মূল অসমিয়া : মামণি রয়সম গোস্বামী (ইন্দিরা গোস্বামী)
বাংলা অনুবাদ: মনোতোষ চক্রবর্তী
[অনুবাদটি হুমায়ুন কবির ও আতাউর রহমান সম্পাদিত "চতুরঙ্গ' পত্রিকার বর্ষ ৬১ -র ৩-৪ সংখ্যার (কার্তিক-চৈত্র ১৪০৮ বাংলা ) ২২২-পৃৃৃষ্ঠা- তে প্রকাশিত। পাঠক হিসেবে আমাদের মনে হয়েছে কিছু শব্দে মুদ্রণ প্রমাদ আছে, কিছু শব্দের বানান আকাদেমি অভিধান অনুসারে পরিবর্তন দরকার (যেমন কি-র বদলে কী, ভাল-র বদলে ভালো), কিছু শব্দেরও পরিবর্তন দরকার (লেখক অঞ্চল শব্দটি নিজেও ব্যবহার করেছেন, কিছু জায়গাতে খণ্ড ছিল---আমরা অঞ্চল করে দিলাম)। আমরা সেই সব করেছি। --সুশান্ত কর]
(C)Imageঃছবি
অধ্যাপক মীরাজকার ও আমি কাজিরাঙ্গা অভয়ারণ্য দেখে ফিরে আসছিলাম। আমরা দু’জন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় ভাষা বিভাগে কাজ করি। খুব আগ্রহের সঙ্গে আয়োজিত ছাত্রদের এক সভায় আমরা দু’জন নিমন্ত্রিত অতিথি হয়ে এসেছিলাম।
আমরা দু’জন একটি অ্যাম্বাসেডরে গুয়াহাটি অভিমুখে ফিরছিলাম। গাড়িটি ছিল খুব পুরনো। সে জন্যে আমরা দিনের আলোয় ফিরছিলাম যাতে গুয়াহাটিতে তাড়াতাড়ি পৌঁছুতে পারি।
মীরাজকার সাহেবের বাঘ-ভালুকের ভয় ছিল না। কিন্তু সন্ত্রাসীদের তিনি বড় ভয় পাচ্ছিলেন। তাঁর একজন অন্তরঙ্গ বন্ধুকে পাঞ্জাবের সন্ত্রাসবাদীরা গুলি করে হত্যা করেছিল। পথে তিনি আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন:
তোমাদের এই রম্যভূমিতে সত্যি সত্যি সন্ত্রাসবাদের সমাপ্তি ঘটেছে?
আমি এই প্রশ্নটির সঠিক উত্তর দিতে পারিনি।
আসার পথে আমরা বেশ কয়েকটি জায়গায় মিলিটারি চেকপোস্ট পার হয়ে এসেছি। আসার সময় তারা টর্চ জ্বালিয়ে আমাদের তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করেছে। কোন জায়গায় কাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল ড্রাইভারটি আমাদের এই কথা বলছিল।
... অত্যন্ত সুন্দর পথ দিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। দূরের আলোয় ওইগুলি কি বাঁশ? কাজিরাঙ্গার টুরিস্ট লজের বারান্দায় বসে আমি বাঁশ ঝাড় থেকে আসা ঝরঝর শব্দ শুনছিলাম। মনে হয়েছিল কেউ একটা মুগার কাপড়ের থান খুলে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে। ... ছাতিম গাছের বাঁকা হয়ে আসা একটি ডালে খুব একটি ডালে খুব একটা বড় একটা পেঁচা বসে ছিল। জ্যোৎস্নারাতে তার গোল মাথাটি সদ্যোজাত শিশুর গোল মাথার মতো দেখাচ্ছিল।
মীরাজকার সাহেবকে বুঝিয়েছিলাম---গুয়াহাটিতে পৌঁছুতে আমাদের দেরি হলেও আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সন্ত্রাসবাদ আস্তে আস্তে শেষ হয়ে আসবেই। হয়ত হয়ে গেছেও।
... আমরা জাতীয় সড়কের দু’দিকে সবুজের অপূর্ব শোভা দেখছিলাম। দুপুরের সোনালি রোদ যেন একখানা রেশমের কাপড় হয়ে এসে ফুল, ধান, পাতা সব কিছুকেই আরও উজ্জ্বল ও স্বচ্ছ করে তুলেছিল। ধানের খেতগুলি যেন এক উন্মত্ত যৌবনের কাহিনির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল।
মীরাজকার সাহেব মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দূরের পাহাড়শ্রেণীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কোথাও ছায়া পড়ে গভীর নীল ধারণ করা, কোথাও রোদ পড়ে সোনালি পাহাড়ের রূপ ধারণ করা, আর কোথাও আধো আলো, আধো অন্ধকারের রহস্যময় রূপ ধারণ করা পাহাড় যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল।
... তবুও মাঝে মাঝে তিনি উৎকর্ণ হয়েছিলেন।
কী জানি কোথায় তিনি সন্ত্রাসবাদীর বন্দুকের আওয়াজ শুনতে পাবেন। কিছু সময় পর এই ভাবনা তাঁর মন থেকে দূর হল। এই সময় সন্ত্রাসবাদী নেই আমার এই কথা তিনি বিশ্বাস করলেন।
শিমূল, খয়রা, শিশু, হলং, পমা , বগীপমা, বকুল, জাম আর সেগুন গাছে ভরা অরণ্যের পথে আমরা এগিয়ে গেলাম। অস্তগামী সূর্যের শেষ আলো গাছ-গাছালির সারিতে ঢুকে পড়ল। আলোর টুকরো যেন রেশমের একটি চাদরের টুকরো গায়ে জড়িয়েছে সেই ঝড়ের মধ্যে এখন ছোপ ছোপ দাগ দেখা গেল। যেন রোদের নয় হরিণের ফুটকি ফুটকি ছাল গাছগুলি শরীরে জড়িয়েছে। ... রেশমের চাদর এখন হরিণের ফুটফুটে ছাল।
ধানক্ষেতের সবুজ রংও এখন এক অনন্য রূপ নিয়েছে। এই রং কোনোখানে অন্ধকারের আঁচলে কাঁচুমাচু হয়ে ঢুকবার তোড়জোড় করছে। কোথাও রোদের আলোয় গা ধুয়ে যেন পরিচ্ছন্ন হয়ে আছে, কোথাও যেন সোনালি সুতোর সঙ্গে জট পাকিয়ে আছে এই রং, আবার কোথাও যেন এই রং বৌদ্ধ ভিক্ষুর শরীরে কাপড় টানাটানি ক’রে আনার চেষ্টা করছে।
গাড়ি এগিয়ে গেল। ড্রাইভার বলল:
এই অঞ্চলে এখন আর কারও হাতে বন্দুক নেই। গতবার এখানেই গোলাগুলি হয়েছিল।
বন্ধুক নেই? আঃ, একটি মোলায়েম গালিচা যেন সবকিছু ঢেকে রেখেছে। ... ঢেকে রেখেছে বারুদের ধোঁয়া, ঢেকে রেখেছে রক্তের দাগ...!!
মীরাজকার সাহেব বললেন, এই অঞ্চল থেকে বন্দুকগুলি উধাও হয়েছে, যদিও চোরাকারবারিদের হাতে বিভিন্ন ধরনের বন্দুকের আদান-প্রদান হচ্ছে।
কাজিরাঙ্গায় বন-বিভাগের আধিকারিক আহমেদ সাহেব বলেছিলেন, চোরাকারবারীরা পয়েন্ট থ্রি-জিরো, থ্রি-ইউ এস কার্বাইন, ফাইভ হান্ড্রেড ডাবল ব্যারেল, ফোর সেভেন জিরো ডাবল ব্যারেল ব্যবহার করছে। মারিডিফুতে দু’জন চোরাকারবারি ধরা পড়েছে। গুলি খেয়েও মরেছে কয়েকজন।
মীরাজকার সাহেবের বন্দুকের প্রতি একটি জন্মগত কৌতূহল ছিল। তিনি বন্দুক, খার-বারুদ ইত্যাদি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতেন। বইপত্রও পড়েছিলেন। এই বার তিনি প্রথম মহাযুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে এই রকম কিছু বন্ধুক সম্পর্কে কয়েকটি সরস কাহিনি বলতে আরম্ভ করলেন। রমাকান্ত ড্রাইভারও খুব কৌতূহলের সঙ্গে মীরাজকারের কথা শুনল। সে তার অর্ধেক বয়সী। চুল না থাকার জন্য সে মাথায় নেপালি টুপি পরে। ছোটখাটো শক্ত চেহারা। ঘাড়-গলা প্রায় নেই বললেই চলে। চোখ দু’টিও তেমনই ছোট। নাকের নিচে জম্পেশ গোঁফ। সে বিজ্ঞ ড্রাইভার, ক্লাচ ও ব্রেক বেশি ব্যবহার করে না।
দূরের অপূর্ব প্রকৃতির শোভা থেকে কোনও মতেও আমি চোখ সরিয়ে নিতে পারছিলাম না। মাঝে মাঝে মীরাজকার সাহেবের কথা থেকে আমার মন সরে যাচ্ছিল। দূরের বড় বড় ভেলেউ গাছগুলিতে লেগে থাকা শ্যাওলা চোখে পড়ছিল। সেইগুলোকে বানরের শরীরের লোমের মতো লাগছিল। আঃ কত ধরনের গাছ ওইগুলি? কিছু কিছু গাছকে মুগা লতার মতো দেখতে বন্যলতা আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। যেন মাকড়সার জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দি কোনও অর্বাচীন খণ্ডহর। ... আঃ, ওইগুলি কোণ বর্ণের পাতা? কাঁঠাল গাছের পাতার মতো? আর ওই গাছগুলি? পুঁটি মাছের শরীরের মতো পাতা? কিছু কিছু গাছের ভিক্টোরিয়ার ছবি থাকা রূপার টাকার মতো গোলগোল পাতা? কিছু কিছু ঝোপের গাছের পাতা নারিকেল গাছের পাতা আবার অন্য গাছকে ছায়া দিচ্ছে। কী গাছ ? কী গাছ? এইগুলি... আর ওইগুলি? মনে হয় ওইগুলি যেন বিরিণ গাছ নয় মাটিতে খেলা করছে মেঘ।
মাটিতে পড়ে থাকা এই রকম মেঘের খেলা মীরাজকার সাহেবও বহুদিন দেখেন নি। দিল্লির এক বিষম আবহাওয়া থেকে এসে যেন তিনি এক অনুপম স্বর্গরাজ্যে উপস্থিত হয়েছেন। এখানে বন্দুকের শব্দ? হাতিমারা বন্দুক!
পয়েন্ট থ্রি জিরো থ্রি?
ফাইভ হাণ্ড্রেড ডাবল ব্যারেল?
পয়েন্ট ফোর সেভেন জিরো?
ইউ. এস. কারবাইন, উইথ এ সাইলেন্সর।
... না, না এই সব অস্ত্র এখানে থাকা অসম্ভব? দিল্লির আবহাওয়ার সঙ্গে তুলনা করা যায় না এটি এ রকম এক মধুর ভূমি। স্বর্গরাজ্য! দিল্লি আর মানুষ থাকার যোগ্য নয়। আফগান, তুর্কি কবির যমুনা এখন দুর্গন্ধ নর্দমায় পরিণত হয়েছে। মানুষের ভিড়ে সদরবাজার যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। রিং রোডে এক্সিডেন্ট হয়ে পড়ে থাকা মৃত মানুষের শব বাসি হয়ে থাকার মতো অবস্থা হয়েছে।
... আস্তে আস্তে দিনের আলো সম্পূর্ণ নিস্তেজ হয়ে এল। এক প্রকাণ্ড অজগর সাপ যেন নিজের চকচকে ছাল ফেলে অদৃশ্যের দিকে অগ্রসর হতে আরম্ভ করেছে... । দিন সাপ হয়ে অন্তর্ধান করল।
... হুর হুর হুরাৎ... গাড়ি শব্দ করে রাস্তার কিনারে চা ও ডাবের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। রমাকান্ত সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে গেল বনেট খুলে দেখল। রেডিয়েটার লিক হয়ে জল শুকিয়ে গেছে। প্রচণ্ড গরমও হয়েছে। লিকেজ বন্ধ করার জন্য গাড়ি গ্যারেজ নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
আমরা দু’জনেই নামলাম। ... ছোট ছোট কয়েকটি দোকান কাছে থাকায় আমার মন্দ লাগল না। মীরাজকার সাহেব বললেন:
জঙ্গলের মধ্যে খারাপ হলে খুব মুশকিল হত। অন্ধকার হয়ে আসছে। আমিও তাঁর কথায় সায় দিলাম। ইতিমধ্যে রমাকান্ত ওয়ার্কশপের খোঁজ নিতে রাস্তার কিনারের ছোট ছোট দোকানগুলিতে ঘোরাফেরা করতে লাগল।
হঠাৎ দেখলাম জাতীয় সড়কের একটু ভেতরের একটা দোকান থেকে একটি মানবমূর্তি আমাদের গাড়িটিকে লক্ষ ক’রে আসছে। হাতে একটা কেরোসিনের বাতি । ঢিলে পাঞ্জাবি, হাঁটুর গোঁড়ায় ধুতি। পায়ে স্যান্ডেল আছে কি না বোঝা যায় না। ...
তিনি এগিয়ে এসে একেবারে গাড়ির সামনে দাঁড়ালেন। ... আমি ভালোভাবে লক্ষ করে দেখলাম তাঁর চুলের গুচ্ছ দীঘল। খোঁপা করে বেঁধে রেখেছেন। বয়স হয়েছে। সত্তরের চৌকাঠ পার হয়েছেন বলে মনে হয়। ... বাতিটা উপরে তুলে তিনি বললেন:
সম্ভবত গাড়ি ব্রেকডাউন হয়েছে --- ওয়ার্কশপ সাতমাইল দূরে। ... দাঁড়ান আমি গাড়ি একটা দাঁড় করাই। ড্রাইভার গিয়ে ওয়ার্কশপ থেকে একজন মেকানিক আনতে পারবে। এই সময়টুকু আপনারা আমার দোকানে কিছুক্ষণ বসতে পারেন। চা-পান খেতে পারবেন।
এইবার তিনি গিয়ে মাঝখানে দাঁড়িয়ে কেরোসিনের বাতিটি উপরে তুলে ধরলেন। বেঁধে রাখা খোপাটি খুলে কাঁধের উপর চুলগুলি ছড়িয়ে পড়ল।
দীঘল চুল, হাঁটুর উপর ধুতিতে তাঁকে ওঝাপালির ওঝার মতো লাগছে। রাস্তার মাঝখানে গাড়ি থামানোর জন্য তিনি বিচিত্র ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকলেন।
মীরাজকার সাহেব ও আমি শেডের নীচের দোকানটিতে ঢুকলাম। ছোট হ্যারিকেন ল্যাম্প, তা-ও বাঁশের খুটার উপর ঝুলিয়ে রাখা আছে। ল্যাম্পটির চিমনি ফাটা ও মলিন। কেরোসিনের স্টোভ, কিম্ভূতকিমাকার চেহারার একটা সসপেনে আধা করে রাখা চা আর কয়েকটি জং ধরা টিন একটি কাঠের বেঞ্চের নীচে ফেলে রাখা হয়েছে। বেড়ায় সিগারেট ফুঁকতে থাকা চিত্র-তারকার একটি ফটো ঝুলিয়ে রাখা আছে। পেট্রলের গ্যালন, ছেঁড়া কাপড়, নারিকেলের খুলি ইত্যাদি কাঠের বেঞ্চের চৌকোণে ছত্রাখান হয়ে পড়ে আছে। চারিদিকে এক হতাশাজনক দৃশ্য। আমরা দু’জন কাঠের বেঞ্চটিতে বসলাম। আমরা বসার সঙ্গে সঙ্গে কেরোসিনের বাতি একটা নিয়ে একজন বৃদ্ধাও এসে হাজির হলেন। তিনি বললেন :
উঃ ! আজ সারাটা দিন আমি যেন সাগরে মাছ ধরছিলাম। একটাও খদ্দের নেই।
খদ্দের নেই?
আমি বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলাম। বৃদ্ধ বললেন : ওইসব দোকানে খারাপ জিনিসও বিক্রি হয়। আমরা হচ্ছি ভক্ত মানুষ। ওই ধুমপানরত মেয়েটির ছবি এখানে রাখা নিয়ে ছেলের সঙ্গে ঝুটঝামেলা হয়ে গেছে।
বুড়ি এইবার কাঁপা কাঁপা হাতে চায়ের সসপেনটি তুলে নিলেন। বাতি ও সসপেন নিয়ে দোকানের পিছন দিকে গিয়ে সসপেনটি ধুয়ে নিয়ে এলেন। স্টোভটিতে বোধহয় কেরোসিন ছিল না। জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে একটা উগ্র গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
মীরাজকার ও আমি এক কাপ গরম চায়ের অভাব খুব বেশি করে অনুভব করছিলাম। বুড়ি কাঁপা কাঁপা হাতে কাঁচের গেলাস, দুধ ইত্যাদি সরঞ্জাম সাজিয়ে নিচ্ছিলেন দেখে আমার একটু খারাপ লাগল। দুটি বাতির আলোয় এবার বুড়ির পরনের পোশাক-আশাক বড় স্পষ্ট হয়ে উঠল। সূতির মেখলা। পাড় দেওয়া চাদরের এখানে ওখানে সুপুরির পিকের দাগ। ব্লাউজের অনেক তালি। ছিঁড়ে যাওয়া খানিকটা জায়গা দিয়ে বৃদ্ধার শরীরের শিথিল মাংস যেন স্পষ্ট হয়ে পড়েছে। আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম: দিদিমা , এই বয়সে আপনাকে যে এইরকম করতে হচ্ছে, সাহায্য করার মতো কেউ কি নেই?
ছিল, ছিল, সাহায্য করার জন্য আমার বৌমা ছিল। গতবছর বন্যার সময় আমার বড় ছেলেটি মারা গেছে। অজানা এক ব্যাধি হয়েছিল, চিকিৎসা করা হয়নি। ডাক্তাররা ডাকাত হয়ে গেছে কি না। সে মারা যাবার সময় ও অন্তঃসত্ত্বা ছিল। এখন একটি ছেলে জন্মেছে। মেয়েটি খুব দুর্বল। এখানে এসে সাহায্য করা দূরের কথা, পেট ও পিঠ এক হয়ে গেছে। ভালোমতো খাওয়া-দাওয়া তো হয়ই না!
আমি প্রশ্ন করলাম, বাড়িতে আর কে আছে দিদিমা?
দু’টি ছেলে ও দু’টি মেয়ে আছে। তারা স্কুলে পড়ছিল। একটি উগ্রপন্থীদের দলে যোগ দিয়েছে। অন্যটি কোথায় উধাও হয়েছে জানি না। ... অথচ আজ সাত বছর ধরে নদীর উপদ্রব। ভূমি একেবারে গ্রাস করে ফেলেছে। দিদিমা এবার ফিসফিস করে বললেন:
আমার বড় মেয়ে নির্মালির একজন মিলিটারির সঙ্গে গণ্ডগোল হয়েছিল। পাড়ার ছেলেরা তাকে মেরে শরীরের হাড় ভেঙে দিয়েছে। মিলিটারি বেঁচে গেল। দায়ের কোপ একটা কিন্তু খেয়েছে।
... এই সময় হাতে কেরোসিনের বাতি নিয়ে বুড়ো রাস্তা থেকে ফিরে এলেন। তিনি বোধহয়, গাড়ি দাঁড় করিয়ে মেকানিক আনার জন্য ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিয়ে এখন ফিরে এসেছেন। দূর থেকেই তিনি চিৎকার করছিলেন।
ও নির্মালির মা! শ্রান্ত হয়ে আসা পথিকদের নিজের দুঃখের কাহিনি শুনাস না; চা দে চা দে...!
হঠাৎ বুড়ি উঠে গিয়ে বৃদ্ধের কাছে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বললেন:
আজ রেললাইনের কাছে মনোহররা ওকে দেখেছে। বুড়ো আশ্চর্য হয়ে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকলেন। তারপর হালকা করে দেবার জন্য বললেন:
গতবারও মানুষ তাকে রেললাইনের কাছে দেখেছে বলে বলেছিল। এই সব কথায় মন-কান দিস না! ... যা যা কাজিরাঙ্গা দেখে ক্লান্ত হয়ে আসা খদ্দেরদের চা দে!
বিস্কুট আছে না-কি?
নেই, বিস্কুট কোথায় থাকবে? গত সপ্তাহ থেকে চিনি চা-পাতা আনতেই ভাঁড়ার খালি!
মীরাজকার সাহেব ও আমি একসঙ্গে চেঁচিয়ে বললাম :
না-না আমরা গরম চা-ই শুধু খাব।
চা করে একেবারে ঢেলে দেওয়া পর্যন্ত বুড়ি দিদিমা মনমরা ও অসন্তুষ্ট হয়ে রইলেন ও বলতে থাকলেন...
বুড়ো কী চিন্তা করবে! আমি জানি আর কী ঘটবে---হরি হরি আর কী ঘটবে ! বন্যার সাহায্য সমিতি কোথায় মিটিং করেছে...পথের কিনারে দপ্তর সাজিয়ে সরকারি মানুষ থেকেছে... এই মেয়েটি শুনেছিল আজ সাতবছর কত কত জমি খেয়েছে--- সরকারি লোক একজন টাকা একশো দিয়ে খেল খতম করে দিল...
বুড়ো দাদু গর্জে উঠলেন: এই বুড়ি চুপ করে থাক!
সরকারি অফিসারের পায়ে পড়তে লজ্জা করে বুড়োর। বন্যায় নাজেহাল হওয়া মানুষকে দেবার জন্য সরকারের দেওয়া টাকা পয়সা খেয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠা লাঠি নিয়ে তিনি ঘোরাফেরা করতেন... বসতেন দামি কারুকার্যময় গালিচায়... সেই সব পুরনো কথায় মাথা ভার হয়ে আছে... ঠেলে ঠেলে আমি সরকারি মানুষের কাছে পাঠাতে পারিনি---সাতবছর ধরে ভুগছি... আমার অবস্থা দেখে আসবে এবার অন্তত সরকারকে বলবে... কাজিরাঙ্গার জন্তুগুলি দেখলে এলে তোমরা আমাদের গ্রামের মানুষগুলির অবস্থাও দেখে আসবে! বুড়ো দাদু এবার হাতজোড় করে বললেন:
বাবারা , আপনারা মনে কিছু করবেন না... খদ্দের এলেই বুড়ি এরকম বকবক আরম্ভ করে।
বুড়ির দিকে তাকিয়ে এবার ধমক দিয়ে উঠলেন।
দে দে চায়ের সঙ্গে অল্প আদাও থেঁতলিয়ে দে! আদা যদি না থাকে তেজ পাতা দু’টুকরো ফেলে দে...
হঠাৎ আমার চোখ পড়ল বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখা একটা দোতারার দিকে । আমরা বসে ছিলাম যে বেঞ্চে তার পেছন দিকে ঝুলিয়ে রাখা ছিল বলে এতক্ষণ ভালো করে আমার চোখে পড়েনি। বস্তা, টিন, নারিকেলের খুলি ইত্যাদি নানারকম জিনিসের স্তূপের মধ্যে আমি এই দোতারাটি লক্ষ করে আশ্চর্য হলাম। কারুকার্য করা আছে। খুব অল্প করে রাখা বলে মনে হল।
দাদু, এই দোতারাটি কে বাজায়?
প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করার সঙ্গে সঙ্গে একটা ঐশ্বরিক হাসি দাদুর মুখে ছড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ আগেও বৃদ্ধের মুখে যে এই ধরনের হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠতে পারে এ বিষয়ে আমার ধারণা ছিল না। তিনি বললেন:
ডিফলুর পাড়ে যতগুলি নামঘর আছে সবকটিই আমার এই বাদ্য চিনত। ডিফলুর পাড়ের অনেকগুলি নামঘর নদী গ্রাস করেছে, আরিমরাহ, হোলাপার, কোহরার, মিহিমুখ সবকটিই একসময় আমার এই দোতারাটিকে চিনত। ডিফলুর পাড় দূরের কথা ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে একেবারে বেহালি পর্যন্ত মানুষ আমার গানের প্রশংসা করত!
কোণায় পড়ে থাকা একটি বেলনায় আদা থেঁতলাতে থাকা বুড়ি দিদিমা আবার রেগে উঠলেন---
বুড়ো এখন পুরোনো কালের ইতিহাস বলবে। দুইমাস ধরে উধাও হয়ে থাকা ছেলেটি যে খাই খাই মূর্তি ধরে রেললাইনের কাছে দাঁড়িয়ে আছে সে সব কথা, হায়, সে সব কথা বুড়োর ভালো লাগে না।
চুপ থাক, চুপ থাক বুড়ি। দু’গ্লাস চা করতেই এত দেরি করছিস!
অধ্যাপক মীরাজকার মধ্যস্থতা করে বললেন:
আমার কিন্তু একটা গান শোনার খুব ইচ্ছে হয়েছে!
দাদু যেন এই কথা শোনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন।
হ্যাঁ, হ্যাঁ শোনাব শোনাবো, আপনাদের মেকানিক এখনও এসে পৌঁছায়নি, কিছুক্ষণ বসতেই হবে। যত খদ্দের আসে, সবাই আমার গান শোনে... বুড়ি আবার রেগে ধমকে উঠলেন---
গত সপ্তাহ থেকে খদ্দের আসেনি বললেই হয়। দেখলেন তো কতগুলি গাড়ি পার হয়ে গেল! বুড়োর দিকে তাকিয়ে আবার বললেন: আমি খদ্দেরদের চা দিচ্ছি। আপনি বাতিটি নিয়ে রেল লাইনে গিয়ে দেখে আসুন। গল্প করতে আর গান গাইতে বসলে বুড়ো আর উঠবেই না।
রাখ! রাখ! বুড়ি! গতবারও কে একজন বলেছিল না সে রেললাইনে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করছে?
বুড়ির হাত থেকে গ্লাস দুটো নিয়ে দাদু সাবধানে আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন। একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে দাদু বললেন:
চাটুকু খেয়ে নিন। আমি গান শুনাবই।
আমরা দু’জনেই খুব আগ্রহের সঙ্গে ধোঁয়া-ওঠা চায়ের গ্লাস হাতে তুলে নিলাম।
দাদু বললেন: কাজিরাঙ্গায় বাঘ দেখেছেন কি? শুনেছি ১৯৬৬ সনে কাজিরাঙ্গায় কুড়িটা মাত্র বাঘ ছিল, এখন ষাটটার মতো না-কি আছে... গণ্ডারও তিনশো’ থেকে দেড় হাজারের মতো হয়েছে, হাতিও পাঁচশো’র বেশি না কি হয়েছে...
আমি উৎসাহের সঙ্গে বললাম: আমরা একটা হাতির পাল দেখেছি। এদিকেও কখনও সখনও হাতি বেরোয় না-কি?
যানবাহনের শব্দের জন্যে এইদিকে হাতির দল আর বেরোয় না। আগে খেতে মাঠে নামা হাতিকে আমাদের জাল পেতে তাড়াতে হত... কিন্তু বাঘ বেরোয়। এই তো সেদিন একটি ঘটনা ঘটে গেল। ডিমৌগুড়ির মহন্তের হাতিটি রাস্তার পাশের পুকুরের পাড়ে বেঁধে রেখেছিল। খুব শান্ত হাতি। ডিফলুতে ধোয়ানোর জন্য নিলে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলাধুলা করত। দুপুরবেলা পুকুরের পাড়ে হাতিটি শুয়ে ছিল।
হঠাৎ কখন বাঘ এসে পাছা কামড়ে নিয়ে গেল আমরা টেরই পেলাম না। ‘ইস! ইস!’ আমরা আর্তনাদ করে উঠলাম। বুড়ো দাদু এবার হাতির গল্প বলতে আরম্ভ করলেন:
হাতি কিন্তু অন্তর্যামী জন্তু! শুনেছিলাম বেশ কয়েকটি মহাসমর না-কি হাতির জন্যই হয়েছিল... আমাদের লক্ষ্মী সিংহের দিনের মোয়ামারিয়া বিদ্রোহ না-কি একটি হাতির জন্যই হয়েছিল।
একটা হাতির জন্য?
হ্যাঁ, একটা রোগা হাতির জন্যই। পড়েন নি কি মা জননী? লক্ষ্মীনাথ সিংহের সময়ের কথা? বুড়ো বয়সে রাজ্যপাট পেয়েছিলেন ---কীর্তিনাথ বরবরুয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। আমাদের রাজাদের মধ্যে এই লক্ষ্মী সিংহ আর গৌরীকান্ত সিংহ দেখতে খুবই কদাকার ছিলেন। গৌরীকান্ত সিংহ আফিম খেয়ে চোখ মেলতে পারতেন না।
শুনুন, শুনুন।
হাতির গল্প...! বরবরুয়ার আবার মোয়ামারিয়া মহন্তের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল না! এই ঝগড়ার বীজ অবশ্য অন্য জায়গায় ছিল। ... বছরের শেষে হাতি পরিশোধ করতে হত, পর্বত মোয়ামারিয়া মহন্ত বরবরুয়াকে একটা ক্ষীণকায় হাতি উপহার দিলেন। হাতি দিতে গিয়েছিলেন নাহর খুড়া। বরবরুয়া ভয়ংকর ক্রোধে নাহরের কান দুটি কেটে ফেললেন।
... এই সময় বুড়ি দিদিমা আবার একবার ধমক দিয়ে উঠলেন---
কান-কাটা ছাড় এই বুড়ো... বাতিটি নিয়ে দেখে আয় কোথাও মিলিটারির গুলি খেয়ে পড়ে থাকে যদি...
বুড়ো দাদু সেইদিকে খুব একটা মন দিলেন না। বললেন:
এই অঘ্রান মাসে ন’হাজার মোয়ামোরিয়া সেনা রংপুর পর্যন্ত গিয়ে কীর্তি চন্দ্রকে শূলে চড়াল, এই সব কাহিনির গোড়াতেই সেই ক্ষীণকায় হাতিটিই তো ছিল?
আমি দাদুর কথা শুনতে শুনতে চা খাচ্ছিলাম। মাঝখানে ড্রাইভার রমাকান্ত এসে চটপট এক গ্লাস চা খেয়ে গেল। সঙ্গে বলেও গেল যে “ কাজ শেষ হতে খুব কম করে আরও ঘণ্টা দেড়েক লাগবে। রেডিয়েটারটি খুলে ওয়ার্কশপে নিয়ে চলে গেছে!”
বুড়ি দিদিমা বললেন:
আজ দু’জন মার খদ্দের এসেছে। মা জননী আরও এক গ্লাস করে চা যদি খান তা’হলে খুব ভালো হয়। চিনি, চা-পাতা তো আছেই!
আমরা দু’জনে খুব উৎসাহের সঙ্গে দিদিমাকে আরও এক গ্লাস করে চায়ের অর্ডার দিলাম।
দাদু ইতিমধ্যে দোতারার তার দুটি ঠিক করে নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বলেও গেলেন---
বন্যার কবল থেকে কোনওরকমে আমি এই দোতারাটি রক্ষা করেছি। এইরকম দোতারা বানানোর কারিগর এখানে আর নেই। এটি আমার খুব আদরের...
বুড়ি দিদিমা আবার মনে করিয়ে দিলেন ---খদ্দেরদের আমি যত্ন করে দেখছি। বাতিটি নিয়ে রেললাইনের দিকে গিয়ে দেখে এস... কিছু বলা যায় কি। কিছু বলা যায় কি!!
বুড়ো দাদু এবার ধমক দিয়ে উঠলেন।
চুপ কর বুড়ি! আমাকে খদ্দেরদের সঙ্গে কথা বলতে দেখলে তোর কলিজা পোড়ে, তাই না? সঙ্গের সবাই মরে, হেজে শেষ হয়ে গেছে। গল্পের সঙ্গী আর নেই...।
বুড়ি দিদিমা চাদরের আঁচল দিয়ে চোখ দু’টি মুছলেন। চায়ের ছাকনি আর সসপেন নিয়ে তিনি ধীরে ধীরে বাইরে চলে গেলেন। সম্ভবত পুরোনো সব চা-পাতা ফেলে দিয়ে তিনি একেবারে নতুন করে আবার চা করবেন।
এবার বুড়ো দাদু বেড়ার পেরেকে ঝুলিয়ে রাখা পুরোনো নোংরা গামছা দিয়ে দোতারাটি মুছতে আরম্ভ করলেন। তিনি আমাদের খুব কাছে বেড়ায় হেলান দিয়ে বসলেন। বললেন, “ইস! আমাদের রাজরাজড়াদের কত কাহিনি আমি জানতাম। জ্যোৎস্না রাতে লুইতকে কেমন দেখাত। জানেন তো মা জননী?”
কী রকম?
ইস! নদী নয় যেন বুড়ি দিদিমার একগোছা সাদা চুল উড়ছে। শুনছেন মা জননী?
এইবার গলা বাড়িয়ে কপাল কুঁচকিয়ে দাদু একটা বিচিত্র ভঙ্গী করে বললেন: আমার এই বুড়ি এখন এই রকম খিটখিটে হয়েছে। আগে এরকম ছিল না। ... গৌরীনাথ সিংহের সময়ের দশটা ‘বানবাটি’ (পুরোনো দিনের অভিজাত বাটি) ছিল। সেগুলি তেঁতুল দিয়ে ধুয়ে মুছে চকচকে করে রাখত, যাতে সন্ধেবেলা অতিথিরা এলে আপ্যায়ন করতে পারে...। ঊ: দিনকাল একেবারে অন্যরকম ছিল... একেবারে অন্যরকম ছিল।
গামছাখানি বুকের কাছে নিয়ে কিছু সময় দাদু কী একটা যন্ত্রণা রুদ্ধ করে রাখতে চাইলেন।
... এক মুহূর্ত মাত্র। তারপর হঠাৎ তিনি যে আবার উৎসাহিত হয়ে উঠলেন...
“শুনুন মা জননী! গৌরীনাথ সিংহের কাহিনি আমি যতটা জানতাম এই অঞ্চলের কেউ জানত না। ... আফিমের নেশায় রাজা চোখ মেলতে পারতেন না।” দাদু আবার মাথা বাড়িয়ে দিয়ে চোখ দু’টি ছোট ক’রে খুব কৌতূহলের সঙ্গে আমার দিকে তাকালেন, আর ফিস ফিস করে বললেন:
স্বভাবও খুব ভালো ছিল না। তাঁরা মাসির ঘরের সামনে অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকতেন। অপেক্ষার ধরন দেখেই সবাই বুঝতে পারত। ... তাছাড়া আমাদের ডিফলুর দিকের একজন মহিলাও ছিল। তাঁকে রাজার সোনার অলংকার পাঠানোর কাহিনি এই অঞ্চলে সকলের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল... বরাহি, চুতিয়া, কলিতা, কায়স্থের মেয়েও রাজকন্যা হয়েছিল, যদিও একে নিয়েছিলেন কি না জানতে পারিনি। এই তো সেদিনও সব কথা চটপট মনে পড়ত। আজকাল মনে থাকে না।
আমি প্রশ্ন করলাম ---
শুনেছিলাম একজন রাজা খুব আফিমখোর ছিলেন। আফিমের সঙ্গে মুগা-পোকা ভেজে খেতে ভালোবাসতেন... তাই না?
দাদু জোরের সঙ্গে হাসতে লাগলেন, শুনুন মা জননী আমার ইনি মহিষের সঙ্গে মাংস খেতে পারা গদাধরের মতো ছিলেন না। ... হঠাৎ যেন একটা ভূমিকা কষা হল।
হয়েছে হয়েছে, মোষের মাংসের কথা ছেড়ে রেললাইনের কাছে যা, রেল লাইনের... । বুড়ি দিদিমা আমাদের হাতে চায়ের গ্লাস তুলে দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন।
---আমি লক্ষ করলাম দাদু বুড়ি দিদিমার কথায় এইবারও খুব একটা মনোযোগ দিলেন না। তিনি তাড়াতাড়ি দোতারাটির দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি কাঁধে একটা গামছা নিয়ে ঘোরাফেরা করছিলেন। সেটি দিয়ে দোতারাটি মুছতে মুছতে বললেন:চোখেও ভালো করে দেখতে পাই না। বুড়ি তো বাতি নিয়ে গিয়ে দেখে আসতে বলে... সেদিনও রেললাইনের ধারে হঠাৎ পড়ে গেলাম। বুকে এখনও ব্যথা আছে... শুনছেন মা। আমার অবস্থা এইরকম ছিল না। বন্যায় খেয়ে খেয়ে এমন অবস্থা করেছে... আমার এ রকম অবস্থা হওয়ার কথা ছিল কি? সত্যি, আমার এই রকম পথে দাঁড়ানোর মতো অবস্থা হওয়ার কথা ছিল কি? খদ্দের আসবে আসবে বলে অপেক্ষা হওয়ার কথা ছিল কি? খদ্দের আসবে আসবে বলে অপেক্ষা করে থাকার মতো এই অবস্থা! দু’টো ভাঁড়ার ছিল। অচেনা পথিকও পুকুরের মাছ দিয়ে জহা চালের ভাত খেয়ে যেত। আমরা বরবরুয়া বংশের মানুষ। রাজার ছিল গুরুতর অপরাধীকে বাঁশের খাঁচায় পুরে জলে ফেলে প্রাণদণ্ড দেবার অধিকার। আমার পূর্বপুরুষ বরবরুয়াও অপরাধীকে হাঁটুর ঘিলা কেড়ে নেবার মতো শাস্তি দিতে পারতেন। তিনি আবার দয়ার সাগর ছিলেন। চিহ্নস্বরূপ তার রূপার ছাড়া এখনও আছে। দিনে বা সকালবেলা হলে দেখিয়ে আনতে পারতাম। কারুকার্যময় গালিচা , রূপোর গানের বাটা, সোনার মতো ভালো গুণমানের ধান হয় এমন বুকের মাংসের মতো জমি এসব এখন কিছুই নেই।
বুড়ি দিদিমা আবার রেগে উঠলেন।
হয়েছে হয়েছে মরা-পোঁতার গর্তগুলো কেন খুঁড়ছ। একবার রেললাইনের পাশে গিয়ে দেখে এস।
দাদু আবার চিৎকার করে উঠল...।
চুপ থাক। চুপ থাক বুড়ি। আগেও দু’তিনবার এরকম উড়ো খবর শুনিসনি? আমাদের চায়ের দোকানে আজ গণ্যমান্য মানুষ এসেছেন। দাদু এবার বেপরোয়া হয়ে দোতারা বাজাতে শুরু করলেন। কুপির আলোয় এইবার দাদুর মুখখানা একেবারে স্পষ্ট হয়ে পড়ল। দাদুর নাকটি লম্বা। ভেতরের দাঁতগুলি পড়ে যাওয়ায় গাল তোবড়ানো। চোখের নীচে মাকড়সার জালের মতো যাওয়ায় গাল তোবড়ানো। চোখের নীচে মাকড়সার জালের মতো অজস্র রেখা। তার রং অত্যন্ত কালো, তাই শুধু কুপির আলোয় এই রেখাগুলি স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল। কপালের বলিরেখাগুলি কীসের সংকেত দিচ্ছে? চিন্তা, জিজ্ঞাসা , দুঃখ আর? আর?
অত্যন্ত সুললিত সুরে দাদু পদ্মাপ্রিয়ার গীত গাইতে আরম্ভ করলেন---
“পুত্র পতিধন সকলই অকারণ
যেন জলবিম্ব হাসে।
এই আছে নেই সব হবে ছাই
সব কিছু কালগ্রাসে।
জীবন যৌবন সব অকারণ
যেন স্বপনের নিধি। ...
শুধু পদ্মপ্রিয়াই না-কি? গোপাল দত্ত শ্রী শঙ্কর রাজা প্রভুরও গীত দাদু আমাকে গেয়ে শোনাতে আরম্ভ করলেন। আমাদের হাতে সময় বড় কম। কিন্তু দাদু আমাদের ছাড়ছেন কই? বললেন, এরকম খদ্দের আমি কোথায় পাব? মনের আনন্দে তিনি গীত গাইবেন।
---আমরা প্রায় একঘণ্টা ধরে দাদুর সুললিত সুরের গীত শুনলাম। দিদিমার উশখুশ ভাবের জন্য আমাদের রস আস্বাদনে বাধা পড়ল । ... এবারে দিদিমা যেন রণচণ্ডী মূর্তি ধরে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন:
তাকে রেললাইনের কাছে দেখেছে বলে কিছু মানুষ বলে গেল...। বুড়োর কানে ঢোকে না। মিলিটারিরা গুলি মেরে তার প্রাণ নিলেও বুড়োর বুক ভেঙে যাবে না...
আমরা হঠাৎ দাঁড়ালাম। বললাম, আমাদের গাড়ি ভালো হবার সময় হয়েছে। এখন আমরা গাড়িতে গিয়েই বসি। দাদুর গান শুনে আমরা যেন স্বর্গরাজ্যেই ছিলাম। জ্যোৎস্না পোশাক যেন শরীরে পরেছিলাম।
কেউ যেন ফুলের হাতা দিয়ে আমাদের মুখে একফোঁটা দু-ফোঁটা করে মধু ঢালছিল। শেফালি ফুলের নীচে পরিষ্কার করে রাখা আসনে যেন আমরা বসেছিলাম। মীরাজকার সাহেব এইবারে কোটের পকেট থেকে বেশ কিছু নোট বের করে দাদুর সামনে রাখলেন। দাদু খুব জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন।
এই নির্মালির মা, চায়ের পয়সা হিসেব করে রাখ। বাকি টাকা সাহেবদের ফিরিয়ে দে। অতটাকা কেন দিয়েছেন বাবা?... আমরা টোকো পাতার ঝাঁপি দিয়ে ফেরা বরবরুয়া বংশের মানুষ... এই সঙ্গীত। এই সঙ্গীত। গুরুজনদের আত্মার প্রতিধ্বনি এই সঙ্গীতের জন্যে কেউ আমাকে টাকা দিলে আমি হৃদয়ে বড় কষ্ট পাব... এইসব কথা কেউ বোঝে না...। আজকাল কেউই বোঝে না।
বুড়ি দিদিমা টাকাগুলির দিকে টো টো করে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি কোনও প্রশ্ন করছিলেন না, টাকাগুলি গুনেও দেখছিলেন না। ... ঠিক এই সময়ে একজন যুবতী মেয়ে ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে এসে দরজায় হাত রেখে ভিতরের দিকে উঁকি দিয়ে দেখল। বুড়ো বুড়ি দু’জনেই চেঁচিয়ে উঠল...
এই হতশ্রী এখানে কেন এসেছিস!
এ কোনও উচ্চবাচ্য করল না। আমাদের সামনে দিয়ে পার হয়ে গিয়েও পেছনের বাসন ধোয়ার জায়গায় ফেলে রাখা একটি কাঠের টুলে গিয়ে বসল। আমরা বুঝতে পারলাম যে ও-ই ভারতীয় সেনাটির সঙ্গে প্রেমের লেনদেন করে পরিবারটির মুখ-কালো-করা নির্মালি।
... এই মুহূর্তটুকু বুড়ো দাদু ও বুড়ি দিদিমা নিজেদের কাজে মন দিল। বুড়ি দিদিমার দৃষ্টি আবার টাকাগুলির উপর পড়ল। এত টাকা সম্ভবত বহুদিন তারা দেখেনি।
ঠিক এই সময় হঠাৎ যেন একটি বিস্ফোরণ-ই হল। আমরা চারটে মানুষ কিছুদূর গিয়ে যেন ছিটকে পড়লাম। পাশের গাছ-গাছালির ঝাড় থেকে ঝাঁপ দিয়ে এসে কী করে যেন একটা জবড়জং পুরুষমূর্তি আমার কাছে দাঁড়াল। আমি বুঝতেই পারলাম না। কেরোসিনের বাতির আলোয় আমি তাকে স্পষ্টভাবে দেখলাম। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। ... তরুণ যুবক, ঠোঁট ও চোখের এক অংশ বন্দুকের ধারালো অস্ত্রের আঘাত লেগে এক ভয়ংকর জখম। ভুরুর নীচ থেকে চোখের কিনারা পর্যন্ত এক টুকরো মাংস ছিঁড়ে যাওয়ার ফলে মুখটি এত বেশি ভয়ংকর ও কুৎসিত হয়ে যে আমি দিদিমার হাতটি খামচা মেরে ধরলাম। পরে এসেছে একটা বিবর্ণ কালো জিনস। ঠিক এই রকম বিবর্ণ একটা খাকি জ্যাকেট। মাথার লম্বা কালো চুল এলোমেলো। থুতনির নীচে দীঘল দাড়ি। হাতে ওটা? ওটা রিভলভার... কেরোসিনের বাতির আলোয় ঝিকমিক করছে ওটির ব্যারেল?
হঠাৎ ছেলেটি বেড়ার কাছে এসে নির্মালিকে দেখল। সে ছুটে গিয়ে তার পেটে একটি লাঠির খোঁচা দিয়ে চিৎকার করে উঠল।
“শালী বেশ্যা! ছেলেগুলি কুপিয়ে তোর পা ভাঙেনি তাহলে... সেনাটিকেও না-কি দু’টুকরো ক’রে কাটতে পারেনি... ফু!” সে থুথু ফেলল। দিদিমা অনুনয় বিনয় করে তার হাত ধরে টানাটানি করে ভিতরে নিয়ে আসার চেষ্টা ক’রে কাঁদতে লাগলেন।
ও আমার আদরের বাবা! ও আমার আদরের বাবা! আমি তোর বাবার কাছে কাকুতিমিনতি করেছি বাতিটি নিয়ে গিয়ে তোকে রেললাইন থেকে নিয়ে আসুক... ডিফলু থেকে আসা দু’জন মানুষ তোর দেখা পেয়েছে বলে আমাকে বলে গেছে--- ও আমার আদরের বাবা...
দিদিমা এইবার চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। ছেলেটি কিন্তু এইদিকে বেশি ভ্রুক্ষেপ করল না। সে কিছু সময় বাতির আলোয় উজ্জ্বল হয়ে থাকা টাকটা নোটগুলির দিকে কৌতূহলের দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল। তার দৃষ্টি শিকারের আশায় উড়ে উড়ে বেড়ানো শ্যেন পাখির দৃষ্টিতে রূপান্তরিত হল। সে ছুটে গিয়ে নোটগুলির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল:
দিদিমা চিৎকার করে উঠলেন---
এগুলি অতিথিদের পয়সা বাবা, ফিরিয়ে দে , ফিরিয়ে দে...
জবড়জং ছেলেটি এ কথায় ভ্রুক্ষেপ করল না। সে বকবক করতে লাগল---চোরা শিকারিরা দুটো ইউ.এস. কারবাইন বিক্রি করবে। আমার কাছে মাত্র কুড়ি টাকা কম আছে। টাকার দরকার, টাকার দরকার...।
সে যেমন ঝড়ের মতো এসেছিল ঠিক তেমনই অন্ধকারের বুকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
দাদুর মুখে একটা হাসির ঝিলিক দেখা গল। মানুষের হাসি যে এমন হৃদয়-বিদারক হতে পারে এই কথা আমি আগে জানতাম না।
গুয়াহাটি পর্যন্ত ফিরে আসার বাকি পথটুকু মীরাজকার আমাকে আর কোনও প্রশ্ন করেন নি। অন্ধকারের বুকে আমাদের গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন