বুঝিয়ে দিল। আচ্ছা আচ্ছা আর হয়েছে এর থেকে বেশি কিছু আশা করো না। বিবেককে বলল অনেক হয়েছে বন্ধু, এ জীবনে আমি শুধু আমাকেই ভালবাসব। বাকী সব পরের জন্মের জন্য রইল। 

 

 


১৬/১১/২০২০
শিলচর

( আমার লেখা দ্বিতীয় গল্প। উধারবন্দ এর সমাজ সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক  লিটল ম্যাগাজিন " বৈচিত্র্য"  এর পঞ্চম বর্ষের পঞ্চম সংখ্যায়  প্রকাশিত)

কোন মন্তব্য নেই: