“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

ভদরি


 


মূল অসমিয়া : লক্ষ্মীনাথবেজবরুয়া

বাংলা অনুবাদ: অমিতাভ চৌধুরী

 (সামান্য সংশোধিত রূপ)

(সৌ) লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া

কই গো! ভাত নিয়ে এসো---শুনছ? বলছি ভাত নিয়ে এসো।এই বলে লাঙল আর ভেজা গামছা বদল করে শিশুরাম রান্নাঘরে উঁকি মেরে দেখতে পেল ভাত ফুটেছে মাত্র। শাকসবজির অবস্থা ততোধিক শোচনীয়। ঢেঁকিশাকের মুঠোটি এক খোলামেলা বাটিতে বেছে আধোয়া রাখা আছে, কলা পাতার একটুকরোতে ময়দা মেখে রাখা আছে যেন ময়ুর পাখি   কাত হয়ে শুয়ে আছে। কাদামাখা কই-মাছগুলোর যেন নেশা ধরেছে, ছাইভস্ম মাখা ফকিরের মতো মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। ওদিকে মাটির মালসার নীচে উনুনে ভেজা কাঠ গুঁজে দিয়ে ভদরি বাঁশের চুঙ্গিতে ফুঁ দিয়ে চলেছে; কিন্তু ভেজা কাঠ শোঁ শোঁ শব্দে গোঙাচ্ছে। অনেকগুলো কারণেই সেই সকাল থেকে শিশুরামের রাগ মাথায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে; ভর দুপুরে হাল বেয়ে ঘরে ফিরে ভাত না পাওয়ার জ্বলন্ত আগুনে ঘি পড়ল। প্রথম কারণ, গতকাল নিষ্ঠুর কৃষ্ণা একাদশীর জন্যে উপবাস, আর তা থেকে হালের ক্ষতি। দ্বিতীয়ত, একাদশী পালন করা মানুষের মতোই হালের গরুগুলোর কর্মবিমুখতা সেই ভোরবেলা থেকেই শিশুকে বিরক্ত করছিল। আসলে মাঠের সব কথা ভেঙে বললে গরুর গায়েও কাজে গাফিলতির, যেমন হাল-কাঁধে মাঠে শুয়ে পড়ার দায় বর্তায়। উপরন্তু মালিকের ঘাড়েও হিন্দুর পূজনীয় গরুর প্রতি অহিন্দু আচরণ করার মতো গর্হিত অপরাধ চেপে বসতে পারে। যে যা বলুক, পেছনে কথা বলার অভ্যাস আমাদের নেই। পেছনে কথা বলে একাদশী পালন করে পেটে-পিঠে এক হওয়া শিশুরামকে আর অভুক্ত রাখার ইচ্ছা নেই। তা ছাড়া হালের গরুর প্রতি শিশুরামের বদ্ধমূল ভালো ধারণাটিকে ঘষেমেজে নষ্ট করার কোনো অভিপ্রায়ও আমাদের নেই। তৃতীয় কারণটি এখানে বলে রাখা ভালোতা না হলে ভদরি-শিশুরাম উপাখ্যান অসম্পূর্ণ হয়ে থাকবে। যেমন সীমা বাড়ানোর জন্য বাঁশের বেড়া দেওয়ার ব্যাপারে ভোরবেলাতেই জমিতে শিশুরামের অল্পবিস্তর বাকবিতণ্ডা চলছিল। কথা কাটাকাটি তপ্ত ঘিয়ে লুচির মতো ফুলে উঠছিল। বেগতিক দেখে খোঁটা বসিয়েই ফোলা লুচি ফুটো করে  পালিয়ে গেল বলে ঝগড়াটা শুধু কথা কাটাকাটিতেই সীমাবদ্ধ হয়ে রইল। এ সংসারে প্রচলিত নিয়ম আছে যে পুরুষমানুষেরা বাড়ির বাইরে ক্ষোভের সঠিক প্রকাশ করতে না পারলে ঘরে ফিরে রং চড়িয়ে স্ত্রীর ওপর ঝাল মেটায়। শিশুরামও ব্যতিক্রম নয়। এর আগেও জমিনে খুঁটি বসানো নিয়ে ঝগড়ায় সুবিধা করতে না পেরে বাড়ি ফিরে প্রদীপ না জ্বালানোর অজুহাতে বেচারি ভদরিকে প্রহার করার খবর কারও অজানা নয়।

স্বামীর এমন অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ ভদরি বুঝতে পারে বলেই সহনশীল বসুধার মতন সকল অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে নেয়। প্রকৃতপক্ষে ভদরির বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল যে গালিগালাজ, মারপিট, অশান্তি---এগুলো বিবাহিত জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু সব কিছুরই এক সীমা আছে, থাকা দরকার; মারধোর তো আর ঈশ্বরের মতো অসীম কিছু নয়। অতি সহনশীলা বসুন্ধরাও কখনও কখনও কেঁপে ওঠেন। সে ক্ষেত্রে আমাদের ছোট্ট ভদরি, ধৈর্যশীলা ভদরির রক্তমাংসের শরীরও কখনও-বা অসহ্য হলে ভয় পেয়ে দু-একবার চিৎকার করে ওঠা এমন আর কী বড় কথা? কাঁচা কাঠে ফুঁ দিতে দিয়ে চোখের জল আর নাকের জল একাকার করা ভদরি দুর্ভাগ্যবশত আজও এক সংযত এবং অনুচিত চিৎকার করে উঠল।

শিশুরাম---ওই অমুকের বেটি, তিন প্রহর তো গেল ভাত হল না কেন?

অমিতাভ চৌধুরীর অনুবাদের মূল রূপ

ভদরি---আমার মাথা দিয়ে রাঁধব নাকি? এক টুকরো খড়িও নেই। কাঁচা খড়ি ফুঁ দিতে দিতে হয়রানির আর শেষ নেই। না-বুঝে, না দেখে গজগজ করলেই হবে নাকি?

কী বললি বেটি?” –এই বলে শিশুরাম মেঝেতে পড়ে থাকা কইমাছের রক্ত পিপাসার্ত ধারালো দা-খানা দিয়ে ভদরির পিঠে পরপর দুই কোপ মারল। তৃতীয় কোপ বসানোর আগমুহূর্তে ভদরির চিৎকার শুনে শিশুরামের সম্পর্কিত ভাই কিনারাম দৌড়ে এসে পিছন থেকে কী করছ দাদা?”—এই বলে শিশুরামের হাত থেকে রক্তে ভেজা দাটি  ছিনিয়ে নিল। রক্তাক্ত ভদরি মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে রইল।

 

 

দ্বিতীয় অধ্যায়

হাসপাতালে তিনদিন পর ভদরির সংজ্ঞা ফিরল। চোখ খুলে প্রথমেই পাশে ডেরেছিকে  জিজ্ঞাসা করল, “উনি কোথায়?”

অমিতাভ চৌধুরীর অনুবাদের মূল রূপ

            ডেরেছি--- উনি কৌন?

ভদরি--- (একটু অপ্রস্তুত হয়ে) আমার উনি। আমার স্বামী।

ডেরেছিও আদমি হাজত ম্যা আছে।

ভদরি---উনাকে ডেকে দাও।


         ডেরেছি---ক্যা
, ডেকে আনবে; ও আদমি আভি আসব না পারবে। উসকো তো হাজত ম্যা দিছে। তুমি থামো আভি। তোমহারা আদমি কা বাত আভি তুমি না ভাবিবে। ওই বাত আভি ভাবিলে আমি জানিছে তোমার বেমার বহুত বেছি হবে।

    হাসপাতাল ডেরেছির কথা শুনে ভদরি আবার অজ্ঞান হয়ে পড়ল। এমন সময় ডাক্তার এসে পড়লেন। কম্পাউণ্ডারের মুখে সব শুনে ডাক্তার বুঝলেন যে শিশুরামকে হাজত থেকে ছুটিয়ে না আনতে পারলে রোগীর অবস্থার উন্নতি হবে না। তাই দেরি না-করে অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিলেন।

 

 

তৃতীয় অধ্যায়

চেতনা ফিরলে পর ভদরি চোখ খুলে দেখতে পেল তার শয্যার পাশে দুজন লাল পাগড়িওয়ালা কনস্টেবলের মাঝখানে শিশুরাম দাঁড়িয়ে আছে। কাছেই ডাক্তারবাবু।

ভদরি---(শিশুরামের দিকে তাকিয়ে) তোমার শরীর কেমন? ভাত খেয়েছ? নিশ্চয় তোমার খাওয়াদাওয়ার খুব কষ্ট হচ্ছে।

উত্তরে শিশুরামের দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।

ভদরি--- (ডাক্তারের দিকে জোড় হাত করে) ধর্মাবতার! ওঁর কোনো দোষ নেই। ওঁকে ছেড়ে দিন। দাসীর কাতর নিবেদন, আমার স্বামীকে ছেড়ে দিন। আসলে মাছ কাটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে দায়ের উপর পড়ে গিয়ে এই দাসীর শরীর জখম হয়েছে।


ভদরির সকরুণ আকুতি শুনে ডাক্তার , ডেরেছি, কনস্টেবল সবাই অবাক শিশুরামও আর থাকতে না-পেরে কান্নায় ভেঙে পড়ল, “ না হুজুর আমি-ই ওকে দা দিয়ে কুপিয়েছি। আমায় ফাঁসি দিন। ধর্মাবতার, আমি মহাপাপী; আমি একজন মহিলার গায়ে অস্ত্রাঘাত করেছি!

 




***

কিছুদিন পর ভদরি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠল। কিন্তু স্বামীকে আইনের মারপ্যাঁচ থেকে ছুটিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করেও তিনমাসের হাজতবাস আটকাতে পারল না। শিশুরাম হাসতে হাসতে আদালতের বিচার মেনে নিয়ে জেল হাজতে ঢুকল আর কাঁদতে কাঁদতে ভদরি ফিরল নিজের বাড়ি। এখানেই আমাদের এই সংক্ষিপ্ত কাহিনি শেষ হল।

 

 

 

 

 

কোন মন্তব্য নেই: